প্রতিনিধির কণ্ঠ

প্রতিনিধি কণ্ঠ*

১৯শে জুলাই, ১৯৭১

… টিক্কা-হামিদ, ভূট্টু-মওদুদী চক্র পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সেনাপতি ইয়াহিয়াকে বলিলেন, “আলোচনার প্রয়োজন নাই, আলোচনা দ্বারা বাঙালীকে ঠাণ্ড করা যাইবে না। সেনাবাহিনী প্রস্তুত, হুকুম পাইলেই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাঙালী জাতিটাকে চিরদিনের জন্য হুকুমের গোলাম বানাইয়া দিতে পারি।” হুকুম মিলিয়া গেল। রাতের অন্ধকারে পরিকল্পনা মোতাবেক আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত হইয়া ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী নারী শিশু জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ১০ লক্ষ বাঙালীকে খুন করিল। নগর, বন্দর, গ্রাম, জনপদ, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, কারখানা, পত্রিকা অফিস সবই এই কসাইরা অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে ধ্বংস করিতে লাগিল। ইহারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করিল। বাঙালী জাতি এই দানবীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জল্লাদদের হাত হইতে অস্ত্র কাড়িয়া লইয়া রুখিয়া দাড়াইল। বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করিল। কসাইদের অত্যাচার ও লুণ্ঠনের কারণে ৬০ লক্ষ বাঙালী হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইল। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া ইয়াহিয়ার নিয়মিত জল্লাদ বাহিনীতে যখন টান পড়িল, তখন পশ্চিম পাকিস্তান হইতে অনিয়মিত বাহিনী আমদানী করা হইল। বঙ্গ শার্দুলদের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া যদি বলা হয় ইয়াহিয়া-টিক্কার হানাদার বাহিনী খতম হইয়াছে, তাহা হইলে অত্যুক্তি হইবে না। আমরা যাহারা অসীম সাহসী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত আছি তাহারা দেখিয়াছি বাংলার সংগ্রামী জনতা ও মুক্তিবাহিনীর নাম শুনলে কিভাবে এই হানাদার বাহিনী প্রাণ লইয়া দৌড়ায়। মার খাইতে খাইতে ইহারা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে আসিতে নারাজ। অপরপক্ষে এই পশুবাহিনী নিরীহ গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার চালাইয়া প্রতিশোধ লইতে চাহিতেছে। এই প্রসঙ্গে দুই-একটি জেলার যুদ্ধ প্রসঙ্গ উল্লেখ করিতে চাই। তাহা হইতে বিশ্ববাসী বুঝিতে পারবেন প্রকৃত অবস্থা কি। একমাত্র নোয়াখালী জেলার শুভপুর, ছাগলনাইয়া, বান্ধুয়া, মুন্সিরহাট, পরশুরাম, রথি ইত্যাদি স্থানের সম্মুখযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর তিন হাজারের উপর সৈন্য নিহত হইয়াছে। গেরিলাদের আক্রমণে এই জিলার পেনাঘাটা, চন্দ্রগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, মাদাসা ব্রীজের নিকট, বগাদিয়া , আলোরপাড়া, কাঠালিয়া, পারপাড়া, পাঠাননগড় ইত্যাদি স্থানে কর্নেল, মেজর, ক্যাপ্টেন, জে-সি-ও ইত্যাদি অফিসার সহ এক হাজারের উপর হানাদার বাহিনী নিহত হইয়াছে। আহতের সংখ্যা নিহতের সংখ্যার দ্বিগুণ হইবে। পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা জিলার শত্রুর অবস্থা আরও শোচনীয়। কুমিল্লা হইতে ফেনী পর্যন্ত হাইওয়ে রাস্তার দুই পার্শ্বে মিয়ার বাজার, চৌদ্দগ্রাম, জগন্নাথ দিঘী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শালদা নদী, কসবা, আখাউড়া, গঙ্গাসাগর ইত্যাদি রণাঙ্গন হানাদার বাহিনীর গোরস্থানে পরিণত হইয়াছে। মুক্তিবাহিনীর সাথে গ্রামবাসী একত্র হইয়া যোগাযোগ ব্যবস্থা বানচাল করিয়া দিয়াছে। গেরিলা যুদ্ধ সম্বন্ধে নোয়াখালীর এক গ্রামবাসীর মন্তব্য এখানে উল্লেখ করিতে চাই। তাহারা পিতা-পুত্র দুইজনে শক্র যাতায়াতের রাস্তার পার্শ্বের জমিতে ইরি ধান কাটিতেছিল। এমন সময় মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়া শত্রু সৈন্যসহ দুইখানা ট্রাক ধ্বংস হইয়া যায়। পরের দিন গ্রামবাসীরা তাদের নিকট ঘটনার বিষয় জানিতে জড়ো হয়। তখন বৃদ্ধ বলিতে থাকেন, “যুদ্ধের কথা শুনিয়াছি, এইবার আল্লাহ তাহা দেখাইয়াছে। কামান-বন্দুকের কথা শুনিয়াছি কিন্তু গতকল্য যাহা দেখিয়াছি তাহা আল্লার গজব ছাড়া আর কিছু নহে। এই পাঞ্জাবী পশুরা নিরীহ গ্রামবাসী মা-বোনের উপর অকথ্য অত্যাচার করিয়াছে, শরিয়ত বিরোধী কার্যে লিপ্ত হইয়াছে। তাই আল্লাহ তায়ালা এই গজবিয়াগো উরফে এক্কারে নারাজ অই গ্যাছে। নইলে কওচেন, হিগুন যাওন লাগছিল রাস্তার হরদি গাড়ী চালাইয়া, আচমবিৎ মাটির তলেতুন আওয়াজ করে কি একটা বারঅই হিগুনরে কিল্লাই ধ্বংস কল্লো! ইয়াতুন আর মনে অইচে ইগুনের উরফে আল্লার গজব নাজিল অইচে। আল্লা মজিবের উরফে রাজী অই গ্যাছে। মজিব এই যুদ্ধে জিতবো। নইলে আল্লার কিতাব মিইছা।”……

                                                                        (নূরুল হক, এম-এন-এ)

*জাতীয় সংসদ সদশ্যের বক্তৃতামালা থেকে সংগৃহীত

.

