“আমরা” গোষ্ঠীর ভূমিকার উপর লিখিত প্রতিবেদন

<৪,১৯৭,৪০৮-৪১৩>

অনুবাদকঃ ফাহমিদা আক্তার বৃষ্টি

     শিরোনাম        সূত্র       তারিখ
১৯৭। “আমরা” গোষ্ঠীর ভূমিকার উপর লিখিত প্রতিবেদন        “আমরা” ২২ নভেম্বর, ১৯৭১

                        গোপন

                                                                                                                                                            “আমরা”

                                                           জাকার্তা

                                                        নভেম্বর ২২, ১৯৭১

 

 

 

                  ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশ আন্দোলনের মূল্যায়ন

  সবচেয়ে বড় মুসলিম রাজ্য হিসেবে, ইন্দোনেশিয়াতে পাকিস্তান এক সম্মান উপভোগ করেছিলো। এটি গত দশক থেকে তার দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের  জন্যও (পশ্চিম পাকিস্তানে) এক সুনাম পেয়েছিলো। পাকিস্তান বিষয়াবলী সবসময়ই ইন্দোনেশিয়ান জনগণকে আগ্রহী করেছে। আইয়ুব খানের পতন, ইয়াহিখানের ক্ষমতা গ্রহণ, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের অসাধারণ বিজয় এবং তারপর থেকে বিভিন্ন ঘটনাবলী বিভিন্ন জনস্তরের লোকদের মাধ্যমে খুব কাছ থেকে পরিলক্ষিত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সামরিক শাসকগণ এটা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে যায় যে পাকিস্তানে সামরিক শাসন ব্যবস্থা টিকেছে এবং একটি অবিচ্ছিন্ন পাকিস্তানকে শাসন করে চলেছে। মুসলিম নেতাগণ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া চেয়েছিলেন যেন পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অখণ্ডতা মেনে চলা হয়, যেখানে আশা করা হয় যেন বর্তমান সমস্যাও আপোসে মীমাংসিত হয়। সুমাত্রান নেতাগণ, যেহেতু তাদের দ্বীপ রাষ্ট্রের কাছ থেকে নেওয়ার চেয়ে বেশি দেয় বলে কিছুটা বঞ্চিত এবং হতাশ বোধ করে, তাদের নিকট বাঙালি স্বাধিকার আন্দোলনে এক মৌন সমর্থন আছে। বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং সংবাদ মাধ্যমগুলো পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে। সংবাদ মাধ্যম, রেডিও এবং টেলিভিশনগুলো বাংলাদেশে দুঃখদায়ক ঘটনার ব্যাপক প্রচারণা দিয়ে যাচ্ছে। ফলাফলস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ান জনগণ, হোক তারা বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তাবৃন্দ, ব্যবসায়ী অথবা রিকশাচালুক, গৃহ পরিচারক বা পরিচারিকা অথবা রাস্টার সাধারণ লোকজন, তারা পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর নৃশংসতা ও বর্বরতা এবং সামরিক শাসনতন্ত্রের অনুসৃত দমননীতি সম্পর্কে জানতে পারে। এখন ইন্দোনেশিয়ান জনগণ সাধারণভাবেই পাকিস্তানিদের ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঘৃণা করে এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য দুঃখ করে।

