দর্পণ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত আরও কয়েকটি নিয়মিত কথিকা শব্দসৈনিক’, ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ । আগষ্ট-ডিসেম্বর,১৯৭১।
দর্পণ

 

২৬ আগষ্ট, ১৯৭১

ক্যাম্পে বসে বসে সে তার পুরানো দিনগুলোর কথা ভাবছিল। সেই নদী, শীতের সকাল, গ্রামকে বিলুপ্ত পরান মাঝির চোখ-এক এক করে সব কথাই মনে পড়ছে। প্রথম যেদিন বন্দুক থেকে গুলি ছুড়েছিল সেদিনের কথাও ।

 

সোনাগাছির চর পাখী শিকারের জন্য বিখ্যাত। শীতকালে নদী ক্রমশঃ শুকিয়ে এলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চর পড়ে। এই চর থেকে প্রায় মাইল তিনেক দূরে তোরণের বাড়ি। বাড়ি বলতে অবশ্য ছোট দুটি কুড়েঘর, একট আমগাছ, গোটা কয়েক সুপারি গাছ চালের উপর সারা বছর কুমড়ো গাছের লতা ছেয়ে থাকে। শীতের গেছে। ঘাটে বাঁধা নৌকায় নদী পার হয়ে, চরের শিশির ভিজে ওঠা বালুর উপর দিয়ে আরও মাইল খানেক হাঁটার পর এলোমেলো চরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা খালের পাড়ে এসে দাঁড়াত। খালের পাশেই বালুর উপর দুটো ছই পাতা। তার একটাতে খড়ের উপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে বৃদ্ধ পরান মাঝি তখনও ঘুমাচ্ছে। তোরণ তাকে ডেকে তুলতো। খালে বেড় দিয়ে মাছ ধরার যন্ত্র সারারাত পেতে রাখা হত; তোরণ আর পরান দু’জনে মিলে গামছা পরে সব মাছ খাঁচিতে ঝেড়ে তুলতো। তারপর তোরণ নিজ হাতে ছোট ছোট কাঠের টুকরো দিয়ে মালসা জ্বালিয়ে তাতে দুজনেই হাত-পা সেঁকে নিত। পরান নিজ হাত হুকো ধরিয়ে হাত-পা সেঁকতে সেঁকতে আয়েশ করে খোঁচা খোঁচা মুখে ধোঁয়া ছাড়ত। এরপর একটা বাঁশের টুকরোর দু’পাশে দুটো খাঁচি বেঁধে নিয়ে নদীর ঘাট পার হয়ে কুয়াশা ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে যেত গঞ্জের দিকে।

 

মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের বাইরে রাতের অন্ধকারে বসে থাকা তোরণের এক এক করে অনেক কথাই মনে পড়ল। তখন ওর বয়স প্রায় ২৩ বছর। বছর নীয়েক পূর্বে ওর বাবা মারা গেছে। সংসারে একমাত্র বৃদ্ধ মা ছাড়া আর কেউ নেই। পনের বছর বয়স থেকে সে পরান মাঝির সাথে কাজ করে। বৃদ্ধ পরান তাকে ছেলের চেয়েও বেশী স্নেহ করত।

 

সে শীতের সেই সকালগুলোর কথা ভাবছিল। পরান গঞ্জের দিকে বেরিয়ে গেলে, তোরণ মালসার পাশে বসে নতুন করে হুকো ধরিয়ে পরানের মত ভঙ্গিতে টানতো। ক্রমে ক্রমে কোন দিন কুয়াশা আরও পাতলা হয়ে আসত, কোন কোন দিন আরও ঘন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চরের বালু পর্যন্ত বিলুপ্ত করে দিত। সূর্য উঠবে উঠবে পায়ের ছাপ পড়তে শুরু করত। এবং তাদের সবাইকে যেতে হ’ত পরান মাঝির মাছ ধরার জায়গার উপর দিয়ে। তারপরই বিস্তীণ চর-যেদিকে খুশী চলে যাওয়া যায়। এইসব শিকারীদের একজনের কাছ থেকে সে প্রথম বন্দুক চালান শেখে।

সেদিনও তোরণ যথারীতি বসে বসে হুকো টানছিল। বন্দুক হাতে জনাতিনেক লোক তার কাছে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, চরের কোন অঞ্চলটায় ভাল পাখী পাওয়া যায় এবং এর জন্য তোরণকে তারা সঙ্গে নিতে চায়। উপযুক্ত পারিশ্রমিকেরও কথাও তারা উল্লেখ করল। তোরণ বন্দুক কোনদিন নিয়ে পর্যন্ত দেখেনি। চট করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বলল, “যাবার পারুম এক শর্তোত, হামাক বন্দুক মারা শিখাবার নাগিবে।” যে ভদ্রলোক কালো একটা ওভারকোট গায়ে দিয়েছিলেন তিনি হেসে উঠলেন। মাছ মেরে শখ মেটে না, পাখী মারার ভীষণ শখ তাই না?

