দৃষ্টিকোণ

দৃষ্টিকোণ

 

১৫ডিসেম্বর, ১৯৭১

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের হবু বেসামরিক সরকারের হবু উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্টমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টোর জাতিসংঘ প্রাসাদ চত্বরে পদার্পণের সাথে সাথেই হাজার মাইল দূরের ভিয়েৎনামের টনকিন উপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের পদচারণা শুরু হয়ে গেছে। গন্তব্যস্থল অনিদিষ্টি বলে উল্লেখ করা হলেও আপাতত উদ্দেশ্য নাকি ঢাকার মার্কিন নাগরিকের উদ্ধার করা। ঢাকার মাত্র কয়েক শ’ মার্কিন নাগরিক উদ্ধারের জন্য সপ্তম নৌবহরের পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ ন্যায় রণপোতকে ব্যবহার করতে হচ্ছে এই খোঁড়া অজুহাতটি দুগ্ধপোষ্য বালকেও বিশ্বাস করবে না। তা ছাড়া মার্কিন নাগরিকরা হয়তো ইতিমধ্যেই ঢাকা ছেড়ে গেছেন। তাই সপ্তম নৌবহরের এই আকস্মিক আনাগোনা বা শক্তি প্রদর্শনের পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোন অভিসন্ধি রয়েছে, এটা সকলেই স্বাভাবিকভাবে সন্দেহ করবেন। এদিকে দিয়ে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ন্যস্কারজনক কীর্তিকলাপের রেকর্ড কেউ বিস্তৃত হবেন না। মার্কিন সমর দফতর পেন্টাগনের গোপন দলিলপত্র সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়ার পর দুনিয়ার মানুষ জেনেছেন কিভাবে বিনা প্ররোচনায় এই সপ্তম নৌবহর টনকিন উপসাগরে থেকে উত্তর ভিয়েতনামের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। এখনও ভুলে যাওয়ার কথা নয়, ১৯৫৬ কোরিয়া যুদ্ধে মার্কিন হানাদার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ম্যাকআরথারের নৌবহর বলে পরিচিত এই সপ্তম নৌবহরকে কোরিয়ার হামলা চালানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ! লোক অপসারণের নামে এরা অবতরণ করেছিল ১৯৬২ সালে থাইল্যাণ্ডে। পর্যবেক্ষকরা তাই ১২৫টি জাহাজ, ৬৫০টি বিমান ও ৬৫ হাজার নৌসেনা গঠিত এই সপ্তম নৌ-বহরকে উনবিংশ শতাব্দীর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গানবেটের সাথে তুলনা করেছেন। অতএব অবরুদ্ধ মার্কিন নাগরিক উদ্ধারের অজুহাত যে একেবারেই বাজে একথা বলাই বাহুল্য মত্র। ভারত সরকারের জনৈক মুখপাত্র ইতিমধ্যেই তাই বলেছেন” মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্যই মার্কিন সপ্তম নৌবহরের এই পদচারণা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের পিণ্ডি-প্রেম বর্তমানে প্রায় চরম পর্যায়ে উপনীত হলেও একেবারে নতুন কিছু নয়। দুনিয়ার সকল জাতির মুক্তি আন্দোলনের বিরোধিতায় সবার আগে এগিয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে পিণ্ডির জল্লাদ দলের গণহত্যা তথা এক কোটি বাঙালীর পৈত্রিক ভিটেমাটি থেকে উৎখাতের ব্যাপারে

এই মার্কিন প্রশাসন তাই উচ্চবাচ্য করেনি। মার্কিন সংবাদপত্র এবং উদারপন্থী সিনেটেরদের প্রবল চাপের মুখে নিক্সন সরকার শরণার্থীদের জন্য কিঞ্চিৎ খয়রাতি বিতরণ করলেও পিণ্ডির জল্লাদচক্রকে অস্ত্রশস্ত্রসহ সবকিছুর সাহায্যে মদদ দিয়েছে। যার পরিণতি ভারতের উপর পাকিস্তানী সামরিক চক্রের প্রকাশ্য নগ্ন হামলা। আজ নিজের চক্রান্ত জালে আটকে জবরদস্ত সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁর যখন নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে তখন পেয়ারের পিণ্ডিকে বাঁচানোর জন্য স্বস্তি পরিষদের দুয়ারে ছুটে গেছে নিক্সনের অগ্রদূত বুশ সাহেব। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়ায় দিনের পর দিন নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে গ্রামের পর গ্রাম এমনকি বনাঞ্চল সাফ করে দিলেও আজ শ্যামচাচারা এই উপমহদেশের শাস্তির জন্য একেবারে বেচায়েন হয়ে পড়েছে। ভিয়েতনামে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য অপসারণে যে মার্কিন প্রশাসন অস্বীকৃতি জায়য়েছে সেই একই প্রশাসন আজ বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতির আহবান জানাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এবারের চক্রান্তে মার্কিনী “কাগুজে বাঘ” রা এক নয়। চীনের বিপ্লবী সাত্ত্বিক নায়করা এবার মার্কিন শ্যামচাচার সাথে ভিড়ে গেছেন। স্বস্তি পরিষদে প্রস্তাব পেশ ও ভোটদানের ব্যাপারে এ দুটো দেশ একই সাথে চলেছে হাতে হাত মিলিয়ে।

