৫। জগন্নাথ হলে পাকবাহিনীর গণহত্যার উপর কয়েকটি প্রতিবেদন (৩৩৫-৩৪৮)

সূত্র – দৈনিক পূর্বদেশ, ফেব্রুয়ারি ১৯৭২

হানাদারদের কবলে জগন্নাথ হল-১

পঁচিশের সেই ভয়ংকর রাতে তিনি একটানা ১৯ ঘণ্টা ম্যানহোলে ছিলেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ হল। সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। পাশেই গোয়াল। এর নিকটে ম্যানহোলে একটানা ১৯ ঘণ্টা আত্মগোপন করে থেকে তিনি আত্মরক্ষা করেছেন। নিজেকে রক্ষা করেছেন হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলা থেকে। ম্যানহোল পুতি দুর্গন্ধময়। মাঝে মাঝে তার দম বন্ধ হয়ে যেতো। মাথা ঝিমঝিম, পা রিরি করতো। উপায় নেই বেরুবার। অবিরাম গোলাগুলির শব্দ। মানুষের আর্তনাদ, কান্নার শব্দ সবই তার কানে ভেসে আসছিল।

একটু পরপর কিছু সময় অন্তর অন্তর ম্যানহোল থেকে কোন রকমে গলাটুকু পর্যন্ত বের করে তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েছেন। এক পলক দেখে নিতে চেষ্টা করেছেন ম্যানহোলের বাহিরের দুনিয়াটাকে, যখন তখন বীভৎস হত্যালীলা চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সাধারণ সম্পাদক শ্রী পরিমল গুহ আমার কাছে ২৫শে মার্চের ভয়াল ভয়ঙ্কর রাত্রের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন।

তিনি এই দুঃস্বপ্নের রাতের একজন সাক্ষী হয়ে ছিলেন। ম্যানহোলে কোন রকমে ঢুকে পড়ে মৃত্যুপুরীর নিশ্চিত পরিমাণ থেকে নিজেকে অনেকটা অলৌকিকভাবে রক্ষা করেছেন। তিনি বলেছেন ২৫শে মার্চ রাতে প্রায় ১১টার দিকে আমি প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রথীন রায়ের লক্ষীবাজারস্থ বাসা থেকে হলে ফিরি। তখনো হানাদার সামরিক বাহিনীর লোকেরা হামলা শুরু করেনি। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে বেরিকেড তৈরী করেছেন। গাড়িগুলো ক্ষীপ্র গতিতে চলাচল করছে। রথীনদার বাসা থেকে রাস্তায় পা বাড়াতেই লোকজন আমায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় যাবেন। আমি জগন্নাথ হলে যাব শুনে সবাই আমাকে যেতে নিষেধ করলেন। বললেন, শহরের অবস্থা খুব উত্তপ্ত, যে কোন সময় সামরিক বাহিনী নামতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাই হবে এদের প্রধান লক্ষ্যস্থল।

আপনি যাবেন না, শ্রী পরিমল গুহ বলেছেন। লোকজনের কথা শুনে আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। ভাবলাম রাত্রে হলে ফিরব না। হলে তখন অনেক ছাত্র। হলে অবস্থানরত ৬০/৭০ জন ছাত্রের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। তাদের কথা ভেবে আমি হলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মরলে সবাই একসাথে মরবো আর বাঁচলে সবাই একসাথে বাঁচবো। ওদেরকে ওভাবে ফেলে আমি নিজের প্রাণ রক্ষাকে বিরোধী ভেবে হলে ফিরি।

রাত্র তখন পুরো ১১টা। চারিদিকে থমথমে ভাব। গাড়ি ঘোড়া চলাচল বন্ধ। নিরব নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছে দূর থেকে গগনবিদারী শ্লোগান “জয় বাংলা, বাঙালী জেগেছে- বাঙালী জেগেছে”। হলের ছাত্ররা হলের গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত! কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই অজানা আশংকায় শঙ্কাগ্রস্ত।

আমি তাদেরকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম। আমার কথায় কেউ বিশ্বাস করলোনা। কেউ বললেন আমাদের উপর হামলা করার কোন কারন নেই। এর প্রায় ২৫ জন ছাত্র বাহিরে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবার জন্য তৎক্ষণাৎ হল ত্যাগ করলেন। জানিনা তারা এখন কোথায়? সত্যিই কি নিরাপদ হতে পেরেছিলেন, না হানাদারদের লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন। আমাদের হলে পাকবাহিনী আক্রমণ করে রাত সাড়ে বারটায়। এর আগেই আমরা চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ পাচ্ছিলাম।

সেদিন আমরা রাইফেলের গুলির শব্দ শুনিনি। শুনেছিলাম মেশিনগান, মর্টার শেলিং ও মাঝে মধ্যে ট্যাঙ্কের প্রচন্ড শব্দ। সৈন্য প্রবেশের আগে আমরা যারা হলে ছিলাম তাদের মধ্যে কেউ কেউ হলের ছাদে উঠলো, কেউ কেউ সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে, আবার কেউ কেউ নিজেদের রুমেই আত্মগোপন করার চেষ্টা করলো আমি পিছনের দিকের ড্রেনের মধ্য দিয়ে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের দিকে গেলাম।

হানাদার সৈন্যরা তখন হলে ঢুকে পড়েছে। আমি দেখলাম তারা প্রতিটি রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। আমার কানে গুলির শব্দ পৌঁছাচ্ছিল। আমি পিছনের দিক দিয়ে বেরুলাম। ধীরে ধীরে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের ড্রেনের দিকে এগিয়া গেলাম। হানাদার সৈন্যরা হলে ঢুকে পড়েছে। আমি তখনো ম্যানহোলে ঢুকে পড়িনি। দেখলাম সৈন্যরা তন্ন তন্ন করে প্রতিটি রুম খুঁজছে।

হলে বাতি নেই। হল আক্রমণের আগেই বিদ্যুৎ যোগাযোগ ছিন্ন করে দিয়েছিল ওরা। তবুও দেখছিলাম ছাত্রদের ধরে বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ত, কখনো বেদম প্রহার করতো, আবার কখনো ধরে নিয়ে আসতো। এর মাঝেই কাছ থেকে গুলির শব্দ কানে আসলো। গুলির শব্দে আমার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। এর পরে আমি ম্যানহোলে ঢুকি। তখন রাত প্রায় ১টা।

২৬শে মার্চ। সকালে ভোরের সূর্য উঠলো। আমি ম্যানহোলে। সারাদিন ম্যানহোলে থাকলাম। সারাদিন আমার কানে শুধু গোলাগুলি আর মানুষের আত্মকান্না ভেসে আসছে বা এসেছে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। আর পারা যায়না। ১৯ ঘণ্টা পর আমি প্রাণ হাতে নিয়ে রাস্তায় গুনে গুনে পা বাড়াই। দেওয়াল টপকিয়ে নিকটবর্তী স্টাফ কোয়ার্টারে যাই। প্রফেসর সন্তোষ ভট্টাচার্যের বাসায় আশ্রয় নেই।

-দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২

হানাদারদের কবলে জগন্নাথ হল-২
।। হোসেন তওফিক ।।

জগন্নাথ হলে পাকিস্তান হানাদার সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণ শুরু হয় ২৫শে মার্চ রাত্র সাড়ে বারটায়। ছাত্ররা দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পারলেন আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করলেন। ক’জন দল বেঁধে ছাদে উঠলেন, কেউ কেউ নিজের কক্ষেই আত্মগোপন করার চেষ্টা করলেন, দু’একজন সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের দিকে গেলেন। জগন্নাথ হল। নর্থ হাউজ। ২৯ নং কক্ষ। কক্ষে দুজন ছাত্র থাকতেন। হরিধর ও সুনীল দাস। ২৫শে মার্চ সুনীলের একজন অতিথি এসেছিলেন। পরিমল বললো পাকিস্তানী হিংস্র হানাদারেরা নর্থ হাউজে আক্রমণ চালিয়ে প্রথমেই ঢুকলো ২৯ নং কক্ষে।

তিনজনই তখন রুমে উপস্থিত। পাকিস্তানী সৈন্যরা এত হিংস্র হতে পারে তারা তা ধারণা করেননি। তাই সরল বিশ্বাসে তারা নিজেদের রুমটাকেই সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় ভেবেছিলেন। সৈন্যরা তিনজনকে পেয়ে গেল। শিকার ধরতে পেরে এই পশু সৈন্যদের সে কী উল্লাস, সে কী আনন্দ! পরিমল গুহ বললেন, হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। সৈন্যরা সার্চলাইট সাথে এনেছিল। তিনজনকে একত্রে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ করলো তারা। একত্রে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। এরপর সৈন্যরা রুমে একটা গ্রেনেড ছুড়ে মারলো।

