কামাল হোসেন, ডক্টরআওয়ামী লীগ নেতা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ১৪৩ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ১৮ নং দলিল থেকে বলছি…

ডঃ কামাল হোসেন

১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আইয়ুব সরকার প্রচুর পাঞ্জাবি সেনা এবং এলাকা হারিয়েছিল। কিন্তু এর বিপরীতে কোন অর্জন দেখাতে পারে নি। তাই পাকিস্তান আর্মির ভেতরেও তাঁর সমর্থন কমে গিয়েছিল। রাশিয়ার চাপে ইন্ডিয়ার সাথে শান্তির উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরিত তাসখন্দ চুক্তি পাঞ্জাবিদের কাছে ছিল অত্যন্ত অপমানজনক। এই চুক্তি করার পেছনে অবশ্য আইয়ুব নিজের অবস্থান জোরালো না করে বরং সামগ্রিক অবস্থার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন এবং হারানো এলাকা ফিরে পাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এর ফলে অবস্থা আরো খারাপের দিকে গেল। এই যুদ্ধের পিছে আইয়ুবকে উস্কানী দেয়া ভুট্টোও এ সময় নিজেকে আইয়ুবের পিছন থেকে সরিয়ে নেন এবং সবখানে এই চুক্তি বিরোধী বক্তব্য দিতে থাকেন। এভাবেই ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের ক্ষমতায়নের পর যে সকল পাঞ্জাবি রাজনীতিবিদ রাজনীতির ময়দান থেকে পার্শ্বসারিতে চলে গিয়েছিলেন, তাঁরাও একটি অসন্তুষ্ট আর্মির সাথে একজোট হয়ে আইয়ুবকে ধীরে ধীরে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিজেদের গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ খুঁজে পান।

পূর্ব পাকিস্তানের জনতার মনোভাব ছিল পুরোই বিপরীতধর্মী। তাঁরা যুদ্ধকালীন নিজেদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, ‘উন্মুক্ত’ এবং অরক্ষিত মনে করছিল। ভুট্টো বলেছিল যে ইন্ডিয়ার সাথে যুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তান আক্রান্ত হলে বন্ধুসুলভ চৈনিকেরা তা রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। তবে এটি ছোট্ট একটি স্বান্তনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাই তাসখন্দ চুক্তিকে পূর্বাঞ্চলের প্রায় সকলেই আশির্বাদ হিসেবেই গণ্য করেছিল।

১৯৬৬ সালে পাঞ্জাবি রাজনীতিবিদরা আইয়ুবের নিকট হতে রাজনৈতিক অধিকার আদায় এবং ‘জাতীয় সরকার’ প্রণয়নে জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠে। তাঁরা বুঝেছিলেন যে বাঙালিরা যদি এই দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে, তবেই শুধু তা সত্যিকার অর্থে সম্ভব। তাঁরা যে এতে শেখ মুজিবকে সংযুক্ত করতে চায়, তা প্রচারসংখ্যার শীর্ষে থাকা বাঙালি দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাকের প্রভাবশালী সম্পাদক মানিক মিয়া (তফাজ্জল হোসেন) বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত পাঞ্জাবি বিরোধী দলীয় নেতাদের একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সম্মেলনে পাঞ্জাবি নেতারা একটি সাধারণ আইয়ুব বিরোধী জোট গঠনের জন্য জোর দিয়েছিলেন এবং ‘নিশ্চিত’ ছিলেন যে আর্মি তাঁদের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। তাঁরা চাইছিলেন মানিক মিয়া যেন শেখ মুজিবকে রাজি করিয়ে এই আইয়ুববিরোধী জোটে অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু মানিক মিয়া জানতেন যে ঢাকায় সকলে তাঁকে প্রশ্ন করবেন যে, আইয়ুবকে সরিয়ে আরেক দল পাঞ্জাবি নেতাদের ক্ষমতায় বসালে কি বাঙালিদের সাথে চলে আসা অবিচার কমবে? তাই তিনি পাঞ্জাবিদের স্পষ্টভাবে প্রশ্ন করলেন যে, তাঁরা রাজধানী কিংবা কোন একটি সরকারি সেবাখাতের হেডকোয়ার্টার পূর্ব-বাংলায় স্থানান্তর করতে কিংবা সংখ্যাসাম্য নয় বরং জনসংখ্যার ভিত্তিতে ক্ষমতায়নে রাজি আছেন কিনা।

জবাবে তাঁরা বলেছিলেন, “আগে আইয়ুবের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিই, তারপর দেখা যাবে যে কিভাবে তা আমাদের মাঝে ভাগ-বটোয়ারা করা যায়।“

পাকিস্তানের প্রথম দশকে এঁদের সুচিন্তিতভাবে সংগঠিত বৈষম্যের কথা বাঙালি ভুলে নাই। বাঙালি ভালোভাবেই জানতো যে ‘এক-কেন্দ্র’ এবং ‘সংখ্যাসাম্য’-র নীতি এঁদেরই বুদ্ধি। তাই এই ধরণের জোট গঠনের ফলে পূর্ব-বাংলার সুবিধা বর্ধন নিয়ে কিছু সন্দেহের অবকাশ ছিল। কেন্দ্র ও প্রদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক তথা বাঙালির দাবিকৃত আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন সম্পর্কে যদি আগেই কিছু সুনির্দিষ্ট ঘোষণা থাকতো, তবে এ ধরণের জোট গঠনে বাঙালিদের কিছু লাভ হতো বটে।

মানিক মিয়ার প্রত্যাবর্তনের পরেই জানুয়ারীতে আইয়ুব খান ঢাকায় আসেন। এসে তিনি বাঙালি বিরোধী দলীয় নেতাদেরকে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। তখনকার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব বাদে যে সকল নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তাঁরা সকলেই ছিলেন সনাতনী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। যেমন নুরুল আমিন, ইউসুফ আলী চৌধুরী, হামিদুল হক চৌধুরী এবং অন্যান্য। আইয়ুবের সাথে মিটিঙের আগেই সেখানে পেশ করার জন্য কিছু সাধারণ দাবীদাওয়া নিয়ে একমত হওয়া প্রসঙ্গে ইনফর্মালি আলোচনা করার জন্য শেখ মুজিব অন্যান্য বাঙালি নেতাদের চাপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। উনি সেখানে কিছু নির্দিষ্ট দফা অন্তর্ভুক্ত করার জন্যেও চাপ দিলেন, যেগুলো স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রশ্নে বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষা করবে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে প্রথমবারের মতো কাগজের বুকে দফাগুলো লেখা হয়েছিল। দলের তদকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ সেই দফাগুলো কাগজে লিখেছিলেন। শেখ মুজিব নুরুল আমিনকে তাঁদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করার জন্য চাপ দিলেন। নুরুল আমিনসহ অন্যান্য সনাতন আওয়ামিপন্থিরা এত বেশি প্রথাবিরোধী স্বায়ত্তশাসন দাবী করার বিপক্ষে ছিলেন। তাঁরা দ্বিধান্বিত ছিলেন যে এগুলো পেশ করলে আইয়ুব ক্ষেপে যাবেন এবং অন্যান্য ‘মধ্যমপন্থি’ দাবীসমূহ যেমন ‘সংবিধানের গণতান্ত্রিকীকরণ’, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচন, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা এবং জাতীয় সরকারে বিরোধী জোট প্রভৃতি ঝুলে যাবে। তবে মুজিব অবিচল ছিলেন। বললেন, অন্যরা এই ৬ দফার প্রতি সমর্থন না জানালেও তিনি নিজেই এই দাবি তুলবেন। মিটিঙে হামিদুল হক চৌধুরী ছিলেন বাঙালি নেতাদের তরফ থেকে মনোনীত বক্তা। তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতে শেখ মুজিব অস্বীকৃতি জানালেন। তাই আইয়ুবের সাথে মিটিং শুরু হয়ে সিরিয়াস কোন আলোচনা ছাড়াই শেষ হয়ে গেল।

পাঞ্জাবী বিরোধীদলীয় নেতারা ৩ ফেব্রুয়ারী লাহোরে এক বিরোধী দলীয় জাতীয় সম্মেলনে আহ্বান করেন। আমন্ত্রিত বাঙালি নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ মুজিব। মানিক মিয়ার অনুরোধে মুজিব সেখানে উপস্থিত হন। মানিক মিয়া বুঝেছিলেন যে, শেখ মুজিব সেখানে না গেলে পূর্ব-পাকিস্তানের সবচেয়ে কার্যকর বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে না। তবে তিনি মুজিবকে স্বায়ত্ত্বশাসনের দফাগুলো পেশ করতে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, সেগুলো আরেকটু নমনীয় করতে। যদিও শেখ সেই দফাগুলো উত্থাপনে অবিচল ছিলেন।

লাহোর কনফারেন্সের সভাপতি ছিলেন চৌধুরী মুহাম্মদ আলী। শেখ যখন দফাগুলো উত্থাপন করতে চাইলেন, তখন তিনি তা বাতিল করে দিলেন। এমনকি তিনি তা আলোচ্যসূচিতেও রাখলেন না। গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে ৬ দফা আসলে সরকারের ‘সমর্থনেই’ উত্থাপন করা হচ্ছে যেন বিরোধী জোটের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে।

সমাবেশে দাবীনামা উত্থাপন করতে দেয়া না হওয়ায় শেখ মুজিব ওয়াক-আউট করলেন এবং সরাসরি প্রেসে গিয়ে তা প্রকাশ করে দিলেন। সমাবেশে বিরোধী নেতারা ক্ষেপে গেলেন। তবে এ কথা বুঝলেন যে স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রশ্নে বাঙালির প্রতিনিধিত্বকারী শেখ কোন প্রতিশ্রুতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁদের সাথে থাকবেন না।
এভাবে লাহোর সম্মেলন ভেঙে গেল। বিস্তারমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিপেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবীতে পাঞ্জাবি ও কিছু দুর্বল সনাতন আওয়ামী নেতাদের সাথে শেখ মুজিবের বিভেদটা প্রকট হয়ে উঠলো।

সরকার এই সুযোগটা কাজে খুব দ্রুত কাজে লাগালো। একদিকে পাঞ্জাবি বিরোধীদলীয় নেতাদের এই বলে দোষ দিতে লাগলো যে তাঁরা পূর্ব আর পশ্চিম বিরোধীজোটের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে পারেন নাই এবং শেখ মুজিবের সাথে সম্মিলিতভাবে পাঞ্জাবিদের সাথে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন। কারণ মুজিবের ৬ দফা পাঞ্জাবিদের স্বার্থে প্রবলভাবে আঘাত করেছে। এইসব প্রচারের মাধ্যমে সরকার শাসক শ্রেণির উচ্চ পদাধিকার প্রাপ্ত বিভক্ত পাঞ্জাবিদের এবং বিরোধী জোটের দাবীতে নিজ স্বার্থ রক্ষার চেষ্টায় লিপ্ত একটি অংশের মধ্যে পুনরায় ঐক্য ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।

অবশ্য ভুট্টো ও আইয়ুবের আইনমন্ত্রী এস, এম জাফরসহ অনেকেই উল্টো সরকারকে দোষ দিতে থাকে এই বলে যে, মুজিবকে ৬ দফা পেশ করার জন্য সরকারের নিকটবর্তী কেউ ইন্ধন দিয়েছে যেন পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। অবশ্য এই দাবী দৃশ্যমানভাবে ভুল প্রমাণিত হয়। কারণ পরবর্তীতে আইয়ুব সরকার ৬ দফার বিপরীতে প্রবল দমনপীড়ন চালায়।

৬ দফা ছিল একটি লিখিত দলিল। একে লাহোর সম্মেলনে উপস্থাপন করার কথা ছিল। এর শিরোনামে ছিল “৬ দফা-আমাদের বাঁচার দাবী, পেশকারীঃ শেখ মুজিবুর রহমান, ২৩ মার্চ ১৯৬৬”। এটিকে পেশ করা হয়েছিল একটি বিবৃতি হিসেবে, “দেশের আন্তঃপক্ষীয় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা সমূহের সুনির্দিষ্ট সমাধানের মূলনীতি” হিসেবে। এখানে দাবীগুলোকে এই বলে জোর দেয়া হয়েছিল যে, “এগুলো আমার কিংবা অন্য কারো আবিষ্কৃত নতুন কোন দাবী নয়, বরং এগুলো বহু দশক যাবৎ চলে আসা অপেক্ষমাণ জনতার ও তাঁদের নেতাদের দাবী।”

সেই বিবৃতি থাকা ৬ দফাগুলো হলোঃ

১নং দফা
ঐতিহাসিক লাহোর- প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়তে হবে। তাতে সংসদীয় সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত-বয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।
২নং দফা
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র-এই দুইটি বিষয় থাকবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় প্রদেশের হাতে থাকবে।
৩নং দফা
মুদ্রা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দুইটি প্রস্তাবের যে কোন একটিকে গ্রহণ করতে হবেঃ
(ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে, অথবা
(খ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। এ অবস্থায় সংবিধানে এমন কার্যকর বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে। দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক থাকবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক ও মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে হবে।
৪নং দফা
সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। কেন্দ্রসরকারের সে ধরণের ক্ষমতা থাকবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত খাজনার নির্ধারিত অংশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে ব্যবহৃত হবে। প্রদেশগুলোর সংগৃহীত অর্থের নির্ধারিত পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের তহবিলে জমা হবে।
৫নং দফা
(১) দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখতে হবে।
(২) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে।
(৩) যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে।
(৪) স্বদেশী দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানী-রফতানী চলিবে।
(৫) সাংবিধানিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি-রফতানী করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করতে হবে।
৬নং দফা
পূর্ব পাকিস্তানে একটি মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন করতে হবে।

১ নং দফাতে সংসদীয় সরকারের সেই মৌলিক দাবিটিই উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে সকলেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। ১৯৬৬ এর প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে এটি আলাদা গুরুত্ব পেয়েছিল। আইয়ুব যে সংবিধানের ভিত্তিতে সরকার চালাচ্ছিলেন তাতে প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতির হাতেই সর্বময় ক্ষমতা ছিল। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফেডারেশন মূলক সরকার পদ্ধতির দাবী দ্বারা মূলত তুলে ধরা হয়েছিল যে লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর জন্য “সার্বভৌম স্বায়ত্বশাসনের ব্যবস্থা” সন্নিবেশ করা হয়েছিল। ফলে লাহোর প্রস্তাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট যা ছিল মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশসমুহের জন্য “সার্বভৌম” স্বতন্ত্র ষ্টেট প্রতিষ্ঠা করা তার ভিত্তিতেই ফেডারেশন সরকারের দাবী করা যায়। পাকিস্তানের প্রদেশসমূহ একমাত্র অবাধে ও স্বেচ্ছায় যেভাবে চায়, ঠিক সেভাবেই একটি ফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে একত্র হবে এবং ফেডারেশনের চরিত্র নির্ধারিত হবে সকলের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে- এমন রূপরেখা লাহোর প্রস্তাবেই অঙ্কিত ছিল। ‘আন্দাজে’ কোনো মডেল আরোপ করা হলে সেটা হবে নির্মম। ফেডারেল সরকারের এই আরোপণের ক্ষমতা তখনই থাকবে যখন সকল সাংবিধানিক একক সত্ত্বা ‘একমত হয়ে’ তাকে এই ক্ষমতা প্রদান করবে। স্বার্বভৌম এককসমূহ যত অল্পই হোক ফেডারেল সরকারকে মেনে চলতে পারবে এবং তাদেরকে নিজ নিজ সম্মতির বেশী অধিকার ছাড় দিতে বাধ্য করা যাবে না। ফেডারেশন সরকার গঠন পরিস্থিতি আগেকার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া এক্ট, ১৯৩৫ এর মত হবে না। সেখানে কনস্টিটিউয়েন্ট একক সমূহের কিছু ক্ষমতা বিলোপ করে ইউনিটারি পদ্ধতিকে ফেডারেল হিসবে রূপদান করা হয়েছিল। বরং একটি ‘সত্যিকার ফেডারেশন’ গঠিত হবে যেখানে কনস্টিটিউয়েন্ট এককসমূহ সাধারণ সম্মতির ভিত্তিতে কিছু অধিকার ছেড়ে দিয়ে বা কিছু ক্ষমতা অর্পণ করে ফেডারেল সরকার গঠন করবে।

১৯৪৭ এ দেশভাগের পর চব্বিশ বছরে সেই মৌলিক অবস্থানটি হয়তো ইচ্ছে করেই ঝাপসা করে দেওয়া হয়েছিল। কনস্টিটিউয়েন্ট এককসমূহ কর্তৃক ফেডারেল সরকারকে ক্ষমতা অর্পণের কথা থাকলেও ফেডারেল সরকার কনস্টিটিউয়েন্ট এককসমূহকে ক্ষমতা প্রদান করবে এমন একটি সংবিধান তারা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। সন্দেহ নেই যে ক্ষমতাধর সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণী যারা কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রন নিতে পেরেছিল, তারা নিজেদের অবস্থান সুরক্ষার জন্য গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া এক্ট, ১৯৩৫ এর ছায়া বেছে নিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তারা জাতীয় ঐক্যের নামে কেন্দ্রীয় সরকারকে আরো সুসংহত করার জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। বস্তুত ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্ট এক্ট অনুযায়ী, কনস্টিটিউয়েন্ট একক সমূহ অধিবেশনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সংবিধান (ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) প্রনয়ণ না করা পর্যন্ত এটি ‘সাময়িক’ সংবিধান হিসেবে কাজ করবে এবং এতে প্রদেশসমুহ এবং কেন্দ্রের সম্পর্কের কাঠামো নির্দেশিত ছিল। তবে এতে কনস্টিটিউয়েন্ট এককসমূহ যে নীতিগত ভাবে ‘সার্বভৌম’ এবং ‘প্রাদেশিক’ নয় তা কেন্দ্র কর্তৃক আবছা করে রাখা হয়েছিল। এতে ১৯৪৭ এর পূর্বে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া আমল থেকে সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্র কর্তৃক প্রদেশসমূহকে ক্ষমতায়ন করা হতো।

২ নং দফা একটি দ্বি-বিষয় কেন্দ্রীক অথবা মুদ্রার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করলে বলা যায় তিনটি বিষয় সংশ্লিষ্ট। ১৯৪৬ এর কেবিনেট মিশন প্ল্যান এ এর পটভূমি নিহিত আছে। এতে বলা হয়েছিল কেন্দ্রের হাতে শুধু প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগের ৩ টি বিষয় থাকবে। সরকার বিরোধী একটি রাজনৈতিক মোর্চা “দ্য গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলী অফ ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস” ও ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে ঢাকায় একটি ফেডারেশনের প্রস্তাব করেছিল যার নাম দেয়া হয়েছিল ইউনাইটেড স্টেটস অফ পাকিস্তান। প্রস্তাবনা অনুযায়ী সেখানে কেন্দ্র শুধু প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ এই তিনটি বিষয় দেখভাল করবে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্ধী দল সমুহের গঠিত দ্য ইউনাইটেড ফ্রন্ট ১৯৫৪-এ পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে তাদের ২১ দফা ইশতেহারের একটিতে বলেছিল যে, সংবিধানে এমন একটি ফেডারেশনের সংস্থান থাকবে যেন কেন্দ্রের কাছে শুধু তিনটি বিষয় থাকেঃ প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং মুদ্রা। অতএব ছয় দফার দ্বিতীয় দফাটি সংবিধান সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়ের পুনরুচ্চারন মাত্র যা অন্যতম মৌলিক বিষয় হিসেবে পরিগ্রহ করা হয়েছিল অর্থাৎ তা ছিল ফেডারেল কন্সটিটিউশনের আওতায় কেন্দ্র এবং প্রদেশের ক্ষমতার বন্টন সংক্রান্ত বিষয়।

দফা ৩, ৪ এবং ৫ নম্বর ছিল সুনির্দিষ্টভাবে পূর্ব বাংলার, অর্থাৎ বাঙালিদের নিরাপত্তা সংরক্ষণে, তাদের সম্পদে নিয়ন্ত্রণে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষমতার ব্যাপারে। পাকিস্তানের গোঁড়ার দিক থেকেই অনেকেই বোধ করছিলেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পুর্ব বাংলা ‘ন্যায্য অধিকার’ পাচ্ছিলো না। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছিলো যে ফেডারেল ফান্ডের বরাদ্দ, বৈদেশিক মুদ্রা বণ্টন এবং সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার বৈষম্য ঘটাচ্ছে। অভিযোগ উঠেছিল যে পূর্ব বাংলাকে ন্যায্য হিস্যা দেয়া হচ্ছে না। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে ষাটের দশকে বাঙালি অর্থনীতিবিদরা তাদের লেখনীতে পারিসংখ্যানিক প্রমাণের সাহায্যে এই অভিযোগ তীক্ষ্ণ করে তোলেন। এসব লেখনীতে দুই পাকিস্তানে বৈষম্যমূলক নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুস্পষ্ট অসাম্য তুলে ধরে দেখানো হয়েছিল যে পক্ষপাতদুষ্ট এবং পদ্ধতিগত বৈষম্যের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করে পশ্চিম পাকিস্তানকে সুবিধা দেয়া হচ্ছে।

পূর্ব থেকে পশ্চিমে বড় আকারে সম্পদ পাচারের প্রধান মাধ্যম বলে ধারণা করা হয়েছিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ। তাই ছয় দফার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল অর্থনীতির আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনা।

ছয় দফা অঙ্কুরিত হয়েছিল সেই ১৯৬২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায়, যার নাম ছিল ‘দা চ্যালেঞ্জ অফ ডিস্প্যারিটি’। এটি জোরকণ্ঠে বলেছিল যে, বৈষম্যের বাস্তবিক সমাধানের জন্য কতিপয় মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন প্রয়োজন যার সংক্ষিপ্তসার এরূপঃ কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন বিলুপ্ত করে দুটি শক্তিশালী আঞ্চলিক পরিকল্পনা প্রনয়ণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা এবং অর্থ মন্ত্রনালয় দুই শাখা বিশিষ্ট করা। এটি এমনও পরামর্শ দিয়েছিল যে বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা অঞ্চলভিত্তিক আলাদাভাবে নির্ণয় করা উচিত এবং আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষকে বৈদেশিক সাহায্য নীতি নির্ধারনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা উচিত। এসব সুপারিশমালায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার আঞ্চলিকীকরণের বীজ বপন করা হয়েছিল যেমন করের ক্ষমতা, আর্থিক ও মুদ্রানীতি প্রনয়নের ক্ষমতা, সম্পদের পরিকল্পনা এবং নিয়ন্ত্রন এবং বৈদেশিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষমতা অঞ্চলসমূহে স্থানান্তর ।

অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণে দেখা গেল যে পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদ স্থানান্তরের প্রধান অস্ত্র ছিল বৈদেশিক বানিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রা এবং বৈদেশিক সাহায্যে কর্তৃত্ব। পাটজাত পণ্য রপ্তানী হতে আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রা সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে (শিল্পায়নসহ) ব্যবহৃত হতো। বৈদেশিক সাহায্যদাতা সংস্থাগুলোর কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রজেক্ট সমূহ যেভাবে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হতো পুর্বপাকিস্তানের গুলো সেভাবে তুলে ধরা হতো না। সেচ, কৃষি এবং শিল্পক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক বিনিয়োগ দুই পাকিস্তানের অসাম্য বাড়িয়ে তুলেছিল।

এটি বুঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, যখন থেকে ছয় দফা প্রস্তাব করা হয়েছিল তখন থেকে সবচেয়ে আপষহীন প্রতিরোধ হয়েছিল বৈদেশিক বাণিজ্য এবং সাহায্য সংশ্লিষ্ট দফাটিতে। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী যে হাতিয়ার দিয়ে অর্থনীতিতে কর্তৃত্ব ফলাচ্ছিলো, তা ছাড়তে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

তাই ছয় দফার প্রতি আইয়ুবের প্রতিক্রিয়া ছিল একে জোর পূর্বক দমন করা। তিনি ছয় দফাকে অভিহিত করলেন বিচ্ছিন্নতাবাদ অপচেষ্টা হিসেবে এবং ঘোষণা দিলেন যে অস্ত্রের ভাষায় তিনি এর জবাব দিবেন।

শেখ মুজিব এবং আওয়ামীলীগ বাঙালিদের মনোভাব বুঝে একে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে গেলেন এবং এর সমর্থনে একটি গণআন্দোলন গড়ে উঠলো। এপ্রিলের ১৮ তারিখে শেখ মুজিব গ্রেফতার হলেন এবং ৯ই মে ডিফেন্স অফ পাকিস্তান রুলে তাকে আটক দেখানো হল। ৭ই জুন, ১৯৬৬ তে ছয় দফার সমর্থনে একটি বিশেষ প্রতিবাদ দিবস পালন করা হল। আইয়ুব সরকার এটিকে বলপ্রয়োগে দমন করতে চাইলেন। বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ হল, কয়েকজন নিহত হলো। পরবর্তীতে বিপুল সংখ্যক গ্রেফতার করা হলো এবং বাঙালিদের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক বাজেয়াপ্ত করে এর সম্পাদককেও গ্রেফতার করা হলো।

এমন নিপীড়নের মুখে আন্দোলন কিছুটা দমে গিয়েছিল। হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করে আদালতে বিষয়টি নিস্পত্তির চেষ্টা করা হল।

১৯৬৭ এর ডিসেম্বরের শেষের দিকে পরিস্থিতি হঠাৎ অস্থির হয়ে নানারকম গুজবে বাতাস ভারী হয়ে উঠেলো। পূর্ব পাকিস্তানে সফররত আইয়ুব খানের কথা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামস্থ চন্দ্রঘোনার দাউদ কমপ্লেক্স পরিদর্শন করবেন। তিনি অকস্মাৎ সেটা বাতিল করলেন। বলা হল গুপ্তহত্যা বা অপহরণ ছক আঁটা হয়েছে আন্দাজ করে সেটি বাতিল করা হয়েছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন দেখা গেল যে চট্টগ্রাম এবং চন্দ্রঘোনার পথে মোটরশোভা যাত্রার জন্য প্রস্তুত সজ্জিত রাস্তাঘাটে কোনো গাড়ী গেল না তখনি বোঝা গেল যে সফরটি বাতিল করা হয়েছে।

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন আমার এক ব্যারিস্টার সহকর্মী আমিরুল ইসলাম থেকে জানা গেল যে জেলখানায় তিনি একজন মক্কেলের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তার অভিযোগ ছিল যে তাকে মারাত্মকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে এবং নির্যাতনের চিহ্ন লোকটির শরীরে ছিল। লোকটি জানালেন যে নির্যাতন করে ষড়যন্ত্র মূলক মামলায় কয়েকজন ব্যক্তিকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তি দিতে তাকে বাধ্য করা হয়েছে। আমিরুল ইসলাম খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং তার করনীয় সম্পর্কে পরামর্শ চাইলেন। তাকে পরামর্শ দেওয়া হলো যে বিষয়টি হাইকোর্ট এর দৃষ্টিগোচর করানোর জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এবং লোকটিকে পরীক্ষা করার জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠনের জন্য তাগাদা দেওয়া প্রয়োজন। ঐদিন সন্ধ্যায়ই নির্যাতনের অভিযোগ এবং আক্রান্ত ব্যক্তিটিকে পরীক্ষণের জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন চেয়ে হাইকোর্টে উপস্থাপনের জন্য একটি পিটিশন প্রস্তুত করা হলো। পিটিশনটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল এবং মেডিকেল বোর্ড গঠনের জন্য কোর্টকে আশ্বস্ত করা হল। ব্যক্তিটি ছিলেন কামাল উদ্দীন আহমদ যাকে পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামী করা হয়েছিল।

