বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের জন্যে বিশ্বের সকল উপাচার্যের প্রতি বাংলাদেশের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের আবেদন

<৪,১৫,২৩-২৪>

অনুবাদকঃ কাজী সাদিকা নূর

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫। বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের জন্যে বিশ্বের সকল উপাচার্যের প্রতি বাংলাদেশের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের আবেদন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন স্কটল্যান্ডের প্রকাশিত প্রচারপত্র

 

১৯ এপ্রিল, ১৯৭১

 

উপাচার্যবৃন্দের প্রতি একটি নিবেদন

বাংলাদেশের (প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং ছাত্ররা পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার শিকার হয়েছে। নিচে আমরা “সানডে টেলিগ্রাফ” (১৮ই এপ্রিল, ১৯৭১) -এ প্রকাশিত সংবাদ পুনঃউত্থাপন করছি, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনাব এ এস চৌধুরির তাঁর ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের ব্যাপারে বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। নিঃসন্দেহে উপাচার্য হিসেবে আপনাদেরও একইরকম অনুভূতি হবে এবং ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা আপনাদের কাছে আবেদন করছি রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে, যার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলার সকল বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করা।  

ছাত্রদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য 

(দি সানডে টেলিগ্রাফ ১৮ই এপ্রিল, ১৯৭১)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গত তিন সপ্তাহেরও কিছু বেশি সময় ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংক তাঁর ক্যাম্পাসে আঘাত হানা এবং তাঁর ছাত্রদেরকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করার ভয়ংকর ঘটনাটি উপলব্ধি করতে পারার আগ পর্যন্ত এটি তেমন উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনা ছিল না।

 

আবু সায়েদ চৌধুরি পূর্ব পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত ঢাকা হাই কোর্টেরও একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক। তিনি বলেন, “অবশ্যই আমার এখন পূর্ব পাকিস্তান বলা উচিত”। এখানে তাঁর অবস্থানকালে তিনি শুধুমাত্র তাঁর ব্রিটিশ উকিল এবং প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধুদের সাথে তাঁর প্রাক্তন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলেছিলেন। গত সপ্তাহে তিনি মান্দ্রেককে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারটি দেন।

বিচারপতি জনাব চৌধুরি জেনেভায় মানবাধিকার কমিশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের জন্য ১৮ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা ছাড়েন। তিনি দুর্ভাগ্য স্বীকার করে বলেন, “আমরা জাম্বিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার আত্মসংকল্প নিয়ে কথা বলেছি। এখন দেখছি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্তি অর্জন ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে অত্যাচার সহ্য করছে তা মানব ইতিহাসে অতুলনীয়।”

তিনি সাথে তাঁর পরিবারকেও নিয়ে এসেছিলেন। “এমন নয় যে আমি জানতাম এরকম কিছু ঘটবে। এখানে আমাদের জিসিই পড়ুয়া ছেলেকে আমার স্ত্রী দেখতে চেয়েছিল, তাই সাথে করে আমাদের ছোট দুই সন্তানও এসেছে।”

মানবাধিকার কমিশন তাঁদের আলোচনা শেষ করে এবং অন্য দিকে পূর্ব পাকিস্তানে ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ শুরু হয়। চৌধুরি হিথরোতে পৌঁছনো মাত্র এ সম্পর্কে জানতে পারেন কিন্তু চার দিন আগেই সাইমন ড্রিং দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশ করেন যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে এবং তাঁর ছাত্র-শিক্ষকদেরকে হত্যা করা হয়েছে।

