সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হুমায়ুন কবির

<১০, ৪.৭, ১৭৫-১৭৮>

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হুমায়ুন কবির

 

১৭ ই মে আমাকে প্রথম অপারেশনে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন গফফার সাহেবেই আর নেতৃত্ব দেন। কসবা, কুটিবাড়ি, আড়াইবাড়ি ইত্যাদি এলাকায় পাকসেনাদের ঘাঁটি ছিল। আমার লোক দিয়ে সমস্ত অবস্থান জেনে নিয়ে তাদের উপর অতর্কিত আক্রমনে পরিকল্পনা করি। তখন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে। আমদের নির্দেশ ছিল হঠাৎ করে আক্রমণ করো এবং সরে এসো। আমরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে একদলকে রক্ষণভাবে রাখি। দ্বিতীয় দল মর্টারের সাহায্যে পাকসেনাদের ঘাটিঁর উপর আক্রমণ চালায়। আমি ছিলাম ক্যাপ্টেন গফফারের সাথে মর্টারের শেলিং-এ। শেলিং করে আমরা চলে আসি। চলে আসার সময় পাকসোনারা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের ওপর প্রচণ্ড গোলাগুলি চালায়। আমরা সবাই ক্যাম্পে ফিরে আসি। পরে খবর পেয়েছিলাম ওদের ১৫ জনের মত মারা গিয়াছিল এবং প্রচুর গোলাবারুদের ক্ষতি হয়েছিল। এটাই ছিল আমার প্রথম অপারেশন। ক্যাম্পে সমস্ত সৈনিক দেখি শত্রুখতম বা আক্রমণ এক নেশার মধ্যে আছে। খাওয়া-দাওয়া অনিয়ম বা কাপড়-চোপড় অভাবে তাদের ছিল, কিন্তু এদিকে কারও খেয়াল ছিল না। শক্রর খোজ পেলে তারা তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করার আনন্দে মেতে উঠত। তাদের দেশপ্রেম এত প্রবল হয়ে উঠছিল যে, মৃত্যৃভয়ও তাদের টলাতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যে আমাকেও এই নেশায় পেয়ে বসল। এরপর যখন কোন খবর পেতাম শত্রুকে আক্রমণ করার, তখন আমি আমার অধীনে অয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গিয়ে পেট্রোলিং এ্যামবুশ এবং শত্রুর ওপর হঠাৎ আক্রমণ চলাতাম। এরপর ক্যাপ্টেন গফফার আমার অধিনায়কত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শত্রুর উপর ঝাপিঁয়ে পড়ার অনুমতি দিলেন।

 

কসবা হচ্ছে এমন একটি স্থান যার ভৌগলিক গুরুত্ব অপরিসীম। কসবা রেলওয়ে স্টেশন খেকে ভারতীয় সীমান্ত দেখা যায়। সীমান্তের পাশ দিয়ে ছোট ছোট পাহাড়। পাহাড়ে বেশ গাছ পালা ও আছে। মে মাসের ২২/২৩ তারিখে দিকে খবর পেলাম পাকসেনারা দুটি ট্রলি বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র মন্দভাগ রেলওয়ে (কসবার নিকট) স্টেশন থেকে শালদা নদীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রেলওয়ে ট্রলির দুই পাশ দিয়ে আক প্লাটুন পাকিস্তানী সেনা টহল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। খবর পেয়ে দু সেকশন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি খালি গায়ে এবং লুঙ্গি পড়া অবস্থায় পাহাড়ের ধার দিয়ে গাচপালার ফাঁক দিয়ে আস্তে আস্তে মন্দভাগ রেলওয়ে ষ্টেশনের দিকে অগ্রসর হলামল। খালি গায়ে ছিলাম এই জন্য গেঞ্জি বা কোন কিছু পরে থাকলে তাদের নজরে পড়ে যেতে পারে। আমরা সকাল ৯টায় এসে মন্দভাগ গ্রামে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এ্যামবুশ পেতে বসে থাকলাম। আধাঘন্টা পরেই দেখলাম সেনাবহিনীর লোকেরা ট্রলির দু’পাশে দিয়ে হেঁটে পাহারা দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছে। ট্রলি দু’টি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সাজ্জিত ছিল। আমার হঠাৎ করে এলএমজি, এসএমজি’র সাহায্যে শত্রুদের উপর অতর্কিত গুলি ছুড়াতে লাগলাম। কয়েকজন পাকসেনা সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই পাকসেনারা ট্রলির ওপাশে গিয়ে পজিশন নিয়ে আমাদের পের গোলাগুলি ছুড়তে লাগল। আমরা রকেট লাঞ্চারের সাহায়্যে ট্রলির উপর আঘাত হানলাম। এক্সপ্লোসিভ থাকায় লাঞ্চারের আঘাতে ট্রলির অস্ত্রশস্ত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়। তারপর পাকসেনা আর্টিলারীর সাহায্যে আমাদের উপর অবিরাম গুলিবর্ষণ কর তাদের আহত জোয়ানদের নিয়ে পালিয়ে যায়। পাকসেনা পলিয়ে যাওয়ার পর আমি আমার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধকে নিয়ে ঘটনান্থলে যাই। দেখি ভাঙ্গাচোরা অনেক অস্ত্র পড়ে আছে। এরমধ্যে কিছু ভাল অস্ত্র ছিল। আমার ঐ সমস্ত অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসি। এ এক দুঃসাহসিক অভিযান ছিল, যা আমার জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। উল্লেখযোগ্য যে, আমার বাহিনীর কেউ এ অপারেশনে মারা যায়ন্ কসবা মন্দভাগ রেলওয়ের দূরত্ব মাত্র দু’মাইল।

