২৯০. ৮ সেপ্টেম্বর পাগলা কুকুর হতে সাবধান

অনুবাদঃ সাইমা তাবাসসুম

<৬, ২৯০, ৫০০-৫০২>

শিরোনাম: পাগলা কুকুর হতে সাবধান

সংবাদপত্র : বাংলাদেশ ভলিউম ১: নং ১১

তারিখ: ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

.

পাগলা কুকুর হতে সাবধানঃ মেরে ফেল

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আর কিছু নয়,অন্তত তাদের জন্য বৃথা যেতে পারেনা, যারা অকৃতিম ভালবাসা আর প্রচেষ্টা দিয়ে দেশটার জন্য লড়ছিল। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোও সেদিকে ইংগিত করছিল, ইংগিত করছিল আমরা জয়ের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি।

পাকিস্তানি মিলিটারিরা নিজেদের ফাঁদে নিজেরা আটকে পরছিল। তারা চেষ্টা করেছিল, হয়ত কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য প্রতারণা করতেও সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জয়ী হতে পারেনি। তাদের হিসেব মতো চলছিল না কোনো কিছুই। তীক্ষ্ণদৃষ্টি সম্পুর্ন ইয়াহিয়া খানও তার ভারসাম্য হারাচ্ছিল। শুধু তার আচরণই নৃশংস ছিল না, বরং তার কথাও ভীষণ রুঢ় হচ্ছিলো। শেষপর্যন্ত সে তার ভেতরের পশুকে আটকে রাখতে পারেনি। তার পশুত্ব মানুষের সামনে বেরিয়েই এসেছিল।

এইটা স্মরণযোগ্য যে ইয়াহিয়া খান তার ২৮ জুনের বেতার ভাষণে নিশ্চিত করে ছিলেন, অবশ্যই তিনি ক্ষমতা  ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচিত জন প্রতিনিধির কাছে ছেড়ে দিবেন। এইটা সাংবাদিকদের মাধ্যমে বার বার প্রচারিত হচ্ছিল, সাম্প্রতিককালে যখন মৃদুহাস্যে সে বলছিল “আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করব প্রথম সেই মানুষটির কাছে যাকে আমি ২৭ অক্টোবরের সকালে পাবো।” বাংলাদেশের জনগণের ইয়াহিয়ার কথা সম্পর্কে কোন সন্দেহ ছিল না। সুতরাং সেই রসিকতার কথা ছিল, ২৭ অক্টোবরের পূর্ব রাত্রে ইয়াহিয়া সামরিক হেডকোয়ার্টারে যাবে এবং ক্ষমতা তাকেই দিবে যাকে প্রথমে দেখবে, অর্থাৎ যেখানে একজন জেনারেল আর তার স্ত্রী থাকে । কিন্তু তার বেড টি এবং মদের বোতল পরিষ্কার করার জন্য কে থাকবে?

প্রতিশ্রুতির দুই-তৃতীয়াংশ সময় ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে কিভাবে নির্বাচন হবে? আর কারাই বা প্রতিদ্বন্দ্বী? সামারিক সৈন্য কিংবা তাদের সাহায্যকারী জোট এখন বুঝতে পারছিল মুক্তিবাহিনীরা যা বলছে তা পাকাপোক্ত আর জোর দিয়েই বলছে। তারা তাদের জাতির ভাগ্য নিয়ে মোটেও হইচই করছিল না।

অল্প কিছু দেশদ্রোহী নিজের দেশে থাকার বদলে লাহোর-করাচী-পিন্ডিতে থাকার পক্ষপাতী হয়ে উঠে। তথাকথিত নেতারা তাদের সমর্থকদের দিয়ে নিজেদের থাকার এলাকাকে সুরক্ষিত দূর্গের মত তৈরি করল। তারা চাইছিল তাদের সমর্থক এবং প্রশংসকরা রক্তের বিনিময়ে তাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা তৈরি করুক। তাদের সমর্থকরা  উদ্বিগ্ন  ছিল। তারা আরো উদ্বেগ হয়ে দেখছিল পাকিস্তানি আর্মি তাদেরকে মুক্তিবাহিনীর কঠোর আন্দোলন, পিটুনির দিকে এগিয়ে দিচ্ছিল। আর এই যুবসমাজ যারা পাকিস্তানিদের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল এবং নিজেদের রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল প্রকৃতপক্ষে এই বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক তাদেরকেই সব থেকে বেশি দাম দিতে হয়েছে। যুদ্ধটা যেহেতু সবার সামনে হচ্ছিল, সেহেতু আমরাও খবর শুনেছি রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে।

পাকিস্তান রেডিও আবার ই. বি. আর, ই. পি. আর আর পুলিশদের “সাধারণ রাজক্ষমা” নিয়ে চিল্লাচ্ছিলো। যদি স্মৃতি ধূসর না হয়ে যায়, স্পষ্টত মনে থাকার কথা যে, মাস কয়েক আগে প্রথম রাজক্ষমার ঘোষণার পর, পাকিস্তান রেডিও এক হাজার সৈন্যবাহিনী এবং পুলিশ কর্মকর্তার নাম উপস্থাপন করেছিল। ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রদত্ত বিবরণ অনুযায়ী, তখন পর্যন্ত তাদের দশ লক্ষ্যের ও বেশি আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল। যদি এটা বিশ্বাসই করতে হয় যে পিন্ডির মানুষখেকো এখন নিরামিষাশী হয়ে গেছে, তাহলে এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে যে কেন মানুষ এখনো শত্রুর ভয়ে মরিয়া হয়ে তাদের দেশত্যাগ করছে। বাংলাদেশিদের মাঝে কেনো এত ভয় আর অনিরাপত্তা বোধ? আসলে, উত্তরটা পানির মতোই সহজ এবং সরল। এর জন্য খুব একটা মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পরে না। মানুষ তাদের বিশ্বাস করতে পারছিল না, আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল তাদের উপর থেকে।

