কথিকা

কথিকা

১৩ আগষ্ট, ১৯৭১

২৪ বছর পরে আজ ১৪ই আগস্টে মনে পড়ছে আজ থেকে ২৪ বৎসর আগেকার দিনটি কথা। সেদিন কি উজ্জ্বল ছিল বাংলাদেশ, আর প্রাণদপ্ত ছিল বাংলার মানুষ। সারাদেশে কাগজের রঙিন পতাকা আর মালার ছড়াছড়ি। আলোয় আলোয় সারাদেশ ঝলমল। আমরা স্বাধীন হয়েছি, এবার আমাদের দুঃখ ঘুচবে। বিদেশী শাসন, জমিদারের অত্যাচার, মহাজনের শোষণ আর সামাজিক অসাম্যের হাত থেকে রেহাই পাবে বাংলার মানুষ। সারাদেশের মানুষ অন্তরের সবটুকু ভালবাসা দিয়ে বরণ করে নিল ১৪ই আগষ্টের ভোরের লগ্নটি।

তারপর প্রতিবছর ১৪ ই আগষ্ট ঘুরে ঘুরে এসেছে। বাংলার মানুষ তাদের ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশ্যা নিয়ে প্রতিবছর ১৪ই আগষ্টের ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। ভেবেছে, যে দিনগুলো চলে গেলো সে এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। এবার নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুত নতুন জীবনের বাণী বহন করে আসছে ১৪ই আগষ্ট। কিন্তু প্রতিবারই ভুল ভেঙ্গে গেছে বাংলার মানুষের। তার অতি কাজেক্ষয় জীবনের প্রতিশ্রুতি বহন করেন এলো না কেন ১৪ই আগষ্ট। বিদেশী শাসনের পরিবর্তে তার ঘাড়ে চেপে বসলো পশ্চিম পাকিস্তানী শাসন। ১৪ই আগষ্ট বাঙালীর জন্যে মুক্তি নিয়ে এলো না কোনবার। শুধু তীব্রতর হলো শোষণ জমিদারের অত্যাচার আর মহাজনের শোষণের চাইতে পশ্চিম পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র এবং পুঁজিপতিদের বর্বরতম অত্যাচার ও তীব্রতর শোষণে তারা জর্জরিত হয়ে উঠলো। সামাজিক অস্বীকৃতি আর অনাচারে তাদের জীবন হয়ে উঠলো দুঃসহ।

এই শৃঙ্খলিত শাসন আর সামাজিক অবিচারের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছে বাংলাদেশের নিপীড়িত জনসাধারণ। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকবার প্রতিটি উপকরণের জন্যে তাদের লড়তে হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র বাংলাদেশের প্রতিটি দাবিকে অস্বীকার করেছে, আর প্রতিটি দাবি আদায়ের জন্যে বাংলার মানুষকে লড়তে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্টের পর বাংলাদেশের ইতিহাস পশ্চিম পাকিস্তানী

শোষকশ্রেণীর শোষকের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস। এই ইতিহাস গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মানুষের রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস।

১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলে বাংলার বীর সন্তানেরা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছে, ১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে বাংলার মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে তাজা তাজা প্রাণগুলো উৎসর্গ করেছে। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন কোটি বাঙালীর প্রাণের দাবি দফ-দফাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে ভাই মনু মিয়া এবং আরো অনেকে। ১৯৬৯ সালে বাংলার স্বাধিকারের দাবিতে, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার দাবিতে, বাঙালীর প্রাণাপেক্ষা প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে বুকের তাজা রক্তে বাংলার শ্যামল মাটি লালে লাল করে দিয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানী শোষকশ্রেণী, আমলাতন্ত্র, সামরিকচক্র এই তিনশক্তির বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে বার বার হামলা করেছে। প্রতিবারই বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতিরোধের সম্মুখে পিছু হটে গিয়েছে। এবং চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে। তারপর তারা তাদের চূড়ান্ত আক্রমণ পরিচালনা করলো ২৫ মার্চের মুক্তিকামী জনতার কণ্ঠকে। কিন্তু বাংলার মুক্তিকামী জনতার দুর্জয় প্রতিরোধের সম্মুখে আবার পিছু হটে চলেছে পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বর শোষকশ্রেণী এবং তাদের স্বার্থবাহী সামরিক চক্র। তাদের এই অভিজ্ঞান হয়েছে যে, পরাজয় তাদের সুনিশ্চিত-মৃত্যুর ঘন্টা বেজেছে।

বাংলায় আজ রক্তের স্রোত বইছে। ঘরে-ঘরে, মাঠে মাঠে, রাজপথে জমাট-বাঁধা রক্ত। ধর্ষিতা মাবোনদের মরণ আর্তনাদ অভিশপ্ত ১৯৪৭ সনের ১৪ই আগষ্ট আর তার নায়কদের প্রতিমুহুর্তে ঘৃণার সাথে ধিক্কারে ধিকৃত করছে। ’৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট বাংলার জন্য এনেছে প্রতিশ্রুতির আড়ালে বঞ্চনা, শোষণ আর রক্তস্নান; কান্না আর দীর্ঘশ্বাস।

তাই আজ ১৪ই আগষ্টে স্বাধীন বাংলার পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে শিকল-ছেড়া বাংলার মানুষ অতীতের অপমান আর গ্লানিভরা দিনগুলোকে স্মরণ করছে প্রচণ্ড ঘৃণার সাথে। আর সেজন্যেই সেদিন ছোট ছেলেটি বললো- মা, কি পুণ্যই যে ছিল তোমার, যার জন্যে ১৯৪৭-এর আগষ্টের কলঙ্কিত দিনটির মুখ দেখেতে পাইনি, আর তোমাদের মত আমার দুহাত দিয়ে এমন দিনটির জন্যে মালা গাঁথতে হয়নি।

(জেবুন্নাহার আইভি রচিত)

Scroll to Top