১৯৬২ সনের শাসনতন্ত্র ঘোষনার পর পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভাব্য ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলন মোকাবেলার পরামর্শঃ স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ২য় খণ্ডের ১৩৫-৩৭ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ১৯ নং দলিল থেকে বলছি…

শিরোনাম সূত্র তারিখ
 ১৯৬২ সনের শাসনতন্ত্র ঘোষনার পর পূর্ব পাকিস্তানে সম্ভাব্য ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলন মোকাবেলার পরামর্শঃ স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদন সরকারী ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২

 

পূর্ব পাকিস্তান সরকার

স্বরাষ্ট্র (পোল) অধিদপ্তর

সেকশন ১.

ডিও নংঃ ১৬৩-পোল/এস(১), তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২

 

প্রিয় সুলাইন

ঢাকায় ছাত্রদের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে সংবিধানের ঘোষণার পর কী ঘটতে পারে। যেহেতু এই পরিস্থিতি আরো সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে, সেহেতু ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সম্বন্ধে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

২। কিছু নিষিদ্ধ দলের সদস্যরা বিশেষত কমিউনিস্ট এবং অন্যান্য চরমপন্থিরা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি করতে তৎপর, যেন সৃষ্ট ঘোলাটে পরস্থিতিতে তারা ব্যক্তিগত এবং নিজের দলের স্বার্থ উদ্ধার করতে পারে। এমনকি সংবিধানের গঠন ও উপাদান সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট এবং আওয়ামী লীগের একটা অংশ বলে আসছে যে এটি অগ্রহণযোগ্য এবং একে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। এটা মনে হচ্ছে যে, তাদের কার্যপদ্ধতি হলো শিক্ষার্থীদের আবেগ নিজেদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা, ছাত্রদের মিছিল করতে প্ররোচিত করা, প্রেসিডেন্টের ছবি পুড়িয়ে বা নষ্ট করে প্রেসিডেন্টকে অপমান করা, কর্তৃপক্ষকে প্ররোচিত করে বল প্রয়োগে বাধ্য করা এবং কর্তৃপক্ষ দ্বারা বল প্রয়োগকে ব্যবহার করে নিজেদের সমর্থন আরো বাড়ানো। মনে হচ্ছে যে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে মৌলিক গণতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে তারা ঘৃণামূলক প্রচারণা চালাবে এবং তাদের জোর করে পদত্যাগ করাবে।

 

৩। এ পর্যন্ত ঢাকার ঘটনা নিয়ে সাধারণ মানুষ ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। ঢাকার মিছিলগুলো ছাত্রদের একটা অংশ এবং সুযোগ সন্ধানী লোকজন দ্বারা সংগঠিত হয়েছে যারা লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ থেকে লাভের আশা করেছিল। ঢাকায় ঝামেলাকারী নেতাদের ধরা পড়া নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেয়া শুরু হয়েছে এবং যেখানে সম্ভব সেখানে সামরিক আইনের অধীনে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

 

৪। সাধারণত এই ধরনের ঘটনা ঘটার পর ক্ষতিকর লোকজন দ্বারা প্রশাসনের উপর থেকে সহানুভূতি সরানোর পাশাপাশি নৈরাশ্য এবং ভীতি তৈরি করতে ভয়ংকরভাবে চমত্কার সব গুজব রটানো হয়। ঢাকার এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর কর্তৃপক্ষ যে প্রশংসনীয় ধৈর্য্য এবং সহিষ্ণুতা দেখিয়েছে, তা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে, এমনকি চরমপন্থিদের মাঝেও। এই সুনামকে নস্যাৎ করার জন্য গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, পুলিশ অনেক ছাত্রকে মেরে মেডিকেল কলেজের মর্গে রেখেছিল এবং পরে গোপনে সরিয়ে ফেলেছে। বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং অন্যদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করার জন্য আরো গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, গৃহীতব্য পদক্ষেপ নিয়ে কর্তৃপক্ষের মাঝেও প্রচণ্ড মতপার্থক্য আছে। 

 

