গণহত্যার প্রতিবাদে ও স্বায়ত্ত শাসনের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান

<2.51.278-282>
            

    শিরোনাম      সুত্র      তারিখ
গনহত্যার প্রতিবাদে ও স্বায়ত্ব শাসনের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেও         

   প্রচারপত্র

৮ইজুন,১৯৬৬

 

দমননীতি,গনহত্যার প্রতিবাদে ও স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে

দলমত নির্বিশেষে সকল দেশবাসী

ঐক্যবদ্ধ হউন

ভাই ও ভাগিনীগন,

জালিমশাহীর গুলিতে আবার জনতার রক্ত ঝরিয়াছে।গত ৭ই জুন ঢাকা,নারায়নগঞ্জ, তেজগায় পুলিশের গুলিতে এ দেশের শান্তিকামী মানুষকে আবার জীবন বিসর্জন দিতে হইয়াছে।সরকারী হিসাব মতেই গুলিবর্ষণে নিহতের সংখ্যা এগারো।

 অগনিত মানুষ আহত হইয়াছেন।দেড় হাজার ব্যক্তিকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হইয়াছে।ঢাকাসহপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে।জনতাকে শায়েস্থা কয়ার উদ্দেশ্যে সামরিক ট্রায়ালের ব্যবস্থা করা হইয়াছে।দমননীতির প্রয়োগে দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হইয়াছে।

রাজবন্দীদের মুক্তি পুর্ন আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে আওয়ামী লীগের আহবানে গত ৭ই জুন তারিখে প্রদেশের বিভিন্নস্থানে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়।হরতালের সাফল্য শাসকচক্রকে হকচকিত করিয়া তোলে এবং ইহাকে বানচাল করার জন্য সরকার নিরস্ত্র জনসাধারনের উপর পুলিশ বাহিনী লেলাইয়া দেয় ও পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে।

রুটি,রুজি,ও গনতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রামরত জনতার উপর গুলিবর্ষণ ইহাই প্রথম নয়।

১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের মাদারশায় কৃষকদের উপর, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ও ১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় ছাত্রদের উপর,টংগী, খুলনা ও চট্টগ্রামে কালুরঘাটে শ্রমিকদের উপর,সুশং,সানেশ্বর,নাচোল,মাগুরা ও বালিশিরায় কৃষকদের উপর এবং ১৯৫০ সালের ২৪শে এপ্রিল রাজশাহী জেলের অভ্যন্তরে দেশপ্রমিক রাজবন্দীদের উপর গুলি চালাইয়া ইতিপূর্বে শত শত ব্যক্তিকে হত্যা করা হইয়াছে।

পেশোয়ারের চারসাদ্দার জনসভার উপর গুলিবর্ষণ এবং বেলুচিস্তানের ঈদের জামাতে বোমা বিস্ফোরন করা হইয়াছে।পাঞ্জাব ও করাচীতে ছাত্র হত্যা করা হইয়াছে-বেলুচিস্তান ও সরহাদের ন্যাপসহ নেতৃবৃন্দকে ফাসিকাষ্ঠে ঝুলানো হইয়াছে।

  ৭ই জুনের দমননীতি এই নির্মম দমননীতিরই অন্যতম বীভৎষ নজির।গত ১৯ বৎসর যাবত পাকিস্থানের শাসকগোষ্ঠীর চরিত্রের স্বরুপ সাময়িক ব্যতিক্রম বাদে মোটামুটি একই রুপ হইলেও নৃশংসতায় বর্তমান সরকার

 

 

তার পূর্বসূরীদের অনেক পিছনে ফেলিয়া আসিয়াছে।গদি রক্ষার তাগিদে ঈদের জামাত অথবা রাজপথের শান্তিপূরণ জনতার উপর পাশবিক হত্যালীলা চালাইতেও এই সরকার বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নাই।

