আজকের বাংলায়

আজকের বাংলায়

১৬ অক্টোবর, ১৯৭১

ঘাট থেকে ফিরে এলো গোলাপজান। তার কোলের বাচ্চাটার নোংরা কাপড়-চোপড় ধুয়ে নিয়ে উঠোনে সেগুলো একটা বাঁশের ওপর মেলে দিতে দিতে সে লক্ষ্য করলো- কলিমুদ্দিন তার ফেরীতে যাবার সরঞ্জামগুলো

সাজিয়ে নিচ্ছে। গোলাপজান ত্রস্তে একবার ঘরের ভেতরটা দেখে নিল। মেঝেতে তখনও অঘোরে ঘুমুচ্ছে তার বছর পাঁচেকের ছেলেটা। ওকে নিয়ে ঠিক এই মুহুর্তে গোলাপজানের এতো ভীতি। গতকাল রাতে যখন ওর সামনে একটা আধপোড়া শুকনো রুটি ও খেতে দিয়েছিল, তখন ছেলেটা কিছুতেই তা গিলতে চায়নি। ওর একমাত্র জেদ ভাতই খাবে আর কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত গোলাপজান সকালেই ভাত রেধে দেবে বলে বহু সাধ্যসাধনা করে রুটিটা খাইয়েছিল। এখন, যদি ও উঠেই জেদ ধরে এই আশংকায় যতোক্ষণ কলিমুদ্দিন ঘরের ভেতর ছিল, গোলাপজান ওর সাথে কথা বলেনি। বারান্দায় আসতেই ও স্বামীর উদ্দেশে বলে উঠল-

আইজ তুমার ফেরীতে জাওনের কাম নাইক্যা।’

‘ক্যান, কি অইছে, ঘরেত চাউল নাই, খাওনের কিছু নাই, এডডা পয়সাও নাই, হে খেয়াল আছে? এমতেই আইজ দশদিন বাইর অই নাই, প্যাটেত খাওন লাগবো না?”

থাউকগা অবাবর, তুমারে বাড়িত থাকন লাগবো, আমারে ডর করতাছে।’

‘ডর! কি তামাসা করতাছস, ডর কিয়ের লাইগ্যা?

‘হেই কতাই তো কইতাছি, ঘাটেত ত্যানাবানি ধ্যুইয়া, গোসল কইর‍্যা উঠতাছিলাম, দেহী নাকি, দুইডা মেলেটারি, আমারে দেইখ্যা খাড়াই গ্যালো, আর চিকখোর পাইড়া, এশারা কইরা কি যান কইব্যার লাইগলো, তারপর আমারে ছটপটাইয়া বাড়িত যাওন দেইক্যা তাগোর কি হাসি। হাচা কইতাছিগো, ডর লাগতাছে, তুমি যাইও না।’

‘তোক তাগোর মনে লাগছেরে সোন্দরী, আর আমগো বাবনা কিরে, তোর কপালটা ফির্যাই গ্যাল। আচ্ছা থাউক, আমি যাইগ্যা।’

গোলাপজানের উদ্দেশ্যে রসিকতার কথাটি বলে কলিমুদ্দিন তার অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িপাতিলগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে রাস্তায় নামলো।

 শহরে এমনিই মানুষজন কম। মিলিটারীদের সাথে শেখ সাহেবের দলের কি একটা গোলমালে সমস্ত সম্পত্তি। ভালো ভালো ঘরের মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। রাস্তাঘাটে অনেক ধর্ষিতা মৃতদেহে একটা ভ্যাপসা পচা কটুগন্ধে ওর মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। শহর জনশূন্য। কৃচিৎ-কদাচিৎ কোন বাড়িতে দেখা যায় বুড়ো অথবা আধৰুড়ো দাড়িটুপিওলা এক-আধজন মুরুববী চেহারার লোক। শহরের সব লোক পালিয়ে গেছে গ্রামে। পথচলিত দু’একটা লোকের মুখে কলিমুদিন এ খবরও পেয়েছে, শহরের লোক গ্রামে চলে যাওয়ায় এখন মিলিটারীদের লক্ষ্য গিয়ে পড়েছে গ্রামে। তারা শহরে যে সমস্ত অত্যাচার চালিয়েছে, এখন ব্যাপক হারে তা চালাচ্ছে গ্রামে। হঠাৎ এসব কথা ভাবতে ভাবতে কলিমুদিনের ভীষণ হাসি পেলো। বোধ হয় একটু জোরেই হেসে উঠলো ও আরে কি বোকা সে। যেখানে শহরে মানুষ নাই বললেই চলে, যা এক-আধজন আছে, তারাও আতঙ্কে খাওয়াদাওয়া ছেড়েই দিয়েছে প্রায়, দোকানপাট-হাটবাজার সব ভস্মীভূত-ধ্বংস-প্রায়, আর এরমধ্যে সে কিনা বের হয়েছে হাঁড়িপাতিল বেচতে।