৫। সাধারণ জনগণের বিশেষ করে ছাত্র সম্প্রদায়ের সমর্থন অর্জনের জন্য উস্কানিদাতারা পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈষম্যের উপর জোর দিচ্ছে। এই ইস্যুতে জনগণকে বিভ্রান্ত করা বেশ সহজ কারণ প্রকৃতভাবেই বৈষম্যের অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু ঘটনা হলো, সামরিক শাসনের পূর্বের সরকারগুলো পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য কিছুই করতে পারে নি। উপরন্তু সময়ের সাথে সাথে পাকিস্তানের দুই অংশের উন্নয়নের বৈষম্য দূর করার জন্য তারা কোন পরিষ্কার নীতিমালা প্রণয়ন করতে চায় নি অথবা এটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে নি। ১১ বছর ধরে গড়ে ওঠা বৈষম্য রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়। এর জন্য সময় দরকার। এখানে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, গত তিন বছর ও অক্টোবর বিপ্লবের আগের ১১ বছরের উন্নয়নের তুলনা করলে দেখা যায় যে, গত তিন বছরে তার আগের ১১ বছরের তুলনায় উন্নয়ন বহু গুণ বেশি হয়েছে। বর্তমান সরকার দেশের দুই অংশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈষম্য দূর করতে নীতিগতভাবে কাজ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর প্রেসিডেন্টের সম্প্রচারিত ভাষণের উপর আপনার মনোযোগ প্রত্যাশা করছি। এই ভাষণের হাজার হাজার কপি বাংলা এবং ইংরেজিতে মুদ্রণ করা হয়েছে এবং বিতরণ করা হচ্ছে যেন এই প্রদেশে গত তিন বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কী কী করা হয়েছে, সেই বিষয়ে এবং সময়ের সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানকে উন্নয়নের দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সমকক্ষ করার সরকারের নীতির ব্যাপারে জনগণ সচেতন থাকে।

 

৬। ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার ঘটনাগুলোর পূর্ণ বিবরণসহ তথ্যপূর্ণ বিবৃতি প্রেসে প্রকাশিত হয়েছে। আমি এই সকল ঘটনার সূত্রপাত এবং বিস্তার লাভ দেখিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতিও পাঠাচ্ছি যেন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যপূর্ণ বিবৃতিগুলোর সাথে মিল রেখে সামগ্রিক পরিস্থিতির একটা চিত্র আপনি বুঝতে পারেন এবং যে কোন মিথ্যা গুজব ছড়ালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন।

 

৭। পূর্ব পাকিস্তানের একটি মারাত্মক গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে এবং এটি নিয়ে সকল পূর্ব পাকিস্তানি ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ার কারণগুলোর মধ্যে একটি ছিল বিনিয়োগকারীদের মনে অতীব সংকীর্ণমনা অথবা কমিউনিস্টদের দ্বারা সংঘটিত দাঙ্গা এবং বিশৃঙ্খলার ভয়। ১৯৫৪ সালের আদমজীর দাঙ্গা নিশ্চিতভাবেই পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগের পরিস্থিতিকে নাজুক করে দিয়েছিল। যারা বিনিয়োগে আগ্রহী ছিল তারা যত দ্রুত সম্ভব অর্থ ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয় অথবা পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকে। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও গত তিন বছরে পূর্ব পাকিস্তানে বড় বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার মতো পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান শুধু পূর্ব পাকিস্তানের উদ্যোক্তাদের দ্বারা উন্নত হতে পারবে না। আমরা যদি পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতি চাই, তবে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে পশ্চিম পাকিস্তানী এবং বিদেশী অর্থবান ও কারিগরি জ্ঞান সমৃদ্ধ ব্যক্তিবর্গ এখানে আসে এবং বিনিয়োগ করে। ঢাকার ঘটনার একটা প্রতিক্রিয়া অবশ্যই তাঁদের উপর পড়বে এবং তাঁদের থামিয়ে দিবে। এই ধরণের ঘটনা যদি আরো ঘটে, তবে এই প্রদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির অপূরণীয় পশ্চাদপদতার সৃষ্টি হবে। বিনিয়োগকারীরা অতি সতর্ক এবং যদি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতাবস্থা নিয়ে তাঁরা নিশ্চিত না হন, তবে অহরহ সমস্যাসংকুল জায়গায় তাঁরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না।