নবজীবনের স্রোত

    একদিকে যখন একচেটিয়া পুজিবাদ ও সামন্তস্বার্থের রক্ষক সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী আমলাতান্ত্রিক স্বৈরশাহীর শাসন,শোষন ও অত্যাচার আজ চরমে পৌছায়াছে,অপরদিকে তখন নিপীড়িত, অত্যাচারিত জনতার বুকের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ আজ শান্তিপূর্ণ হরতালের মাধ্যমে আত্নপ্রকাশ করিয়াছে।পাকিস্থানের জীবনেতিহাসে এমন হরতাল আর দেখা যায় নাই।পিকেটিংয়ের প্রয়োজন হয় নাই,স্বেচ্ছাসেবক, চোখেমুখে তাদের দৃপ্ত শপথ,আত্নশক্তিতে গভীর আস্থা-কোনও ভ্রকুটি,কোনও চন্ডনীতিই তাহাদিগকে টলাইতে পারিবে না-প্রত্যেকেই সৈনিক-মঞ্জিলে পৌছাইতে হইবে।কাপিয়া উঠিল জুলুমশাহীর বুক,টলিয়া উঠিল এতদিনের পাকাপোক্ত আসন-আর গজিয়া উঠিল পুলিশের বুলেট।শহীদানের রক্তে বিভিন্ন রাজপথ লাল হইয়া উঠিল।শোকের ছায়া নামিয়া আসিল সমস্ত শহরে,পথে প্রান্তরে।তবে মাতম নয়-বজ্রকঠোর শপথ-শহীদানের রক্তের ডাক এদেশের জনতার রক্তেও আগুন ধরাইয়া দিল।শহীদানের রক্তপাত বৃথা যায় না।

 সাম্রজ্যবাদের সহযোহী এই জালিম সরকার সাম্রজ্যবাদেরই সহযোগিতায় ১৯৫৮ সনে সামরিক শাসন জারির মারফত দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোপুরি কব্জা করিয়া নিয়াছে।আপামর জনসাধারনের সুখী-সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের আশা আকাঙ্খা মাটিচাপা দিয়াছে।বাকস্বাধীনতা,ব্যক্তিস্বাধীনতা,সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ মানুষের সকল মৌলিক অধিকার ছিনাইয়া লইয়াছে।

একনায়কত্ব বনাম সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ গঠন

সুপরিকল্পিত উপায়ে একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে।পাকিস্থান কায়েমের পর পরস্পরবিরোধী দুইটি স্বার্থের সংঘাত শোষকশ্রেণী করত একচেটিয়া মুনাফা লুন্ঠন ও শোষন ব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে চাপাইয়া দেওয়ার গরজেই শুরু হয়।প্রতিটি নাগরিকের খেয়ে-পরে সুখে শান্তিতে বাচার সুবন্দোবস্ত করিতে হইলে-(১)শোষন ব্যবস্থা খতম করা প্রাথমিক কাজ এবং (২)শিল্প-কৃষির দ্রুত উন্নতির জন্য সকল বিদেশী পুজি,ব্যাঙ্ক,পাট,তুলা ইত্যাদি ব্যবসা জাতীয়করণ,(৩)সামন্তবাদকে উচ্ছেদ করিয়া প্রকৃত চাষীর হাতে জমি প্রদান-জাতীয় উন্নতির জন্য এই ত্রিবিধ করমধারা সাম্রাজ্যবাদ,সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুজিবাদী শোষনের ভিত্তিমূলকেই উতপাতত করিবে।

 দেশী-বিদেশী শোষকচক্র এই কর্ম পন্থাকে বানচাল করিতে চায়।দ্বিতীয়তঃ কৃষি-শিল্পের দ্রুত উন্নতির সাধনের জন্য সাম্রজ্যবাদীদের আওতামুক্ত স্বাধীন অরথনীতির বুনিয়াদ অপরিহারর্য শর্ত।এই পথে প্রথম পদক্ষেপ হইতেছে দেশে ইস্পাত, লোহা ও যন্ত্রশিল্প গড়িয়া তোলা।বিগত দশ বতসর যাবত পাকিস্তানে একটি ইস্পাত কারখানা স্থাপন করিয়া দিবার প্রস্তাব সোভিয়েত ইউনিয়ন দিয়া আসিতেছে।কিন্ত এই দেশে ইস্পাত তৈরী হইলে পাকিস্তানে মার্কিনীদের শত শত কোটি টাকার লোহার সরঞ্জাম বিক্রয়ের বাজার নষ্ট হইবে।এইজন্যে মার্কিনীদেরর ও দেশীয় বড় ধনিকদের কারসাজিতে পাকিস্তানে ইস্পাত কারখানা স্থাপন করা হইতেছে না।

 

 

এইভাবে দেশী-বিদেশী শোষকচক্র ষড়যন্ত্রের মারফত জোর করিয়া পাকিস্তানকে গরীব অনুন্নত কৃষিপ্রধান দেশে পরিণত করিয়া রাখিয়াছে।অথচ কৃষিপ্রধান পাকিস্তানে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার খাদ্যদ্রব্যও বিদেশ হইতে আমদানী করিতে হয়।এই অতি মুনাফাখোরদের স্বার্থে দেশে খাদ্য,বস্ত্র ঔষুধপত্র ইত্যাদির দাম সাধারণ লোকের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে।তদুপরি,খাজনা,ট্যাক্স দিন দিন বাড়িতেছে।আগামী বৎসরের  কেন্দ্রীয় বাজেটে আরো ৩৭ কোটি টাকা নতুন ট্যাক্স বসানো হইয়াছে।টেন্ডুপাতা ব্যবহার নিষিদ্ধ করিয়া লক্ষ লক্ষ বিড়ি শ্রমিককে ভাতে মারার যোগাড় হইয়াছে।ধর্মঘটের অপরাধে শত শত রেল শ্রমিক চাকুরী হারাইয়াছেন।

