মানুষের মুখ

মানুষের মুখ *

১৬ জুন, ১৯৭১

এক টুকরো রুটি

সময় ; উনিশ শ একাত্তের সনের ২৭শে মার্চ স্থানঃ চট্টগ্রামের কোন উপকণ্ঠ। পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে শহরে, বন্দরে, গ্রামে। দানবের সাথে সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হয়েছে ঘরে ঘরে আমাদের মুক্তিবাহিনী। সীমান্ত থেকে ছুটে এসেছে ই-পি -আর এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরা। দলে দলে ওরা এসেছে রামগড়া রাঙামাটি আসলং কিংবা হরিণা থেকে। শ্রান্ত, ক্লান্ত অথচ উদ্দীপ্ত ঐ জওয়ানদের অন্তত একরাত্রির আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর কাল ভোর থেকে ওরা অবরোধ শুরু করবে ক্যান্টনমেন্টে। সুতরাং যত শীঘ্র সম্ভব ঐ দেড়শ জওয়ানের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা প্রয়োজন।

        না, অসুবিধা মোটেই হল না। থাকার ব্যবস্থার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালা খুলে দেয়া হল। খাবারের কথা গ্রামে পৌঁছতেই বাড়ি বাড়ি থেকে গরম ভাত-তরকারি চলে এল। মাত্র একঘণ্টার মধ্যেই নবাগত মেহমানদের জন্যে স্বতঃস্ফূর্ত খাবার এল অঢেল পরিমাণে।

        যুদ্ধের সময়ে খাদ্য সরবরাহ একটি গুরত্বপূর্ণ ব্যাপার। স্থানীয় যুবকবৃন্দ এ বিষয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে একটি কমিটি করে ফেললেন। খবর এল, রাতেই আরও নতুন জওয়ান পৌছে যাবে ওখানে। মোট আড়াই শ’ লোকের ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। জনগণের মধ্যে উদ্দীপনা থাকলেও নিয়মিত কার্যসূচী চালিয়ে যাওয়া নিতান্ত সাধারণ কথা নয়।

        ভোর বেলাতেই বস্তা বস্তা চাল এসে পৌঁছলো মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় দফতরে। গ্রামের একজন অবস্থাপন্ন ভদ্রলোক দু’টো দশাসই ছাগল নিয়ে এলেন। ওগুলো যুদ্ধকর্মীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আগমী ঈদে কোরবানী দেব ভেবেছিলাম। সে সুযোগ আর জীবনে আসবে কিনা জানি না। ছাগল দুটো দিয়েই খালাস পেলাম ভাববেন না। প্রয়োজন হলে নিজেকেও কোরবানী দিতে কসুর করব না।

        শুধু চাল আর ছাগল নয়। আরও এল তরিতরকারি, লাউ-কুমড়ো, গুড়ো মশলা ইত্যাদি। অনেকে পাক করে আনলেন ভাজা কিংবা সেদ্ধ ডিম। সেসব যথাযথভাবে রাখতে হিমশিম খেয়ে উঠলেন তিরিশজন কর্মী।

* ‘মানুষের মুখ’ শীর্ষক ধারাবাহিক কথিকাগুলি কামাল মাহবুব’ ছদ্মনামে মাহবুব তালুকদার রচিত।

.

একাশি বছরের বৃদ্ধ সাদেক আলী লাঠীতে ভর দিয়ে যখন এসে পৌঁছালেন তখন সকাল আটটা। গভীর মমত্ববোধে তাকিয়ে রইলেন জওয়ানদের মুখের দিকে। শীর্ণ হাতে ধরে থাকা একটা কলাপাতার ঠোঙা। ওটার মোড়ক খুলে বেরুল এক টুকরো রুটি।

        বৃদ্ধ একজন জওয়ানের দিকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন ঠোঙাটি। দেখতে পেয়ে জনৈক কর্মী ছুটে এলেন। বললেন কিছু দিতে হলে আমাকে দিন। ভদ্রলোক রুটির টুকরোটি এগিয়ে দিলেন কর্মীটির দিকে। বললেন, আমি গরীব মানুষ। এক টুকরো রুটি দেয়া ছাড়া আমার আর সাধ্য নেই বাবা। বয়স কম হলে যুদ্ধে যেতাম। কিন্তু আল্লাহ সে সৌভাগ্যও কপালে রাখেননি।

