রক্তের অক্ষরে লিখি

রক্তের অক্ষরে লিখি*

১৪ নভেম্বর, ১৯৭১

শান্তির ললিতবাণী যাদের কাছে পরিহাসের সামগ্রী, সেই দানবের সঙ্গে সংগ্রামের তরে সংগ্রামীরা ঘরে ঘরে প্রস্তুত হচ্ছে- এই সংবাদ রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিয়েছিলেন বহু বছর আগে। আজ বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা অনুভব করছি সংগ্রামীদের পদচারণা, বীরের মতো তারা যুদ্ধ করছে শত্রু র সঙ্গে, প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে প্রাণ দেয়া-নেয়ার এই উৎসবের মধ্য দিয়ে তারা আমাদের সোনার বাংলা ও তার শান্তিপ্রিয় মানুষকে সুখের মধ্যে

*  ‘রক্তের অক্ষরে লিখি’ শীর্ষক ধারাবাহিক কথিকাগুলি ‘জাফর সাদেক’ ছদ্মনাম

প্রতিষ্ঠিত করার মহান সংকল্প নিয়েছে। জেগেছে মানুষ, জেগেছে প্রাণ, খুলেছে দুয়ার। কার সাধ্য বিজয়ের পথে বাধা সৃষ্টি করে। কার সাথ্য অন্ধকারে রাজত্ব কায়েম করে।

সাধ্য যে নেই তার প্রমাণ বাংলাদেশ, রক্তাক্ত বাংলা, সংগ্রামী বাংলা। সাধ্য যে নেই তার প্রমাণ বাংলার মানুষ, প্রমাণ তাদের সংগ্রামী চেতনা। সেই চেতনার কথা বলছেন বাংলারই এক কবিঃ

আমার চেতনা ঘিরে বিচ্ছুরিত এক কণা

গড়ে তোলে আর এক রক্তিম চেতনা

পৃথিবীর সব কথা স্নান ভেবে অনেক বিস্মৃতি

মুছে ফেলে আজ জেগে থাক রক্তাক্ত স্মৃতি।

এই রক্তাক্ত অনুভূতির কথা বাংলার হৃদয়কে উজ্জীবিত করেছে। বাংলার যে মানুষ চিরকাল শান্তি শত্রু র সঙ্গে যুদ্ধ করতে। আজ শক্র হননের পালা। জীবন আজ উৎসর্গিত হবে জীবন বাঁচাতে- জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে, প্রতিষ্ঠিত করতে এমনভাবে যেন শত্রু আর শান্তির নীড়ে হানা দিতে না পারে। তাই আজ চারিদিকে লাল সূর্যের অভ্যুদয়।…

২১ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জোরদার করার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু পত্রপত্রিকা বেরিয়েছে। আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘জয় বাংলা সাপ্তাহিক বাদে বাংলার বাণী, নতুন বাংলা, বিপ্লবী বাংলা, স্বদেশ, দাবানল প্রভৃতি নানা নামের পত্রপত্রিকায় আমাদের বীর যোদ্ধাদের অগ্রগতির সংবাদ, অজেয় মনোবল ও অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের কাহিনীসহ দেশী-বিদেশী সংবাদ সব সময় বেরুচ্ছে। দেশের জনসাধারণকে সব ব্যাপারে ওয়াকিফহাল রাখতে এই পত্রপত্রিকাগুলো নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে। হানাদারদের মিথ্যা প্রচারের স্বরূপ উদঘাটনের জন্য দেশপ্রেমিক সাংবাদিকরা মন-প্রাণ দিয়ে পরিশ্রম করছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ার যে প্রচণ্ড প্রচেষ্টা দেশের মানুষ সব সময় করে চলেছে, এটা তারও একটি অংশ। দেশবাসীর মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখতে সংবাদপত্র যে মহান ভূমিকা পালন করতে পারে সেই ভূমিকাই আন্তরিকভাবে এইসব পত্রিকাগুলো পালন করে চলেছে।

সংগ্রামীরা যুদ্ধের সংগে সংগে কলম ধরেছেন এবং দেশপ্রেম ও সংগ্রাম এক হয়ে যে আগুন ঝরাচ্ছে তা অনুভব করতে হলে এই পত্রিকাগুলো বার বার পড়া দরকার।

