ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের মধুদা

৮০। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের মধুদা (৪৯৫-৪৯৬)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের মধুদা

সুত্র – বাংলাদেশে গণহত্যা, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২

“মধুসূদন দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সকলের প্রিয় মধুদা। এই ‘মধুদা’ তার ছেলে, পুত্রবধূ এবং স্ত্রীসহ নিহত হয়েছিলেন বর্বর পাক-সেনাদের হাতে।

মধুবাবু তার পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতেন শিববাড়ী কোয়ার্টারে। পঁচিশে মার্চের ভয়াল বীভৎস রাতের পরদিন, তথা ২৬শে মার্চ সকালে বর্বর বাহিনী আক্রমন চালায় জগন্নাথ হলের পার্শ্ববর্তী শিববাড়ীতে। পাকবাহিনী মধুবাবুর ঘরের দড়জায় সজোরে করাঘাত করলে, দ্বিধা নিয়ে মধুবাবু দরজার কপাট খুলে দেন। সাথে সাথে একজন ভিতরে ঢুকে মধুবাবুকে টেনে বাইরে নিয়ে গিয়ে পাশের বাড়ীর আঙ্গিনায় আটকিয়ে রাখে।লোলুপ-দৃষ্টি আর পৈশাচিকতায় উন্মত্ত বর্বর পাকবাহিনীর হাত থেকে বাঁচবার আপ্রাণ চেষ্টায় ছোট ঘরের আঙ্গিনায় ছুটোছুটি করছিলেন মধুবাবুর পুত্রবধূ রানী। অসহায় গৃহবধূর আর্তি প্রমত্ত হায়েনাকে এতটুকু বিচলিত করেনি সেদিন। স্ত্রীকে রক্ষা করতে স্বামী রণজিত দে ছুটে এলে, বর্বরদের উদ্যত রাইফেলের আঘাতে তারা দুজনেই লুটিয়ে পড়ে।

দাদা-বৌদিকে রক্ষা করতে মধুর অবুঝ মেয়ে রানু সেদিন ছুটে গিয়েছিল পাশের ঘরে। সাথে সাথে বর্বরদের উদ্যত রাইফেলের গুলী তার চোয়ালে আঘাত করে। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এই রানু সেদিনের সকল ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আর সবাই আরো ছোট ছোট থাকলেও, তারাও সেদিন সামনে থেকে দেখেছিল তাদের আপনজনকে বর্বর নরপিশাচদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হতে।

রণজিত বাবু আর তার স্ত্রীকে হত্যা করে বর্বররা মধুবাবুকে আঙ্গিনায় এনে দাঁড় করায়। একজন দস্যু সেনা তার দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ধরলে, মধুবাবুর স্ত্রী শঙ্কিত হয়ে, দৌড়ে গিয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরেন। সাথে সাথে বর্বরের উদ্যত রাইফেলের গুলীবর্ষনে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলীর আঘাতে হাতদুটো তার ঝাঁঝরা হয়ে যায় এবং স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজে প্রাণ দেন। গুলীর আঘাতে মধুবাবুর দেহও জর্জরিত হয়ে গেলে, তিনিও স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে লুটিয়ে পড়েন। বর্বরদের গুলী রানুকেও তখন আহত করেছিল। একটা গুলী তার বুক ভেদ করে বেড়িয়ে যায়। বর্বররা কি ভেবে তখন চলে যায়।

গুলীর আঘাতে জর্জরিত মধুবাবু বর্বররা চলে যাবার পরও অনেকক্ষন বেঁচে ছিলেন। তার ঘন্টাখানেক পর আবার ওরা আবার এসে মধুবাবুকে নিয়ে যায়। বাবাকে রেখে যাওয়ার জন্য চীৎকার করে সেদিন রানু বলছিল, “তাহলে আমাকেও বাবার সাথে নিয়ে যাও। আমারও তো গুলি লেগেছে।”

বর্বররা তাকে নিয়ে যায়নি। আবার ফিরিয়ে দিবে আশ্বাস দিয়েছিল বলে, কচি শিশু মন সেদিন সারাদিন আর রাত ভরে অপেক্ষা করেছিল তার বাবার জন্য। বর্বররা তার আহত বাবাকে আর ফিরিয়ে দেয়নি। মধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জগন্নাথ হলের মাঠে।

ঘটনার পর চৌদ্দদিন পর্যন্ত শিববাড়ীতে পড়েছিল মধুবাবুর ছেলে, পুত্রবধূ আর স্ত্রীর লাশ।“

Scroll to Top