৫ আগষ্ট, ১৯৭১

প্রিয় ভাই বোনেরা

পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের সর্বাত্মক যুদ্ধ বর্তমানে পঞ্চম মাসে পদার্পণ করল। প্রতিকূলতার মধ্যেই আওয়ামী লীগের জন্ম এবং প্রতিকূলতার মধ্যেই আওয়ামী লীগ ২২ বৎসর যাবৎ টিকে আছে। যুদ্ধ আমরা চাইনি, যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যুদ্ধ চাইনি বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা নির্বাচনে অংশ্রগ্রহণ করেছিলাম। প্রতিপক্ষ অর্থাৎ পশ্চিম পাক সামরিক জান্তা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় সংখাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে কিন্তু অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সামগ্রিক সংখাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না। ওরা ভেবেছিল বাংলদেশের যে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল আছে তাদের কিছু কিছু বাঘা বাঘা নেতা নির্বাচনে জয়লাভ করবেই এবং সেই সমস্ত ‘কুইস্লিং’ দেরকে নিয়ে যে পরিষদ গঠিত হবে তাতে আওয়ামী লীগ খুব জোর হলে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে পরিষদে আসন গ্রহণ করবেন কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বিগত নির্বাচনে সাড়া বাংলার সংগ্রামী মানুষ যেন  এক হয়ে গেল এবং শতকরা ৯৮.৫ টি আসনে জয়লাভ করে অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। তার পরেই শুরু হলো নতুন খেল। সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁ ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলাপ করে ফেরার পথে মন্তব্য করল যে “আমি পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাপ করে এসেছি।” এদিকে পূর্বেই আয়োজিত লারকানায় শিকারের বাহানায় ভুট্টোর সঙ্গে মিলিত হয়ে সেনাপতি ইয়াহিয়া ভুট্টোকে বলল যে, চিরাচরিত প্রথায় অর্থাৎ মন্ত্রিত্বের টোপ আমি দিয়ে এসেছি। ভুট্টো তুমি শক্ত হয়ে যাও। ভুট্টো তার চিরাচরিত প্রথায় আবোল-তাবোল বকা আরম্ভ করে দিল এবং তার ঔদ্ধত্য এতখানি বেড়ে গেলে যে, সে বলল- “পাঞ্জাব এবং সিন্ধু পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।” অথচ সবাই জানেন যে, সিন্ধু প্রদেশ ’৪৭ সালের পরে কোন সময়ই শাসনযন্ত্রের চাবিকাঠি হাতে পায় নি। পশ্চিম পাঞ্জাবের সামন্তপ্রভু এবং আমলাতন্ত্রের হাতের ক্রীড়নক হিসাবে সিন্ধু প্রদেশ অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতার যোগান দিত। আমাদের তরফ থেকে আমরা জবাব দিলাম যে, স্মরণকালের ইতিহাসে ১৯৪৭ সালের পূর্বে পশ্চিম পাঞ্জাব কোন সময়ই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস ছিল না, বরং বৈদেশিক আক্রমণে বিদেশীদের ভাড়াটিয়া লাঠিয়ালের কাজ করেছে। শুধু তাই নয়, আলেকজাণ্ডার হতে আরম্ভ করে যত বিদেশী আক্রমণকারী ভারত বর্ষে স্বল্পকাল অবস্থান করেছেন তাঁদের অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে আসেননি।

যাই হোক ভুট্টোর সাথে বঙ্গবন্ধুর যে আলোচনা হয়েছিল তাতে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিলেন যে, আমি জনগণের কাছে আমার দলের ৬-দফা এবং ছাত্রদের ১১-দফা কর্মসূচী দিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছি। এ থেকে একচুল নড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভুট্টো বলেছিল সে তার দলের নেতাদের সঙ্গে আলেচনা করে পরে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করবে। কিন্তু পরবর্তীকালে ভুট্টোর ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ আপনাদের সকলেরই জানা আছে। যাই হোক সংখ্যাগরিষ্ঠদলের নেতা হিসাবে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেনাপতি ইয়াহিয়াকে তারযোগে জানিয়ে দিলেন যে, যদি ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা না হয় তবে ১৪ই ফেব্রুয়ারী প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাহার পরে ১৩ই ফেব্রুয়ারী তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করে। এদিকে ভুট্টোর একগুয়েমির কারণে পহেলা মার্চ বেআইনী এবং অগণতান্ত্রিকভাবে সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁ পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই মুলতবি ঘোষণা করে দিল। সারা বাংলাদেশ আন্দোলনে ফেটে পড়লো। শত শত ছাত্র-জনতা ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনীর গুলিতে শহীদ হলেন। সংগ্রামী ছাত্রলীগ ২রা মার্চ প্রদেশের সর্বত্র প্রতিবাদ দিবস ঘোষণা করল এবং আওয়ামী লীগ

৫ই মার্চ প্রতিবাদ দিবস ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রমনার ঘোড়দৌড় মায়দানে আয়োজিত লক্ষ লক্ষ মানুষের ঐতিহাসিক সমাবেশে ঘোষণা করলেন, “শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ দিয়ে আওয়ামী লীগ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে পারে না।” তিনি ঘোষণা করলেন যে, অবিলম্বে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সৈন্যদেরকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং ২রা মার্চ হতে ৬ই মার্চ পর্যন্ত যে সমস্ত ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে তাদের হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে – অন্যথায় আওয়ামী লীগ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে পারে না।