কিছুদিন বাদে পরপর অনেকগুলো গ্রেফতার করা হল। আহমেদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দুস, শামসুর রাহমান, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সকল সিনিয়র কর্মকর্তা এবং সশস্ত্র বাহিনীর বেশ কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হলো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে আহমেদ ফজলুর রহমান সর্বপ্রথম আইনজীবির সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং তাতে তিনি আমার নাম করেন। ১৯৬৭ এর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ কিংবা ১৯৬৮ এর জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে আমি জেলখানায় তার সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি জানালেন যে গ্রেফতারের পরপরই তাকে ঢাকায় বনানীস্থ নতুন আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কয়েকদিন ধরে তাকে সেখানে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তার মাধ্যমে একটি ষড়যন্ত্র মামলায় কয়েকজনকে জড়াতে চেয়েছিলেন। যতই এসব আটকের ঘটনা ঘটছিল, উত্তেজনা ততই বাড়ছিল। এমনকি গ্রেফতারকৃতদের আইনজীবীরাও গ্রেফতারের সম্ভাবনায় ছিলেন। ফজলুর রহমানের জন্য একটি হাবিয়াস করপাস (আদালতে বন্দী প্রদর্শন) আবেদন দাখিল করা হলো।
একই দিনে ব্যারিস্টার কে জেড আলম আমার কাছে এলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেমের পক্ষে একটি আবেদন জমা দেওয়ার জন্য। তাকে বলা হয়েছিল যে প্রত্যেক গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির জন্য আলাদা আলাদা আইনজীবী কাজ করার জন্য। কারণ একই আইনজীবী সকলের পক্ষে লড়লে অভিযুক্ত ব্যক্তিগনের মধ্যে ‘সম্পর্ক’ প্রতীয়মান হয় যা ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ মামলার ক্ষেত্রে পরিহার করা উচিৎ। পরে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেমের মামলাটি ইশতিয়াক আহমেদ পরিচালনা করেন। রুহুল কুদ্দুসের শ্যালক কামালউদ্দীন হোসাইন রুহুল কুদ্দুসের মামলার ভার নেন। যখন পিটিশনটি উচ্চ আদালতে গেল তখন সরকারী উকিলেরা এসে বললেন যে এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে। জানুয়ারীর প্রথম দিকে প্রকাশিত প্রথম সরকারী প্রেসে অভিযুক্ত হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ছিল না। প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রথম বার আসে জানুয়ারীর ২০ তারিখে প্রকাশিত আনুষ্ঠানিক প্রেস রিলিজে।

পরবর্তী ৫ মাস অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে পুরো মামলাটি রেখে দেওয়া হলো। অভিযুক্তদের অবস্থান সম্পর্কে কোন তথ্য দেওয়া হল না। এদেরকে জেল থেকে মিলিটারি জিম্মায় পাঠানো হয়েছিল। বিচার কার্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে পরিচালনার জন্য একটি অধ্যাদেশ জারী করা হলো। সেই স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট এর বিচারক এস এ রহমান, এবং হাই কোর্টের দুজন বাঙালি বিচারক এম আর খান এবং মাকসুমুল হাকিম। একেবারে শুরু থেকেই বুঝা যাচ্ছিল যে মামলাটি রাজনৈতিক। মামলাটির প্রধান প্রমাণ ছিল কয়েকজনের সাক্ষ্য যাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ ছিল এবং বিচারের সময় এরা ‘বিরূপ’ স্বাক্ষীতে পরিণত হচ্ছিলেন।

বিচার শুরু হবার কিছুদিন পর টম উইলিয়ামস কিউসি এমপি নামের একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টারকে লন্ডনস্থ বাঙালিরা ঢাকায় পাঠালেন বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর দলে যোগ দেবার জন্য। সালাম খানের নেতৃত্বে পুরো দলটি ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই ঠিক করা হল যে টম উইলিয়ামস দু’একদিনের মধ্যে বিচারকার্যের ক্রস পরীক্ষণ করবেন এবং এরপর তিনি হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করবেন। আমি উইলিয়ামসের সাথে রিট প্রস্তুতিতে লেগে গেলাম এবং একটি খসড়া প্রস্তুত করা হলো। পিটিশনটি উইলিয়ামস পরিচালনা করলেন এবং হাইকোর্ট একটি রুল জারী করলেন। অবশ্য উচ্চ আদালত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিলেন না। ঐ সময়টায় উইলিয়ামস অভিযোগ করলেন যে তাঁকে পুলিশ এবং গোয়েন্দা লোক দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে আইয়ুবের নজরদারীতে রাখা হয়েছে। তার গাড়ি অনুসরণ করা হচ্ছিলো এবং সবচেয়ে খারাপ ঘটনার মধ্যে ছিল তার ঘরে অনুপ্রবেশ করে লাগেজ এবং কাগজ পত্র তছনছ করা। সপ্তাহখানেক কাটানোর পর তাকে আয়কর পরিশোধের নোটিশও দেওয়া হয়েছিল আর ভীষণ রকমের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল। টম উইলিয়ামসের ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়া উচিত বলে সবাই ঐক্যমত্য প্রকাশ করলেন। তার আগমন এবং মামলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্য মিটে গিয়েছিল। টাইমস (লন্ডন) এর নতুন প্রতিনিধি পিটার হাজেলহার্স্ট এই মামলা এবং টম উইলিয়ামসের ভোগান্তির ওপর সিরিজ রিপোর্ট করে এতে সাহায্য করেছিলেন।

মামলার অগ্রগতি এবং বিচারকার্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জনগণের কাছে প্রবল আগ্রহের বিষয় ছিল। আইয়ুব খান যদি ভেবে থাকেন যে এই মামলা শেখ মুজিবের জন্য অমর্যাদাকর হবে তবে ফল হয়েছিল ঠিক উল্টো। বাঙালির অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে শেখ মুজিব অত্যাচারিত হচ্ছেন বলে তিনি আরো সহানুভূতি পেতে লাগলেন। বাঙালির দুর্দশা ব্যাপক প্রচারও পেয়েছিল এবং এতে তাদের বঞ্চনার বোধও তীব্র হচ্ছিল।

১৯৬৮ এর শুরুর দিকে আইয়ুব মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং এতে প্রশাসনের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কমে গেল। সম্ভাব্য উত্তরসূরি সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেল। আর্মি কমান্ডার-ইন-চিফসহ ভূট্টোর মত পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিরা আইয়ুবের এই দুর্বলতাকে নিজেদের সুযোগ হিসেবে দেখতে লাগলেন।

১৯৬৮ এর শেষের দিকে এসে আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার জন্য দুই পাকিস্তানেই ক্ষোভ যথেষ্ট পুঞ্জিভূত হয়েছিল। ’৬৮ এর নভেম্বরে পেশোয়ারে ছাত্রদের প্রতিবাদে পুলিশের একশনে বেশ কয়েকজন ছাত্র আহত হয়। সে সময় রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থানরত ভুট্টো এই ঘটনাকে লুফে নেন এবং জনঅসন্তোষ ক্রমশ বাড়তে থাকে।

১৯৬৮ এর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এক জনসভায় মওলানা ভাসানী পরবর্তী দিন হরতাল আহবান করেন। সেই হরতালটি ভালভাবেই পালিত হয়েছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রবল উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আলোচনায় বসলেন এবং ১৩ই ডিসেম্বর গোটা প্রদেশে হরতাল ডাকা হল। ৮ই ডিসেম্বর মওলানার আহূত হরতাল সফল ছিল না। মিলিটারির পূর্ণ সহযোগিতায় চলমান জরুরী অবস্থায় রাষ্ট্র যখন সকল সামর্থ্য নিয়ে হরতাল বানচালে উদ্যোগী হয়, তখন এর সার্বিক সাফল্যে সরকারের চেয়ে বিরোধীদের জনপ্রিয়তাই প্রমাণিত হয়। জনগণ অবশ্যই আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত ছিল। ছাত্ররা ছিল সবসময়েই খ্যাপাটে আর সক্রিয়। তারা দ্রুতই পরিস্থিতি অনুযায়ী সাড়া দিয়ে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিজেদের সংগঠিত করে নেয়।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান প্রধান ছাত্রসংগঠন থেকে প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি স্টুডেন্ট একশন কমিটি গঠন করা হয়। ডাকসুর তখনকার সহসভাপতি হিসেবে তোফায়েল আহমেদ এই কমিটির আহবায়ক ছিলেন এবং এর মাধ্যমেই তিনি সবার পরিচিত হয়ে ওঠেন।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবী উত্থাপন করে। এই ১১ দফা বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম দফার অধীনে “টিউশন ফি অর্ধেকে নামিয়ে আনা”, “পলিটেকনিক ছাত্রদের কোর্স সমৃদ্ধকরণ” ইত্যাদি থেকে শুরু করে “শিক্ষার সকল স্তরে মাতৃভাষায় পাঠদান চালুকরণ” এবং “অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং বিনামূল্যেকরণ” এরকম ১৫ টিরও বেশী উপদাবী ছিল। এগুলো পর ছিল সামগ্রিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কিছু দাবী। আওয়ামী লীগের ছয় দফার সারবস্তু এতে অন্তর্ভূক্ত ছিল। তবে উপস্থাপনায় কিছু আকর্ষণীয় পরিবর্তন ছিল। এতে পূর্ববর্তী প্রদেশসমূহে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সাবফেডারেশনের দাবীও ছিল। এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা বিলোপের দাবী ছিল। ছিল নিবর্তমূলক আইনসমূহ বিলোপের দাবি এবং রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি। উল্লেখযোগ্যভাবে ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবী। পররাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সেন্টো, সিয়াটো চুক্তি পরিত্যাগ এবং “পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক চুক্তি” বাতিলের দাবী করে “নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি” অবলম্বনের দাবী করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স এবং পাটসহ সকল বড় বড় শিল্প রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবী ছিল। গরীব কৃষকদের জন্য কর এবং ভূমি খাজনা হ্রাসের দাবী তোলা হয়েছিল। তাদের বকেয়া খাজনা এবং ঋণ মওকুফ করে দিতেও বলা হয়েছিল। আঁটি প্রতি পাটের মুল্য নূণ্যতম ৪০ রুপি নির্ধারণ, শিল্পশ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী এবং অন্যান্য কল্যাণ সুবিধা সহ ‘শ্রমিক বিরোধী বিভিন্ন কালো আইন’ দূর করার দাবী তোলা হয়েছিল। বন্যা প্রতিরোধের ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছিল। এভাবে ১১ দফা দাবীতে প্রকৃতপক্ষে সার্বিক চাহিদা তুলে ধরা হয়েছিল এবং একে সামনে নিয়ে এসে ছাত্ররা তাদের আন্দোলন শুরু করলো।

এমন একটি পূর্ণাঙ্গ দাবীর তাৎপর্য ছিল একাধিক। ছয় দফার অন্তর্ভূক্তিতে বোঝা গিয়েছিল যে এগুলো শুধু একটি রাজনৈতিক দলের দাবী ছিল না বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন এতে সমর্থন দেওয়ায় তা পূর্বপাকিস্তানের জনগণের মৌলিক দাবী হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক দাবী ছুড়ে দিয়ে ছাত্ররা প্রমান করল যে রাজনৈতিক সংগ্রাম সফল হতে হলে তাতে অবশ্যই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে। পররাষ্ট্র বিষয়ক দাবী দেশের জন্য স্বাধীন এবং জোট-নিরপেক্ষ পথে আগানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল।

ঐ সময়টাতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সংগ্রাম চালিয়ে নেওয়ার উপায় সম্পর্কে নানা আলোচনা করছিলেন এবং ছাত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছিলেন। শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের সামনের সারির নেতৃবৃন্দ কারাগারে থাকায় অন্যান্য বিরোধী দলীয় নেতাদের সাথে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব ছিল সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাঁধে। জানুয়ারীর ৬ তারিখ সফলভাবে হরতাল পালনের পর পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলের নেতারা ১০ তারিখে ঢাকায় একটি আলোচনায় বসেন। সেখানে ছিলেন আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (রিকুইজিশনিস্ট), কেএসপি, আওয়ামী লীগ (পিডিএম), কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামাত-ই-ইসলাম, নিজাম-এ-ইসলাম এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের প্রতিনিধিগণ।

আমি করাচীতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় বার কাউন্সিল এর একটি মিটিং থেকে ফিরে দেখলাম যে নেতৃবৃন্দ তখনো সাধারন দাবীর বিষয়ে একমত হতে পারেন নি। ঐক্যমত্যে প্রধান বাধা ছিল পাঞ্জাবী নেতৃবৃন্দের ছয় দফায় অস্বীকৃতি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারেরও চাপ ছিল। প্রস্তাবিত ডেমোক্র্যাটিক একশন কমিটিতে অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে আওয়ামী লীগের দিক থেকে এসব অন্তর্ভূক্ত করার চাপ ছিল।

দুই পাকিস্তানের বিরোধীদলগুলোর এসব বিতর্ক থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে দুই ভাগের রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্য ভিন্ন। এ পর্যায়ে ‘যুক্তরাষ্ট্রিয় সংসদীয় সরকার’-এর দাবী অন্তর্ভূক্ত করে এই বিরূপতা আড়ালে রাখা হয়েছিল। ছাত্রদের ব্যাপক সাড়া পাওয়া ১১ দফা আন্দোলন শুরু হয়েছিল যাতে তারা ৬ দফাকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

আন্দোলনের মাত্রা ক্রমে বাড়ছিল। গঠিত হওয়া ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটি জানুয়ারীর ১৭ তারিখকে “জাতীয় প্রতিরোধ দিবস” হিসেবে ঘোষণা করলো। সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে প্রয়োজন হলে ক্রিমিনাল প্রসিডিউর আইনের ১৪৪ ধারা বা অন্যান্য নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করা হবে। বাস্তবেই ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটির নেতৃবৃন্দ শহরের কেন্দ্র বাইতুল মোকাররমের সামনে জড়ো হয়ে প্রতিকীভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিল্বেন। এটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ছিল কারণ এই প্রথম সাংবিধানিক রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নেতৃবৃন্দ ইচ্ছাকৃতভাবে আইন ভাঙলেন। আন্দোলনের রণোম্মুখ অংশ অর্থাৎ ছাত্ররা প্রতিকী প্রতিরোধে সন্তুষ্ট ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বিরাট মিছিল বের হলো যাতে পুলিশ গুলিবর্ষণ করল। আসাদ নামক একজন তরুণ ছাত্র নিহত হলো। শহীদের রক্ত ছিল গণআন্দোলনের সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্ধন। আসাদের শাহদানের পর ডিএসি’র নেতৃবৃন্দ প্রকারান্তে স্টুডেন্টস একশান কমিটির ওপর আন্দোলনের ভার ছেড়ে দিলেন। পূর্বপাকিস্তান জুড়ে বিক্ষোভ ঘণীভূত হলো এবং জরুরী অবস্থা বলবৎ থাকলেও গণআন্দোলন এবং মিছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। পুলিশের গুলিতে আরো কয়েকজন প্রাণ হারালো এবং পুলিশকে সহায়তা করার জন্য সেনা মোতায়েন করা হলো। কার্যত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রত্যেকটি নির্দেশই প্রতিরোধ করা হচ্ছিলো, জারীকৃত কারফিউ হরহামেশাই ভাঙ্গা হচ্ছিলো, কিছু ক্ষেত্রে আর্মির বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় আর্মি নির্বিচারে গুলি চালালে অনেকেই মারা পড়ছিলো। যাদের মধ্যে ছিল মিছিলে থাকা একটি স্কুলবালক, বাড়ীতে থাকা একজন গৃহবধূ, মায়ের কোলে থাকা একটি শিশু, ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে সরকার পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিলো। গ্রামের দিকে স্থানীয় সংগ্রাআম পরিষদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে পুরোপুরি সরিয়ে দিয়েছিল। শহরাঞ্চলে উচ্চতর মজুরী এবং উন্নত পরিবেশ চাওয়া শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরোধ মীমাংসায় ছাত্র নেতাদেরই ডাকা হচ্ছিলো।

পশ্চিমেও উত্তেজনা গতি পেয়েছিল। মাস কয়েক আগে আর্মির তত্ত্বাবধানে উন্নয়নের দশক উদযাপন করা আইয়ুব সরকার পরিষ্কারভাবেই সবদিক থেকে জনগণের দাবীদাওয়া পূরণের জন্য প্রবল চাপের মুখে পড়েছিলো।

সে সময়ে একটি মোকদ্দমা নিয়ে মনজুর কাদেরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। যিনি তখন আগরতলা মামলার চীফ প্রসিকিউটর হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তিনি চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে বিরক্ত হয়েছিলেন বলে মনে হয়েছিল দেখে আমি তাকে জোর দিয়ে বললাম যে, আইয়ুব সরকার জনগণকে ‘অনেক দেরীতে অল্প কিছু দেবার’ দায় না নিয়ে বরং দেয়াল লিখন গুলো পড়ুক আর জনগণের দাবী মেনে নিক। জবাবে তিনি আইয়ুবকে জনগণের দাবী মেনে নেবার জন্য চাপ দেবেন বলে জানালেন। তবে এরপর তিনি সংবিধানের ১৯৬২ সালের প্রতিরক্ষাকে টেনে আনলেন। তিনি নিজেই এর স্থপতি ছিলেন। চলমান উত্তেজনার সূত্রপাত হিসেবে তিনি ১৯৬২ সালের সংবিধানের কথা বলে নিজেই যেন গণজাগরণের কৃতিত্ব দাবী করলেন।

পরিস্থিতি দেখে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী ফার্স্ট-অফ-দ্য মান্থ সম্প্রচারে ঘোষণা দিলেন যে তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সাথে আলোচনায় বসবেন। এই প্রস্তাবিত আলোচনার নাম দেয়া হল ‘রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স’। তিনি ডেমোক্রেটিক একশন কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানকে ১৯৬৯ এর ১৭ই ফেব্রুয়ারী রাওয়ালপিন্ডিতে আলোচনায় আহবান করে একটি চিঠি ইস্যু করলেন।

এ ঘটনা ছিল একাধারে গণ-আন্দোলন শক্তি এবং আইয়ুবের ক্রগাগত দুর্বলতার প্রমাণস্বরূপ। ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটি আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে মার্শাল ’ল প্রত্যাহার এবং সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি চাইলো। এ প্রেক্ষিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং শেখ মুজিবের মুক্তি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন ছিল এই যে, পূর্ব পাকিস্তানে ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আওয়ামী লীগ পরিস্কারভাবে আলোচনায় বসার ন্যুনতম শর্ত হিসেবে মামলাটি প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তি চেয়েছিলো।

ডেমোক্রেটিক একশান কমিটির পাঞ্জাবী নেতারা এবং প্রকৃতপক্ষে স্বনামধন্য কিছু প্রবীণ বাঙালি নেতারাও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চাপ দিতে গড়িমসি করছিলেন। আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনায় তারা আইনগত জটিলতার বিষয় ইঙ্গিত করে বলছিলেন যে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রত্যাহারের দাবি আলোচনা চলাকালীন সময়েও আদায় করা যাবে। শেখ মুজিব থাকলে যে কোন আলোচনায় ছয় দফাই রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হবে এমন বুঝেই যে তারা বিরোধীতা করছিলেন, এটা পরিষ্কার ছিল। যা হোক, একসময় তারা বুঝতে পারল। বিশেষত অন্যান্য বাণাগ্লি নেতারা বুঝতে পারলো যে শেখ মুজিবের ছয় দফাকে এড়িয়ে যেই মীমাংসাই হোক না কেন বাঙালি তা মেনে নেবে না এবং এতে তারা নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। আওয়ামী লীগও আলোচনার পূর্বে শেখ মুজিবের মুক্তি ব্যাপারে অনড় ছিল। এমন চাপে পড়ে ডেমোক্রেটিক একশান কমিটি আইয়ুবের কাছে বিষয়টি তুলে ধরলেন। আইয়ুব তা প্রত্যাখ্যান করে বললেন, যেহেতু শেখ মুজিব বিচারাধীন রয়েছেন, তাই সেখানে “আইনগত জটিলতা” রয়েছে।

আমি বিরোধী দলীয় নেতাদের বিশেষ করে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়াঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শেই ছিলাম। ১৯৬৬ সালের জুনে যখন তাকে আটক করা হয় এবং ইত্তেফাক বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন থেকে বিষয়গুলো নিয়ে উচ্চ আদালতে আমিই নিযুক্ত ছিলাম। মানিক মিয়াঁর বাড়িটি ছিল বিরোধী দলীয় নেতাদের মিটিঙের স্থান, বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং ছাত্র নেতাদের। মানিক মিয়াঁ শেখ মুজিবের মুক্তি এবং রাউন্ড টেবিলে তার থাকার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার সাথে আলোচনাকালে আমি জানালাম যে মামলাটি বন্ধ করার জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় যা করণীয় তা শুরু করা উচিত এবং এতে শেখ মুজিব কে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে চাপ বাড়বে।

এসব যখন চলছিল, তখন আমি একটি বার্তা পেলাম যে শেখ মুজিব আদালতে আমার সাথে দেখা করতে চান। আমি পরের দিন ত্বরিত আদালত ভবনে তাঁর সাথে দেখা করি। তিনি বিবাদী পক্ষের প্রধান পারিষদ আব্দুল সালাম খান, যিনি আওয়ামীলীগের ভাঙ্গা অংশ পিডিএম’র প্রতিনিধি ছিলেন, তার গৃহীত অবস্থান নিয়ে বেজার ছিলেন। সালাম খান শেখ মুজিবকে চাপ দিচ্ছিলেন রাউন্ড টেবিলে বসার পূর্বশর্ত হিসেবে মামলা প্রত্যাহার এবং তার মুক্তির ব্যাপারে জোর না করার জন্য। এমনকি তিনি প্রচ্ছন্ন হুমকি দিচ্ছিলেন যে শেখ মুজিব এরকম ‘অনড়’ থাকলে তিনি মামলা পরিচালনা করতে পারবেন না। শেখ মুজিব এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আমাকে তাগাদা দিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে মামলার দায়িত্ব নেওয়ার এবং মামলা বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার জন্য। তিনি আরও জানালেন যে প্রয়োজন হলে আমি ইত্তেফাক মামলার কৌশলী এ কে ব্রহীর সাহায্য নিতে পারি। আমি নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করলাম।

আন্দোলন যতই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো, পুলিশসহ গভর্নর মোনায়েম খান আর তার বেসামরিক প্রশাসন ক্রমশ লুকিয়ে পড়ছিল। অদ্ভুতভাবে জেনারেল অফিসার কমান্ডিং জেনারেল মুজাফফরউদ্দীন ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হতে লাগলেন। ধারণা করা হচ্ছিল আর্মির কমান্ডার ইন চীফ ইয়াহিয়া তার জেনারেল অফিসার কমান্ডিং এর মাধ্যমে পরিস্থিতি সরাসরি পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থাক্কে তদারক করতে চাইছিলেন। আমার স্মরণ আছে যে জানুয়ারিতে মানিক মিয়াঁর সাথে মুজাফফরউদ্দীনকে আলোচনা করতে দেখেছিলাম। ইয়াহিয়া খান তাকে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য বলেছেন জেনে তা মানিক মিয়াঁর মনে রেখাপাত করেছিল এবং তিনি নিজেও মনে করেছিলেন যে রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চালানো উচিৎ। ইয়াহিয়াকে কোন মতামত জানাবার থাকলে তিনি তা পৌছে দিতে পারবেন বলেও জানিয়েছিলেন। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ন ছিল যে কমান্ডার ইন চীফ ইয়াহিয়া একাই সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছেন বলে দেখা যাচ্ছিলো। রাজনৈতিক নিষ্পত্তিমূলক আলোচনা শুরু করতে হলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে মুক্ত করার গুরুত্ব এবং এটিই যে একমাত্র উপায় তা জেনারেল মুজাফফরউদ্দীন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বুঝতে পেরেছিলেন। জানা গিয়েছিল যে তিনি তার মতামত ইয়াহিয়াকে জানিয়েছিলেন এবং ইয়াহিয়া ইঙ্গিত করেছিলেন যে যদি আইনগতভাবে শেখ মুজিবের মুক্তির কোনো উপায় থাকে, তাহলে তা বিবেচনা করা যেতে পারে।

এদিকে মানিক মিয়াঁ আমাকে চাপ দিতে লাগলেন মামলাটি বন্ধ করার জন্য আইনগত পদক্ষেপ নেবার জন্য। আমি ব্রহীর সাথে পরামর্শ করার জন্য করাচী গেলাম। পৌঁছুলাম ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে যেদিন সারা দেশজুড়ে হরতাল চলছিল। করাচীতে জীবন যাত্রা থমকে গেছে দেখে ভালই লেগেছিল যদিও হোটেল থেকে ব্রহীর বাড়িতে আমাকে হেটে যেতে হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ব্রহী ট্রায়ালটিকে আইনগত আক্রমণ করার জন্য উপায় নির্ধারনে রাজী হয়ে গেলেন। তবে জানালেন যে কাগজপত্র এবং রেকর্ডকৃত প্রমাণাদি দেখার জন্য তাকে ঢাকায় আসতে হবে। আমি সেদিন সন্ধ্যাতেই আর ব্রহী পরের দিন সকালে ঢাকা চলে এলেন। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেল যে ট্রায়ালটিকে আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করার জন্য একটি শক্ত পয়েন্ট আছে। ততদিনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা হলে ১৯৬২ এর সংবিধান অনুযায়ী মৌলিক অধিকারের প্রবিধান কার্যকর হবে। সেটি হওয়া মাত্র ট্রায়াল সম্পর্কে যুক্তি উপস্থাপন করা যাবে যে আইনের চোখে সমান অধিকারের আলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে এই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল চলতে পারে না। এটি সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি কারণ এটি আইনের চোখে নাগরিকের সমানাধিকারকে ক্ষুণ্ণ করছে। সুতরাং মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ সকলকে মুক্তি দিতে সরকারের জন্য একটি আইনি নোটিশ প্রস্তুত করা হল। ব্রহী এবং আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে সেটি মনজুর কাদেরের নিকট হস্তান্তর করলাম। মনজুর কাদের উল্লেখিত পয়েন্টের সারমর্ম বুঝতে পারলেন এবং টেলিফোনে দ্রুত আইয়ুবের সাথে যোগাযোগ করবেন বলে জানালেন।

এ বিষয়ে যখন মনফজুর কাদেরের সঙ্গে আলোচনা চলছিল তখন তার কাছে একটি টেলিফোন আসে এবং কথা বলার সময় টেলিফোনে প্রাপ্ত খবর শুনে তাকে বিরক্ত দেখাচ্ছিল। তাকে এইমাত্র জানানো হল যে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে একজন মিলিটারী গার্ড গুলি করে হত্যা করেছেন এবং আরও দু’জন আহত হয়েছেন। তার উত্তেজনা দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছেন। স্পষ্টতই এ খবর বাইরে ছড়ালে জনরোষ বাড়বে। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই মর্মাহত ছিলাম কারন সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন আমার এক সহকর্মী এডভোকেট আমিনুল হকের ভাই যাকে মাত্র কয়েকদিন আগে কথা দিয়েছিলাম যে তার ভাইয়ের পক্ষে কোর্টে উপস্থাপনের জন্য কিছু যুক্তি প্রদান করব। প্রদত্ত নোটিশটি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার গুরুত্ব সম্পর্কে মনজুর কাদেরকে সচেতন দেখা গেল।

জহুরুল হকের দাফনের সময় ঠিক হল বিকেলে। পল্টনে জানাজা শেষ করেই কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে আমি আজিমপুর কবরস্থানের দিকে গেলাম। অন্তত দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেল কিন্তু লাশ তখনো এলো না। এতে উদ্বেগ বাড়তে লাগলো। জানা গেল যে মিছিলকারীরা মন্ত্রীদের বাসভবন এলাকায় যখন এক মন্ত্রীর বাগান থেকে ফুল ছিঁড়তে যান, তখন তাঁদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে মিছিলকারীরা ক্ষেপে যান এবং পরে তাঁরা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রিসাইডিং জাজ ও মন্ত্রীদের বাসাসহ অন্যান্য সরকারি বাসভবনেও হামলা করেন এবং আগুন জ্বালিয়ে দেন।