পিকিং ও ওয়াশিংটন একের পর এক প্রস্তাব স্বস্তি পরিষদে উত্থাপন করেছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ইউনিয়নের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের ফলে তাদের সে চক্রান্ত ভণ্ডুল হয়ে গেছে প্রতিবারেই। সোভিয়েট প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেনের বক্তব্য সমর্থন করে বলেছেন, বাংলাদেশ সমস্যার মূল অনুসন্ধান না করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ন্যায়সঙ্গত ও আইনানুগ অধিকারের কথা বিবেচনা না করে শুধুমাত্র যুদ্ধবিরতির আহবান জানালে তাতে সমস্যার কোন সমাধান হবে না। তিনি স্বস্তি পরিষদের বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিকে তাঁদের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দেওয়ার আহবান জানিয়েও একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাতেও সমর্থন জানানোর প্রয়োজনবোধে করেনি।

জাতিসংঘ স্বস্তি পরিষদের ব্যর্থ হওয়ার পর পিণ্ডির মহাপ্ৰভু ওয়াশিংটন আর জানি-দোস্ত পিকিং একই সাথে জাতিসংঘের বাইরে দাবার ঘুটি চালাতে শুরু করেছে। নিক্সনের নির্দেশে সপ্তম নৌবহর সায়গন দরিয়ার পানি কেটে এগিয়ে চলেছে তথাকথিত মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধারের অজুহাতে। অন্যদিকে তিব্বত চীনা সৈন্য নাকি নড়াচড়া করতে আরম্ভ করেছে। মার্কিন বা চৈনিক কার্যক্রমের পেছনে যে গৃঢ় অভিসন্ধিই থাকে না কেন, তাদের লেজের আগুনে আর একটি ভিয়েতনাম এই উপমহাদেশে কখনই করতে দেবে না বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি এবং ভারতের ৫৫ কোটি মানুষ। স্বাধীন দুনিয়ার বড় মোড়ল গণতন্ত্রের মেকি ভজনাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু ঘৃণাভরে উপেক্ষা করবে এই দু দেশের সাধারণ মানুষ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সককারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদও সাম্প্রতিক এক বেতার ভাষণে বলেছিলেন, এই উপমহাদেশ সম্পর্কে মনগড়া যে ধারণা নিয়ে কতিপয় বৃহৎ শক্তি থাকুন না কেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম তাতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে না। নিক্সন প্রশাসনের চোখরাঙানি আরো একবার প্রমাণ করলো, গণতন্ত্রের জন্য যতই তারা চীৎকার করুক না কেন আসলে এরা দুনিয়ার সকল জঙ্গীচক্রের শয্যাসঙ্গিনী। ভিয়েতনামের থিউ, কম্বেডিয়ার লন নল, লাওসের ফুমি নোসাভান, থাইল্যাণ্ডের কিট্টিকাচরণ, কঙ্গোর মোবুতু আর পিণ্ডির ইয়াহিয়া সবাই শ্যামচাচার অবৈধ সন্তান।

নিক্সন প্রশাসনের বাসনা থাকলেও বাংলদেশকে আর একটি ভিয়েতনাম বানানোর পথে বড় বাধা হোল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাগ্রত জনমত। ভিয়েতনামের জঙ্গীচক্রের শাসন বজায় রাখতে গিয়ে আমেরিকার শত শত মা হারিয়েছেন তাঁদের সন্তান, স্ত্রী হারিয়েছে স্বামীকে, পিতা হারিয়েছে পুত্রকে। তাই আর একটি ভিয়েতনাম সৃষ্টির ঝুঁকি তাঁরা নিতে চান না। সিনেটের এডওয়ার্ড কেনেভী, সিনেটোর মাস্কি, সিনেটের ম্যাকগর্ভান এবং মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ডেমোক্রেটিক পাটির নেতা সিনেটর মাইক ম্যান্সফিল্ড ইতিমধ্যেই পাকিস্তান সম্পকে নিক্সন প্রশাসনের ভ্রান্তনীতির সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠছেন। এই সিনেটরদের মধ্যে অন্ততঃ দুজন আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হতে পারেন। আশা করা যায়, এই অবস্থায়