        পরবর্তীকালে ১৫ই মার্চ থেকে সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁ তার উপদেষ্টাদের নিয়ে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর উপদেষ্টাদের সাথে সুদীর্ঘ আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সকল শর্ত মেনে নিল এবং ২৪ কি ২৫শে মার্চের মধ্যে উহা ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দিল। কিন্তু আসলে এই দীর্ঘসূত্রতা অতি সংগোপনে সামরিক প্রস্তুতির বাহানা ছাড়া আর কিছুই নয়। রেডিওর ঘোষণা দূরে থাকুক আসলে ২৫ই মার্চ রাতে ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান নিয়ে হানাদার বাহিনী বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রথমে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা এবং বিভিন্ন রেজিমেন্টে যে সমস্ত বাঙালী অফিসার ও নিয়মিত বাঙালী আছে তাদেরকে নিরস্ত্র করে হত্যা করা এবং ই-পি-আর ও পুলিশ বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দেয়া। তাই তারা যেখানে সম্ভব হয়েছে সেখানে নিয়মিত বাহিনীর বাঙালীদেরকে হত্যা করেছে এবং ই-পি-আর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থানের ই-পি-আর পুলিশ বাহিনীর উপর সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। আজকে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ আমাদের বাঙালী ছেলেরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বন্দুক ঘুরিয়ে ধরেছে এবং দেশমাতৃকাকে হানাদারের কবলমুক্ত করার অগ্নিশপথে সারা বাংলার ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক-জনতা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের নির্দেশে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।  আজকে বাংলার প্রতিটি ঘর এক-একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছে। সেই জন্য মরিয়া হয়ে হানাদার বাহিনী নারী ও শিশু সমেত হাজার হাজার নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীকে হত্যা করে চলেছে। ইয়াহিয়া বাহিনীর এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের জন্য আমাদের মন ও প্রাণ শোকাপুত এবং অভিভূত।…

প্রিয় ভাই-বোনেরা

আজকে আপনারা সকলেই বিক্ষুব্ধ। বাংলার ঘরে এমন কোন পরিবার নেই যাদের কেউ না কেউ কোন না কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন নাই। বঙ্গবন্ধুর নামে আজকে আপনাদেরকে ডাক দিয়ে যাই-বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। এই স্বাধীনতা সংরক্ষণের দায়িত্ব আমার আপনার সকলের। মুক্তি বাহিনী আজ যথেষ্ট শক্তিশালী এবং দিন দিন এর শক্তি বেড়েই যাবে, কমবে না। আপনারা ধৈর্য ধরুন। বঙ্গবন্ধুর সুমহান নেতৃত্বে আমরা উদ্বুদ্ধ। একটি বাঙালী বেঁচে থাকা পর্যন্ত হানাদারদের রেহাই নাই। বাঙলা মায়ের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব কায়েম আমরা করবোই। বাঙালী হিসাবে জন্মেছি, বাঙালী হিসাবে বাঁচবো, বাঙালী হিসাবে আমাদের জীবনতরী বেয়ে যাবো আর বাঙালী হিসাবেই মরবো- এই মন্ত্রই হোক আমাদের যাত্রাপথের পাথেয়।

         পরিশেষে আমি বলতে চাই

                “আমাদের যাত্রা হলো শুরু

এখন ওগো কর্ণধার,

তোমারে করি নমস্কার।

এবার বাতাস ছুটুক, তুফান উঠুক

ফিরবো নাকো আর

ওগো কর্ণধার।”

আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন। জয় বাংলা।

(মিজানুর রহমান, এম-এন-এ)

২১ আগষ্ট, ১৯৭১

শেখ মুজিব আজ কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়- শেখ মুজিব আজ বাংলার ইতিহাস। বাংলার ২৩ বছরের রাজনীতি তথা সামাজিক উত্থান-পতনের সঙ্গে তিনি এক হয়ে মিশে গিয়েছেন। শোষণ ও পীড়নের রাজনীতিতে শেখ মুজিব এক আশ্চর্য প্রতিবাদ। প্রতিবাদ তিনি করেছেন সমস্ত জীবন ধরে, সমস্ত সত্তা দিয়ে। তিনি তাঁর পর্বতপ্রমাণ অটল সাহস ও মনোবল নিয়ে সবকিছু বাধা বিঘ্নকে অতিক্রম করে একক ভাবে বাংলার ইতিহাসে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

আজ সেই শেখ মুজিব, যাঁকে বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালী বঙ্গবন্ধু নামে আখ্যায়িত করেছিল এবং যিনি শুধু মুজিব ভাই বলে সবারই কাছে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং বিচারের নামে প্রহসন চলছে।

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার সন্তান। বাংলাদেশে জন্মেছেন, বাংলাদেশে লালিত-পালিত, বাংলাদেশকে ভালবেসেছেন এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছেন। শুধু তাই নয় বাঙালীর স্বার্থে বাঙালীর মুক্তি কামনায় নিজের জীবনের সুখ-শান্তি চিরদিনের মত বিসর্জন দিয়েছিলেন। সেই শেখ মুজিবকে বাংলাদেশে না রেখে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শোষক গোষ্ঠী সমস্ত রকমের আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়েও নিরীহ বাঙালীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাঁকে ১২০০ মাইল দূরে বন্দী করে রেখেছে। শুধু তাতেই তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করেনি। বাঙালীর কণ্ঠকে ও দাবীকে চিরকালের জন্য স্তব্ধ করার জন্য তাঁকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।…

এবারের এই বন্দীদশা তিনি অনায়াসে এড়াতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্রে, বিশ্বাস করতেন অহিংস আন্দোলনে। তিনি কোনদিন মনে-প্ৰাণে গ্রহণ করতে পারেননি যে, বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস। তিনি কোনদিন চাননি নিরস্ত্র, নীরহ জনসাধারণের রক্তে বাংলাদেশ রাঙা হোক। আগরতলা কেস থেকে মুক্তি পেয়েই রমনার রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, “আমি জনগণের রক্তের সঙ্গে বেঈমানী করব না, দেশের স্বাধীনতার জন্য দরকার হলে সবার আগে আমি রক্ত দেব”। তিনি নিজের ঘোষণার সম্মান দিয়েছেন। আজ তিনি ধৃত। আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধে তিনি সবার আগে তাদের হাতে ধরা পড়েছেন।