দাফন হওয়া মাত্র আমি ব্রহীর হোটেলের দিকে এগুলাম এবং পথে যেতে যেতে দেখলাম বেশ কিছু বাড়ি জ্বলছে। ব্রহীর ওখানে আমি মনজুর কাদেরকেও পেলাম। তিনি বললেন যে রাওয়ালপিন্ডিতে তিনি কথা বলেছেন কিন্তু কোনো জবাব আসে নি। জহুরুল হকের মৃত্যুতে জনগণের আবেগ দেখে মনজুর কাদের এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে বিচারটি আর চলতে পারে না যেখানে প্রিসাইডিং জাজের বাসভবন পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। মনজুর কাদের ব্যক্ত করলেন যে ট্রায়াল চালিয়ে নেয়া বাস্তবসম্মত হবে না। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি বললেন, বিচারটির উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে বুঝানো যে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দোষী এবং তাদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু যেখানে জণগণ তাদের মত করে বুঝে নিয়েছে এবং তাদের আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ‘দোষী নয়’ বরং “বীর” সেখানে বিচারটি চালানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। ঠিক করা হল যে ব্রহী এবং মনজুর কাদের দু’জনই পরের দিন সকালে রাওয়ালপিন্ডি ফিরে যাবেন এবং লিগ্যাল নোটিশটি আমলে নিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিব ও অন্যান্য বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে আশ্বস্ত করবেন। এরপর দুই দিন চলে গেল তবু কোনো খবর আসছিল না। ব্রহী করাচী চলে গেলেন এবং আমাকে টেলিফোনে জানালেন যে নোটিশটি এখনো আইন মন্ত্রণালয় খুটিয়ে দেখছে।

স্বাভাবিকভাবেই ১৭ই ফেব্রুয়ারি রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স শুরু হল না এবং আমাকে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে শেখ মুজিবের মুক্তি আদায়ের জন্য চেষ্টা করতে রাওয়ালপিন্ডি যেতে অনুরোধ করা হচ্ছিলো। কারাগার থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া তাজউদ্দীন আহমেদ, আমিরুল ইসলাম এবং আমি ফেব্রুয়ারীর ১৭ তারিখে রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছুলাম। যেহেতু শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছিল না এবং ফলস্বরুপ ডেমোক্রেটিক একশান কমিটিও আলোচনায় বসছিল না তাই সবদিকে একটা সংকটময় পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। অবস্থা জানতে বিরোধী দলের আইয়ুব মানজার বশির, একজন এডভোকেট, স্বপ্রণোদিত হয়ে আইন মন্ত্রী জাফর এর সাথে গভীর রাতে দেখা করতে গেলেন। একেবারে মধ্যরাতে কেউ আমাকে বলল যে তিনি পরের দিন সকালেও জাফরের সাথে দেখা করতে যেতে পারতেন। জাফর “আইনগত জটিলতা” জাতীয় কিছু চেঁচামেচি করলেন কিন্তু যখন তাকে লিগ্যাল নোটিশের জবাব দিতে বলা হল তখন তিনি জানালেন যে বিষয়টা শুধু আইনী নয় বরং উপর মহলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও বটে।

তাকে বুঝানো হল যে আইনী নোটিশে একটি পরিষ্কার জবাব চাওয়া হয়েছে এবং এতে দেরী করা উচিত নয়। তিনি বললেন যে সেদিন সকালেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং দুপুরেই একটি জবাব তিনি আমাকে দিবেন। তিনি আরো একটি নোটিশ অথবা আগের নোটিশটির সামারীও চাইলেন। ১ ঘন্টার মধ্যে তাঁকে আরেকটি নতুন নোটিশ দেয়া হলো। সাড়ে ১২ টার জাফর আমাকে টেলিফোন করে তার হোটেলে দেখা করতে বললেন। সেখানে তিনি আমাকে জানালেন যে সুদীর্ঘ আলোচনা শেষে মন্ত্রণালয় না বোধক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে অর্থাৎ নোটিশে প্রদত্ত চাহিদা তারা মেনে নিবেন না। শুনে আমি ক্রুব্ধ হলাম এবং সেখানে উপস্থিত মনজুর কাদেরকে আমার অনুভূতি জানালাম। তিনিও সরকারের এহেন আচরণে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি বিকেলে আমার সাথে কথা বলবেন জানিয়ে জাফর এর সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।

সেদিন বিকেলে মনজুর কাদের টেলিফোন করে আমাকে একই হোটেলে তার কক্ষে দেখা করতে বললেন। তিনি যখন রুমে ঢুকছিলেন তখনি জাফর সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তারা (মনজুর কাদের এবং জাফর) প্রস্তাব দিলেন যে সরকার একটি ঘোষণা করতে প্রস্তুত যে শেখ মুজিব ‘মুক্ত মানুষ’ হিসেবে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগ দিতে পারবেন। যখন আইনী দিকটার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম তখন জাফর কাচুমাচু হয়ে বললেন যে এই একটি মাত্র পথেই সরকারকে তিনি রাজী করাতে পারবেন। তারা আমাকে শেখ মুজিবের কাছে বার্তাটি পৌছে দিতে বললেন।

তাজউদ্দীন, আমিরুল ইসলাম এবং আমি লাহোর এবং করাচী হয়ে ঢাকা ফিরে এলাম। কারণ পরের দিন সকালে ঢাকায় আসার জন্য সেটাই একমাত্র পথ ছিল। লাহোর এয়ারপোর্টে আসগর খান এবং করাচীতে ব্রহীর সাথে আমাদের দেখা হলো। আসার আগে মনজুর কাদের আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে তিনি সন্ধ্যায় আইয়ুবের সাথে আবারো দেখা করে নোটিশের দাবী মেনে নেবার জন্য চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে দেখবেন।

ফেব্রুয়ারীর ১৮ বা ১৯ তারিখের রাত। করাচী এয়ারপোর্ট থেকে মনজুর কাদেরকে একটা টেলিফোন করা হলো। মনজুর কাদের জানালেন যে আইয়ুবের সাথে দেখা করার জন্য তিনি সন্ধ্যা থেকে বসে আছেন কিন্তু তাকে বলা হয়েছে যে আইয়ুব একটি মিটিঙে আছেন। মধ্যরাত পার হয়ে গেলেও আইয়ুবের মিটিং শেষ হচ্ছে না দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন যে শুধু সে বারই তিনি আইয়ুবের সাথে দেখা করতে চেয়েও পারলেন না। তিনি চুপিসারে বললেন যে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে হয়তো খুবই গুরুত্বপূর্ন কোন মিটিং চলছে।

পরে জানা গিয়েছিল, সেটি ছিল একটি ভাগ্য নির্ধারনী মিটিং যেখানে আইয়ুব তার তিনজন সার্ভিস চীফকে ডেকেছিলেন। আইয়ুব তার সার্ভিস চীফদের মার্শাল ‘ল সমর্থনে প্ররোচিত করলেন এবং গণআন্দোলনকে মিলিটারী মোতায়েন করে দমন করতে বললেন। সার্ভিস চীফেরা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অবশ্যই আইয়ুবের রাজনৈতিক দায় ছিল এবং ঘটনাপ্রবাহে দেখা যাচ্ছিল যে ইয়াহিয়ারও নিজস্ব উচ্চাকাংঙ্ক্ষা ছিল। যদি জনগণকে দমন করার জন্য আর্মি ব্যবহার করা হয় সেটি আইয়ুবের ক্ষয়িষ্ণু সরকারের সাহায্যার্থে নয় বরং ইয়াহিয়া এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদেরই উদ্দেশ্য সাধন করবে।

আইয়ুব এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের সাথে ১৯৬৯ এর ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিত বৈঠক সম্পর্কিত রিপোর্টে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টার স্বীকারোক্তিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ

“১৯৬৯ এ আমি যখন ইয়াহিয়ার মন্ত্রিপরিষদে যোগদান করি, তখন তার কাছ থেকেই জানতে পারি যে, ১৯৬৯ এর ফেব্রুয়ারীতে আইয়ুব এবং সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের দফায় দফায় মিটিং হয়েছিল। জেনারেল আকবর এবং প্রেসিডেন্টের কতিপয় হাউজ স্টাফও এর সত্যতা প্রদান করেন যারা অনেক “ভেতরের খবর”-ও জানতেন। আর্মি, নেভি এবং বিমান বাহিনীর প্রধান এবং তাদের সহযোগীগণ আইয়ুবের সাথে আলাদা আলাদাভাবে এবং যৌথভাবে মিটিং করেছিলেন। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন মিটিংটি ছিল মধ্য ফেব্রুয়ারীতে যেখানে তিন বাহিনী প্রধান (জেনারেল ইয়াহিয়া, এয়ার মার্শাল নূর খান এবং ভাইস এডমিরাল আহসান) আইয়ুবকে বিপ্লবী আন্দোলন দমন করার জন্য মিলিটারীর ওপর নির্ভর না করে ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি’ নিয়ে ভাবতে বলতে নিয়েছিলেন। এই মিটিঙে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টি ছিল, বসের নিকট এই অপ্রিয় সত্যটুকু কে বলবেন? সেখানে ইতস্তত বোধ এবং নীরবতা ছিল। নেভির আহসান এই উদ্যোগ নিলেন না কারণ তিনি তার নিরপেক্ষ ভাব ধরে রাখতে চান। ইয়াহিয়ার জন্য সময়টা কঠিন ছিল কারণ আইয়ুব তাকে কয়েকজন সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙ্গিয়ে কমান্ডার ইন চীফ করেছিলেন। শেষ মেশ দায়িত্বটি পড়ল স্পষ্টবাদী এয়ার ফোর্স চীফ নূর খানের ঘাড়ে। প্রশাসন কাজকর্ম চালিয়ে নেবার জন্য এবং ধারণাগতভাবে ভারতের মত বিদেশী শক্তি যাতে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে না পারে তাই ন্যুনতম সংখ্যক সেনা মোতায়েনে আর্মি চীফ রাজী ছিলেন।“

রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার পরামর্শ আইয়ুবের কাছে নিঃসন্দেহে একটি অভিঘাত ছিল। বিগত ১৮ বছর ধরে (১৯৫০-৬৮) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান থাকায় সকলেই তাকে সম্মান করতেন। এ নিয়ে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে তিনি একবার বলেছিলেন যে “ওরা হয়ত আমার চেহারা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছে।“

যখন আইয়ুব এবং সার্ভিস চীফের মধ্যে এই অপ্রত্যাশিত আলোচনা চলছিল আমি তখন শেখ মুজিবকে জানাবার জন্য রাওয়ালপিন্ডি থেকে খবর নিয়ে ঢাকায় আসছিলাম।

এয়ারপোর্টে নামামাত্র মানিক মিয়াঁ আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন এবং আমরা ক্যান্টনমেন্টে রাওনা দিলাম। যখন শেখ মুজিবকে জাফরের প্রস্তাব জানানো হল যে তিনি ‘মুক্ত মানুষ’ হিসেবে ঘোষিত হয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে যেতে পারবেন শেখ মুজিব তা অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাবনা বলে তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, জহুরুল হককে যেখানে মেরে ফেলা হয়েছে সেখানে জিম্মা থেকে পলায়নপর অবস্থায় তিনি কিভাবে যাবেন যখন যে কেউ তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে। তিনি বললেন, তাদেরকে মামলা নিস্পত্তির জন্য যে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে তাঁদেরকে সেটার উত্তর দিতে হবে। তিনি আরও বললেন যে অন্যদেরকে বন্দী অবস্থায় রেখে তিনি কিছুতেই যাবেন না।

যখন আমি জেনারেল মুজাফফরুদ্দীনকে এসব জানালাম, তখন তিনি বললেন, জাফরের সাথে তিনি টেলিফোনে কথা বলবেন। জাফরকে বলা হল যে তার দেওয়া ফর্মুলা শেখ মুজিবের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। হয় তিনি নোটিশ গ্রহণ করবেন অথবা হাইকোর্টে কার্জক্রম চলবে এবং হাইকোর্ট হয়তো মুক্তির আদেশ দিবে। জাফর বললেন যে তিনি কিছু সময় পর টেলিফোন করবেন। তিনি টেলিফোন করে বললেন যে হাইকোর্টের প্রক্রিয়া সময়ক্ষেপণকারী এবং এর পরিবর্তে ট্রাইব্যুনালকে কার্যকর করে শেখ মুজিবের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন মুক্তির আদেশ চাওয়া যেতে পারে। এটি হবে জামিন প্রকৃতির।

শেখ মুজিবকে এসব জানানো হল। তিনি বললেন, এখানে জামিনের প্রশ্ন অবান্তর। ইতোমধ্যে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের দু’জন বাঙালি বিচারপতি এবং একজন প্রসিকিউটিং আইনজীবীকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হলো। তারা প্রস্তাব করলেন যে শেখ মুজিবকে জামিনে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। যখন সহকর্মী আমিরুল ইসলাম শেখ মুজিবকে এটা জানালেন, তিনি তখন কঠোরভাবে জামিনে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। আমিরুল যখন তার সাথে কথা বলছিলেন তখন শেখ মুজিবকে জামিনে মুক্তি দেয়া হচ্ছে মর্মে একটি রিপোর্ট সম্প্রচারিত হচ্ছিল। সেটা শুনে শেখ মুজিব রেগে আগুন হয়ে গেলেন।

শেখ মুজিব মুক্তি পেতে যাচ্ছেন শুনে হাজার হাজার মানুষ ঐদিন সন্ধ্যায় এয়ারপোর্ট রোড ধরে পায়ে হেঁটে ক্যান্টনমেন্টের দিকে আসতে লাগল। আর এদিকে শেখ মুজিবের জামিনে মুক্তিতে কঠোর প্রত্যাখ্যানের খবর পেয়ে একটি মিলিটারী গাড়ী লাউড স্পিকার নিয়ে জনগণের কাছে ছুটে গিয়ে জানাতে লাগলো যে ঐদিন সন্ধ্যায় কোনো মুক্তি হচ্ছে না। ইতোমধ্যে আইয়ুবের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য খাজা শাহাবুদ্দীন এবং এডমিরাল এ আর খান ঢাকায় এসে পৌছলেন। শেখ মুজিবের অবস্থান সম্পর্কে ট্রাইব্যুনালের কাছে আমাদের রিপোর্টের কথা শেখ মুজিবকে জানিয়ে আমরা যখন ফিরছিলাম, তখন এডমিরাল এ আর খান এবং খাজা শাহাবুদ্দীনকে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলার জন্য প্রবেশ করতে দেখলাম।

এটা পরিষ্কার ছিল যে আইয়ুব বিপদে ছিলেন। স্পষ্টতই সার্ভিস চিফগণ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে মিলিটারী অপশন তার কাছে খোলা ছিল না। তাই তাকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আপোষে আসতে হবে। এটি তখনি সম্ভব যদি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে শেখ মুজিব ছাড়া কোনো সমঝোতা গ্রহণযোগ্য হবে না।

পরের দিন সকালে সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকায় খবর ছড়িয়ে পড়লো যে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তারা এক মাস আগে দেওয়া লিগ্যাল নোটিশের ফর্মুলাতেই গিয়ে ঠেকেছেন যে ট্রায়ালটি সাংবিধানিকভাবে অবৈধ এবং তা ভেঙ্গে দিতে হবে।

শেখ মুজিব একজন জাতীয় বীর এবং পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের প্রশ্নাতীত নেতা হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন, ঢাকায় একটি জনসভা করে জনগণের মেন্ডেট নিয়ে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে রাউন্ড টেবল বৈঠকে অংশ নিতে যাবেন। দশ লাখের বেশী মানুষের সমাগমের এক বিশাল জনসভা তাকে তার ছয় দফার স্বায়ত্বশাসনে সমর্থন জানালো এবং তাকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধীতে ভূষিত করলো।

শেখ মুজিব এরপর রাউন্ড টেবল কনফারেন্সে অংশ নেবার দায়িত্বভার নিলেন যেখানে তিনি বাঙালি জনগণের দাবিদাওয়া তুলে ধরবেন বলে জানালেন। তিনি জানালেন যে এসব দাবিদাওয়া যদি গৃহীত না হয় তবে তিনি ফিরে আসবেন এবং আন্দোলন চালিয়ে যাবেন কিন্তু আপোষ করবেন না।

পার্টির নেতৃবৃন্দদের নিয়ে রাউন্ড টেবল কনফারেন্সের উদ্বোধনী অধিবেশনে অংশ নেবার জন্য রাওয়ালপিন্ডি রওনা দিলেন। আমাকে দলটিতে অংশ নেবার জন্য বলা হয়েছিল। ঘটনাক্রমে, ভুট্টো এবং শেখ মুজিব লাহোরগামী প্লেনে একই বিমানে চড়েছিলেন। ভুট্টো এবং তার সহযোগীরা ছিলেন প্রথম শ্রেনীতে। আর শেখ মুজিব এবং তার প্রতিনিধি দল ছিলেন ইকোনমি শ্রেনীতে। এতে শেখ মুজিবের দল যে আমজনতার পার্টি এবং পিপলস পার্টি ‘বড় লোকদের পার্টি’ তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার সুযোগ এসেছিল। ভুট্টো ঢাকায় শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন যে তিনি রাউন্ড টেবল কনফারেন্সে (আরটিসি) অংশ নেবেন না কারণ এটি বিফল হতে বাধ্য। এখানে উল্লেখ্য যে মওলানা ভাসানীও একই অবস্থান নিয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ে ফেব্রুয়ারিতে মওলানা ভাসানী এবং নওয়াবজাদা নসরুল্লাহর মিটিঙয়ে মওলানা যখন পুনর্ব্যক্ত করছিলেন যে তিনি আরটিসি তে যাবেন না, তখন তিনি এও বলেছিলেন যে তিনি এটির সাফল্য কামনা করেন এবং এতে যদি ভাল কিছু হয় তার অংশীদার তিনি হবেন। তখন তিনি আরটিসির জন্য দু’হাত তুলে প্রার্থনা করেছিলেন।

লাহোরে ভুট্টো এবং শেখ মুজিব প্রতিনিধিদলগণকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য দুটো আলাদা দল এলো। শেখ মুজিবকে অভ্যর্থনা জানালেন এয়ার মার্শাল আজগর খান এবং জেনারেল আজম। ভুট্টো চাইলেন যে শেখ মুজিব তার সাথে একত্রে প্লেন থেকে নামুক। কিন্তু শেখ মুজিবকে অভ্যর্থনা জানাতে আসা লোকেরা তার বিরোধীতা করলেন। ফলে ভুট্টো প্লেন থেকে নেমে একটি ট্রাকে চেপে এয়ারপোর্ট ত্যাগ করলেন। তার পেছনে মোটামুটি ভীড় ছিল। এরপর শেখ মুজিব এবং তার দল নেমে এলেন এবং বিশাল মিছিল নিয়ে শহরের দিকে যাত্রা করলেন। একটি সংক্ষিপ্ত পথসভারও আয়োজন করা হয়েছিল।

দলটি সেদিন সন্ধ্যায় রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছুল। ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটির (ডিএসি) একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে তবে সময় সংক্ষিপ্ততার কারণে সেটা কোন ফলপ্রসূ আলোচনা ছিল না। পরদিন সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাউন্ড টেবল কনফারেন্স শুরু হলো। যেহেতু ঈদ উল আজহা সমাগত ছিল এবং অংশগ্রহনকারী দলগুলোর মধ্যেও পরামর্শের প্রয়োজন ছিল, তাই সকলের সম্মতিতে ১০ দিন মূলতবী নিয়ে মার্চের ১০ তারিখ পুনরায় বসার সিদ্ধান্ত হল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে রাউন্ড টেবল কনফারেন্স শুরু হবার দু’দিন পূর্বে ডেমোক্র্যাটিক একশন কমিটি অংশগ্রহণকারীদের পরামর্শ দেবার জন্য এবং সাধারন নেগোসিয়েশন অবস্থানে আসার জন্য সম্মিলিত হবে।

ঢাকা ফিরে শেখ মুজিব বললেন আমি যেন বিশেষজ্ঞদের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপের (প্রধানত অর্থনীতিবিদ এবং অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ) সাথে বসে ছয় দফার আলোকে সংবিধান প্রনয়নের জন্য প্রস্তাবনা নির্ধারন করি। ছয় দফা অকার্যকর এবং একে ঘিরে কোনো ফেডারেল কাঠামো তৈরি সম্ভব নয়, এমন সমালোচনার জবাব দেবার জন্য এটা দরকারী ছিলো। ওয়ার্কিং গ্রুপটির কয়েকটি মিটিঙয়ে সুনির্দিষ্ট সংবিধান প্রস্তাবনা এবং বিকল্প আলোচনার অবস্থান নির্ধারন করা হয়েছিল। সম্ভাব্য বিরোধীতা অনুমান এবং তার জবাব প্রস্তুত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

৬ই মার্চ, ১৯৬৯ এ শেখ মুজিব তার সহকর্মীদের নিয়ে লাহোরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আমাকে লাহোরে প্রতিনিধিদলে যোগদান করতে এবং রাওয়ালপিন্ডিতে উপদেষ্টা হিসেবে অংশ নিতে বলা হল। আরো মনে করা হয়েছিল যে ডঃ সারোয়ার মুর্শীদ এবং ডঃ মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে প্রতিনিধি দলে অংশ নিতে অনুরোধ জানানো হতে পারে। লাহোরে পৌঁছে বুঝা গেল যে বিভিন্ন অংশ থেকে আগত প্রতিনিধি থাকার কারণে একটি সাধারন ফরমানে দাবী দাওয়া উত্থাপন করা বেশ কঠিন। কারণ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত নেতৃবৃন্দের মাঝে ক্রমশ মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছিলো।

শেখ মুজিব ডিএসি মিটিঙে অংশ নেন নি, তিনি অসুস্থতা দেখিয়ে হোটেলেই ছিলেন। আসলে সাধারণ দাবীনামায় ছয় দফার অন্তর্ভূক্তিতে পাঞ্জাবী নেতাদের প্রবল বিরোধীতার কারণে তিনি আলোচনা থেকে দূরে থাকতে চাইছিলেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ যুক্তি দেখালো যে ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটির ঐকমত্যের আট দফার মধ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা ভাঙ্গার শর্ত অন্তর্ভুক্ত। কারণ ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটি ‘ফেডারেল পার্লামেন্টারী সরকার’ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। “ফেডারেল” চরিত্র মানে কী, তার ব্যাখ্যা চাওয়া হল এবং এ উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং এক-কেন্দ্রিক ব্যবস্থার বিলোপন সম্পর্কে ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটির নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা প্রয়োজন ছিল। একজন পাঞ্জাবী সাবেক উর্ধ্বতন বেসামরিক কর্মকর্তা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মুহাম্মদ আলী বরাবরই আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং এক-কেন্দ্র বিলোপের বিরোধীতা করে আসছিলেন। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, কমন চার্টারে “ফেডারেল” বলতে কী বুঝানো হয়েছে, তখন তিনি বললেন যে সবাই এর অর্থ জানে এবং দরকার হলে অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে এর অর্থ দেখা যেতে পারে! শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ, ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টির সমর্থন নিয়ে গোঁ ধরে বসলো যে সাধারণ দাবীনামায় স্বায়ত্ত্বশাসন অন্তর্ভুক্ত না করলে তারা রাউন্ড টেবল কনফারেন্সে অংশ নিবেন না। তারা দেখালেন যে রাউন্ড টেবল কনফারেন্স আহবান করা হয়েছে গণআন্দোলনের মুখে। এই আন্দোলন ১১ দফাতে তাদের সংবিধান বিষয়ে দাবী পেশ করেছে। এতে ছয় দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা বিলোপনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটিতে এমন মেরুকরণের কারনে চেম্বার হাউজে তাড়াহুরো করে একটি ইস্ট পাকিস্তান রিজিওনাল ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটির সভা আহবান করা হল। বাঙালি প্রতিনিধিগণ উপলব্ধি করেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জনমত এবং ১১ দফা আন্দোলনের গতিতে বাঙালিদের একটি সাধারন দাবী থাকা উচিত এবং সেটি হল পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন। ঐক্যমতের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটির নিকট পাঁচটি সুপারিশ দেওয়া হলো। এই পাঁচটি সুপারিশের মধ্যে ছিল পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন এবং এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেবার দাবী। কেন্দ্রীয় ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে এগুলো মেনে নেওয়া যায় কিনা, তা খুঁজতে লাগলো। তবে তা কার্যকর হয় নি। কারণ পাঞ্জাবি নেতারা ছয় দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের শক্ত বিরোধীতা করে আসছিলো। মেটাফিজিক্স এবং জুরিসপ্রুডেন্স দেখিয়ে তর্ক করা হল যে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটি কিংবা আইয়ুবের আইনসভা কোনোটারই সিদ্ধান্ত দেয়ার ‘এখতিয়ার’ নেই। এর বিপক্ষে যুক্তি এলো যে, যেহেতু প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধনীগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য ডেমোক্র্যাটিক একশান কমিটি এবং আইয়ুবের আইনসভারএ খতিয়ার রয়েছে, তাই আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন নিয়ে কাজ করার যোগ্যতাও তাদের রয়েছে।

ইতোমধ্যে আমি ভাবছিলাম যে আমাদের বিশেষজ্ঞ দলকে আরও শক্তিশালী করার জন্য এই দলে কিছু অর্থনীতিবিদ অর্ন্তভূক্ত করা দরকার। সেই লক্ষ্যে ইসলামাবাদের তৎকালীন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আনিছুর রহমানকে লাহোরে আমাদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানানো হলো। তার সাথে অধ্যাপক ওয়াহিদুল হক, যিনি ইসলামাবাদে ছিলেন এবং ইতোমধ্যেই ঢাকা থেকে আগত ড. মোজাফফর আহম্মেদ চৌধুরী পরের দিনই আমাদের দলে যোগ দিলেন।

৮ মার্চ সন্ধ্যায় সাব-কমিটির মধ্যে বিরাজমান অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে মাওলানা মওদুদী, মমতাজদৌলতানা ও চৌধুরী মুহাম্মদ আলীসহ পাঞ্জাবের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের কক্ষে আসলেন এবং বললেন যে, “ছয় দফা” স্বায়ত্বশাসনের দাবী আমাদের সাধারন দাবীনামার অংশ হওয়া উচিৎ নয়। শেখ মুজিব তাঁর দাবীতে অটল ছিলেন। তিনি এবং তাঁর দল “ছয় দফা” ফর্মূলার উপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবী উত্থাপন করতে না দিলে গোল টেবিল বৈঠকে অংশ গ্রহন করবেন না। “ছয় দফা” ফর্মূলা অকার্যকর বলে যখন কিছু পাঞ্জাবী নেতা কথা বলছিলেন, তখন শেখ মুজিব বললেন যে, তিনি সাথে করে একটি বিশেষজ্ঞ দল নিয়ে এসেছেন। যারা তাদের (পাঞ্জাবী নেতাদের) নির্বাচিত যে কোন বিশেষজ্ঞ দলের সাথে ‘ছয় দফা’ ফর্মূলা প্রয়োগের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য প্রস্তুত। তখন আমাদের পাঠানো হলো। কারণ এই মুহূর্তটার জন্যেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর ও শেখ মুজিবের বিশেষজ্ঞ দলের মাঝে একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। বৈঠক শেষে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী বলেন যে, বিষয়টি তার জন্য ‘খুবই জটিল’ এবং ‘দুর্ভাগ্যবশত’ তাদের হাতে এত বিশেষজ্ঞ নেই।

একদিকে ‘ছয় দফা’-র ভিত্তিতে স্বায়ত্বশাসনের দাবী সাধারন দাবিনামার অংশ না করার সিদ্ধান্তে পাঞ্জাবী নেতৃবৃন্দ অনড়, অন্যদিকে শেখ মুজিব আপসহীন থাকায় একটি অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো। তিনি ইঙ্গিত করলেন যে, “ছয় দফা” সাধারন দাবিনামার অর্ন্তভুক্ত করা না হলে তিনি পরের দিন সকালে রাওয়ালীপিন্ডির গোল টেবিল বৈঠকে অংশ না নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাবেন। এদিকে পাঠান ও বেলুচ নেতারা ‘ছয় দফা’-কে সাধারন দাবিনামাতে অর্ন্তভূক্তির ব্যাপারে সমর্থন প্রদানের জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়া সংক্রান্ত তাঁদের দাবীকে সমর্থন দেয়াতে বাঙালিদের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এয়ার মার্শাল আজগর খানের মধ্যস্থতায় ৮ মার্চের সমস্ত বিকেল নিবিড় আলোচনার পর অবশেষে একটি আপস ফর্মূলা খুজে বের করা হয় যে, সর্বদলীয় কমিটি একটি সংক্ষিপ্ত সাধারণ দাবীনামা প্রস্তাব করবে। তবে প্রত্যেক দল তাদের নিজ নিজ দাবীগুলো পৃথকভাবে উপস্থাপনের সুযোগ পাবে। এর মাধ্যমে শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ তাদের দাবীগুলো গোল টেবিল বৈঠকে তুলে ধরার সুযোগ পাবে। এই শর্তে শেখ মুজিব গোল টেবিল বৈঠকে অংশ গ্রহনে সম্মত হলেন।

