বগুড়ায় পাক বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের উপর ২টি প্রতিবেদন

৪০। বগুড়ায় পাক বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের উপর ২টি প্রতিবেদন (৪২৬-৪২৯)

সূত্র – সংবাদ, ২ ও ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২

প্রতিদিন বধ্যভূমি থেকে ভেসে আসতো মানুষের মরণ চীৎকার
সাধুবাবা আতঙ্কে বিহব্বল হয়ে তাই শুনতেন

আজ থেকে প্রায় সত্তর আশি বছর আগের কথা। আমাদের গুরু এসে আস্তানা পেতেছিল বগুড়া জেলার বাগাবান কারবার একটি বটগাছের ছায়ায়। বগুড়া শহরে বলতে তখন কিছুই গড়ে ওঠেনি। একটা তিনের ঘরে থানা এবং ফুলবাড়ীর রমজান মণ্ডলের একটি কাঠের কারখানা বোধহয় ছিল। আজকের সাত-মাথা তখন ছিল গাছপালা আর জঙ্গলে ভরা। আমাদের গুরু আনন্দ গোস্বামী এবং ভেরেণ্ডা গোস্বামী এই পৃথিবী ছেড়ে অনেক পূর্বেই বিদায় নিয়েছেন কিন্তু সেদিন এক সঙ্গে চলে গেল আমার তিন ভাই। হাত বেঁধে বগুড়ার সেউজাগড়ির আনন্দ আশ্রমে সকাল বেলা বসে বসে এই সাধুবাবা সব ঘটনা বলেছিলেন।

হানাদার পাক বাহিনী বগুড়া দখল করা পরও আশ্রমে চারজন সাধু ও তিনজন মাতা ছিলেন। হানাদার বাহিনীর তিনজন সাধুকে বগুড়া রেলস্টেশনের পশ্চিম দিকে ডিগ্রি কলেজ সড়কের পার্শ্বে গুলী করে হত্যা করে। এদের ভিতর ছিলেন সুন্দর সাধু, মঙ্গল সাধু এবং স্থানীয় বাদুরতলার একজন বৃদ্ধ মুনেন্দ্রনাথ সরকার। তিনজনই ছিলেন বগুড়ার প্রাক্তন অধিবাসী। এই তিন সাধু বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন সাধুবাবা। বগুড়া অতীত ইতিহাসকে বুকে নিয়ে এই সাধু বাবা আজও বেঁচে আছেন। বগুড়ায় এমন লোক কমই আছেন যারা এই সাধুবাবাকে চেনে না। পাক দস্যুদের জঘন্য নৃশংসতার পরও আজ সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আছেন এই সাধুবাবা।
যুগোল কিশোর গোস্বামীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি বাঁচলেন কেমন করে?
হেসে তিনি বললেন- ওরা আমাকে কেন যে হত্যা করেনি তা আমি বলতে পারবো না। আমরা তিনভাই তখন খেতে বসেছিলাম। হঠাৎ সেই মুহূর্তেই বাড়ীর ভিতরে ঢুকল কয়েকজন আবাঙ্গালি। ওরা আমার ভাইদের খেতে দেয়নি। এসেই ভাইদের হাত বেঁধে ফেললো। ওদের নিয়ে যাওয়ার সময় আমি বললাম, আমাকে মারো, ওদের নিয়ে যেয়ো না। বৃদ্ধ বলেই বোধহয় আমাকে ওদের সঙ্গে নেয় নি। কিন্তু আমার ভাইয়েরা আর ফিরে আসেনি। একদিনকে ধাঙ্গড় এসে আমাকে জানালো, পাক সেনারা রাস্তার ধারের গর্তে আমার ভাইদের পুঁতে রেখেছে।
সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা সবাই আগে পালালেন না কেন?
সাধুবাবা প্রত্যুত্তরে বললেন, সে অনেক কথা বাবু। প্রায় সকলেই কখন শহর ছেড়ে চলে যান। ভক্তরা এসে আমাদের অনেক অনুরোধ করেছে। কিন্তু সংঘের সাধুর মাতারা নিষেধ করেছিল। আমরা কারো অন্যায় করিনি। ওরা নিষ্ঠুর ওরা কাল, ওরা অনেক অন্যায় করেছে- কথা বলতে বলতি মিষ্টভাষী সাধুবাবার মুখ চোখ লাল হয়ে উঠেছিল। সাধুবাবা বললেন, ওরা আমাকেও ছাড়েনি। মাঝে মাঝেই পাক সেনারা আশ্রমে অন্যায়ভাবে প্রবেশ করতো। আমার সামনে বন্দুক ধরে বলতো, টাকা কাঁহা টাকা দো- ওরা আমরা পাঁচশত টাকা আগেই নিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও আসতো টাকার খোঁজে। এই দেখুন আমার পিঠে রড দিয়ে অনেক মেরেছে। সবসময় ওরা আমাকে ছোরার ভয়ে কাবু রেখেছে। একদিন ওরা আমাকে মন্দিরের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো- কুয়া কাঁহা হায়? আমি ভেবেছিলাম ওরা এবার আমাকে মেরে ফেলবে। ওরা আমাকে বললো, বুডডা তুম কালেমা পড়। এরপর হঠাৎ জানিনা ওদেরকি মনে হওয়াতে আমাকে ছেড়ে দিল। আমি বেঁচে আছি, কিন্তু ওরা আমাকে যেমন অত্যাচার করেছে,তাতে বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্য।