মোট কথা, কৃষক-মজুর-মধ্যবিত্তের জীবন আজ বেকারী,স্বল্প আয়,অগ্নিমূল্য ও ট্যাক্সের জ্বালায় অতিষ্ট হইয়া উঠিয়াছে।কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জনাব শোয়েব নয়া ট্যাক্সে সাধারণ মানুষের কোন কষ্ট হইবে না এই আশ্বাস বাণী শূনাইয়া-কাপড়, সাবান, কেরোসিন তৈল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের উপর কোটি কোটি টাকা ট্যাক্স ধার্য করিয়াছেন।শোষন ও শাসনের যাতাঁকলে পড়িয়া আজ সাধারণ মানুষের বাচিয়া থাকাই দায় হইয়াছে।তাই আজ দিকে দিকে শোষিত নিপীরিত মানুষের গগনবিদারী আর্তনাদ ধ্বনিয়া উঠিয়াছে।

আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন-সংহতির একমাত্র পথ                                                             

  ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুই অঞ্চল লইয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।কেন্দ্রীয় সরকারের আসন পূর্ব পাকিস্তান হইতে প্রায় এক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত।মূলধন,মাল-সামান বা লোকজনের আমত্নঃ আঞ্চলিক স্বাভাবিক চলাচলের কোন উপায় নাই।

  পাক-ভারত যুদ্ধে মানুষের চক্ষু খুলিয়াছে।বৈমাত্রেয় আচরণের বদৌলতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দেশরক্ষা ব্যবস্থায় ন্যায্য হিস্যা পূর্ব পাকিস্তান পায় নাই।প্রদেশবাসী দেশরক্ষায় আত্ননির্ভরশীলতা দাবী করিলে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত সামরিক শক্তি পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার পক্ষেও যথেষ্ট বলিয়া যুক্তি দেওয়া হইত।কিন্ত যুদ্ধের অগ্নিপরীক্ষায় এই যুক্তির অন্তসারশূন্যতা উদঘাটিত হইয়াছে।পারস্পারিক বিচ্ছিন্নাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তান হইতে কোন সামরিক সাহায্য প্রেরণ করা দূড়েড় কথা,এমনকি যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য কি ঘটিতেছে তাহা সরেজমিনে তদারক করিয়া দেখা স্বয়ং প্রেসিডেন্টের পক্ষেও সম্ভবপর হয় নাই।

   শত্রুর উদ্যত আক্রমনের মুখে এ দেশবাসী নিজেদের সম্পূর্ণ অসহায় সেদিন মর্মে মর্মে অনুভব করে।এমতাবস্থায় পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের সুষম অর্থনৈতিক বিকাশ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশরক্ষা ব্যবস্থা গড়িয়া তোলার জন্য পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়কে পূর্ন আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের অধিকার প্রদান করা অপরিহার্য ছিল।কিন্তু শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে একচেটিয়া সুবিধাভোগী বড় ধনিক গোষ্টী পূর্ব পাকিস্তানকে অনুন্নত রাখিয়া চিরকাল শোষণ করিবার গরজে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবীকে নস্যাৎ করিতে চায়।ফলস্বরুপ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আজ প্রর্বতপ্রমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হইয়াছে এবং এই বৈষম্যনীতি জাতীয় সংহতির ভিত্তিমূলকেও কমজোর করিতেছে।

 

 

 

  পশ্চিম পাকিস্তানেও সরহদ, বেলুচিস্তানে ও সিন্ধুর বাসিন্দারা নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টির বিকাশ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে ক্রমাগত অধিকতর সচেতন হইয়া উঠিতেছে।পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চলের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন ও পাকিস্তানের ফেডারেল সরকারের প্রতিটী ইউনিটের স্বেচ্ছাকৃত মিলনের মধ্যেই যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও জাতীয় সংহতি নির্ভরশীল- এই বাস্তব সত্যকে শাসক শক্তি যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করিবে ,ততই মঙ্গল।

 

জালিমশাহীর হামলা ও গনতান্ত্রিক শিবিরের কর্তব্য

 