৯ মার্চ শেখ মুজিব বাস যোগে রাওয়ালীপিন্ডি রওয়ানার আগে আমাদেরকে ‘ছয় দফার’ উপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন সংক্রান্ত দাবীর একটি বোধগম্য বিবৃতি তৈরীর নির্দেশনা দিলেন। ফেডারেল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও প্রাপ্ত বয়ষ্কদের ভোটে সরাসরি নির্বাচনের সাধারণ দাবীর প্রতি সমর্থন প্রদানের পাশাপাশি ‘ছয় দফা’ ফর্মুলায় নির্দেশিত আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবীর বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে সারা দিন কাজ করে খসড়া প্রনয়ণপূর্বক ৯ মার্চ সন্ধ্যায় খসড়াটি রাওয়ালীপিন্ডিতে নেয়া হয়। এই বিবরণীতে বিশেষজ্ঞ দল কর্তৃক প্রণীত ‘ছয় দফা’ ফর্মুলার পয়েন্টগুলোর প্রত্যেকটি সবিস্তারে ও পুঙ্খনুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা হয়। এক কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে জনসংখ্যার অনুপাতে ‘এক লোক-এক ভোট’-এর মাধ্যমে ফেডারেল সংসদের জনপ্রতিনিধিত্ব নির্ধারণের দাবীর পক্ষে একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। আওয়ামী লীগের যৌক্তিক দাবীসমূহকে দরকষাকষির মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্যে শেখ মুজিব সব পক্ষ থেকে মনোনীত অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করলেন। যারা ‘ছয় দফা’ ফর্মুলার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন প্রয়োগের যথার্থতা খুঁজে বের করবে। এরকম আলোচনার জন্য তার বিশেষজ্ঞ টিম পুরোপুরিভাবে তৈরী ছিল। বিশেষজ্ঞরা ছাড়াও তদানীন্তন পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব ইকনমিকস ডেভেলপমেন্টস এর পরিচালক ড. নজরুল ইসলামকে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। যেন তিনি বিশেষজ্ঞ টিমের সাথে যোগ দিয়ে কমিটির আলোচনা চালিয়ে নিতে পারেন।

রাওয়ালপিন্ডি এসে দেখলাম যে এখানে মনজুর কাদেরও উপস্থিত। সে আমার সাথে যোগাযোগ করল এবং আমাকে অবহিত করল যে, আইয়ুব খান তাঁকে তার উপদেষ্টা হিসেবে রাওয়ালপিন্ডি ডেকে এনেছেন। তখন শেখ মুজিবের প্রস্তাব এবং সেটি বাস্তবায়নের কথা তাকে জানানো হলো। তিনি আনন্দের সাথে জানালেন যে এরকম একটা কমিটি গঠিত হওয়াই ভালো এবং সম্ভবত তিনি সেখানে সরকার পক্ষের একজন হবেন।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দেখা গেল, পাঞ্জাবীরা তাদের পূর্বের অবস্থানে অনড়। এমনকি তারা ‘ছয় দফা’ ফর্মূলা নিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানাল। পাঞ্জাবের বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খান ও তার আ্ইন মন্ত্রী জাফরের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করছিল। বস্তুতপক্ষে আইয়ুব খান নিজে আপত্তি উত্থাপনের আগেই চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ‘ছয় দফা’ ফর্মুলার বিরোধীতা শুরু করেন। উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, গণতান্ত্রিক এ্যাকশন কমিটির ফেডারেল সংসদীয় সরকারব্যবস্থার দাবী সংখ্যাসাম্যর ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধিত্বের পরিবর্তন কিংবা এককেন্দ্রিয় শাসনব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেয়া নির্দেশ করে না। তিনি আরো বলেন, এ প্রশ্নে গোল টেবিল বৈঠকে আলোচনা হতে পারে না।

তদকালীন পাকিস্তানের প্রাদেশিক অর্থমন্ত্রী ড. নুরুল হুদা আ্ইয়ুব খানের বিশেষজ্ঞ টিমের একজন সদস্য ছিলেন। উনি আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন এবং সরকারি শিবিরে কী ঘটনা ঘটছে, সে সম্পর্কে কিছু ‘গোপনীয় তথ্য’ দিলেন। তার মতে উল্লিখিত বিষয়ে সরকারি শিবির দুই ভাগে বিভক্ত। যাদের নিজেদের মধ্যে প্রচুর মতপার্থক্য বিদ্যমান। দোহার সমর্থনপুষ্ট জাফর এবং এ্যাডমিরাল এ, আর, খান যারা বাজপাখি (Hawks) বলে পরিচিত, তারা স্বায়ত্বশাসন ও এককেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থা ভাঙ্গার দাবী কিছুতেই মেনে নিতে রাজি নয়। এমনকি তারা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনেরও বিপক্ষে। ড. হুদা নিজে এবং মন্জুর কাদেরদের গ্রুপ, যারা ঘুঘুপাখি (Doves) নামে পরিচিত, তারা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের পক্ষে যার মাধ্যমে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন নিয়ে আলোচনা করা যায়।

আমি নিজেও মন্জুর কাদেরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলাম। ১১ মার্চ মন্জুর কাদেরের সাথে আমার যখন দেখা হয়, তখন তিনি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের বিষয়ের তার সর্থনের কথা জানান। তিনি আরো জানান যে, তিনি ‘ছয় দফা’ ফর্মুলা পরীক্ষা করে দেখছেন এবং একটি জটিলতা লক্ষ করছেন। সেটা হচ্ছে দুটি ভিন্ন মুদ্রার দাবী। তাকে জানানো হল যে সম্মেলনে দেয়া বিবৃতিতে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের অন্তর্গত একক মুদ্রার একটি বিকল্প প্রস্তাব প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু কেবিনেট ডিভিশন থেকে প্রাপ্ত ট্রান্সক্রিপ্টে বিকল্প প্রস্তাবটির কথা উল্লেখ না থাকায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। আমি তাকে জানাই যে, শেখ মুজিব একটি লিখিত বিবরণী তৈরি করে তার কপি বিতরণ করেছেন। সুতরাং তাতে এমন একটা বড় ভুল থাকার সুযোগ নাই। তিনি হতাশা প্রকাশ করেন এবং তাকে শেখ মুজিবের লিখিত বিবরণীর একটি কপি প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন। তখনই তা সংগ্রহ করে তার নিকট প্রেরণ করা হয়। ১১ মার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী, সরকার পক্ষ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের বিষয়ে জরুরী আলোচনা ও বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের দিকে ঝুঁকেছিল। ১২ই মার্চে আইয়ুব খানের উদ্ধোধনী বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল।

১২ মার্চ এর দিনে এডমিরাল এ আর খান এবং এয়ার মার্শাল আসগর খানের মধ্যে দীর্ঘ কথা কাটাকাটিতে উল্লেখযোগ্য আর তেমন কিছুই ঘটলো না।

১২ মার্চের সন্ধ্যায় ডঃ হুদাসহ অনেকে প্রচার করতে লাগলেন যে বাজপাখির দল নিয়ন্ত্রণ পেতে শুরু করেছে। পরবর্তীতে আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম যে ১২ মার্চ রাতে স্বায়ত্বশাসনের বিরোধী পক্ষ অর্থাৎ পাঞ্জাবী বিরোধী নেতৃবৃন্দ এবং সরকার পক্ষীয় বাজপাখির দল একটি মিটিং করেছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বিলোপ এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন সংক্রান্ত সকল নমনীয়তা যে কোন মূল্যে প্রতিহত করা হবে।

মার্চ এর ১৩ তারিখে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চেহারায় আইয়ুব একটি বিবৃতি পাঠ করলেন। যা দেখে বুঝা যাচ্ছিলো যে তিনি বাজপাখির দলের মারাত্মক চাপে পড়েছেন। এই আলোচনার সাথে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার বরাতে জানা যায় যে আইয়ুবের কিছুই করার ছিল না। কারণ আড়াল থেকে ইয়াহিয়া এবং সেনাবাহিনী সমস্ত কলকাঠি নাড়ছিলেন। তাঁরা ততক্ষণে ক্ষমতা দখল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন। আসল ক্ষমতায় আর্মির উপস্থিতি টের পেয়ে শেখ মুজিব ১২ তারিখে ইয়াহিয়ার সাথে একটি আলাদা সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং ছয় দফার ভিত্তিতে বাঙালির স্বায়ত্বশাসনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ইয়াহিয়াকে অনুকূলে নিয়ে এসেছিলেন। ইয়াহিয়া ভাবভঙ্গি ঠিকই ছিল বরং তিনি আইয়ুব এবং মোনায়েম খানের উপর সুকৌশলে দোষ চাপাচ্ছিলেন যে তারা ছয় দফা দাবীকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে অস্ত্র দিয়ে জবাব দিতে চায়। কিন্তু ইতিহাসের আগাগোড়া দেখলে আপনি বুঝা যায় যে এই মিটিঙের মাধ্যমে ইয়াহিয়া রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি বাহ্যিকভাবে সম্মেলনের সফলতা কামনা করলেও, তিনি আসলে চাইছিলেন যেন এটি ব্যর্থ হয়। এজন্য তিনি আর্মির পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগ করছিলেন। ক্ষমতা কেড়ে নেবার জন্য এ ধরনের ব্যর্থ একটি অবস্থা তার কাছে আবশ্যক ছিল।

আইয়ুবের ঘোষণা ছিল এক পক্ষকে খুশি করার মতো। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এবং পাঞ্জাবী নেতাদের সুরে তিনি তার সেই বিবৃতিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন বা এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি ঘোষণা করলেন যে একটি ফেডারেল পার্লামেন্টারী সরকার গঠন এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য তিনি ১৯৬২ সালের সংবিধানে পরিবর্তন আনার ব্যবস্থা নিবেন। তিনি যুক্তি দেখালেন যে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন এবং এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের মত মৌলিক প্রশ্নের মীমাংসা শুধুমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই করতে পারেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে দেখা গেল এই অবস্থান গ্রহন ছিল পুরোই একটি কৌশল। কারণ ২১ মাস পর একটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির একটি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছিল বটে কিন্তু আবারো সেই পাঞ্জাবীরা গোঁ ধরল যে বিষয়গুলো এতই মৌলিক যে জনপ্রতিনিধিগণ এটি নির্ধারিত করতে পারবেন না। এটি ঠিক হবে অন্যত্র গোল টেবিল বৈঠকে। আইয়ুবের এই বিবৃতিটি দেয়া মাত্র পাঞ্জাবী নেতারা তাকে তড়িঘড়ি করে অভিনন্দন জানালেন এমনকি গণতান্ত্রিক একশন কমিটির সদস্যদের আলোচনা করার আনুষ্ঠানিকতার সুযোগও দিলেন না। সেখানেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে স্বায়ত্বশাসন বিরোধীরা আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের জন্য আলোচনার সব পথ বন্ধ করে দিতে সফল হয়ে গেল। শেখ মুজিব এ ভাষণ প্রত্যাখ্যান করলেন। সম্মেলন কক্ষ ত্যাগের পর তিনি পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় বসলেন। বিকাল ৩ টায় একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকা হল এবং আমাকে বলা হল আইয়ুবের ভাষণ প্রত্যাখ্যানপূর্বক নিজেদের ডিএসি (ডেমোক্রেটিক একশন কমিটি) থেকে প্রত্যাহার এবং আন্দোলন চালিয়ে যাবার মর্মে সাংবাদিকদের জন্য একটি বিবৃতি প্রস্তুত করার জন্য। পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন রকম খবর আসছিল। একদিকে মঞ্জুর কাদের জানালেন যে আলোচনা পুনরায় শুরু করার প্রচেষ্টা চলছে। অন্যদিকে গুজব শোনা যাচ্ছিল যে মিলিটারি ক্ষমতা গ্রহন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন যে আওয়ামী লীগ ডিএসি (ডেমোক্রেটিক একশন কমিটি) থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং গন-আন্দোলন চলবে। ডেমোক্রেটিক একশন কমিটি সেদিন সন্ধ্যায় বিলুপ্ত ঘোষিত হল।

শেখ মুজিব ভেবেছিলেন আইয়ুবের ভাষণ প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাবার যে ঘোষণা তিনি দিয়েছেন, তাতে গনসমর্থন পাবেন। তাই তিনি জনগণের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য ঢাকায় টেলিফোন করলেন। বাঙালি জনগণের প্রতিক্রিয়া ছিল রোমাঞ্চকর। আইয়ুব, পাঞ্জাবী নেতা আর আইয়ুবের ভাষণকে স্বাগত প্রদানকারী বাঙালিদের বিরুদ্ধে এবং ছয় দফার সমর্থনে ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হল। বাঙালির মুখপাত্র হিসেবে শেখ মুজিবের যথার্থতা এই বিক্ষোভে প্রমাণ হল।

আইয়ুব বুঝতে পারলেন যে পূর্বের দিকটায় অনান্য বাঙালি নেতাদের পাত্তা দেওয়াই বৃথা। কারন জনগণ কিংবা পরিস্থিতির ওপর তাদের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি সম্মেলন ভেঙ্গে যাবার পরপরই শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং ছয় দফা মেনে নিতে পারবেন না বলে জানালেন এই অজুহাতে যে, সংবিধানের এই পরিবর্তন জাতীয় পরিষদে পাশ হবার জন্য যথেষ্ট সমর্থন পাবে না। শেখ মুজিব পাল্টা জবাব দিলেন যে সংবিধান সংশোধন বাঙালিদের মর্জিমতে হলে সমর্থন পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। এরপর আইয়ুব অজুহাত পাল্টিয়ে বললেন যে এ ধরনের সংবিধানের সংশোধন অনেক সময়সাপেক্ষ। শেখ মুজিব তাকে নিশ্চয়তা দিলেন যে সংশোধনের খসড়া তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রদান করা হবে।

সেই মিটিং থেকে ফিরে শেখ মুজিব সঙ্গে সঙ্গে তার উপদেষ্টামণ্ডলীদের ডেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমস্ত সংশোধনীর খসড়া প্রস্তুতের নির্দেশনা দিলেন। ঢাকায় ফিরে সেই দলটি দিন রাত কাজ করতে লাগলেন, যাতে তিন সপ্তাহের মধ্যে ১৯৬২ সালের সংবিধানের একগুচ্ছ সংশোধনের খসড়া প্রস্তুতি শেষ করতে পারেন। যেখানে ছয় দফার প্রতিফলন থাকবে আর দূর হবে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে এ সমস্ত অন্তর্ভুক্ত করে আওয়ামী লীগ সদস্যরাই জাতীয় পরিষদে সংবিধান সংশোধনী বিল প্রস্তাব করবেন। কামরুজ্জামান সেই কপিগুলো রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে গেলেন এবং ২২ শে মার্চ তারিখে আইয়ুবকে এক কপি আগেভাগেই পৌঁছে দিলেন। সংশোধনী প্রস্তাবটি জাতীয় পরিষদে ওঠার আগেই আইয়ুব পদত্যাগ করলেন। কারন হিসেবে তিনি দেখালেন যে দেশ বিভাগের এই অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করতে পারবেন না। এদিকে আইয়ুবকে সরানোর প্রস্তুতি নিতে থাকা ইয়াহিয়া খান উঠে এসেই ১৯৬২ সালের সংবিধান স্থগিত করার পাশাপাশি সংসদ অবলুপ্ত করলেন এবং সামরিক শাসন ঘোষণা করলেন।

ইয়াহিয়ার প্রথম কাজ ছিল ক্ষমতার কাঠামো সুরক্ষিত করা, যা গন-আন্দোলনের ফলে হুমকির সম্মুখীন ছিল। মার্শাল ল’ জারি করে তিনি কিছু সময় নিলেন। তার প্রথম বক্তৃতায় তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিবেন। অল্প সময় পরেই তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে দ্বিপাক্ষিক শলাপরামর্শ শুরু করলেন। শেখ মুজিব প্রস্তাব দিলেন যে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংসদের কাঠামোবিশিষ্ট সংবিধানই একমাত্র সঙ্গতিপূর্ণ এবং বাঙালিরা অন্য কোনরকম সংবিধান মেনে নেবে না।

বাইশটি বছর কেটে গেল। তবুও পাকিস্তানের জনগণ কিসের ভিত্তিতে একত্রে থাকবে সেটা ঠিক করতে পারল না। ব্রিটিশরা একটি সার্বভৌম সংসদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে পাঞ্জাবী আর্মির হস্তক্ষেপে সেই সংসদ ভেঙ্গে যায়। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ১৯৫৬ সালে যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল, তা গ্রহনকারীদের (আর্মি) কারণে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় সাম্য নিশ্চিত হবে কিনা সন্দেহ ছিল। তাছাড়া মার্শাল ল’ এর হুমকিতে তারা কেন্দ্র এবং অঞ্চলে তাদের ক্ষমতার বিশেষ বিন্যাস প্রবর্তন করেছিলেন। ১৯৬২ সালের সংবিধান রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে জারি হয়েছিল। জনসংখ্যার অনুপাতে সংসদীয় আসনের দাবী ছিল যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম; ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলায় যেটিতে তারা একতরফা ভাবে জিতেছিল। পাকিস্তানের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের একত্রে বসবাসের ভিত্তিখানা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নির্ধারণের সেই মৌলিক ইস্যুটি এখন আর এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছিলো না। পাকিস্তান শাসনে পাঞ্জাবী সেনাদের কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। বস্তুত তাদের এমন বিড়ম্বনাও ছিল যে, বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের কোন এক সময়ে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট রুল জারি করেছিল যে ইয়াহিয়া জবরদখল করে ক্ষমতা নিয়েছিলেন এবং তা অসাংবিধানিক ছিল।

যে পাঞ্জাবী নেতারা আইয়ুবের গোল টেবিল বৈঠকে তর্ক করছিলেন যে শুধুমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের মত মৌলিক প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার রাখেন, তারা এখন সুর পাল্টে ফেলেছেন। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে অল্পকিছু সংশোধন এনে ১৯৫৬ সালের সংবিধান পুনর্বহালের জন্য তাদের কেউ কেউ চাপ দিচ্ছিলেন। অন্যরা চাইছিলেন ১৯৬২ সালের মতো করে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধান প্রবর্তিত হোক। সংখ্যালঘু হিসেবে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জাতীয় পরিষদে পাঞ্জাবীদের ঠাই না পাওয়ার আশঙ্কা পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই তাদের দুঃস্বপ্নের মত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। পাঠান, বেলুচ এবং সিন্ধুদের বড় অংশই যথাশীঘ্র এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেবার জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিলো।

ইয়াহিয়া বুঝতে পারলেন যে এই বিক্ষুব্ধ জনগণের সাথে প্রকাশ্য মিলিটারী শাসন অনন্তকাল চালানো যাবে না। দুই পাকিস্তানের চাপ সামলে তার শাসনকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার জন্য উপায় তিনি খুঁজছিলেন। তার মূল চ্যালেঞ্জ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের উন্মাতাল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং একজনমাত্র নেতার পেছনে গোটা জাতির একতা। শেখ মুজিব মুজিব পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ডিক্রি জারির মাধ্যমে কোনো সংবিধান প্রবর্তন বাঙালিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মতো কিছু তো একেবারেই নয়। একমাত্র সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সংসদ কতৃক প্রণীত সংবিধানই বাঙালিরা মেনে নেবে। পাঞ্জাবী ক্ষমতাশালীরা নির্বাচনের রায়ের ভয়ে ভীত হয়ে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে আর্মির শরণাপন্ন হলেন। তারা যথার্থই ভয় পেয়েছিলেন যে নির্বাচিত সংসদ এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে পারে, যা তাদের ক্ষমতার অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন কেন্দ্র, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিতে পারে। একই উদ্বেগে মিলিটারিও ক্রমাগত প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়ে চলছিল।

এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়ে ইয়াহিয়াকে কিছুটা ছাড় দিতে হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ২৮ শে নভেম্বর তিনি ঘোষণা করলেন যে একটি নির্বাচিত সংসদ স্থপনের জন্য তিনি আইনগত কাঠামো প্রস্তুত করবেন। এক লোক –এক ভোট অথবা জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্বের দাবিটি তিনি মেনে নিলেন। এতে জাতীয় পরিষদের ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৯ টি পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে গেল। এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেবার ঘোষণাও তিনি দিলেন। স্পষ্টতই এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা ভাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধুর এনডব্লিউএফপি এবং বেলুচিস্থানের ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়ে নির্বাচনে বাঙালিদের সামনে এককভাবে দাঁড় করানো। এভাবে সম্মিলিতভাবে বাঙালিদের মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের অনুকূলে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। এখানে অবশ্য ছোট্ট একটি ঝুঁকি ছিল যে প্রতিনিধিগণ বাঙালিদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ছয় দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের ব্যবস্থা সম্বলিত সংবিধান পাশ করিয়ে ফেলতে পারে।

নিঃসন্দেহে এটাই ছিল ইয়াহিয়ার প্রধানতম চিন্তার বিষয়। ১৯৭০ সালের ২৮ শে মার্চে প্রণীত আইনি কাঠামোর মধ্যে কতিপয় প্রথাবিরুদ্ধ অনুবিধিতে এ উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেয়েছিল এবং সংখ্যালঘু শাসকদের স্বার্থ সংরক্ষণে আর্মির ভূমিকা সম্পর্কে এতে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছিল। আইন কাঠামোটির ২০ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান কাঠামোতে পাঁচটি মৌলিক নীতি অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে যার চার নম্বরটি ছিল নিন্মরুপঃ

“আইনগত, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতাসহ সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে এরূপে বণ্টিত হবে যেন প্রদেশ সমূহ সর্বোচ্চ স্বায়ত্বশাসন ভোগ করবে অর্থাৎ তারা আইনগত, প্রশাসনিক এবং আর্থিকভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করবে। তবে বহির্বিশ্ব এবং আভ্যন্তরীণ যে কোন ব্যাপারে এবং স্বাধীনতা ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষায় যথাযথ দায়িত্ব পালনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আইনগত, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতাসহ পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকবে।”

২৫ নং অনুচ্ছেদে বলা ছিল যে সংবিধান বিলটি প্রামাণ্যকরণের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপন করতে হবে। আরও উল্লেখ ছিল যে, যদি প্রামাণ্যকরন প্রত্যাখ্যাত হয় তবে অধিবেশন অবিলম্বে বিলুপ্ত হবে।

বাঙালিরা দেখতে পেল, এসব অনুবিধিতে নির্বাচিত সাংসদগণের গৃহীত সিদ্ধান্তে পাঞ্জাবী সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং আর্মির ভেটো ক্ষমতা নিহিত রয়েছে। নির্বাচিত সংসদ স্থাপনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তৎক্ষণাৎ শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন যে, তিনি মনে করেন এক লোক-এক ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত কতৃপক্ষ হবে সার্বভৌম এবং তাদেরকে সংবিধান প্রনয়ণের ক্ষমতা প্রয়োগে ২০ এবং ২৫ নং অনুচ্ছেদের মতো অনুবিধি দিয়ে শৃঙ্খলিত করা যাবে না। তিনি এ সকল অনুবিধি বাতিল করার আহবান জানালেন এবং বললেন যে, যেভাবেই হোক না কেন জনগণের স্বার্বভৌমত্বের ওপর এমন বিধিনিষেধ আরোপ বেআইনি এবং অযৌক্তিক।

ইয়াহিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। তিনি সতর্কভাবে বেশ কিছু হিসেব নিকেশ করেছিলেন। আগেই বলা হয়েছে, এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা ভাঙ্গার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তার উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালিদের ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্বশাসনের দাবীর বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের একতাবদ্ধ করা। তিনি আরও ঠিক করে রেখেছিলেন যে যদি ১২০ দিনের মধ্যে সংসদ সংবিধানের রূপদান করতে পারে, তবে সেটি হবে পাঁচ বছরের জন্য জাতীয় আইনী কাঠামো। যদি এ সময়ের মধ্যে করতে না পারে, তাহলে সংসদ অবিলম্বে বিলুপ্ত হবে। সদস্যগন সমঝোতা করবেন মর্মে সমঝোতা করবেন, এমনটা প্রত্যাশিত ছিল। আশা করা হচ্ছিলো সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণী কিছুটা হলেও স্বায়ত্বশাসনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি প্রামাণ্যকরণ প্রত্যাখান করতে পারবেন। এছাড়াও, ইয়াহিয়া ভেবেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে কোন দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারবে না। অন্যভাবে বলা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং এতে করে তিনি ইচ্ছামতো এবং সুবিধাজনক ভাবে ছড়ি ঘুরাতে পারবেন। এই কৌশল পঞ্চাশের দশকে সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণী কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিল এবং ইয়াহিয়া সোৎসাহে ভেবেছিলেন তিনিও তা পারবেন। আওয়ামী লীগ বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না বলে হামিদুল হক চৌধুরীর মত কতিপয় প্রবীণ বাঙালি রাজনীতিবিদের মন্তব্যও তাকে ভরসা দিয়েছিল।

যতই প্রাক নির্বাচনী প্রচারণা এগুচ্ছিলো, ততই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছিলো যে আওয়ামী লীগ এককভাবে সার্বজনীন সমর্থনপুষ্ট একটি দল হয়ে উঠছে। অন্য দলগুলো অবস্থাদৃষ্টে বুঝতে পারছিল যে আওয়ামী লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে। ফলে, তারা নির্বাচন স্থগিত করার জন্য ছটফট করতে লাগলো।

আগস্টের দিকে বন্যা দেখা দেওয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সুযোগ পেয়ে গেল। তাঁরা ৫ই অক্টোবর, ১৯৭০ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন পেছানোর জন্য চাপ দেয়া শুরু করলো। তারা মনে করেছিল নির্বাচন পেছালে হয়ত তারা তাদের ভীত কিছুটা শক্ত করতে পারবে। নির্বাচন পেছানোর প্রচেষ্টায় তারা সফল হলেন। নির্বাচনের তারিখ ৫ই অক্টোবরের পরিবর্তে ৭ই ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হল। এই মূলতবীকরন যদিও আওয়ামী লীগের কাজে লেগেছিল। বড় সময় পেয়ে শেখ মুজিব অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় ভ্রমন করতে পেরেছিলেন এবং বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মানুষের নিকট যেতে পেরেছিলেন। এছাড়াও নভেম্বর মাসের ঘটে যাওয়া সাইক্লোন এবং জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। এটি জনগনের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল যা চুড়ান্তভাবে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবান্বিত করেছিল।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমান এবং প্রাণহানির বিচারে এটি ছিল একটি বিপর্যয় যা বিশ্বজুড়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল। ইয়াহিয়া এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নিস্ক্রিয়তা দেশের ভেতরে এবং বাইরে সকলেই লক্ষ্য করেছিলেন। সাইক্লোনের পরপর ইয়াহিয়া চীন হতে ফেরার পথে ঢাকায় যাত্রাবিরতি নিয়েছিলেন। কিন্তু থেকে যান নি। সরকারের ত্রাণ কার্যক্রম ছিল ধীর এবং অপর্যাপ্ত। এতে শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি বাঙালিদের ক্ষোভ প্রচার- দু’টোতেই নিজেদের প্রমান করার সুযোগ পেয়েছিল।

অন্যান্য দলগুলো আবারো নির্বাচন স্থগিতের জন্য আস্ফালন শুরু করতে লাগলো। আওয়ামী লীগ সর্বোতভাবে নির্বাচন স্থগিতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলো। বস্তুতপক্ষে, শেখ মুজিব বুঝালেন যে নির্বাচন স্থগিতের এই প্রচেষ্টা ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র এবং হুশিয়ার করে দিলেন যে এ ধরনের কর্মকাণ্ড জনগন প্রতিহত করবে। তিনি বললেন যে দশ লক্ষ মানুষ ইতোমধ্যে মরেছে এবং যদি দরকার হয় আরও দশ লক্ষ আত্মত্যাগ করে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করবে এবং নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রনের জন্য ক্ষমতা কেড়ে নেবে।