 

 

 সংযুক্তি

গোপনীয়

অতীতে ছাত্রদের উপর আওয়ামী লীগ এবং ন্যাপের একটা অংশের ভালো আধিপত্য ছিল এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাদের প্রচুর ব্যবহার করা হয়েছে। ছাত্রনেতাদের মাঝে কেউ কেউ ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। অন্যরা আইন-কলেজগুলোতে ভর্তি হয়ে এবং বছরের পর বছর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ বিভিন্ন হল-ইউনিয়ন নির্বাচনে এই পেশাদার ছাত্ররা অনেক কম সমর্থন পেয়েছে। তারপরেও তারা ছাত্রদের মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ও অবিচারের মত বিষয়গুলো নিয়ে প্রচার প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। তারা এই সকল প্রচারণার উপর ভিত্তি করে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে অস্থিরতা তৈরীর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো এবং আসন্ন সংবিধানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য এই অস্থিরতা অব্যাহত রেখেছিল। জনাব সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তার তাদের কর্মপরিকল্পনাকে আরো ত্বরিত করে দেয় এবং সাথে সাথে তাদের গোপন উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেয়। অধিকাংশ ছাত্রই জনাব সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তার সম্পর্কে অবগত ছিল না এবং সত্যি বলতে তারা এই সকল প্রাক্তন-আওয়ামী লীগারদের পরিচালিত অবরোধের বিরোধিতা করেছিল। সাধারণত এ সকল ক্ষেত্রে যা ঘটে থাকে, এই সব সংখ্যালঘু চরমপন্থিরা সাময়িক জয় পায়। এমনকি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবরোধও আংশিক সফলতা পায়। অধিকাংশ ছাত্রই সমস্যা এড়াতে শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত ছিল। তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের পরিকল্পনা করছিল যেখানে একটি সুযোগ এসে উপস্থিত হয় যখন জনাব মঞ্জুর কাদের আমন্ত্রিত হয়ে ইতিহাস বিভাগের ছাত্রদের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান, যেটি কয়েক মাস পেছানো হয়েছিল। গোলমালকারীরা উনাকে কথা বলতে বাঁধা দেয়। এমনকি তারা উপাচার্যের গাড়ি ভাংচুর করে যিনি ছাত্রদের নিকট খুবই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। রমজানের জন্য অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ছিল। গোলযোগকারীরা মনে করে যে তাদের সুযোগ ফস্কে যাচ্ছে এবং আইন ভেঙ্গে রমজানের ছুটির বিরুদ্ধে মিছিল করার জন্য ছাত্রদের সংঘটিত করতে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের একটি মিছিল সচিবালয়ের দিকে যেতে চাইলে অবধারিতভাবে পুলিশের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এই মিছিলে ছাত্র সংখ্যা (৩০০) কম ছিল। পরে প্রচুর বহিরাগত লোকজন তাদের সাথে যোগ দেয়। এরপর থেকে পত্রিকায় প্রতিদিন এই বিষয়গুলোর উপর প্রতিবেদন আসতে থাকে। ছাত্রদের একটা বড় অংশ এই ঘটনাগুলোর এত পরিব্যাপ্তিতে খুশি ছিল না এবং তারা এগুলোতে অংশ নেয় নি। তবে এটা নিশ্চিত যে, বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাত্রদের একটা অংশ সক্রিয়ভাবে গোলমালে জড়িত ছিল এবং নিজেদের এলাকায় ছাত্রদের দ্বারা অবরোধ জাতীয় বিবিধ বিষয় আয়োজন করার দিকনির্দেশনা পেয়েছিল। এই উস্কানিদাতাদের উপর সতর্ক নজর রাখা প্রয়োজন। দরকার হলে যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

Scroll to Top