শহীদ আসাদ দিবস পালনোপক্ষে স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েমের আহ্বান

<2.146.621-623>

পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী , আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জনগনের সশস্ত্র সংগ্রাম কিছুতেই দাবিয়ে রাখতে পারবে না । ১৯৭০ – এ পূর্ব বাংলার জনগনের যে গনযুদ্ধ শুরু হয়েছে তা দাবানলের রূপ নেবে ১৯৭১ – এ । পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে দাউ দাউ করে জ্বলবে গনযুদ্ধের দাবাগ্নি , আর তাতে পুড়ে মরবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার শত্রুরা , বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীরা এই প্রবল ঝড় – তরঙ্গে থর থর করে কাঁপবে পুরনো দুনিয়া , গড়ে উঠবে জনগনের গেরিলা বাহিনী , সমাপ্ত হবে পূর্ব বাংলার শ্রমিকশ্রেনীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি সংগঠন হিসেবে পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকা , প্রতিষ্ঠিত হবে পূর্ব বাংলার শ্রমিকশ্রেনীর রাজনৈতিক পার্টি।

 

 

 

                                                    টীকা

 

১। বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীঃ মনি সিং – মোজাফফর সংশোধনবাদী , হক – তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদী , হক – তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদী , দেবেন – মতিন ট্রটস্কী – চেবাদী , কাজী – রনো ষড়যন্ত্রকারী , অগিপ্রভ মাইতি প্রভৃতিকে বুঝানো হয়েছে , যারা আকৃতিতে পৃথক কিন্তু সারবস্তুগতভাবে সংশোধনবাদী ।

 

 

২। পূর্ব বাংলার দক্ষিনপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলঃ মুসলিম লীগের সকল অংশ , পিডিপি , জামাত ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক পার্টিসমূহ , আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একটি অংশ ।

 

৩। আকৃতিগতভাবে বামপন্থী কিন্তু সারবস্তুগতভাবে দক্ষিনপন্থীঃ প্রতিক্রিয়াশীল ন্যাপ উভয় অংশ , আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ব্যাপক অংশ ।

 

 

 

 

                                                       ২০শে জানুয়ারি শহীদ আসাদ দিবস

                                                             সর্বত্র হরতাল পালন করুন

 

                                                  সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের পতাকা ঊর্দ্ধে তুলিয়া ধরুন

                                          আমাদের স্বপ্ন স্বাধীন জনগনতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েম করুন

 

শহীদ আসাদের রক্তমাখা ২০শে জানুয়ারি আমাদের মাঝে আবার ফিরিয়া আসিয়াছে । ২০ শে জানুয়ারি পূর্ব বাংলার কৃষক শ্রমিক জনতার মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক গভীর বেদনাদায়ক ও সংগ্রাম দিন। এই দিন পূর্ব বাংলার ছাত্র – জনতা সম্রাজ্যবাদ , সামন্তবাদ ও বৃহৎ পুঁজির জাতীয় নিপীড়ন ও শ্রেনী শোষনের বিরুদ্ধে গণ – অভ্যুত্থানের বিস্ফোরণ ঘটাইয়াছিল । আমাদের সংগঠনের পূর্বসুরী ও প্রিয় সাথী আসাদ ছিলেন এই অভ্যুত্থানের একজন নির্ভীক সেনানী। ১৯৬৯ সালের ২০ শে জানুয়ারির সকাল বেলায় শহীদ আসাদ সহ জঙ্গী ছাত্রসমাজ যখন নিষ্ঠুর অত্যাচারী আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিয়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সম্মুখে দিয়া মিছিল করিয়া অগ্রসর হইতেছিল , তখন শাসক গোষ্ঠীর ভাড়াটিয়া কুকুরের দল রিভলবার দিয়া গুলি করিয়া হত্যা করে জনতার মুক্তি সংগ্রামের নির্ভীক যোদ্ধা আসাদ কে। যাহারা প্রত্যক্ষদর্শী  তারা জানেন , আসাদের হত্যাকান্ড কোন আকস্মিক ঘটনা  নয় । অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ ভাবে লড়াই করিতে করিতে আসাদ হাসিমুখে শাসকগোষ্ঠীর বুলেটকে বরণ করিয়া লইয়াছেন – আসাদ শহীদ হইয়াছেন । আসাদের হত্যা , জনগনের মধ্যে বিদ্রোহের যে আগুন ধুমায়িত হইয়া উঠিতেছিল , তাহাকে কেউ দাউ দাউ করিয়া জ্বালাইয়া দিল । শাসকগোষ্ঠী জেল – জুলুম – গুলী – বেয়োনেট – কারফিউকে অগ্রাহ্য করিয়া বিদ্রোহী জনতার কাফেলা আগাইয়া চলিল । শহরে শাসকগোষ্ঠীর  প্রশাসনযন্ত্র  অচল হইয়া গেল আর  গ্রামাঞ্চল হইয়া পড়িল আধা – মুক্ত এলাকা । সৃষ্টি হইল পূর্ব বাংলার বুকে এক প্রচন্ড বিপ্লবী  গণ – অভ্যুত্থান । জনতার সে কি বিপ্লবী মেজাজ ! কি বিপ্লবী প্রানবন্যা  !  জনতার এই বিপ্লবী শক্তি উতখাত করিল জালেম আইয়ুব শাহীকে ।

 

 

 

সংগ্রামী দেশবাসী !