“সেই মুহূর্তে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই এবং আমার এখানে ব্যাথা অনুভব করি”। তিনি তাঁর বুকে স্পর্শ করেন। “এরপর যখন নিশ্চয়তা আসে, তখন শ্বাসরুদ্ধকর একটি পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তৎক্ষণাৎ আমি শিশুর মত কান্নায় ভেঙে পরি। আমি আমার স্ত্রীকে জানাই এবং সেও ফুঁপিয়ে ওঠে”।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়, এখানে ছ’শ প্রাতিষ্ঠানিক কর্মচারী এবং দশ হাজার ছাত্র আছে। তিনি বলেন, তাদের মাঝে পাঁচ হাজারেরও কম সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং তাঁর মতে তারা সবাই শান্তিপূর্ণভাবেই এতে অংশগ্রহণ করে। বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগই “গ্রামের দরিদ্র ছেলেপেলে” যারা বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকে এবং তারাই ২৫ মার্চ রাতে সেনাবাহিনীর ঘুমন্ত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

যে পাঁচশ জন ছাত্রীর জন্য ১ মার্চ যে হল খোলার কথা ছিল তাদের ভাগ্যে কী লেখা আছে সেকথাও বিচারপতি জনাব চৌধুরি জানেন না। “আমি অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়েছিলাম এবং কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলাম আমার ফিরে আসার অপেক্ষায় উদ্বোধনের দিন যেন কোনভাবেই পেছানো না হয়। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে থাকার জায়গার বড্ড অভাব ছিল। কিন্তু জাতীয় সমাবেশ মূলতবী করায় ঢাকার জীবন পুরোপুরি থেমে যায়”।

যদিও তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের করণীয় সম্পর্কে এবং তিনি এই সপ্তাহে নিজের প্রস্তাব একদল রক্ষণশীল পশ্চাৎপন্থীদের সামনে রাখবেন। তাঁর যুক্তি অত্যন্ত কঠোর।

“অবিভক্ত পাকিস্তানের আদর্শ অবলম্বন করা এখন মরীচিকার পেছনে ছোটার মতই। এখানে দুইটি বিকল্প রাস্তা আছে। প্রথমত, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে তার আর্মি প্রত্যাহার করতে রাজি করানো, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে দেয়া এবং তাকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি নতুন সংবিধান গঠন করার অনুমতি প্রদান করা। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্টকে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের মেরে ফেলার অনুমতি দেয়া, এবং এর ফলে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার রাজত্ব চলতে থাকবে। এই পরিস্থিতিকে কোনভাবেই অভ্যন্তরীণ ঘটনা হিসাবে দেখা যাবে না, যেখানে জনগণের ওপর গত দুই সপ্তাহ ধরে গোলাবর্ষণ হচ্ছে”।

তিনি একইভাবে এও নিশ্চিত যে, ততদিন পর্যন্ত তিনি ঢাকায় ফিরতে পারবেন না, যতদিন না পর্যন্ত সরকার বদলাচ্ছে। একজন বিচারক হিসাবে এটি অসম্ভব। “এই মুহূর্তে কীভাবে উচ্চ আদালতে কেউ সরকারের আদেশ নাকচ করে আবেদন নিয়ে যেতে পারে? এখন কোন আইন নেই। সরকার এখন জোরের”।

একজন উপাচার্যের জন্য এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। “আমার ছাত্রদেরকে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমার মুখ দেখানোর মতন অবস্থা ছিল না। দেখুন, আমার ছাত্ররা আমায় ভালবাসৎ এবং আমিও আমার ছাত্রদেরকে ভালবাসতাম। যদি আমি তাদের প্রতি অবিচারের কোন সুরাহা আমি করতে না পারি, তাহলে ফিরে গিয়ে আমি মুখ দেখাব কী করে?”

এবং ব্রিটিশ সাংবাদিকদেরকে এতকিছু বলার পরেও তিনি সমর্থন পেতে ব্যর্থ হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,

রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং সংশ্লিষ্ট কলেজসমূহের কর্মচারীবৃন্দ

যারা উচ্চ শিক্ষার জন্য বর্তমানে স্কটল্যান্ডে আছেন

বাংলাদেশ অ্যসোসিয়েশান

স্কটল্যান্ড                                      

১৫ এল্ডন স্ট্রিট                              

গ্লাসগো সি৩

১৯/৪/১৯৭১

Scroll to Top