সাক্ষাৎকারঃ আবদুস সামাদ

<৯, ১৬, ৪৮০-৪৮৬>

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন-৩
সাক্ষাৎকারঃ আবদুস সামাদ,বিপি

(স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প ৫-৬-৮৩ তারিখে গৃহীত)

 

একাত্তরের মার্চে আমার বাসা ছিল ৪১৫ নিউ ইস্কাটন রোডে, এখন চীনা দূতাবাস অবস্থিত ঠিক তার পাশে। ঢাকা নিওন সাইন নামে আমার একটি ছোট লাইটিং কারখানা ছিল আমার। ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ইত্যাদিতে প্লাস্টিক সাইন সরবরাহ হতো আমার কারখানা থেকে। সে সময় যেহেতু ঢাকায় বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক প্রভৃতির কর্মকর্তাদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি, সেহেতু তাদের সাথে আমার ব্যবসায়িক যোগাযোগের সুবাদে আমি পাঞ্জাব ও উর্দু ভাষাটা ভালোই শিখেছিলাম। এটা ঢাকার গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা কালে আমার পক্ষে অনুকূল হয়েছিল। অনর্গল উর্দু ও পাঞ্জাবী ভাষা বলতে পারার কারণে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাস্থানীয় কোনও অবাঙালি আমাকে ঢাকায় গেরিলাযুদ্ধের একজন সংগঠক বা সহায়তাকারীরূপে সন্দেহ করতে পারেনি।

 

যা হোক, ২৫ মার্চ সন্ধ্যে থেকে যখন সমস্ত শহরের পরিস্থিতি ক্রমেই থমথমে হয়ে উঠেছিল এবং পাকিস্তানী সামরিক কার্যক্রমের আসন্নতা যখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল তখন আমার কারখানার কিছুসংখ্যক কর্মী এবং আমার বাড়ির পার্শ্ববর্তী আলো ডেকোরেটরের আরও কিছু লোকজন মিলে নিউ ইস্কাটন রোডের কিছু জায়গায় গর্ত করা শুরু করে এবং দিলুরোডসহ আশেপাশের এলাকায় বহু ঠেলেগাড়ি জমা করে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে যেন পাকবাহিনী এই পথ দিয়ে অগ্রসর হতে না পারে। আমাদের আশংকা বাস্তবে রূপ নিতে বেশী দেরি হল না। রাতের মধ্যেই বাংলা মোটর (তৎকালীন পাকমোটর) হয়ে নিউ ইস্কাটন রোড ধরে পাকবাহিনীর সামরিক যানগুলি এগিয়ে এলো। মনে আছে, সামনের যে জীপগুলি ছিল, সেগুলির বাতি ছিল হলুদ রঙের। গাড়িগুলি আমাদের তোইরি ব্যারিকেডের সম্মুখীন হতেই প্রচণ্ড ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল। ফায়ারিংযের মুখে রাস্তাঘাট মুহুর্তেই ফাঁকা হয়ে গেল। আমরাও আত্মরক্ষার্থে বাসার ভেতর আশ্রয় নিলাম। উন্মত্ত গাড়িগুলি ব্যারিকেড চুরমার করে মৌচাক হয়ে রাজারবাগের দিকে ছুটে যায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করতে পাকিস্তানী সামরিক যান এই নিউ ইস্কাটন রোড ব্যবহার করেছিল।

 

ঢাকা শহর পাক কবলিত হওয়ার পর এপ্রিলের শেষের দিকে আমার বিশিষ্ট বন্ধু তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ খানের-যিনি পরে ১১নং সেক্টর অধিনায়ক কর্নেল তাহের আহত হওয়ার পর ঐ সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সাথে তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে একদিন দেখা হয়। তিনি তখন পাক বিমানবাহিনী থেকে ডিফেক্ট করার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু ঠিক উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আমি তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হলে তিনি আগরতলা চলে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন। এ ব্যাপারে আমি যোগাযোগে সাহায্য করি।

 