পাছে যদি কেউ কেউ বেঁচে যায়! ব্রাশে সুনীল ও তার অতিথি মারা গেলেন। সুনীলের খবর নিতে এসে তিনি নিজেই নরপশুদের থাবায় প্রাণ বিসর্জন দিলেন। হরিধরের গায়ে গুলি লাগেনি। মেশিনগানের গুলির শব্দে তিনিও অপর দুজনের সাথে পড়ে গিয়েছিলেন মেঝেতে। কিন্তু গ্রেনেড লাগলো তার পায়ে। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হলেন। পরিমল গুহ বললেন, গ্রেনেড ছুড়েই হানাদার সৈন্যরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, তারা ভেবেছিল সবাই শেষ। কেউ মেশিনগানের গুলি এবং এর পরেই গ্রেনেড চার্জে বাঁচতে পারেনা। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন হরিধর। তার পা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছিল। নিজের তাজা টকটকে লাল রক্তের ধারা নিজেই চেপে ধরে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রক্ত বন্ধ করতে পারেননি।

হরিধর কক্ষে বসে পাহারা দিচ্ছিলেন তার বন্ধু সুনীল আর তার অতিথির মৃতদেহ। কক্ষে রক্তের স্রোত, বেরোবার উপায় নেই। হিংস্র হায়েনার দল এ কক্ষে সে কক্ষে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যাদেরকে পেয়েছে তাদেরকেই হত্যা করেছে। হরিধর বিস্ময়ে বিমূঢ়। তার চেতনাশক্তি লোপ পাবার উপক্রম। হতবাক হয়ে বসে রয়েছেন। চিন্তা করছেন হরিধর, সুনীল ও তার অতিথি এবং অপরাপর ছাত্রদের শোচনীয় পরিনতির কথা। তিনি চিন্তা করছেন। খেই হারিয়ে যাচ্ছে তবুও ছিন্তা করছেন। হঠাৎ মনে পড়লো তার কক্ষে কয়টি শিক ভাঙ্গা। চেষ্টা করলে হয়তো বেরোনো যাবে মৃত্যুপুরী থেকে এ পথে।

তখন শেষরাত। হলের ভিতরে গোলাগুলির আওয়াজ কমে গেছে। হরিধর চেষ্টা করলেন। পাইপ বেয়ে নিচে নামলেন। কিন্তু নিরাপদ স্থান কোথায়। ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে এগুলেন তিনি পুকুরের দিকে। তখনো তার পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। তবে রক্তের বেগ কমে গেছে। প্রায় পানির সাথে মিশে তিনি পুকুরের পাড়ে ঘাসের মধ্যে আশ্রয় নিলেন। এরপর এখান থেকে তিনি আর সরেননি। মার্চ সকাল পর্যন্ত হরিধর এ অবস্থায় কাটিয়েছিলেন।

সকালে কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। জনৈক দোকানী এ পথে যাবার সময় অর্ধমৃত হরিধরকে দেখতে পান। তিনি হরিধরকে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। বেশ কয়েকদিনের চিকিৎসার পর হরিধর সুস্থ হয়ে ওঠেন।

-দৈনিক পূর্বদেশ, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২

হানাদারদের কবলে জগন্নাথ হল-৩

২৫জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র একজন ছাড়া কেউ এদের ক্রুদ্ধ ছোবল থেকে রক্ষা পান নি-
হলের ছাদে লাল টুকটুকে রক্তের স্রোত

তাদের বুকের সাইজ মিলিয়ে দাঁড় করানো হলো। কয়েকটা লাইন। প্রতি লাইনে তিনজন। তারপর “দ্রিম দ্রিম” শব্দ। মেশিনগানের গুলি। সবাই একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তারপর একটু নড়াচড়া করে মহান মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শে নীরব হয়ে গেলেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদের কথা বলছি। হানাদার পাকিস্তানী হায়েনার দল ২৫শে মার্চে শেষ রাতে হলের ছাদে আশ্রয় গ্রহণকারী বেশ কয়েকজন ছাত্রকে এমনিভাবে গুলি করে হত্যা করে।

শ্রী পরিমল গুহ বলেনঃ পাকিস্তানী নরপশুদের তান্ডব নৃত্য দেখে সত্য দাস, রবীন ও সুরেস দাস সহ জনা পঁচিশেক ছাত্র হলের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন আত্মরক্ষার জন্য। একমাত্র সুরেস ছাড়া আর কেউ ওদের ক্রুদ্ধ ছোবল থেকে রক্ষা পাননি। তিনি বলেছেন সুরেস একটু বেঁটে খাটো। বুকের সাইজ অন্যান্যদের সাথে তার মিল ছিলোনা। তাঁকে সবার পিছনে দাঁড় করানো হলো। তারপর গর্জে উঠলো মেশিনগান। সকলের বুক হানাদারদের মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো। হলের ছাদে লাল টুকটুকে রক্তের স্রোত বইলো। সুরেস বেঁটে খাটো, তার বুকে গুলি লাগেনি। লেগেছিলো তার কাঁধে। তিনিও সকলের সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ঠিক মৃতের মতো।

মৃতের মিছিলে জীবন্ত

মৃতের মিছিলে জীবন্ত সুরেস। আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নিতে গিয়েও সবাই মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পন করলেন; মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পারলেননা। কিন্তু শুধু বেঁচে রয়েছেন তিনি। বেঁচে রয়েছেন তিনি এই নির্মম হত্যাকান্ডের জীবন্ত সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে। পরিমল বললেন, সুরেসের কাঁধের মাংস উড়ে গেছে মেশিনগানের শক্তিশালী গুলিতে। অবিরাম ধারায় রক্ত ঝরছিল। ক্ষতস্থানে গায়ের জোরে চেপে ধরেও তিনি রক্ত বন্ধ করতে পারছিলেননা। নিজের শরীরের উষ্ণ রক্তে তিনি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন।

নিজের গায়ের টকটকে তাজা রক্ত অবিরাম ধারায় ঝরছে তো ঝরছেই। কিছুতেই বন্ধ হচ্ছেনা তার রক্তপাত, রক্তের বেগ কমছেনা। ব্যান্ডেজ করা দরকার। কিন্তু ব্যান্ডেজ করবেন কি দিয়ে। পরনের লুংগি আর গায়ের গেঞ্জি ছাড়া তো আর কিছুই নেই। লুংগি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে লুংগির ছেঁড়া টুকরো দিয়েই তিনি তৈরী করলেন ব্যান্ডেজ। ছাদের উপর সারিবদ্ধ তরুণদের মৃতদেহ। প্রহরীর মত তিনি জেগে আছেন একা।

রক্তের স্রোত। হলের ছাদ লাল রক্তে ভাসে গেছে। চারিদিক নীরব নিঝুম। শুধু গোলাগুলির শব্দ ও মানুষের আর্তকান্না ছাড়া আর কিছুই শোনা যায়না। পরিমল বলেই চলেছেনঃ মৃত্যুর পাশে বসে থাকার উপর তার ধিক্কার আসছিলো,আবার কখনো তার চোখের সামনে ভাসে উঠছিলো ভীড় জমানো ফেলে আসা স্বপ্ন, রঙ্গীন মধুময় হাজারো দিনের স্মৃতি।

আছড়ে আছড়ে কেঁদে সেসব স্মৃতি ফরিয়াদ জানাতো। স্মৃতির মিছিলে সুরেস নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন। হলের ছাদের উপর পানির ট্যাঙ্ক। হঠাৎ তার চেতনার উদয় হলো। সুরেস আর দেরী না করে পানির ট্যাঙ্কে ঢুকলেন। ২৬শে মার্চ পুরোদিন ও সারারাত তিনি পানিরট্যাঙ্কে কাটালেন আত্মগোপন করে। ২৭ তারিখ পানির ট্যাঙ্কে তার থাকা সম্ভব হচ্ছিলনা। ২৭ তারিখ ভোরের দিকে প্রাণ হাতে নিয়ে তিনি ভয়ে ভয়ে নামলেন ছাদ থেকে।