   ২) ইন্দোনেশিয়ান ছাপাখানাগুলো বাংলাদেশকে ইন্দোনেশিয়াতে অভিক্ষিপ্ত করতে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, যখন পূর্ব পাকিস্তানে এক নির্মম ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিলো, পাকিস্তান সম্পূর্ণ সুস্পষ্টরূপে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়ে আসছিলো। নির্বাচন, আওয়ামী লীগের জয়, পরিষদের বৈঠক স্থগিতকরণ, অসহযোগ আন্দোলন, বিশ্বাসঘাতকতার কথা, সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ, ঔদ্ধত্য, স্বাধীনতার ঘোষণা ইত্যাদি ভালো জায়গা পেয়েছিলো। রেডিও এবং টেলিভিশনও একই ধরনের প্রচারণা দিচ্ছিলো। অধিকাংশ পত্রিকাগুলোই সন্তোষজনক সম্পাদকীয় লিখেছে। তারা সেনাবাহিনীর কার্যকলাপের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন করেছে, দমনের সমালোচনা করেছে এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সহানুভূতি দেখিয়েছে। বাংলাদেশ পরিস্থিতির উপর সংবাদ, প্রবন্ধ, সম্পাদকীয়সমূহের মন্তব্য নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছিলো। যদিও সহানুভূতিশীল ছিলো, ছাপাখানাগুলো সরাসরি বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থন দেয়নি। এটা হতে পারে সরকারের অন্যের ব্যাপারে নাক না গলানোর নীতি এবং সর্বত্র জনপ্রিয় আবেগের কারণে যে এটা খুবই দুঃখজনক হবে যদি শ্রেষ্ঠ মুসলিম রাজ্য দুই ভাগ হয়ে যায়। যাইহোক, সংবাদগুলো এই মতবাদের উপর জোর দেয় যে সামরিক শাসনতন্ত্রের উচিৎ সমস্যাটির একটি রাজনৈতিক সমাধান অনুসন্ধান করা। ইন্দোনেশিয়ান অবজার্ভার এবং জাকার্তা টাইমসের মতো কিছু পত্রিকা পূর্ব পাকিস্তানে দমন নীতি চালিয়ে যাওয়ার ফলাফল সম্পর্কে সতর্ক করেছে।

    সংবাদপত্রগুলোর একটি প্রবণতা হলো অবিরত ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি জরিপ করা। পাকিস্তান তথ্য সেবার প্রকাশ সংবাদ মাধ্যমগুলোর দ্বারা সাধারণভাবে অধিগত হয়নি। পাকিস্তান দূতাবাস এবং স্থানীয় পাকিস্তানি গোষ্ঠী কিছু পত্রিকাকে তাদের প্রবন্ধ বা চিঠি প্রকাশ করতে মোটা পরিমাণের টাকা দিতে হয়। ইন্দোনেশিয়ান অবজার্ভার এক মাস পূর্বেই জাকার্তা ভ্রমণ করে যাওয়া আজিজ বেগের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করতে প্রত্যাখান করে। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো পাকিস্তান বিরোধী নয়, কিন্তু সামরিক শাসনতন্ত্রের নীতির প্রতি এটির প্রতিক্রিয়া অবশ্যই অসন্তোষজনক এবং বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণের প্রতি এর মনোভাব সহানুভূতিপূর্ণ।

   ৩) মোটের উপর, ইন্দোনেশিয়ার জনগণ বুঝতে পেরেছে যে অধিকাংশ পাকিস্তানি জনগণ পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত গণহত্যার জন্য অপরাধবোধ করে। ১৯৬৫ সালের বড় বিয়োগান্তক অভিজ্ঞতা থেকে, তারা যে কোন হত্যাকাণ্ডের খবরেই কেঁপে উঠে। জনগণ এখন জানে যে পূর্ব পাকিস্তানিরা সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষিত হয়ে আসছে।কিন্তু এদের অনেকেই এই উদ্ভট রাজ্যের বিশেষত্ব নিয়ে এবং দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের কারণ নিয়ে সচেতন নয়। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের নামও দ্বিধার সৃষ্টি করে। তারা প্রায়ই ভাবে যে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার সমস্যা অনেকটাই সুমাত্রা এবং জাভার মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার মতোই। কিন্তু যদি ব্যাখ্যা করা হয়, তারা পাকিস্তানের অযৌক্তিকতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে পারে। ব্যক্তিগত আলোচনায়, জ্ঞান জনগণকে বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে মূল্যায়ন করতে এবং সমর্থন করতে সক্ষম করে। কিন্তু সামরিক আধিপত্য বিস্তৃত চুপ থাকার সরকারি নীতির কারণে তারা জনসম্মুখে কোনকিছু বলতে কুণ্ঠাবোধ করে। তবুও, দুই মুসলিম নেতা ড. রোয়েম এবং ড. আবু হানিফাহ, যারা নয়া দিল্লীতে বাংলাদেশ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলো, পাকিস্তানের দুই ভাগের মধ্যে সমস্যা এবং বৈষম্য নিয়ে কথা বলার এবং লেখার সাহস দেখিয়েছিলো। যাইহোক, এটা মনে হয় যে লোকজনের নিকট ড. আবু হানিফাহের দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে ড. রোয়েমের দৃষ্টিভঙ্গি বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছিলো, যেহেতু ড. রোয়েম পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই একটা সমাধানের ইঙ্গিত দেওয়ার ব্যাপারে নজর দিয়েছিলেন।