        আপনি কোথেকে এসেছেন? কর্মীটি সহনুভূতির স্বরে জিজ্ঞেস করলেন। গ্রামের নাম বললেন বৃদ্ধ। আত্মপরিচয়ও দিলেন, ‘আমি গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতাও করেছি। এখন আর কিছু করে খাবার সাধ্য আমার নেই’। ‘কিন্তু আপনি দেড় মাইল পথ হেঁটে রুটি বয়ে আনলেন, কষ্ট তো আর – বাধা দিয়ে বৃদ্ধ বললেন, ‘আমার এতগুলো ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দেবে, আর আমার হবে কষ্ট?’ একটু যেন উষ্ণতা তাঁর কণ্ঠে। ভদ্রলোক বিশেষ অপেক্ষা না করে চলে গেলেন।

        এক টুকরো রুটি নিয়ে যুদ্ধ কর্মীটিকে যথেষ্ট অসুবিধেয় পড়তে হল। সকালের টিফিন-সবারই খাওয়া হয়ে গেছে। রুটিটা তাহলে কি করা যায়? এমনিতর রুটি তখন পর্যন্ত আর আসেনি, সুতরাং ওটাকে আলাদা রাখতে হবে এবং এক টুকরো রুটির জন্যে আলাদা ব্যবস্থার প্রয়োজন। কর্মীটি মনে মনে বিড়ম্বনা বোধ করলেন।

        বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক সুবেদার সাহেব তাঁর প্লাটুন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন অপারেশনের জন্যে। কর্মীটি তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, এটা খেয়ে নিন তো?

আমার নাস্তা সারা হয়েছে। সুবেদার বললেন, এখন এটা দিয়ে কি করব?

কর্মীটি ম্লান মুখে বললেন, আমার রাখার অসুবিধা হচ্ছে। একজন অনেক কষ্ট করে রুটিটা নিয়ে এসেছেন। সুতরাং কোনদিকে ফেলে রাখতেও মন চাইছে না।

দিন তাহলে আমাকে, সুবেদার সাহেব হাত বাড়িয়ে রুটির টুকরোটি নিলেন। তারপর ওটা কাগজে মুড়িয়ে প্যান্টের পেছন-পকেটে ভরে রেখে দিলেন।

        ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু তা হল না। দুদিন পর্যন্ত কোন খোঁজ পাওয়া গেল না সুবেদার সাহেবের। শোনা গেল, যুদ্ধ করতে করতে সুবেদার সাহেব ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি চলে গিয়েছেন,  বিস্তর পাক সৈন্যকে খতম করেছে ওঁদের দলটি। গড়পড়তায় এক-একজন মুক্তিযোদ্ধা তিনজন পাকিস্তানীর প্রাণ নিয়েছে। কিন্তু সুবেদার সাহেব বেঁচে আছেন কিনা কে জানে!

        হ্যাঁ, বেঁচেছিলেন সুবেদার সাহেব। তিনদিন পরে যখন ফিরলেন তখন তাঁকে দেখে মনে হল, কয়লার খনি থেকে এইমাত্র বেরিয়ে এসেছেন যেন, দুচোখ ভরে কালি পড়েছে। শ্রান্তি আর ক্লান্তির প্রলেপ পড়েছে মুখে।

        কিন্তু সুবেদার সাহেব কাকে যেন খুঁজছেন। পেয়েও গেলেন এক সময়। সেই যুদ্ধ কর্মীটিকে সামনে দেখে হাত চেপে ধরলেন তার বললেন, আপনি আমার খুব উপকার করেছেন।

আ-আমি! অপ্রস্তুত হলেন কর্মীটি।

আপনি সেদিন রুটিখানা না দিলে কি যে হত? উপোস করার অভ্যেস অবশ্য আছে। কিন্তু যুদ্ধের জন্যে যে তাকদ দরকার ঐ রুটিখানাই তা আমাকে দিয়েছিল। আপনি ওটা না দিলে-