এগিয়ে গেলেন জগন্নাথ হলের উত্তর পাশের রাস্তার দিকে। সুরেস ভয়ে সোজা হননি। হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছিলেন। পরিমল গুহ তখন কারফিউ তুলে নেবার পর স্টাফ কোয়ার্টার থেকে এদিকের রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। পরিমলের সাথে দেখা হওয়ায় সুরেস প্রাণ ফিরে পেলেন। পরিমল গুহ পরে সুরেশকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দিয়ে আসেন। পরিমল ছাদের নারকীয় হত্যালীলার কাহিনী সুরেসের কাছ থেকে শুনেছেন।

-দৈনিক পূর্বদেশ, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২

হানাদারদের কবলে জগন্নাথ হল-৪

অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল নরপশুরা। অমানুষিক প্রহারের ফলে তারা তিনজন যখন প্রায় আধমরা তখন তাদের লাইন বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হলো-

২৬শে মার্চ সকাল ১১টা। হানাদার সৈন্যরা ৫ জনকে ধরে নিয়ে এলো হলের ভিতরে। তাদের দিয়ে বিভিন্ন কক্ষ, হলের ছাদ, বারান্দা থেকে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত লাশগুলো নিয়ে ট্রাকে তুললো। হলের মাঠে মাঝখানে আগে থেকেই একটি বিরাট গর্ত খুড়ে রাখা হয়েছিলো। লাশগুলো সেখানে নিয়ে এলো মাটিচাপা দেওয়ার জন্য। এই ৫ জনকেও সেখানে নিয়ে গেল। তারপর ঠিক গর্তের পারে তাদেরকে দাঁড় করিয়ে গুলি করলো। সবাই সাথে সাথেই লুটিয়ে পড়লো।

শ্রী পরিমল গুহ বললেন ২৬শে মার্চ সকালের কথা। তিনি তখনো ম্যানহোলে। স্বচক্ষে দেখেছেন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, বীভৎস দৃশ্য। তিনি বলেছেন, এই ৫ জনের মধ্যে তিনি কালীরঞ্জন শীলকে চিনতে পেরেছেন। আর কাউকে চেনা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাদের একত্রে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ করার পর হানাদার খুনীরা চলে গেল গাড়ি হাঁকিয়ে।

হয়ত তারা আরো শিকার ধরার জন্যই গেল। মাঠের গর্তের পারে রইল অগণিত নিষ্প্রাণ দেহ। হঠাৎ এই মৃতের স্তূপ থেকে একজন লোক উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালালো। পরিমল গুহ বললেন, আমি স্পষ্ট দেখলাম এই ভাগ্যবান ব্যাক্তি কালীরঞ্জন শীল।

জনৈক ইঞ্জিনিয়ারের স্যালুলয়েড ক্যামেরায় যার ছবি ধরা পড়েছে তিনি কালীরঞ্জন শীল। তিনি আবার ২৬শে মার্চ ভোরের কথা বললেন। খুব ভোরে হানাদার সৈন্যরা অধ্যাপক অনুদ্বেপায়ন ভট্টাচার্যকে ধরে নিয়ে আসে মাঠে। শ্রী ভট্টাচার্য হলেন একজন হাউজ টিউটর। এসেম্বলী বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষে থাকতেন। পরিমল গুহ দেখেছেন হলের ছাত্র বিধান রায় এবং অপর একজন লোককে তারা ধরে নিয়ে আসলো। শেষোক্ত ব্যাক্তির বেশভূষায় তাঁকে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বলে মনে হলো।

অধ্যাপক ভট্টাচার্যের পরনে ধুতি। তিনজনকে একত্র করা হলো। প্রহারের পালা। তারা তাদেরকে বুট দিয়ে লাথি দিচ্ছিলো, রাইফেলের বাট দিয়ে মারছিলো। বেদম প্রহার। তারা চিৎকার করছিলো, বিধান প্রহারের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে ছেড়ে দেবার কাকুতি করছিলেন। বারবার প্রার্থনা জানাচ্ছিলেন তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বিধানের কথাতে তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। নরপশু সৈন্যরা প্রহারের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দিলো।

অমানুষিক প্রহারের ফলে যখন তারা তিনজন প্রায় আধমরা হয়ে গিয়েছিলেন। তখন তাদেরকে লাইন করে দাঁড় করানো হলো। তারপর সেই পরিচিত মেশিনগানের শব্দ। তারা তিনজন এলিয়ে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। পরিমল গুহ বললেন তিনি ২৬শে মার্চ মাঠে মানবতার পূজারী প্রখ্যাত দার্শনিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ ডক্টর গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মৃতদেহ দেখেছেন। তার গা খালি ছিলো। সৈন্যরা তাঁকে উপুড় করে শুইয়ে রেখেছিলো মাটিচাপা দেবার জন্য।

-দৈনিক পূর্বদেশ, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২”

“জগন্নাথ হলের মাঠে ২৬শে মার্চের সকালে যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখেছি আমরা জানালা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে মুভি ক্যামেরায় তা ধরে রেখেছি”

যিনি টেলিভিশন ক্যামেরায় ধরে রেখেছেন ২৫শে মার্চের হত্যাকান্ডের হৃদয়বিদারক দৃশ্য সেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎকৌশলের অধ্যাপক ডঃ নূরুল উল্লার সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকার।

প্রশ্ন: আপনি কি ২৫শে মার্চের হত্যাকান্ডের ছবি নিজ হাতে তুলেছিলেন?
উত্তর: হ্যাঁ আমি জগন্নাথ হলের মাঠে ২৬শে মার্চের সকাল বেলা যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য ঘটেছিলো তার ছবি আমার বাসার জানালা থেকে টেলিস্কোপ ক্যামেরায় তুলেছিলাম।

প্রশ্ন: এ ছবি তোলার জন্য কি আপনার কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো, না এমনি হঠাৎ করে মনে হওয়াতে তুলে নিয়েছেন?
উত্তর: ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণের পর থেকে আমার একটা ধারণা হয়েছিলো যে এবার একটা বিরাট কিছু পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। তাই তখন থেকেই বিভিন্ন সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, মশাল মিছিল, ব্যারিকেড ইত্যাদির ছবি আমি তুলতে আরম্ভ করি।

প্রশ্ন: ক্যামেরাটি কি আপনার নিজস্ব?
উত্তর: না ওটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ভিডিও টেপ ক্যামেরা। ছাত্রদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনি ধরনের আরো বহু ক্যামেরা ও জটিল যন্ত্রপাতি রয়েছে।

প্রশ্ন: ক্যামেরাটি আপনার কাছে রেখেছিলেন কেন?
উত্তর: এর জবাব দিতে গেলে আমাকে আরো পেছনের ইতিহাস বলতে হয়। ইতিহাস কথাটা বলছি এজন্য যে এগুলো ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখা উচিৎ। ৭ই মার্চের পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কিছু ছেলে এসে আমাকে ধরলো,

স্যার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের যন্ত্রপাতি দিয়ে একটি অয়্যারলেস স্টেশন তৈরী করতে হবে।

আমি ওদের কথা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারলাম না। এর পরে ওরা একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কথা ঠিক করে আমাকে তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে নিয়ে গেলেন। আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর একেবারে ভিতরের এক প্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার পরে আমি দেখলাম সেখানে সোফার উপর তিনজন বসে রয়েছেন। মাঝখানে বঙ্গবন্ধু। তাঁর ডানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এ বাঁ পাশে তাজউদ্দিন সাহেব।

আমি ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে সালাম করলাম। ছাত্ররা আমাকে বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। যদিও অনেকবার তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি সোফা থেকে উঠে এসে আমাকে ঘরের এক কোণে নিয়ে গেলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে অত্যন্ত সন্তর্পণে বললেন,

নূরুল উল্লা আমাকে ট্রান্সমিটার তৈরী করে দিতে হবে। আমি যাবার বেলায় শুধু একবার আমার দেশবাসীর কাছে কিছু বলে যেতে চাই। তুমি আমায় কথা দাও, যেভাবেই হোক একটা ট্রান্সমিটার আমার জন্য তৈরী করে রাখবে। আমি শেষবারের ভাষন দিয়ে যাব।”

বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ তখন আমার কাছে বাচ্চা শিশুর আবদারের আবেগময় কণ্ঠের মত মনে হচ্ছিল। এর পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমাদের তড়িৎ কৌশল বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে খুলে বললাম। শুরু হল আমাদের কাজ। বিভাগীয় প্রধান ডঃ জহুরুল হকসহ প্রায় সকল শিক্ষকরাই আমাকে সহযোগীতা করতে লাগলেন। ৯ দিন কাজ করার পর শেষ হলো আমাদের ট্রান্সমিটার। এর ক্ষমতা বা শক্তি ছিল প্রায় সারা বাংলাদেশব্যাপী। শর্ট ওয়েভে এর শব্দ ধরা যেত। যাহোক পরবর্তী সময়ে এর ব্যবহার আসেনি। এরই সাথেই আমার মাথায় ধারণা এল, যদি কোন হত্যাকান্ড, অগ্নিসংযোগ বা গোলাগুলি হয় তাহলে তা আমি ক্যামেরায় তুলে ফেলব। এবং সে থেকেই ক্যামেরাটি আমার সাথে রাখতাম।

প্রশ্ন: আপনি কখন ছবি তোলা শুরু করেন?
উত্তর: রাত্রে ঘুমের মাঝে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে আমাদের সকলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। অবশ্য আমরা অতটা গুরুত্ব দেইনি। আমি ভেবেছিলাম যে আগের মতই হয়ত ছাত্রদেরকে ভয় দেখাবার জন্য ফাঁকা গুলী করা হচ্ছে। অথবা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের নির্দেশ ও সহযোগীতায় যে সমস্ত হাতবোমা তৈরী করছিল তারই দু’একটা হয়ত বিস্ফোরিত হয়েছে। সারাটা রাত একটা আতঙ্কের মধ্যে কাটালাম। জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে জগন্নাথ হলের দিকে তাকাতাম। কিন্তু সমগ্র এলাকাটা আগে থেকেই বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়াতে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। রাতে জগন্নাথ হলের এলাকায় কি হচ্ছিল কিছুই দেখতে পারলাম না। শুধু গোলাগুলির শব্দ শুনছিলাম। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে ওখানে দুপক্ষেই একটা ছোটখাট লড়াই হচ্ছে। সাথে সাথে আমার ক্যামেরাটার কথা মনে পড়ে গেল। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন সকাল হবে আর দিবালোকে আমি ছবি তুলতে পারবো।

প্রশ্ন: আপনি যে ক্যামেরা বসিয়েছিলেন তা কি বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিলনা?
উত্তর: এমনভাবে ক্যামেরা বসানো হয়েছিলো যে বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই। কারণ পর্দার আড়ালে এমনভাবে বসানো হয়েছিলো যে শুধু ক্যামেরার মুখ বের করা ছিলো। পুরো ক্যামেরাটা কালো কাপড় দিয়ে মোড়ানো ছিল। আমাদের জানালাগুলো এমনভাবে তৈরী যে বন্ধ করার পরেও ধাক্কা দিলে কিছুটা ফাঁক থেকে যায়। ঐ ফাঁক দিয়ে ক্যামেরার মুখটা বাইরে বের করে রাখলাম।

প্রশ্ন: ক্যামেরা চালু করেন কখন?
উত্তর: সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যবর্তী সময়ে। জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম যে জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে কিছু ছেলেকে ধরে বাইরে আনা হচ্ছে এবং তাদেরকে লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে, তখনই আমার সন্দেহ জেগে যায়। এবং আমি ক্যামেরা অন করি। আমাদের ক্যামেরাটির একটা বিশেষ গুন এই যে, এতে মাইক্রোফোন দিয়ে একই সাথে শব্দ তুলে রাখা যায়। তাই আমি টেপের সাথে মাইক্রোফোন যোগ করিয়ে ক্যামেরা চালু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম যে ছেলেগুলোকে একাধারে গুলী করা হচ্ছে ও একজন একজন করে পড়ে যাচ্ছে। পাকসেনারা আবার হলের ভিতর চলে গেলো। আমি ভাবলাম আবার বেরিয়ে আসতে হয়ত কিছু সময় লাগবে। তাই এই ফাঁকে আমি টেপটা ঘুরিয়ে আমার টেলিভিশন সেটের সাথে লাগিয়ে ছবি দেখতে লাগলাম যে ঠিকভাবে উঠেছে কিনা। এটা শেষ করতেই আবার জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম যে, আবার কিছু সংখ্যক লোককে ধরে নিয়ে এসেছে। আবার লাইন করে দাঁড় করানো হচ্ছে। আমি তখন পূর্বের তোলা টেপটা মুছে ফেলে তার উপর আবার ছবি তোলা শুরু করলাম।

প্রশ্ন: আপনি পূর্বের তোলা ছবিটার টেপ কেন মুছে ফেললেন?

উত্তর: আমার মনে হচ্ছিল আমার আগের ছবিতে সবকিছু ভালোভাবে আসেনি। আর নতুন ছবি তুলতে গিয়ে আমি হয়ত আরো হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য ধরে রাখতে পারব। আর হাতের কাছে আমার টেপ ছিলনা। মোট কথা আমি ঐ সমস্ত দৃশ্য দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেলাম। আজও দুঃখ করি যদি আমি নতুন টেপে ছবি তুলতে পারতাম তাহলে কত ভালো হতো। দুটো দৃশ্য মিলে আমার টেপের দৈর্ঘ্য বেড়ে যেতো। কিন্তু তখন এত কিছু চিন্তা করার সময় ছিলনা। যা হোক দ্বিতীয়বারের লাইনে দেখলাম একজন বুড়ো দাড়িওয়ালা লোক রয়েছে। সে বসে পড়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছে। আমার মনে হচ্ছিলো সে তাঁর দাড়ি দেখিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল যে সে মুসলমান। কিন্তু বর্বর পাক বাহিনী তাঁর কোন কথাই শুনতে চায়নি। তাকে গুলি করে মারা হলো। মাঠের অপর অর্থাৎ পূর্বপার্শ্বে পাক বাহিনী একটা তাবু বানিয়ে ছাউনী করেছিলো। সেখানে দেখছিলাম, ওরা চেয়ারে বসে কয়েকজন চা খাচ্ছে আর হাসি তামাসা ও আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ছে।

প্রশ্ন: লোকগুলোকে হলের ভিতর থেকে কিভাবে আনা হচ্ছিলো?
উত্তর: যাদেরকে আমার চোখের সামনে মারা হয়েছে ও যাদের মারার ছবি আমার ক্যামেরায় রয়েছে তাদেরকে দিয়ে প্রথমে হলের ভিতর থেকে মৃতদেহ বের করে আনা হচ্ছিল। মৃতদেহগুলি এনে সব এক জায়গায় জমা করা হচ্ছিলো। এবং ওদেরকে দিয়ে লেবারের কাজ করাবার পর আবার ওদেরকেই লাইনে দাঁড় করিয়ে এক সারিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মনে হচ্ছিলো একটা করে পড়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন: জমা করা মৃতদেহের সংখ্যা দেখে আপনার ধারণায় কতগুলো হবে বলে মনে হয়েছিলো?
উত্তর: আমার মনে হয় প্রায় ৭০/৮০ জনের মৃতদেহ এক জায়গায় জমা করা হয়েছিলো।

প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয় যে ওগুলো সবই ছাত্রদের মৃতদেহ?
উত্তর: আমার মনে হয় ছাত্র ছাড়াও হলের মালি, দারোয়ান, বাবুর্চি এদেরকে একই সাথে গুলি করা হয়েছে। তবে অনেক ভালো কাপড়চোপড় পরা বয়সী দেখে আমার মনে হয় তারা ছাত্রদের গেস্ট হিসাবে হলে থাকছিলো।

প্রশ্ন: আপনি কি দেখেছেন যে কাউকে গুলি না করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে?
উত্তর: না তবে লাইনে দাঁড় করাবার পরে যে খান সেনাটিকে গুলি করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছিলো সে তখন পিছনে তার অফিসারের দিকে মুহূর্তের জন্য তাকিয়েছিলো। আর এই ফাঁকে দু’জন লোক সামনে স্তূপ করা মৃতদেহগুলির মধ্যে শুয়ে পড়লো। আর বাকিগুলোকে গুলি করে মারা হলো। গুলি করে যখন খান সেনারা কয়েক ঘণ্টার জন্য এলাকা ছেড়ে চলে গেল সেই ফাঁকে ঐ দু’জন উঠে প্রাণভয়ে পালাতে লাগলো। পরবর্তীকালে তাদের একজন আমার বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলো। সে একজন ছাত্রের অতিথি হিসাবে হলে থাকছিলো। ঢাকায় এসেছিলো চাকরির ইন্টারভিউ দিতে।

