নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই সংকট মুক্তির একমাত্র পথ- একটি সম্পাদকীয় অভিমত

<02.185.717>
 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই সঙ্কট মুক্তির একমাত্র পথ- একটি সম্পাদকীয় অভিমত দৈনিক পাকিস্থান ৯ই মার্চ, ১৯৭১

 

সম্পাদকীয়ঃ সঙ্কট মুক্তির একমাত্র পথ

 

            বাংলাদেশের সংগ্রাম জনসাধারণ একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করিয়াছেন যে, বাঙালীকে আর শোষিত ও অবদমিত রাখা যাইবে না। গত রবিবার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়াছে, তাহাতে প্রতিফলিত হইয়াছে মুক্তিপাগল প্রতিটি বাঙ্গালীর মনোভাব। পূর্ব বাংলার মাটি হইতে এখনো শহীদের রক্তের দাগ মুছিয়া যায় নাই, এখনো এদেশের বহু ঘরে শোনা যাইতেছে স্বজন-হারানোর আর্তনাদ। তাই শেখ মুজিবুর রহমান প্রদীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন যে, তিনি শহীদের রক্ত মাড়াইয়া পরিষদে যোগ দিতে পারেন না। তবে তিনি পরিষদে যোগদানের সম্ভাবনাকে একেবারে উড়াইয়া দেন নাই। অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হইলে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া নিলে, গণহত্যার তদন্ত করা হইলে এবং দেশের শাসনভার জনপ্রতিনিধিদের হাতে হস্তান্তর করিলেই তিনি বিবেচনা করিয়া দেখিবেন পরিষদে যোগদান করিবেন কি করিবেন না। ইহার আগে পরিষদে যোগদান করার কোন প্রশ্নই উঠে না বলিয়া তিনি জানান।

 

            শেখ মুজিবুর রহমান পরিষদে যোগদানের প্রশ্নটি বিবেচনা করিয়া দেখার যে চারিটি শর্ত আরোপ করিয়াছেন সেগুলি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। এই শর্তাবলী মানিয়া লওয়া হইলেই শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁহার পার্টি সদস্যদের পরিষদে যোগদান করার পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হইতে পারে, ইহার আগে নয়। বেয়নেটের ছায়ায় কখনো পরিষদের কাজ মুক্ত ও সুষ্ঠভাবে চলিতে পারে না। এই জন্যই অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা এক অপরিহার্য প্রয়োজন দেখা দিয়াছে। খোদ প্রেসিডেন্টই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলিয়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে কোন রকম বিলম্ব ঘটানোর কোন নৈতিক অধিকার বর্তমান সরকারের নাই। একথা প্রেসিডেন্টের বোঝা উচিত যে, জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পথে অন্তরায় শুরু হইতেছে বলিয়াই পূর্ব বাংলা আজ বিক্ষুব্ধ। যদি একটি সংখ্যালঘু দলের অন্যায় আবদার রক্ষা করিতে গিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা না হইত, তবে বাংলাদেশ ফাটিয়া পড়িত না বিক্ষোভে, শহীদের রক্তে রঞ্জিত হইত না বাংলার মাটি। বাংলাদেশের বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আরম্ভের কথা ঘোষণা করিতে গিয়া তিন গত শনিবার যে বেতার ভাষণটি দান করিয়াছেন তাহা খুবই দুঃখজনক, সন্দেহ নাই। তাঁহার সেই ভাষণ সাত কোটি বাঙালীর মনে দুঃখ ও ক্ষোভের সঞ্চার করিয়াছে। তিনি যে সুরে কথা বলিয়াছেন, তাহা আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক ঠেকিয়াছে। গণপ্রতিবাদমুখর বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তিনি বাংলাদেশের জনসাধারণ ও বাঙালী নেতৃত্বকেই দায়ী করিয়াছেন। কিন্তু একটি সংখ্যালঘু দলের যে নেতাটি ইহার জন্য দায়ী, যাহার অনমনীয় মনোভাবের জন্যই বাংলার মাটি আবার রঞ্জিত হইল রক্তে, বুলেটের শিকার হইল এখানকার নিরস্ত্র মানুষ তাঁহার দোষর প্রেসিডেন্টের লক্ষ্যগোচরই হইল না। ইহা কি একদেশদর্শিতার পরচায়ক নয়? সে যাহায় হউক, সঙ্কট এড়াইতে হইলে অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা একান্ত জরুরী। এয়ার মার্শাল নূর খান তো স্পষ্টতই বলিয়াছেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ করার আইনগত অধিকার রহিয়াছে এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের সব রকম প্রতিবন্ধকতা অবিলম্বে দূর করা উচিত। এয়ার মার্শাল আসগর খানও শেখ মুজিবুর রহমানের শর্তাবলীকে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে করেন। বস্তুতঃ ইহাই শান্তি প্রতিষ্ঠা ও দেশ রক্ষা করার একমাত্র পথ।

Scroll to Top