প্রেক্ষিতে নিক্সন সাহেব যত লম্ফঝফই করুন না কেন আর একটি ভিয়েতনাম সৃষ্টি করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজনৈতিক সমাধি রচনায় তিনি সাহসী হবেন না। সর্বোপরি, মার্কিন দুঃসাহসের পথে প্রচণ্ডতম অন্তরায় হয়ে আছে সোভিয়েট ইউনিয়ন। সোভিয়েট রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই পদগণি ইতিমধ্যেই বৃহৎ শক্তিবর্গকে এই উপমহাদেশের সংকট থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। তিনি এ ব্যাপারে নাক গলানোর বিরুদ্ধে সকলকে হুশিয়ার করে দিয়েছেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত স্বীকৃত সত্য। জাতিসংঘ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশ যত তাড়াতাড়ি এই সত্যকে স্বীকার করে নেবেন, এই উপমহাদেশে সংকট তত তাড়াতাড়িই নিম্পত্তি হবে। এতে বিভ্রান্তি বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোন অবকাশ নেই।

(লেখকের নাম জানা যায়নি)

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঢাকার অধিকৃত এলাকা থেকে চমকপ্রদ খবর এসে পৌছছে। দখলদার বাহিনীর তথাকথিত বেসামরিক প্রশাসনের শেষ কাঠামোটুকুও ভেঙ্গে ছারখার হয়ে গেছে। রেডক্রসের নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। চীফ সেক্রেটারী ও পুলিশের আইজিসহ আমলাদের একটি দলও মহাজনী পন্থা অনুসরণ করেছেন। কিন্তু ঢাকার লাখ লাখ বেসামরিক অধিবাসী এখন কি ভাবছেন, কি করছেন? বিগত নয় মাস ধরেই তারা বাস করছেন ইতিহাসের দীর্ঘতম অমাবস্যার রাত্রিতে। ২৫শে মার্চের কালরাতে আমবস্যার যে অন্ধকারে নেমে এসেছিল এখনও তার অবসানের প্রতিক্ষা। স্বজন হারিয়ে, সর্বস্ব যখন বলতে পারবো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি? সেই দিন যেদিন আসবে পাকিস্তানের রাহুগ্রাস থেকে সোনার বাংলার মুক্তি। বাংলাদেশের মুক্তির দ্বারপ্রান্তে ঢাকায় এখন চলেছে চূড়ান্ত সংগ্রামপিণ্ডির জল্লাদ দলের শাসন-শোষণের অবসানের শেষ সংগ্রাম। মুক্তির এই উষালগ্নে জঙ্গীশাহী যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করুক না কেন ঢাকার মানুষ কি ধাতুকে গড়া তা তারা ভালভাবেই জানে। ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক হবেন যে ঢাকার মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ, একথা নিঃশঙ্কচিত্তে বলা চলে। গত এক দশকের ইতিহাসে যাঁরা জ্ঞাত আছেন, যাঁরা দেখেছেন কিভাবে ঢাকার মানুষ এই সময়ে জঙ্গী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি হওয়ার জন্য একের পর এক দুর্বার গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলেছে, তাঁরাই একথা স্বীকার করবেন। কামানের গোলা, মর্টারের শেল আর মেশিনগানের গুলি বর্ষিত হয়েছে হাজারো হাজারে। কারফিউ আর ১৪৪ ধারা সেখানে নিত্যসহচর। সমুদ্র সেখানে শয্যা পাতা, জঙ্গীচক্রের আজকের শেষ চোখরাঙানিতে সেখানে ভয়ের কি আছে। ঢাকার সংগ্রামী নাগরিকরা পিণ্ডির জল্লাদ দলের সকল ভ্ৰকুটিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের দিকে বার বার। ইয়াহিয়ার গুরুদের আইয়ুব খাঁর সামরিক শাসনের খবরদারীকে ছিন্নভিন্ন করে পথে নেমেছিলেন ঢাকবাসী গণতন্ত্রের দাবী কণ্ঠে নিয়ে ১৯৬২ সালে। মিছিলে মিছিলে রক্ত ঝরেছিল সেদিনে। আইয়ুবের ছবিগুলো হয়েছিল টুকরো টুকরো। আইয়ুবের দেওয়া ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার যুপকাষ্ঠ সংগ্রামের আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল রমনার রাজপথে, পটুয়াটুলির অলিতে-গলিতে। আইয়ুবের মৌলিক ধরনের মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ঢাকার মানুষ সুস্পষ্টভাবে রায় দিয়েছিলেন আইয়ুবের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। এলো ১৯৬৬ সাল ঐতিহাসিক ছ’দফা আন্দোলনের ক্রান্তিলগ্ন। বাংলার স্বাধিকারের দাবীতে গর্জে উঠলো ঢাকা। ৭ই জুন স্তব্ধ হয়ে গেল নগরীর প্রতিটি ধমনী। মিছিলের ভৈরব গর্জনে প্রকম্পিত হোল একনায়কত্বের পাষাণ কারা। জনসন রোড, জিন্নাহ এভিনু্য, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় শত শত শহীদদের রক্ত স্নান করেছিল কৃষ্ণচূড়ার লাল রং এরপর থেকে ঢাকার মানুষের বজ্রকণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছে বারবার ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। ৬৮-৬৯ সালের আইয়ুব-বিরোধী গণুঅভ্যুত্থানের প্রবল জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পিণ্ডির শাসকচক্রের সকল জঞ্জাল। ঢাকার মুক্তিপাগল মানুষ সেদিন অগ্নিমন্ত্রে