এ সময় আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গেরিলা ট্রেনিং চলার কথা শুনতে পাই, এবং কোনও গেরিলা দলের খোঁজ পাই কিনা তাঁর জন্য অনুসন্ধান চালাতে থাকি। এই অবস্থার মধ্যে আমার বাড়ির নিকটের প্রতিবেশী পাকিস্তান রেডিও-এর একজন কর্মচারী হাফিজ ভাইয়ের বাসায় একটি ছেলের মুখে মুজিবনগর এলাকায় জোর গেরিলা ট্রেনিং চলার কথা শুনতে পাই। আরও শুনতে পাই যে, অতি শীঘ্রই ভারত থেকে ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা চালানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা দল পাঠানো হবে। খবর শুনে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি এবং এরূপ গেরিলা দল এলে আমি তাদের সর্মতোভাবে সাহায্য করার আগ্রহ প্রকাশ করি। ছেলেটি তাঁর নিজের আইডেন্টিটি গোপন রেখে শীঘ্রই একজন গেরিলা যোদ্ধাকে আমার কাছে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এর সপ্তাহ দু’য়েক পরেই হঠাৎ এক সকালে আমার বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে একটি ছেলে এসে হাজির। সে এসে দ্বিধাজড়িত কন্ঠে আমার খোঁজ করতেই আমি তাঁর কাছে আমার পরিচয় দিলাম এবং তাকে নিয়ে এসে আমার ড্রয়িংরুমে বসালাম। আমি গেরিলাদের যুদ্ধে সাহায্যদানে ইচ্ছুক কিনা সরাসরি জানতে চাইলে আমি আমার পূর্ণ সম্মতি জ্ঞাপন করি। নিশ্চিত হয়ে সে তখন গাজী দস্তগীর বলে নিজের পরিচয় দেয় এবং খুব শীঘ্রই এই ব্যাপারে যোগাযোগ করবে বলে আমাকে জানায়। ঢাকায় গেরিলাদের সাথে এ ভাবেই আমার প্রথমিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে, এবং আমি তাদের কিভাবে সাহায্য-সহায়তা করতে পারি সেসম্পর্কে চিন্তা করতে শুরু করি। আমার কিছু পূর্ব সামরিক জ্ঞান ছিল এবং বেশকিছু সামরিক অফিসারের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। ভেতরে দেশপ্রেম কাজ করছিল, তারই প্রেরণায় আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত একটি হৃদয়হীন শক্তির মুখে সামরিক ছাউনি পরিবেষ্টিত ঢাকা শহরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিরোধের শিখা জ্বালাতে আমি আমার সামান্য সীমিত শক্তি নিয়োগ সংকল্পবদ্ধ হই। এটা সুবিদিত যে, গেরিলারা জনবিচ্ছিন্নভাবে কোনো কাজ করতে পারে না। গণসমর্থন তাদের কাজের অপরিহার্য প্রাথমিক শর্ত। সে জন্য আমি প্রথম যে কাজটি করেছিলাম সেটা ছিল ঢাকায় আগত প্রথম গেরিলাদের জন্য শেলটারের ব্যবস্থা করা।

 

গাজী দস্তগীরের সাথে আলাপের কয়েকদিন পরই সে কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে আমার বাসায় চলে আসে। এরা ছিল ২ নং সেক্টরের মেলাঘর,নির্ভয়পুর প্রভৃতি স্থানে আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে যাদের নাম এখনো আমার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল তারা হচ্ছেন মোফাজ্জল হসেন চৌধুরী মায়া (মায়া ক্র্যাক প্লাটুনের দায়িত্বপ্রাপ্ত), উলফত, জুয়েল, এবং যাদের নাম আমার স্মরণে নেই। গাজী দস্তগীর এদের সবাইকে একে একে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানায় যে, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধের উপযোগী অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে করে এনেছে। তখন গেরিলাদের ঢাকা প্রবেশের রাস্তা দু’টি- একটি বিবিরবাজার-কুমিল্লা হয়ে, অপরটি মীরপুরের নদীপথে মালিবাগ পর্যন্ত। গেরিলারা আমাকে জানালো, যে অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়েছে সেগুলি তারা মালিবাগের একটি বাসায় রেখে এসেছে, রাস্তায় রাস্তায় পাকবাহিনীর জোর তল্লাশী চলায় সেগুলো তারা আমার বাসা পর্যন্ত আনতে সাহস পায়নি। অস্ত্রগুলি দু’টি বস্তায় ভর্তি। একটিতে ছিল কয়েকটি স্টেনগান, চাইনিজ রাইফেল, বুলেট ইত্যাদি। অপরটিতে ছিল, যাকে বলা হয় প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, অনেকটা গোলানো ময়দার মতো দেখতে, প্লাস্টিকের থলিতে ভর্তি। এ ছাড়া ছিল বিস্ফোরণ ঘটানোর অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী।