জানতে চাইলাম, নয়টি মাস আপনার ও মাতাদের খাবার সংগ্রহ করলেন কোত্থেকে? তিনি বললেন অনেক কষ্ট করেছি। ভিক্ষেও করেছি। পাশের গ্রামে গিয়েছি। একটু আধটু যা পেতাম তাই খেয়ে বাঁচতাম। আমাদের দশ মণ চাল, ৮টা গরু, প্রায় হাজার টাকার বাসনপত্রাদি সব লুট করে নিয়ে গেছে ওরা। চোখের সামনে দেখতাম কিন্তু কিছুই বলতে পারিনি। মাঝে মাঝে ভক্তরা গোপনে কিছু সাহায্য দিয়ে যেত। তাই দিয়ে চালিয়ে নিয়েছি।

আশ্রমের পূর্বদিকের বাগানে দেখিয়ে সাধুবাবা বললেন- ঐ যে ওখানে একটা বদ্ধ কুপ আছে। প্রায় প্রতিদিনই করুন কান্নার আওয়াজ আমি শুনেছি। একদিন এক ছোট শিশু, বাবা, মা, বাঁচাও বাঁচাও করে চিৎকার করছিল। ঐ ছেলেটাকে জবাই করে কুপে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমি প্রায় প্রতিদিনই এরকম চীৎকার শুনেছি। সাধুবাবার অনুরোধে আমি বদ্ধকুপে হিংস্রতার অনেক চিত্র দেখেছি। আজো এই বাগানের একটি ঘরের দেয়ালে দেয়ালে মানুষের রক্ত লেগে আছে। কুপে নরকংকাল আর মাথার খুলিগুলো এখনো দেখা যায়। কত নিরাপরাধ, নিষ্পাপ মানুষ এখানে জল্লাদের হাতে বলি হয়েছে কে তার হিসাব দিতে পারে?

বগুড়া শহরের অতি পুরাতন এবং সবার পরিচিত সাধুর আশ্রম আজ আবার ভক্ত আর গুনগ্রাহীদের আগমন ভরে উঠেছে। কিন্তু আশ্রমের সেই পরিচিত মুখগুলো আর নেই। জিজ্ঞেস করলাম দেশ সম্বন্ধে। আপনি কি ভাবছেন? উত্তরে তিনি শুধু বললেন, ওরা খুবই বেআইনী কাজ করেছে। ওরা গণভোট মানে না। শেখ মুজিবকে ক্ষমতা না দিয়ে তারা খুবই অন্যায় করেছিল। ওরা অত্যাচারী। অত্যাচারীকে শাস্তি ভোগ করতেই হবে।