        আর আজ জল্লাদ ইয়াহিয়া বিচারের আসনে বসেছেন। কিন্তু কার বিচার কে করে? তাঁকে বিচারের অধিকার খুনী ইয়াহিয়ার নাই। শেখ মুজিব সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর আশা-ভরসার স্থল, তাদের একচ্ছত্র নেতা। স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া তাঁকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে অভিনন্দিত করতেও কসুর করেনি। আজ শেখ মুজিবুর রহমান যদি অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে ইয়াহিয়াকে তাঁরই হুকুমের তাঁবেদার হতে হতো। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে শেখ মুজিবের বিচার তিনি করতে বসেছেন। যদি বিচার করতেই হয় তাহলে এত গোপনীয়তা কেন? কেন আজ স্থানের নাম পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে? কেন বিচারকদের নাম জনগণকে জানান হচ্ছে না? কেন বাইরের কৌসুলী আসবার অনুমতি দেয়া হয়নি? শেখ মুজিব যদি দেশদ্রোহী বা দেশের শক্র হন তাহলে সাধারণ কোর্টে এবং সবার সামনে বিচার করার মত সৎসাহস থাকা উচিত ছিল।…

আজ পৃথিবীর শান্তিকামী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের কাছে আমাদের দাবী ও আবেদন তাঁরা যেন শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন বন্ধ করতে জল্লাদ ইয়াহিয়াকে বাধ্য করেন। শেখ মুজিবুর রহমান কোন একটি বিশেষ দেশের মানুষ নন। তিনি গণতন্ত্রের প্রতীক, তিনি নিপীড়ত জনগণের ত্রাণের প্রতীক। তাঁর জীবন রক্ষা

করার দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের লোকের নয়, তাঁকে রক্ষা করার দায়িত্ব শান্তিকামী প্রতিটি মানুষের। শেখ মুজিবকে হত্যা মানেই গণতন্ত্রকে হত্যা করা- সত্য ও ন্যায়কে আবর্জনার আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়া। বাংলাদেশের মা-বোনের তরফ থেকে আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই, তাঁর মত মহান নেতার কোন ক্ষতি আমরা সহ্য করবো না। এবং তাদের এই বলেই সাবধান করে দিতে চাই, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানের কোন লোককেই ক্ষমা করবে না।…

(বদরুন্নেসা আহমেদ, এম-এন-এ কর্তৃক

শেখ মুজিবের বিচার প্রসঙ্গে’ শিরোনামে লিখিত ভাষণ)

১৫ নভেম্বর, ১৯৭১

        বাংলাদেশের মানুষের উপর যখন ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী হিংস্র হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়লো, যখন বাংলার শ্যামল প্রান্তরে রক্তের প্লাবন বয়ে চললো, যখন বাংলার আকাশ নির্যাতিত মানুষ ও ধর্ষিতা মা-বোনদের আর্তণাদে বেদনাকরুণ, তখন পৃথিবীর মানুষের চোখে এক নিদারুণ বিস্ময় ঘনীভূত হয়ে উঠেছিলো। পরম বিস্ময়ে মানুষ দেখছিলো বিশ্ববিবেক যেন স্তব্দ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির সরকার, যারা  গণতন্ত্র এবং মানবতার নামে চীৎকারের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ, তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ।  শুধু তাই নয়, পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের এই রক্তপ্লাবী ঘটনাকে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার বলে একটা ধামাচাপা দেয়ার প্রচেষ্টারও অন্ত ছিল না। এদের মনোভাব দেখে এই সময়ে মনে হয়েছিলো ব্যবসার মুনাফার বেদীমূলে তারা মানবতাকেও বলি দিতে কুন্ঠিত নন। বাংলাদেশের ঘটনা যে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার নয় সেই সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো “লাখো লাখো আদম সন্তানের লাশের তলায় পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। পাকিস্তান আজ মৃত। রক্ত স্নানের মধ্য দিয়ে একটা নতুন জাতির জন্ম হয়েছে।” কিন্তু তার এই পরিষ্কার ঘোষণাটিও যেন তখন পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের মনে কোন সাড়া জাগাতে পারেনি। কিন্তু দেখা গেল মানবতাকে রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর মুক্ত মানুষের মন সোচ্চার হয়ে উঠলো বাংলার মানুষের স্বপক্ষে। ধিক্কার দিল তারা ইয়াহিয়ার জঙ্গী শাসক ও পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক চক্রকে। ব্যবসার মুনাফার গোলকধাঁধায় বাধা সরকার ছাড়া প্রতিটি দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালো।

ইংল্যাণ্ডের লিবারেল দলের M.P মিঃ রাসেল জনষ্টোন ৩১ মার্চে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বল্লেনঃ

“আমি বিশ্বাস করি না ইহাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া বৃটেন নীরব দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করিতে পারে। আমাদের চোখের সম্মুখে যে ঘটনা সংঘটিত হইতেছে তাহা চূড়ান্ত বর্বরতার নামান্তর মাত্র। শান্তি ফিরাইয়া আনা এবং মীমাংসার জন্য কমনওয়েলথের প্রধান সদস্য হিসাবে বৃটেনকে তাহার সমস্ত কিছুই করিতে হইবে।”

“Conflict in East Pakistan : Background & Prospect” শিরোনামে হার্বাট বিশ্ব বিদ্যালয়ের ৩ জন অধ্যাপক- মি: এডওয়ার্ড মেসন, রবার্ট ডফম্যান এবং স্টীফেন এ, মার্গলিন ১লা এপ্রিল তারিখে লিখলেনঃ

“স্বাধীন বাংলাদেশ অবশ্যম্ভাবী। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম, বাংলাদেশ হবে একটি সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু প্রশ্ন হল এই স্বাধীনতার জন্য তাকে কত রক্ত ঢালতে হবে।”

 History of Economics & Political Domination of East Pakistan পত্রিকায় Herbert বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপন সোসাইটি লিখলেন, “বাংগালীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ লড়ছে।