 

তোরণ কোন উত্তর দেয়নি, ভদ্রলোকরা রাজী হয়ে গেল। সেদিনই সে প্রথম বন্দুক ছুড়লো। লাল একটা কার্তুজ ভরে যখন তার হাতে বন্দুকটা দিল তখন সে নতুন একটা অভিজ্ঞতা অর্জনের আনন্দে কেঁপে উঠেছিল, কিছুটা ভয়ও করেছিল। নির্দেশমত বাঁটটা বুকের কাছে শক্ত করে ধরে ট্রিগারটা ডানহাতের আঙ্গুল দিয়ে চেপে দিয়েছিল। এখনও সেই দিনের কথা ভাবলে তোরণের নাকে বারুদের গন্ধ এসে লাগে।

 

সেইদিন  থেকেই প্রায় প্রত্যেকদিন বন্দুক ছোড়ায় শর্তে চরের যেসব অঞ্চলে প্রচুর পাখি সেইসব এলাকায় শিকারীদের নিয়ে যেত। তারপর দুপুরবেলা মাছ ধরার ডেরায় ফিরে আসত। ভোরে গঞ্জে যাওয়া বৃদ্ধ পরান দুপুর গড়িয়ে গেলে ফিরে আসত। আসার সময় বাড়ি থেকে খেয়ে আসত। পরান ফিরে এলেই তোরণ বাড়িতে ফিরে যেত। আবার সন্ধ্যেবেলায় দিকে কিছুক্ষণের জন্য আসত-তারপর আবার সেই ভোরের দিকে।

 

মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের বাইরে বসে এক এক করে সব কথা মনে পড়ল। কবে তার বাবা মরে গিয়েছিল। কবে একবার নদীর পাঁকে পড়ে ডুবতে ডুবতে আশ্চর্যভাবে বেঁচে এসেছিল, একবার মাছের ডেরা ফেলে সারা রাত যাত্রা শোনার জন্য বুড়ো পরান মাঝি তাকে ভীষণ মেরেছিল । সব কথা এক এক করে মনে পড়ছে। কিন্তু একদিনের কথা তোরণ কিছুতেই ভুলতে পারে না। একদিন দেখল অসংখ্য নৌকায় চড়ে দলে দলে সব লোক যাচ্ছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল কুড়িগ্রামে নাকি বিরাট মিটিং-শেখ মুজিব বক্তৃতা করবেন। অতি পরিচিত নামটা শুনে তোরণ যেন সম্মোহিত হয়ে গেল। বলে কয়ে কুড়িগ্রামমুখী একটা নৌকায় উঠে বসল।

 

এখনও মনে পড়ছে কি সে মিটিং লক্ষ লক্ষ লোক যেন ফেটে পড়তে চাইছে। অসংখ্য স্পীকার লাগান হয়েছে। ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। শেখ মুজিব বক্তৃতা দিলেন, বাংলার কথা বললেন, বাংলার মানুষের কথা বললেন। তোরণ নিম্পলক দৃষ্টিতে সমস্ত বক্তৃতা শুনলো।

 

মিটিং ভাঙ্গলে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ফিরতি কোন এক নৌকায় ফিরে এসেছিল। ভোররাতের দিকে তাকে ঘাটে নামিয়ে দিল। তোরণ ভয়ে ভয়ে মছের ডেরায় ফিরে এসে দেখলো ছই-এর নীচে পরান চাচা নেই। সে অবাক হয়ে গেল। এরকম একটা ব্যতিক্রম পরান মাঝির জীবনে নেই বললে চলে। ভোরের দিকে মাঝি ফিরে এলো। জিজ্ঞেস করে জানতে পেলো পরান মাঝিও মিটিং -এ গিয়েছিল। মাছের ডেরা ফেলে মিটিং-এ যাওয়া পরান মাঝির জীবনে এই প্রথম।