এমন অবস্থা দেখে, ইয়াহিয়া আর নির্বাচন পেছালেন না। শুধু সাইক্লোন উপদ্রুত এলাকাগুলোতে (১৭ টি আসনে) নির্বাচন পেছানো হল। অন্যান্য এলাকায় তফশীল অনুযায়ী ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭০ তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো।

জাতীয় পরিষদের ৩১৫ টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ছিল ১৬৯ টি। আওয়ামী লীগ এই আসনগুলো মধ্যে ১৬৭ টি-তেই জিতে গেল। শেখ মুজিবকে পরম সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেওয়া এই অভুতপূর্ব সিদ্ধান্তপূর্ণ নির্বাচনী ফলাফল ছিল শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ এবং ছয় দফার সমর্থনে স্পষ্ট রায়। এই ফলাফল ইয়াহিয়ার সম্পূর্ণ কৌশলকেই ভয়াবহ বিশৃঙ্খলায় ফেলে দিয়েছিল। তিনি পূর্বে কিছু আসন পেয়ে বাধাহীনভাবে ইচ্ছামতো চালাতে পারবেন বলে ভেবেছিলেন। এখন তিনি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সম্মুখীন হলেন। তিনি দেখতে পেলেন যে পরিস্থিতি পুরোপুরি তার হাত ফসকে যাচ্ছে এবং দেশ চালানোর ক্ষমতা তিনি হারাতে বসেছেন। যেখানে তিনি নির্ভর করছিলেন পূর্বপাকিস্তানে কিছু আসন হলেও জিততে পারবেন বলে ধারণা করে তিনি ফলাফল হিসেবে পেলেন একনিষ্ঠ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তার এই অনুমান শুধু পরিস্থিতির ওপর হিসেব নিকেশেই বদ্ধমূল ছিল না বরং পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ আর ইয়াহিয়া যাঁদের উপর বিশ্বাস রাখতেন, সেই বহির্বিশ্বের নেতারাও তাকে এমন ধারণা দিয়েছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচনে ভুট্টো শুধু সিন্ধু আর পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে মোট ১৩১ টি আসনের মধ্যে ৮৩ টিতে জয়লাভ করেন। ভূট্টোর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মত। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর তাঁর একেবারে প্রথম বিবৃতি ছিল যে পিপলস পার্টির সম্মতি ছাড়া সংবিধানে কোনো পরিবর্তন আসতে পারবে না। তিনি সিন্ধু এবং পাঞ্জাবকে “ক্ষমতার কেন্দ্র” বলে দাবী করেন। এর পরে তিনি বলেন, “শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে জাতীয় রাজনীতি চলে না”। স্পস্টতই তিনি দেখলেন যে জাতীয় পরিষদে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রতিহত করার একমাত্র উপায় হল পরিষদের বাইরে তাকে মোকাবেলা করা। একমাত্র জায়গা যেখানে সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণী একটি শক্তির সাহায্যে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে পেছনে ফেলতে পারবে, সেটা হল আর্মি। এই একই প্রক্রিয়াতেই ২৪ বছর ধরে পাকিস্তান চলেছে। যখনি কোনো গনতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতাকে মোকাবেলা করতে চেয়েছে, তখনি তারা সামরিক শক্তির শরণাপন্ন হয়েছে। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল; ভুট্টোর দাবী মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা তাদের ছিল না। ইয়াহিয়া এখানে নগ্নভাবে আপস করতে এগিয়ে এলেন। ডিসেম্বরের শেষের দিকে এসে মনে হচ্ছিলো, আওয়ামী লীগকে ৬ দফা পরিবর্তনের জন্য ইয়াহিয়া স্বউদ্যোগে এবং প্রাথমিকভাবে চাপ দিতে লাগলেন যাতে অভিজাত শাসকশ্রেণী এবং আর্মির স্বার্থ রক্ষিত হয়। যদি তিনি সফল হতেন, তবে হয়তো অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের কাছে ভিড়িয়ে ভুট্টোকে সম্পূর্ণ একা করে ফেলতেন।

ইয়াহিয়া যখন এসব ভাবছিলেন, তখন বুঝাই যাচ্ছিল যে ভুট্টো জেনারেলদের একটি অংশের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত। ইয়াহিয়ার একজন উপদেষ্টার প্রকাশিত বিবৃতি অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের প্রধান স্টাফ অফিসার জেনারেল পীরজাদা ভুট্টোর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। সম্ভবত জেনারেল গুল হোসেন সহ আরও যারা একাত্তরের পরে ভুট্টোর নেয়া শুদ্ধি অভিযানে বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা এই গ্রুপেরই অংশ ছিলেন। ঢাকায় গভর্নমেন্ট হাউসে অনুষ্ঠিত জমকালো ডিনারে একজন জেনারেলের মন্তব্যে এদের সেসময়কার মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। অন্য আরেকজন পাকিস্তানী অফিসারের বরাতে জানা যায় যে, মন্তব্যটি ছিল “চিন্তার কিছু নেই,… আমরা এই পিছিয়ে থাকা কালো লোকদেরকে আমাদের শাসনভার দেবো না।”

জানুয়ারির মাঝামাঝিতে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসলেন। এখানে ইয়াহিয়া এবং শেখ মুজিবের মধ্যে একটি প্রাথমিক মিটিং হয়েছিল যেখানে ইয়াহিয়া বাহ্যিকভাবে আপসের ভঙ্গিতে ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ৬ দফা সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। এভাবেই তিনি ৬ দফা সম্পর্কে ঐকমত্যে আসার জন্য আলোচনার শুরু করতে চেয়েছিলেন।

ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা জানলেন যে, ৬ দফার বাস্তবায়ন সম্পর্কে ইসলামাবাদে বিস্তারিত পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং আসলেই ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সংবিধানের একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছিল। সুতরাং ৬ দফা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চেয়ে করা অনুরোধটি ছিল প্রকৃতই মার্জিত আলোচনার আহবান। শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ এ ধরনের আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। জুন মাসে শেখ মুজিবের উত্থাপিত ৬ দফা দাবীর ওপর সমর্থন যাচাইয়ের উপায় হিসেবেই নির্বাচনকে সূচিত করা হয়েছিল। জনগণের রায়ে তা সমর্থন পেল। শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন যে, “৬ দফা” এখন জনগণের সম্পত্তি এবং তিনি তাতে কোনোরূপ পরিবর্তন আনার অধিকার রাখেন না। এই অবস্থান ঘোষণা করা হয় জানুয়ারির শুরুতে। জাতীয় এবং প্রাদেশিক অধিবেশনের জন্য নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যদের নিয়ে এক বিশাল জনসভায়। যেখানে তারা ৬ দফা নিয়ে কোন আপস করবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। শেখ মুজিব এবং তার জ্যেষ্ঠ সহকর্মীবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী, খন্দকার মোস্তাক এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানের সাথে ইয়াহিয়া আলোচনায় বসেন। তারা ইয়াহিয়াকে বুঝাতে চাইলেন যে ৬ দফা পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত এবং সংবিধান অনুযায়ী শুধু কেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ কাজে প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করে বাকি ক্ষমতা এবং কার্যাবলী ছেড়ে দেয়া হবে। সেই সম্পদ দিয়ে কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় কার্যাবলী সম্পাদন করা যাবে। এটি ব্যাখ্যা করা হয়েছিল যে সংবিধান মোতাবেক কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা এবং রাজস্ব কেন্দ্র এমনিতেই পাবে এবং তার জন্য অঞ্চলসমূহের ছাড় দেওয়া না দেওয়ার উপর নির্ভর করতে হবে না।

এই আলোচনার পর শেখ মুজিব আমাকে পীরজাদার সাথে ৬ দফা ব্যাখ্যা করে আলাদাভাবে আলোচনা করতে বললেন। সেই মিটিঙে পরিস্কারভাবে বুঝা গেল যে, তাদের মূল উদ্বেগ ছিল কেন্দ্রের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা এবং রাজস্ব বণ্টন নিয়ে। অঞ্চলগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্য এবং সাহায্য নিয়ন্ত্রণ নিয়েও কিছুটা উদ্বেগ তারা প্রকাশ করেছিলেন। তাদের কাছে ব্যাখ্যা করা হলো যে বৈদেশিক মুদ্রা এবং রাজস্বের একটা অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য আলাদাভাবে বরাদ্দ করার কথা সংবিধানেই উল্লিখিত আছে। বৈদেশিক বানিজ্য এবং সাহায্য নিয়ে বলা হলো যে, এসব ব্যাপারে দেশের বৈদেশিক নীতির আলোকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলোই বিবেচনা করবে। আরও উল্লেখ করা হল যে, যেহেতু আওয়ামী লীগ একাধারে পূর্ব পাকিস্তান এবং কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রক থাকবে, সেহেতু কোন সমস্যা হবে না। পীরজাদা কিছুতেই আশ্বস্ত হচ্ছিলেন না, আরও বলছিলেন যে ইয়াহিয়া খানও এতে আশ্বস্ত হবেন না। ফলে আওয়ামী লীগ কে পিপলস পার্টির সাথে সমঝোতায় আসতে হবে। উনি বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগ এবং পিপল’স পার্টির মধ্যে সমঝোতামূলক একটি সংবিধানই পরিষদে উঠার মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদলকে ত্বরান্বিত করতে পারে। পীরজাদার কথাবার্তাতেই বুঝা যাচ্ছিল যে তার সাথে ভুট্টো এবং সেনাবাহিনীর একটি অংশ রয়েছে।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ইয়াহিয়া খান ঢাকা থেকে সরাসরি লারকানায় উড়ে গিয়েছিলেন। যদিও বলা হয়েছিল যে এটি একটি “শুটিং ট্রিপ” ছিল, তথাপি ক্ষমতাসীন জান্তার অধিকাংশ জেনারেলও সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়, যা ভুট্টো তার ‘গ্রেট ট্র্যাজেডি’ নামক বইতে নিশ্চিত করেছেন। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বাঙালিদের স্তিমিত এবং হতাশ করাই তাদের কৌশল ছিল কিনা, তাতে কিছুটা সন্দেহ থেকে যায়। ঘোষণা করা হলো যে ভূট্টো শীঘ্রই ঢাকা আসবেন। নওয়াব আকবর খান বুগতি, মৌলানা নুরানী এবং সরদার শওকত হায়াত খানের মত অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারাও ঢাকা আসছিলেন।

জানুয়ারীর ২৭ তারিখে ভুট্টো ঢাকা এলেন। শেখ মুজিবের সাথে ভুট্টোর বেশ কয়েক দফা আলোচনা হলো। সমান্তরালভাবে আওয়ামী লীগ টিমের সাথে পিপলস পার্টি টিমেরও আলোচনা চলছিল। সেখানে পিপলস পার্টির টিমে ছিলেন জে রহিম, শেখ আব্দুর রশিদ, হানিফ রামেয়, আব্দুল হাফিজ পীরজাদা এবং রাফি রাজা। আওয়ামী লীগের টিমে ছিলাম আমি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ আর এ এইচ এম কামরুজ্জামান। এই দুই দলের আলোচনায় আওয়ামী লীগের সদস্যরা ভেবেছিলেন যে ৬ দফার বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক আলোচনা হবে। আওয়ামী লীগ পিপলস পার্টির নেতাদের আহবান জানালো ৬ দফার মধ্যে তাদের আপত্তিসমূহ জানাতে। তাদের বলা হলো যে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যেকটি দফার ভুল বোঝাবুঝি দূর করা সম্ভব। কিন্তু রহিমের নেতৃত্বে পিপলস পার্টি সুনির্দিষ্ট বিষয় তুলে না ধরে সমাজতন্ত্রের জটিল তাত্ত্বিক আলোচনার অবতরণ করলেন। সমাজতন্ত্রে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রের গুরুত্ব নিয়ে রহিম আলোচনা শুরু করলেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রের উপস্থিতির প্রসঙ্গ টানলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে এ ধরনের তুলনা প্রাসঙ্গিক নয় বলে জানালেন। বরং তাকে ৬ দফার ওপর সুনির্দিষ্ট আলোচনার জন্য চাপ দিলেন। যতদূর মনে পড়ে, ৬ দফায় উল্লিখিত ইস্যুসমুহ নিয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনা তাঁরা লক্ষ্যনীয়ভাবে এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। বিকল্প কোনো সাংবিধানিক পরিকল্পনাও উপস্থাপন করা হয় নি। সুতরাং আলোচনাটি ছিল একেবারেই কাঠামোবিহীন এবং প্রকৃতপক্ষে কোনো যোগাযোগই হচ্ছিলো না। আমি হাফিজ পীরজাদাকে খানিক তিরস্কার করলাম এই বলে যে, একজন আইনজীবী হিসেবে একটি বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার গুরুত্ব তার বোঝা উচিৎ। তাকে তাগাদা দেওয়া হয়েছিল যেন তিনি তার সহকর্মীদের বুঝিয়ে পয়েন্ট ভিত্তিক আলোচনায় নিয়ে আসেন এবং সুনির্দিষ্টভাবে আপত্তির বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। যাতে সেগুলো সম্পর্কে উত্তর দেওয়া যায়। তিনি রসিকতার সাথে প্রত্যুত্তর দিলেন যে রহিম বুড়ো মানুষ। তাকে বুঝানো যাবে না এবং পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারী মাসে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় পুরোদমে তারা প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন। ভুট্টোর মূল চিন্তা ছিল শেখ মুজিবকে নিয়ে। উনি প্রেসিডেন্ট হলে তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কিনা এবং জোট গঠিত হলে তার দলকে আর কী কী পদ দেওয়া হবে।

জানুয়ারীর আলোচনার পর ভুট্টো ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলন করে বললেন যে, “আমাদের সমস্যা সত্যিই বেশ জটিল এবং এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে হলে অন্তত পক্ষে ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।” তিনি আরও বললেন যে, “সাংবিধানিক ভাবে অধিবেশন শুরু করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। কারণ অধিবেশন শুরু হবার পরও আলোচনা চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে।” বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ তার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংবিধান প্রণয়ন করতে পারবে কিনা, এরকম প্রশ্নে ভুট্টো জবাব দিলেন এই বলে, “আইনগত দিক থেকে বলতে গেলে পারবে। কিন্তু হাউসকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই কি সংবিধান গৃহীত হবে, নাকি তার জন্য দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। যেহেতু আমাদের ভৌগলিক অবস্থান বিচিত্র, তাই সংবিধান রচনা এবং তা গ্রহণ করা সর্বসম্মতিক্রমে হওয়া বাঞ্ছনীয়।”

বিরতি নেওয়ার সময় ভুট্টোর দলের সদস্যগন ইঙ্গিত দিলেন যে, তারা পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য যাচ্ছেন। এই আলোচনা শেষে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবারো আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনার জন্য তাঁরা ফিরে আসবেন।

একাত্তরের ফেব্রুয়ারির ঘটনাপ্রবাহ এবং পিপলস পার্টির আচরণ এটাই পরিস্কার করে দেয় যে তারা সংলাপের জন্যে কাজ করছে না বরং সঙ্কট ঘনীভূত করতে ভূমিকা রাখছে, যা চলমান সঙ্কটকে সংঘর্ষের দিকে ধাবিত করছে।

একাত্তরের ২রা ফেব্রুয়ারী একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। লাহোরে দুজন তরুণের দ্বারা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটা বিমান ছিনতাই হয়। রারা নিজেদের কাশ্মীরের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করে। ভুট্টো এবং তার পিপলস পার্টি এই দু’জনকে বীরের বেশে লাহোরের রাস্তায় বরণ করে নেয়। এমনকি ভুট্টো নিজে হাতে তাদের ফুলের তোড়া দেন । ইন্ডিয়াতে এর তীব্র সমালোচনা হয়।

আমি স্পষ্টভাবে শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া মনে করতে পারি। ছিনতাই করার চেয়ে বিমানটির ধ্বংস হওয়া নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। সন্দেহটি ছিল যে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাধা সৃষ্টি করতেই এরকম পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। এই ব্যাপারে শেখ মুজিব এর নিম্নরূপ একটা বক্তব্য পাওয়া যায়ঃ

“সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে এরকম পরিস্থিতি এড়ানো যেত। জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে এটা বুঝা উচিত ছিল যে এরকম অবস্থা আত্মঘাতী। আমি সরকারকে এই ব্যাপারে তদন্ত করতে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলবো যেন কেউ এই ঘটনার সুযোগে পরিস্থিতি আরও অবনতি করতে না পারে ।“

বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ঐ দু’জনকে বীর হিসেবে উপস্থাপন করা হলো। পিপলস পার্টি সাথে সাথে আওয়ামীলীগকে এই প্লেন ছিনতাই এবং ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্ত করে । লাহোরে আওয়ামীলীগের অফিসে আক্রমণ করা হয়। তখন থেকেই বলা হচ্ছিলো যে, ছিনতাই নিয়ে দুই পক্ষের দু’রকম প্রতিক্রিয়া এটাই প্রমাণ করে যে ৬ দফা অনুযায়ী একটা বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করা কতটা কঠিন হবে।

ছিনতাইয়ের ব্যাপারে আওয়ামীলীগের কোন সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করা উচিৎ নয়, এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে শেখ মুজিব বলেন যে সরকার তাকে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানায় নি, যদিও তিনি সর্বাধিক প্রতিনিধিত্বশীল দলের নেতা। একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো যে, আলভি নামক অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব ১ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় উপস্থিত হয়েছিলেন এবং ২ মার্চ শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে ছিনতাইয়ের ব্যাপারে জানানোর জন্যে অনুমতি চেয়েছিলেন। যেহেতু ২ মার্চ ছিল অসহযোগ আন্দোলনের সময়, তাই তার সেই সুযোগ হয়ে উঠে নি।

এই ছিনতাইয়ের ফলে ইন্ডিয়া তার আকাশসীমায় পাকিস্তানের সকল ফ্লাইটের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। ফলে পশ্চিম পাকিস্তান হতে পূর্ব পাকিস্তান যাবার জন্যে একমাত্র ভারতীয় উপদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে সিলন (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) হয়ে আসতে হতো। যার ফলে দূরত্ব ও যাত্রার সময় প্রায় ৩ গুন হয়ে যায়, যা কিনা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ কঠিন ও খরচসাপেক্ষ করে দেয়।

ভুট্টোর আচরণ এবং জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকতে গড়িমসি আচরণ এটাই প্রকাশ করছিল যে ইয়াহিয়া এবং সামরিক জান্তা অধিবেশন না করার জন্যে কিছু একটা ষড়যন্ত্র করছে।

তবে ইন্ডিয়ার উপর দিয়ে বিমান চলাচলের নিষেধাজ্ঞার জন্যে সেনা, অস্ত্র এবং রসদ সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হবে, ফলে তাদের সেনার কার্যক্ষমতা কমে যাবে তাঁদের আশঙ্কা ছিল।

এটা মনে রাখা দরকার যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারে শেখ মুজিব ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই তাঁর নেতাদের সাথে ভিতরে ভিতরে আলোচনা করছিলেন। সংসদ অধিবেশন নিয়ে গড়িমসিই এমনটা ভাবতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু এরকম ঘোষণার ফলে মিলিটারি অ্যাকশনের ব্যাপকতা এবং জনতার প্রতিরোধ ও উত্তোরণ ক্ষমতাও ভালমতো বিবেচনা করা হচ্ছিলো। রয়ে যাওয়া সামরিক শক্তি নিয়েও কিছু হিসেব করা হচ্ছিলো। এটাও হিসেব করতে হচ্ছিলো যে ইন্ডিয়ার আকাশসীমা পাকিস্তানিদের জন্যে বন্ধ থাকায় মিলিটারিকে মানুষ ও মালামাল পরিবহনে কিরুপ সমস্যায় পড়তে হতে পারে।

আমাকে একটা স্বাধীনতার ঘোষণার খসড়া লিখতে বলা হয়েছিলো। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণার দলিলটিকে রেফারেন্স হিসেবে নেয়া হয়েছিলো যেখানে ব্রিটিশ রাজাদের অবিচারের ব্যাপারটাকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার কারণ হিসেবে সূচিত করা হয়েছিলো। ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখের দিকে শেখ মুজিবের হাতে একটা খসড়া তুলে দেয়া হয়েছিলো। যা তিনি সাথে রাখতেন। তাজউদ্দীন এই খসড়ার সাথে সংযুক্ত ছিলেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য রূপরেখার কাঠামো তৈরি করেছিলেন। এই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল প্রধান শহরসমূহে বিশাল জনসমাবেশ ঘটানো, যেখানে শত-সহস্র জনতা রাস্তায় নেমে আসবে যা মিলিটারিকে অন্য দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য করবে। যেন প্রধান লক্ষ্যসমূহ যেমন রেডিও স্টেশন, সচিবালয় এবং গভর্নরের বাসভবন দখল করা যায় এবং গভর্নর যেন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাপ্তরিক ঘোষণা দেন।

এই সময়ে আওয়ামীলীগ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের জন্যে চাপ দিতে থাকে। আওয়ামীলীগের সব সদস্য যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলো এবং সেই সাথে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের নিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি মিটিং হয়েছিলো ‘ভবিষ্যৎ কর্মপরিধির’ ব্যাপারে। এটা বহুল প্রচলিত যে এই মিটিঙের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হবে কিনা, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছিল। আমার মনে আছে মিটিং এর আগে বিদেশী এক কূটনীতিবিদ জিজ্ঞেস করেছিলো যে “তোমরা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবে কি?”

মিটিং এর দিন সকালে যখন পাকিস্তানিদের গড়িমসির জন্যে সবাই রাগান্বিত, তখন ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন ১৯৭১ এর ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে।

এই ঘোষণার পর ভুট্টোর প্রতিক্রিয়া সঙ্কটকে ঘনীভূত করে। ১৯৭১ এর ১৫ ফেব্রুয়ারী পেশোয়ারে তিনি বলেন, তার দল এই অধিবেশনে যোগদান করতে পারবে না যেহেতু ৬ দফা দাবির ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ‘ছাড় দেয়া না সংশোধনমূলক’ কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নি । তিনি আরও বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে তার দলের সদস্যরা আরও সমস্যায় পড়বে এবং তিনি এমন কোন অবস্থায় পড়তে চান না যেখানে “ইন্ডিয়ার বর্বরতা এবং ৬ দফা মেনে না নেয়ার মধ্যবর্তী দ্বৈত বাধ্যতামূলক অবস্থানে” উনাকে পড়তে হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারী করাচিতে তিনি বলেন যে, “তার দলের ৩রা মার্চ এর অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত অবিচল এবং তা বদলাবে না।“

১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি করাচিতে বলেন, “বর্তমান অবস্থায় পিপলস পার্টির জাতীয় অধিবেশনে যোগদান করার কোন মানে নাই।“ তিনি আরও বলেন, তার দলটি আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করতে চেয়েছিল, কিন্তু “এখন আর আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতার কোন দ্বার খোলা নেই।” ৬ দফা নিয়ে তিনি বলেন, দাবিগুলোর মধ্যে বৈদেশিক নীতি এবং বৈদেশিক সাহায্য” নিয়ে সমঝোতা সবচেয়ে কঠিন ।

ভুট্টোর বক্তব্য তার কঠোর অবস্থানকে প্রকাশ করেছিল এবং জানুয়ারির শেষের দিকে দেয়া তার বক্তব্যের বিপরীত ছিল, যেখানে উনি বলেছিলেন, আওয়ামীলীগের সাথে উনি আরো আলোচনা করবেন। সেই আলোচনাগুলো জাতীয় পরিষদেও হতে পারে। কিন্তু এখন তিনি এরকম করতে অস্বীকার করছেন এবং আওয়ামীলীগের সাথে কোন আলোচনা করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

বাঙালিরা বুঝতে পেরেছিল সামরিক জান্তা অথবা সামরিক জান্তার একাংশ কঠিন কোন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে এবং ভুট্টো তাঁদের সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে। প্রেসে ভুট্টোকে করা একটি প্রশ্নের জবাবে তাঁর পার্টির অধিবেশনে যোগদানের অস্বীকৃতি যে বর্তমান শাসকের সমর্থনপুষ্ট নয়, সেই বক্তব্য এরকমই আভাস দেয়। তিনি আরও বলেন, তার সাথে আর কারো “পর্দার অন্তরালে” কোন সমঝোতা হয় নি। এটা নিয়ে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ইয়াহিয়ার একজন উপদেষ্টার লেখা থেকে জানা যায়ঃ

“এই সময়ের মাঝে ভুট্টো নিজের দরকষাকষির শক্তিশালী জায়গা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তার সাথে সামরিক জান্তার একটা শক্তিশালী অংশ ছিল, যেটা ইয়াহিয়ার সাথে ছিল না। এর আগ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি স্বাধীন ক্ষমতা ছিল। কিন্তু সামরিক জান্তা “অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ” করছিল যে ইয়াহিয়া দেশের একতা ধরে রাখার জন্য যে কোন ধরণের সাংবিধানিক বিষয়াদি অনুসরণ করছে কিনা। কিন্তু জানুয়ারির শেষের দিকে মুজিবের সাথে ইয়াহিয়ার ব্যর্থ আলোচনার পর তারা আর সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে পরোক্ষ ভূমিকায় থাকলো না এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ভূমিকা বদলে গেল। আহসানের মতো আমারও ধারণা, ফেব্রুয়ারিতে ইয়াহিয়াও হামিদ দ্বারা পরিবর্তিত হবে এবং ইয়াহিয়া হয়তো এই বিষয়ে অখুশি হবে না। কিন্তু কোন একটা কারনে জান্তা ইয়াহিয়া কে বদলাল না। তাই ইয়াহিয়া এরকম অগ্রহণযোগ্য অবস্থাতেও তাঁর ভূমিকা পালন করে গেলেন।“

ফেব্রুয়ারির ৩য় সপ্তাহে দুর্যোগের আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখে ঢাকাতে মিলিটারির আনাগোনা লক্ষ্য করা যায় এবং সংসদের সামনে একটি মেশিনগানের ছাউনি দেখা যায়। এই দেখে শেখ মুজিব দলের নেতাদের জরুরি সভা ডাকলেন। সেই সভায় কিছু ছাত্রনেতাও উপস্থিত ছিলেন। আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেখানে রিপোর্ট আসলো যে ক্যান্টনমেন্টে কিছু গতিবিধি দেখা যাচ্ছে এবং কোন ধরণের মিলিটারি হস্তক্ষেপ আসন্ন। ঐ সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে রাতের বেলায় কোন নেতা যেন বাসায় না থাকে এবং যদি সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয় তবে যেন তাঁরা ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যায় এবং মানুষদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। যদিও এরকম কোন কিছু হয় নি, তথাপি পরিস্থিতি ক্রমাগত উত্তপ্ত হচ্ছিলো।

২১ শে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল এবং অনেকেই ধারণা করছিলেন যে সেদিন শহীদ মিনারের সভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন। কিন্তু জনসভায় তিনি বলেন বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ আছে এবং যদি তাদের দাবি মানা না হয়, তবে তারা রক্ত দিতে প্রস্তুত আছে।

একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি আলোচনার জন্যে ঢাকাতে এসেছিল। আলোচনাগুলোতে আওয়ামীলীগের অবস্থান ছিল এরকম যে, আওয়ামী ৬ দফার ভিত্তিতে একটা সংবিধান তৈরিতে সংকল্পবদ্ধ। কিন্তু তাঁরা সব রাজনৈতিক দলের সাথে সেই সংবিধানের খসড়া তৈরির জন্য আলোচনায় বসতে চায়। এছাড়া ৬ দফার ফলে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, এনডাব্লিউএফপি এবং অন্যান্য রাজ্যের পাশাপাশি যৌথরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা সচল থাকার উপর কোন ধরণের প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে কোন ভুল বুঝাবুঝি থাকলে আওয়ামী তার ব্যাখ্যা দিতে চায়। ২৪ ফেব্রুয়ারির প্রেস রিলিজের মাধ্যমে শেখ মুজিব আওয়ামীর অবস্থান পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন। এটা ধারণা করা হয়েছিল যে একই সময়ে সামরিক জান্তার একটি মিটিং হয়। ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা সেই মিটিং নিয়ে নিম্নরূপ বলেনঃ

