১০০। ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের অদিকৃত এলাকার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে

শফিকুল ইসলাম

<৬,১০০,১৬২-১৬৩>

শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে স্বাধীন বাংলা

১ম বর্ষঃ ১৯শ সংখ্যা

১৪ নভেম্বর, ১৯৭১

 

বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার অর্থনীতি
একেবারেই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)

বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার অর্থনীতিতে চরম অচলাবস্থা বিরাজমান। গত পহেলা মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হইতেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কর্মচাঞ্চল্য ভাটা পড়ে, গত কয়েক মাসের লড়াই উহাকে একেবারে অচল করিয়া দিয়াছে।

কলকারখানা আজো পুরোপরি চালু করা সম্ভব হয় নাই। ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ বললেই চলে। কৃষিক্ষেত্রে কিছুটা তৎপরতা থাকিলেও ব্যবসাকেন্দ্রগুলি ধ্বংস হওয়ায় কৃষি পন্যের বাজারজাতকরণের সুবিধা খুবই সীমাবদ্ধ।বাংলাদেশের দুটি সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম ও চালনা শ্রমিকদের অসহযোগিতা ও মুক্তিফৌজের আঘাতে আঘাতে প্রায় অচল আমদানী রপ্তানী প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ। যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়ায় অধিকৃত এলাকার অভ্যান্তরেও পন্য চলাচল খুবই সামন্য। ফলে স্থানীয় চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতেই জিনিসপত্রের দাম নির্ধারিত হইতেছে।

আমাদের সংবাদদাতাদের প্রেরিত রিপোর্ট হইতে জানা জায়, কৃষকরা যাহা উৎপাদন করে উহা পানির দরে বিক্রি হইতেছে আর শিল্পজাত পন্য বা যাহার সরবরাহ বাহির হইতে আসে সেগুলি রীতিমত অগ্নিমূল্য। ধান-চাউলের দর বেশী না হওয়া সত্তেও লোকের ক্রয়ক্ষমতা একেবারেই লোপ পাওয়ার ফলে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করিতেছে।

ময়মনসিংহ জিলার একটি এলাকা হইতে আমাদের একজন সংবাদদাতা জানাইয়াছেনঃ

ভৈরববাজার, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ এই তিনটি মূল ব্যবসা কেন্দ্রের সহিত প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানী ব্যহত হওয়ায় দ্রব্যমূল্য ভীষনভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে। কাপড়-চোপড়, ঔষধ, লবন, কেরোসিন তৈল, সরিষার তৈল, চা, সিগারেট, চিনি প্রভৃতি মূল্য দ্বিগুন হইতে তিনগুন বৃদ্ধি পাইয়াছে। চাউলের দর প্রতিমণ ৫০ টাকা, আটা ৪২ টাকা।

পাট

কৃষকের প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের উৎপাদন এবার খুবই কম। স্থানীয়ভাবে অনুমিত হয়, অন্যান্য বৎসরের তুলনায় অর্ধেক পাট উৎপাদন হইয়াছে।

পাট বোনার মওশুমে পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচার শুরু হওয়ায় কৃষকের পাট বুনিতে পারে নাই। অনেক কৃষক জঙ্গীশাহীর সহিত অসহযোগিতার উদ্দেশ্যে পাটক্ষেত ভাঙ্গিয়া ধান বুনিয়াছিল তাছাড়া পাক সৈন্য ও রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারে বহু কৃষক বাড়ীঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাওয়ায় ক্ষেতের পাট ক্ষেতে শুকাইয়াছে। ফলে পাট উৎপাদন বিরাজ গুরুতররূপে হ্রাস পাইয়াছে।

নারায়নগঞ্জে পাটের দর চড়া থাকা সত্ত্বেও কৃষকেরা উহার সুবিধা পাইতেছেনা অনেক ভাল ভাল পাটের বাজার পাক হানাদার সৈন্যরা পুড়াইয়া দেওয়ায় পাট বিক্রয়ের দারুন অসুবিধা সৃষ্টি হইয়াছে। আবার আর্থিক সঙ্কট এবং পাক বাহিনী বা রাজাকারদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির আশঙ্কায় কৃষক ঘরে ঘরে পাট মজুত রাখা নিরাপদ মনে করিতে পারে নাই। কৃষকের এই অসহায় অবস্থার সুযোগ ফড়িয়া ব্যাপারীরা গ্রাম হইতে পানির দরে পাট কিনিয়া নিয়াছে। পাটের দর সূতী মনপ্রতি ২০ হইতে ৩০ এবং বগী ৩৫ হইতে ৪০ টাকা। নিরপত্তার অভাব হেতু ব্যবসায়ীরা সরাসরি নারায়নগঞ্জে পাট চালান না দিয়া নরসিংদীতে বিক্রি করিয়া দেয়। লুটেরা রাজাকার বাহিনী পাটের নৌকা আটক করিয়া হয়রানির একশেষ করে। ফলে নারায়নগঞ্জ বন্দরে পাটের দর ও গ্রামের বাজারে কৃষক যে দাম পায়, উহার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হইয়াছে।