আশ্রমের মন্দিরে গুরুদের আস্তানা দেখিয়ে সাধুবাবা বললেন, আমার হারিয়ে যাওয়া ভাইয়েরা এমনিভাবেই থাকত। কিন্তু দস্যুরা তাদের নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে। মাথায় তার ছোট জুটি বাঁধা। সামান্য সাদা কাপড়ের একটি গামছা তার পরনে। তিনি বললেন, পরের অন্যায় করা আমাদের নীতি নয়। তবুও ওরা আমাদের মেরেছে। বৃদ্ধ সাধু যুগোল কিশোর গোস্বামীই শুধু তার ভাইকে হারান নাই, বগুড়াবাসীও হারিয়েছে তাদের পরিচিত শ্বেতবস্ত্রধারী তিনটি ভাইকে। তারা আর আসবে না।

= বগুড়া রেলস্টেশনে চারপাশেই ছিল জল্লাদের কসাইখানা =

তখন জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। রাত্তিবেলা শুয়ে আছি। হঠাৎ ইন্টার ক্লাশ ওয়েটিং রুম থেকে ভেসে আসলো মানুষের করুন আর্তনাদ। ‘আমাকে বাঁচাও’ করে কে যেন চিৎকার করছিল। একটু পরেই থেমে গেল বুঝলাম সে আর নেই।
কথাগুলো বলতে বলতে শিউরে উঠেছিলেন বগুড়া রেলওয়ের একজন পদস্থ বাঙ্গালী কর্মচারী। জানতে চাইলেম আপনি দস্যুদের আর কি নৃশংসতা দেখেছেন। উত্তরে তিনি জানালেন, কি দেখি নাই বলুন। ওরা সব করেছে। বাঙ্গালীরা সবাই ছিল ওদের শত্রু কেননা, যে বাঙ্গালীই রেলস্টেশনের আশেপাশে আসতো তাঁকেই তারা হত্যা করেছে। একদিন একজন নিরীহ বাঙ্গালীকে দিয়ে কয়েকজন মিলিটারি তাদের মালপত্র ট্রেনে উঠালো। তারপর কাজ শেষ হলে শুরু হলো তার উপর আমানুশিক অত্যাচার। একজন মিলিটারি লোকটাকে ওয়াগনের পিছনে দু’পা সমান করে পায়ের সঙ্গে মাথা লাগিয়ে বসিয়ে রাখলো। তারপর একজন উঠলো তার পিঠের উপর। জোর করে ওরা জীবন্ত মানুষটার হাড়গুলো এমনি করে ভেঙ্গে দিল। মানুষটার অনুরোধ আর মিনতি ওরা শুনে নাই। এরপর লোকটাকে আর ভাইদের মত হত্যা করা হলো। পাক দস্যুরা স্টেশনের আশপাশে অহরহই মানুষদের এমনি নিষ্ঠুরভবে অত্যাচার করে হত্যা করতো।

জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের ওরা কিছু বলেন নাই? উত্তরে তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের অংশ নেওয়ার বাঙ্গালী কর্মচারীদের ওরা ক্ষমা করে নাই। যারা সরতে পারে নাই তাদের মৃত্যু ছিল ওদের হাতে।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বললেন, একদিন মেজর জাকি সামরিক হেডকোয়াটারে আমাকে ডাকলো। তারপর পাশের রুমে থেকে রক্তমাখা কাপড় পরিহিত একজন বাঙালিকে ডেকে আনা হলো। তার হাত বাঁধা ছিল এবং মুখ ছিল রুমাল দিয়ে বাঁধা আমাকে মেজর বলল-এ দেখো। এরপর কড়া মেজাজে হুকুম হলো- আভি তোম যাও। আমি মেজর জাকির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি বটে, কিন্তু ঐ রক্তমাখা ভাইটি বেঁচে আছে তিনা জানি না। শেষের দিকে ওরা রেলওয়ের বাঙালি কর্মচারীদের হত্যা করারও ষড়যন্ত্র করেছিল। রেলস্টেশনের আশপাশে নিরীহ বাঙ্গালীদের হত্যা করেও ওদের রক্ত পানের তৃষ্ণা তখনও মেটেনি। বগুড়া ছাড়ার পূর্বেই ওদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হাওয়ায় আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু রেলস্টেশনের বধ্যভূমিতে হারিয়ে যাওয়া ভাইরা আর আসবে না। রেলস্টেশনে সুইপার দশন জমাদাঁর সতর্কতার ইঙ্গিত দিয়ে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু এই যুদ্ধের ৭টি মাস কেটে গেছে স্টেশনের আশপাশের মৃত বাঙ্গালীদের কবর দিতেই।

