জনতার সংগ্রাম

জনতার সংগ্রাম

৫ নভেম্বর, ১৯৭১

আমাদের বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা রচনা করেছে নয়া ইতিহাস। হরতাল, মিছিল আর বিক্ষোভের স্তর পার হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যে মুহুর্তে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিয়েছে, সে মুহুর্তে জনতার মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে আপনাআপনি। ফুল ফুটলে যেমন সুগন্ধ বেরিয়ে আসে, ঠিক তেমনিভাবে।

দুনিয়ার ইতিাহসে দেশের এমন ঘটনা অবশ্য ঘটেছে এর আগেও। ফ্রান্সে ঘটেছে ফরাসী বিপ্লবের সময়। রাশিয়াতে ঘটেছে সোভিয়েট বিপ্লবে। চীনে গণচীনের প্রতিষ্ঠায়। কিউবাতে ঘটেছে চে গুয়েভারার গেরিলা সংগ্রামের ধারায়। আর ঘটেছে হো চি মিনের ভিয়েতনামে- সারা দুনিয়াকে আজও যা করছে বিস্মিত।

কিন্তু বাংলাদেশে হরতাল, বিক্ষোভ আর মিছিলের স্তর পার হয়ে জনতার মুক্তিসংগ্রাম যত তাড়াতাড়ি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, এমনটি আর কোথাও হয়নি।

চলতি ’৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে অহিংস গণঅসহযোগের কর্মসূচী অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়, তা যে দেখতে দেখতে অস্ত্ৰধারণের কর্মসূচীতে পরিণত হবে, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বিশাল পাকিস্তানী হানাদার সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করার দুর্দম অভিযানে পৌছতে পারবে, এ ধারণা হয়তো আগে করা যায়নি।

কিন্তু এ ঘটনাই ঘটিয়ছে আমাদের বাংলাদেশ- আমাদের বাংলাদেশের জনতা- বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাসিন্দা। পাকিস্তানী শাসকচক্রের শোষণে জর্জরিত বাংলাদেশের নিরন্ন বুভূক্ষু সর্বস্তরের মানুষ, নরনারী-শিশু অবতীর্ণ হয়েছে আপোষহীন মুক্তিযুদ্ধে। মাত্র সাত মাসের মধ্যে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ আধুনিক অস্ত্র নিয়ে হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শিখেছে। পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের সমস্ত রকমের যোগাড়যন্ত্র করা আধুনিকতম মারণাস্ত্রে সজ্জিত সাঁজোয়া বাহিনী ‘ব্লিৎসক্রিগ’ বা বজ্রগতির যুদ্ধপদ্ধতিতে বাংলাদেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেও বাংলাদেশের বিপ্লবী সংগ্রামী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারেনি। ফিউজ হয়ে গিয়েছে পাকিস্তানী ‘ব্লিৎসক্রিগ’। বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের একটিমাত্র অংশের কাছে মামুলি ধরনের অস্ত্র ছিল ২৫শে মার্চ।  ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বাঙালী ইপিআর আর বাঙালী পুলিশ বাহিনী এবং আনসার বাহিনীকে সামনে নিয়ে ভবিষ্যতে আধুনিক অস্ত্র পাবার আশায় বাংলাদেশের জনতা মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েই হানাদার পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর সামরিক সময়সূচীকে পণ্ড করে দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে উদ্যোগ।

নরঘাতক ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, হামিদ খান, গং এর নির্দেশে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতাকে ঠাণ্ডা করার মতলবে যে বীভৎস হত্যাকাণ্ড আর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে আসছে গত সাত মাস ধরে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজীর নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা এতে ঠাণ্ডা না হয়ে বরং আরও বেশি একরোখা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রায় দু’কোটি মানুষ উৎখাত হলেও দেখা যাচ্ছে জনতা শুধু সামলে নেয়নি নিজেদের, পাল্টা আঘাত শুরু করেছে হানাদার বাহিনীর ওপর- প্রথমত গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ পরিচালনা করে, দ্বিতীয়ত নিয়মিত সেনাবাহিনীকে রণক্ষেত্রে নিয়োজিত করে। সময়সূচীর দিক দিয়ে এইভাবে পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার তুলনা নেই ইতিহাসে।

সে জন্যই আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা মুক্তিসংগ্রামের নতুন নজীর স্থাপন করলো।

তুলনা করার জন্যে দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে ফরাসী বিপ্লবের আমলের ফরাসী জনতার। ফ্রান্সের জনগণ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের শাসন-শোষণের যাতাকলে নিষ্পষিত হচ্ছিল। গ্রামাঞ্চলে কৃষকসমাজ আর শহরের মেহনতি মানুষ আর ব্যবসায়ীরা খাজনা-ট্যাক্সের কড়ি গুণতে গুণতে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিল। একদিন ফ্রান্সের শহর আর গ্রামাঞ্চলের কোটি কোটি জনতা তাই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের পতাকা নিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে অবতীর্ন হয়েছিল। পূর্ণ গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, ফরাসী জাতির নবজীবন আর মুক্তি আর মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্যে যে সংগ্রাম চলে আসছিল বিভিন্নভাবে, তা-ই দানা বেঁধেছিল সশস্ত্র বিপ্লবে।

সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ প্যারিসের জনতা শুধুমাত্র সড়কি সম্বল করে দুর্ভেদ্য ব্যাষ্টিল কারাগার ভেঙ্গে ফেলেছিল। মুক্ত করে এনেছিল রাজবন্দীদের। তার পরে বিপ্লবী ফরাসী গণসেনাবাহিনী গড়ে তুলতে তাদের চার বছর লেগেছিল। অথবা বলা যেতে পারে, ফরাসী জনতা চার বছর সময় পেয়েছিল গণসেনাবাহিনী গড়ে তোলার। পরে অবশ্য তৎকালীন ইউরোপের সমস্ত দেশের রাজতন্ত্রী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করেছিল এই ফরাসী জনতার গণসেনাবাহিনী। রাজকীয় অস্ত্রভাণ্ডারগুলি দখল করে জনতার এই সেনাবাহিনী। রাজতন্ত্রীদের সাঁজোয়া বাহিনী তুলোর মত উড়ে গিয়েছিল ফরাসী গণবাহিনীর ঝটিকা অভিযানে। এই গনসেনাবাহিনীর লোকদের নিয়মিত সামরিক পোশাক-আশাক ছিল না বলে তাঁদের স্যানসবুলেট নাম হয়েছিল। জনতার মুক্তিসংগ্রাম জনতার মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হবার পরে জনতার সুখে-দুঃখে, ভাবনায়-চিন্তায় জড়িত যে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হয়, তার সফল সূত্রপাত হয়েছিল এইভাবে।

এদিক দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা আর মুক্তিবাহিনী ফরাসী বিপ্লবকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। স্মরণ করবে বিপ্লবের নেতা ড্যান্টনের অগ্নিবাণী- আমাদের চাই সাহস, আরও সাহস এবং আরও সাহস।

শ্রদ্ধা জানাবে একথা মনে রেখেই যে, বাংলাদেশেও এমন লড়াই করছে, যা আজ এবং আগামী যুগে- যুগান্তরে মুক্তিপ্রেমিক দেশদেশান্তরের মানুষকে অনুপ্রানীত করবে। …।

(রণেশ দাশগুপ্ত রচিত)

Scroll to Top