“ভাগ্য নির্ধারণী লারকানার আলোচনার পর রাওয়ালপিন্ডিতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি জান্তারা অফিশিয়াল সভায় মিলিত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, শেখ মুজিব যদি তার অনমনীয় অবস্থান থেকে সরে না আসেন, তবে কঠিন পদক্ষেপ নেয়া হবে। কিন্তু উল্লেখ্য যে, ভুট্টোর আক্রমণাত্মক বক্তৃতা নিয়ে সেখানে তেমন কিছু বলা হয় নি। শাসক উচ্চশ্রেণির লোকদের মতো ভুট্টোকে তখন থেকে পাকিস্তানের “জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী” হিসেবে গণ্য করেন তার বিশ্বস্ত বন্ধু পীরজাদা, হামিদ, ওমর এবং গুল হাসানের মতো জেনারেলরা। এই সভাতেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়া হবে। সেখানে লোকেরা আগেই ইলেকশনের পর থেকে চাপমুক্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭০ এর ৮ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া সিদ্ধান্ত নেন তা না করার জন্য। কারণ তখনকার কিছু সদস্যের সাথে শেখ মুজিবের ভালো যোগাযোগ ছিল। এছাড়া বাকিদের কাছ থেকে তার কিছু সাহায্য দরকার ছিল। কারণ তখন কষ্ট করে হলেও সংসদ অধিবেশন নিয়ে কথা চলছে। কিন্তু এখন সামরিক জান্তার উপর ইয়াহিয়ার কর্তৃত্ব কমছিল। কারণ উনি শেখ মুজিবের উপর কোন প্রভাব রাখতে পারছিলেন না। তাই উনাকে এবং আহসান কে তিরস্কার করা হয়। আহসান চাপমুক্ত হতে চাইছিলেন। তাই তার পরিবর্তে লেফটেন্যান্ট জেনারেক টিক্কা খানকে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৭ ই ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়া হয়। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ইয়াহিয়া আমিসহ আরও কয়েকজনকে তার উপদেষ্টা হিসেবে সচল থাকার জন্যে আমন্ত্রন জানান। তিনি মন্ত্রিসভার পরিবর্তে উপদেষ্টা সভা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। (কিন্তু সেই প্রস্তাবিত কাউন্সিলে বাঙালিদের মধ্যে আহসানুল হক ছাড়া বাকি সবাই সচল থাকতে অস্বীকৃতি জানান। পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে শুধু কর্নেলিয়াস থেকে যান।)

আওয়ামী লীগের সংবিধানিক কমিটি রাতদিন কাজ করছিলেন, যেন ১ লা মার্চের আগে সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করা যায়। ইয়াহিয়া ১ লা মার্চের আগে ঢাকায় পৌঁছবেন বলে কথা ছিল এবং আমরা শেখ মুজিবের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছিলাম, যেন খসড়ার একটা কপি ইয়াহিয়ার কাছে ঐদিন পৌঁছে যায়।

যখন সংবিধানের খসড়া তৈরি করা হচ্ছিলো, একজন সিনিয়র বাঙালি সরকারি অফিসার খবর নিয়ে এসেছিলেন যে সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে। শেখ মুজিব যেন দ্রুত গভর্নর আহসানের সাথে দেখা করেন এবং এই সিদ্ধান্তের কঠোর নিন্দা করেন। তিনি ঐদিন সকালেই আহসানের সাথে দেখা করেন। খবর শুনে আহসান নিজেই আশ্চর্শ বোধ করেছিলেন। শেখ মুজিব বলেন, এরকম কিছু করা হলে বাঙালি তাদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে বলে ধরে নেবে এবং পরিস্থিতি বিস্ফোরিত হবে। আহসান কথা দেন যে তিনি এই খবর ইসলামাবাদে পৌঁছে দেবেন। পরে তিনি জানান যে তিনি তা জানিয়েছেন কিন্তু উনারা সিদ্ধান্ত বদলায় নি। এমনকি তিনি নিজেও পরামর্শ দিয়েছিলেন যে অধিবেশন স্থগিত করা হলে যেন নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্যে করা হয়, অনির্দিষ্টকালের জন্যে নয়। ২৮ ফেব্রুয়ারির এক বক্তৃতায় শেখ মুজিব বলেন যে সাংসদদের কেউ যদি যুক্তিসঙ্গত কিছু বলেন, তবে তা মেনে নেয়া হবে। ঐদিনই এক প্রলম্বিত বক্তৃতায় ভুট্টো বলেন যে বৈদেশিক সাহায্য এবং বাণিজ্য নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যেকার সমস্যার সমাধানের পথে আছেন। তিনি এই বলে শেষ করেন যে, হয় অধিবেশন স্থগিত করতে হবে নতুবা ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনার ব্যাপারটা সরিয়ে ফেলতে হবে।

ইয়াহিয়ার উপদেষ্টার ভাষ্যমতে ভুট্টো তখন মিলিটারি জান্তার সাথে যুক্ত হয়ে তাঁদের পক্ষে কথা বলছিলেন। তার রিপোর্ট অনুযায়ীঃ

“তো ইয়াহিয়া অনড় নীতিতে চলতে লাগলেন। ভুট্টোর হুমকির পর ৩রা মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত করা হলো। ১ লা মার্চে অধিবেশন স্থগিত করে ইয়াহিয়ার ঘোষণার চেয়ে উত্তেজনা উদ্রেককারী এবং দুঃখজনক ঘটনার আর হতে পারে না। ৫ই মার্চে এই ঘোষণার ব্যাপারে আমি তাকে যখন জিজ্ঞেস করি তখন উনাকে শুণ্য ও অসহায় লাগছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি শুধু সাইন করেছেন কিন্তু পেছনে কলকাঠি নাড়ছে অন্য কেউ। ভুট্টো এবং পীরজাদা এই ঘোষণার খসড়া লিখেছিলেন বলে জানা যায়। ইয়াহিয়া আগের মতো এটি প্রচার করেন নি। এটি শুধু রেডিওতে পাঠ করা হয়েছিলো ।

রাওয়ালপিন্ডি থেকে করাচী যাওয়ার আগেই ইয়াহিয়া ভুট্টোকে ঢাকায় যেতে রাজি করিয়েছিলেন, যেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে না যায়। তিনি আগেই ভুট্টোকে সেই অধিবেশনে উপস্থিত হতে রাজি করানোর জন্য আহসান, ইয়াকুব এবং পীরজাদাকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি ভুট্টোকে কথা দিয়েছিলেন যে যদি মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানিদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ৬ দফা নিয়ে অধিবেশনে জোর দেন এবং যদি তাঁর সংবিধান সংশোধনের খসড়া দেশকে বিভক্ত করে দেবে বলে মনে হয়, তবে তিনি ঐ মুহূর্তে অধিবেশন স্থগিত করবেন। কিন্তু ভুট্টো তাতেও রাজি হন নি। যখন এটা পরিস্কার হয়ে গেল যে অধিবেশনটিকে ভুট্টোর বয়কটের হুমকির ফলে বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানি সাংসদরা অধিবেশনে থাকবেন না, তখন ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিত করে দেন। কিন্তু তিনি একটা বক্তব্য দিতে চেয়েছিলেন যেন পূর্ব পাকিস্তানে উত্তেজনা তৈরি না হয়। যদিও আমি তার মন্ত্রিসভার কোন সদস্য ছিলাম না, তবুও তিনি আমাকে একটি শান্তিকামী বক্তৃতা প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেন। আমি তাড়াতাড়ি সেই খসড়া তৈরি শুরু করি যা নিম্নরূপঃ

“পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যকার বিরোধের ফলে আমি ১৯৭১ সালের ৩ মার্চে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করছি। আমি এটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই যে, এই স্থগিত সর্বোচ্চ ২-৩ সপ্তাহের জন্যে বলবৎ থাকবে। এই সময়ের মধ্যে আমি দেশের এই দুই অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যবর্তী সমস্যা মিটমাট করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি, পাকিস্তানের দু’পক্ষের মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন সংবিধান গঠন করার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠনের জন্যে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। এমনটি হলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবো। আমার পক্ষ থেকে আমি জাতিকে এই আশ্বাস প্রদান করছি যে এই ব্যাপারে সব ধরণের সহযোগিতাই করা হবে।

পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী আমার সহযোগীদের এটুকুই অনুরোধ করবো। যেন তারা এখনকার অবস্থার গভীরতা বুঝেন এবং আমাকে একটি সমঝোতাপূর্ণ সমাধান তৈরির জন্যে এই দুই-তিন সপ্তাহের সময় দেন।

ইনশাআল্লাহ্‌ আমরা সমাধান করে ফেলবো। কায়েদ-এ-আজমের কথা মনে রাখবেন, “পাকিস্তান টিকে থাকতে এসেছে।” আসুন আমরা নিজেদেরকে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে নিযুক্ত করি।“

আমি ব্যক্তিগতভাবে খসড়াটি ইসলামাবাদ এয়ারপোর্টে ইয়াহিয়াকে দিই। তিনি তখন করাচির পথে যাচ্ছিলেন। তিনি পরে তা পীরজাদাকে দেন, যিনি ভুট্টোর সাথে মিলে তা নাকচ করে দেন। আমি এখনো হতাশ অনুভব করি যে আমি ইয়াহিয়ার সাথে করাচি গেলাম না কেন। আমি যাই নাই কারণ আমি আর মন্ত্রীসভার সদস্য না এবং তার উপদেষ্টা হবার প্রস্তাব আমি ফিরিয়ে দেই। কিন্তু এখন আমি বুঝি যে ইয়াহিয়ার দুর্বলতা ছিল ব্যাক্তিত্বে। উনি আমার খসড়াটি অনুমোদন করেছিলেন কিন্তু আমার অনুপস্থিতিতে ভুট্টো এবং পীরজাদা আরেকটা খসড়া উপস্থাপন করলে তিনি দুর্বল ব্যাক্তিত্বের কারণে সেই উত্তেজনা সৃষ্টিকারীটাকেই মেনে নেন। যদিও আমি প্রমাণ দিতে পারব না এবং মিলিটারি সেক্রেটারিসহ তার ব্যক্তিগত সহকারীর কাছ থেকে আমি শুনেছিলাম, ইয়াহিয়া ভুট্টোর সাথে মিলে পীরজাদার করা খসড়াটি স্বাক্ষর করার প্রবল বিরোধী ছিলেন। কিন্তু প্রবল চাপের কাছে তিনি এক পর্যায়ে নতি স্বীকার করে নেন ।

আহসান ইয়াহিয়াকে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিলেন, যদি অধিবেশন পিছিয়ে দেয়া হয় তবে পূর্বে রাজনৈতিক পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটবে। ২৮ ফেব্রুয়ারীতেও মনে হচ্ছিলো, ইয়াহিয়া ১ লা মার্চে ঢাকায় আসবেন। প্রেসিডেন্ট আসার আগে স্বাভাবিকভাবে যে সকল কাজ করা হয়, তা করা হচ্ছিলো। যদিও ১লা মার্চে বিমান এসেছিল, কিন্তু তিনি আসেন নি। একজন সরকারি কর্মকর্তার বরাতে জানা যায়, বিমানটিকে ২ বার করাচিতে দেরি করানো হয়েছিলো যদি ইয়াহিয়া আসেন। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত রয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং রিপোর্ট পাওয়া যায় যে, ঐদিন রাতে তিনি ভুট্টোর সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন।

আওয়ামী লীগের সংবিধান খসড়া প্রনয়নের পূর্ণ কমিটি পার্টি অফিসে এসে খসড়াটি সম্পূর্ণ করতে কাজ করছিল। ১ মার্চ ডেডলাইন ধরে উনারা প্রায় কাজটি সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন। হঠাৎ একজন কর্মি এসে বললেন, দুপুর ১টায় রেডিওতে জরুরি একটা ঘোষণা দেয়া হবে। তখন সবাই একটু বিরতি নিয়ে সেটা শুনার অপেক্ষায় থাকলেন। শেখ মুজিব এবং আরও অনেকেই তখন তাঁদের সাথে ছিলেন। শুনার জন্যে একটা রেডিও আনা হয়েছিলো।

দুপুর ০১:০৫-এ একজন এনাউন্স করলো যে এখন ইয়াহিয়ার দেয়া বার্তা শুনানো হবে। মূল কথা ছিল “অনির্দিষ্টকালের জন্যে অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে।” এটি একটি অসম্পূর্ণ ঘোষণা ছিল। কারণ হিসেবে ভবিষ্যৎ সংবিধানে সব দলের মতৈক্য হয় নি বলে বলা হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের রাজনৈতিক সংঘাতের বিষয় তুলে ধরা হয়। বলা হয়, “পশ্চিম পাকিস্তানের এত এত নেতাবিহীন অধিবেশন যদি ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতও হতো, তবে তা নিজেই বিশ্লিষ্ট হয়ে যেত।“ আরও বলা হয়, “এটা দরকারী যে এখন রাজনৈতিক নেতাদের জন্যে কিছুটা সময় দেয়া হোক, যেন সংবিধান প্রনয়নের কাজে কিছুটা সমঝোতার সৃষ্টি হয় এবং এরপর অধিবেশন ডাকা হবে।“

অন্য কথায়, ইয়াহিয়া এটাই বলেন যে সংবিধান প্রনয়নের ব্যাপারে সংখ্যালঘু শাসকগোষ্ঠির সাথে আগেই মতৈক্য হতে হবে। তা না হলে অধিবেশন হবে না। বাঙালিরা আসনসংখ্যায় বেশি হলেও সংসদে তাদের কর্তৃত্বকে এই ঘোষণার মাধ্যমে অস্বীকার করা হয়।

ঘোষণাটি বাঙালি শ্রোতাদের মাঝে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই সংক্ষিপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে বাঙালিদের প্রতি সুদীর্ঘ অবজ্ঞাই আরেকবার প্রকাশিত হয়। আওয়ামী লীগ অফিসের নেতাদের প্রতিক্রিয়া মিনিটের মাঝেই জনগনের মধ্যে ছড়িয়ে পরে। সচিবালয়সহ অন্যান্য সরকারি অফিস, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান খালি হতে শুরু করে। স্টেডিয়ামে একটি ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। রেডিও শোনামাত্র সকলেই সেখান থেকে বেরিয়ে পরে। স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদের জন্যে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে।

রেডিওটি শুনে শেখ মুজিব ঘোষণা দেন, আওয়ামীর সব সংসদ সদস্য যেন দুপুর ৩টায় হোটেল পূর্বানিতে উপস্থিত থাকেন। সেখানে উনি পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে সবাইকে জানাবেন।

এই ব্যাপারে কোন সন্দেহই ছিল না আমাদের ইতিহাসের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী সময় এসেছে। এটা পরিস্কার ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিবে না এবং এভাবেই তারা একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাদের ট্যাঙ্ক ও বিমান বহরসহ প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী আছে। তাদের বিপক্ষে এদিকে আছে সাড়ে সাত কোটি জনতা যারা প্রতিবাদে ফেটে পড়ছিল এবং যারা নতি স্বীকার করবে না। যদিও এরা সশস্ত্র নয় এবং সম্মুখ সমরে অনেক রক্ত ঝরবে ।

এটা পরিস্কার ছিল যে অসহযোগ ছাড়া আর কোন পথ ছিল না বাঙালিদের সামনে। সশস্ত্র সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী। যদিও কবে শুরু হতে পারে, সেটা বুঝা যাচ্ছিলো না। আমি যখন পূর্বানি হোটেলে, তখন বিক্ষুব্ধ জনতা লাঠিসোটা হাতে বিভিন্ন দিক থেকে হোটেলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো । তাদের মুখে একটাই কথা, “স্বাধীনতা চাই”।

এই অবস্থায় মানুষের এরকম প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক ছিল না। ‘৬৯ এর গণঅভ্যুথানের সফলতা ভূপতিত হয়েছিল প্রথমত গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতায় এবং দ্বিতীয়ত সামরিক শাসনের পুনরাগমনে। এরপর ঘূর্ণিঝড়োত্তর সরকারের অসহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড দেখে ভোটের সময় মানুষ তাদের মতামত দিয়েছিলো। কিন্তু এরপরের এরকম কর্মকাণ্ড মানুষের মনে সামরিক সরকার কিংবা তাদের তাবেদার সরকার পাঞ্জাবী দফতরের প্রতি ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিলো । অধিবেশন স্থগিত করায় সরকার কিংবা পাকিস্তানের অখণ্ডতা কোনটার উপরেই মানুষের আর বিশ্বাস ছিল না। ৬৯ এর অভিজ্ঞতা তাদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছিলো যে তারা ইতিহাস তৈরিতে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ রাখতে পারবে। তাই লক্ষ্য স্থির হয়েছিলো স্বাধীনতার জন্যে এবং রাজনৈতিক নেতাদেরকে তাঁরা তাদের সঠিক নেতৃত্ব প্রদানের দাবি জানিয়াছিল।

আওয়ামী লীগের সাংসদরা ঐদিন ৩ টার সময় উপস্থিত ছিলেন। শেখ মুজিব ০৩.২০-এ এসে উপস্থিত হন। পরিস্থিতি নাজুক ছিল। শ’খানেক আন্তর্জাতিক সাংবাদিক বাইরে জড়ো হয়েছিলো। তিনি ঘোষণা দিলেন…শুধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বার্থ রক্ষার জন্যেই সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে যা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা এটুকুই বুঝি যে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি এবং আমরা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলাম।

তিনি ৬ দিনের জন্য অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতালের পাশাপাশি ৭ মার্চ জনসভার ঘোষণা দেন।

প্রাথমিক প্রতিবাদ হিসেবে তাই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। এর মানে কোন বাঙালি ইয়াহিয়া কিংবা সেনাদের সাথে কোন প্রকার সহযোগিতা করবে না। ২ রা মার্চে শেখ মুজিবের কথা ছিল, “প্রত্যেক বাঙালির (সরকারি কর্মচারী সহ) প্রধান কাজ গণবিরোধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন করা এবং সকল প্রকার শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সকল প্রকার কূটচাল ভণ্ডুল করা।” এটাও ঘোষণা দেয়া হয়, “নির্বাচিতরাই এখন একমাত্র কর্তৃত্বের অধিকারী। সকল পক্ষের এটা জেনে রাখা দরকার।“

এরপরের কিছুদিনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলায় প্রশাসন অচল করে দেয়া। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের সরবরাহ এবং পূর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবন যেন অটুট থাকে, টা নিশ্চিত করা।

এটা ঠিক করা হয় যে নির্দেশনা কেন্দ্রিয়ভাবে দেয়া হবে। আমি, তাজউদ্দীন এবং আমিরুল ইসলাম এই ৩ জনকে নির্দেশনার খসড়া তৈরির কাজ দেয়া হয় এবং শেখ মুজিব ও দলীয় নেতাদের অনুমোদনের পর তা বলবৎ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

প্রথম নির্দেশনা ২ রা মার্চ বলবৎ করা হয়েছিল। ৩-৬ মার্চ সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দেশব্যাপি সকল পর্যায়ে হরতালের ডাক। সচিবালয় , হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্ট, সরকারি এবং স্বায়ত্ত্বশাসিত অফিস যেমন পোস্ট অফিস, রেলওয়ে এবং অন্যান্য যোগাযোগ ও পরিবহন খাত (সরকারি ও বেসরকারি), কারখানা, শিল্প, অর্থনৈতিক স্থাপনা এবং বাজার স্থবির হয়ে যায়। তবে এম্বুলেন্স, সাংবাদিকের গাড়ি, হাসপাতাল, ঔষধের দোকান, বিদ্যুৎ এবং পানির সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল।

প্রতি সন্ধায় মিলিটারি কারফিউ জারি করতো। কিন্তু তা মানা হত না। তাঁরা কারফিউ অমান্যকারীদের গুলি চালাতো এবং বেশ কিছু মানুষ মারা গিয়েছিলো। কিন্তু সেনা কমান্ডার জেনারেল ইয়াকুব আরও সৈন্য পাঠানোর কথা বললেন। কারণ গণমানুষের আন্দোলন থামানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।। তার এই ধীরে চল নীতির কারণে মার্চের প্রথম সপ্তাহে টিক্কা খানকে তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত করা হয়। বেলুচিস্তানের জনসাধারণের উপর টিক্কা খানের নির্মমতা প্রসিদ্ধ ছিল।

৩ রা মার্চ ছাত্রদের ডাকা মিটিঙে শেখ মুজিব দাবি করেন, মিলিটারিকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। যদি স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি মানা না হয় এবং জনতাকে দমন করা হয়, তবে মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করবে না। তিনি একই সাথে ‘কর না দেয়ার কর্মসূচী’ চালু করেন।

একই সন্ধ্যায় ইসলামাবাদ থেকে রেডিওতে একটা ঘোষণা আসে। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ১০ মার্চ ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের একটা গোলটেবিল বৈঠক এর প্রস্তাব। সামরিক জান্তা আন্দোলনের প্রভাব আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করে। এই বৈঠকের প্রস্তাব ব্যাপারটাকে আরো উত্তেজিত করে তুলে। কারণ এই প্রস্তাব অনুযায়ী, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল একটি গোল টেবিল বৈঠকে বসবে অন্যান্য দলের সাথে যাঁদের দাবি ও যথার্থথা সকল হিসেবেই প্রশ্নবিদ্ধ। একই সময়ে মিলিটারি কর্তৃক নিরস্ত্র জনতার উপর গুলিবর্ষণ চলছিল।

আমি বুঝতে পারছিলাম, শেখ মুজিবের উপর এই বৈঠক প্রত্যাখ্যানের জন্যে চাপ ছিল। কিছু ফিসফিসানি চলছিল যে সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান না করে একটু সময় নিয়ে অবস্থা বুঝে এরপর সিদ্ধান্ত হবে। কেউ কেউ বলছিল পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। শেখ মুজিব সিদ্ধান্ত নেন যে তৎক্ষণাৎ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হবে। আমাকে ঘোষণাটির খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেয়া হল এবং বলা হল প্রস্তাবটি ‘নিষ্ঠুর হাস্যরসাত্মক’ তাই প্রত্যাখ্যান করা হল। সারাদেশের দৃষ্টি তখন ৭ মার্চের সমাবেশের দিকে নিবদ্ধ হল। বিদেশীরা বলতে লাগলো, স্বাধীনতার ঘোষণা সম্ভবত ঐদিনই দেয়া হবে।

একই সময়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল এবং আন্দোলনের মাঝে এটা অনুভূত হলো যে আন্দোলন দীর্ঘায়িত করার জন্যে জরুরি সরবরাহ এবং কিছু জরুরি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলমান রাখতে হবে, যেন মানুষের কষ্ট বেশি না হয়। যেহেতু ১ লা মার্চেই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেহেতু অনেক সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারিই তাঁদের বেতন তুলতে পারেন নাই। যারা চেকের মাধ্যমে বেতন পেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই বেতন ক্যাশ করতে পারেন নাই। সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও তার বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধানের জন্য দেশের সকল প্রান্ত থেকে জনতা সেই অসহযোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন।

উদ্ভূত নানা সমস্যার মোকাবেলায় মার্চের ৪ তারিখে আরো কিছু বিস্তারিত নির্দেশনা এলো। এসব নির্দেশনাসমুহ ছিল অনেকটা গঠনমূলক অর্থাৎ জনগণকে কোনো কোনো কাজে নিরস্ত থাকার জন্য শুধু আদেশই নয় বরং আওয়ামীলীগের প্রদর্শিত পথে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কাজ করা বা কোনো দায়িত্ব পালন করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। পুর্ব পাকিস্তানে কার্যত সরকার পরিচালনাকারী হিসেবে এটাই ছিল আওয়ামীলীগের প্রথম পদক্ষেপ। এভাবে ৪ই মার্চ পরিষ্কার নির্দেশনা এলো যে সরকারী অফিসসমূহে যেখানে কর্মচারিদের বেতনভাতা তখনো পরিশোধ করা হয় নি, সেগুলো শুধু বেতনভাতার অর্থ প্রদানের জন্য বেলা ২টা ৩০ মিনিট থেকে ৪ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকবে। আরও নির্দেশ এলো যে, অনুর্ধ্ব ১৫০০ রূপির বেতনভাতার চেকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন লেনদেনের জন্য বেলা ২টা ৩০ মিনিট থেকে ৪ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ব্যাংক খোলা থাকবে।

যেহেতু আশঙ্কা করা যাচ্ছিলো যে, ব্যাংক খুললেই পশ্চিম পাকিস্তানে পুঁজি পাচার হতে পারে, সেহেতু সুনির্দিষ্টভাবে আদেশ দেয়া হলো যে বাংলাদেশের বাইরে অর্থপ্রেরণ সংক্রান্ত কোনো লেনদেন কার্যকর হবে না এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। বেলা ২টা ৩০ মিনিট থেকে ৪ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল যাতে সকলের নিকট স্পষ্ট করা যায় যে অফিসসমূহ সকালে স্বাভাবিক নিয়মে খুলছে না বরং আওয়ামীলীগের নির্দেশে এবং আওয়ামীলীগের প্রদর্শিত নিয়মেই সেগুলো কাজ করছে। এছাড়া ডাক্তার, সাংবাদিক, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থানীয় ও দূরবর্তী টেলিফোনকল প্রভৃতিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এসব নির্দেশনা কঠোরভাবে পরিপালন করা হয়েছিল এবং তদুদ্দেশ্যে অফিস ও ব্যাংকসমুহ বেলা ২টা ৩০ মিনিট থেকে ৪ টা ৩০ মিনিট পর্যন্তই কাজ করেছিল। তাছাড়াও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে খাদ্যগুদামসমূহ বিলি-বন্টনার্থে প্রয়োজনে ৪ টা ৩০ মিনিটের পরও খোলা থাকতে পারবে।

কতিপয় ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য অনুযোগ জানালো যে একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে একই বিলে মজুরী পরিশোধ করা হয় বলে চেকের অর্থ ১৫০০ রূপীর চাইতে বেশ বড় অঙ্কের হয়ে যায়। যার ফলে তাদের নগদে পরিশোধ করতে হচ্ছিলো। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর জন্য নির্দেশনা শিথিল করে বলা হলো, ১৫০০ রূপীরও বেশী অর্থের চেক পরিশোধ করতে হলে সর্বমোট অর্থের পরিমান নির্দেশিত মজুরি রেজিস্টার চেকের সাথে উপস্থাপন করতে হবে। বাস্তবে, এতে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় পরবর্তীতে নির্ধারিত হয় যে সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ট্রেড ইউনিয়নের প্রত্যয়ন থাকলেই ১৫০০ রুপীর চেয়ে বড় চেক পরিশোধ করা যাবে।

মার্চের ৬ তারিখে সানাউল হকের নেতৃত্বে বেসামরিক কর্মকর্তাদের একটি দল আমার সাথে দেখা করে জানালেন যে তারা একজোটে শেখ মুজিবকে সমর্থন ঘোষণা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা এটা জানাতে তাঁর সাথে দেখা করতে চাইলেন যে, এখন থেকে তাঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ মোতাবেকই কাজ করবেন। আমি একটি সাক্ষাতের আয়োজন করলাম যেখানে সানাউল হক বেসামরিক কর্মকর্তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং সেখানে তারা আওয়ামীলীগের নির্দেশনার প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে আনুগত্য ঘোষণা করেন। আমার মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য শেখ মুজিব তাদের নির্দেশনা দিলেন এবং যে তিনজন বিশ্বস্ততার সাথে নির্দেশনাসমূহ তৈরির দায়িত্ব পালন করছিলেন তাদেরকে প্রতিদিনই এদের সাথে বসার জন্য পরামর্শ দিলেন। সামনের দিনগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের কাজকর্ম চালানোর জন্য এটিই প্রশাসনের নিউক্লিয়াস হয়ে উঠলো।