  ৪) ইন্দোনেশিয়ান সরকার প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থনে খুবই প্রগলভ ছিলো যে পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আদম মালিক বেশ কয়েকবার এই ঘোষণা দিইয়েছিলেন। ইন্দোনেশিয়ান সরকার জনশ্রুতি দিয়ে সংবাদপত্রগুলোর উপর চাপ প্রয়োগ করে যেন এমন কিছু প্রকাশ না করে যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কর্তৃপক্ষ কয়েকজন ছাত্র নেতাকে হেফাজতে নেয় যারা পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে পূর্ব পাকিস্তানে হত্যার বিরুদ্ধে প্রদর্শন করেছিলো। ইন্দোনেশিয়ান সরকার সম্পর্কেও ধারণা করা হয় যে পাকিস্তান সরকারের সামনে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়, সে সম্পর্কে কিছু নির্দিষ্ট পরামর্শ উপস্থাপন করে। কিন্তু ধীরে ধীরে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে থেকে, বাংলাদেশের পক্ষে নয়, পাকিস্তানি জেনারেলদের নীতির বিরুদ্ধে। এটি পাকিস্তান সরকার এবং দূতাবাসের কাছ থেকে পাওয়া অযৌক্তিক অনুরোধের প্রতি অনিচ্ছা বা উদাসীনতা দেখায়। অনেক তদবিরের পরেও, পাকিস্তান দূতাবাস জয় প্রকাশ নারায়ণের জাকার্তা ভ্রমণের জন্য পদাঙ্ক নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, যেন ড. রোয়েম এবং ড. হানিফাহকে নয়া দিল্লীতে বাংলাদেশ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা থেকে থামানো যায় যাতে এই দুই পণ্ডিত বাংলাদেশ সম্পর্কে এবং জোরপূর্বক উচ্ছেদকৃত ইন্দোনেশিয়ান সুফিদের সম্পর্কে কোনকিছু বলতে বা লিখতে না পারে। সরকারটি পাকিস্তান থেকে আগত দর্শনার্থীদের দিকে তেমন মনোযোগ দেয়নি। এটি সংবাদপত্রগুলোর সাথে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোন সংবাদ বা মতামত তুলে ধরার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। কিছু সময় পূর্বে সরকারি টিভিতে দেখা গিয়েছিলো, একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর করা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন আমাদের  বৈদেশিক মন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমেদ। এটা মনে হলো যে সরকার ধীরে ধীরে সমস্যাটি এবং সত্যটি বুঝতে পারছে। এটি সম্ভবত বাংলাদেশের পক্ষে কোন উন্মুক্ত প্রচারণার অনুমতি দেয়নি, যেহেতু তারা এখনও পাকিস্তানকে অবিভক্ত দেখতে চেয়েছিলো।

   ৫) জাকার্তায় অবস্তানরত বিদেশি কূটনীতিকগণ এবং বিদেশি সংবাদদাতাগণের বাংলাদেশের বাস্তবতা নিয়ে কোন সন্দেহ ছিলো নাই।তারা বিশ্বাস করে যে আগের পাকিস্তান মৃত এবং এটি সময়ের প্রশ্ন যে কখন স্বাধীন বাংলাদেশ স্বীকৃতি পাবে। তারা আরো ভাবে যে বিষয়টি আন্তর্জাতিক করতে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করবেীবং বাংলাদেশ সঙ্কট বিষয়ে মুখ বাচাবে। প্রায় পনের দিন আগে কিছু সংবাদদাতা বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের উদ্দেশ্যে জাকার্তা ত্যাগ করে উপমহাদেশের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিবেদন করতে।