এই যুদ্ধে তাদের জয় সুনিশ্চিত। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের কত প্রাণ দিতে হবে এবং তাদের কত সম্পদ ধ্বংস হবে।”

 ৯ই এপ্রিল নেপালের ‘অৰ্পন’ পত্রিকা বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করলো,“ইহা পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় আজ শুধুমাত্র কল্পনা নয়, একটি বাস্তব সত্য।”

১৩ই এপ্রিল তুরস্কের পত্রিকা আকসাস লিখলো, “পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানীরা স্বাধীনতার যুদ্ধ লড়ছে।” ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পত্রিকা ১৫ই এপ্রিল লিখলো, “পূর্ব পাকিস্তানীরা আর পাকিস্তানী নামে পরিচিত হইতে ইচ্ছুক নয়। তারা বাঙালী- এই পরিচয়ই গ্রহণ করেছে। কারণ আজ পাকিস্তানী’ শব্দ দ্বারা তারা মনে করে একদল সৈন্য, যারা তাদের লোকজনকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে।”

৩০শে মার্চ চিকাগো ট্রিবিউন লিখলো, “পৃথিবীর যে অংশটি একদিন ভিয়েতনামের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুখর ছিল, সেই অংশে আজ শত-সহস্ৰ লোককে মেশিনগানের গুলিতে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। ভিয়েতনামে গত ৪ বছরে যত লোককে হত্যা করা হয়নি তার চেয়েও অধিক লোককে মাত্র ৪ দিনে হত্যা করা হয়েছে।”

৭ই এপ্রিল নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা লিখলো, “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা করছে, চাক্ষুষ দর্শীর এই বিবরণ সত্ত্বেও ওয়াশিংটনের এই নিস্ক্রিয়তা এবং নিরবতা মানুষের কাছে নিশ্চয় পীড়াদায়ক। বাংলাদশের এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধ প্রতিবাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চয় একটি মানবিক দায়িত্ব রয়েছে।

শুধুমাত্র এই কয়েকটি পত্রপত্রিকাই নয়, লণ্ডনের ডেইলি মেইল, ডেইলি টেলিগ্রাফ, New Statesman. Sunday Times. London- এর Time পত্রিকা, গার্ডিয়ান, Sunday Telegraph. Newsweek. Christian Monitor. Washington Post. Ockland Tribune. Bultimore Sun. Otowa Citizen. চিলির আলমারকিউরিও, ব্রসেলসের লা লিব্রা, জাপানের Time পত্রিকা, আরব রাষ্ট্র কুয়েতের আকবর- আল- কুয়েত, সিরিয়ার আল তাউরা, রাশিয়ার প্রাভধা ইত্যাদি সমস্ত পত্রিকায় পৃথীবির মানবতাকামী মানুষ ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানালেন, স্বাধীনতাকামী বাংলার মানুষকে জানালেন আন্তরিক সমর্থন।

        হিমালয়ের ঘুম ভাঙলো। পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য দেবার বিরুদ্ধে আমেরিকার সিনেটে প্রতিবাদের ঝড় তুললেন সিনেটর কেনিডি। শ্রমিকরা পাকিস্তানী জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করতে অস্বীকার করলেন। আমেরিকার বৈদেশিক সাহায্য কমিটি পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য বন্ধ করার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করলেন।

        বৃটেন, ফ্রান্স, পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য প্রদান বন্ধ করার কথা ঘোষণা করলো। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন গণহত্যার নিন্দা করে গণহত্যা বন্ধ করার দাবী জানালেন।

 এবার বাংলাদেশর সপক্ষে এগিয়ে এলো উত্তর কোরিয়া ও উত্তর ভিয়েতনাম। সংগ্রামী উত্তর ভিয়েতনাম ঘোষণা করলোঃ “বাংলাদেশের যুদ্ধ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ।” বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে তারা পূর্ণ সমর্থন জানালেন- কিন্তু দৃষ্টি নিবদ্ধ রইল চীনের প্রতি। ইয়াহিয়া বার বার হ্রেষা ধ্বনি করছিল,”চীন আমাদের সাথে”।   চীনের কণ্ঠ নীরব। অবশেষে চীন মুখ খুললো ভুট্টোর চীন গমন উপলক্ষ ভোজসভায়। বিভ্রান্ত ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত হিসাবে মানবতার ইতিহাসে অন্যতম জঘন্য অপরাধী ভুট্টো গিয়েছিলো চীনের সমর্থন আদায়ের জন্য।

        ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো চক্ৰ মনে করেছিলো চীন তাদের কুকর্মকে সমর্থন জানাবে, কিন্তু চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিন প্রকৃতপক্ষ ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মুখে চপেটাঘাত করলেন। ভোজসভায় চীনের অস্থায়ী

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টোকে পরামর্শ দিলেন পূর্ব বাংলা সম্বন্ধে একটি যুক্তিসম্পন্ন মীমাংসা করতে। শুধু তাই নয়, চীন ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রের সমস্ত প্রচারণার মুখে পদাঘাত করলেন।

১১ই নভেম্বর

B.B.C.-র খবরে প্রকাশ, চীন পাকিস্তানকে সংযত হওয়ার জন্য উপদেশ দিয়েছে। চীন বলেছে, “কোন অবস্থাতেই ভারত আক্রমণ করা পাকিস্তানের উচিত হবে না। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান বাংলাদেশ সমস্যাকে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার আকারে নিরাপত্তা পরিষদে তোলার আবেদন জানিয়েছিলো। চীন তার সেই আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছে। চীনের এই কথার অর্থ এই দাঁড়ায়, চীন পাকিস্তান সরকারের কার্যাবলী সমর্থন করতে প্রস্তুত নয় এবং ইয়াহিয়ার রণহুঙ্কারকেও চীন অসার ও অযৌক্তিক মনে করে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যাকে চীন পাকভারত সমস্যা হিসাবে দেখতে রাজী নয়। এইদিকে মার্কিন সরকারও পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রয়ের লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছে। এর ফলে আজ ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার সারা বিশ্ব অসহায় এতিমের পর্যায়ে নেমে এসেছে। অন্যদিকে বিশ্ববিবেক সোচ্চার হয়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলার মানুষের সপক্ষে। বাংলার দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনী আঘাতের পর আঘাত হেনে চলেছেন। তাদের ক্ষীপ্রতায় এবং প্রচণ্ডতায় হানাদার বর্বর পাক বাহিনী দিশেহারা। সেদিনের স্বল্প অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিবাহিনী আজ বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট হয়ে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং দুর্ধর্ষ শত্রু টিকেও নিশ্চিহ্ন করার জন্য। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় বাংলা।

