৬। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় পাক বাহিনীর হত্যাভিযান (৩৪৯-৩৫২)

সূত্র – দৈনিক বাংলা, তারিখঃ ১৯ জানুয়ারী, ১৯৭১

পঁচিশে মার্চ ও তার পরদিন
।। মঞ্জুর হাসান ।।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম শহীদ মিনারের সামনে ৩৪ নম্বরের এক তলার ফ্লাট বাড়ীতে। আমাদের এ বিল্ডিং এর পশ্চিম দিকের তিন তলায় পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যক্ষ জনাব মনিরুজ্জামান সে রাত্রে বিছানায় যেয়েও ঘুমোতে পারেননি, একথা তাঁর স্ত্রীর কাছে শোনা। দিন কতক আগে এখানে রাস্তায় গাছ ফেলে যে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছিল সেনাবাহিনীর একদল প্রথমে তা কেটে সরিয়ে দিতে আসে।

সেই সব ডালপালা কাটার শব্দ হচ্ছিলো। এর কিছু পরই পাক সৈন্যের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ শুরু হয়। ছাত্রাবাসগুলোর দিক থেকে সৈন্যদের গোলাগুলির আওয়াজে মনিরুজ্জামান সাহেব অস্থির হয়ে ওঠেন এবং বদনায় পানি নিয়ে পরপর তিনবার ওজু করেন। এমন সময় জগন্নাথ হলের কাছে গর্জে ওঠে বর্বর পাক সৈন্যদের গোলার আওয়াজ।

চারপাশে গোলাগুলির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং পর মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারের পাশেই মনে হলো তোপধ্বনির আওয়াজ। আমি যে ঘরে ঘুমাতাম, তার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টার, তার দক্ষিণে শহীদ মিনার। সেই আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত হয়ে উঠে মুহূর্তের জন্যে। আমি বিছানা থেকে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ি।

আমার ছেলেটিকে আমি আর আমার স্ত্রী মেঝেতে শুইয়ে চেপে ধরি। ছোট ছেলে ভয়ে একবার শক্ত হয়ে যাচ্ছিলো আর শুয়ে থেকে শুধু কাঁদছিল। আমি মেঝেতে পড়ে থেকে কয়েক মুহূর্তে চিন্তা করতে চেষ্টা করছিলাম, কি হলো? চারদিকে অনবরত গোলাগুলির শব্দ আর রাস্তা দিয়ে ভারি গাড়ি চলার শব্দ পাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় জগন্নাথ হলের পূর্ব দিকে আমাদের ৩৪ নং বাড়ির গেটে ভিতরে তিনটি মিলিটারী গাড়ি ঢোকে। তারপরই ভারি বুটের শব্দ এবং আমাদের দরজায় লাথি ও ধাক্কা শুরু হয়।– ‘দরজা খোল, দরজা খোল’।

ঠিক এর পরই সব ফ্লাটের দরজায় লাথি মারা আরম্ভ হয়ে গেছে এবং সব বাড়ির কলিং বেলগুলো ওরা বাজাচ্ছে। মা, বোনেরা এবং ছোট ভাইটি অন্য ঘর থেকে ছুটে আমার ঘরে এলো। মা বললেন, ‘বাবা ওদিক দিয়ে দেখলাম, মিলিটারিরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।’ আর বিল্ডিং-এর টেলিফোনের লাইনগুলো কেটে দিল। আমার ঘরে সকলকে মেঝেতে শুয়ে যেতে বললাম। মাকে বললাম ‘ওরা যদি দরজা ভেঙ্গে আসে তাহলে আসুক, দরজা খুলব না আমরা।’

বাড়িতে আমার বয়সী এক আত্মীয় ছিলেন, উনি এই সময়ে বিল্ডিং এর ভিতরে বাঁচার আশা ত্যাগ করে বলতে লাগলেন, ‘আমি জঙ্গলে ঝোপের মধ্যে যেয়ে লুকাবো’ এবং ফ্ল্যাট ছেড়ে পিছন দিক দিয়ে বাইরে যেতে উদ্যত হলেন। আমি আর মা ওকে জাপটে ধরলাম। উনি বারান্দার নেট ছিঁড়ে ফেলতে উদ্যত হলেন। মা আর আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘যদি আমরা মরে যাই সবাই একসাথে মরে যাব।’