  ৬) পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ বিশ্বাস করে যে ইন্দোনেশিয়া এখনও তাদের পাশেই আছে। এই বড় মুসলিম রাজ্যের চলমান সমর্থন পেতে, তারা যা কিছু সম্ভব করে যাচ্ছে। পাকিস্তান দূতাবাস এবং স্থানীয় পাকিস্তানি সম্প্রদায় ( যা বাস্তবিকই বড় এবং সম্পদশালী) সংবাদপত্রগুলোকে তাদের মতবাদ প্রচার করতে প্রলুব্ধ করার জন্য বিশাল অংকের টাকা খরচ করছে ।তারা মাঝেমধ্যে তাদের চিঠি বা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে একটি বা দুটি পত্রিকা কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণির কিছু সাংবাদিককে কিনতে সক্ষম হয়েছে। তারা প্রায় সময়েই বাংলাদেশের পক্ষে বা পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রকাশনা বন্ধ করতে আংশিকভাবে সফল হয়েছে। কিন্তু মোটের উপর তাদের প্রচেষ্টা অকার্যকর হয়েছে। সংবাদপত্রগুলো কদাচিৎ পাকিস্তান দূতাবাসের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বহন করে। পাকিস্তান দূতাবাস তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিতে এখানে সাংবাদিক, বিজ্ঞজন, কর্মকর্তাবৃন্দ এবং শিল্পপতিদের পাঠাচ্ছিলেন। আজিজ বেগ, ড. আই. এইচ. কুরেশি, আমির আলী ফ্যান্সি এবং এয়ার ভাইস মার্শাল ইউসুফ সম্প্রতি জাকার্তা ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু তারা কোনভাবেই তাদের উপস্থিতি অনুধাবন করাতে কোন অংশেই সফল হয়নি। যদিও জনসম্মুখে তারা তাদের প্রভুরা যেমনটা শিখিয়েছে তেমনটাই বলেছিলো, কিন্তু ব্যক্তিগত আলোচনায় তারা তাদের আতঙ্ক এবং হতাশা গোপন করেনি। ড. কুরেশি বলেছিলেন সেনাধ্যক্ষরা কোন রাজনীতিবিদ ছিলেন না এবং তারা কোন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম। তিনি যোগ করেন, যদি কোন রাজনৈতিক সরকার থাকতো তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। তিনি আরো স্বীকার করেন যে, এল.এফ.ও এবং সরকারি বিবৃতি ছিলো এক সাঙ্ঘাতিক ভুল। মিসেস ইউসুফ, যিনি তার স্বামীর সাথে এসেছিলেন, উল্লেখ করেন, তারা তাদের সন্তানদেরকে রাজ্যের সার্থক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শান্তি চেয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন কামানের শিকার না করতে। আজিজ বেগ বলেন, ভারতের সাথে যুদ্ধ অপরিহার্য ছিলো, যেহেতু তারা চলমান হয়রানিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমির আলী ফ্যান্সি ভুট্টো এবং সরকারের সমালোচনা করেন। লাহোরের একজন সাংবাদিক, খালিদ হাসান, যিনি ভিসা ছাড়াই পৌছেছিলেন, বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার অনুমতি পাননি এবং ঠিক তার পরের  লভ্য বিমানে করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। মিয়া জিয়াউদ্দিন, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, বৈদেশিক অফিসের পরিচালক এ. ডব্লিউ. শামসুল আলমের সাথে পূর্বনির্ধারিত ৬ ডিসেম্বরে পৌছান। মিয়া জিয়াউদ্দিন ছিলেন ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত এবং রাষ্ট্রপতি সুহার্তোর জন্য ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারিদের পাকিস্তান ভ্রমণের জন্য আমন্ত্রণেরও প্রসার করে যাচ্ছেন। কিন্তু তবুও এপাশ থেকে খুব কম সাড়া পাওয়া যায়। অনেক প্রচেষ্টার পরে তারা শ্রী সুলতান হামেঙ্কু বুয়েনোকে তেহরান থেকে নয়া দিল্লী ভ্রমণের পথে পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলো। তাদের আমন্ত্রণে রেডিও এবং টিভির তিনজন কর্মকর্তা নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এবং তার দালালগণ তবুও বাংলাদেশের উদ্দেশ্য এবং আন্দোলনকে দমন করতে এখানে তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা অবিরতভাবে এবং সহিংসভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।