 

গেরিলারা অস্ত্রগুলি নিরাপদে রাখার ব্যাপারে স্বতঃই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। আমি তাদের এ ব্যাপারে আশ্বাস দিই, গাজী দস্তগীরের দু’টি ছেলেসহ আমার নিজের টয়োটা করওলা গাড়ি নিয়ে মালিবাগের সে বাসায় চলে যাই এবং বস্তাভর্তি অস্ত্রগুলি নিয়ে আসি এবং আমার অফিসের স্টিলের আলমারি খালি করে তাতে সেগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করি। দলে তখন আমরা ছিলাম মোট ৭ জন। আমাদের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনতেই হবে, এই ছিল প্রতিজ্ঞা।

 

এভাবেই প্রথমে প্রশিক্ষিত জনে ও অস্ত্রে গেরিলা অপারেশনোপযোগী তৎপরতার প্রাথমিক ভিত্তি রচিত হবার পরই ঢাকায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী গেরিলা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। গেরিলাদের আনা অস্ত্রগুলি সম্বন্ধে আমার পূর্ব ধারণা বিশেষ কিছু ছিল না। তাই আমার বাসায় নিয়ে আসার পর সেগুলির ব্যবহার সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমার কাছে সবচেয়ে মারাত্মক ঠেকেছিল এক্সপ্লোসিভগুলি, সেগুলি ছুঁয়ে দেখতে সাহসে কুলোচ্ছিল না, ছিল টাইম পেন্সিল বোম, ইগনেটিং অয়ার, ডেটোনেটর ইত্যাদি বিধ্বংসী ধরনের নানা ডিভাইস।

 

অস্ত্রগুলি আনার পরদিনও আমরা সেগুলি নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখি। তারপর উলফত, মায়া, জিয়েল আমরা সবাই মিলে কিভাবে কোথায় অপারেশন চালানো যাবে এ নিয়ে পরিকল্পনা করি। মায়াকে ২ নং সেক্টর থেকে এই দলের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল, এবং এই জন্য তার দল পরিচিত ছিল মায়া ক্র্যাক প্লাটুন বলে। ঢাকা শহরে আমার বিশেষ অবস্থাবগত কারণে- যা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মায়া পরিকল্পিত অপারেশনগুলিতে স্থানীয়ভাবে আমার নেতৃত্ব কামনা করে এবং আমি তার আগস্ট মাসে পাক সামরিক জান্তার হাতে ধরা পড়ার পূর্বমুহূর্তে পর্যন্ত সানন্দে পালন করেছিলাম। গেরিলাদের ঢাকায় নিজ বাসগৃহে থাকার সমূহ আসুবিধা ছিল। গেরিলা যুদ্ধের জন্য অত্যাবশ্যক গণভিত্তি হিসাবে আমি তাদের নিরাপদ শেলটারের ব্যবস্থা করেছিলাম, তাদের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় পোশাক পরিচ্ছদ সরবরাহ করেছিলাম- সমস্তই এককভাবে এবং তাদের অপারেশন সংগঠন ও পরিচালনায় সাহায্য করেছিলাম প্রত্যক্ষভাবে।

 

২নং সেক্টরের অধিনায়ক তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং গেরিলা প্রশিক্ষক মেজর, এ ,টি এম হায়দার প্রায়ঃশই গোপনে কুরিয়ার মারফৎ আমাকে চিঠিপত্র পাঠাতেন ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা এবং গেরিলাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। এক পর্যায়ে মুজিবনগর থেকে জেনারেল এম, এ, জি ওসমানীরও নির্দেশ সম্বলিত চিঠি পেয়েছিলাম।

 