মুক্তিযোদ্ধারা ডায়েরীর আকারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা সব সময় লিখছেন এখানে। দাবানল’ পত্রিকায় ‘গেরিলার ডায়েরী’ লিখেছেন মুকুল নায়ক। ৩১শে অক্টোবর সংখ্যায় ইনি লিখেছেন :

“আমি একজন গেরিলা নায়ক। গত মাসে পাবনার বিভিন্ন মুক্ত এলাকা ঘুরেছি। গ্রামবাংলার মানুষ এত দুঃখ, কষ্ট ও নির্যাতনের মাঝেও সুকঠিন মনোবল নিয়ে থাকতে পারে এটা একটা বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত ছাড়া কিছুই নয়। তাদের বাড়ি-ঘর দস্যুসেনারা জ্বালিয়েছে, লুট করেছে মা-বোনের ইজ্জত, হত্যা করেছে নিরীহ মানুষকে, তবুও তারা মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তিবাহিনীর আগমনের অপেক্ষায়।… তারা দেশকে শত্রু মুক্ত করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছেন।… তাদের সকলের কথা অস্ত্র চাই, মরতে হয় যুদ্ধ করে মরবো, দেশকে স্বাধীন করবোই।” কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল তাদের চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে।

এরপর লেখক দালাল, দস্যু ও পাকসেনাদের খতম করার কাহিনী বলেছেন :

“রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে এলো আমাদের গেরিলা ইউনিটসমূহের দলপতিগণ।… গাজনার বিলে অপারেশন করে এগারোজন দুর্ধর্ষ ডাকাতকে ধরে এনে গণআদালতে বিচার করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। বাকী দুষ্কৃতকারীগণ গ্রাম থেকে পালিয়েছে।… তৃতীয় দল নগরবাড়িগামী পাকসেনা বোঝাই ট্রাকের উপর আক্রমণ চালিয়ে ১২ জন পাকসেনাকে খতম করেছেন।

তাদের বীরত্বপূর্ণ কাজের কথা শুনে সত্যি আনন্দ অনুভব করছিলাম।”

বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকার নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধার ডায়ের প্রকাশিত হচ্ছে। বরিশাল থেকে মিজানুর রহমান লিখেছেন তার উপর পাকসেনাদের নির্যাতনের কথা, কিভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলেন তার কথা। তিনি লিখছেনঃ

“মৃত্যুর হাত থেকে আমি বেঁচে এসেছি। বাঁচিয়েছে মুক্তিসংগ্রামী আবদুল জলিলকে। কিন্তু বাঁচাতে পারিনি শহীদুল হাসান, শাহজাহান ও আমির হোসেনকে। ওরা আজ মৃত্যুর দেশে বসে আমাদেরকে আশীৰ্বাদ করছে।” এই স্মৃতিচারণের পর লেখক বর্ণনা করেছেন, কিভাবে তারা পাঁচ বন্ধু খান-সেনাদের হাতে বন্দী হলেন। এরপর তিনি লিখছেনঃ

“পাক হানাদাররা আমাদের পাঁচজনকে পাঞ্জাবী পুলিশের হেফাজতে রেখে চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।… এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হোল থানায়। সেখানে পাঁচজনের উপর চলল নির্যাতন।… শরীর কেটে লবন পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। সমস্ত রাত ধরে চলল এমনি অত্যাচার, পর দিনও কাটল। আবার রাত হলো।…

দেখতে দেখতে এক সময় চরম মুহুর্ত ঘনিয়ে এলো। ফায়ারের অর্ডার হলো। তিনজন পাঞ্জাবী পুলিশের রাইফেল গর্জে উঠল, লুটিয়ে পড়ল শহীদুল হাসান, শাহাজান, আমির হোসেন। আবার ট্রিগার টানা হলো মুহুর্ত পরেই লুটিয়ে পড়ব আমরা বাকী দুজন, কিন্তু এমন মৃত্যুই কি চেয়েছিলাম?

না, না, প্রতিশোধ নিয়ে তবে মরতে হবে। পাশেই স্রোতস্বিনী নদী বয়ে চলেছে- বাঁচতে হবে, প্রতিশোধ নিতে হবে, আবার ফায়ারের অর্ডার হল। কিন্তু তার আগেই জলিলকে বুকে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম নদীর বুকে। হে দেশমাতা, তোমার বুকে ঝাঁপ দিয়েছি, তুমিই গ্রহণ করো।

রাতের আধাঁর বিদীর্ণ করে ঝাকে ঝাকে গুলি এসে পড়তে লাগল নদীর বুকে, জলিলকে ধরে ডুব দিতে দিতে ওদের নাগালের বাইরে চলে এলাম, এবার প্রতিশোধ।”…..