 

 

যে আশা – আকাঙ্খা লইয়া কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষ এই বিপ্লবী গণ – অভ্যুত্থান সৃষ্টি করিয়াছিল ,  সে স্বপ্ন লইয়া শহীদ আসাদ মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তাহার অমূল্য প্রাণ বিসর্জন দিয়াছিল , জনগনের সেই আশা আকাঙ্খা কি বাস্তবায়িত হইয়াছে ? শহীদ আসাদের সেই স্বপ্ন কি সার্থক হইয়াছে ? দুই বছর পর ২০ শে জানুয়ারি  সে প্রশ্ন লইয়া আজ আবার আমাদের  দুয়ারে  হাজির হইয়াছে । আমাদের আজ সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হইবে । আসাদের প্রান বিসর্জন ও  জনতার বিপ্লবী গণ – অভ্যুত্থানের একটিমাত্র উদ্দেশ্য ছিলঃ তেইশ বছর ধরিয়া পূর্ব বাংলার জনগনের উপর সাম্রাজ্যবাদ   সামন্তবাদ ও বৃহৎ পুঁজি এই  তিন শত্রুর শোষন ও শাসনের যে পাহাড় চাপিয়া বসিয়া আছে , তাহাকে সমূলে উতপাটিত করা , পূর্ব বাংলার বুকে কৃষক – শ্রমিক , মধ্যবিত্ত  তথা সমগ্র জনতার একটি রাষ্ট্র কায়েম করা । মৃত্যুর পূর্ব  দিন  পর্যন্ত আসাদ এই উদ্দেশ্য  ও  লক্ষ্য কে বাস্তবায়িত করিবার জন্যই সংগ্রাম করিয়া গিয়াছেন । শহীদ আসাদ সাম্রাজ্যবাদ , সামন্তবাদ , ও বৃহৎ পুঁজির শাসন  ও  শোষনমুক্ত এমন এক নতুন পূর্ব বাংলা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিতেন , যে রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার কৃষক  জোতদারী  মহাজনী শোষন হইতে  মুক্ত হইবে , গরীব ও ভূমিহীন কৃষক জমির মালিকানা পাইবে , তাহাদের উপর হইতে  শ্রমের দাসত্বের নিষ্ঠুর বোঝা লাঘব হইবে , ছাত্র – মধ্যবিত্ত  বুদ্ধিজীবীর বিকাশের রাস্তা রাহুমুক্ত হইবে , তাহারা বেকারত্বের দুঃসহ  জ্বালা হইতে মুক্তি পাইবে ।

 

 

এক কথায় , পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগনের জীবনে অন্ন – বস্ত্র , বাসস্থান , শিক্ষা -চিকিতসা , জীবন ও জীবিকার নূন্যতম নিশ্চয়তা আসিবে । শহীদ আসাদ প্রান দিয়া  বিশ্বাস করিতেন যে , শাসকগোষ্ঠীর সশস্ত্র শক্তির মোকাবিলা সশস্ত্র শক্তির মাধ্যমেই করিতে হইবে । শাসকগোষ্ঠীর  সর্বাপেক্ষা দুর্বল ঘাঁটি গ্রামাঞ্চলে কৃষি বিপ্লবের  সূচনা করিয়া  সশস্ত্র সংগ্রামের ঘাঁটি এবং কৃষকের বিপ্লবী রাজত্ব প্রথমে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে । তাহার পর মুক্ত গ্রাম এলাকা দিয়া শহর ঘেরাও করিয়া চূড়ান্ত ভাবে রাষ্ট্রশক্তি  দখল করিতে হইবে । এই উদ্দেশ্যকে  বাস্তবায়িত করিবার জন্যই শহীদ আসাদ মনোহরদী – তাহিরদিয়া  এলাকায় কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ  করিয়াছিলেন , এই জন্যই আসাদ মৃত্যুর কিছুদিন  পূর্বে  হাতিরদিয়ার হাট হরতালকে সাফল্যমন্ডিত করিয়া তুলিতে যাইয়া আর একবার শাসকগোষ্ঠীর  বুলেটের সম্মুখীন হইয়াছিলেন ।

 

 

সংগ্রামী জনতা !

