২০১. ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশে ঈদ হয় নাই

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<৬,২০১,৩৫০>

শিরোনামঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে

সংবাদপত্রঃ সংগ্রামী বাংলা ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা

তারিখঃ ২৭ নভেম্বর, ১৯৭১

 

                                           বাংলাদেশের অভ্যন্তরে

                                        বাংলাদেশে ঈদ হয় নাই

                                         রিপোর্ট – দুরমুজ আলী

       যে উৎসব, যে আনন্দ, যে মহামিলনের বার্তা নিয়ে প্রতি বছর ঈদের আবির্ভাব মানুষের ঘরে, সে বার্তা অশ্রুসজল নয়নে ফিরে চলে গেছে । বাংলার ঘরে ঘরে বিষাদের ছায়া, প্রতি ঘরে কান্নার রোল, প্রতিটি মানুষের চোখের জলে এবারের ঈদ বেদনাহত হয়ে ফিরে গেছে । ঈদ উৎসবের ভাষা স্তব্ধ । আনন্দের ভাষা কণ্ঠরুদ্ধ । মহামিলনের বদলে মহাবেদনা নিয়ে ফিরে গেছে সবাই নিজ নিজ আশ্রয়ে । এবার আবার কিসের ঈদ? সমগ্র বাংলা জুড়ে নর কঙ্কালের মিছিল । শকুনী গৃহিনীর রাজত্ব । এখানে পুত্রহারা মায়ের আকুল আর্তনাদ । মাতৃহারা শিশুর মর্মভেদী হাহাকার । গৃহহারা, সম্পদহারা, সর্বহারাদের দীর্ঘশ্বাসে আকাশ বাতাস ব্যথিত । বাংলার প্রকৃতি বেদনায় ক্ষত বিক্ষত । মানুষ লড়াই করছে মৃত্যুর সঙ্গে, দারিদ্রের সঙ্গে, নিষ্ঠুর পাক ফৌজ ও তার অনুচরদের সঙ্গে । শুধু ঈদ নয় বাংলায় শরৎও এসেছিল কিন্তু শারদীয় উৎসব হয় নাই । আনন্দ হয় নাই । জগজ্জননী দুর্গা বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িতা লাঞ্ছিতা হয়েছেন । বাংলায় মন্দিরও নেই দেবতাও নেই । আজ বাংলায় গৃহবধূ সান্ধ্যদ্বীপ জ্বালে না বিগ্রহ দেবতাকে প্রণাম জানাবার কেউ নাই আজ বাংলায় বাংলায় উলধ্বনি আর হয় না, কাঁষার ঘন্টাও বাজে না । মন্দিরের দ্বারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করার জন্য কোন লোক ভক্ত পূজারী পাক অধিকৃত বাংলায় নাই । বাংলায় ফুল হয়ত আছে তার সৌন্দর্য্য উপভোগ করার কোন লোক নাই । বাঙ্গালী বাড়ীঘর চাকরী ব্যবসা সব ছেড়ে সর্বহারায় পরিণত হয়েছে, লাঞ্ছিত মানবতা কেঁদে ফিরে সর্বত্র । বাংলার সুখ শান্তি নির্মমভাবে নিহত । বাংলায় আছে পাক ফৌজের পাশবিক অত্যাচার আর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের রাইফেল মেশিনগানের গোলাগুলি । আজ বাংলাদেশ এক বিশাল রণক্ষেত্র । ৭ মাস ধরে বাংলার মানুষে রাতে ঘুমুতে পারে নাই । আহারের কোন প্রেরণা পায় নাই । বাংলার চাষীরা মেঠো গান ভুলে গেছে । রাখালেরা আর মাঠে মাঠে বাঁশী বাজায় না । শিশুদের খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেছে । মাঝিদের ভাটিয়ালী গানে নদী মাতৃক বাংলা আর মুখরিত হয়ে উঠে না । যাত্রা থিয়েটার বাংলা থেকে বিদায় নিয়েছে । পল্লীগীতি, লোকগীতি, বাউল, মুর্শিদী কীর্তনের জন্মভূমি বাংলা আজ প্রতিহিংসাপরায়ণ । অত্যাচারী জালেমশাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সৈনিক । বাংলায় লুন্ঠনকারী আর ডাকাতেরা বড়লোক হয়েছে, লক্ষপতি হয়েছে, আবার অনেক ধনী পথের কাঙ্গাল হয়েছে । নির্বিচারে নিরাপরাধ জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, আর অপরাধীরা রাজাকার হয়েছে । এখনও বাংলায় গঙ্গা, যমুনা, ব্রক্ষ্মপুত্র, মেঘনা ধলেশ্বরী, তিস্তা প্রবাহিত হয় কিন্তু তার পানি লাল । বাংলার শ্রমিকেরা চাকরী হারিয়েছে, কৃষকরা জমি ছেড়ে চলে গেছে । ছাত্র সমাজ স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিয়েছে । বাঙ্গালী দোকানদার দোকান ছেড়েছে । বাংলা আর মুক্তিযোদ্ধা ।

Scroll to Top