দেশে গঠনে নারীর ভূমিকা

দেশ গঠনে নারীর ভূমিকা

১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১

আজ দেশের প্রায় সকল এলাকাই শত্রুমুক্ত। এই স্বর্গাদপি গরীয়সী জন্মভূমি, যাকে ভালোবাসার অপরাধে বুলেট, বেয়নেট, মর্টার, মেশিনগানে, লক্ষ লক্ষ প্রাণের অবসান ঘটেছিল। হারিয়েছিল কতজন স্বামী, সন্তান পিতা-ভ্রাতা। আত্মীয়পরিজন ভরা সুখের সংসার সর্বস্বহারা। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কতজন বাহির হয়েছিল পথে- সাতপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে।

আজ শত্রুমুক্ত অঞ্চলে ফিরে আসছে সবাই- কিন্তু বসতি গড়ে তুলবে এ কোন মাতৃভূমির কোলে চির সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা যার প্রতিরূপ এক পশুশক্তির দাহনে জনশূন্য, শস্যশূন্য, গৃহশূন্য দগ্ধ হাহাকারের এক চরম অভিশাপে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। বর্বর ইয়াহিয়ার অনুচরবর্গের অঞ্চল ত্যাগের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত হত্যাযজ্ঞের অবশিষ্টরূপে রয়েছে দগ্ধ গৃহ, লুষ্ঠিত দ্রব্যের ভগ্নাংশ, স্বজনসম্পত্তি হারা, শোকার্ত, বুভুক্ষু ও পঙ্গু কুকুর আর শকুনের লড়াই। শূন্য ভিটায়, ভগ্নগৃহে কারো বুকে জ্বলছে পিতা-মাতা, ভ্রাতা আর বন্ধু বিয়োগের বেদনা- স্বামী-সন্তান আর সুখের সংসার হারিয়ে কেউ বা কাঁদছে ভূলুষ্ঠিত হয়ে, কারো বা বেদনা ভাষাহীন। বিয়োগের বেদনা, সন্তান আর সম্পদ হারানোর শোক অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিকও নয়- আর এ শোকে সান্তুনার ভাষাও নেই। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নিস্ফল শোকও পরিহার করতে হবে। অত্যাচারীর কবলমুক্ত পুনজীবিত আমরা। আমাদের এই নবজন্ম ও জীবন পরিচালনার সন্ধিক্ষণে পশ্চাতের শোক, দুঃখ, অনুশোচনাকে দূরে সরিয়ে একতা, শান্তি ও শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজ সংগঠনে সক্রিয় হয়ে নতুন উদ্যমে বাঁচতে ও বাঁচাতে হবে। এই ভগ্নহাটের দগ্ধভূমিতে এই শোকার্ত, নির্যাতিত পদুদের মাঝেই আমাদের কর্মক্ষেত্র বিছাতে হবে। আত্মনিয়োগ করতে হবে বিপন্ন, বিপর্যস্ত, নিরন্ন এই জনসমাজের কল্যাণমূলক সংগঠনের দায়িত্বে।

দীর্ঘ সংস্কারের অভাবে মুক্তাঞ্চলের স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা নানাভাবে বিপর্যস্ত। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অব্যবস্থা ও ময়লা নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে মশামাছির বৃদ্ধি ইত্যাদিতে নানা রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে।

তদুপরি রক্তলোলুপ খান সৈন্যদের পলায়নের প্রাক্কালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে নিহত পরিত্যাক্ত গলিত মৃতদেহ বসবাসের উপযোগী পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছে। পরমুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের উদ্যোগে এ সমস্ত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যরক্ষা সমস্যা সত্বর নিরসনে অগ্রণী হওয়া উচিত। পল্লী অঞ্চলের ভগ্ন, অর্ধভগ্ন নলকূপ মেরামত, প্রয়োজনবোধে নতুন নলকূপ চালু করার ব্যাপারে কর্তপক্ষকে অবহিত করা, নর্দমা ইত্যাদি সংস্কারে নিজেদের মনোযোগী হওয়া- যেখানে সেখানে আবর্জনা আর ময়লা ফেলার ব্যাপারে সকলকে সতর্ক করা, জল ফুটিয়ে পান করা- স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনীয় এই সমস্ত দায়িত্বগুলিতে মেয়েরা নিজেদের দৃষ্টান্তে অপরকেও সতর্ক করতে পারেন। নালা-নর্দমায় জীবাণুনাশক ঔষধ প্রয়োগ, ঘরে ঘরে টিকা-ইনজেকশনের ব্যবস্থা তুরান্বিত করা ইত্যাদিতে বর্তমান পরিস্থিতির অনুকূলে মেয়েরা যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারেন।

বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত প্রায় পল্লী ও শহরগুলির যেখানে আহত-পীড়িতদের চিকিৎসা ও শুশ্রষাব্যবস্থা তুরান্বিত করা সহজসাধ্য নয়, সেখানে সকলে একতাবদ্ধ হয়ে গাঁয়ে, গঞ্জে, শহরে, ঘরোয়া চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলে ও সাধ্যানুযায়ী সহায়তা দানে মেয়েরা এগিয়ে আসতে পারেন- আর্তের সেবা, সাহায্য পথ্য ও পানীয়ের সমস্যা সকলের সম্মিলিত যত্নে সমাধান হয়ে যাবে।

তা ছাড়া, বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিয়মিত বিদ্যালয় চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পাঠাভ্যাস দীর্ঘ অনভ্যস্ত ছেলেমেয়েদের একত্রিত করে সমান সহোযোগিতায় কাজ চালিয়ে গেলে শিক্ষাদান কার্য অনেকটা এগিয়ে যাবে।

উপস্থিত আমরা সকলেই লুষ্ঠিত, সর্বস্বান্ত- তবুও তার মধ্যে কিছুটা সামর্থ্য আর সঙ্গতি যাদের আছে, তাঁদের কাছ থেকে কিছু কিছু অর্থ সাহায্য নিয়ে, আর সঙ্গতি যাদের আছে, তাঁদের কাছ থেকে কিছু কিছু অর্থ পারি। শীতবস্ত্রের প্রয়োজনে সুতো-কটা সংগ্রহ করে বসে গেলে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে অপরের প্রয়োজনেরও সাহায্য করতে পারি। রোগীদের প্রয়োজনীয় ব্যাণ্ডেজ, বন্ধনী, নবজাত শিশু আর প্রসূতির উপযুক্ত বস্ত্রাদি, সাময়িক সাহায্য, কিছু ঔষধপত্রের ব্যবস্থা, শিশুদের পাঠ্যবইও আমরা এ থেকে করে নিতে পারি।

হানাদার বাহিনীর জঘন্যতম অত্যাচারের শিকার পরিনণত, নির্যাতিত –নিপীড়িত- যারা স্মগ্র মাতৃজাতির অবমাননার কালিমা নিজের গায়ে মেখে জীন্মৃতঃ জনচক্ষুর অন্তরালে পড়ে আছে, আসুন আমরা এগিয়ে যাই  ব্যথায় বিমূঢ় লাঞ্চনা, বেদনা আর অপমানের বিষপানে জর্জরিত নিরূপায় সেই মা, বোন, বধূ আর কন্যাদের মাঝে। তাদের দুঃসহ দুঃখ ও লজ্জার গুরুভার যদি সমগ্র অন্তর দিয়ে লাঘব করতে না পারি, তবে বৃথাই আমরা মাতৃ অংকে জন্ম নিয়েছি। সমবেদনার প্রলেপে, দরদের অশ্রুতে আমরা মুছে নেব তাদের হৃদয়ের গভীর ক্ষত। ডেকে নেব আমাদের সর্ব কাজে, সর্বস্তরে। বেঁধে দেব তাদের ভাঙ্গা ঘর, ফিরিয়ে দেব তাদের সুখ-শান্তি, সম্মান।

তবে একতা, শৃঙ্খলা, শান্তি আর সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে যেন আমরা পরষ্পরের সাহায্যে এগিয়ে যাই। হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিযোগিতা আর সাম্প্রদায়িকভাবে বিষাক্ত নিঃশ্বাস যেন আমাদের এই কল্যাণব্ৰতকে কলুষিত না করতে পারে। সকল স্বার্থ, নিন্দা, ভয়, ভেদ, বিবাদের সমস্যাজয়ী বাংলার নারী যতই দুরূহ হোক না কেন, সুসমাধান যে হবেই এ কথা সম্পূর্ণ নিশ্চিত।

(বাসনা গুণ রচিত)

Scroll to Top