জালিমশাহীর আজ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ হইতে সম্পূর্ণ বিছিন্ন হইয়া পড়ীয়াছে।পাকিস্তানের উভয় অংশে শোষিত মানুষ রুটি-রূজি,গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে সংগ্রামের পথে পা বাড়াইয়াছে।উত্তাল গণ-আন্দোলনের মোকাবেলায় গণবিরোধী সরকার অস্ত্রের ভাষাকেই সম্বল করিয়াছে।ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের উত্তাল জনসমুদ্রে উত্থিত ‘রাজবন্দীদের মুক্তি ও আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের’ দাবীর জওয়াব আসিয়াছে পূর্ব পাকিস্তান কামান-বন্দুকের ভাষায়-মৃত্যুর হিমশীতল ছোঁয়ায়।

এই বর্বর দমননীতি ও গনহত্যার বিরূদ্ধে আজ সারা দেশ বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে।এই জুলুমের বিরূদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা আমাদের নাই।খুনী জালিমের বিরূদ্ধে জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে দূর্বার ও জোরদার করিয়া তোলাই প্রতিবাদের একমাত্র পথ।‘রাজবন্দীদের মুক্তি’ ও ‘স্বায়ত্বশাসনের’ জনপ্রিয় দাবীর আওয়াজ তুলিয়াছিলেন- এই অপরাধে আমাদের ১১ জন শহীদ ভাইয়ের বুকের তাজা খুনে, ঢাকা নারায়নগঞ্জের রাজপথ লাল হইয়াছে।তাঁহাদের এই দেশাত্নবোধ ও কোরবানী সকল কালের সকল মানুষের মুক্তি-পথের আলোকবর্তিকারূপে চিরকাল বিরাজ করিবে।শহীদানের অমর স্মৃতির প্রতি আমরা লাখো তসলিমাত জানাই।দুঃখভারাক্রান্ত তাঁহাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি আমরা আন্তরিক সমবেদনা জানাইতেছি।বাংলা ভাষার দাবীতে যাঁহারা জীবন দিয়াছেন,যাঁহারা শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের রূটি-রূজির লড়াইয়ে জীবন দান করিয়াছেন-তাঁহাদের সে আত্নহূতি ব্যর্থ হয় নাই।আজ গনতান্ত্রিক অধিকার ও স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে যে নির্ভীক সেনানীরা আত্নহূতি দিয়াছেন,তাঁহাদের মহান ত্যাগও বিফল হইবে না।শহর-বন্দর-নগর-পল্লীর ঘরে ঘরে আজ প্রতিটি নরনারী শহীদ স্মরণে গনতান্ত্রিক অধিকার,স্বায়ত্বশাসন ও শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার বৈপ্লবিক শপথ গ্রহণ করিবে।

৭ই জুনের নির্মম হত্যাকান্ড জালিমশাহীকে জনগণ হইতে আরও বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়াছে।প্রতিটি লোক আজ শাসকচক্রের গণবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকেবহাল ও অধিকতর সচেতন হইয়া উঠিয়াছে।৭ই জুন আরো প্রমাণিত করিয়াছে যে,জনগণ আজ জালিমশাহীর মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথে পা দিয়াছে।কিন্তু গণতান্ত্রিক শিবিরের নেতৃত্বে আজও অনৈক্য বিরাজিত।জনতার এই ঐক্য গণতান্ত্রিক শিবিরের নেতৃত্বের প্রতি

 

 

চ্যালেঞ্জস্বরূপ।তাই আমরা আশা করি রাজনৈতিক দলসমূহ জনতার চ্যালেঞ্জ গ্রহণপূর্বক তাঁহাদের ভিতরকার অনৈক্য দূর করিয়া ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনপূর্বক জনতার সংগ্রামকে সফল পরিণতির দিকে আগাইয়া নিবেন।জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন স্বৈরাতন্ত্রী সরকারের এই নির্মম হামলার মোকাবিলায় গনতান্ত্রিক দল ও দেশপ্রমিক ব্যক্তিদের উপর এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব বর্তাইয়াছে।গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ ঐক্যবদ্ধ না হইলে গণআন্দোলনের সফল পরণতি সুদূরপরাহত।বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের বর্তমান অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা ক্ষমতাসীন্দের পক্ষেই সহায়ক হইবে।কোন দলের একক প্রচেষ্টায় সর্বাত্নক আন্দোলন গড়িয়া তোলা সম্ভবপর নয়।সুতরাং বর্তমান মুহূর্তের ঐতিহাসিক কর্তব্য হইতেছে ঐক্য-গণতান্ত্রিক শিবিরের ঐক্য।