কর্মীটি বাধা দিয়ে বললেন-সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে স্মরণ করুন ঐ এক টুকরো রুটি যে সময় বিশেষে এত মূল্যবান হয়ে উঠবে, তাতো আমি জানতাম না। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বোধকরি জানতেন।

দুজনেই মাটির দিকে তাকালেন। দুজনের অভিভূত মনে একজন বৃদ্ধের মুখচ্ছবি। একজনের মনে বাস্তব, আর একজনা তাঁকে দেখেননি বলে ছবিটি কাল্পনিক। কিন্তু আর একটা ছবি ওদের সামনে স্পষ্ট। দুজনের চোখের সামনেই অতি সাধারণ এক টুকরো রুটি।

২৭ জুন, ১৯৭১

স্বাতীর যুদ্ধ

স্বাতী। বয়েস সাড়ে পাঁচ। পেশা-ঘরকান্নার কাজে মাকে টুকিটাকি সাহায্য করা, আব্বু বাড়ী ফিরলে দরজা খুলে দেয়া, ছোট বোনটিকে যাবতীয় পার্থিব বিষয়ে উপদেশ দান। ইস্কুলের পড়াশুনা এখনও ওর শুরু হয়নি, বাসায় প্রথম পাঠের অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের হাজার মেয়ের মত সাড়ে পাঁচ বছরের ছোট্ট স্বাতী এখন যুদ্ধ করছে।

        ওর বাবা ছিলেন অধ্যাপক। আর অধ্যাপক মানেই জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনীর পয়লা নম্বরের শক্র। ওদের চোখে শিক্ষা ও শিক্ষকতা মারাত্মক অপরাধ। মানুষের বুদ্ধি, মেধা প্রভৃতি আণবিক বিস্ফোরকের চাইতেও মারাত্মক; ফলে কুচক্রী পাশব শক্তির ষড়যন্ত্রে ওদের ছোট্ট সংসারেও নাড়া পড়ল। সংসারের সাজানো বাগান পেছনে ফেলে ওদের এগিয়ে যেতে হলো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

        প্রথম বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল একটি স্কুলের ছাত্রাবাসে। দিন দশেকের মধ্যে ওখান থেকে সরে যেতে হলো গ্রামের আরো অভ্যন্তরে, তারপর আরও ভেতরে যেখানে আদি অকৃত্রিম পা ছাড়া বিংশ শতাব্দীর কোন যানবাহন চলে না। চিরকালের পরিবেশ ত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন করে নতুন এক পরিবেশে এসে দাঁড়াল ক্ষুদে পরিবারটি। হাতের সম্বল বলতে সামান্য কিছু টাকা- স্বাভাবিক অবস্থায় যাতে পনের থেকে বিশ দিন অব্দি চলে। এখন ঐ টাকায় অনির্দিষ্টকাল চালাতে হবে। প্রথম দিকে আলুভর্তা, ডাল আর দুবেলা ভাত বরাদ্দ রইল, কিন্তু ওতে মুখ ঘুরিয়ে রইল স্বাতী। বল্লো, আমি নাশতা খাবো। আমার বড়ো খিদে লাগে।

        ওর মা এসে মাথায় হাত বুলালেন, নাশতা এখন কোথায় পাব মামণি? এখন তো যুদ্ধ চলছে। সাবাইকে তাই কষ্ট করতে হচ্ছে। আমরা যুদ্ধ করছি? স্বাতীর মুখের রেখা পালটে গেলো সহসা। ওর চোখে-মুখে ঔজ্জ্বলতার ছোঁয়া লাগল। কণ্ঠ নামিয়ে বল্লো, ভূট্টো খুব পাঁজী, খুব শয়তান। আর শেখ মুজিব কতো ভাল, না আম্মু?