এদিকে ডাঃ মালিক ছিলেন কাঠের পুতুল, কেবল প্রদর্শনের জন্য। কারণ, ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান ওরফে জেনারেল নিয়াজি ছিলেন সামরিক আইন শাসন এবং পূর্ব আধিপত্যের সেনাপতি। মেজর জেনারেল রহিম খান ছিলেন সামরিক আইনের সহকারী পরিচালক। ক্ষমতা ছিল সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ এবং গভর্নরের, একজন রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, এবং সামরিক আইন অধিদপ্তরের নেতা যে কিনা কেবল তার শাসকের খেয়ালখুশির দেখাশুনো করছিল মাত্র।

পাকিস্তানি ডেমোক্রেসি পার্টির নেতা মিঃ নুরুল আমিন, তাদের “বাধ্যগত কর্মী” নয় বলে জানানো হয়। তাই তাকে তার নিজের মতো করে কাজ করতে দেয়া হয়নি। এজন্য পিডিপি আর পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাশনাল পার্টির মিঃ আমিন এই ক্ষেত্রে যখনি “না” বলবেন তখনি তার পদ বহিঃস্কার হয়ে যাবে বলে জানানো হয়। জামায়াত-ই-ইসলাম এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের তিনটি চক্র( কাইয়ুম, কাউন্সিল, কনভেনশন) এর সদরদপ্তর ছিল লাহর আর পিন্ডিতে। এদের কিছু কর্মী বাংলাদেশে কাজ করছিল। তাদের ভূমিকা ছিল ভাড়াটে সৈনিকদের মতো। দেশ থেকে কোনো সমর্থন তারা পায়নি। মানুষের উপর তাদের নৃশংসতাই তাদের নগ্ন উদাহারণ যে তারা মানুষের নয়, মানুষের জন্যে নয়।

রাজনৈতিক অবস্থার এই প্রেক্ষাপটে মুক্তিবাহিনী ধীরেধীরে একরকম তীব্র আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো এবং তাদের জন্য মরণ ফাঁদের আয়োজন করছিল। শত্রুপক্ষ ও অশান্ত হচ্ছে, আতংকিত হচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য থেমে আছে। বন্দরগুলো বিনিয়োগের বাইরে চলে গেছে। এমনকি নদীপথও চলাচলের জন্য অনিরাপদ।

পশ্চিম পাকিস্তানের পরিস্থিতিও  উদ্বেগজনক। ওমার টিক্কা আকবর জোটের ইয়াহিয়া হামিদ পিরজাদা জোটের কাছে পরাজয়ে টিক্কার গ্রুপের প্রিয় উত্তরাধিকার জুলফিকার আলি ভুট্টোকে অরাজকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পাকিস্তান পিপল পার্টির কার্যক্রম সামন্ত এবং শিল্পপতিদের পছন্দ নয়। তারা তাদের সাময়িক সমর্থন ভুট্টোকে দিয়েছিল যাতে বাঙালীদের দমন করা হয়। কিন্তু যখন তা ব্যর্থ হয় তারা তাদের সমর্থন তুলে নেয় এবং তাদের পুরাতন বন্ধু জামাত, মুসলিম লীগ আর জামায়াত-এ-উলমাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরে। ভুট্টো ছিল তার নিজের লক্ষ্যে স্থির, ক্ষমতালোভী সামন্ত প্রভু, এমনকি সে মৌদুদ, কাইয়ুম এবং দাউলাতানা দের চোখে চোখ তুলে চাইতো না। তাই ভুট্টো যখন ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাঝে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বলল তখন অন্যরা সামরিক শাসনের অবসানে বাঁধা দিল। তাদের কাছে ব্যক্তিগত আক্রমণ বৈষয়িক আক্রমণ নয়।

ন্যাশনাল আওয়ামীলীগের নেতা মিঃ ওয়ালি খানকে আফগানিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি ইয়াহিয়ার কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। অন্যদিকে, তেহরিক-ই-ইশতেকলাল এর শীর্ষস্থানীয় নেতা এয়ার আমি মার্শাল আসগর খান গণতন্ত্র পূণরুদ্ধার এবং বেপরোয়া হত্যাকান্ডের ইতি টানা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পরেন। বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাতে প্রচুর নেতা গ্রেপ্তার ও হয়। ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। উৎপাদন এবং বিক্রি কোনোটাই এখানে ছিল না সুতরাং শিল্পপতিরা রুষ্ট হয়ে উঠছিল। বন্দুকের নল থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তি কিংবা সাহসের সঞ্চার হয়নি, বরং দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রকদের ২২টি পরিবার থেকে হয়েছিল। ছাত্ররা যারা আইয়ুবের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে যুদ্ধে নেমেছিল, তারা ইয়াহিয়ার চিরস্থায়ী আর্মি শাসনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা এবং তার ভন্ড মুখোস টেনে ছিড়ে জনতার সামনে এনে রেখেছিল।

এরকম দূর্যোগময় অবস্থায়, ইয়াহিয়ার পাগল প্রায় অবস্থা। সবার উপর সে দিন রাত তর্জনগর্জন চালাতে লাগলো। এমনকি সে তার কথার মাঝে সংযম পর্যন্ত হারিয়ে ফেললো। প্রচন্ড হতাশা আর অবজ্ঞায় মরিয়া হয়ে সে মুক্তিবাহিনীর দিকে ছুঁড়ে দিল : ” পাগলা কুকুরগুলোকে একটা একটা করে ধরো আর মেরে পুঁতে ফেলো।”

Scroll to Top