২৫ নভেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা এক বিচিত্র অবস্থার মধ্যদিয়ে এ বছরের ঈদ উদযাপন করলো। দেশের মাঝে পশুশক্তির প্রতীক ইয়াহিয়া চক্র নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে, নিরস্ত্র বঙ্গবাসী প্রাণ রক্ষার্থে ব্যতিব্যস্ত, আর বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবনপণ করে লড়ছে শত্রু র সঙ্গে। বিভিন্ন সেক্টরে খান সেনারা আজ কাপুরুষের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে, দিন গুণছে মৃত্যুর। এমনি পরিবেশের ঈদের চাঁদ উঠলো, ঈদও হয়ে গেল- কিন্তু বাঙালী আজ দরদভরা

কণ্ঠে, আব্বাসউদিনের কণ্ঠে শুনতে পেলো না নজরুলের সেই বিখ্যাত গানঃ রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।

এতে বাংলাদেশের মানুষ দুঃখিত নয়। কারণ তারা জানে যে, কোনো জাতির জীবনে কোন কোন সময়ে এক-একটি ঐতিহাসিক মুহুর্ত আসে যখন তাকে স্থায়ী একটি সিদ্ধান্ত দিতে হয়, জীবন ও মৃত্যুর শত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। শত আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে তাকে এ কথা নিশ্চিত প্রমাণ করে যেতে হয় যে, পরবর্তী বংশধররা আর অত্যাচারিত, শোষিত, নিষ্পেষিত হবে না। সেই ঐতিহাসিক ও চরম মুহুর্ত আজ এসে গেছে। আমরা সেই ইতিহাস পরিবর্তনকারী, ইতিহাস সৃষ্টিকারী গৌরবময় মুহুর্তের মধ্যে আছি যখন আমরা বুঝতে পারছি “ফুল খেলবার দিন আজ নয়’- আজকের দিন হচ্ছে চরম সংগ্রামের, চরম আত্মত্যাগের, আত্মোপলব্ধির।

বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব অবস্থা বিরাজ করছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এবারকার ঈদ সম্পর্কে নানা মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত একাধিক পত্রপত্রিকায়।

সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা পত্রিকা ২ অগ্রহায়ণ সংখ্যায় লিখেছেঃ এবার শারদোৎসবে বুড়ীগঙ্গার পারে যেমন বাজন বাজেনি, তেমনি এবার ঈদেও খুশীর চাঁদ বাঙালীর আকাশে ওঠেনি। খুশী হওয়ার উৎসব করার অবকাশ কই এখন বাঙালীর জীবনে? গোটা জাতি যখন তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ব্যস্ত, নরপশু ইয়াহিয়ার দস্যুচক্রের বিরুদ্ধে জাতি যখন জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত তখন উৎসব করার, আনন্দ করার অবকাশ মানুষের জীবনে থাকতে পারে না।

গতবারও বাংলাদেশের মুসলমান রোজার ঈদে উৎসব করতে পারেনি। বারোই নভেম্বরের প্রলংকারী ঝড়ে সেবার বিশ লাখ বাঙালী মৃত্যুবরণ করেছে। দেড় হাজার মাইল দূরে তথাকথিত ইসলামাবাদের শাদাদী বেহেশতে বসে ইয়াহিয়া-চক্র বিশ লাখ বাঙালীর মর্মন্তদ মৃত্যু দেখে উপেক্ষার শয়তানী হাসি হেসেছে এবং আরো দশ লাখ বাঙালীকে হত্যার জন্য ছুরি শাণিয়েছে। গতবার বাংলার মুসলমান বিশ লাখ মানুষের মৃত্যুর শোকে রোজার ঈদে শোকাশ্ৰ চোখে কাতারবন্দী হয়েছে নমাজের ময়দানে,- এবার আরো বিশ লাখ ভাইবোনের লাশের স্তুপের উপর বসে তারা আকাশে দেখছে বাঁকা খঞ্জরের মত ঈদের চাঁদ। এবারও তারা উৎসব পালন করতে পারে না।