 

এরপর অনেক চোট খাটো অপারেশন করেছি যা আজ আর মনে নাই। তবে প্রায়ই অপারেশন করতাম।

 

জুন মাসের ৮ তারিখে ক্যাপ্টেন গফফার এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে বেলুনিয়া ক্যাম্পে চলে গেলাম। কসবা সাব-সেক্টরের ভার আমার উপরে পড়ল। আমার অধীনে এক কোম্পানীর বেশী মুক্তিযোদ্ধা রইল।

 

তৎকালীণ পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ঘোষনা করলেন-ঢাকা-চট্রগ্রাম রেললাইন পুনরায় চালু করা হবে। ট্রেন মোটামুটি ঢাকা-চট্রগ্রাম লাইনের অন্য জায়গায় চলেলও আখাউড়া থেকে শালদা নদী পর্যন্ত কোন ট্রেন চলতো না। ঐ জায়গায় গুরুত্ব চিল অপরিসীম। টিক্কা খানের এ ঘোষণা শুনে সেক্টর ২ এর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ একদিন মেলাঘরে (সেক্টর ২ এর হেড কোয়ার্টার) সাব-সেক্টর কামাণ্ডারকে ডেকে পাঠালাম। তিনি আমাদের বললেন টিক্কা খান যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনুরুদ্ধার করতে চাচ্ছে। এটা যেন হতে না দেওয়া হয়্। আমি তাকে এ সম্পর্কে আশ্বাস দিলাম। আমি বললাম আমাদের জীবনে থাকতে এটা হবে না। যদি তারা ফিরিয়ে আনতে পারে তবে আমি অস্ত্র জমা দিয়ে দেব। এ প্রতিজ্ঞা আমি রেখেছিলাম। টিক্কা খানের এ ইচ্ছা কোন দিন পুরন হয়নি।

 

এরপর আমার বাহিনীর সাহায্যে শালদা নদী থেকে কসবা পর্যন্ত যত ছোট ছোট রেলওয়ে কালভার্ট, ব্রীজ ছিল, তা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয় হয়। টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ পাইলনও অনেক উড়িয়ে দেওয়া হয়। যার জন্য পাকসেনারা অনেক সময় যোগাযোগ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে। ঢাকা-চট্রগ্রাম ট্রাষ্ক রোডের উপর ছোটখাট অনেক কালভার্টও গেরিলা বাহিনী পাঠিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। খানসেনারা যখন দেশের মধ্যে সাধারণভাবে অত্যাচার চালাচ্ছিল-খন এ দেশের কিছুসংখ্যক দালাল, রাজাকার, শান্তিবাহিনী লোকেরা যে কীর্তিকলাপ চালিয়েছে তার তুলনা নেই। পাকসেনারা অনেক আগেই এদেশে থেকে বিতাড়িত হয়ে যেত-যদি না এইসব কুলাঙ্গাররা এদের সাহায্য করতো। এই লোকেরা পাকসেনাদের মনোবল যোগাতো। পাকসেনারা এত ভীত হয়ে গিয়েচিল যে, তারা সামান্য কুকুর দেখলে পর্যন্ত ভয় পেত। তাদের ধারনা ছিল বাঙ্গালীরা যাদুবিদ্যা জানত। সেই হেতু তারা মুক্তিবাহিনীর কীর্তিকলাপকে যাদুবিদ্যার সাথে তুলনা করতো। তারা এত ভীত হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের উপর একটি গুলি ছুঁঢ়লে তারা অবিরাম গুলিবর্ষণ করতো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ভাবত মুক্তিবাহিনী চলে গেচে। এই ঘৃণ্য দালালেরা পাকসেনাদের কাছ মেয়ে পাঠাতো তাদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য। এই সমস্ত পশুদের অপরাধ পাকিস্তানী সেনাদের চেয়ে কমতো নয়ই, বরং বেশী। এদেরে কিছু কীর্তিকলাপ তুলে ধরছি। একবার এক বুড়ো পাকিস্তানীমনা লোক তার ১৬ বছরের নাতনীকে পাকিস্তানী সেনাদের কাছে বিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল। আমরা এ খবর পেয়ে হঠাত করে তার বাড়ি ঘেরাও করে মেয়েটিকে উদ্বার এবং বুড়োকে শাস্তি প্রদান করি।