দীক্ষা নিয়ে শাসক। শ্রেণীর মিথ্যার বেসাতির কারখানাগুলোকে সাফ করে দিয়েছিল আগুনের লেলিহান শিখায়। বাংলার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবীতে ঘেরাও করেছিল ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট। সাজানো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মিথ্যা নথিপত্র সমেত পুড়েছিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এস. এ রহমানের বাসভবন। বাঙালী গৃহভূত্যের মহানুভবতায় প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। ১৮ই ফেব্রুয়ারীর রাত। ঢাকার মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসে সে এক অনন্য রাত। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে মুখোমুখি মোকাবিলা করেছে নিরস্ত্র মানুষ সারা রাত। অবরোধ করে রেখেছে ঢাকা নগরীকে। কারফিউর বিধিনিষেধ দিয়েছে উড়িয়ে। মেশিনগানের গুলির মুখে বুক পেতে দিয়েছিল তারা। শ্লোগানে শ্লোগানে ঝংকৃত ঢাকা নগরীতে সে রাতে হৃদকম্প উপস্থিত হয়েছিল আইয়ুবের বেতনভুক সেনাবাহিনীর রক্তের বিনিময়ে মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে এনেছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ধন্য হয়েছিল তারা। তারপর মার্চের অবিস্মরণীয় অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলিতেও ঢাকা আপন মহিমায় থেকেছে অম্লান বস্তুতঃপক্ষে ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মূলতবি ঘোষণা করলে ঢাকার মানুষই প্রথমে ছুটে গিয়েছিল তাঁদের নেতার কাছে নির্দেশের জন্য। ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে তখন বৈঠক চলছিল বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির নির্দেশ এলো সর্বাত্মক গণঅসহযোগ আন্দোলনের। কারখানার চিমনিতে ধোঁয়া উড়লো না। ট্রেনের চাকা গেল থেমে। লঞ্চ-স্টীমার স্তব্ধ। বাসট্যাক্সি-রিকশা চললো না। এমন যে সাধের পিআইএর বিমানগুলোও মুখ থুবড়ে পড়ে থাকলো মাটিতে। মিছিলে পতাকায় ব্যানারে ফেস্টুনে শ্লোগানে সে আরেক ঢাকা পিণ্ডির শাসক-চক্রের বাংলাদেশবিরোধী অনড় মনোভাবের মুখে ঢাকার মানুষই প্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন একটি নতুন জাতীয় পতাকার, নতুন জাতীয় সঙ্গীতের মিছিলের বজ্ৰমুঠিতে সেদিন উচ্চকিত হয়েছিল একটি নতুন জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রথম শপথ।

নিষেধাজ্ঞা-বিধিনেষেধের বেরাজাল ফেললেই ঢাকার মানুষ প্রতিবাদে আলোড়িত হয় ঝাপিয়ে পড়ে। কারফিউ দিলে রাস্তায় নামে। কাউকে ডাক দিতে হয় না। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। আওয়াজ তোলে । গুলিতে বুক পেতে দেয়। আবার শ্লোগানে কাঁপিয়ে তোলে আকাশ-বাতাস।

অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে এখনও সে মানুষ আছে। পিণ্ডির জল্লাদ দলের পাশবিক হামলাকে বিশেষ এক অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা মুখ বুঝে সহ্য করেছে। গত নয় মাস শুধু সেই বিশেষ মাহেন্দ্রক্ষণটি প্রতীক্ষায়, যখন তারা ফেটে পড়তে পাড়বে আগ্নেয়গিরির মত। নাদিরশাহের সুযোগ বংশধর জল্লাদ সরদার ইয়াহিয়া খাঁর পাইকবরন্দাজের দল মৃত্যুর পূর্বমুহুর্তে যে বিভীষিকাই কায়েম করুক না কেন, ঢাকায় তাদের নিস্তার নেই।

(লেখকের নাম জানা যায়নি)

Scroll to Top