আম্মু মাথা নাড়লেন।

এরপর স্বাতীই সংসারের সব সমস্যার সমাধান করে ফেলল। ওর আব্বুর পরনের একমাত্র লুঙ্গিটা ছিড়ে এসেছিল কিন্তু কেনা হচ্ছিল না। স্বাতীর মাও কবার বলেছেন আর একটা কিনে ফেলতে। কিন্তু পয়সার অভাব তখনকার জন্যে নিদারুণ সত্য। স্বাতী বল্লো, যুদ্ধ থামলে তোমাকে একটা ভালো লুঙ্গি কিনে দেব আব্বু।

এ কথার পর যথাশীঘ্ৰ লুঙ্গি কেনার ব্যাপারে ওর মায়ের চাপ কার্যকরী হলো না। ওর বাবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

স্বাতীর ছোট বোনটির অনেকগুলো হবি। তার মধ্যে অন্যতম কান্না। কিছু একটা হাতের মুঠোয় পায়নি বলে হঠাৎ সেদিন কান্নায় প্লাবন বইয়ে দিল। বোনের রকম-সকম দেখে স্বাতী ভারি খাপ্পা। বোনকে রীতিমতো শাসাল সে, কতবার বলছি এখন যুদ্ধ হচ্ছে। খবরদার তুমি কান্নাকাটি করবে না। কাঁদলে মিলিটারি বুঝে ফেলবে আমরা এখানে আছি। আব্বুকে তখন ধরে নিয়ে যাবে।

        তারপর আব্বুর কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বল্লো! আব্বু তুমি যে প্রফেসর তা কিন্তু কাউকে বলো না। তুমি যদি কিছু না বল, তাহলে তোমাকে কেউ চিনতেই পারবে না, আবার যুদ্ধ করে আমাদের জয় হলে তখন তুমি প্রফেসর বলবে।

        ওদের বাসস্থানের তিন-চার মাইলের মধ্যেই গোলাগুলির শব্দ শোনা যেত। ততদিনে স্বাতী চিনে ফেলেছে কোনটি মেশিনগানের শব্দ আর কোনটা শেল। বেশী আর অনেকক্ষণ ধরে শব্দ হলে বুঝত পাকিস্তানীদের আওয়াজ, অন্যদিকে পাশাপাশি কম শব্দ হলেই বুঝতে পারতো বাঙালীদের গোলাগুলির শব্দ। সাড়ে পাঁচ বছরের স্বাতী যুদ্ধের অনেক কথাই শিখে ফেলেছিল।

        এইটা মেশিনগানের শব্দ, না আব্বু? দূরের শব্দ শুনে স্বাতী বলতো। কখনো ছোট বোনকে ধমকে দিয়ে বলতো, তুমি কিছু বোঝ না। খালি বিস্কুট খেতে চাও। যুদ্ধের সময় কি বিস্কুট পাওয়া যায়।

        কান্নাকাটি থামিয়ে ছোট বোনটি তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকাত ওর দিকে। আম্মু ও আব্বু দুজনেই তাকাতেন। তখন ভবিষ্যতের অনেক পরিকল্পনায় মুখর হতো স্বাতী ; আমাকে আর ছোট বোনকে দুটো শাড়ি কিনে দিয়ো যুদ্ধ থামলে। আমরা না একদিন পোলাও খাব তখন! তখন তো তুমি আবার মাইনে পাবে। আমাদের সাইকেলে চড়ে আবার বিকেলে বেড়াতে যাব। আচ্ছা আব্বু আমাদের অত সুন্দর বাড়ীটা মিলিটারীরা নিয়ে গ্যাছে? তোমার বইগুলো ওরা নষ্ট করেছে? এসব কথা শুনে ওর আব্বুকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে হতো, ছল ছল করতো ওর মায়ের চোখ। আশ্চর্য, এসব মোটেই বিষাদ-বেদনা জড়াতো না ওর কণ্ঠে। স্বাভাবিক সহজভাবে বলতো সব কথা। যুদ্ধক্ষেত্রের একজন সৈনিক যেমন জীবনের সকল অস্বাভাবিকতা দূর করে পৃথিবীর নির্মমতম সত্যটিকে হাতের মুঠোয় রাইফেল তুলে দাঁড়ায়, তেমনি ওদের ছোট্ট সংসারে বাস্তবের কঠিন সত্যতার মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য প্রেরণা যোগাত সে।

        একদিন বিকেলে দিঘীর পাড়ে আব্বুর সাথে বসে ছিল স্বাতী। চুপচাপ বসে মেশিনগানের শব্দ শুনছিল। হঠাৎ প্রশ্ন করল সে , আব্বু যুদ্ধ কেন হয়?