আজ নয়, বাংলার আকাশে খুশীর ঈদের চাঁদ একদিন উদিত হবে এবং সেদিন সুদূর নয়- যেদিন ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হবে এবং স্বাধীন ও মুক্ত বাংলার নীলাকাশে শওয়ালের চাঁদ সব অশ্রুর কুয়াশামুক্ত হয়ে আবার খুশীর রোশনাই ছাড়বে।

মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার ১লা অগ্রহায়ণ সংখ্যায়ও ঈদ সম্পর্কে একটি রচনা প্রকাশ করা হয়েছে। পাকিস্তানী বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণেও বিধ্বস্ত একটি পাকা মসজিদের ছবিসহ এই রচনার এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ

বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে এসে ঈদ যেন এবার ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়াল। তার নামে যে কী একটা উৎকট দুর্গন্ধের দমকা হাওয়া ঢুকে পড়ে মুখটাকে একটু বিকৃত করে ফেললো। কী এক বিকট হাহাকার ও আর্তনাদের ধ্বনি যেন তার কানে তালা লগিয়ে দিলো। চোখ তুলে এক মুহুর্ত এদিক-ওদিক তাকিয়ে একেবারে আৎকে উঠল সে? ধ্যাননেত্ৰে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় কোথাকার কোন রক্তপিপাসু রক্তপায়ী দানবের দল কামড়ে আঁচড়ে লাখো লাখো বাঙালীর মুণ্ডু ছিড়ে রক্ত ঝরিয়ে চলেছে। ধর্ষিতা বাংলার মা হতচেতন অবস্থায় মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আর এখনো যারা বাংলাদেশে প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে আছে তারা প্রায় সকলেই প্রিয়জনের

বিয়োগব্যথায় শোকাতুর, ব্যাথাতুর, স্নানমুখ, জীবন্মত অবস্থায় ধুকছে। আমি কি করে এদের মুখে হাসি ফোটাব?…

মৃত্যুর সঙ্গে, শত্রু র সঙ্গে যে পাঞ্জার লড়াই চলছে- তার সংবাদ দিয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধামন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ। ঈদের দিনে মুক্তিবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ সদস্যদের উদ্দেশ করে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন যে, আমরা শত্রু কে চারদিক থেকে আঘাত হেনে চলেছি, দেশবাসী যেন তৈরি থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করার কথা বলেছিলেন, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছে। শত্রু কে নির্মুল করে এমন এক সুখী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে একজন আর একজনকে শোষণ করতে পারবে না। সবাই সমান সুযোগ-সুবিধে পাবে।

এর পর পরই মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড বিক্রমে শত্রু সেনার উপর আঘাত হেনেছে এবং খুলনা, যশোর, রংপুর, সিলেট ও চট্টগ্রাম খান সেনারা প্রচণ্ড মার খেয়ে ক্রমাগত পিছু হটে চলেছে। মুক্তিবাহিনী এখন বিজয়ের পথে। সে কথা ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী গত ২৩শে নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক বেতার ভাষণে দেশের প্রতিটি বিজয়ের পথে এগিয়ে চলেছে, শক্র দাঁতভাঙ্গা জবাব পাচ্ছে। সে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। তার মনোবল ভেঙে গেছে। সে বুঝতে পারছে অন্যায় টিকতে পারে না। অহঙ্কারের পতন অবশ্যম্ভাবী, অত্যাচারীর ধ্বংস অনিবার্য, পশুশক্তি মানবতার কাছে কিছুই নয়। বাংলার মানুষ আজ ইতিহাসের শুভ্রতম পৃষ্ঠাগুলো অধিকার করেছে, আর ইয়াহিয়াচক্র ইতিহাসের কৃষ্ণতম পৃষ্ঠাগুলোর মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ছে। এরই নাম ইতিহাস, এরই নাম মহাকাল। এরই নাম সত্যের জয়, ন্যায়ের জয়।