 

একবার দু’জন রাজাকার এক বিবাহিতা যুবতীর (সে পাকসেনাদর হাত থেকে পালিয়ে আসবার জন্য ভারতে চলে আসছিল) উপর পাশবিক অত্যাচার চালাবার জন্য তাকে ধরে ফেলে এবং তার ছ’মাসের বাচ্চা ছেলেকে পাটক্ষেতে ফেলে দেয় এবং তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। আমার এই ঘৃণ্য অপরাধের জন্য পরে তাদের ধরে এনে শাস্তি প্রদান করি। এদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের ফলে বাচ্চা ছেলেটি মারা যায়। এক গ্রামের দরজির তিনটি বউ ছিল। সে পাকসেনাদের আমন্ত্রণ জানাত নিজ বাড়ীতে এবং বউদের অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত। সে মুক্তিবাহিনীর খবরাখবর পকসেনাদের নিকট জানাত। আমি এ খবর জানতে পেরে তাকে ধরে এনে শাস্তি দেই।

 

অনেক নিরীহ শান্তিপ্রিয় লোক ভারতে চলে যেতো পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য । কিন্তু এই দস্যুরা এই নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার চালত। তাদের জিনিসপত্র কেড়ে নিত। এই রকম চার দস্যুকে আমরা ধরে শাস্তি দেই এবং তাদের মধ্যে একজন হিন্দুও ছিল।

 

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কিছু পাকিস্তানী দালাল শরনার্থীর বেশে ভারতে আসত এবং আমাদের খবর নিয়ে যেত। আমরা এ খবর জানার পর সর্তক হয়ে কিছু সন্দেহভাজন লোকের উপর তল্লাশি চালাই। তাতে দেখ যায, অনেক দালাল চালের মধ্যে গ্রেনেড বস্তার মধ্যে গ্রেনেড এবং অন্যান্য উপায়ে নানা ধরণের ধ্বংসাত্মক জিনিস নিয়ে আসত আমাদের ক্ষতি করবার জন্য। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এক মহিলার উপর তল্লাশি চালিয়ে দেখা যায় যে, সে লাউয়ের ভিতরে গ্রেনেড নিয়ে এসেছে।

 

এইসব ঘৃণ্য দালাদের কীর্তিকলাপ যে কত জঘন্য ছিল তা বলবার নয়। তারা পাকসেনাদের মনোবল বাড়াবার জন্য যা করেছে, তা পাকিস্তানী সেনাদের থেকেও ঘৃণ্য। অনেক রাজাকার গ্রামে গ্রামে ডাকাতি করত। আমি আমার বাহিনীর লোকেরা যাতে নিরীহ জনসাধারণের কোন ক্ষতি না করে তা লক্ষ্য রাখতাম। কেউ কোন অপরাধ করলে শাস্তি দেওয়া তহো। একবার এক মুক্তিযোদ্ধা গ্রামে গিয়ে ডাকাতি করেছে। এ খবর শোনার পর তা পরীক্ষা করে সত্য প্রামাণিত হওয়ার তাকে শান্তি প্রদান করি। এ ব্যাপারে কোন ক্ষমা প্রদর্শন করা হত না।

 

*বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে ১৯৭৩ সালে এ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়।

Scroll to Top