মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাসঃ বাংলাদেশের অব্যাহত স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর একটি সমীক্ষা

<৪,৭৫,১৩৩-১৩৪>

অনুবাদকঃ ইফতি

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭৫। মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাসঃ বাংলাদেশের অব্যাহত স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর একটি সমীক্ষা বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এ্যাকশন কমিটি, গ্রেট বৃটেন। সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।

 

ছয় মাসের স্বাধীনতা আন্দোলন
বাংলাদেশের বিস্তৃত নদ-নদী অযথাই রক্তরঞ্জিত হয়নি!

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হানাদার অধ্যুষিত বাংলাদেশে যে রক্ত ঝরিয়েছে তা কিউসেকে মাপা সম্ভব। মেঘনা ও পদ্মায় বহমান প্লাবনের মতোই এই রক্তস্রোত বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশবে, বাংলার চিরসবুজ মাটিতে মিশে যাবে। ব-দ্বীপ বাংলাদেশের মাটি হাজার হাজার শহীদের রক্তে সমৃদ্ধ হয়ে আবার হেসে উঠবে, যখন হানাদার বাহিনী বিতাড়িত হবে।

এরই মধ্যে স্মরণীয় একটি উপলক্ষ্য হচ্ছে আজ ২৬ সেপ্টেম্বর। ২৫ মার্চের সেই কালোরাতের পর ছয়মাস গত হয়েছে, যখন ইয়াহিয়া তার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীকে নিরস্ত্র বাঙালির হত্যাযজ্ঞে লেলিয়ে দেয়। নিশ্চিতভাবে এই ছয়টি মাস বাংলাদেশের প্রতিরোধ সংগ্রামে একটি যতিচিহ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।

তারপরও, স্মৃতি চিরন্তন! এই ছয় মাসে ইতিহাস দেখেছে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর নারী-শিশুর প্রতি নারকীয় অত্যাচার ও অনাচার – যার উদ্ভব বিকারগ্রস্ত মানসিকতার বিকৃত দুঃস্বপ্নে। এবং তা মানব সভ্যতার ইতিহাসে নজিরবিহীন, মধ্যযুগে মধ্য এশীয় বর্বরেরা যারা এশিয়া এবং ইউরোপের মাটিতে ভয়াবহতা নিয়ে নেমে এসেছিলো!

বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার পোষা নেকড়েদের এই অনাচার ইতিহাসের পাতায় সাধারণ মানুষের উপর সংঘটিত সশস্ত্র বাহিনীর অত্যাচারের নিকৃষ্টতম উদাহরণ হিসেবে স্থান পাবে।

অস্বাভাবিক এই একশ আশিটি দিন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষায় পরিপূর্ণ।
শত্রুপক্ষের জ্ঞাত উদ্দেশ্যগুলো এবং তার অনাচারের ফলাফলের একটি সমীক্ষা থেকে তা উদ্ভুত। তার একটি উদ্দেশ্য ধরা যাক। ‘ঢাকার কসাই’ জেনারেল টিক্কা খান পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমিয়ে আনার মরণপণ লক্ষ্য নিয়ে তার গণহত্যামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিলেন।

তার অনাচারের কারণে সংঘটিত জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের আপাত সাফল্য নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট হতেই পারেন: প্রাথমিকভাবে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রক্তলালসায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণ দিয়েছে; ৯০ লাখ স্ব-অবস্থায় ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে যেখানে শরণার্থী শিবিরে মহামারী এবং অপুষ্টি তাদের সংখ্যায় কমিয়ে আনছে; এবং আরো কয়েক মিলিয়ন উদ্বাস্তু মানুষ বাংলাদেশের মধ্যে ভাসমান অবস্থায় ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

ইয়াহিয়া বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে দুর্ভিক্ষের আগমন, যার জন্যে ইসলামাবাদ জান্তা গভীর আগ্রহে অপেক্ষমান। এ অনিবার্য দুর্ভিক্ষ, যার পথ পাকিস্তান গড়ে দিয়েছে শস্যের ধ্বংসসাধন এবং চাষিদের ক্ষেত থেকে উৎখাতের মাধ্যমে, তা যে শুধু বাংলাদেশের আরো একটি অংশ ধ্বংস করবে তাই নয়, বরং বুভুক্ষু মানুষকে খাবারের বিনিময়ে হানাদার বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে।