এমন সময় দু’টো সৈন্য আমাদের জানালার পাশ দিয়ে দৌড়ে এসে ফ্ল্যাটের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে গেল। দরজাটি ছিল বাগানে যাবার জন্য খুব কম মজবুত একটা প্লাইউড দিয়ে বানানো দরজা। আমরা বারান্দা থেকে মুহূর্তে ঘরে ঢুকলাম; কিন্তু আমার ঘরের দরজা লাগাবার সাহস হলো না যদি শব্দ হয়ে যায়। এর অল্প পরই সৈন্য দু’টো চলে গেল পাশের পশ্চিম দিকে একতলার ফ্ল্যাটের পেছনে, সম্ভবতঃ ওদিককার দরজা খুলে ফেলার আওয়াজ শুনে। আমি দরজা লাগিয়ে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লাম।

মৃত্যু আসন্ন মনে হলো, আমরা সকলে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। ততক্ষণে আমাদের দরজায় লাথি মারা থেমে ছিলো কিন্তু আবার শুরু হলো ‘খোল খোল’ আর লাথি। ভারি বুটের দুড়দাম করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার শব্দের মাঝে জোরে শুনতে পেলাম মনিরুজ্জামান সাহেবের গলার আওয়াজ- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স.)’ চার-পাঁচবার শুনতে পেলাম উনার কালেমা পড়ার শব্দ, তারপর হঠাৎ থেমে গেলেন যেন।

বাইরে চারিদিকে গোলাগুলির আওয়াজ-এর পরই আমাদের বাইরের দরজার উপর গুলি হলো, আর কয়েকটা বুকফাটা আর্তনাদ ভেসে এলো। ১২/১৪ রাউন্ড গুলির শব্দ শুনলাম। মনে হলো, মেরে ফেললো- মরে গেলো মানুষ। রাত তখন দেড়টা। তারপর আমাদের বিল্ডিং-এ সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। মিনিট দশেক পরে শুনলাম ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরদার চিৎকার, ‘বাসন্তী-দোলা।’ তিনি স্ত্রী ও মেয়ের নাম ধরে ডেকে উঠেছিলেন। বিল্ডিং-এর সামনে তাঁকে গুলি করা হয়েছিল।

উনি ঘাসের উপর পড়েছিলেন। ডঃ জ্যোতির্ময় ২৫শে মার্চের পরও কয়েকদিন জীবিত ছিলেন এবং ২৭শে মার্চের সকালে তাঁকে মেডিক্যাল কলেজে নেয়া হয়। মনিরুজ্জামান সাহেবের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙ্গে গিয়েছিলো মিলিটারির বুটের ধাক্কায়। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী এবং তাঁর বোন, জ্যোতির্ময় বাবুর গলার আওয়াজ শুনে পানি নিয়ে নিচে নামছিলেন। তাঁরা তিনতলা থেকে আর্মিদের চলে যেতে দেখেছেন এবং তখনো বুঝতে পারেননি যে নিচে তাঁদের বাড়ির লোকজনদের একতলার দরজার উপর হত্যা করা হয়েছে।

মনে করেছিলেন এরেষ্ট করে নিয়ে চলে গেলো। নিচে নামতেই দেখতে পেলেন এক ভয়াবহ দৃশ্য। মনিরুজ্জামান সাহেবের ষোল বছরের ছেলের তখন অন্তিম মুহূর্ত। সে কষ্টে বলেছিল ‘মা পানি দাও’। মুখে পানি দেবার পর সে এক মুখ পানি নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ছেলের পাশে পড়ে ছিলেন মনিরুজ্জামান সাহেব, তাঁর প্রায় ৩০ বছর বয়স্ক ছোট ভাই এবং ১৪ বছরের ভাগ্নেটি। এই চারজন শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে যেয়ে মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী জ্যোতির্ময় বাবুর মুখে পানি দেন।