মার্চের ৭ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য জনসভায় কেমন অবস্থান দেখানো হবে, সে সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য ৬ই মার্চ শেখ মুজিবের বাসভবনে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি মিটিং আহবান করা হলো। দেশের অভ্যন্তরে প্রত্যাশা ছিল যে ৭ই মার্চ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা আসতে পারে। বস্তুতপক্ষে, ছাত্রসমাজ এবং তরুণরা এমন একটি ঘোষণা খুব করে চাইছিলো। প্রকৃতপক্ষে ৭ই মার্চ আসতে আসতে পরিস্থিতি এমন হলো যে, ছাত্রসমাজ, তরুণেরা এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন জনতার বড় একটি অংশ স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যতীত অন্যকিছু মেনে নেবে কিনা, সেই সন্দেহ পার্টির সদস্যদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে শেখ মুজিব এবং পার্টির ওপরই ছিল এই গুরুভার বহনের দায়িত্ব। ৭ই মার্চে স্বাধীনতা ঘোষণার পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয়েছিল।

একমুখী স্বাধীনতার ঘোষণার ফলে পুর্ন সামরিক শক্তির আক্রমন হতে পারে। এতে যে তারা শুধু বলপ্রয়োগের ছুতা খুঁজে পাবে তাই নয় বরং জোড়পূর্বক অভিপ্রায় সিদ্ধিতে তাঁরা সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পারে। নিরস্ত্র জনতা কি এমন প্রচণ্ড আক্রমন সহ্য করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারবে? বহির্বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কি হবে? পাকিস্তান সরকার কি স্বাধীন বাংলাদেশকে সহজেই স্বীকৃতি দিবে? তেমন একটি স্বীকৃতির আদায় না হওয়া পর্যন্ত একটি শক্তিশালী সুশৃঙ্খল মিলিটারী আক্রমনের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার কি টিকে থাকতে পারবে? এছাড়াও, নানারকম বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার স্বার্থ বিবেচনায় সকলেই কি স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় মেনে নেবে? আরও অনেক প্রশ্নের সাথে এসব প্রশ্নগুলোও উদ্বেগের সাথে আলোচনা করা হয়েছিল। আলোচনায় শেখ মুজিব বিভিন্ন সদস্যদের প্রদত্ত স্বতন্ত্র মতামত শুনলেন। আলোচনায় নানান দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসছিল। আলোচনা চলাকালে ইয়াহিয়ার একটি বিবৃতি সম্প্রচারিত হল। এটি ছিল আগাগোড়া উস্কানিমূলক এবং বাঙ্গালী অনুভূতির প্রতি মারাত্মক অবমাননাকর। এতে বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য শেখ মুজিব এবং আওয়ামীলীগকে দায়ী করা হয়েছিল। বিবৃতিটিতে প্রচ্ছন্ন হুমকির স্বর ছিলঃ

“পর্যাপ্ত সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে পরিস্থিতিকে বেশ ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে জেনেও লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং খুনোখুনির মাদ্ধ্যমে আইনলঙ্ঘন বন্ধ করার জন্য পূর্বপাকিস্তানে আমি একেবারেই ন্যূনতম সংখ্যক ফোর্স ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি…

সবশেষে, আমি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানাতে চাই, যত যাই ঘটুক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি পাকিস্তানী আর্মির নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আছি, পাকিস্তানের পূর্ন এবং নিঃসন্দেহ অখণ্ডতা আমি নিশ্চিত করব। এই ব্যাপারে যেকোনো সংশয় বা ভুল বোঝাবুঝি থাকা চলবে না। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এই দেশ টিকিয়ে রাখা আমার দায়িত্ব। তারা এটাই আমার কাছ থেকে আশা করে এবং আমি তাদের হতাশ করব না। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ লক্ষ লক্ষ নিরীহ পাকিস্তানির জন্মভূমিকে ধ্বংস করবে, তা আমি বরদাস্ত করব না। পাকিস্তানের একতা, সংহতি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এই দায়িত্ব পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এবং এ দায়িত্ব পালনে তারা কখনো ব্যর্থ হয় নি।”

অনুবাদকৃত ভাষার চাইতেও দাম্ভিক স্বরের ইশারায় বুঝা গিয়েছিল, ইয়াহিয়া নিশ্চিত ছিলেন যে মিলিটারি দিয়ে পরিস্থিতির সমাধান সম্ভব এবং তিনি “পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য” যেকোনো পদক্ষেপ এবং মাত্রাহীন বলপ্রয়োগের জন্য নিজেকে ক্ষমতাসম্পন্ন এবং এখতিয়ারধারী বলে মনে করতেন।

বার্তাটির ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। সম্প্রচার শেষ হয়ে গেলে শেখ মুজিব ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে মিটিংটি সন্ধ্যা পর্যন্ত মুলতবী করলেন। ঐ সময়ে তিনি তিনি পরের দিনের বক্তব্য নিয়ে ভাববেন।

সিদ্ধান্ত নেবার গুরুদায়িত্বটি ছিল তাঁর একার কাঁধে। শেখ মুজিব দলের তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মুশতাক, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান প্রমুখ সিনিয়র নেতৃবৃন্দের কাছে পরামর্শ চাইলেন। আমাকেও সেখানে ডাকা হয়েছিল। সুনির্দিস্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাদানের ভালমন্দ দিক সমূহ সতর্কভাবে দেখতে হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এমন একটি ঘোষণা সেনাবাহিনীকে তাদের প্রার্থিত সামরিক আগ্রাসনের সুযোগ এনে দেবে, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে এমন সুযোগ তাদের করে দেয়া যাবে না। পাশাপাশি আন্দোলনের বেগ ধরে রেখে ইয়াহিয়াকে চাপ দিতে হবে যাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমাদের বিবেচনা ছিল, যদি আন্দোলনের বেগ এবং জনতার ঐক্য ধরে রাখা যায়, তবে ইয়াহিয়া এবং মিলিটারী জান্তা বুঝতে পারবে যে সামরিক বলপ্রয়োগে কোনো লাভই হবে না। তাই সুনির্দিষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়ার ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট দাবী তুলে ধরার ছিল, এসব দাবীতে আন্দোলন চালিয়ে নেয়াই ছিল লক্ষ্য যার শেষ পরিণতি ছিল “স্বাধীনতা”। এসব দাবীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলঃ সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া, পশ্চিম থেকে পূর্বপাকিস্তানে অধিকতর সেনা প্রবেশ বন্ধ করা এবং হত্যাকান্ডের তদন্ত করা। শেখ মুজিব বললেন, দুটো দাবীর ওপর জোর দেয়া হবে, প্রথমত মার্শাল ল’ প্রত্যাহার এবং দ্বিতীয়ত, অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

এ অবস্থান তুলে ধরে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রস্তুত করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো, যেটি ৭ই মার্চ এর জনসভা শেষে প্রেসে দেয়া হবে। ভাষণের গুরুত্ব দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে একটি লিখিত সারাংশ তৈরি করে রাখা দরকার, যাতে শেখ মুজিবের বলা শেষ হলে মার্চের ৭ তারিখেই তা প্রেসে ছাড়া যায়। ঐদিন সন্ধ্যাতেই মূল বক্তব্যের একটি খসড়া তৈরী করা হলো। খসড়াটিতে মার্শাল ল’ প্রত্যাহার এবং অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা তুলে ধরা হয়েছিল এবং শেষ প্যারায় বলা হয়েছিলঃ

“বর্তমান আন্দোলনের লক্ষ্য হচ্ছে অবিলম্বে মার্শাল ল’ প্রত্যাহার এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এই লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলবে।”

শেখ মুজিব বললেন, লেখাটি তাজউদ্দীনের হেফাজতে রাখতে এবং সত্যিকার ভাষণের আলোকে প্রয়োজনে যেকোন সংশোধন করে তিনি সেটি প্রচারের ব্যবস্থা করবেন।

৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল মাত্র ১৯ মিনিটের। ঐ ভাষণে কার্যকারী বাক্যটি ছিল: “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এছাড়াও অনতিবিলম্বে মার্শাল ল তুলে নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়। তাজউদ্দীন সাহেব কর্তৃক তদানুসারে সংশোধিত লিখিত প্রজ্ঞাপনেও দুটি পয়েন্ট সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। সুতরাং, যদিও স্বাধীনতা একটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে, শেখ মুজিব একটা আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ঠিক আগমুহূর্তে থেমে থাকেন কারণ পরিষ্কার ভাবে লক্ষ করা যাচ্ছিলো যে, স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হলে তৎক্ষণাৎ আঘাতের জন্য শহরের সুবিধজনক স্থানসমূহে আর্মি নামানো হয়েছে। এখানে মনে হয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আগের দিন রাতে (৬ মার্চ) ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে একজন ব্রিগেডিয়ার ফোন করে বলেন যে তিনি (ইয়াহিয়া) খুব শীঘ্রই ঢাকা আসবেন এবং এমন সমঝোতায় পৌঁছানোর আশা প্রকাশ করেন যেটা বাঙালিদের সন্তুষ্ট করবে। কৌতুহল উদ্দীপক এই যোগাযোগটাকে ৭ মার্চের সম্মেলনে শেখ মুজিবের অবস্থানকে প্রভাবিত করার মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। এই বার্তাটিকে ইয়াহিয়ার নিজেকে নির্দোষ রাখার একটা চক্রান্ত হিসেবেও দেখা হয়; কারণ, যদি স্বাধীনতার ঘোষণা করা হতো তাহলে ইয়াহিয়া বিশ্ববাসীর দিকে ফিরে বলতে পারতো যে- সে ঢাকায় গিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু শেখ মুজিব ইউডিআই (ইউনিল্যাটেরাল ডিক্লেরেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স) ঘোষণা করে বল প্রয়োগকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। ৭ই মার্চে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা না দেওয়ার পিছনে এটাও শেখ মুজিবের আরেকটি বিবেচনার বিষয় ছিল।

পরবর্তী সপ্তাহের একটি নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছিল। ট্যাক্স না দেয়ার কর্মসূচী চলমান রাখা হয়েছিল। প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক লেনদেন চালু রাখতে অন্যান্য দায়মুক্তি এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ঘোষণা করা হয়েছিল মার্চের ৭ তারিখে এবং ৯ তারিখে। রেলওয়ে এবং পোর্ট কার্যকর রাখার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু তা যদি জনগণকে চাপে রাখার জন্য পাক আর্মি পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয়, তবে সহযোগিতা না করার নির্দেশনা ছিল। ৮ মার্চের নির্দেশনা ছিল ব্যাংকগুলোর প্রতি সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা। এগুলো বাঙালি ব্যাংকারদের সাথে একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়, যারা সুনির্দিষ্ট কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছিল যা বিভিন্ন পক্ষ মোকাবেলা করছিল। এই নতুন নির্দেশনায় চালু মিল সমূহের জন্য কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য ব্যাংকের লেনদেন অনুমোদিত ছিল এবং নির্ভেজাল ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ ১০০০ রুপি উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া হয়। অপরিহার্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম পালনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যেন সার এবং সেচের পাম্পের জন্য ডিজেল সরবরাহে সংশ্লিষ্ট সরকারী অফিস সমূহ খোলা রাখা হয়। আরো নির্দেশনা ছিল যে খাদ্য, ইটভাটার জন্য কয়লা সরবরাহ এবং পাট ও ধানের বীজ সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।

কিছু সারিবদ্ধ নির্দেশনা কার্যকর করার জন্য পরবর্তীতে এ কে এন আহমেদ, করাচী থেকে আগত একজন জ্যেষ্ঠ বাঙালি স্টেট ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ব্যাংকারদের সাথে আরো মিটিং করা হয়…

মার্চের ১৫ তারিখে ইয়াহিয়া ঢাকায় আসে।। শেখ মুজিব ১৬ই মার্চ সকালে তার সাথে দেখা করেন। বৈঠকটি প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। শেখ মুজিব ফিরে এসে সিনিয়র নেতাদের ডাকেন। আমাকেও ডাকা হয়। এই প্রক্রিয়াটা পরবর্তী সপ্তাহগুলোতেও চালু ছিল। ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টাদের সাথে প্রতি বৈঠকের পর সিদ্ধান্তগুলো পুনঃবিবেচনা করার জন্য এমন মিটিং ডাকা হতো। শেখ মুজিব বলেন যে ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের সিদ্ধানের সাফাই গাওয়া দিয়ে শুরু করেছে। শেখ মুজিব তাকে এই চরম ভুল সিদ্ধান্ত নেবার আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তার (শেখ মুজিবের) সাথে আলোচনা না করার জন্য দোষারূপ করেন। ইয়াহিয়া তারপর বলে যে সে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের পথ খুঁজতে চায়। এ প্রেক্ষিতে শেখ সাহেব তাকে বলেন যে, যা কিছু ঘটেছে তার উপর এবং জনতার আকাঙ্ক্ষার দিকে দৃষ্টি রাখলে, ৭ই মার্চে যে দাবী সমূহ তোলা হয়েছে তার থেকে কিছু কম মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। স্পষ্ট করে বললে দ্রুততম সময়ে মার্শাল ল তুলে নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই যথেষ্ট। ইয়াহিয়া তারপর বলেন যে, তাকে উপদেশ দেয়া হয়েছে যে সংবিধান প্রবর্তনের পূর্বে মার্শাল ল তুলে নেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা রয়েছে। এ কথার প্রেক্ষিতে শেখ মুজিব বলেন যে, তিনি তার আইন বিশেষজ্ঞদের বলবেন ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য এবং কোন আইনি জটিলতা সৃষ্টি হবে না এই মর্মে তাদের আশ্বস্ত করবেন।

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে শেখ সাহেব আমাকে তথাকথিত আইনি জটিলতার ব্যাপারে আলোচনার জন্যলে. জে. পীরজাদার সাথে ঐদিন সন্ধ্যায় দেখা করতে নির্দেশ দেন। আমি ঐদিন সন্ধ্যায় পীরজাদার সাথে দেখা করি এবং বলি যে তারা অনৈতিকভাবে অধিবেশন বাতিলের দায়ে দোষী। যে ভাবে এটি করা হয়েছে, তা সমগ্র বাঙালি জাতি একটি অপমান হিসেবে গ্রহণ করেছে, এ কথাটিও তাকে জানিয়ে দেই। সে অস্বস্তিতে ছিলেন এবং রক্ষণাত্মকভ অবস্থানে ছিলেন। তারপর সে অনতিবিলম্বে মার্শাল ল প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে আসেন। তিনি এই বলে যুক্তি দেখান, যদি সংবিধান প্রণয়নের পূর্বে মার্শাল ল তুলে নেওয়া হয় তবে একটি আইনি শূন্যতার সৃষ্টি হবে। আমি তৎক্ষণাৎ এই যুক্তির প্রতিবাদ করে বলি, মার্শাল ল প্রত্যাহার এবং একটি সংবিধান প্রণয়নের অন্তর্বর্তীকালীন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সমঝোতার আদেশ (একটি অস্থায়ী সংবিধান) জারী করা যেতে পারে। এটা রাষ্ট্রপতি / প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জারী করতে পারেন, সেই একই আদেশ দ্বারা যা দিয়ে তিনি মার্শাল ল জারী করেছিলেন। এই যুক্তি স্পষ্টভাবে আসন্ন আলোচনায় তুলে ধরা হয়েছিল।

পরদিন সকালে, মার্চ ১৭, শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করেন এবং মার্শাল ল প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী পুনর্ব্যক্ত করেন। ইয়াহিয়া আবারো আইনি জটিলতার কথা বলে এবং জানান যে বিচারপতি কর্নেলিয়াসকে ডাকা হয়েছে। এ সকল প্রশ্ন বিবেচনার জন্যযে কিনা এখন তার আইন উপদেষ্টা। ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের সাথে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের একটা বৈঠক প্রস্তাব করা হয়। ১৭ই মার্চ সন্ধ্যায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ এবং আমি নিজে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা মণ্ডলী পীরজাদা, কর্নেলিয়াস এবং কর্নেল হাসানের (জাজ এডভোকেট জেনারেলের) সাথে বৈঠকে বসি। বৈঠকে পীরজাদা তার পর্যবেক্ষণ দিয়ে শুরু করেন যে সকালে শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার আলোচনা এমন দিকে অগ্রসর হয়েছে যে ইয়াহিয়াকে একটা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে হবে। সে কিছু মৌলিক উপাদানের দিকে নির্দেশ করেন যা এমন ঘোষণার সাথে যেতে পারে। সেগুলো আলোচনাগুলো থেকে উঠে এসেছে। তার ভাষ্য মতে, শেখ মুজিব প্রস্তাব করেছেন যে পূর্বের জন্য আলাদা করে সংবিধান রচনা করবে পূর্বের সদস্যরা এবং পশ্চিমের জন্য সংবিধান রচনা করবে পশ্চিমের সদস্যরা। পরে তারা সকলে একত্রে বসে পাকিস্তানের জন্য সংবিধান রচনা করবে। ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল ছিল যে পূর্বে ৬ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের বিধান রাখা হবে। পশ্চিমের প্রদেশগুলো ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী স্বায়ত্ত্বশাসন উপভোগ করবে এবং অতিরিক্ত ক্ষমতাসমূহ কেন্দ্রে থাকবে। কর্নেলিয়াস বলেন যে, এমন একটা ইন্সট্রুমেন্ট-একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান- প্রণয়ন জাতীয় পরিষদের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হতে পারে। এরপর প্রস্তাব করা হয়েছিল এমন একটা ইন্সট্রুমেন্টের খসড়ার কাজে হাত দেয়ার পূর্বে দুই পক্ষের উপদেষ্টাদের শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার সাথে একটা পরিকল্পনা মিটিং করলে ভাল হবে, এতে মূল দিকনির্দেশনাসমূহ তাদের কাছ থেকে নেওয়া যাবে।

মার্চ ১৭ তারিখে পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্রে যা বলা হয়েছে, তা সত্য নয়। কারণ একটা মার্শাল ল রেগুলেশনের খসড়া ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে মন্ত্রীদের কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে যা প্রদেশের গভর্নরদের উপদেশ দেবে অথবা এমন কোন রেগুলেশন যা মার্শাল ল কে পিছনের দিকে ঠেলে দিবে। আলোচনা মূলত হয়েছিল উপরে উপরে এবং বেশীরভাগ সময় তা পীরজাদা এবং কর্নেলিয়াসের করা আইনি শুন্যতা সৃষ্টির প্রশ্নে অতিবাহিত হয়। পাল্টা যুক্তি হিসেবে একটা ঘোষণার প্রস্তাবনা আনা হয়, যা মার্শাল ল প্রত্যাহার এবং নতুন সংবিধান গ্রহণের মাঝে সেতু হিসেবে কাজ করবে।

এটা এখন দলিলে আছে যে ১৭ই মার্চের বৈঠক শেষে ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানকে বলে- ‘গেট রেডি’ এবং সে অনুযায়ী ১৮ই মার্চের সকালে মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা ও রাও ফরমান আলি সমগ্র প্রদেশের উপর মিলিটারি আগ্রাসনের নীল নকশা আঁকে যা ২৫ মার্চ হতে কার্যকর হবে। কোড নেম- ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

১৯ মার্চ সকালে, শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সাথে আরেকটি মিটিং করেন এবং একমাত্র সমাধান হিসেবে মার্শাল ল তুলে নেওয়া এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপর জোর দেন। একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারী করা যেতে পারে মধ্যবর্তী সময়ের জন্য। এমন একটা অধ্যাদেশ প্রেসিডেন্ট জারি করতে পারেন। সেদিন সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের সাথে বসেন।

পাকিস্তানী সরকারের শ্বেতপত্রে যা প্রকাশ করা হয়েছে তা সত্য নয়। সে অনুযায়ী আওয়ামী লীগের দাবীসমূহ ‘আইনতভাবে যতটা করা সম্ভব ততটা’ পূরণ করতে প্রেসিডেন্টের টিম একটি মার্শাল ল নীতিমালা প্রস্তাব করেছিল।

মার্শাল ল নীতিমালা সংক্রান্ত এমন কোন খসড়া নথি পত্র নেই। তথাপি ঐ দিন সকালে অনেকটা সময় ব্যয় করা হয় আইনি শূন্যতা নিয়ে কথা বলে, এরপর এমন কোন নীতিমালা লেখার প্রস্তাব আসে নি।

২০ মার্চ সকালে শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করেন। এই দিন তিনি সাথে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনছুর আলী, খোন্দকার মুশ্তাক আহমেদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং আমাকে সাথে নিয়ে যান। ইয়াহিয়ার দিকে পীরজাদা, কর্নওয়ালিস এবং কর্নেল হাসান উপস্থিত ছিলেন।

আগের দিন যখন আর্মি ট্রাক টঙ্গী অতিক্রম করছিল, তখন তারা জনতার আক্রমণের মুখে পড়ে এবং আর্মির সাথে জনতার গুলি বিনিময় ঘটে। এটাকে আর্মির বিরুদ্ধে জনতার প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধও বলা যায়। শ্বেতপত্রে আরও বলা আছে যে ‘এম ভি সোয়াত’ জাহাজ থেকে আর্মির সাধারণ পরিবহন খালাশে জনতা বাঁধা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আদতে বাঙালিদের জন্য তা ছিল গণহত্যার জন্য খালাশকৃত অস্ত্র। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। উত্তেজনার বশে ইয়াহিয়া বলে যে, যদিও সে আলোচনার জন্য এসেছে এবং আর্মিকে সংযত থাকতে বলেছে কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগ আর্মির চলাচলে বাঁধা দিলে তা সে মেনে নেবে না। শেখ মুজিবও শক্ত জবাব দেন। তিনি বলেন, যখন আলোচনা চলছে তখন আর্মির উচিৎ ছিল ব্যারাকে থাকা। ইয়াহিয়া জবাবে বলেন, তারা ব্যারাকেও থাকলেও আর্মি রসদ অবশ্যই চালু থাকতে হবে। শেখ মুজিব তারপর বলেন, ঐভাবে আর্মিদের ট্রাকে করে চলাচল মানুষের কাছে উস্কানিমূলক লেগেছে। কারণ ইতিঃপূর্বে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যখন আর্মি নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর গুলি চালিয়েছে। এই কিছুদিন আগে জয়দেবপুরের খুব কাছেই এমন একটা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে যেখানে সাধারণ নিরস্ত্র তরুণদের উপর আর্মি গুলি চালিয়েছে। এ সকল কারণে সাধারণ মানুষের অনুভূতি তিক্ত হয়ে আছে। শেখ মুজিব বললেন, জনতার এমন মানসিক অবস্থায় আর্মির মোটেই উস্কানি দেওয়া উচিৎ হয় নি। তিনি আরও বলেছিলেন, আপনার জানা উচিৎ যদি সাধারণ নিরস্ত্র মানুষ গুলি খেতেই থাকে, তবে তাঁরাও একসময় অস্ত্র তুলে নিয়ে পাল্টা গুলি করতে বাধ্য হবে। তাই একটা রাজনৈতিক সমাধানই কাম্য এবং এতে আর কোন রক্তপাত হবে না।

শেখ মুজিবের এই কড়া জবাব সম্ভবত ইয়াহিয়ার উপর কিছু প্রভাব ফেলে এবং সে রাজনৈতিক সমাধানের প্রসঙ্গে ফিরে আসে এই বলে যে, সে একজন সাধারণ মানুষ। ইতোমধ্যে সে শেখ মুজিবের দাবীসমূহ নীতিগতভাবে মেনে নিতে চেয়েছেন। কিন্তু তাকে এই বিশেষজ্ঞরা বলেছে যে সংবিধানের আগে মার্শাল ল বিলুপ্ত হলে আইনি শূন্যতা দেখা দিবে। কর্নওয়ালিস এই পয়েন্ট ধরে বসে সংবিধানের আইন এবং একটা আইনি কাঠামোতে সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন অভিভাবকের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে একটা ছোটখাটো লেকচার পড়ে শোনান। আমি সাথে সাথে এর জবাব দিই এই বলে যে, এমন কোন শূন্যতা আসবেই না যদি ইয়াহিয়া একটা অন্তর্বর্তীকালীন সমঝোতা আদেশ হিসেবে একটি ইন্সট্রুমেন্ট ঘোষণা করেন যা নতুন সংবিধান গ্রহণ পর্যন্ত বহাল থাকবে। এই বিষয়ে পাল্টাপালটি যুক্তি চলতেই থাকবে বুঝে আমি ভাবলাম যে এই পয়েন্টে একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করালে হয়ত কোন সমাধান পাওয়া যাবে। যেমন এ কে ব্রহি যার পরামর্শ ওদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। আমি জানতাম ব্রহি ঢাকাতে আছেন এবং তার সপরামর্শ আওয়ামী লীগের পক্ষে যাবে এ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কারণ এটা আইন সঙ্গত। আমি আরও জানতাম কর্নওয়ালিস ব্রহিকে সম্মান করেন এবং তার পরামর্শ মেনে নিবেন। আমার এই ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়। কর্নওয়ালিস বলে যে এমন মতামত সাহায্যকারী হবে। আমি এই মতামত নেয়ার এবং যথাস্থানে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করি। শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার দিকে ফিরে বলেন, “রাজনৈতিক অচালবস্থা নিরসনের পথ বিশেষজ্ঞরা তখনি বের করতে পারবেন যখন আমরা প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা তাদের প্রদান করব।“

এরপর প্রস্তাবিত নথির মূল বিষয়গুলো লিখে রাখার প্রস্তাব করা হয়। এগুলো খসড়া প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত ছিলঃ

ক) মার্শাল ল তুলে নেওয়া
খ) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর
গ) পূর্বে বর্ধিত স্বায়ত্তশাসন (এটা ছয় দফার আলোকে করার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়)

সেদিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের সাথে বসে এ প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা করবেন মর্মে সকলে রাজি হন।

ইয়াহিয়া তারপর বলে যে তার উচিৎ পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আলোচনা করা। শেখ মুজিব বলেন যে এটা শুধু তার নিজের ব্যাপার এবং নিজের ইচ্ছামতো এ বিষয়ে আগানোর ব্যাপারে তার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। ইয়াহিয়া বলে তার পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা নেয়া দরকার। তা না হলে এটা তার জন্য খুব বড় দায়িত্ব হয়ে যাবে। সে আরো বলে যে সকল রাজনৈতিক দল তাকে রাষ্ট্রীয় ঘোষণা দিতে বলছে, তাদের সেটা লিখিত দিতে হবে।

ইয়াহিয়া তারপর বলে সে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের আমন্ত্রণ জানাতে চায়। বিশেষ ভাবে ভুট্টোকে। শেখ মুজিব বলেন, প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীন এবং এটা তার ইচ্ছা। তবে শেখ মুজিব বলেন যে তিনি ভুট্টোর সাথে সরাসরি দেখা করবেন না। তবে ইয়াহিয়া আলাদা করে দেখা করতে পারেন। প্রায় ছয় সপ্তা আগে এক আলোচনার আগে ও পরে ভুট্টো ও তার দলের আচরণের কারণে এমন অভিব্যক্তি তিনি ব্যক্ত করেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল এই যে, দেখা যাচ্ছিল ইয়াহিয়া আর ভুট্টো মূলত একই রকম কথা বলছিল। তাই তাদের আলাদা আলোচনা করতে দিলে আলোচনায় এগিয়ে থাকা যাবে।

আমি সরকারী দিক থেকে খসড়া নথি প্রস্তুত করার প্রস্তাব করি যেহেতু তারা আইন মন্ত্রণালয়ের সম্পদ ব্যবহার করতে পারবে। মন্ত্রণালয়ের আইনি খসড়াসম্যান খসড়া করবে বলে পরামর্শ দেয়া হলো। খসড়ার একটি কপি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের কাছে তৈরির সাথে সাথে প্রেরণ করতে হবে।

২১ মার্চ সকালে আমি শেখ মুজিবের খোঁজে যাই। সে এবং তাজউদ্দীন একটা আলোচনার মাঝে ছিলেন। তিনি আমাকে তার একটা দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানালেন যে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলেন এবং তার মতে জনতার চাহিদার কথা চিন্তা করলে অনতিবিলম্বে শুধু প্রদেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের দিকে আওয়ামী লীগের জোর দেওয়া উচিৎ। কেন্দ্রের ক্ষমতা এখনই দখল উচিৎ হবে না। তাঁর এই সিদ্ধান্তে আসার পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিলঃ

