রণাঙ্গনের চিঠি

রণাঙ্গনের চিঠি

.

যশোহরের রণাঙ্গনে ক্ষণিক বিরতির সময়ে জানতে পেলাম, গণতন্ত্রের পীঠস্থান মহান ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। উল্লাসে ফেটে পড়েছে আমাদের সমস্ত শিবির। আনন্দে কোলাকুলি করছে সবাই, কেউ মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, আমার দেশের মাটি আমার মায়াঘেরা দেশের সোনার মাটি, কত ঝড় বয়ে গেলো তোর উপর দিয়ে, শত্রুর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে তোর সোনার অঙ্গ। ভাবিস আমরা তোর শৃঙ্খল ঘোচাবো, তোকে মুক্ত করবো, আবার তোকে সাজাবো আমাদের প্রীতি মমতা দিয়ে, সবটুকু শক্তি দিয়ে।

জানো বন্ধু, কী তৃষ্ণা কী আকুলতা নিয়ে কেটেছে গত আট মাস বারো দিন এই একটি সংবাদের জন্য! কেটে গেছে কতো বিনিদ্র রজনী। যখন রণক্ষেত্র থেকে আহত স্বামীকে কোলে করে নিয়ে ফিরেছি, তখন ভেবেছি আর কতদিন? স্বামী মৃতদেহের পাশে বসে ভেবেছি আর কতো দিন বাকী আমাদের স্বীকৃতির। মনে পড়ে কয়েক দিন আগে শেষ নিঃশ্বাস ফেলবার আগের মুহুর্তে আশরাফ ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করেছিলো “স্বীকৃতি মিলেছে? উত্তর দেবার আগেই আশরাফ শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে। আমার বুকে আমার হাতে তখনও আশরাফের ছোপ ছোপ রক্ত। রক্ত কথা বলে উঠলো, “আমি আশরাফের রক্ত স্বীকৃতির দাবী নিয়ে বাংলার মাটিতে জমাট বেঁধে থাকবো, তোমরা আমাকে স্বীকৃতি দাও। তোমরা আমাকে স্বীকৃতি দাও।”

আজ স্বীকৃতি মিলেছে। আমার বুকপকেটে রয়েছে আশরাফের রক্তমাখা আমার রুমালটি। বার বার রুমালটি দু’চোখে চেপে ধরছি। আমাদের বন্ধু আশরাফের রক্ত-শোন, তুমি শোন, স্বীকৃতি মিলেছে তোমার। স্বীকৃতি মিলেছে আশরাফের, স্বীকৃতি মিলেছে কুদ্দুস, টিটু, আজাদ, তারিক, মাসুদ আরো শত শত শহীদের রক্তের। স্বীকৃতি মিলেছে দশ লক্ষ লোকের রক্তের, যারা বর্বর খুনী ইয়াহিয়ার বাহিনীর গুলির আঘাতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, স্বীকৃতি মিলেছে বাংলার সাতে সাত কোটি মানুষের।

বন্ধু, আনন্দে আমার চোখের জল ঝরছে। আশরাফের পবিত্র রক্তের সংগে আমার চোখের জল মিলে একাকার হয়ে গেছে। তুমিও কী কাঁদছো বন্ধু? কেঁদো না। দোহাই তোমার, কেঁদোনা, চোখের জল মুছে ফেলো।

বাংলাদেশে পাকিস্তানী সরকারের বিমান বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ৪৭টি পাকিস্তানী জংগী বিমান ভূপাতিত তাদের দুটি যুদ্ধজাহাজ, একটি ডেষ্ট্রয়ার, ১টি সাবমেরিন নিমজ্জিত। তাদের একটির পর একটি ঘাটিঁতে পতন ঘটেছে। আখাউড়া, লাকসাম, কুলাউড়া, লাতু, বিয়ানীবাজার, মিয়ার বাজার, ফেনী থেকে শত্রুসেনা সম্পূর্ণ বিতাড়িত। সমগ্র টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী জেলা সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়েছে। অন্যান্য জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উড্ডীয়মান বাংলাদেশের জয় পতাকা।

সুতরাং, বন্ধু কেঁদো না। চোখের কোণে তোমার আনন্দের, বেদনার যে জলটুকু জমে উঠেছে তা মুছে ফেলো। আমরা এগিয়ে চলেছি, তোমরাও এগিয়ে চলো দুর্বার গতিতে। শত্রুর দুর্গে আঘাতের পর আঘাত।

হানবো আমরা। চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবো ওদের সামরিক শক্তি। ধুলোয় মিলিয়ে দেবো ওদের শক্তির দম্ভকে। তারপর আর মাত্র কয়েকদিন পর যখন বাংলাদেশের মাটি থেকে শেষ শত্রুটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যখন আমাদের সোনার বাংলার মাটি শত্ৰস্পর্শের কলঙ্কমুক্ত হবে তখন আমরা কাঁদবো গলা জড়িয়ে আমাদের হারানো সাখীদের জন্যে। আমরা সেদিন চোখের জলে আমাদের বন্ধুদের শুভ্র, পবিত্র অম্লান স্মৃতিকে স্মরণ করবো। আর সবাই মিলে গড়ে তুলবো আমাদের সোনার বাংলাকে।

(গাজীউল হক রচিত)

Scroll to Top