পূর্ব দিকের দোতলায় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সাহেব দেখতে পান আর্মি চলে গেছে এবং জ্যোতির্ময় বাবুর গলার আওয়াজ শোনা গেলো বিল্ডিং-এর সামনে ঘাসের ওপর থেকে। তখন রাজ্জাক সাহেবের বাসা থেকে একজন লোক নিচে নামতে যেয়ে দোতলার দরজায় এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ঘরে ঢুকে পড়ে। এরপর রাজ্জাক সাহেব তাঁকে নিয়ে নিচে নেমে আসেন। এ সময় জ্যোতির্ময় বাবুর স্ত্রী, সারভেন্ট কোয়ার্টার থেকে তাঁর ড্রাইভারকেও ডেকে এনেছিলেন।

তাঁরা কয়েকজন ধরাধরি করে পশ্চিম দিকের একতলায় জ্যোতির্ময় বাবুকে তাঁর ফ্ল্যাটে নিয়ে যান। ঠিক এই সময় আবার বিল্ডিং এর গেটের কাছে আর্মি এসে পড়ে। এর আগেই রাজ্জাক সাহেব দোতলায় তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন এবং সকলেই দরজা বন্ধ করে ফেলেন। বাড়ির বাগানে বেরুবার পেছন দিকের দরজা দিয়ে সৈন্যরা জ্যোতির্ময় বাবুর ফ্ল্যাটে ঢোকে এবং তাঁকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। এ কথা তাঁর কাছ থেকে শোনা। ২৭শে মার্চ জ্যোতির্ময় বাবুর স্ত্রীর সঙ্গে মেডিক্যালে দেখা হয় এবং তাঁকে সাথে করে ডঃ জ্যোতির্ময় বাবুর বেডের পাশে যেয়ে দাঁড়াই।

দেখেছিলাম তাঁর ঘাড়ের কাছে গুলি লেগে এদিক থেকে ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে এবং ডান হাত ও ডান পা অবশ হয়ে গেছে। জ্ঞান সম্পূর্ণ ছিল এবং খুব ভালোভাবে তখন আমার সাথে কথা বলছিলেন। মনের জোর তখনো অটুট ছিল। বলেছিলেন, রাইট সাইডটা পেরালাইজড কিন্তু বেশ বহাল তবিয়তেই আছি। উনি বলেছিলেন যে নাম জিজ্ঞাসা করার পরই তাঁকে গুলি করা হয়। এরপর আরম্ভ হলো আমাদের বিল্ডিং-এর উত্তর দিকে প্রায় বিশ গজ দূরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্টের বাড়ির দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা।

‘খোল খোল, দরজা খোল’- আর দরজায় লাথি, ধাক্কা। কিছুক্ষণ চললো, তারপর থেমে গেলো। তারা বাকি রাত্রিটুকুর মধ্যে ওখানে পুরনো দিনের মজবুত দরজা খোলার আরো দু’বার চেষ্টা চালায়। চারদিকে অনবরত গুলির শব্দ। ভোর হলো। থেকে থেকে আশপাশে গুলির শব্দ হচ্ছে। সকাল ৯টার দিকে শহীদ মিনারের কাছে একটা ক্ষীণ মাইক দিয়ে এক অবাঙ্গালী বাংলাতে বললো, ‘আপনারা বাড়ির বাইরে বেরুবেন না, আপনাদের ঘেরাও করা হয়েছে।’ মেঝেতে শুয়ে নিজে নিজে মনে করলাম হয়ত কারফিউ-এর বাংলা তরজমা করতে যেয়ে ‘ঘেরাও’ বললো। মনকে প্রবোধ দিলাম, কারফিউ-এর কথাই হয়ত বলছে। এর ঘন্টাখানেক পর এত ঘন্টার পরিচিত গোলাগুলির আওয়াজের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে শহীদ মিনারের কাছে একটা জোর শব্দ হলো। মনে হলো হাত বোমা।