২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

… ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয় তখনও আমরা জানতাম পশ্চিম পাকিস্তানের জীবনধারন পদ্ধতি, ধ্যান-ধারণা, আচার-সংস্কার প্রভৃতির সঙ্গে বহুক্ষেত্রেই আমাদের মিল নেই, তাদের সঙ্গে আমাদের গভীর পরিচয় নেই, বহুদূরে অবস্থিত সেই দেশের মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে সব সময় পরিচায়েরও সুযোগ নেই। তবুও আমরা মিলেমিশে থাকতে চেয়েছিলাম। বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতি নিয়েও একসঙ্গে বাস করা যায়। রাশিয়া, ভারত, চীন তার প্রমাণ। আমরা আশা করেছিলাম, ইতিহাসের দৃষ্টান্ত যেমন আমরা অনুসরণ করছি তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারাও অনুসরণ করবেন। দেয়া-নেয়া, মিলনের মধ্যদিয়ে একটি বৃহৎ মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হবে, সে জন্যই আমরা সব সময়ই স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলাম, স্বার্থ ত্যাগ করেছিও। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদে সমান সমান প্রতিনিধিত্ব আমরা মেনে নিয়েছিলাম। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও এ কথা আমরা বলিনি যে একমাত্র বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা আমরা চেয়েছিলাম, মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে বিদ্যা শিক্ষা আমরা চেয়েছিলাম, কিন্তু এ কথা আমরা বলিনি যে, উর্দু সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে- যে উর্দুকে আমরা জানবো না, উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের কোন উৎসাহ নেই। বরং উর্দু ছোটগল্প, কবিতা সম্পর্কে আমাদের উৎসাহ-ই ছিল। সমসাময়িক উর্দু সাহিত্যিকদের মধ্যে ফয়েজ আহমদ ফয়েজসহ অনেকেই আমাদের পরিচিত ছিলেন। শুধু উর্দু কেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সবকটি ভাষা সম্পর্কেই আমাদের গভীর আগ্রহ ছিল। পশতু বা সিন্ধী সাহিত্য জানবার চেষ্টা করেছি আমরা। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়াশীলরা যখন পাকিস্তানী ভাষা ও সাহিত্য কেন পৃথিবীতে সমস্ত ভাষা ও সাহিত্য জানবার দরজা আমরা সব সময়ই খোলা রেখেছি। বাঙালী কি ইতোপূর্বে সংস্কৃত, ফারসী, আরবী, উর্দু, ইংরেজি শেখেনি? সেইসব ভাষা ও সাহিত্যে তাদের অধিকার অর্জন করেনি?

প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোনরকম বাধনিষেধ বা ঘৃণার জন্ম দিতে কখনও রাজি হয়নি। আমরা জানিয়ে দিয়েছি কোন কিছু জোর করে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিলে আমরা মেনে নেবো না- যেমন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা আমরা ব্যর্থ করে দিয়েছি; কিন্তু তখন একথা আমরা বলিনি, উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমরা বিদ্বেষভাবাপন্ন। এমনকি বাংলাদেশে যে সমস্ত উর্দুভাষী বাস করছেন তাদেরকে উর্দু বাদ দিয়ে কেবল বাংলাই শিখতে হবে এমন কথাও আমরা বলিনি। আমরা সব সময়ই উদার নীতি গ্রহণ করেছি। আমরা স্মরণ করেছি যে, হিটলারের সঙ্গে যখন যুদ্ধ চলছে, তখনও জার্মান সাহিত্য গ্রন্থ বা সংগীত বন্ধ করে দেয়নি বৃটেন। এই দৃষ্টান্ত আমাদের লেখকরা বারবার কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থিত করেছিলেন; বিশেষ করে ভারত থেকে বাংলা গ্রন্থাদি আমদানী করার সয় দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে আমরা বলেছিলাম যে, যে জাতি জ্ঞানের দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হয় সে জাতির মৃত্যু অনিবার্য। কেবল গায়ের জোরে একটি জাতি টিকে থাকতে পারে না। ইতিহাস তার সাক্ষী….

৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১

… আমরা, বাংলাদেশের মানুষেরা, সবসময় পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বাস করতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম বলেই দীর্ঘকাল ধরে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য প্রচণ্ড স্বার্থ ত্যাগ করেছিলাম। বড় বড় উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে, আর বাংলাদেশে সামান্য কয়েক শ কোটি টাকার অভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি, সম্ভব হয়নি ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচার জন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ। লক্ষ লক্ষ বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু পশ্চিমী কুচক্রীদের চৈতন্যেদয় হয়নি। শেষ পর্যন্ত বীর বাঙালী হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, যুদ্ধ করেছে ও করছে শত্রু র সঙ্গে। এখন চূড়ান্ত বিজয় ঘোষণার সময়, এখন শত্রু র পরাভব শিকারের সময়, এখন শত্রু র অস্ত্র ত্যাগ করে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার সময়। এখন সত্যের জয়, আলোকের জয়, ন্যায়ের জয় ঘোষণার সময়। এখন নতুন সূর্য ওঠার সময়।…