= দশীন জমাদার =

বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনের একজন সুইপার। বয়স প্রায় ৭০ বছরের বেশী। এই বৃদ্ধ তার সাতটি মাস কাটিয়ে দিয়েছে বর্বর পাক দস্যুদের হত্যা করা লাশ সরিয়ে। দস্যুদের হত্যাযজ্ঞের সে একজন নীরব সাক্ষী।

“আমি পূর্বে আরো মোটাসোটা ছিলাম স্যার। আমি লাল টক টকে ছিলাম। কিন্তু বগুড়া স্টেশনের আশপাশের বাঙ্গালি ভাইদের রক্ত দেখে দেখে আমি খুব রোগা হয়ে গেছি। আমার শরীরে আগের মত মাংস নেই। আপনিই বলুন, একজন মানুষ শত শত রক্ত মাখা লাশ সরালে আর কি করে বাঁচার আশা রাখে ! জীবন নিয়ে খেলা হয়েছে সাহেব। আপনারা কিছুই জানেন না। আমি কেমন করে বেঁচে আছি জানি না- ওরা কত জবাই করেছে, কিন্তু আমি কিছু বলতে পারিনি। মুক্তি আর ইন্ডিয়ার সৈন্য আমাদের রক্ষা করল হুজুর।“
বগুড়া রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে প্রায় ৩০০ গজ দক্ষিনে একটি বদ্ধ কুপ দেখাতে গিয়ে সুইপার দশীন কথাগুলো বলছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বগুড়া রেলওয়ের এস ডি ও সাহেব পরিবারসহ এই প্রথম আসলেন তাঁর বাংলোতে। পাক বাহিনীর আমলে তার বাংলোটা সম্পূর্ণভাবে সামরিক দস্যুদের হাতে ছিল। তারা এই দু’তলা বাড়িটি ব্যবহার করতো কসাইখানা হিসেবে। নিরীহ বাঙ্গালীদের পাকদস্যু আর তার সহযোগীরা ধরে আনতো, তারপর এই বাড়ীতে জবাই করা হলো, বাড়ীর সংলগ্ন একটা বৃহৎ কুপে হত্যা করার পর মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হতো। বাড়ীটার আউট কিচেনে সবচেয়ে বেশী হত্যা করা হতো বলে মনে হয়। কারন এখান থেকে কুপটি মাত্র ২০ গজ দূরে। বাড়ীটির চারিদিকে দীর্ঘ নয় মাস ঘাস আর জঙ্গলে প্রায় ভর্তি হয়েছিল পাকবাহিনীরা সেগুলো পরিষ্কার করতো না। কারন জঙ্গলের মাঝে এই রকম একটি বাড়ীতে তাদের বাঙ্গালীনিধনের নেশা খুবই বেড়ে যেত। শুধু তাই নয়, বর্বর পাক-সেনারা এই বাড়িটাতে মদ আর জুয়ার আড্ডাও বসাতো। দিনে রাতে তারা এখানে আসর জমাতো নির্বিঘ্নে। ওদের কেউ বাঁধা দিতে পারে নাই। রক্তের নেশায় বর্বররা হন্য হয়ে বাঙ্গালীদের খুঁজে আনতো।