আবার মাইল চারেক হেঁটে শহরতলীর বস্তিবাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতেই তার যেন ক্লান্তিতে সারা দেহ অবসন্ন হয়ে পড়লো। কি করবে সে এখন? একটু জিড়িয়ে নিয় বাড়ির দিকে হাঁটবে? কিন্তু, অন্ততঃ কিছু চাল না নিয়ে সে বাড়ির দিকেই বা যাবে কি করে? হঠাৎ এই মুহুর্তে তার ভীষণ রাগ হলো

উপর। সত্যিই, কি অন্যায় গোটা দেশটাকে ওরা একেবারে ছারখার করে দিল। এতো সুন্দর সাজানো শহর, মানুষজন, বাড়িগাড়ি, সব যেন কোথায় হারিয়ে গেল। কলকাকলিতে ভরা এতো বড়ো শহরটা, এখন যেন মৃতের শহর। কোথাও প্রাণের কোন কিছু নাই। পথেঘাটে কুকুরেরা লুটোপুটি করে খাচ্ছে মানুষের গলিত অর্ধগলিত শবদেহগুলি।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে আচম্বিতে তার মনে পড়লো গোলাপজানের কথা, তার মুখে শোনা আজ সকালের ঘটনাটা। আৎকে উঠলো সে। অজান্তেই ক্ষিপ্ৰ পদক্ষেপে সে হাঁটতে শুরু করলো বাড়ির দিকে। তার সাজানো সংসার আজো যেখানে অন্ধ স্যাঁতসেঁতে বস্তিবাড়িতে মোটামুটি সন্ত্রমের সাথেই টিকে আছে- গতকাল পর্যন্ত যেখানে শকুনীর দৃষ্টি পড়েনি- এতোক্ষণ সেখানে যে কি তাণ্ডবলীলা চলেছে কে জানে! আচ্ছা, মিলিটারীরা কি গোলাপজানকে ধরে নিয়ে গেছে? তাই যদি হয়- সলিম, তার বড়ো ছেলেটা, সে কি করছে? নাকি সংগীনের এক খোঁচায় তাকে….না, আর সে ভাবতে পারে না তা তিন মাসের কোলের বাচ্চাটার কথা। ভয়ে-উত্তেজনায় সে হাঁটতে থাকে, তার পা যেন আর উঠছে না মাটি থেকে। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে সে বসে পড়লো রাস্তার পাশের বাবলা গাছটার নীচে, ঘাড় হতে তার ফেরীর বোঝাটা নামিয়ে। এক সময় তার মনে হলো আর বাড়ি গিয়ে কোন লাভ নাই, এতোক্ষণে সব শেষ। এখন বাড়ি গিয়ে যে দৃশ্য সে দেখবে, তা সে দেখতে চায় না। তা সে সহ্য করতে পারবে না।

নাঃ, সে সে যাবেই না আর ওদিকে। বরং বরং সে কামালের সাথে দেখা করবে। উকিলপাড়ার চৌধুরীদের বড়ো ছেলে কামাল, তাদের কামাল ভাই। কামালদের বাড়িটা যেখানে ছিল, সেখানে তখন ইটসুরকির একটা বিরাট ধ্বংসস্তুপ পাকসেনাবাহিনীর বাহাদুরীর সাক্ষ্য হয়ে জমে আছে। যখন এ ঘটনা ঘটে তখন কামাল বাড়িতে ছিল না। যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্য হতে কামালের ছোটবোন আই-এ ক্লাশে পড়া কুমকুমকে ওরা শুধু জ্যান্ত ধরে নিয়ে গেছে। আর সবাইকে……যাকগে, এখন সেকথা ভেবে তার কি লাভ। কামাল কোথায় আছে তা সে জানে। বোঝাটা ঘাড়ে নিয়ে সেদিকে পা চালালো কলিম।