        এ প্রশ্নের উত্তর ওর আব্বুর অজানা-কি উত্তর হতে পারে এই অবোধ সরল শিশুর ক্ষুদ্র প্রশ্নটির? মানুষ মারার কারিগর ইয়াহিয়া খান! আপনি কি পারবেন এ প্রশ্নের জবাব দিতে? বাংলাদেশের মানুষের উপর কেন যুদ্ধ চাপিয়ে দিলেন আপনি? কি স্বার্থ রক্ষা করলেন নিরীহ লক্ষ লক্ষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে নির্বিচারে হত্যা করে? আপনি তো পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়েছিলেন; সেনাবাহিনীর পশুত্ব লেলিয়ে রাষ্ট্রীয় সংহতিকে নিহত করল কে? ইতিহাসের পাতায় একদিন পাকিস্তানের প্রথম শত্রু ইয়াহিয়ার কলঙ্কিত নামে সিন্ধু-বেলুচিস্তানের মানুষও থুতু ছিটাবে। আর বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রবাদে রূপ লাভ করবে এই কথাটির : বিশ্বাসঘাতকতার অন্য নাম ইয়াহিয়া খান।

        কিন্তু স্বাতীর কথায় আসি। দিঘীর কালো জলের দর্পণে মুখ রেখে স্বাতী বলেছিল ; আমাদের পেলেন থাকলে বেশ হতো।

পেলেন দিয়ে কি হবে? অন্যমনস্ক আৰু প্রশ্ন করেছিলেন।

শান্ত ধীর কণ্ঠে স্বাতী বলেছিল, তাহলে পেলেনে বসে আমরা মেশিনগান দিয়ে ওদের মারতাম। আমাদের অনেক বন্দুক থাকলে মিলিটারীরা আমাদের সাথে পারত না।

        হ্যাঁ মা-ওর আব্বু বলেছিলেন, আমদের হীরের টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলী হয়ে গ্যালো। অস্ত্র হাতে থাকলে তা হতো না।

        স্বাতী কি বুঝেছিলে কে জানে! আব্বুর হাত ধরে ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলেছিল, ওরা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পারবে না।

        ওর আব্বুকে উত্তর দিতে হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে এর উত্তর লিখেছে রাঙ্গামাটির প্রান্তরে। সত্যি, ওরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করে পারবে না। জল্লাদ বাহিনীর কয়েক লক্ষ নিয়মিত সৈন্য ছাড়া আর কি আছে? হৃদয়হীন পাশব শক্তির উল্লাস ছাড়া ওদের অস্ত্রের আর কোন ভাষা নেই।

        আর বাংলার মাটির দুর্বার ঘাঁটিতে প্রত্যেকে সৈনিক আজ, প্রত্যেকে সৈনিক’। ওরা কি করে এ যুদ্ধে জিতবে? আমাদের মুক্তিফৌজের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সাড়ে পাঁচ বছরের স্বাতী সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে। ওরা কি করে এ যুদ্ধে জিতবে?

        স্বাতী কেবল একটি মেয়ের নাম নয়, এদেশের অগণিত শিশু মেয়েদের নাম- সে স্বাতী জাতির অন্ধকার আকাশে ধ্রুবতারার মতো সংগ্রামী জনতাকে পথ দেখায়, যে স্বাতী রাতের অন্তিমে আসন্ন সূর্যোদয়ের আহবান জানাতে ঘন অন্ধকারেও প্রাণের আলো জেলে রাখে।

“কলিজার রক্তে ভেজা মুহুর্তেই সে মুক্তি মহিমা

আকাশ, তোমারে ভাঙ্গে সীমা!”