 

তোরণের জীবন থেকে একটা একটা দিন প্রতিদিনের মত খসে যেতে লাগল। এক সময় সারা দেশ জুড়ে ভোট হল, শেখ মুজিব নির্বাচিত হলেন । তারপর বাংলার বুকে খুব দ্রুত কতকগুলো দৃশ্যান্তর ঘটে গেল। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করার চক্রান্ত ফাঁদলেন। আবার নতুন করে শুরু হল শ্লোগান, মিটিং, পোষ্টার, ব্যানার। ঢাকায় শেখ মুজিবের সাথে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর বৈঠক বসল।

 

গঞ্জ থেকে ফিরে আসা লেকাজনের কাছ থেকে সব খবরই সে পেত। কিন্তু পরান মাঝি বিশ্বাস করত না। তোরণও বিশ্বাস করত না। ভোট দিনু যাক’ ক্ষমতাও যাবার নয় এটা হবার পারে না।”

 

পরান মাঝি তখন নিশ্চিন্তে ডেরা নিয়ে ব্যস্ত।

একদিন দেখল গঞ্জ থেকে ফিরে আসা লোকগুলো খুব উত্তেজিত। প্রায় প্রত্যেকের হাতে একটা করে পত্রিকা। গ্রামের ছাত্ররা দল বেঁধে যেন দিন-রাত কিসব সলাপরামর্শ করে। থানায় পুলিশদের মধ্যেও এ কি উত্তেজনা।

 

তারপর একদিন দুপুর গাড়িয়ে বিকেল হ’ল-বিকেল গড়িয়া সন্ধ্যা। ভোরে গঞ্জের দিকে বেরিয়ে যাওয়া পরান মাঝি ফিরে এলো না। অন্যান্য দিন গঞ্জ থেকে সারি সারি নৌকা ফিরতো। সেসবও দেখা গেল না। রাত্রিবেলার দিকে সে মাঝির বাড়িতে গিয়ে দেখা করল। না, তখনও মাঝি ফেরেনি। তারপর রাত আরও বাড়লে গঞ্জ থেকে পালিয়ে আসা একজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম বন্দরের উপর পশ্চিমা সৈন্যবাহিনী প্রচণ্ড গুলি চালিয়েছে। তোরণ মুহুর্তেই ভেঙ্গে পড়ল। কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে পরান মাঝি নিশ্চয়ই ফিরে আসত।

 

পরের দিন তোরণ গঞ্জের দিকে রওয়ানা দিল। স্কুলবাড়ির থেকে একটু দুরে পাটের গুদামের পাশ দিয়ে গঞ্জের ভেতর ঢুকতে যাবে এমন সময় সমস্ত গা ছমছম করে উঠল। একটা লোকজন নেই। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। আর একটু অগ্রসর হতেই দেখতে পেল বাজারে পোড়া ধ্বংসাবশেষ। তোরণের আর ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি। জোরে পা চালিয়ে বেরিয়ে সোজা গ্রামে চলে এসেছিল।

 

তোরণের এখন অন্য জীবন শুরু হয়েছে। বসে বসে পরান মাঝির চোখ দুটোর কথা মনে করল। সেই চোখ দুটো থেকে তোরণের জন্য সবসময় স্নেহ ঝরে পড়ত। না, পরান মাঝি আর গঞ্জ থেকে ফিরে আসেনি। সব বুঝতে পেরে তোরণ মাছের ডেরার পাশে গ্রামে চলে এসেছিল।

 

তারপর পশ্চিমা সৈন্যরা ক্রমে ক্রমে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। একদিন তোরণ মাছের ডেরায় কাজ করছিল, এমন সময় তাদের গ্রামের দিক থেকে গুলির শব্দ শুনতে পেল। তোরণের ছেড়া জাল মেরামত করা বন্ধ হয়ে গেল। সে খুব ভয় পেয়েছে। ঘণ্টা খানেক পর গুলির শব্দ থেমে গেল। বাড়িতে ফেরার সময় বার বার কেন যেন পরান চাচার কথা মনে পড়ল। গঞ্জে গুলি হয়েছিল। পরান চাচা আর ফিরে আসেনি। মা, পরান চাচার বউ এখনও কি বেঁচে আছে? ঘাটে নৌকো পেল না। পশ্চিমা দস্যুরা নৌকো ডুবিয়ে দিয়েছে। সাঁতারে তোরণ নদী পার হ’ল।