  আমরা নিন্মোক্ত দাবীসমূহের ভিত্তিতে সকল দলের স্বীকৃত নিম্নতম কর্মসূচী প্রণয়ন ও দলমত নির্বিশেষে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার জন্য সকল রাজনৈতিক দল,গণ-প্রতিষ্ঠান ও জনগণের প্রতি আবেদন জানাইতেছি।

দাবীসমূহঃ

    (১) দেশের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগ ও সত্যিকার গণপ্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিশন মারফত ৭ই জুনের গুলিবর্ষণ ও আনুপূর্বিক ঘটনার তদন্ত,দোষীদের আদর্শ শাস্তির ব্যবস্থা,নিহিত আহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দান।এই উপলক্ষে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত সকলের মুক্তি,১৪৪ ধারাসহ আরোপিত সকল বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার।

    (২)  সকল রাজবন্দীদের মুক্তি,হুলিয়া প্রত্যাহার,জরূরী অবস্থা প্রত্যাহার করা,দমনমূলক সকল বিধি-নিষেধ বাতিল করা।

    (৩)  পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনঃ

          দেশরক্ষা,পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রা- মাত্র এই তিনটি ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিয়া বাকি সকল ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক সরকারদ্বের হাতে ন্যস্ত থাকিবে।এক ইউনিট রদ করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে ভাষা,কৃষ্টি ও ভৌগলিক ঐক্যের ভিত্তিতে সরহদ,বেলুচিস্তান,সিন্ধু ও পাঞ্জাব-এই চার পৃথক পৃথক প্রদেশ গঠন করা।

     (৪)  ফেডারেল ও পার্লামেণ্টারী শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা।

     (৫)  সকল নাগরিকের ভোটের অধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন।

     (৬) (ক) রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ও জনগণের মালিকানায় মূল ও          ভারী শিল্প যথা-ইস্পাত ও যন্ত্রপাতি নির্মাণের কারখানা প্রতিষ্ঠা।

     (খ)  ডলার ঋণ বর্জন করিয়া জাতীয় সম্পদের ভিত্তির উপর স্বাধীন অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ।

 

 

 

(গ)  সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি,ব্যাঙ্ক বীমা ও পাট ব্যবসায় জাতীয়করণ।

     (৭)  বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলসেচের ব্যবস্থা।

     (৮)  কৃষকের বর্ধিত খাজনা-ট্যাক্স কমানো, বকেয়া খাজনা-ঋণ ইত্যাদি মকুব,পাট-তামাক-ইক্ষু ইত্যাদির ন্যায্য মূল্যের ব্যবস্থা।প্রকৃত কৃষকের হাতে জমি।

      (৯)  শ্রমিকের বাঁচার মত উপযোগী নিম্নতম মজুরী,শ্রমিক-স্বার্থবিরোধী আইন বাতিল,ধর্মঘটের অধিকারসহ পূর্ণ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার,বরখাস্ত রেল শ্রমিক,জাহাজী শ্রমিক ও অন্যান্য শিল্প শ্রমিকদিগকে কাজে পূনর্বহাল।টেন্ডুপাতা অর্ডিন্যান্স বাতিল।

      (১০)  যুদ্ধজোট বর্জন ও স্বাধীন নিরেপক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম।

                             বিনীত-

              হাজী মোহাম্মদ দানেশ

                 সহ-সভাপতি, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি

              মহীউদ্দিন আহমদ,

                 যুগ্ম-সম্পাদক,পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি

              সৈয়দ আলতাফ হোসেন

                সদস্য,কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদ,পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি

               দেওয়ান মাহবুব আলী,

                সদস্য,কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদ,পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি

               পীর হাবিবুর রহমান,

                 সদস্য,কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদ,পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি

               মোজাফফর আহমেদ

                সদস্য,কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদ,পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি

 

 

 

        হাতেম আলী খান

                 সম্পাদক,পূর্ব পাক কৃষক সমিতি ও সদস্য,কেন্দ্রীয় ন্যাপ।                                       

               ওসমান গনি

                 সম্পাদক, ঢাকা শহর ন্যাপ।

               গোলাম মর্তুজা

                সহ-সম্পাদক,ঢাকা শহর ন্যাপ।

               নুরূল ইসলাম

                 সহ-সভাপতি,ঢাকা শহর ন্যাপ।

               ডাঃএম,এ,ওয়াদুদ।

 [তাং ৮-৬-১৯৬৬ইং]

 

 

ইস্ট পাকিস্তান প্রেস,২৬৩ বংশাল রোড, ঢাকা

 

Scroll to Top