মুক্তি সংগ্রামে বঙ্গ বীরাঙ্গণা

মুক্তিসংগ্রাম ও বঙ্গ বীরাঙ্গনা

৫ নভেম্বর, ১৯৭১

নারী জাতির ললাটে গৌরবের টিকা দিয়ে কবি নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন –

যুগে যুগে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারী

প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।

আজকের যখন বাংলাদেশের এক অন্ধকারময় দুদিনে পশ্চিমা পশুদের বিতাড়নের জন্য দিকে দিকে আমাদের সংগ্রামী যুবকগণ জীবনকে তুচ্ছ করে সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন, তখন বাংলাদেশের মা-বোনেরাও এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। পশ্চিম পাকের বর্বর পশুগুলো বাংলাদেশের মা-বোনদের ওপর যে পাশাবিক অত্যাচার করেছে মানবতার ইতিহাসে তার তুলনা নেই। বাংলাদেশের মা-বোনেরা এই অবমাননার কথা কোনদিন ভুলতে পারেন না। তাঁরা দেখেছেন তাঁদের সামনেই সন্তানদের কিরূপ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে- তাঁরা দেখেছেন তাঁদের স্বামীর করুণ মৃত্যু,স্বজনদের রক্তাক্ত নিধন। আর দেখেছেন অসংখ্য মা এবং কন্যার ওপর বর্বরতম পাশবিক অত্যাচার। আজো বোধ করি কয়েক হাজার মা-বোন পশুসৈন্যদের শিবিরে শিবিরে ছাউনিতে ছাউনিতে গ্রানিকর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে। আমরা এই করুণ বেদনার কথা ভুলি নাই, ভুলতে পারি নাই। তাই বাংলাদেশের মা-বোনেরাও আজ সংগ্রামের পথকেই বেছে নিয়েছেন।

নারীর স্থান যে শুধু ঘরে নয়, বাইরের জগতেও যে তার সমাজকল্যাণমূলক এবং দেশসেবার প্রচুর কাজ আছে, বাংলাদেশের জাগ্রত নারী সমাজ তা প্রমাণ করেছেন। আজকের মুক্তিসংগ্রামেও বাংলাদেশের ললনাগণ সেই কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে এগিয়ে এসেছেন। আমরা জানি, আমাদের কোন কোন রণাঙ্গনে অনেক উৎসাহী ছাত্রী আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে পাক-সেনাদের খতমের কাজে তাঁদের সংগ্রামী ভাইদের সাহায্য করছেন। কিন্তু নারীর পক্ষে শুধু অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করাই আধুনিক যুদ্ধের বড় কথা নয়-নারীর পক্ষে আহত সৈনিকদের সেবার মাধ্যমে বাঁচিয়ে তুলতে সাহায্য করাও একটি বড় এবং মহান কাজ। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমাদের বহু সক্ষম ছাত্রী ও মহিলা আজ এই সেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। ইতিমধ্যেই তাঁদের সেবায় আমাদের বহু সংগ্রামী বাঙালী উপকৃত হয়েছেন।

বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় মেয়েদের জীবন যে কত সমস্যার মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে সেকথা ভেবে আমরা বেদনায় অস্থির হই। সেখানে খাদ্যভাব, অর্থাভাব এবং চিকিৎসার নিদারুণ অভাব ছাড়াও রয়েছে নিরাপত্তার অভাব। দখলীকৃত এলাকায় যে-কোন মুহুর্তে যে কোন স্থানে পশ্চিম পাকের পশুসেনারা অথবা রাজাকার বাহিনীর গুণ্ডারা যে-কোন মেয়েকে তাদের পাশবিক আনন্দের শিকারে পরিণত করতে পারে। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, দখলীকৃত এলাকায় এই সংকটের মুখে বাস করেও আমাদের নারী সমাজ সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর সাহায্যের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। দখলীকৃত অঞ্চলের যে গ্রামে মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানীরা আশ্রয় গ্রহণ করেন সেই গ্রামের মেয়েরা দল বেঁধে তাঁদের জন্য রুটি প্রস্তুত করতে বসেন, ভাত রান্না করেন এবং পরম উৎসাহ সহকারে খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আর সবচেয়ে আনন্দের কথা এই যে, গ্রামের মেয়েরা মুক্তবাহিনীর সেননীদের জন্য খাবার তৈরি করে যে কি এক গভীর তৃপ্তি অনুভব করে তার সীমা নেই। এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি গ্রাম ও শহরের সর্বত্র দখলীকৃত বাংলাদেশের মেয়েরা কি অসীম প্রতীক্ষায় দিন গুণছে- কখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে বিজয়ের দিন আসবে আর বাংলাদেশ এই পশুদের কবল থেকে মুক্তিলাভ করবে। এই আন্তরিক শুভেচ্ছার মূল্য যুদ্ধের দিনে কম নয়। আমরা মনে করি, মহিলারা মুক্তিবাহিনীর সেনানীদের খাবার প্রস্তুত করে, তাদের উৎসাহ প্রদান করে যেভাবে সাহয্য করছে তারও অপর নাম সংগ্রাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের মহিলা সমাজও তাই কৃতিত্বের দাবীদার।

কিন্ত বাংলাদেশের মহিলারা কৃতিত্ব চান না- পার্থিব কোন কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশের মহিলারা কাজ করেন না। সন্তানের মুখে, ভাইয়ের মুখে, স্বামীর মুখে, পিতার মুখে তাঁরা যদি দেখতে পান অমলিন হাসি, তবে সব কষ্ট, সব ত্যাগকে তাঁরা সার্থক মনে করেন। দেশজুড়ে এই হাসিমুখ যদি তাঁরা দেখতে পান তবে তাই হবে তাঁদের সবচেয়ে বড় পাওয়া, সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।

আরো একটি উপায়ে বাংলাদেশের মহিলারা এই সংগ্রামে সাহায্য করতে চলেছেন। মায়েরা সন্তানকে বোনেরা ভাইকে এবং স্ত্রীরা স্বামীকে বার বার তাগিদ দিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য প্রেরণ করছেন। রাজশাহী জেলার উত্তরাঞ্চলের একটি গ্রামে এমনি একজন মহীয়সী মায়ের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। তার একটি মাত্র ছেলে। ছেলেটির বয়স বাইশ বছর। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। ছেলেটির পিতা যদিও দেশপ্রেমিক-তবুও একমাত্র ছেলের প্রতি অসীম দুর্বলতা। বস্তুত তিনি ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু মা বলেছেন, না-আজ যখন মা-বোনের ইজ্জত ভুলুষ্ঠিত করেছে পাক-সেনারা তখন আমার ছেলেকেই সেই ইজ্জত রক্ষার্থে প্রথম যুদ্ধে যেতে হবে।

ছেলেটিকে হাসিমুখে তিনি যুদ্ধে পাঠিয়ে এখন পবিত্র প্রতীক্ষায় দিন গুণছেন। তাঁর ছেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে আবার তাঁর কোলে ফিরে যাবে। তাঁর মনে দুঃখ নেই, কোন সংশয় নেই। সেই মহীয়সী মায়ের কথা মনে পড়ে শ্রদ্ধার আমার মাথা নত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আজ এমনি মায়ের পবিত্র মুখ আমরা দেখতে পাব। সেই মুখগুলো শুধু পবিত্র নয়- যেন বঙ্গজননীর মুখচ্ছবির মতই সে মুখগুলো সোনালী অরুণাভায় সমুজ্জ্বল। আর তাঁদের সেই সংগ্রামের মূল্যও আমাদের মুক্তিসংগ্রামে অপরিসীম মূল্যে স্বাক্ষরিত।

(নূরজাহান মযহার রচিত)

Scroll to Top