প্রশ্ন: আপনি কি আপনার ইচ্ছা মতো সব ছবি তুলতে পেরেছিলেন?
উত্তর: না, আমি আগেই বলেছি যে আমি থেমে থেমে তুলছিলাম, পাছে টেপ ফুরিয়ে যায়। তাই আমি সব ছবি তুলতে পারিনি বলে আমারও ভীষণ দুঃখ হচ্ছে। কারণ পরে যখন বুলডোজার দিয়ে সব লাশগুলোকে ঠেলে গর্তে ফেলা হচ্ছিলো সে ছবি আমি তুলতে পারিনি। কারণ ওরা কিছুক্ষণের জন্য চলে যাবার পরপরই আমার পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমাকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো।

প্রশ্ন: আপনি কি টেপ সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন?
উত্তর: না আমি সাথে নেয়াটা আরো বিপদের ঝুঁকি বলে মনে করে বাসায়ই যত্ন সহকারে রেখে যাই। আর এ ঘটনা আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানত না। বাইরে নিয়ে গেলে হয়তো অনেকেই জেনে ফেলতো এবং আজকে এই মূল্যবান দলিল আমি দেশবাসীর সামনে পেশ করতে পারতাম না।

প্রশ্ন: আপনি কখন এই টেপ সবার সামনে প্রকাশ করলেন?
উত্তর: যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত আমার আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে। কখন কে জেনে ফেলে। কখন আমি ধরা পড়ে যাই বা কখন এটা এসে নিয়ে যায়। এমনি মানসিক যন্ত্রণায় আমি ভুগছিলাম। যাহোক দেশ স্বাধীন হবার পরে ১৭ই ডিসেম্বর-এর দিকে আমি আস্তে আস্তে প্রকাশ করলাম আমার এই গোপন দলিলের কথা এবং ২/৩ দিন পরেই এটা আমি সবাইকে জানালাম ও কয়েকদিন পরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও অন্যান্যদের এটা দেখালাম। এ খবর শুনে অনেক বিদেশী সাংবাদিক আমার কাছে বহু টাকার বিনিময়ে এই দলিলের অরজিনাল কপি অর্থাৎ আসল টেপ চাইলেন।

প্রশ্ন: আপনি কি রাজি হলেন?
উত্তর: আমার রাজি হবার প্রশ্ন ওঠে না। অরিজিনাল কপি আমি হারালে আমার দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : নির্যাতনের এক অধ্যায়

বাংলার মানস সন্তানকে বিনাশ করতে কুখ্যাত পাক সামরিক চক্র ও তাদের অনুগ্রহলোভী সহযোগীরা যে ব্যাপক চক্রান্তে লিপ্ত হয় তার অন্যতম নিদর্শন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্যাতন। ২৫শে মার্চ রাত্রির নির্বিচারে হত্যা থেকে শুরু করে কয়েক পর্যায়ে এই নির্যাতন সংঘটিত হয় এবং ক্রমেই তা এক সুসংহত রুপ লাভ করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন চিন্তার অনুসারী ও খুনি সরকারের তোষামোদবিরোধী প্রতিটি শিক্ষক তাদের রোষানলে পতিত হয় ও শেষ আঘাতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তাদের সবাইকে হত্যা করার এক পরিকল্পনা করা হয়।

কিন্তু বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষক আগেই দেশত্যাগ করায় ও পাক বাহিনীর আকস্মিক পরাজয় বরণে এই মহা পরিকল্পনার অংশবিশেষ মাত্র কার্যকরী হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্যাতনের একটি চিত্র নিচে দেওয়া গেল।

“মার্চ-এপ্রিলে যাদের হত্যা করা হয়”

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ও তার কাছাকাছি সময়ে যাদের হত্যা করা হয়েছিল তারা হলেন-
১। ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শন),
২। অধ্যক্ষ এ এন এম মনিরুজ্জামান (সংখ্যাতত্ত্ব),
৩। ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজী),
৪। ডঃ ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান),
৫। জনাব এ মুক্তাদির (ভূবিদ্যা),
৬। জনাব শরাফত আলী (অংক),
৭। জনাব এ আর কে খাদেম (পদার্থ বিদ্যা),
৮। শ্রী অনুদ্বেপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থ বিদ্যা),
৯। জনাব এম সাদাত আলী (শিক্ষা গবেষণা),
১০। জনাব এম এ সাদেক (শিক্ষা এ গবেষণা)।

“চাকুরী থেকে বরখাস্ত”

পাকিস্তানী হানাদারেরা কয়েকজন শিক্ষককে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে। তারা হচ্ছেন-
১। ডঃ এ বি এম হাবিবুল্লাহ (ইসলামের ইতিহাস),
২। ডঃ এনামুল হক (বাংলা)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কৃত হন-
১। ডঃ এনামুল হক ও
২। ডঃ কুদরত-ই-খুদা।

যাদেরকে গ্রেফতার করা হয় ও রমনা হাজতে, দ্বিতীয় রাজধানীতে অবস্থিত পিওডব্লিউ কেজ ও ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয় তারা হচ্ছেন-
১। ডঃ আবুল খয়ের (ইতিহাস),
২। জনাব রফিকুল ইসলাম (বাংলা),
৩। জনাব আহসানুল হক (ইংরেজী),
৪। জনাব সাদউদ্দিন (সমাজ বিজ্ঞান),
৫। জনাব শহিদুল্লাহ (অংক),
৬। জনাব রাশিদুল হাসান (ইংরেজী)।

যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারি করা হয় কিন্তু আত্মগোপন করে অথবা দেশ ত্যাগ করে বাঁচেন তারা হচ্ছেন-
১। ডঃ আহমদ শরিফ (বাংলা),
২। ডঃ ওয়াজিউর রহমান।

যাদের অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ সহ ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়-
১। জনাব আবদুর রাজ্জাক (রাষ্ট্র বিজ্ঞান)।
২। ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
৩। ডঃ সারওয়ার মুরশিদ (ইংরেজী)।

চাকুরী থেকে বরখাস্ত ও আটক রাখার আদেশপ্রাপ্ত-
১। ডঃ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (বাংলা)।

যাদেরকে সরকারীভাবে সাবধান করে দেয়া হয়-
১। অধ্যক্ষ মুনির চৌধুরী (বাংলা),
২। ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম (বাংলা),
৩। ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজী),

যে সমস্ত হাউজ টিউটরকে জেরার জন্য ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হয়-
১। জনাব গিয়াসউদ্দিন আহমদ (মহসিন হল),
২। জনাব জহুরুল হক (মহসিন হল)।

১৪ই ডিসেম্বর আল বদর কর্তৃক ধৃত হয়ে যারা নিহত হন-
১। অধ্যক্ষ মুনির চৌধুরী (বাংলা),
২। জনাব মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা),
৩। জনাব আনোয়ার পাশা,
৪। ডঃ আবুল খায়ের (ইতিহাস),
৫। মিঃ সন্তোষ ভট্টাচার্য (ইতিহাস),
৬। জনাব গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস),
৭। জনাব রাশিদুল হাসান (ইংরেজী),
৮। ডঃ ফয়জুল মহী (শিক্ষা ও গবেষণা)।

আল বদর যাদের খুঁজে পায়নি-
১। ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম (বাংলা),
২। ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজী),
৩। জনাব আহসানুল হক (ইংরেজী),
৪। জনাব সাদউদ্দিন (সমাজ বিজ্ঞান),
৫। ডঃ মনিরুজ্জামান মিয়া (ভূগোল),
৬। জনাব শহিদুল্লাহ (অংক),
৭। জনাব ওয়াকিল আহমদ (বাংলা),
৮। ডঃ আখতার আহমদ (শিক্ষা ও গবেষণা),
৯। জনাব জহুরুল হক (দর্শন),
১০। ডঃ এস ইসলাম (ইঃ ইতিহাস),
১১। ডঃ লতিফ (শিক্ষা ও গবেষণা)।

এদের অনুসন্ধান করা ছাড়াও এদের উপর হামলার প্রমাণ পাওয়া যায়। আলবদর সদস্য আসরাফুজ্জামান খানের ডাইরিতে (পূর্বদেশ, ১১ই জানুয়ারী, ১৯৭২)।

আলবদর আরো যাদের খোঁজ করেছিল, তারা হচ্ছেন-
১২। জনাব আবদুল হাই (দর্শন),
১৩। ডঃ এম আর তরফদার (ইঃ ইতিহাস),
১৪। জনাব রফিকুল ইসলাম (বাংলা),
১৫। ডঃ তরিমত হোসেন (ভূতত্ত্ব) ইত্যাদি।