৩ জুলাই, ১৯৭১

দেশের শক্ৰ

ছেলেটির বয়স ষোল কিংবা সতেরো। মুখের আদলটি কিন্তু আরও কচি। দেখতে চৌকস। এস-এস-সি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিল দুটো লেটার নিয়ে। কলেজের ছাত্র ছিল ঢাকায়। মুক্তিফৌজের দফতরে এসে বলল, আমি গেরিলা যুদ্ধে নাম লেখাব।

তুমি এত দেরী করে এলে কেন? প্রাথমিক তদন্তকারী অফিসার জিজ্ঞেস করলেন।

কি করব? আব্বা দিচ্ছিলেন না কিছুটা উষ্মা ও ক্ষোভ ছেলেটির কণ্ঠে।

তোমার বয়সী ছেলেরা অনেকেই বাবার মতামতের অপেক্ষা করেনি। তদন্তকারী অফিসার বল্লেন।

জানি, একটু বিরক্তির স্বর ছেলেটির কণ্ঠে। বলল, কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ করে আটকে রাখলে আপনি কি করবেন?

তাহলে কি করে এলে? এবারে কৌতুহলের স্বর অফিসারের কণ্ঠে।

অনশন করে। তিনদিন যখন না খেয়ে রইলাম, তখন মা-কে দরজার তালা খুলে দিতে হলো।

মা অবিশ্য আব্বার ভয়ে কিছু বলতে পারেননি, নইলে আটকে রাখার মত মহিলা নন।

তোমার বাবাই বা আটকালেন কেন?

বাবার কথা বলবেন না, সে পরে বলব, আমি আবার একটু ভদ্র ছেলে ছিলাম কিনা, মুক্তিফৌজে যোগদান করব ভেবে বিদায় চাইতে গিয়েছিলাম। অফিসার ভদ্রলোক অন্য প্রসঙ্গ তুল্লেন, বল্লেন-ঢাকার কি খবর বলো।

সবাই স্বাধীন বাংলা বেতার শুনছে, ঐ যে “পরমপত্র’ বলে অনুষ্ঠানটা-দারুণ পপুলার। আচ্ছা বলুন না ভদ্রলোক কি এই ক্যাম্পে থাকনে? আমি দেখব।

পাকিস্তানী বেতার লোকে শোনে না তাহলে?

শোনে মাঝে-মধ্যে, তবে স্বাধীন বাংলা না থাকলে ভারতীয় বেতারই শোনে বেশী। বিশেষ করে রাত সাড়ে দশটার সংবাদ পরিক্রমা।

 ব্যাস! এবার বলো ঢাকার মুক্তিসেনার গেরিলারা কেমন কাজ করছে?

করছে বেশ ভাল, কয়েকটি তো ঘুঘু লোককে সাবাড় করে দিয়েছে। তবে টপ লীগার ফিগারগুলোর মাথায় মিলিটারী ছাতা ধরা কিনা, ঝড়-বৃষ্টি এখনও এদের গায়ে লাগেনি, দুচারটে বাজ ফেলতে পারলে কাজ হবে।

 এরপর ছেলেটাকে তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ জিজ্ঞেস করা হলো। ওর নাম মোরশেদ। ঢাকার এক অভিজাত এলাকায় ওদের বাড়ি। ওদের এলাকায় একটি লিষ্ট তৈরি করে মিলিটারিরা লোকজন ধরছে। বিশেষ করে কম বয়সী ছেলেদের। ওর জন্য অবশ্য বিশেষ ভয় ছিল না। ও বরাবরই একজন গুড বয়। বাংলাদেশের আন্দোলন সম্পর্কে ওর সচেতনতা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২৫শে মার্চের পরের ঘটনা ওকে দারুণভাবে প্রভাবন্বিত করে। তারপরই মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাবে বলে ঠিক করেছে।

তদন্ত ও অন্যান্য কাজ শেষ হলে মোরশেদকে মুক্তিযুদ্ধে ভর্তি করে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠান হল। এতদিনে ওর সকল স্বপ্ন যেন সার্থক হয়েছে। সেই সফলতার ছাপ লাগল ওর চোখে -মুখে।

ওদের ট্রেনিং ক্যাম্পের এক অফিসারের উপর ভার পড়েছিল একটি লিষ্ট তৈরি করবার, তাতে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর সাহায্যকারী দালালদের নাম সংকলিত করে ওদের খতম করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দান ছিল অফিসারটির কাজ। দুজন বন্ধুকে নিয়ে মোরশেদ ঢাকা থেকে নবাগত বলে উনি ওর সাথে আলাপ করছিলেন।

