ইবলিশের মুখোশ

ইবলিশের মুখোশ

.

যখন ছোট ছিলাম, বয়স যখন পাঁচ কিংবা ছয়ের কোঠায় ছিল তখন দাদীমা গল্প শোনাতেন। ঝোলা বোঝাই গল্প ছিল দাদীমার। আজগুবি সব ভূতের গল্প। গল্প শুনতে শুনতে কখনো উত্তেজিত হয়ে উঠতাম, কখনো আবার প্রত্যক্ষ ভূত দেখার মতোই আৎকে উঠতাম। বুকের ভেতরটা দূর দূর কেপে উঠতো। কোন কোন দিন এত ভয় পেতাম যে ভয়ের প্রচণ্ডতায় দাদীমাকেই নিজের অজান্তে জড়িয়ে ধরতাম। এতো ভয় পেতাম তবু কিন্তু গল্প শোনার নেশা কাটত না। ভয় খেয়ে গেছি বলে দাদীমা একটু থেমে গেলেই ওকে তাড়া দিয়েছি আবার শুরু করবার জন্য।

দাদীমার ভূতের গল্পে কেমন একটা যাদু ছিল। গল্পের সব নায়ক-নায়িকারা ছিল জন্তু-জানোয়ার ও পশুপাখি। মজার ব্যাপার হল জন্তু-জানোয়ারগুলো কথা বলতে পারত। দাদীমা সেই জন্তু-জানোয়ারের হাঁকডাকের স্বর ও গোঙানী অবিকল নকল করে শোনাতে পারত। জন্তুরা কেমন আচমকা তাদের রূপ পাল্টাতে পারত এবং দেহের রূপ পাল্টাবার সাথে সাথে বাঁচনভঙ্গীও কেমন পাল্টে যেত, দাদীমা সবকিছু পরিবর্তন করে শোনাতে পারতো। দাদীমার গল্পের সব জন্তু-জানোয়াররাই ছিল ভূত-প্রেত। সন্ধ্যার অন্ধকারে গুটি শুটি মেরে গল্প শুনতাম। অন্ধকারে ভূতেরা কেমন করে হাঁটে, কেমন করে চাঁপা গোঙাতে গোঙাতে পাহাড় পর্বত নদী খাল বিল অতিক্রম করে তা দিব্যি দেখতে পেতাম। দু’মিনিট আগেই যে ভূতটির আকৃতি একটি হিংস্ৰ বাঘের ন্যায় ছিল হঠাৎ কেমন করে তা একটি পোষা ময়না পাখি বনে গিয়ে মিহি সুরে গান শুরু করত তা তখন ভেবেই পেতাম না। তখন ওই সব বিশ্বাস করতাম। কেন না, বয়েসটা ছিল পাঁচের কোটায়। দু’দশক পর আজ হলে দাদীমার সেই আজগুবি ভূতের গল্প হয়ত আমল দিতাম না। দাদীমার ভূতের গল্পে তখন শুধু এক জন্তু অন্য জন্তু বা পশু-পাখিতে রূপান্তরিত হত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর একাত্তরের প্রান্তসীমানায় মানুষও যে ভূত হতে পারে এবং রাতের অন্ধকারে তারা নরঘাতক পশু হতে পারে তা হয়ত দাদীমা জানতো না। জানা থাকলে এ মনুষ্যবশীে ভূতদের গল্পও পারতো। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে এই মনুষ্যবেশী ভূত তথা হিংস্ৰ জানোয়ারদের আজকাল বিচরণ করতে দেখা যায়। সত্যি সত্যি যা ভূত, তার অস্তিত্ব বুঝে পাওয়া কঠিন-কিন্তু এরা যে মনুষ্যবেশী ভূত এদের মূর্তিমান অস্তিত্ব আবিষ্কার করাটা তেমন দুরূহ কাজ নয়।

বাংলার মুক্তিসেনারা দেশের প্রতিটি অঞ্চলে তাদের শৌর্যবীর্য ও পূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই হানাদার জন্তুদের আবিষ্কার করে চলেছেন। মনুষ্যবেশী এই জন্তুদের মুণ্ড আবিষ্কারই এখন এই বীর সেনাদের জীবনের পরম কামনা।

গত কয়েক দিনে ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী ও যশোরে মুক্তিবাহিনীর বীর গেরলাদের হাতে হানাদার পাকিস্তনী সৈন্যরা প্রচণ্ড মার খাওয়ার পর বাংলাদেশে জন্তুরাজ জেনারেল নিয়াজী এই সমস্ত অঞ্চল পরিভ্রমণে বেরিয়েছে। নিয়াজী বলেছে, আমার জওয়ানরা ভারতীয় অনুচরদের আক্রমন প্রতিহত করেছে এবং পাল্টা আক্রমণের মুখে ভরতীয় অনুচররা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। ওদিকে ইয়াহিয়া খানই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একটি বিকৃত রূপ বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য মনুষ্যবেশী ভূতের মতো গোঙাতে শুরু করেছে। ভারত নাকি পাকিস্তানের পবিত্র ভূমি আক্রমণ করছে। বেমালুম চেপে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মাদ খাঁ তার আব্বা হুজুর ইয়াহিয়ার চেয়েও কয়েকহাত বেড়ে গলাবাজি করছে। ভরত-পাকিস্তানের সীমান্তে নাকি একটি যুদ্ধাবস্থার মতো পরিবেশ বিরাজ করছে।

‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’ এ কথা যথার্থতই প্রমাণ করেছে ইয়াহিয়ার তাবেদার সুলতান খাঁ। মনুষ্যবেশী পশুসম্রাট ইয়াহিয়া আরেক কাণ্ড করে বসেছে। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সৌহার্দ্য স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন। ভূতের মুখে রাম নাম আর কি। ভারত কিন্তু এর যথোচিৎ জবাব দিয়েছে। গত তেইশ বছর ধরেই ভারত সৌহার্দ্য স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে এসেছে। আজ হঠাৎ জঙ্গী শাসকদের প্রবক্তা ইয়াহিয়া খান ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপনের জন্য এত উদ্বেল হয়ে উঠলো কেন? মতলবটা কি? আসল মতলব আমরা টের পেয়েছি। উদ্দেশ্য সৌহার্দ্য স্থাপন নয়, বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাকে বিভ্রান্তির অতলে ডুবিয়ে দেয়া। কিন্তু ইয়াহিয়া জানেন, বিভ্রান্তির অতলে বাংলাদেশের মানুষকে আর ডুবানো যাবে না। বাংলাদেশই নয় বিশ্ববিবেকও আজ জাগ্রত।

ভূতের মুখে রাম নামই হোক আর সৌহার্দ্যর প্রস্তাবই হোক, সে আমাদের ব্যাপার নয়। তার জবাব ভারতই দিয়েছে এবং দেবে। কিন্তু আমাদের জবাব সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে বুলেট বেয়নেটে মনুষ্যবেশী জন্তুরা আমাদের সর্বহারা করেছে সেই বুলেট বেয়েনেটের আমরা জবাব দেব। কেননা, আমরা তাদের স্বরূপ উদঘাটন

করেছি। এরা দাদীমার সেই আজগুবি জন্তুবেশী ভূত নয়। এরা মানুষ্যবেশী হিংস্র জন্তু নরঘাতক, ইবলিশ। বাংলার পবিত্র মাটি থেকে উৎখাত করে বিশ্বের দরবারে এই ইবলিশের মুখোশ আমরা ফাঁস করে দেবেই দিবো।

(মেসবাহ আহমেদ রচিত)

Scroll to Top