যারা দেশ ত্যাগ করেন-
১। ডঃ সরোয়ার মুরশেদ (ইংরেজী),
২। ডঃ আনিসুর রহমান (অর্থনীতি),
৩। জনাব রহমান সোবহান (অর্থনীতি),
৪। ডঃ ওয়াহিদুল হক (অর্থনীতি),
৫। ডঃ মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
৬। ডঃ এ বি এম হাবিবুল্লাহ (ইঃ ইতিহাস),
৭। ডঃ অজয় রায় (পদার্থ বিদ্যা),
৮। জনাব নূর মোহম্মদ মিয়া (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
৯। ডঃ বেলায়েত হোসেন (পদার্থ বিদ্যা),
১০। ডঃ জিল্লুর রহমান খান (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
১১। জনাব আবদুল মান্নান চৌধুরী (বাণিজ্য),
১২। মিসেস সুলতানা সরওয়াত আরা (মনস্তত্ত্ব),
১৩। জনাব জয়নুল আবদীন (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
১৪। মিসেস রাজিয়া খান আমিন (ইংরেজী),
১৫। ডঃ ওয়াজিউর রহমান (শিক্ষা ও গবেষণা),
১৬। ডঃ রওনক জাহান (রাষ্ট্র বিজ্ঞান),
১৭। ডঃ জহুরুল আনোয়ার (ফলিত পদার্থ বিদ্যা),
১৮। শ্রী জয়কুমার সরোজী (পদার্থ বিদ্যা),
১৯। শ্রী দুর্গাদাস ভট্টাচার্য (বাণিজ্য),
২০। ডঃ এ টি রফিকুর রহমান (রাষ্ট্র বিজ্ঞান)।
২১। শ্রী রঙ্গলাল সেন (সমাজ বিজ্ঞান) ও আরো অনেকে।

-দৈনিক বাংলা, ৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২।

পঁচিশে মার্চে জগন্নাথ হলের সেই ভয়াল রাতের স্মৃতি
।। কালী রঞ্জন শীল ।।

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ দিনটির কথা ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রতি বছর মার্চ মাস আসে আর মনে পড়ে পঁচিশে মার্চের সে ভয়াল রাতটির কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের উপর পাক বাহিনীর বর্বর হামলার আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এখনও মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয়না। একি সত্যি, না স্বপ্ন, না কোন ঘোরের মধ্যে সে সময়টা কাটিয়েছি।

আমি থাকতাম জগন্নাথ হলের দক্ষিণ ভবনের দ্বিতলে, ২৩৫ নং কক্ষে। মার্চের শুরুতেই ঢাকা শহর উত্তপ্ত ছিল। ঘটনা প্রবাহ খুব দ্রুত গতিতে এগুচ্ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মানুষ নতুন নতুন খবর শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। শহরে নানা রকম জল্পনা-কল্পনার মধ্যে ঐ দিনটিও গড়িয়ে যাচ্ছিল। আমিও সমস্ত দিন মিটিং, প্যারেড মিছিল করে রাত ১১টার দিকে হলে ফিরলাম। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অল্পক্ষণের মধ্যে। হঠাৎ মাথার কাছাকাছি বোমার এক বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সজাগ হয়েই শুনি চতুর্দিকে শুধু গগনবিদারী টর টর পর শব্দ আর মাঝে মাঝে সে শব্দকে ছাপিয়ে গুর গুর গুরুম শব্দ এবং দালান কোঠা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিল হলের পুরান দালান বুঝি এক্ষুণি ভেঙে পড়বে। এমন গোলাগুলির শব্দ জীবনে শুনিনি, কল্পনাও করতে পারিনি। এই অবস্থার মধ্যে পড়ে প্রথমে একটু ঘাবড়িয়ে গেলাম। কি করা দরকার বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। সঠিক কিছুই স্থির করতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। নুয়ে নুয়ে দক্ষিণ দিকের সিড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠলাম। সেখানে সিঁড়ির কাছে আরো কয়েকজন ছাত্র জড়ো হয়েছিল আগেই। সুশীলকে খুঁজলাম। দেখলাম তিন তলার সিঁড়ির কাছে তার রুম তালা বদ্ধ। সুশীল ছিল আমাদের হলের সহ-সম্পাদক। পরে শুনেছি সে গোলাগুলির শুরুতেই মেইন বিল্ডিং (উত্তর ভবন)-এ চলে গিয়েছিল এবং সেখানে মারা গেছে। কেউ কেউ ছাদে ওঠার কথা বললো আমাকে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমি তিন তলার বারান্দা দিয়ে নুয়ে নুয়ে উত্তর দিকে লেট্রিন ও বাথরুমের কাছে গেলাম। দেখি উত্তর বাড়ীর সমস্ত আলো নিভানো। মিলিটারী হলে ঢুকে টর্চের আলোতে ছাত্রদের খুঁজে খুঁজে বের করে এনে সামনের মাঠে শহীদ মিনারের কাছে গুলি করে মারছে। এক একটা ব্রাশ ফায়ার করছিল আর চিৎকার করে কতগুলি তাজা প্রাণ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছিল। কেউ দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করতেই তাকে সে অবস্থায় গুলি করে মারছে। এখনও ভাবতে পারিনা। এ দৃশ্য এতো বাস্তব ও জীবন্ত, তবুও মনে হয় স্বপ্ন। মাঝে মাঝে দালানের উপর ভারী কামানের গোলাবর্ষণ হচ্ছে। কোন কোন স্থানে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। এক সময় এসেম্বলির সামনে ডাইনিং হলটি জ্বলতে দেখলাম। উত্তর বাড়ীর কয়েকটি রুমেও আগুন দেখলাম। মাঝে মাঝে উপর থেকে নীচে সবুজ ও লাল রঙের আলোর গোলা নামতে দেখছি। তখন চতুর্দিক আলোকিত হয়ে উঠছিল। আর সেই আলোতে দেখা গেল উত্তর বাড়ীর সামনের মাঠে শত শত মিলিটারী মেশিনগান ও ভারী কামানের গোলাগুলি বর্ষণ করছে নির্বিচারে।

এক সময় দেখলাম এক একটি গাড়ির বহর হেড লাইট বন্ধ করে থেকে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ থেকে আবার চলে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ দেখে নিচ্ছে ঠিক ঠিক গুলি হচ্ছে কিনা, মানুষ মরছে কিনা। হঠাৎ এক সময় দেখা গেল সলিমুল্লাহ হলের দিক থেকে ৪০/৫০ জন মিলিটারী দক্ষিণ বাড়ীর ঘরের দিকে এলো এবং দরজা ভেঙে খাবার ঘরে ঢুকল। খাবার ঘরের আলো জ্বালল এবং এলোপাতাড়ি জানালা কবাটের উপর গুলি ছুড়তে লাগলো। কয়েকজন চিৎকার করে মারা গেল বুঝতে পারলাম। এক সময় দক্ষিণ বাড়ীর দারোয়ান প্রিয়নাথ বেরিয়ে এলো মেশিনগানের মুখে। তাঁকে দিয়ে মেইন গেট পশ্চিম দিক দিয়ে খুলিয়ে ঢুকে পড়লো হলের মধ্যে। তখন আর আমি মিলিটারীদের দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি প্রথমে লেট্রিনে ও সেখান থেকে জানালা পেরিয়ে তিন তলার কার্ণিশে গেলাম ও শুয়ে পড়লাম। সেখানে কয়েকটি শাল গাছ ছিল। একটি মোটা ডাল (শাখা) কার্ণিশের কাছে নুয়ে ছিল। একবার ভাবলাম গাছে উঠি। শেষ পর্যন্ত গাছে না উঠে কার্নিশে শুয়ে থাকলাম। হলের মধ্যে তখন শুধু গুলির শব্দ আর চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। একতলা, দোতলা করে এভাবে ওরা তিনতলায় উঠল বুঝলাম। এক সময় আমার কাছেই কয়েকটি গুলির শব্দ হলো। আমার মাথা সোজা দেয়ালের বিপরীত দিকে একটা লোক গোঙাচ্ছে শুনতে পেলাম। আমি তখন ভাবছি কখন আমাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসে। কিন্তু আমাকে ওরা দেখেনি বুঝতে পারলাম। বুঝলাম ওরা নেমে গেলো। নিচ থেকে ‘ফরিদ’ বলে ডাক দিলো। একজন সৈন্য সাড়া দিয়ে দৌড়ে নেমে গেল। যেভাবে ছিলাম সেভাবে শুয়ে থাকলাম কিছু সময়। একসময় কার্নিশ থেকে উঠে আবার লেট্রিনে ঢুকলাম এবং সেখান থেকে উত্তর বাড়ী, তার সামনের মাঠ ও সলিমুল্লাহ হলের যে অংশ দেখা যাচ্ছিল সেখানে তাণ্ডবলীলা দেখতে লাগলাম আর কখন এসে আমাকে ধরে নিয়ে গুলি করবে সেই মুহূর্ত গুনতে লাগলাম।