(জিলুর রহমান, এম-এন-এ)

১৭ নভেম্বর, ১৯৭১

প্রিয় ভাইবোনেরা, আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহণ করুন। বিগত প্রায় আট মাসাধিককাল যাবৎ আমরা সবাই মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত আছি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ মুক্তিসংগ্রামে শরীক হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কোরবানী দিয়েছে কোন না কোন ভাবে। মুক্তিযুদ্ধ ও সাধারণ সাম্রাজ্যবাদী বা সম্প্রসারণবাদী যুদ্ধের পার্থক্য এই যে, সাম্রাজ্যবাদী বা সম্প্রসারণবাদী যুদ্ধে দেশের জনসাধারণকে জোর করে যুদ্ধের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়; বেতনভোগী (Mercenary) সৈন্যরা দায়ে পড়ে অথবা পদের লোভে বা প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়। আর মুক্তিযুদ্ধে দেশের আপামর জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরীক হয়- সুশিক্ষিত, অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত সৈন্যরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শত্রুসেনাকে খতম করার জন্য মাতৃভূমিকে শত্রুকবল হতে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধ করে। আমাদের বাংলাদেশের বাহাদুর বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার ও মোজাহেদ বাহিনী, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংস্থার সংগ্রাম পরিষদের বাহাদুরেরা প্রথমে এরূপ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমরনায়ক ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের হানাদার দস্য্যুবাহিনীর বর্বর আক্রমণ রুখে দাঁড়িয়েছে। দেশের সর্বস্তরের নরনারী, ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-মজদুর তথা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে পরবর্তীকালে এই চরম সংগ্রামে শরীক হয়েছে- কেহ সক্রিয়ভাবে, কেহ পরোক্ষভাবে, সক্ষম যুবকেরা অস্ত্রের মাধ্যমে এবং শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী ও কূটনীতিবিদ সাধ্যমত তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা ও প্রতিভার মাধ্যমে। কাজেই একথা বলা ঠিক নয় যে, মুক্তিযুদ্ধ কারও একার কর্তব্য। অবশ্য যুগে যুগে মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে বেঈমান, সুবিধাবাদী, বা ‘কুইসলিং মীরজাফরদের যেমন ভূমিকা ছিল, আমাদের এই সংগ্রামেও

মীরজাফরেরা তেমন নিক্রিয় নয়। দেশবন্ধু তাই একসময়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “পরাধীন দেশের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এই যে, মুক্তিসংগ্রামে বিদেশীদের অপেক্ষা দেশের লোকদের সঙ্গেই মানুষকে যুদ্ধ করতে হয় বেশী।” সোনার বাংলার লক্ষ লক্ষ নীরিহ ‘মাসুম নরনারী, শিশু, যুবক-যুবতীকে নির্বিচারে হত্যার অপরাধে, লক্ষ লক্ষ নারীর শ্লীলতাহানি ও সতীত্ব নষ্ট করার অপরাধে, বাংলার কোটি কোটি টাকার ধন-সম্পদ বিনষ্ট করা, লুটপাট ও চুরি-ডাকাতির অপরাধে, প্রায় ৯৫ লক্ষ নরনারী-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করার অপরাধে এবং অপর প্রায় ২ কোটি লোককে গৃহহারা-বাস্তুহারা এবং ছিন্নমূল করার অপরাধে, লক্ষ লক্ষ কর্মক্ষম ব্যক্তিকে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ হতে বঞ্চিত করা তথা চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করার অপরাধে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ভুট্টো-হামিদ যেমন অপরাধী- তেমনি এই জলল্লাদচক্রের ক্রীড়নক সহযোগী মাহমুদ আলী, ডাঃ মালিক, নুরুল আমীন গং এবং তাদের প্রত্যেকটি সক্রিয় সমর্থক ও তাঁবেদারগণও সমভাবে অপরাধী এবং সমভাবে শাস্তির যোগ্য। ফৌজদারী দণ্ডবিধি আইনের বিধানানুসারে হত্যাকরী এবং তার সহযোগীকে একই আইনে ফাঁসি দেয়ার বিধান চালু আছে। সহযোগী বা নর হত্যাকারীর সম্পর্কে আইনে বলা আছে,  As if he himself Committed murder- অর্থাৎ, সহযোগী যেন নিজেই খুন করেছে। কাজেই ইয়াহিয়া চক্রের দালালদের সম্পর্কে এই চালু ফৌজদারী  দন্ডবিধি আইন সম্পূর্ন প্রযোজ্য। বন্ধুগন, “Truth shall prevail” -এটা universal truth বা সার্বজনীন সত্য- অর্থাৎ সত্যের জয় হবেই, আমাদের পবিত্র কোরানেও আছে-

 قل جاء الحق وزهق الباطل ان الباطل كان زهوقام

অর্থাৎ “সত্য সমাগত- মিথ্যা অপসৃয়মাণ, এবং মিথ্যা অবশ্যই ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে।”

         আমাদের এই আজাদীর সংগ্রাম মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, জালেমের বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বঞ্চিত মজলুমের সংগ্রাম। আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ভাষা‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ” এই যুদ্ধে ইনশাল্লাহ আমরা কামিয়াব হবই। আমাদের মনজিলে মকসুদে আমরা পৌছবই।