 

 

শহীদ আসাদের এই স্বপ্ন , জনতার বিপ্লবী গণ – অভ্যুত্থানের লক্ষ্য আজও বাস্তবায়িত হয়  নাই । কিন্তু কেন ? কারন ১৯৬৮ – ৬৯ সালের গণ – অভ্যুত্থানের যখন সশস্ত্র বিপ্লবে পরিণত হইতে চলিয়াছিল , তখন শাসকগোষ্ঠী  জনতার সংগ্রামকে বিভ্রান্ত করিবার জন্য গোল টেবিলের মাধ্যমে  আপোষের পতাকা তুলিয়া ধরিয়াছিল । গণ – অভ্যুত্থানের আপোসকামী  নেতৃত্ব শাসকগোষ্ঠীর  সহিত আপোসের চোরাগলিতে পা বাড়াইয়াছিল । ফলে শাসকগোষ্ঠী তাহাদের শক্তিকে  পুনরায় মজবুত করিয়া দেশের বুকে সামরিক শাসন জারী করে । শাসকগোষ্ঠী এইবার  পুনরায় নির্বাচনের মধ্য দিয়া জনতার সশস্ত্র বিপ্লবকে প্রতিহত করিতে চাহিয়াছে । কারণ , শাসকগোষ্ঠী ইহা  ভালভাবেই জানে , নির্বাচনের মাধ্যমে মেম্বর  মন্ত্রীর পরিবর্তন হইবে  ,  কয়েকটি দফাও হয়তো কাগজে – কলমে দিতে হইতে পারে , কিন্তু শাসন ও শোষনের মূল চাবিকাঠি মিলিটারী , পুলিশ ও প্রশাসন যন্ত্রের কোন পরিবর্তন হইবে না । তাহা হইলে পূর্ব বাংলার গোটা বাঙালী জাতিকে তাহাদের জাতীয় স্বাধীনতা এবং কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতাকে তাহাদের শ্রেনী শোষন হইতে মুক্তির সংগ্রাম হইতে দূরে সরাইয়া রাখা যাইবে – সংসদীয় রাজনীতিতে মোহাচ্ছন্ন করা যাইবে ।

 

 

তাই এইবারের শহীদ আসাদ দিবস আমাদের নিকট গভীর তাতপর্য  বহন করিয়া আনিয়াছে । আসুন , আজ আমরা শহীদ আসাদের রক্তাক্ত স্মৃতিকে স্মরণ করিয়া শাসকগোষ্ঠী ও সুবিধাবাদী আপোষকামী রাজনীতিবিদদের সকল ষড়যন্ত্রের জালকে ছিন্ন করিয়া বিপ্লবী রাজনীতির পতাকাকে তুলিয়া ধরি । সেই বিপ্লবী  পথ হইল , কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে মুক্ত এলাকা গঠনের পথ । মুক্ত গ্রাম এলাকা দিয়া শহর ঘেরাও ও  শহর দখল করিবার পথ । আর তাহার পাশাপাশি শহরে বিপ্লবী গণ – অভ্যুত্থানের ঝড় তুলিয়া শাসকগোষ্ঠীকে ঘায়েল করা যাহাতে তাহারা সর্বশক্তি লইয়া কৃষকের লড়াইয়ের উপর ঝাঁপাইয়া  পড়িতে না পারে । এই বিপ্লবী  পথেই  খুলনার বাহিরদিয়া ও সিলেটের হাওর  করাইইয়ার সংগ্রামী কৃষক আগাইয়া চলিয়াছে । এই লক্ষ্য অভিমুখেই ১৯৬৮ -৬৯ সালের বিপ্লবী গণ – অভ্যুত্থানের যাত্রা শুরু হইয়াছিল ।

 

 

আসুন , আগামী ২০শে জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শহরে – বন্দরে , স্কুলে – কলেজে , হাট – বাজার – গঞ্জে সর্বত্র হরতাল পালন করিয়া আসাদ সহ শত শত দেশপ্রেমিক  বীর  সেনানীদের আত্মত্যাগকে নতুন করিয়া স্মরণ করি , তাহাদের অপূর্ণ আশা – আকাঙ্ক্ষা ও  অসমাপ্ত কাজকে বাস্তবায়িত  করিবার জন্য  নতুন করিয়া শপথ গ্রহন করি , শহীদ আসাদের স্বাধীন জনগনতান্ত্রিক পূর্ব  বাংলা কায়েমের স্বপ্নকে সার্থক করিয়া তুলিবার পথে জোর কদমে আগাইয়া যাই ।

 

 

                                                                                                         পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন

 

Scroll to Top