এক সময় দেখা গেল সলিমুল্লাহ হলের দিকে আগুন। সলিমুল্লাহ হলের দক্ষিণ পূর্ব কোণের বড় একটি গাছে আগুন জ্বলতে দেখলাম। মাঝে মাঝে উত্তর বাড়ীর পশ্চিম দিকের আকাশ লাল হয়ে উঠছিল। আর বুঝতে পারছিলাম ঐদিকের কোথাও আগুন লাগিয়েছে পাক সেনারা। বাইরের মতো হলের মধ্যেও চললো সমস্ত রাত গোলাগুলি আর আগুন।

এক সময় কোন এক দিকে আজানের শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আরো কয়েকদিকে আজান শোনা গেল। মনে হলো আজানের এমন করুণ সুর এত বিষন্ন সুর আর কোনদিন শুনিনি। গোলাগুলির শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু বন্ধ ছিল মুহূর্তের জন্য মাত্র। আবার চললো গোলাগুলি পুরোদমে। ভোরের দিকে মাইকে কারফিউ জারির ঘোষণা শুনলাম। তখন ভাবলাম বেলা হলে বোধহয় এমন নির্বিচারে আর মারবে না। কিন্তু একটু ফর্সা হয়ে যেতেই দেখা গেলো এখানে সেখানে পালিয়ে থাকা ছাত্রদের ধরে এনে গুলি করছে। যেন দেখতে না পায় আমাকে এভাবেই মাথা নিচু করে লেট্রিনের মধ্যে বসে রইলাম।

বেলা হলো। এক সময় আমার কাছাকাছি বারান্দায় অনেকের কথা শুনতে পেলাম। ছাত্ররা কথা বলছে তা নিশ্চিত হয়ে আমি লেট্রিনের দরজা খুলে বেরুলাম। বেরিয়ে দেখি সিঁড়ির মাথায় মেশিনগান তাক করে মিলিটারী দাঁড়িয়ে আছে আর কয়েকজন ছাত্র একটি লাশ ধরাধরি করে নামাবার চেষ্টা করছে। রাতে আমার মাথার কাছে ও দেওয়ালের ওপাশে যে গোঙাচ্ছিল এটা তারই লাশ। এবং সে আর কেউ নয়, আমাদের হলের দারোয়ান, সবার প্রিয় প্রিয়নাথদা। তাঁকে দিয়ে মেশিনগানের মুখে সব পথ দেখে নিয়ে নামার মুহূর্তে এখানে গুলি করে রেখে গেছে। আমিও আর নিষ্কৃতি পেলাম না।

আমাকেও ধরতে হলো লাশ। তিনতলা থেকে দোতলা, সেখান থেকে একতলা, দক্ষিণ দিকের ভাঙা গেইট দিয়ে ব্যাংকের (এখন যেটা সুধীরের কেন্টিন ওটা ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান) উত্তর পাশে নিয়ে রাখলাম। আরো লাশ জড়ো করা হলো সেখানে। ওখানে আমাদের বসার নির্দেশ দিলো একজন পাক সেনা।

তখন ছিলাম আমরা কয়েকজন ছাত্র, কয়েকজন মালী, লন্ড্রির কয়েকজন দারোয়ান, গয়ানাথের দুই ছেলে শংকর ও তার বড় ভাই, আর সবাই ছিল সুইপার। লাশগুলোর পাশ ঘিরে আমরা সবাই বসে ছিলাম। সুইপার গুলো তাদের ভাষায় মিলিটারীদের কাছে অনুরোধ করছিলো ওদের ছেড়ে দেয়ার জন্য। বলছিল ওরা বাঙালী নয়। সুতরাং ওদের কি দোষ? একজন মিলিটারী হয়ে বসতে বললো আমাদের কাছ থেকে। ওদের নিয়ে কয়েকজন মিলিটারী সোজা উত্তর বাড়ী মাঠে চলে গেল। ভাবলাম ওদের ছেড়ে দেবে। আমাদের আবার ঐ লাশগুলো বহন করতে আদেশ দিলো। লাশগুলি নিয়ে অ্যাসেম্বলির সামনের রাস্তা দিয়ে সোজা পূর্ব দিকের গেটের বাইরে চলে গেলাম। গেটের বাইরে দক্ষিণ পাশে একটি বড় গাছের গোড়ায় জড়ো করলাম লাশগুলো। এই সময় আমাদের সাথে প্রায় সমান সংখ্যক মিলিটারী ছিল। এবং তারা সবাই ছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। ওখানে যেয়ে মিলিটারী দাড়ালো অনেকক্ষণ। একজন সিগারেট বের করে দিলো সবাইকে। আমাদের কেউ বসে, কেউ শুয়ে থাকলো। আমিও কাত হয়ে ছিলাম গাছের শিকড়ের উপর। এখানে পাক সেনারা আমাদের উদ্দেশ্যে বিশ্রী ও অকথ্য ভাষায় ক্রমাগত গালাগালি করছিলো। যতটা বুঝতে পারছিলাম তাতে বুঝলাম, শালা! বাংলাদেশ স্বাধীন করিয়ে দেবো; বল শালারা জয় বাংলা। শেখ মুজিবকেও বাংলাদেশ স্বাধীন করিয়ে দেবো। আরো নানা অশ্লীল গালাগালি দিচ্ছিল। এ সময় একটি গাড়ীর বহর রেসকোর্সের দিক থেকে এসে ওখানে থামল। আমাদের সাথের মিলিটারীর একজন সামনের একটি জীপের কাছে গেলো। তাঁকে কিছু নির্দেশ দেয়া হলো বুঝলাম।

সেখান থেকে আমাদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন দিকে নিয়ে গেলো লাশ বয়ে আনতে। আমাদের অংশটিকে নিয়ে গেলো ডঃ গুহ ঠাকুরতা যে কোয়ার্টারে থাকতেন সেইদিকে। সেই বিল্ডিং-এর সিঁড়ির কাছে অনেকগুলি লাশ পড়েছিল, সিঁড়ির কাছে এনে গুলি করেছে বোঝা গেলো। একটি লাশ দেখলাম সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরা, মাথায় টুপি, পাতলা চেহারা। সেখান থেকে নিয়ে গেলো দোতলা, তিনতলা ও চারতলায় লাশ বয়ে আনতে। প্রতিটি তলায় ওরা খোঁজ নিচ্ছিল কোন জীবিত প্রাণী আছে কিনা। আর খুঁজছিলো দামী মালামাল, ঘড়ি, সোনাদানা ইত্যাদি। চারতলায় একটি রুমে ঢুকতে পারছিল না। কারন রুমের দরজা বন্ধ ছিলো ভিতর থেকে। দরজা ভেঙে ফেললো ওরা। ঢুকে কাউকেই পাওয়া গেল না। কতগুলি এলোমেলো কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্র ছাড়া কিছুই ছিলনা সেখানে। একজনকে ছাদে উঠে কালো পতাকা ও স্বাধীন বাংলার পতাকা নামাতে বলল। নিচে নামলাম আমরা। সিঁড়ির কাছে লাশগুলি নিতে বললো। অনেক লাশ রাস্তায় আগেই জমা করা ছিলো। বয়ে আনা লাশগুলিও জড়ো করলাম এগুলির পাশে। পরে নিয়ে গেলো বিল্ডিং-এর সামনে দোতলা বাংলো বাড়িটিতে (তখনকার এস এম হলের প্রভোস্টের বাড়ী)। সামনে দিয়ে ঢুকতে না পেরে পিছন দিয়ে ঢুকলাম ঐ বাড়িতে। নিচতলা, দোতলার সবগুলি রুমেই খুঁজলাম। এলোমেলো কাপড়-চোপড়, সুটকেস, বাক্স, খোলা ফ্যান ছাড়া কিছুই দেখা গেল না সেখানে। মিলিটারীরা দামী জিনিসপত্র খুঁজে খুঁজে নিয়ে নিলো। কোন লাশ কিংবা রক্তের দাগ ছিল না ঐ দালানে। নেমে আসলাম আমরা সবাই এবং জড়ো হলাম আবার লাশের কাছে। মিলিটারীরা কালো পতাকা ও স্বাধীন বাংলার পতাকা পোড়ালো।