দশীন জমাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তুম কতজন বাঙ্গালীর মৃতদেহ এই কুপে ফেলেছ।
কি আর বলব হুজুর! বিশ্বাস করবেন না! আমার হাতেই কমপক্ষে চার-পাঁচ শত লাশ এই কুয়ায় ফেলেছি। জল্লাদরা তাকিয়ে দেখতো হুজুর, আমি কি করি। আমি লাশগুলো পুঁতে রাখতে চাইতাম। কিন্তু ওরা দেয় নাই। ওরা আমাকে বলতো- তু, শালা হিন্দু হায়। এইসে দরদ কিউ লাগদো! “জানতে চাইলে তোমার সামনেই কি ওরা হত্যা করতো”।
বৃদ্ধ বলে চলছিল- কি বলেন সাহেব! আমাকে ওরা ভয় পেত না। প্রথমে বাঙ্গালিকে ধরে আনতো, তারপর হাত বেঁধে মুখের ভিতর কাপড় গুঁজে দেয়। এরপর হয় পেটের ভিতর চাকু মারে, না হয় জবাই করে। কোনটার আবার পিছন দিক থেকে ঘাড়ে ছুরি বসিয়ে জবাই করতো। ওদের দয়া নেই। কান্নাকাটি অনুরোধ কিছুই শুনেনি। কত বাঙ্গালী যে কাঁদতো হুজুর, কি করবো। মিলিটারিরা খুশিমত মানুষকে গুলী করতো। তারপর আমাকে বলতো ‘ইছি কি হঠাদো’। আমি বাধ্য হয়ে কাজ করেছি হুজুর। কিন্তু ওরা আমাকেও ছাড়ে নাই। রেল ষ্টেশনের বাঙ্গালীদের আমি আগেই বলতাম তোমরা সরে যাও। আমি ওদের এই দিকে আসতে দেইনি। গোপনে গোপনে আমি অনেক বাঙ্গালী সাহেবকে সাবধান করেছি। কিন্তু মিলিটারিরা এটা জানতে পেরে আমাকে সন্দেহ করে ঘাড়ে রাইফেল দিয়ে মারে। শুধু লাশ সরাবার জন্যই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওরা হুজুর বড় বড় সাহেবকেও জবাই করেছে- গুলি করেছে। পাশে পার্ক রোডের একটি ড্রেন দেখিয়ে বলল, এখানে তিনটা, ওখানে ১টা, এই রকম অনেক সাহেবের লাশ এই ড্রেনেই আছে হুজুর। ওরা ভালভাবে পুঁতে রাখতেও আমাকে দেয়নি। আমাকে সন্দেহ করে খুব মারতো, টার উপর আমার চাকুরী নষ্ট করে দিল সাহেব। কয়েক মাস ধরে না খেয়ে আছি।

ঝাড়ুদার দাশীন পাক বর্বরদের বুলেটের সামনে না খেয়েই দিন কাটিয়েছে। চাকুরীতে পূর্ণবহালের কথা সেদিন সে মুখে আনতে পারি নাই। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যারা এমনিভাবে শত শত মানুষকে হত্যা করতে পারে তাদের এক মুঠো ভাতের অভাবে এক গরীবের জন্য চিন্তা করার সময় কোথায়? বগুড়া রেল এস ডি-ও বাংলোর পূর্বদিকের মাঠটা এখন কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। বগুড়া শুত্রুমুক্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই বাংলোর প্রতি ঘরের মেঝে আর দেয়ালে মানুষের রক্তে ভেজা বহু কাপড় জামা ইত্যাদি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল। বাংলোর উপর তলার হাউজে বর্বরতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায়। এই হাউজটি ছিল সম্পূর্ণ মানুষের রক্তে ভরা। রক্তগুলো জমা হয়ে ক্রমশঃ জমাট বেঁধে যায়। কোদাল দিয়ে মাটি কাঁটার মত জমাট বাঁধা রক্ত কেটে এই হাউজ পরিষ্কার করা হয়েছে। জবাই করা মানুষের রক্তে স্রোত দেখার জন্যই বোধ হয় হাউজে রক্ত জমা করতো। রক্ত দেখেই হয়তো রক্তপানের তৃষ্ণা জল্লাদের বাড়তো বেশী। বগুড়া রেলস্টেশন আর ষ্টেশন সংলগ্ন রেললাইনের আশেপাশে কত নিরীহ বাঙালিকে যে পাকসেনা আর তার সহযোগীরা হত্যা করেছে হিসেব নেই। কত নিরীহ মানুষ যে এই দস্যুদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন আর একান্ত অসহায়ভাবে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছেন কেউ বলতে পারেনা। বগুড়ায় পাক দস্যুরা বাঙালিদের ধরে বলত- ইছিকো খরচ খাতা মে (মৃত্যু খাতা) উঠা দেও। বোধ করি রেলষ্টেশনের ও তার আশপাশের নিষ্ঠুর বর্বরতা আর হত্যাযজ্ঞের দ্বারাই তাদের খরচের খাতা পূর্ণ হয়ে গেছে।

Scroll to Top