   ৭) আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক জনগণের উপর নৃশংস সেনাক্রিয়ার পর, আমাদের নেতাদের স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণার সংবাদ কিছু বাঙালি হৃদয়কে প্রজ্জ্বলিত করে, যারা সম্ভাব্য উপায়ে বিদ্যমান অবস্থায় এবং সীমিত সম্পদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাতির স্বার্থে কাজ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। “আমরা” নামে একটি গুপ্ত কমিটি অপারেশন সংগঠিত করতে ও প্রচেষ্টা সমন্বয় করতে “কামাল” এর সাথে প্রধান সমন্বয়সাধক হিসেবে এবং রাম্প ও সাফটকে সদস্য হিসেবে নিয়ে গঠিত হয়। প্রথম পদক্ষেপ ছিলো স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের আসল সমস্যাগুলো অবগত করানো যেমন, পাকিস্তানের পটভূমি, পূর্ব বাঙলার অবদান, বাঙালিদের অবস্থান, পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষণ, গণতন্ত্রের দাবি, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং তার পরের ঘটনাসমূহ এবং সম্ভাব্য সমাধান যা বাঙালিদের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে। “পাকিস্তান-এর জন্ম এবং মৃত্যু” শিরোনামে একটি বর্ণনাত্মক কাগজ “কামাল” এর মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয় এবং স্থানীয় নেতাদের মাঝে বিতরণ করা হয়। (এই কাগজের একটি প্রতিলিপি আমাদের কলকাতা মিশনে সরবরাহ করা হয়)। একইসাথে সমস্যাটি প্রচার করার জন্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতা ও বাংলাদেশের বিষয়টি প্রচার করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এটি করা হয় বিভিন্ন ছদ্ম নামে সংবাদপত্রে একটি সিরিজ আকারে প্রবন্ধ ও চিঠি কাজে লাগানোর মাধ্যমে। “ইসলাম কি মৃত” শিরোনামে একটি অজ্ঞাত প্রবন্ধও “কামালের” অবদান। জাকার্তা টাইমসে ১৯৭১ সালের ১৫ ই এপ্রিলে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটি এক চেতনার তৈরি করে। ( এটি সন্তোষজনক যে এটি বাংলাদেশ প্রকাশনায় জায়গা পেয়েছে) জাকার্তা টাইমসে জায়গা করে নেওয়া অন্যান্য প্রবোধক এবং চিন্তা-জাগানিয়া প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে- দ্য রোল অব ইউ এন ভিজ-আ-ভিজ বাংলাদেশ (কামাল), পাকিস্তান এন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড (রুমি), বাংলাদেশ রিফ্যুজিস (রুমি), এবং বাংলাদেশ রেভ্যুলেশনস (রুমি)। এছাড়াও কামাল এবং রুমি সংবাদপত্রে আরো কিছু সংখ্যক চিঠি পাঠিয়েছিলো বিষয়টিকে জীবিত রাখতে। এছাড়াও বেশ কিছু সংখ্যক টেলিগ্রাম কামালের মাধ্যমে বিশ্ব নেতাদের কাছে পাঠানো হয় যুদ্ধ হত্যা বন্ধ করা, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, এবং বাংলাদেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে। বাংলাদেশ সংবাদপত্র এবং সরকারি প্রকাশনাগুলো প্রধান কাগজ এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের কাছে পাঠানোর জন্য বিশ্ব সংবাদ সংস্থাগুলোর খবর ও মতামতের প্রতিলিপি স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর নিকট সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে জায়গা পাওয়া খবর, মতবাদ এবং সম্পাদকীয় পাতা কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। এই কাজগুলো নিয়মিত রুমির মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছিলো। এই কাজের ব্যয়ভার কিছু সংখ্যক সদস্যের মাধ্যমে পূরণ হচ্ছিলো (অবদানকারীরা হলেন কামাল, রুমি, সাফ্রি, রুহানি, এবং বদর। অনুদানকৃত মোট টাকার অঙ্কের পরিমাণ প্রায় ৪৩০ মার্কিন ডলার হতে পারে) । বাংলাদেশ ফান্ডে একটা ছোট অবদান রাখা হয়। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যয় করা হয় “পিপল” এর সম্মতির জন্য, এবং কিছু স্থানীয় পত্রিকা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য। আমাদের ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে আমাদের বীর যোদ্ধাদের জন্য ৯০ পিস গরম কাপড় কেনা হয়েছে এবং প্রেরণ করা হয়েছে। বাহিনীটির আরো কার্যকরী কাজের জন্য তাদের কার্যকলাপ আরো তীব্রতর করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটির দরকার উতসাহ, উপদেশ, দিক নির্দেশনা, এবং নিয়মিত প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ। কমিটির কোন নিয়মিত অফিস নেই। অধিকাংশ অফিস এবং টাইপের কাজ রুমির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। যখন উন্মুক্ত কার্যকলাপের জন্য সময় উপযুক্ত নয়, পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়, কমিটি একটা ভালো ফলাফল তৈরি করতে পারতো যদি এর একটি উপযুক্ত অফিস, টাইপিং, সাইক্লোস্টাইলিং এবং অনুবাদের সুবিধা থাকতো। “সুফি” কে একজন টাইপরাইটারের যোগান দেওয়া হয় এবং আমাদের কলকাতা মিশনে সাময়িকী প্রতিবেদন জমা দেওয়ার এবং “হামিদ” এর সহায়তায় স্থানীয় নেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে কত কয়েক মাস যাবত গ্রুপের সংস্পর্শে নেই। সম্ভবত সে তার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। যদিও দলটি সুফির কাজের অয়াব বোধ করছে, এটি সাফ্রি, রুহানি এবং আনসারের মতো উদ্যমী সদস্যদের সমর্থন পেয়ে ভাগ্যবান। এটির সর্বশেষ অর্জন হলো বদরের সমর্থন লাভ করা। যদিও এখানে চিত্তপ্রসাদের কোন জায়গা নেই, গ্রুপটি জাতির স্বার্থে তার ছোট্ট অবদান তৈরিতে বিশ্বাসী।