আমাদের আবার লাশ নিতে বললো। রাস্তা দিয়ে সোজা উত্তর দিকে অধ্যাপক গোবিন্দ দেবের বাসার সম্মুখ দিয়ে ইউওটিসি বিল্ডিংয়ের সামনের জগন্নাথ হলের মাঠের পূর্ব দিকের ভাঙা দেওয়াল দিয়ে ঢুকতে বললো। হলের মেইন বিল্ডিংয়ের সামনে শহীদ মিনারের সংলগ্ন লাশগুলির কাছে জড়ো করতে লাগলাম লাশগুলি। লাশ যখন নিচ্ছিলাম তখন দেখলাম ডঃ দেবের বাসা থেকে বের করে নিয়ে আসছে সেলাই মেশিন ও অন্যান্য ছোটখাট জিনিষ। রাস্তার তিন মাথায় অনেকগুলি মর্টার চতুর্দিকে তাক করে রেখেছিলো।

দুজন তিনজন করে আমরা এক একেকটা লাশ বহন করছিলাম। কোন জায়গায় বসলে কিংবা ধীরে হাঁটলে গুলি করার জন্য তেড়ে আসছিলো। সব সময়ই আমরা গা ঘেঁষে বসছিলাম ও চলছিলাম।

কতগুলো লাশ এভাবে বহন করেছি মনে নেই। শেষ যে লাশটা টেনেছিলাম তা ছিলো দারোয়ান সুনীলের। তার শরীর তখনো গরম ছিলো। অবশ্য রৌদ্রে থাকার জন্যও হতে পারে। লাশ নিয়ে মাঠের মাঝামাঝি যেতেই হঠাৎ কতগুলি মেয়েলোক চিৎকার করে উঠলো। দেখি মাঠের দক্ষিণ দিকের বস্তিটির মেয়েছেলেদের মাঠের দিকে দাঁড় করিয়েছে গুলি করার জন্য। এইসব সুইপারদেরই ব্যাংকের কাছে আমাদের থেকে আলাদা করে মাঠে নিয়ে এসেছিলো ওরা। সুইপারদের গুলি করে মারছে আর ঐ মেয়েছেলেরা চিৎকার করছে এবং ছুটে যেতে চাচ্ছে ওদিকে। বুঝলাম এবার আমাদের পালা। আমাদের আগে যারা লাশ নিয়ে পৌঁছেছিলো তাদেরও দাঁড় করিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন খুব জোরে জোরে শব্দ করে কোরআনের আয়াত পড়ছিলো। ব্যাংকের কাছে যখন বসেছিলাম তখন জেনেছি এই ছেলেটি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। কিশোরগঞ্জে ছিল তার বাড়ী। আগের দিন বিকালে আরেক বন্ধু সহ এসে উঠেছিল তার হলের এক বন্ধুর রুমে। গুলি করলো তাদের সবাইকে। আমরা কোন রকমে দুজনে লাশ টানতে টানতে নিয়ে এসেছি। সামনেই দেখি ডঃ গোবিন্দ দেবের মৃতদেহ। ধুতি পরা, খালি গা। ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত সারা শরীর। পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার সাথে যে ছেলেটি লাশ টানছিল সে গোবিন্দ দেবের লাশটি দেখে বললো ‘দেবকেও মেরেছে! তবে আমাদের আর মরতে ভয় কি?’ কি ভেবে, আমি দেবের লাশের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে সুনীলের লাশ সহ শুয়ে পড়লাম। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা তখন আমার ছিল না। চোখ বুজে পড়ে থেকে ভাবছিলাম এই বুঝি লাথি মেরে তুলে গুলি করবে।

এক সময় ভাবছিলাম তবে কি আমাকে গুলি করেছে, আমার তখন অনুভুতি নেই। কি হচ্ছিলো বুঝতে পারছিলাম না। এই মড়ার মতো অবস্থায় কতক্ষণ কেটেছে বলতে পারিনা। এক সময় আমার মাথার কাছে মেয়েছেলেদের ও বাচ্চাদের কান্না শুনতে পেলাম। চোখ খুলে দেখি সুইপার, দারোয়ান ও মালীদের বাচ্চারা ও মেয়েছেলেগুলি মৃত স্বামী কিংবা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে। তখনো অনেকে মরেনি। কেউ পানি চাচ্ছে, তাদেরকে কেউ কেউ পানি খাওয়াচ্ছে। এই সময় দেখলাম কে একজন গুলি খেয়েও হামাগুড়ি দিয়ে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাথা তুলে দেখি যেদিকে মিলিটারীর গাড়ি ও অসংখ্য মিলিটারী ছিলো সেদিকে কোন গাড়ি বা মিলিটারী নেই। চতুর্দিকে এক নজর দেখে নিয়ে মেয়েছেলে ও বাচ্চাদের মধ্য দিয়ে নুয়ে নুয়ে বস্তির মধ্যে গেলাম। প্রথমে গিয়ে ঢুকি চিৎবালীর ঘরে। চিৎবালী ঘরে ছিল না। এক মহিলা ভয়ে কাঁপছিল। তাঁর কাছে পানি খেতে চাইলে সে একটি ঘটি দেখিয়ে দিলো। পানি খেয়ে ঘরের কোণে যে ঘুঁটে ছিল তার নিচে লুকিয়ে থাকতে চাইলাম। মহিলাটি আমাকে তক্ষুণি সরে যেতে বললো। তখন আমি বস্তির পাশের লেট্রিনে ঢুকে পড়ি।

এই সময়ে রাজারবাগের দিকে গোলাগুলি হচ্ছিলো। এক একটা প্রচন্ড শব্দ। থেমে থেমে গোলাবর্ষণ হচ্ছিলো। একটু বাদেই দু’টি প্লেন উড়ে গেলো বুঝতে পারলাম। এভাবে অনেকক্ষণ কাটালাম সেখানে।

এক সময়ে একটা লোক এসে লেট্রিনের দরজা নাড়া দিল। দরজায় নাড়া শুনে ভাবলাম এইবার শেষ। মিলিটারী নিশ্চয় এসেছে। খুলে দেখি একটি লোক, মিলিটারী নয়। লোকটি বললো তার নাম ঈঁদু। পুরোনো বই বিক্রি করে রাস্তার ওপারে। বললো, হলে এসেছিল মেয়েদের মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আমি আছি শুনে আমাকেও নিয়ে যাবে। প্রথমে যেতে চাইনি। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। বললো, সে সাথে যাবে। রাস্তা এখন পরিষ্কার- কেননা মিলিটারী নেই। গায়ে সেই চাপ চাপ রক্ত নিয়ে ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। বকশি বাজারের কাছ দিয়ে যেতে দেখি ওদিকে কোন মিলিটারী যায়নি। অনেকে ওজু করছে নামাজ পড়ার জন্য। সেদিন ছিলো শুক্রবার এবং জুমার নামাজের সময়।

ঈঁদু আমাকে জেলখানার পাশ দিয়ে বুড়িগঙ্গার পাড়ে নিয়ে গেলো। এক মাঝিকে অনুরোধ করায় নদী পার করে দিলো। নদীর ওপারে দেখা হলো আমাদের হলের এক প্রাক্তন ছাত্র সুনির্মল চৌধুরীর সাথে। সে নিয়ে গেলো তার কর্মস্থল শিমুলিয়া। সেখান থেকে প্রথমে নবাবগঞ্জ ও পরে নিজ গ্রাম বরিশালের ধামুরাতে চলে যাই।

সে ভয়াল রাতে জগন্নাথ হলে যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল এখন সে দৃশ্য কল্পনা করলে আমার সমস্ত মানবিক অস্তিত্ত্ব মুহূর্তে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এখনো আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারিনা… আমি বেঁচে আছি। একি সত্যি! ভাবতে গেলে তখন সবকিছু যেন তছনছ হয়ে যায়। সব কিছুই স্বপ্নের মতো মনে হয়। আমি কি কোন এক নেশার ঘোরে সেদিন হল জীবনের নিত্যসঙ্গী ও বন্ধু-বান্ধবের লাশ টেনে মাঠে নিয়ে গিয়েছিলাম। মার্চের শুরুতে এখনো মাঝে মাঝে ঐ দিনের কথা ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে যাই। সেই ঘোর এখনো আমার অস্তিত্বে তীব্র কশাঘাত করে।

‘বাসন্তিকা’
হীরক জয়ন্তী সংখ্যা
জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মে, ১৯৭২

Scroll to Top