অল্পক্ষণের মধ্যে ঘরে বারুদের গন্ধ ভেসে আসলো, দরজার নীচে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে পোড়া কাপড়ের মতো ছাই উড়ে এসে পড়তে লাগলো। এ হাত বোমার রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছিল পালিয়ে যে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেই ধলেশ্বরী নদীর ওপারে এক লোকের কাছ থেকে। সে আমাকে গ্রামে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। কারণ সেও অনেকের মতো শুনেছিলো, প্রফেসর আব্দুল হাইয়ের ফ্যামিলির সকলেই ওই বিল্ডিং-এ ২৫শে মার্চের রাত্রে মারা গেছে। এই লোকটি হলো হাশেম। আমাদের ৩৪ নম্বর বিল্ডিং-এর পূর্বদিকের তিনতলার ফ্ল্যাটে জার্মান প্রফেসর ওয়ান্টার শোয়েপ্পির সে বাবুর্চি ছিল। তার জীবনের চরম মুহূর্ত সেই ২৫শে মার্চের রাতেই কেটে গেছে। তাঁকে দাঁড় করানো হয়েছিলো অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, তার ছেলে, ভাই, ভাগ্নের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করার জন্য। আর্মি অফিসার গুলি করার হুকুম দিতেই গুলির পূর্বক্ষণে সে চিৎকার দিয়ে পড়ে যায়… তার পরই কতক গুলো গুলি হয়ে গেছে- তার শরীরের ওপর লুটিয়ে পড়েছে অন্যেরা।

গুলি শেষ করে বর্বর পশুরা মৃত দেহের উপর লাথি মেরেছিলো এবং হাশেমের কোমরে বুটের প্রচন্ড বাড়ি মারে। তারপর তারা সেখান থেকে সরে যেতেই হাশেম উঠে দাঁড়ায় এবং ছুটে তিনতলায় যেয়ে দরজা বন্ধ করে। তার সমস্ত জামায় রক্ত লেগে গেছে, সে বুঝতে পারছিলনা তার কোথায় গুলি লেগেছে। জামা খুলে হাশেম তার শরীরটা পরীক্ষা করে দেখে যে গুলি লাগেনি। আমি হাশেমকে জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলো যে সে ঘুমকাতুরে এবং যখন দরজায় কলিংবেল বাজায়, মাত্র তখন তার ঘুম ভাঙ্গে এবং আমরা কেউ বেল বাজাচ্ছি মনে করে সে ঘুমের ঘোরে দরজা খোলে।

খুলতেই সেনাবাহিনীর লোক সাক্ষাৎ যমদূতের মতো মধ্যবয়সী হাশেমের জামার কলার চেপে ধরে বলে- ‘তোম প্রফেসর হো?’ হাশেম বলে উঠে, ‘জার্মান সাবকা নওকর হুঁ’। নিমেষে তাদের কয়েকজন ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে। যে তার কলার ধরেছিলো সে পকেটে হাত দিয়ে বলে, ‘জয় বাংলাকা ফোটো হ্যায়?’ তার পকেটে বেতনের কয়েকটা একশ’ টাকার নোট ছিল। জার্মান প্রফেসর হাশেমকে তার আগামী তিন মাসের বেতন দিয়ে ব্যাঙ্কক চলে গিয়েছিলো।

নোটগুলো হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দেয় মেঝেতে। বলে ‘শালা তোম রূপিয়ে লেকে কেয়া করোগে, আভি তোমকো গুলি করেঙ্গে’। বলেই হিড়হিড় করে ওকে নিচে নামিয়ে আনে এবং দুজন ওকে ধরে রাখে। এর পরই সে দেখতে পায় মনিরুজ্জামান সাহেব এবং তাঁর বাসার অন্যান্যদের ধরে নিয়ে আসতে। শ্মশ্রূধারী মনিরুজ্জামান সাহেব উচ্চস্বরে কলমা পড়ছিলেন এমন সময় উনাকে চপেটাঘাত করে এক পাঞ্জাবী সৈন্য। এর পর মুহূর্তে গুলি করা হয়!