এরপর-বিকেলের কিছু আগে কলিমুদিকে দেখা গেল, দুই ফুট চওড়া গ্রেটার রোডে। কোর্ট হতে মাইল দু’য়েক যে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলে হাতের ডাকদিকে চোখে পড়ে তীর চিহ্ন দেওয়া একটা কালো কাষ্ঠফলক, ইংরেজিতে যার গায়ে লেখা  Gratt Sector Headquarter-B Prohibited Area – সেদিকে । এ  লেখা অবশ্য সে পড়তে পারে না, তবে একথা সে জানে ওখানে অনেক মিলিটারী থাকে। এই ভরভেলায় ওই রাস্তায় কলিম কেন যে বোঝাটা নিয়ে চলছে, তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার দু’পাশে যে সমস্ত বড়িঘর, সেগুলো জনশূন্যই, তবু দেখা গেল, দু’পাশের বাড়িগুলোর দিকে চাইতে চাইতে আর হাকতে হকতে কলিমুদ্দিন সে রাস্তা বেয়ে এগিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে এসে পৌঁছল সে কাষ্ঠফলকের সামনে। ওখান হতে সোজা ভিতর দিকে চলে গেছে মিলিটারীর ছাউনিটায় যাবার রাস্তা, জঙ্গল ঘেরা। একটা গেটের মতো তৈরি করা আছে । আর তার কাছে গোটা পাঁচেক মিলিটারি প্রহরী- কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। সিগারেট ফুঁকছে আর হাসাহাসি করছে।

ওদের দেখেই কলিমুদ্দিন একটা লম্বা-চওড়া সালাম ঠুকে দিল, কোন জবাব এলো না। তাজ্জব বনে গেল। মিলিটারীগুলো। যেখানে ওদের দেখলেই সবাই পালায়, সেখানে এ ব্যাটা নিঃসংশয়মুখে ওদের সামনে দিয়ে শুধু যাচ্ছেই না, সালাম ও দিচ্ছে। একজন মিলিটারী ওকে ধমক দিয়ে উঠল- ‘আবে ভাগ, ইহা তেরা হাণ্ডি কোন খরিদেগা?- ‘অহনই যাইত্যাছি সাব, খুব পেরেসান অইছি, পসীনা মুছ্যা লই।’ বলে কলিমুদ্দিন মাথার গামছাটা খুলে ঘাম মুছল। মিলিটারীগুলো অবাক বিস্ময়ে ওর ভীতিহীনতা লক্ষ্য করছে। ঘামটাম মোছা শেষ হলে কলিমুদ্দিন ওর টুকরি হতে বের করলো এক প্যাকেট সস্তা সিগারেট। ম্যাচ দিয়ে ফস করে সিগারেটটা জেলে প্যাকেটটা আর ম্যাচটা রেখে দিল টুকরির মধ্যে। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে সে টুকরীর মধ্য হতে কি যেন একটা বের করল। তারপর-ক্ষিপ্রগতিতে সে জিনিসটা ছুড়ে দিল মিলিটারীদের দিকে।

ততোধিক ক্ষিপ্রতায় একটা মিলিটারীও তার দিকে হাল্কা মেশিনগান হতে গুলি ছড়িলো- অব্যর্থ লক্ষ্যদুটো বুলটেই কলিমুদিনের হৃৎপিণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। লুটিয়ে পড়েছে সে রাস্তায় ছটফট করছে সে, আর দমকে দমকে তার বুকের রক্ত রাস্তায় লাল লাল ছোপ এঁকে যাচ্ছে।

আর ওদিকে গ্রেনেডের বিকট শব্দে যখন ছাটনী হতে সৈনরা উদ্যত অস্ত্র হাতে বেরিয়ে এলো, তারা দেখলো, তাদের প্রহরী পাঁচজন শত টুকরোই বিছিন্ন হয়ে এদিকে-সেদিক ছড়িয়ে আছে। গেটের মাঝখানে একটা বিরাট গর্ত, তখনও চারপাশে ধুয়ো উড়ছে, কাপড় আর পোড়া মাংসের কটু গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।

মিলিটারীগুলো তার দিকে এগিয়ে গেল- দেখলো, তার দেহটা আকাশের দিকে মুখ করে পরে আছে। একটা প্রশান্তির তৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত সে মুখে যন্ত্রণার চিহ্নও নাই।

(আনোয়ারুল আবেদীন রচিত)

Scroll to Top