        দুনিয়ার সমস্ত আজাদীর ইতিহাসে দেখা যায় স্বাধীনতা “অর্জন করা হয়েছে”। স্বাধীনতার জন্য লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিক কোরবান হয়েছে, নানাভাবে আজাদী পাগল মানুষ নির্যাতন ভোগ করেছে- কিন্তু শির দিয়েছে তবু আমামা দেয়নি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে ফাঁসির রজ্জ্ব বরমাল্যের মত কণ্ঠে বরণ করে আজাদীর জয়গান গেয়েছে, তবুও জাতির স্বাধীন সত্তাকে বিলিয়ে দেয়নি- স্বাধীন পতাকাকে অপমানিত হতে দেয়নি। ইতহাসে মহাচীন, আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, আলজেরিয়া যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ করে স্বীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কেহই স্বাধীনতা দান হিসাবে বিনা রক্তপাতে পায়নি। অবশ্য ওদের মুক্তিসংগ্রামে সহায়তা পেয়েছে সভ্য জাতির নিকট হতে, সক্রিয় বা পরোক্ষ সমর্থন পেয়েছে। আমরাও আশা রাখি, দুনিয়ার সমস্ত সভ্য দেশ হতে সাহায্য সমর্থন পাবো। পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্পর্কে অনেকের হয়ত ভ্রান্ত ধারণা যে, মেহেরবানী করে বৃটিশ সরকার আমাদিগকে স্বাধীনতা দান করে গিয়েছেন। বাস্তবপক্ষে কি তাই? ১৮৫৭ ইং সনের সিপাহী বিদ্রোহ, ক্ষুদিরাম, ভগৎসিং এবং হাজার হাজার সিপাহীর ফাঁসির কি কোন দাম নেই? নেতাজী সুভাষ বসুর পরিচালনায় বার্লিন, সিঙ্গাপুর, মালয়, বৰ্মা ও বিভিন্ন স্থানে যে প্রায় পঞ্চাশ হাজার আজাদ হিন্দু ফৌজ গঠন করা হয়েছিল, তা কি কম চাঞ্চল্যকর? মনিপুর ও ইম্পল অপরেশনে যে প্রায় ছয় হাজার আজাদ হিন্দু ফৌজ (INDIAN NATIONAL ARMY) অনাহারে-অর্ধাহারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, এবং ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ সন পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে মিত্র পক্ষ তথা ব্রিটিশ আর্মির হাতে যে বিভিন্নভাবে প্রায় ২০ হাজার আজাদ হিন্দু ফৌজ বন্দী হয়েছিল, নির্যাতন ভোগ করেছিল বা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল, তা কি এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায়নি? বৰ্মা, রেঙ্গুন, সুমাত্রা, সিঙ্গাপুর, জার্মানী, জাপান ও অন্যান্য স্থানের লক্ষ লক্ষ ভারতীয় (তদানীন্তন) নাগরিকগণ কেহ কেহ তাদের সমস্ত ধন-সম্পত্তি ও কোটি কোটি টাকা এবং কেহ কেহ

মোট সম্পদের একটা অংশ INA ফৌজকে দান করেছিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির Kin’s Commission, প্রাপ্ত  Major G.S. Dillon, শাহনাওয়াজের মত শত শত কমিশন্ড অফিসার এবং হাজার হাজার জোয়ান ব্রিটিশ সরকারের চাকরি ও নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের স্রোতে নিজদেরকে নিক্ষেপ করে আজাদ হিন্দু ফৌজে যোগ দিয়েছিল। ICS পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করেও নেতাজী সুভাষ বসু যে চাকরি ত্যাগ করেছিলেন, তা কি বৃথা গিয়েছে? বস্তুতঃ এই সব বীরত্ব ও আত্মত্যাগ উপমহাদেশের আজাদী লাভকে ত্বরান্বিত করেছিল।