বাঙালির জনসংখ্যা কমিয়ে আনার এতোসব গণহত্যামূলক চক্রান্ত তবেই অর্থবহ হতো, যদি বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকতো। কিন্তু, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে সাথে বাঙালি জনসাধারণের বিরুদ্ধে হানাদার বাহিনীর এ নীলনকশা শুধুই ঘৃণ্য অনাচার, যার সফলতা ইহুদি সমস্যার বিরুদ্ধে হিটলারের ‘চূড়ান্ত সমাধান’ – এর চাইতেও কম!

আরো একটি শিক্ষা হলো যে, দ্রুততার সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় ও সশস্ত্র বাহিনীকে সংঘবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। গত মে – এর কালো সপ্তাহগুলোর দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, প্রাথমিক ধাক্কার পরপরই বিধ্বস্ত বাংলাদেশের মধ্য থেকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি রাযে রাষ্ট্রীয় কলাকৌশল সৃষ্টি ও একটি কার্যকরী স্বাধীনতা বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন তা সত্যিই অসাধারণ। স্বাধীনতা বাহিনীর নতুন অর্জনগুলো বিস্তারিত বর্ণনার প্রয়োজন নেই এখানে। হানাদারদের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধের শক্তি এবং মুক্তিবাহিনীর সাফল্যগুলো প্রায় প্রতিদিনই নিরপেক্ষ পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে স্বীকৃতি পাচ্ছে।

আন্তর্জাতিকভাবে, বাংলাদেশ ‘গ্রেট পাওয়ার গেইম’ – এর শিকার হিসেবেই রয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় জনসমর্থনের ভিত্তিতে উদ্ভুত নতুন একটি রাষ্ট্রকে বরণ করে নেয়ায় অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর স্বাভাবিক অনাগ্রহ ছাড়াও অদ্ভুতভাবে পাকিস্তানে আমেরিকা ও চীনের মিলিত স্বার্থ কুচক্রীজান্তাকে ইসলামাবাদেক্ষমতায় রেখেছে, যা একে বাংলাদেশে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার উদ্যম সরবরাহ করছে। ৯০ লক্ষ শরণার্থীর চাপে জর্জরিত ভারত ঘটনা প্রবাহে এই অপেক্ষা ও আশায় আছে যে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র প্রচেষ্টা ইয়াহিয়া বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে পিছু হটতে বাধ্য করবে এবং শরণার্থীদের নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব করবে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন দর্শকের ভূমিকায় অপেক্ষমান, নব উদ্ভুত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের টিকে থাকার সম্ভাবনা যাচাই করছে।

এমন আন্তর্জাতিক অবস্থার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের ব্যাপক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসবে। তারপরও, এমন একটি দূরবর্তী ঔপনিবেশিক যুদ্ধচালিয়ে যাওয়ায় ইসলামাবাদের সক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেখাটা ভুল হবে। পাকিস্তান আমেরিকা নয়।

যেখানে বাংলাদেশের জনগণের দুঃখদুর্দশা এরই মধ্যে হয়তো ভিয়েতনামকে ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধহয়তো ভিয়েতনাম যুদ্ধের বর্তমান অবস্থার মতো ততোটা লম্বা সময় নিয়ে চলবে না।

বাংলাদেশের দেশপ্রেমীদের তাই গভীর প্রত্যাশার সাথে নিকট ভবিষ্যত দেখা দরকার।

বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত

যুক্তরাজ্য

৩৫, গ্যামেজেস বিল্ডিং, ১২৯ হলবোম, লন্ডন ইসি১। টেলি –  ০১. ৪০৫ ৫৯১৭

লার্কুলার লিমিটেড কর্তৃক মুদ্রিত  

Scroll to Top