১. ছাত্র সমাজ গণজাগরণের সাথে কোন রকম সমঝোতার বিপক্ষে ছিল এবং শুধু ক্ষমতার জন্য যেন আওয়ামী লীগ দাবীসমূহ থেকে সরে না আসে সেই পক্ষে ছিল। কেন্দ্রের ক্ষমতা গ্রহণ সমঝোতা হিসেবে দেখা হতো। এমনকি কিছু ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে এ বিষয়ে জোর করেন।

২. একটা সংবিধানের অনুপস্থিতিতে কেন্দ্রের ক্ষমতা গ্রহণ করলে আওয়ামী লীগের পক্ষে কেন্দ্র পরিচালনায় অচালবস্থা সৃষ্টির ঝুঁকি থাকে এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের আগেই এটা তাদের জন্য অসম্মানের ব্যাপার হবে ।

৩. শুধু প্রদেশের ক্ষমতা গ্রহণ একটা ফর্মুলা হিসেবে কাজ করবে যেখানে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রের দায়িত্ব নেয়ার আগেই তার অবস্থান শক্ত করতে পারবে। আমলাতন্ত্রে এবং আর্মিতে পাঞ্জাবীদের আধিক্যের কথা বিবেচনা করলে কেন্দ্রের দায়িত্ব তাদের জন্য পালন করা কঠিন হবে ।

৪. এটা আওয়ামী লীগকে প্রাদেশিক সরকারের সম্পদসমূহ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিবে যা আলাদা করে পুলিশ এবং ইপিআর বাহিনীকে সশস্ত্র সংঘাতের জন্য প্রস্তুত করবে। যে সংঘাতের সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে।

মনে হলো, ইয়াহিয়া নিজেই এই ফর্মুলার প্রতি সমর্থন জানাবে কারণ এর মাধ্যমে তিনি কেন্দ্রে তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবেন। এই প্রেক্ষিতে শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দীন দ্রুত ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠকের আবেদন করেন। তাঁরা ইয়াহিয়াকে বললেন যে, এমতাবস্থায় শুধু প্রদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক।

এই সময়ে ব্রহি একটা বিস্তারিত মতামত লিখে স্বাক্ষর করেন। এটা কর্নেল হাসানের কাছে পৌঁছানো হয়। পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র এই মর্মে স্থূল মিথ্যা বলার দায়ে দোষী যে, আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণাপত্রের আইনি যথার্থতার সমর্থনে কোন সংবিধান বিশেষজ্ঞ আনতে পারে নি।

মার্চের ২১ তারিখে শোনা যায় কর্নেল হাসান রাষ্ট্রপতির একটা লিখিত অধ্যাদেশ তৈরি করেছেন। সেটা সংগ্রহ করতে একজনকে পাঠানো হয়। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা এই খসড়া পরীক্ষা করে দেখেন। দেখে বোঝা যায় যে এটা খুব দ্রুত তৈরি করা হয়েছে। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটা পূর্ব এবং পশ্চিমের সদস্যদের আলাদা আলাদা কমিটির কথা বলে। এটাতে আরও লেখা ছিল যে, যেদিন প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীরা শপথ নেবেন সে দিন থেকেই মার্শাল ল বাতিল হয়ে যাবে। এই খসড়ার যথার্থতা যাচাইয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা দেখতে পান যে এটা অনেক বিষয়ে অসম্পূর্ণ এবং অনির্দিষ্ট। প্রথমত, তাদের দৃষ্টিটা এমন যেন মার্শাল ল প্রত্যাহারের ব্যাপারটা খুব দ্রুত হবে এবং এর কোন দীর্ঘসূত্রিতা হবে না। মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের সাথে সাথে যা কার্যকর হবে। কিন্তু এটা এমন একটা পদ্ধতি যা দীর্ঘ করা সম্ভব। কারণ পাঁচটা প্রদেশ এখানে জড়িত। এটা ধরে নেয়া হয়েছিল যে ঘোষণা আরও দ্রুত কার্যকরি হবে। আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিরা একটা ফর্মুলা প্রস্তাব করেন, যেখানে ঘোষণা কার্যকর হবে প্রাদেশিক গভর্নরদের নিয়োগের মাধ্যমে অথবা ঘোষণা দেওয়ার ৭ দিন অতিবাহিত হবার পর, যেটা আগে হয়।

এই সময়ে ভুট্টো ২১ মার্চ বিকালে এসে উপস্থিত হয়। আমার মনে আছে, যখন সংশোধিত খসড়াটি উপস্থাপন করা হয়, তখন কর্নেলিয়াস বলতে বাধ্য হন যে এটা প্রকৃতপক্ষে অনেক উন্নত এবং আরো সম্পূর্ণ হয়েছে। আমি সাথে সাথে বলি যে এটাকে আওয়ামী লীগের খসড়া বলে বর্ণনা করা যাবে না। খসড়া করার সম্পূর্ণ কার্যটি একটি যৌথ প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে গণ্য করা উচিৎ। এরপর সংশোধিত ঘোষণাপত্রের প্রতিটি বিধি পড়ার কাজ শুরু হয়। পীরজাদা বলেন যে তিনি ভুট্টোর উপদেষ্টাদের সাথে দেখা করবেন এবং সংশোধিত খসড়ার একটা কপি ভুট্টোর কাছে পাঠানো হয়েছে।

ভুট্টোর নিজের ভাষায় তাঁর অবস্থানঃ

“ঐদিন সন্ধ্যা ৭.৩০ -এ আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে প্রেসিডেন্ট ভবনে দেখা করি। প্রেসিডেন্ট আমাকে ১৬ থেকে ২০ শে মার্চ শেখ মুজিবের সাথে টানা আলোচনার ব্যাপারে অবহিত করেন এবং ১৮ তারিখের একটা সংবাদ সম্মেলনের কথা বলেন যেখানে তিনি বলেছেন যে আলোচনার অগ্রগতি হয়েছে। ফলস্বরূপ আওয়ামী লীগের এবং প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিরা প্রস্তাবিত সাংবিধানিক আয়োজনের ব্যাপারে আলোচনায় বসেন। প্রেসিডেন্ট আমাকে আওয়ামী লীগ নেতাদের তৈরি করা প্রস্তাবনার ব্যাপারে জানান।

ঐ প্রস্তাবনার মূল অংশগুলো হলো এই যে, অনতিবিলম্বে মার্শাল ল তুলে নেয়া হবে এবং কেন্দ্রিয় সরকারকে প্রভাবিত না করে পাঁচ প্রদেশের কাছে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা চলে যাবে। প্রস্তাবনামতে প্রেসিডেন্ট বর্তমানের মত কেন্দ্রীয় সরকার চালু রাখতে পারবেন। অথবা তিনি চাইলে এমন উপদেষ্টাদের সহযোগিতা নিতে পারবেন যারা জনপ্রতিনিধি নয়। এটাও প্রস্তাব করা হয়েছে যে জাতীয় পরিষদ দুইটি কমিটিতে ভাগ হবে। একটা পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য এবং অন্যটি বাংলাদেশের জন্য ঢাকাতে। কমিটি দু’টি নির্ধারিত সময়ের ভিতর পৃথক রিপোর্ট তৈরি করবে এবং জাতীয় পরিষদে তাদের প্রস্তাবসমূহ উপস্থাপন করবে। এরপর জাতীয় পরিষদের কাজ হবে দুই কমিটির প্রস্তাবনার উপর আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে একসাথে বসবাসের পথ বের করা। ১৯৬২ সালের সংবিধান সংশোধন করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির মাধ্যমে এটি প্রণয়ন করা হবে। যেখানে পূর্ব পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে ৬ দফার ভিত্তিতে এবং পশ্চিম পাকিস্তান ক্ষমতা পাবে ১৯৬২ সালের সংবিধান মতে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের ভিত্তিতে দুই পক্ষের সম্মতিক্রমে প্রদেশসমূহ নিজেদের স্বায়ত্ত্বশাসনের পথ করে নিতে পারবে। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের আকারে সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটি প্রকাশ করা হবে।“

ভুট্টো তারপর বলেনঃ

“প্রস্তাবনাটি বর্ণনার পর, ইয়াহিয়া আমাকে (ভুট্টো) বলেন যে সে শেখ মুজিবের কাছে এটা স্পষ্ট করেছেন যে তার সম্মতি প্রাথমিকভাবে ভুট্টোর সম্মতির উপর নির্ভর করবে। তবে তিনি আরো সন্তুষ্ট হবেন যদি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতারাও তাদের সম্মতি দেন।“

২২ মার্চ সকালে শেখ মুজিব ইয়াহিয়াকে পুনরায় আলোচনা শুরু করার জন্য আহ্বান করেন। তখন দুই পক্ষ লিখিত ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন। শ্বেতপত্রে লেখা হয়েছে ইয়াহিয়া ভুট্টোকে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করাতে রাজি করিয়েছেন। এটি সত্য নয়। সত্যি কথা বলতে শেখ মুজিব যখন ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করতে যান, তখন ভুট্টোকে উপস্থিত দেখে তাকে একপাশে নিয়ে যান কথা বলার জন্য। শেখ মুজিবের ভাষ্যে তিনি ভুট্টোকে বলেন যে তাদের জন্য বারান্দায় গিয়ে কথা বলা উত্তম যেন তাঁদের কথা অন্য কেউ না শুনে।

ভুট্টোর নিজের ভাষায় এই বৈঠকে যা হয়েছিলঃ

“২২ তারিখ সকালে আমি নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে প্রেসিডেন্ট হাউজে উপস্থিত হই। মুজিবুর রহমান ঠিক ১১টার সময় আসেন। আমরা শুভেচ্ছা বিনিময় করি এবং কিছু আনুষ্ঠানিক কথা বলি।

এরপর আমাদের প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আরেকবার সেখানে আনুষ্ঠানিক সৌজন্য বিনিময় হয়…

মুজিবুর রহমান এরপর প্রেসিডেন্টের দিকে ফিরেন এবং বলেন যে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে তিনি তার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছেন কিনা। প্রেসিডেন্ট মনে করিয়ে দেন যে এতে আমারও সম্মতির প্রয়োজন এবং সে কারণেই আমি আলোচনাতে উপস্থিত ছিলাম। এই ব্যাপারে শেখ মুজিব বলেন যে প্রস্তাবটি প্রেসিডেন্ট বরাবর পেশ করা হয়েছে এবং আমাকে রাজি করানো প্রেসিডেন্টের এখতিয়ারের মাঝে পড়ে এবং একইসাথে বলেন যে ভুট্টো সাহেব প্রস্তাবসমূহের মৌলিক বিষয়াদিতে রাজী হয়েছেন। তাঁরা আনুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যেতে পারতেন কিন্তু তারপর আলোচনাগুলোলো অনানুষ্ঠানিক দিকে চলে গেল এবং শেখ মুজিব চলে যাবার পর প্রেসের কাছে গিয়ে বললেন যে তিনি প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেছেন। সেখানে ভুট্টোও উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন যে এটা যথেষ্ট নয় কিন্তু শেখ মুজিব অনড় ছিলেন…“

বের হয়ে যাবার পথে যখন আমরা প্রতিরক্ষা সচিবের রুমে ঢুকি, শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেনারেল মুহাম্মদ উমর, প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা সচিব জেনারেল ইসহাক এবং প্রেসিডেন্টের নেভাল এইডে-ডি-ক্যাম্প অর্থাৎ যারা ঐ রুমে উপস্থিত ছিলেন, তাদের বের হয়ে যেতে বলেন। কারণ তিনি আমার সাথে কথা চান। তার এই আকস্মিক আচরণ পরিবর্তনে আমি একটু অবাক হই। তিনি আমার হাত ধরে তার সামনে বসান। তিনি বলেন অবস্থা খুবই নাজুক এবং তিনি অবস্থার উন্নতির জন্য আমার সাহায্য চান। এই অবস্থায় রুমে আড়িপাতা হতে পারে চিন্তা করে আমরা বারান্দা ধরে বাড়ির পিছে প্রেসিডেন্টের আচ্ছাদিত আঙ্গিনায় গিয়ে বসি।

শেখ মুজিবুর রহমান আমার আগের কথাগুলো বললেন। এবং আরো বললেন যে ব্যাপারগুলো অনেক দূর গড়িয়ে গেছে এবং এখন আর পিছনে ফেরা সম্ভব না। তার মতে আমার জন্য সর্বোত্তম পথ হবে তার প্রস্তাবনা গুলো মেনে নেওয়া। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে আর কোন বিকল্প নেই। তিনি আমাকে বলেন যে তিনি বুঝতে পেরেছেন পিপলস পার্টিই পশ্চিম পাকিস্তানের একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি এবং অন্য পার্টিগুলো তার সময় নষ্ট করছিল। তিনি আমাকে জানান যে খান আবদুল ওয়ালি খান যার পার্টি অন্তত একটা প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে, তাকে ছাড়া বাকি সব পার্টিকে তিনি বাদ দিয়েছেন যখন তারা তাকে ডাক দিয়েছে। তিনি বলেন তিনি এখন এ বিষয়ে আশ্বস্ত যে তার এবং আমার একমত হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আমাকে বলেন যে আমি পশ্চিম পাকিস্তানে যা খুশী করতে পারি এবং তিনি আমাকে সমর্থন দিবেন। এর বিনিময়ে আমি যেন পূর্ব-পাকিস্তানে ছেড়ে দিই এবং আওয়ামী লীগের প্রস্তাব বাস্তবায়নে তাকে সহযোগিতা করি। তিনি পরামর্শ দেন যে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারি এবং তিনি পূর্বপাকিস্তানের দায়িত্ব নিবেন। তার মতে এটাই একমাত্র সমাধানের পথ। তিনি আমাকে মিলিটারিদের ব্যাপারে সতর্ক করেন এবং ওদের বিশ্বাস করতে নিষেধ করেন; যদি ওরা তাকে ধ্বংস করে তবে ওরা পরে আমাকেও ধ্বংস করবে। আমি উত্তরে বলি, আমি ইতিহাসের কাছে ধ্বংস হবার থেকে মিলিটারির কাছে ধ্বংস হবো। তিনি আমাকে দুই কমিটির প্রস্তাবনা শুরু থেকে মেনে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন…

আমি তাকে বলি যে আমি স্বাভাবিকভাবে তার প্রস্তাব অত্যন্ত মনোযোগের সাথে চিন্তা করব এবং একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসার জন্য যা করা সম্ভব সব করবো। যাই হোক, প্রস্তাবনার চূড়ান্ত রূপ যেমনই হোক না কেন, সেটা অবশ্যই জাতীয় অধিবেশনে পাশ হতে হবে, জরুরী হলে প্রেসিডেন্টের অধ্যাদেশ আকারে পাশ হবে। আমি তাকে আরও জানাই যে, অধিবেশনের বাইরে প্রস্তাবনার ব্যাপারে আমি কোন রকম নিশ্চয়তা দিতে প্রস্তুত নই…

মুজিবুর রহমান অধিবেশনের ব্যাপারটা একেবারেই বাতিল করে দেন। এমনকি সংক্ষিপ্তভাবেও অধিবেশনের কোন প্রয়াস তিনি বিবেচনায় আনলেন না। যে রকমেরই সমাধানে তিনি যাবার জন্য মন স্থির করেছিলেন না কেন, সেখানে সমগ্র দেশের জন্য বসা জাতীয় অধিবেশনের কোন স্থানই ছিল না। এই দৃষ্টিভঙ্গি জানানোর পর তিনি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ান। আমি তাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেই এবং একে অন্যকে বিদায় জানাই। এটাই ছিল আওয়ামী লীগের নেতার সাথে আমার শেষ বৈঠক।“

ভুট্টোর উদ্ধৃতি শেখ মুজিবের মূল অবস্থান নিশ্চিত করে, যা তিনি বজায় রাখছিলেন। যদিও এখানে প্রস্তাবনা যে জাতীয় পরিষদে পাশ করাতেই হবে, ভুট্টোর এমন গোঁ ধরে থাকাটা অনুপস্থিত। এই আলোচনার পর রাজনৈতিক সমাধানের আলো কিছুটা হলেও জ্বলছিল। এমনকি, শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ টীমের কাছে এই ঘটনার রিপোর্টে বলেন যে তার মনে হচ্ছে ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো অনুধাবন করেছে যে তাদের জন্য প্রস্তাবনা মেনে নেওয়াই উত্তম পন্থা হবে। তাদের অবস্থান অন্তত পশ্চিমে নিরাপদ আছে। ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকবেন, ভুট্টো পাঞ্জাব ও সিন্ধুর ক্ষমতা পাবে এবং যেহেতু পশ্চিমের সংবিধান পশ্চিমাদের নিয়ে কমিটির মাধ্যমে হবে। সেহেতু ভুট্টোর দল সেটাকে প্রভাবিত করতে পারবে। আমার মনে আছে কিছু বিদেশী সাংবাদিক বলাবলি করছিল যে পশ্চিমে নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত করার জন্য ‘দুই কমিটি’ -কে ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো সমর্থন করবে। ২২ তারিখটি ছিল সমঝোতার জন্য সম্ভাবনাময় একটা দিন।

২২ মার্চ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে আমার অফিসে বসেন। সেখানে শেখ মুজিব এবং অন্যান্য পার্টি মেম্বাররা আসেন এবং পুরো ড্রাফটা মনোযোগ সহকারে পড়া হয়। কারণ এমন একটি খসড়াই হয়তো ঘোষণাপত্র আকারে আসবে। খসড়ার কাজ শেষ করতে ২২ মার্চের সারা রাত অতিবাহিত হয়।

মার্চ ২৩ ছিল একটা অসাধারণ দিন। আগে এই দিনটা ‘পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল। এটা ছিল সেই দিন যেদিন হাজার হাজার বাংলাদেশী পতাকা বিক্রি হয়। আমার মনে আছে, ভোর ৬ টা সময় খসড়ার কপি সমেত অফিস থেকে বেরোবার পথে আমি নবাবপুর রেলওয়ে ক্রসিং থেকে একটা বাংলাদেশের পতাকা কিনি। সকাল ৭ টার দিকে আমি খসড়ার কপি নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় উপস্থিত হই। অল্প সময়ের মাঝে অসংখ্য মিছিল সেখানে এসে উপস্থিত হয় এবং তার বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এমনকি বেশীরভাগ বাড়ী এবং গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়।

আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল সেদিন সকাল ১১.৩০ টা নাগাদ বাংলাদেশের পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট হাউজে এসে উপস্থিত হন। প্রেসিডেন্ট হাউজে মিলিটারি অফিসাররা সেই পতাকা দেখে প্রতিকূল আচরণ করে।

যখন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল প্রবেশ করেন, তখন তাদেরকে বলা হয় যে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য এমএম আহমেদসহ আরো কিছু অর্থনীতিবিদকে সরকারের পক্ষ থেকে আনা হয়েছে। এম এম আহমেদ এই বলে শুরু করেন যে তিনি ভেবেছিলেন যে ছোট কিছু বিষয় যোগ করার মাধ্যমে ৬ দফা কার্যকর করা সম্ভব। পীরজাদা প্রস্তাব করেন যে এম এম আহমেদ আওয়ামী লীগের অর্থনীতিবিদদের সাথে আলোচনায় বসতে পারেন। নুরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, রেহমান সোবহান এবং অন্যরা অর্থনীতিবিদেরা অর্থনৈতিক বিধিবিধান নিয়ে প্রতিদিন নুরুল ইসলামের বাড়িতে বৈঠক করছিলেন এবং আওয়ামী লীগের সংশোধিত চূড়ান্ত খসড়ায় উল্লিখিত অর্থনৈতিক বিধানে তাদের সম্মতি দেওয়া ছিল। আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল আবার অর্থনৈতিক বিধান নিয়ে আলাদা বৈঠকের পক্ষে ছিল না। কারণ তাদের কাছে এ সবই সময় নষ্টের অজুহাত বলে মনে হচ্ছিলো। আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল বুঝতে শুরু করে যে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিটি অংশ নিয়ে আলোচনা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছিল। ২৩ মার্চের সন্ধ্যার বৈঠকে এম এম আহমেদ আওয়ামী লীগের চুড়ান্ত খসড়া প্রস্তাবে কিছু সংশোধনী ও অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য কিছু লিখিত খসড়া প্রস্তুত করেন। এমনকি বৈদেশিক বাণিজ্য এবং সাহায্যের ব্যাপারেও এম এম আহমেদ কিছুটা নমনীয়তা দেখান। তিনি বলেন, বৈদেশিক বাণিজ্য কোন ঝামেলা ছাড়াই পূর্বে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব। সাহায্যের ব্যাপারে তিনি বলেন, যদি তা কেন্দ্রের বৈদেশিক নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তবে ঝামেলা এড়ানো সম্ভব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনর্গঠনের ব্যাপারে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঢাকা ব্রাঞ্চ বাংলাদেশের জন্য রিজার্ভ ব্যাংক হিসেবে কাজ করতে পারে। এই ব্রাঞ্চের মাধ্যমে অর্জিত সকল বৈদেশিক মুদ্রা দ্বিভাজিত করে পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত অংশ আলাদা করে সংরক্ষণ করা সম্ভব। কিন্তু সংগৃহীত কর দ্বিখণ্ডন করা খুব ঝামেলার হয়ে দাঁড়ায় এবং মেনে নেওয়া হয় যে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল অন্তর্বর্তী সময়ের ভিতর এই সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান নিয়ে আসবে।

আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বাড়ীতে গিয়ে তাদের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগ দেন। এম এম আহমেদের করা সংশোধনীগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং যত্নের সাথে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ, ব্যবস্থাপনা এবং বৈদেশিক সাহায্যের বিধিবিধানগুলো সরকার পক্ষের কাছে ঐদিন সন্ধ্যায় উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করা হয়।

২৩ মার্চ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল এ সকল অর্থনৈতিক বিধানসমূহ নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু করার জন্য ফিরে গিয়ে জানতে পারেন যে ইয়াহিয়া সারাদিন প্রেসিডেন্ট হাউজের বাইরে আছেন। পীরজাদা ক্যান্টনমেন্টের ব্যাপারে কিছু বলেন এবং পরবর্তী আলামত সমূহ নির্দেশ করে যে ২৩ তারিখই সেই দিন, যে দিন ‘জেনারেলরা’ বৈঠক করেছিলেন। এখন আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে এই দিনই অপারেশন সার্চলাইট চূড়ান্ত অনুমোদন পায় এবং দুইজন মূল পরিকল্পনাকারী হেলিকপ্টারে করে ২৪ মার্চ ঢাকার বাইরে তাদের বিশ্বস্ত ব্রিগেড কমান্ডারদের নির্দেশনা দেওয়ার জন্য উড়ে যায়। এম এম আহমেদের সাথে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের সাথে অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা দীর্ঘায়িত করা হচ্ছিলো মূলত ‘মিলিটারি সমাধানের’ জন্য প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। ২৪ শে মার্চ সকালের ভিতর আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল সকল প্রকার আলোচনা এবং ঘোষণাপত্রের খসড়ার প্রশ্নবোধক জায়গাগুলো বিশ্লেষণ করা শেষ করেন। যখন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল সন্ধ্যার সেশনের জন্য চলে যাচ্ছিলেন, তখন শেখ মুজিব নির্দেশ করেন যে দেশের নামের ক্ষেত্রে আমরা প্রস্তাব করব ‘কনফেডারেশন অফ পাকিস্তান’। তিনি ইঙ্গিত দেন যে এটা দেশের মানুষের আবেগের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য দরকার। প্রস্তাবটি আংশিকভাবে স্বাধীনতার জনপ্রিয় ইস্যুকে প্রতিফলিত করে, যা তরুণদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বিরাট গণআন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো।

যখন এই প্রস্তাব সরকার পক্ষের কাছে দেওয়া হয়, তখন তারা এর তীব্র বিরোধিতা করে এই বলে যে, এটা আমাদের মৌলিক অবস্থানের পরিবর্তনের নির্দেশ করছে। আমরা বলি যে নামের পরিবর্তন মৌলিক অবস্থানের পরিবর্তন নির্দেশ করে না। কারণ এখানে বাস্তবসম্মত অন্যান্য সকল বিধান ঠিক থাকছে যা একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য দরকার। কর্নেলিয়াস যুক্তিতর্ক মেনে নিলেন বলে মনে হলো। তবে তিনি ‘কনফেডারেশন’ শব্দের পরিবর্তে ‘ইউনিয়ন’ শন্দটির কথা বলেন। জবাবে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল বলেন যে, এই এক শব্দের বিষয়টা শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার কাছে দেওয়া হবে চূড়ান্ত খসড়া যখন তাদের অনুমোদনের জন্য যাবে তখন।

আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল এটাও আঁচ করতে পারছিল যে বাইরের অবস্থা খুবই গুরুতর। কারণ আর্মি চট্টগ্রামে এম ভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে যাচ্ছিলো এবং হাজার হাজার জনতা তাঁদের বন্দরে যাবার পথে বাঁধার সৃষ্টি করেছিল। রংপুর থেকে মিলিটারি অপারেশনের খবর এসেছিল। ঢাকাতে এমন খবরও পৌঁছাচ্ছিল যে মিলিটারি আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ কারণে মনে হচ্ছিলো যে ২৪ তারিখের মিটিংটাই শেষ মিটিং হতে যাচ্ছে। সেখানে আলোচনা সমাপ্তির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া উচিৎ এবং কারিগরি দিক নিয়ে আলোচনা করার আর সময় নেই।

সন্ধ্যায় সম্পূর্ণ খসড়া পড়ে শেষ করা হয়। আমি পীরজাদাকে অস্থির ভাবে জিজ্ঞেস করি যে কখন খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে? আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বলা হয় আমি যেন কর্নেলিয়াসের সাথে সেই রাতেই বসে খসড়াটি চূড়ান্ত করি। যেন পরদিন তা শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার সামনে পেশ করা যায়। কর্নেলিয়াস রাজি ছিলেন কিন্তু পীরজাদা বলেন যে, “না, আজ সন্ধ্যায় আমাদের কিছু আলোচনা করতে হবে। আপনারা কাল সকালে দেখা করেন।“ আমি পরদিন সকালে একটা সময় নির্দিষ্ট করার কথা বললে পীরজাদা আবারো বাঁধা দেন এবং বলেন যে এটা ফোনে ঠিক করা যাবে এবং সে ফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করবে। তারপর পীরজাদা আমার দিকে তাকান এবং বলেন, “কখন ঘোষণা দেয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?” আমি বলি, এটা গত পরশুদিন দেওয়া উচিৎ ছিল। যেভাবে ঘটনা প্রবাহিত হচ্ছিল (আমার মাথায় চট্টগ্রাম এবং রংপুরের ঘটনাগুলো ছিল, যেখানে আর্মিরা সাধারণ মানুষ ও পুলিসদের উপর গুলিবর্ষণ করছিল)। হাতে একদমই সময় নেই। এই প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন যে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল মনে করেন যে সকল বিষয় আলোচনা হয়ে গেছে এবং আর কিছু আলোচনার বাকি নেই। যা বাকি আছে তা হলো, শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার সামনে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য খসড়াটি পেশ করা। একবার অনুমোদন হয়ে গেলে ঘোষণাটি জারি করা যাবে। তাজউদ্দীনের এই বক্তব্য শ্বেতপত্রে বিকৃত করে এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন আওয়ামী লীগ আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছিল। সত্যিকার অর্থে, এটা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে আলোচনা সম্পূর্ণ সমাপ্ত হয়েছিল এবং শুধু শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার অনুমোদন বাকি ছিল। অবিশ্যম্ভাবী ২৫ তারিখের সারাটা দিন আমি একটা টেলিফোন কলের জন্য অপেক্ষা করি। সেই কল আর কোনদিন আসে নি। যখন আমি রাত ১০.৩০ এর দিকে শেখ মুজিবের বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি আমাকে ফোন কল এসেছে কিনা প্রশ্ন করেন। আমি তাকে কনফার্ম করি যে, আমি কোন কল পাই নি। সেই রাতেই আর্মি বাঙালির উপর গণহত্যার এবং রক্তস্নাতের আক্রমণ শুরু করে। এগুলো পরিহার করা এবং রাজনৈতিক সমঝোতা করাই ছিল আলোচনা শুরুর মূল উদ্দেশ্য।

-ডঃ কামাল হোসেন
১৯৭৪।

Scroll to Top