        আমার প্রিয় ধর্মভীরু দেশবাসীকে বলা প্রয়োজন যে, মিঃ জিন্নার পাকিস্তানের স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে। এবং এটাকে অপমৃত্যু বলা চলেনা। অবশ্য পাকিস্তানের জন্মটাকে কিছুটা অস্বাভাবিক বলা চলে। কাজেই এর প্রতি আর কারও কোন মোহ থাকা উচিত নহে? পাকিস্তানরূপী যে শিশুকে তিওয়ানা-নসরুলা কোম্পানীর আকবার-আহরার পার্টি তথা পশ্চিম সামন্ত বাদ চক্র জন্ম দিতেই চায়নি, তারাই পরবর্তীকালে স্বীয় বুর্জোয়া  স্বার্থে সে শিশুর দাবীদার সেজে প্রকৃত জন্মদাতা তথা নিরীহ ধৰ্মভীরু বাঙালীকে বিগত ২৪ বৎসর ধরে নানাভাবে শোষণ ও নির্যাতন করেছে। ইসলাম, সংহতি ও মুসলমানের নামে বহু অনৈসলামিক কারবার বেঈমানী ও ধোঁকাবাজি করেছে। ব্যবসায়ী স্বার্থে, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে তারা ভাই বলে মুখে প্রচার করেছে কিন্তু পূর্ববঙ্গের মানুষকে কোনদিন তারা হৃদয়ে স্থান দেয়নি। লক্ষ লক্ষ বাঙালী বন্যায়-জলোচ্ছাসে-ঘূর্ণিঝড়ে শিয়ালকুকুরের মত প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা শোষকচক্র, কখনও শোষণের যাতাকল বন্ধ করেনি। ১৯৬৪ সনে যখন পূর্ববাংলার এক মহকুমায়ই ১৮ হাজার লোক একরাত্রে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে প্রাণ হারিয়েছিল তখন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান সফর করতে পূর্ববঙ্গে না এসে লণ্ডনে বেড়াতে গিয়েছিলেন। লণ্ডনের পত্রপত্রিকা ব্যঙ্গ করে লিখেছিলঃ 18 thousand people died, who cares? অর্থাৎ বিগত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালীতেই যখন প্রায় ১০ লক্ষ নরনারীর মৃত্যু হয়েছিল, লক্ষ লক্ষ গৃহহারা সর্বহারা নরনারীর অগণিত মৃতদেহ পদ্মা-মেঘনা-যমুনাতে এমনকি বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছিল- তখন আমাদের গরীবের ট্যাক্সের টাকায় কেনা Gunboat, Helicopter কোথায় ছিল? তদানীন্তন গভর্নর এডমিরাল আহসান বলেছিলেন, “আমি Islamabad-এর কাছে Helicopter চেয়েছিলাম- কিন্তু পাইনি।” সেই নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসলীলা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্কারী দুর্যোগ। লক্ষ লক্ষ দুর্দশাগ্রস্ত আদম সন্তানের করুণ আর্তনাদে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। ভারতসহ দুনিয়ার প্রায় সব রাষ্ট্র হতে সাহায্য-সম্ভার এসেছিল, হেলিকপ্টার এসেছিল। তখনও পিণ্ডি-ইসলামাবাদশাহীর হৃদয় বিগলিত হয়নি। শত শত নর-নারীকে, স্ত্রী ও পুরষকে একসাথে কবরস্থ করা হয়েছিল। এমনকি হিন্দু-মুসলমানকে একসাথে এক গোরে দাফন করা হয়েছিল-কারণ দাফনের কাপড়েরও অনটন হয়েছিল। Gunboat ছিল না, অর্থ ছিল না। এক ফোঁটা পানি, এক মুঠো অন্ন ও লজ্জা নিবারণে এক টুকরো কাপড়ের জন্য লক্ষ লক্ষ আদম সন্তানের করুণ আর্তনাদে সারা দুনিয়া বিগলিত হয়েছিল, সাহায্য-সম্ভার নিয়ে এগিয়ে এসেছিল কিন্তু বিগলিত হয়নি আদমজী, ভালিকা, আমীর আলী, ফেন্সী, দাউদ ও গান্ধারা গোষ্ঠীর তথা পশ্চিমা ২২-পরিবারের হৃদয়। এর পরও আপনারা এদের ইসলামী দরদের ধোঁকামিতে বিশ্বাস করেন? এদের ইসলাম শোষণের যন্ত্রবিশেষ। আসলে এরা ইসলাম মানে না। ১৪ শত বৎসর পর্যন্ত প্রতি জুম্মাতে, ঈদে আপনারা খোতবায় শোনেন

   والإحسان بالعدل يأمر الله ان (ইন্নালাহা ইয়া’মুরু বিয়াদাল ওয়া ইহছান)

 -আল্লাহ ‘আদাল’ ও এহছানের কথা তথা ন্যায়বিচার ও ইনছাফের কথা, মঙ্গলের কথা বলেছেন; আর এই লুটেরা দস্যুরা পাক কোরানের এই নির্দেশ অমান্য করে যুগ যুগ ধরে বেইনসাফ ও বেঈমানী করেছে। ভাইসব, দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রই শুধু ধর্মীয় বন্ধনের নামে বা দ্বিজাতিতত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। জোর করে অবাস্তব ও অসম্ভবকে বেশীদিন টিকিয়ে রাখা যায় না। তাই বহুদিন জোড়াতালি দেওয়ার পর নকল পাকিস্তানের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আর যদি কেহ মনে করেন পাকিস্তানের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, তজ্জন্যও বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ বা পূর্ববঙ্গবাসী দায়ী নহে।

বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত  Artificial Heart Transplantation করে কোন রকমে জোড়াতালি দিয়ে পকিস্তানকে জিইয়ে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অকস্মাৎ ২৫শে মার্চের গভীর রাতে জেনারেল ইয়াহিয়া টিক্কাখান-ভুট্টো চক্ৰ বেয়নেটের খোঁচায় পাকিস্তানের অপমৃত্যু ঘটিয়েছে। এর জন্য এককভাবে তারাই দায়ী। তারপর ১০ লক্ষাধিক বাঙালী নরনারী-শিশু-যুবক-যুবতী-মা-ভাই-ভগ্নির তাজা রক্তস্রোতের অতল তলে পাকিস্তান নিমজ্জিত হয়েছে-ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এর প্রাণরক্ষা আর সম্ভব নহে। ইসলাম Universal -আল্লাহ সবার। আমরা ‘আলহামদুলিল্লাহ রাবিবল আলামীন’- অর্থাৎ সব প্রশংসা তাহার জন্য যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন’….

মোট কথা, ইসলাম  Co-existence, Co-havitation ও Compromise-এর ধর্ম। এক কথায় ইসলামের মর্মকথা Secularism-এর মর্মকথা। কাজেই আমরা স্বাধীন বাংলদেশ গড়ে তুলবো এমন এক সমাজব্যবস্থা যা হবে সার্বজনীন- Universal and Secular-যাতে থাকবে হিন্দু-মুসলমান-ধৃষ্টান-বৌদ্ধ, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমান অধিকার। থাকবে না মানুষে মানুষে কোন বিবাদ-বিচ্ছেদ, কোন ভেদাভেদ। আর আমাদের এই মহান মূলমন্ত্রের হোতা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী তথা দুনিয়ার সমস্ত মজলুম বঞ্চিত মানবতার অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

         ভাগ্যের পরিহাস, তিনি আজ জোনরেল ইয়াহিয়ার কারাগারে আটক, আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালী সাবধান করে দিতে চাই- বঙ্গবন্ধুর কোন ক্ষতি সাধিত হলে সমগ্র বিশ্ব দাবানলের অগ্নির মত দাঊ দাঊ করে জ্বলে উঠবে। এখনও সময় আছে জেনারেল ইয়াহিয়া, তাকে এখনই মুক্তি দাও-নচেৎ শুধু তোমার পাকিস্তান নয় অচিরেই তুমিও ধ্বংস হয়ে যাবে। জয় বাংলা।

(আবদুল মালেক উকিল,এম-এন-এ)

Scroll to Top