ঢাকায় পরিকল্পিত গেরিলা অপারেশন চলাকালীন সময়ে আমরা দ্বিতীয় দফা আরও কিছু অস্ত্রশস্ত্র পাই। এগুলো ছিল বিশেষ ধরণের এবং  গেরিলাদের ভাষায় ছিল ঢাকা শহরকে কাঁপিয়ে তোলার মতো। অস্ত্রগুলি এসে পৌঁছেছিল স্বামীবাগের পুরনো একতলা একটি বাসায়, সেগুলি ছিল বয়স্কা এক মহিলার হেফাজতে। আমি দু’জন গেরিলা যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্রগুলি আনতে যাই। গেরিলা দু’জন উক্ত মহিলার পরিচিত থাকায় তিনি সন্দেহমুক্ত হয়ে দ্রুত অস্ত্রগুলো আমার হাতে তুলে দেন। একটি সুটকেসে ও একটি বস্তায় সেগুলি ভর্তি ছিল। অস্ত্রগুলো বেশ ভারী থাকায় সুটকেসের তলা ফেটে গিয়েছিল, এ নিয়ে মহিলা বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। অস্ত্রগুলি নিয়ে আমরা দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাই, এবং সেটি আমার অফিসেই। খোদ ঢাকা শহরই ছিল আমাদের এরিয়া অব গেরিলা অপারেশন, অস্ত্র প্রয়োগের কলাকৌশল রপ্ত করারও গোপন কেন্দ্র ছিল আমার প্লাস্টিক নিওন সাইন কারখানা ছোট্ট অফিসগৃহে- কারখানার ভারী ভারী হাতুড়ি, শাবল, কোদাল সহকারে লোহার কাজকর্মের দৈনন্দিন ধাতব শব্দরাজির আড়ালে। এসব নতুন পরীক্ষিত অস্ত্রগুলির মধ্যে ছিল বেশকিছু হ্যাণ্ড গ্রেনেড, এম-কে ১৪ মাইন, এম-কে ১৬ মাইন এবং ১৬ মাইনের ক্যাবলসহ একখানা রীল।

 

উল্লেখ্য, আমাদের গেরিলা তৎপরতার মান ক্রমশঃ যতই উন্নত হয়ে উঠছিল ততই আমরা সেক্টর কমান্ডারদের নির্দেশ সমেত অনেক নতুন নতুন অস্ত্রও পাচ্ছিলাম। এ প্রসঙ্গে একজন অত্যন্ত সাহসী গেরিলা আবু- বকরের নাম মনে পড়ছে, গুলশান ২য় মার্কেটের পেছনে তার বাসা ছিল। সে মাঝে মাঝেই প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসতো এবং তার মারফত আরও কয়েকজন তরুণ গেরিলার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল, যাদের মধ্যে দু’জন স্বৈরাচারী আইয়ুব আমলের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর আব্দুল মোনেম খানের সাড়াজাগানো হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেছিল। এরা ছিল খুব স্মার্ট এবং সুপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বিশেষ করে আবু বকরের পায়ের আড়ালে প্লাস্টিক মোড়ানো ভাঁজ করা স্টেন বহনের কৌশল ছিল খুব চমকপ্রদ। চেকিংয়ে দেহতল্লাশীর সময় তার হদিসই মিলত না। মাহবুব সালাম ও নীলুর গুলশানের বাসায়ও এক্সপ্লোসিভ রাখা হতো। নীলু ও শাহজাহান নামের একটি ছেলে দু’টো অপারেশন করেছিল, যদিও তা সফল হয়নি। এরা ছিল আমার রিক্রুট। এদের অপারেশনে আমি নিজেও জড়িত ছিলাম।

 

অপারেশনকালে আমাদের সাথে আরও কিছু ছেলে যোগ দেয়। তাদের মাঝে মেজর জেনারেল(অবসরপ্রাপ্ত) আমজাদ চৌধুরীর ছোট ভাই আনোয়ার চৌধুরী ছিল অন্যতম। মিঃ জামানের নাভানা ওয়ার্কশপে গোপনে তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ঘটে। আনোয়ার চৌধুরীর অপারেশনে বিশেষ করে গাড়ির ব্যবস্থা করার ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিল।

 

দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, বিশ্ববাসীর কাছে দখলদার বাহিনীর এই দাবী চূর্ণ করার উদ্দেশ্যে আমরা প্রথম প্রচেষ্টা নিই ঢাকা শহরে সন্ত্রাস সৃষ্টির। সংশ্লিষ্ট সেক্টর কমান্ডারদেরও নির্দেশ ছিল এটা। এ ব্যাপারে যা কিছু প্লান প্রোগ্রাম তার সবই হত আমার বাসার ড্রয়িং রুমে। সন্ধ্যার অন্ধকার ছিল আমাদের অপারেশনগুলি উপযুক্ত সময়। অপেরেশনগুলি ছিল কমান্ডার খালেদ মোশাররফের ভাশায়ঃ ‘সিটি টেররাইজিং অপারেশনস’।