 আপনি কি শত্রুদের লিষ্ট করেন? মোরশেদ এক সময় তাঁকে প্রশ্ন করল।

 কেন? অফিসারটি এহেন প্রশ্নের জন্য বোধ করি প্রস্তুত ছিলেন না।

 আমি আপনাকে একটা নাম দেব। মোরশেদ বলল।

সবার কাছে সব সময়ে অবশ্য নাম নেওয়া হয় না। নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি সম্পর্কে যদি শত্রুতার উপযুক্ত প্রমাণাদি পাওয়া যায়, তবেই তার নাম তালিকায় রাখা হয়।

আমি কিন্তু সত্যি সত্যি একজন শত্রুর নাম আপনাকে বলতে পারি, মোরশেদ জানালো।

কিন্তু, সে তো সত্যিকার শত্রু না-ও হতে পারে। আসলে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি না বল্লে ঠিক বোঝা যায় না কে কোন ধরনের শক্র । অনেকে ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্যও আমাদের কাছে একজনের নাম দিয়ে বসতে পারে। এই বিষয়ে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হয়।

ব্যক্তিগত শত্রু হলেই দেশের শত্রু হবে এমন কি কথা আছে? দেশের শত্রু মানে দেশের শত্রুই।

কিন্তু সেটা তুমি কিভাবে বিচার করবে। এমন তো হতে পারে যে, তুমি যাকে শত্রুভাবছ, চরম মূল্য দেবার মতো শত্রু সে নয়।

আমি তাকে ভাল করেই চিনি। তিনি যে দেশের জন্য ক্ষতিকর কাজ করেছেন, সে সম্পর্কেও কোনরকম সন্দেহ নেই। মোরশেদ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বল্লো কথাগুলো। সব অভিযোগ খুলে বল্লো।

কি নাম তার বলো। অফিসারটি কাগজ-কলম নিলেন। বল্লেন, যাচাই করে অভিযোগ যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে উপযুক্ত ব্যবস্থাই নিতে হবে। এবারে অকস্মাৎ স্নান হয়ে উঠল মোরশেদের মুখ। চোখের সমস্ত উজ্জ্বল্য যেন নিভে গেলো, শীতল কণ্ঠস্বরে বল্লো-আমি একটা কথা বলতে চাই এ সম্পর্কে।

কি কথা? ধরুন তাকে না মেরে বন্দী করে নিয়ে আসা যায় না?

সেসব আমরা দেখব। তোমার ভাবনার কারণ নেই।

তাকে যদি বন্দী করে রাখা যায় তো সবচেয়ে ভাল।

বল্লাম তো! সে আমরা দেখব, অফিসারটি ওর চোখ-মুখের ওপর দৃষ্টি ফেলেই হঠাৎ থমকে গেলেন, বল্লেন, লোকটির প্রতি তোমার দুর্বলতা আছে মনে হয়; কিন্তু ওর কাজের বর্ণনা শুনে কিন্তু তার প্রতি কোন দুর্বলতা থাকার কথা নয়।

মোরশেদ চুপ করে রইল, কিছু বল্লো না।

কথা বলছো না কেন? অফিসার ভদ্রলোক সহানুভূতির সাথে জিজ্ঞেস করলেন।

উনি আমার আববা, মোরশেদ বল্লো। ওর দুচোখের পাতা ভিজে উঠছে।

না! মোরশেদের আববার নামটি শেষ পর্যন্ত শত্রুর তালিকায় উঠাতে পারেন নি অফিসার। ঐ তালিকায় নাম থাকার একটিমাত্র অর্থ, তা হচ্ছে মৃত্যু। গেরিলা যুদ্ধের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে মোরশেদ এখন দিগ্বিজয়ের মতো একটির পর একটি দেশের শত্রুকে খতম করছে। ওর মতো একটি ছেলের শুধুমাত্র জনক হয়ে মোরশেদের বাবা তার জীবনের মূল্য পরিশোধ করেছেন। জনাব আফতাব আলী সাহব-ঐ হীরের টুকরো সন্তানের ত্যাগ ও দেশপ্রেমের কথা স্মরণ করে নিজেকে আপনি সংশোধন করবেন না কি?

 

Scroll to Top