সেই হাশেম যখন মৃত্যুর হাত থেকে ছুটে এসে দম ফেলেছিলো তখন আবার শুনতে পায় বিল্ডিং-এ মিলিটারি আসার শব্দ। এর কিছু পরে কে যেন তাঁর ফ্ল্যাটের দরজায় কাতরাতে থাকে। ও মনে করেছিলো হয়ত এ বিল্ডিং-এর কেউ আহত অবস্থায় দরজার কাছে এসেছে। সিঁড়িতে আলো জ্বলছিলো। হাশেম কাঠের দরজার ছিদ্রপথে দেখে, এক সৈন্য অস্ত্র হাতে দরজার পাশে বসে অভিনয় করছে। হাশেম ছুটে বারান্দার প্রান্তে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পাক সেনারা ওই ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করেনি। এ হাশেমের কাছ থেকেই তখনি শোনা, শহীদ মিনারের অভাবিত দৃশ্যের কথা।

বেলা তখন দশটার মতো। হাশেম বলে চললো, আমি লুকিয়ে তিনতলা থেকে শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে দেখছি চারজন পাঞ্জাবী সৈন্য শহীদ মিনারের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের বিল্ডিং-এর দিকে মুখ করে আছে। এমন সময় কি হয়ে গেলো সেখানে; বোমা ফেটে গেলো, হাতবোমা। ধোঁয়া, আর শহীদ মিনারের পেছন দিকে দু’টো লোক পালিয়ে গেলো। দেখা গেলো সে মুহূর্তে দু’জন সৈন্য শহীদ মিনার থেকে মেডিক্যাল কলেজের মোড়ের ট্রাফিক লাইটের দিকে দৌড়ে পালালো। কয়েক মিনিট পরেই এলো একটা গাড়ি। শহীদ মিনারের ওপর পড়েছিলো দু’টো মিলিটারির লাশ। সে গাড়িটি মরা সৈন্য দু’টোর অস্ত্রগুলো নিয়ে চলে গেলো। কয়েক মিনিট পর আর একটি গাড়ি এলো এবং লাশ দু’টোকে নিয়ে চলে গেলো। সেদিন ছিল ২৬শে মার্চ, শুক্রবার। শহীদ অধ্যাপক মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছি।

যে, ২৬শে মার্চ শুক্রবারে তাঁর ফ্ল্যাটে বার পাঁচেক পাক সেনারা ঢোকে এবং বলতে থাকে ‘আওর এক আদমি হ্যায়, ও কিধার হ্যায়?’ উনারা জানান যে বড় পুরুষ মানুষ আর কেউ জীবিত নেই। তখন তারা সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজে এবং জিনিষপত্র তছনছ করে ফেলে। হয়ত এই অপর এক আদমি ছিল হাশেম। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী ও হাশেম এই বিল্ডিং-এর তিনতলা থেকে জগন্নাথ হলের মাঠে বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে বহু মৃতদেহ সে গর্তে ফেলে দিতে দেখেছিলেন।

রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গেও গ্রামে একদিন দেখা হয়, উনিও বুলডোজার দিয়ে গর্ত করে লাশ পুঁতে ফেলার কথা বলেন। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী ধরা গলায় বলেছিলেন, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বিকেল বেলা আর্মি গেঞ্জী পরা ১২/১৪ বছরের চারটে ছেলে নিয়ে এসে মনিরুজ্জামান সাহেবের লাশ টানিয়ে নিয়ে গেলো গর্তের ওখানে। তখন বোধ হয় আর লাশ মাঠে ছিলোনা। ছেলে চারটিকে গর্তের পাশে লাইন করে ওরা গুলি করেছিলো।

Scroll to Top