  ৮) এই প্রতিবেদনটি নিচের মন্তব্য বা পরামর্শের সাথে শেষ করা যেতে পারে:

    ক) যদিও বাংলাদেশের প্রতি ইন্দোনেশিয়ান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানে অসন্তোষজনক এবং অবন্ধুত্বপূর্ণ, তাদেরকে আমাদের দিক বুঝাতে এবং তাদের সমর্থন লাভ করতে অব্যাহত প্রচেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মুসলিম বিশ্বে এটা প্রয়োজন এই দেশের অবস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এবং যেহেতু অধিকাংশ জনগণ আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশ প্রচারণার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়মিত কর্মকর্তাদের এবং কর্মচারীদের নিকট সরবরাহ করা উচিৎ (ইতোমধ্যেই তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে)। বাংলাদেশি নেতাদের মাঝে মাঝে ইন্দোনেশিয়াকে সম্ভাষণ করা উচিৎ সমর্থন, সহানুভূতি এবং সাহায্যের জন্য। যদিও ইন্দোনেশিয়ান সরকার কোন বাংলাদেশি প্রতিনিধিকে এই দেশ ভ্রমণে অনুমতি নাও দিতে পারে, আমাদের সরকারকে তবুও প্রতিনিয়ত এখানে প্রতিনিধি পাঠানোর চেষ্টায় উদ্যমী হতে হবে। বিমুক্ত এলাকা এবং ভারতের শরণার্থি শিবির দর্শন করতে আগ্রহী বিশিষ্ট ইন্দোনেশিয়ান নেতাদের প্রতি আমন্ত্রণ পাঠানো যেতে পারে।

  খ) সেনা নৃশংসতা, জনগণের এবং শরণার্থিদের দুর্ভোগ সকলের দৃষ্টিগোচর করতে এবং বাংলাদেশ ইস্যুটি ছড়িয়ে দিতে ইন্দোনেশিয়ান সংবাদ মাধ্যমগুলোর পালন করা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উপযুক্তভাবে আমাদের সরকারের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। মাঝে মাঝে সংশ্লিষ্ট পত্রিকাগুলোকে মর্যাদা দিয়ে চিঠি পাঠানো যেতে পারে। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ এবং চিঠির সারাংশ আবারো প্রকাশ করা উচিৎ এবং ওখান থেকে প্রতিলিপিগুলো এখানে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সরবরাহ করা যেতে পারে। এটি তাদেরকে উৎসাহিত করবে। তারা গ্রহণ করুক বা নাই করুক, বিশিষ্ট সাংবাদিকেরা বিমুক্ত এলাকা এবং শরণার্থি শিবির পরিদর্শন করতে আমন্ত্রণ পাঠাতে পারে। উদ্দেশ্য হলো তাদের সাথে অব্যাহত যোগাযোগ রক্ষা করা। সংবাদ মাধ্যমগুলোকে নিয়মিত বাংলাদেশের কাগজ এবং প্রকাশনার সরবরাহ পেতে হবে।