বাংলাদেশ, বাঙালী জাতি আজ সেই গৌরবের অধিকারী হতে চলেছে। তারা অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। প্রাণ দেয়ার মহান কর্তব্যে বাংলাদেশের লক্ষ তরুণ আত্মনিয়োগ করেছে। তাদেরই একজন আমিন। সেই আমিনের আত্মত্যাগের কথা লিখেছেন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’। পত্রিকাটি লিখছেনঃ

“তেতুলিয়া নদীর পাড়ে ছোট একটি গ্রাম, নাম তার সোনাহাটি। কবে অনাদি কালে কে এই মিষ্টিমধুর নামটি রেখেছিল জানি না, তবে সোনারহাট না হলেও ঘর আলো করা অফুরন্ত সুখ-সৌন্দর্য এই গ্রামটিকে ঘিরে ছিল-আজও কালের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা তার সবটুকু হরণ করে নিতে পারেনি। সোনাহাটির প্রতিটি গাছ, পাতা, লতা আর ধূলোমাটির সাথে তার অন্তরের একান্ত আত্মিক সম্পর্ক। সে বন্ধন কেউ কোনদিন ছিন্ন করতে পারে না- পাক হানাদার বাহিনী তো দূরের কথা মহাকালও সেখানে এসে থমকে দাঁড়ায়।

এরপর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তেতুলিয়াতে যে যুদ্ধ হয় তার প্রসঙ্গে পত্রিকাটি লিখছেনঃ

“তেতুলিয়ার বুকে আজ দস্যুদের গানবোট। গোলাগুলির বজ্ৰগম্ভীর শব্দের অকস্মাৎ সোনাহাটির আকাশবাতাস কেঁপে উঠছে। চোখের পলকে ছোট ছোট কুটিরগুলো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। বিশ্বাঘাতক বেঈমানেরা হানাদারদের খবর দিয়েছে- খবর দিয়েছে আমিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা সুসংঘটিত হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করছে। আর যোগ্য সেনানীর ন্যায় পরিচালনা করছে ওর সহযোদ্ধাদের। এ যুদ্ধ হলো বিপ্লবী বাংলাদেশের বীর সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধ, যে মুক্তিযুদ্ধ কোনদিন ব্যর্থ হয়নি, হতে পারে না। চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে রাইফেল আর হাল্কা মেশিনগানের গুলি হানাদারদের আক্রমণের জবাব দিতে আরম্ভ করল। পাক পশুরা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সারাদিন ধরে এইভাবে চললো গুলিবিনিময়। একশো’র উপর খান

সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে- পশুদের উষ্ণ তাজা রক্তে সেনাহাটির মাটি তৰ্পণ করছে। এক সময় পশ্চিম দিকের মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি চালনা থেমে যায়। এই সুযোগে অবশিষ্ট হানাদারদের গানবেটে পালিয়ে গেলঃ পেছনে ফেলে গেল ১০-১২ খানা গানবেটি ও অসংখ্য আধুনিক মারণাস্ত্র।”

এই যুদ্ধে আমিন শহীদ হন। আমরা জানি ইতিমধ্যে শত্রু রা তেতুলিয়াসহ বহু জায়গায় পরাস্ত হয়ে পালিয়ে গেছে। আমিনের আত্মত্যাগ সম্পর্কে পত্রিকাটি মন্তব্য করেছেন।

“আমিন মরেনি, আমাদের মাঝে ও বেঁচে আছে-বেঁচে আছে বাংলার মাটির সাথে, মিশে আছে তেতুলিয়ার উদাম তীরভাঙ্গা পাগলা ঢেউগুলোর সাথে, যা কোন দিনই বাংলা মায়ের কাছ ছাড়া হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সবাই যে যার ঘরে ফিরে যাবে-ফিরে যাবে সেই ছোট গ্রাম সোনাহাটিতে। সেই গ্রামে অজস্র ঝরা বকুল ফুল কবরটাকে ঢেকে রেখেছে। মিষ্টিমধুর গন্ধে মাতোয়ারা মৌমাছি উড়ে বেড়াচ্ছে গাছটাকে ঘিরে, লক্ষ আমিন জন্মেছে বাংলাদেশে। আমিনরা কোনদিন মরবে না, আমিনরা কোনদিন মরে না।

Scroll to Top