অন্যান্য অর্থকরী ফসল

এই মওশুমে কলা, লিচু, মূলা, হলুদ, মরিচ, পেয়াজ, রসুন, আদা, তরিতরকারী প্রভৃতি বিক্রি করিয়া কৃষকের হাতে কিছু পয়সা আসিত। কিন্তু বাজারজাতকরণের অসুবিধা এবং ক্রয়ক্ষমতা লোপ পাওয়ার দরুন স্থানীয় চাহিদা হ্রাসের ফলে এই সবের মূল্য শতকরা ৪০ হইতে ৫০ ভাগ কমিয়া গিয়াছে।

খাদ্য-শস্য

এই এলাকায় চাউলের দর বর্তমান মণপ্রতি ৪৫ টাকা হইতে ৫০ টাকা নিরাপত্তার অভাবে ধান চাউলের মজুত ব্যবসা নাই। পার্শ্ববর্তী ভাটি অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতার দরুন সেখানে ধান প্রতিমণ ৮ হইতে ১০ টাকা এবং চাউল ১৫ হইতে ২০ টাকা দরে বিক্রি হইতেছ। যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে মাল চলাচল নাই।

ভাটি অঞ্চলের ধানই সাম্বৎসরের একমাত্র ফসল। কৃষক উহা পানির দরে বিক্রি করিয়া দিতে বাধ্য হইতেছে কারন লুটেরা রাজাকার বাহিনীর দৌরাত্ম্যে কৃষক ঘরে ধান চাউল মজুত রাখিতে ভরসা পাইতেছে না। অবিশ্বাস্য হইলেও সত্যি যে, একদিকে ধান চাউলের নিম্ন মূল্য ও অন্যদিকে দূর্ভিক্ষের করাল ছায়া পাশাপাশি বিরাজ করিতেছে। রুটি রোজগারের অভাবে গ্রামের গরীব মানুষ ক্ষেতমজুর ভূমিহীন প্রভৃতি উপবাসে দিন কাটাইতেছে। তাছাড়া আমন ফসলের ফলন বিক্রি ভাল হয় নাই। সার ও কীটনাশকের অভাবে অধিক উৎপাদনশীল ইরি ধানের চাষ ক্ষতিগ্রস্থ হইয়াছে। যুদ্ধাবস্থার দরুন আউশ ধান সময় মত বোনা ও কাটা সম্ভব হয় নাই ফলে কৃষকের সামনে অন্ধকার ভবিষ্যত।

তাঁত শিল্প

সুতার অভাবে গ্রামীন তাত শিল্প ধ্বংসের মুখে। পশ্চিম পাকিস্তানী মিলের কাপড় চালু করার উদ্দেশ্য হানাদার পাক সৈন্যরা অনেক গ্রামে তাত পুড়াইয়া দিয়াছে। যথাঃ বাজিতপুর, বসন্তপুর, নিতাইকান্দি, কাপাসটিয়া পার্শ্ববর্তী ঢাকা জেলার নরসিংদী এলাকার তাঁত শিল্পও পাক বাহিনী ধ্বংস করিয়া দিয়াছে।

বেকার সমস্যা

এই অর্থনৈতিক অবস্থার পটভুমিতে গ্রামাঞ্চলে বেকার সমস্যার তীব্রতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। শিক্ষক সরকারী কর্মচারী বেসরকারী চাকুরীজিবী বেকার হইয়া গ্রামে আশ্রয় লইয়াছে। এবং ভরনপোষনের জন্য নিজেদের যৎসামান্য জমির উপর নির্ভর করিতেছে। অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা দলে দলে গ্রামে আসিয়া ভিড় জমাইয়াছে। সরকারী ও বেসরকারী অফিসের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাও বেকার হইয়া ক্ষেতমজুরের কর্মপ্রার্থী হইয়া একদিকে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি করিয়াছে অন্যদিকে ক্ষেত মজুরের চাহিদা ও মজুরী হ্রাস পাওয়ার কারন ঘটাইয়াছে।

Scroll to Top