  গ) “আমরা গ্রুপ” কে নিয়মিত সকল প্রচারণা সামগ্রী এবং সংবাদপত্রের পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রতিলিপির সরবারাহ দিতে হবে যেন তারা তাদের বাছাই নীতির উপর স্থানীয় বিতরণের ব্যবস্থা করতে পারে। গ্রুপটি এই সরবরাহের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল, কেননা এটি গোপনীয়তার সাথে তার নগণ্য সম্পদ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংগঠিত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। দলটিকে জোরালো করতে ও তাদের কার্যকলাপ তীব্রতর করতে তাদের প্রয়োজন উপদেশ, নির্দেশনা এবং কিছু স্বীকৃতি। উত্তরোত্তর সদস্যরা এই দলটিকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসছে। এই গোপন দলটিকে এমন একটি উপায়ে সংগঠিত করা হচ্ছে যেন একজন নির্দিষ্ট সদস্য দল বা ঘাঁটি ছেড়ে গেলেও এর কাজের কোন ক্ষতি না হয়। এটা অনুভূত হয় যে কোন স্বীকৃতি এই কাজকে সহজতর করবে, এমনকি সুফির কার্যোপযোগিতাও পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব করতে পারে যে কিনা উদ্দেশ্যহীনভাবে ও ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছিলো এবং ব্যর্থ ও নকল প্রচেষ্টা করে যাচ্ছিলো।

  ঘ) যদিও বর্তমান পরিস্থিতে জাকার্তায় উন্মুক্ত অফিস কিংবা উন্মুক্ত প্রচারণা সম্ভন না, দলটি ভালো ফলাফল বের করতে পারতো যদি এর কোন দোভাষী টাইপিস্ট অফিস এবং সেবা থাকতো। ভাষা সমস্যার কারণে এটি স্থানীয় ভাষার পত্রিকাগুলোর সাথে সঠিক যোগাযোগ রক্ষা করতে এবং যেসব বিষয় ইংরেজি থেকে বাহাসা কিংবা বাহাসা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা প্রয়োজন, সেসব তথ্যগুলো পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। এর সীমিত সম্পদের সাথে, দলটি একজনকে অনুবাদকের কাজে কাউকে নিয়োগ করার মতো অবস্থায় নেই। এই বিষয়ে উপদেশ অনুরোধ করা গেলো।

  ঙ) তাদের কি করা উচিৎ বা কি করা উচিৎ নয় এই ব্যাপারে বাঙালিরা এখানে কোন সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা এখনও পায়নি। বদলির ক্ষেত্রে কোন পথ গ্রহণ করতে হবে, তা খুব পরিষ্কার নয়। সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য এই ব্যাপারে সরকারি দিক নির্দেশনা বা বিজ্ঞপ্তি হতে পারে।

                                                                          কামাল

_________________________________________________________________________________

    প্রতিবেদনটির উপর এবং এর কার্যকারিতার উপর যেকোন মন্তব্য সমাদৃত হবে।

                                                                         (কামাল)

                                                                     আমরা, জাকার্তা

                                                             নভেম্বর ২২, ১৯৭১

  জ্ঞাপিত:

১) কার্যনির্বাহক রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশ।

২) বৈদেশিক মন্ত্রী, বাংলাদেশ।

৩) বৈদেশিক সচিব, বাংলাদেশ।

৪) হাই কমিশনার, বাংলাদেশ মিশন, কলকাতা।

৫) রাজনৈতিক শাখা (জনাব আনোয়ারুল করিম চৌধুরী)।

৬) তথ্য শাখা (জনাব মকসুদ আলী)।

Scroll to Top