 

তোরণ এখন মুক্তিযোদ্ধা। গতকাল একটা অপারেশনে গিয়েছিল। আবার আগামীকাল রাতের অন্ধাকারে পশ্চিমা দস্যুদের খোঁজে গ্রেনেড, এল-এম-জি নিয়ে কয়েকজন মিলে যেতে হবে। আজ রাতটা শুধু একটুখানি বিশ্রাম। ক্যাম্পের বাইরে একটা অন্ধকারে গাছের নীচে বসে বসে তোরণ এইসব ভাবছিল। সাঁতরে তোরণ নদী পার হয়ে কাছাকাছি আসতেই সে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়েছিল। গ্রামের ঘরগুলো পুড়ে ছাই হয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। ঠিক শ্মশানের পরিত্যক্ত চিতার মত। গ্রামের ভেতর ঢুকে দেখতে পেল গুলি চালনার সময় যারা পালিয়ে বেঁচেছিল তারা ফিরে এসে ছাইয়ের ভেতর থেকে তাদের আপনজনের মৃত লাশ খুঁজছে। তোরণ পাগলের মত দৌড়ে তার বাড়ির দিকে ছুটে গেল। ভিটের উপর তার মায়ের চিহ্ন খুঁজে পেল না। তারপর বাড়ির আশেপাশের ফিরে আসা দু’চারজন লোককে জিজ্ঞেস করল। তারা কেউ কিছু বলতে পারল না। তোরণ পাগলের মত বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ল। এমনও তো হতে পারে গুলি খেয়ে বাঁশঝাড়ে ঢুকে সেখানেই মারা গেছে। তন্নতন্ন করে সেখানে খুঁজতে লাগল। সেখানেও পেল না। তারপর বাড়ির থেকে আরও দূরে খুঁজতে বেরিয়ে গেল।

 

ক্যাম্পের বাইরে বসে থাকা তোরণের চোখ দিয়ে দু’ফোটা উত্তপ্ত অশ্রু বেরিয়ে পড়ল। তাদের গ্রাম থেকে আধা মাইল খানেক দূরে একটা আমবাগানে আছে। তারি ভেতর তার মায়ের লাশের পাশে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েছিল তোরণ।

এখনও মায়ের কথা মনে পড়লে তার কণ্ঠেস্বর যেন কানে এসে বাজে। শীতের খুব ভোরে মাছ ধরার ডেরার দিকে যাবার সময় মা তাকে বলতো, “জার নাগিবে রে তোরণ, জার নাগিবে। মোর একখানা শাড়ি জড়ায়া নে ক্যানে?”

 

এই মা আর কোনদিন ফিরে আসবে না।

 

তোরণ শুধু ভাবছে। সে প্রাইমারী পর্যন্ত পড়েছিল, তারি বন্ধু কাজল যে ইউনিভাসিটিতে পড়ত তার সথে একদিন দেখা হয়ে গেল। সে-ই তাকে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আসে।

 

শেষবারের মত তার মায়ের কাঁচা কবরের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার পোড়া ভিটেটাকে পেছনে ফেলে রেখে কখনও নৌকায়, কখনও হেটে কাজলের সাথে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে চল এসেছিল।

 

প্রায় মাস দুয়েক হয়ে গেল। রাতের পর রাত জেগেছে। আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়েছে কিন্তু তোরণের মধ্যে আজ পর্যন্ত বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নামেনি। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দিনের পর দিন লড়াই করে চলেছে। সে জানে মাকে আর কোনদিন সে ফিরে পাবে না। পরান মাঝি আর কোনদিন ফিরে আসবে না। প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে সে লড়ছে। তোরণ আবার সেই ফেলে আসা শীতের সকাল, গ্রামকে বিলুপ্ত করে দেয়া কুয়াশা, পানিতে ভেসে বেড়ান পানকৌড়ি, সোনাগাছির চরের উপর প্রসন্ন বুনো হাঁস এইসব হারিয়ে যাওয়া টুকরো টুকরো সুখ আবার আগের মত ফিরে পেতে চায়।

 

(আশরাফুল আলম রচিত)

Scroll to Top