 

মুক্তিবাহিনীর সুদৃপ্ত অস্তিত্ব ঘোষাণার জন্য আমরা মোহাম্মদপুরের অবাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকা থেকেই প্রথম যাত্রা শুরু করি। বিশ্বস্ত বাহন আমার টয়োটা করোলা, দলে হাফিজ ভাই, উলফত, গাজী বাপী এবং আমি। আগস্টের দিকে ঘটনা। আমরা যখন আইয়ুব (বর্তমানে আসাদ) গেটের কাছাকাছি, তখন মীরপুরের দিক থকে একটি আর্মি কনভয় আসছিল। আমরা সেটা লক্ষ্য করি। আমদের সাথে কিছু এম-কে মাইন-১৪ ছিল। পেট্রোল নেবার ছল করে কাছে পেট্রোল পাম্পে গাড়ি থামাই, এরই মধ্যে উলফত রাস্তায় খুব দ্রুত ক’টি মাইন পেতে দিল, কনভয় এগিয়ে আসার আগেই। কনভয়ের প্রথম দুটো গাড়ি নির্বিবাদেই পার হয়ে গেল, পরের গাড়ির বেলায় ঘটল পরম আকাঙ্ক্ষিত বিস্ফোরণটি। মাইনের আঘাতে গাড়ির চাকা প্রচণ্ড শব্দে বার্স্ট হয়ে গেল, চারদিক নড়ে উঠল। আমরা ততক্ষণে হাওয়া।

 

আসাদ গেটে সন্ত্রাসের কাণ্ডটি ঘটিয়ে ঐদিনই শিকার খুঁজতে টোয়োটা করোলা চলে আসে হাইকোর্ট-ময়মনসিংহ রোড ক্রসিং-এর ট্রাফিক রাউন্ডে- এখন যেখানে স্বাধীনতা উত্তর শিল্পর্কীতি জোড়া দোয়েল ডানা বিস্তার করে আছে। সেখানে বাপী আর উলফতের পাতা মাইনের শিকার হয় অবাঙালি যাত্রীবাহী এক ডবল ডেকার বাস। এর পরদিন নর্থ-সাউথ রোডের উপর চাংওয়াতে অপারেশনের প্ল্যান নেওয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ এক আর্মি চলে আসাতে অপারেশন হলো না। তবে রাস্তার উল্টো পাশে রাখা আর্মি অফিসারের জীপের চাকার নিচে এম-কে ১৪ রেখে আমরা দ্রুত সরে পড়ি। গাড়িতে ছিলাম আমরা মোট ৪ জন। স্টিয়ারিংয়ে আমি, বাকী ৩ জন ছিল উলফত, হাফিজ ও বাপী। আমরা সরে পড়ার আধ ঘন্টার মধ্যে প্লাস্টিক মাইন দারুণ আওয়াজে ফেটে গিয়ে জীপ দু’টির চাকা বিধ্বস্ত হয়।

 

এভাবে আরো বেশ কিছু গেরিলা অপারেশন আমরা করি। এগুলি ছিল গ্যানিজ ও ভোগ ফ্যাশন বিপনিকেদ্রিক অপারেশন, গ্রীন রোডের মোড়ে পেট্রোল পাম্প অপারেশন- যাতে সায়েন্স ল্যাবরেটরীর রাস্তায় হাফিজের(পরবর্তী কালে শহীদ) বসানো এম-কে ১৬ মাইনের তোড়ে খানসেনাসহ একটি মিলিটারী জীপ উড়ে গিয়েছিল, কমলাপুর স্টেশন অপারেশন, টয়েনবি সার্কুলার রোডস্থ গভর্ণর হাউসের পাশ্ববর্তী পি-এন-ও(পাকিস্তান ন্যাশনাল ওয়েল বা দাউদ পেট্রোলিয়াম লিঃ) পেট্রোল পাম্প অপারেশন ইত্যাদি। মায়া ক্র্যাক প্লাটুনের এসব অভিযানে অংশ নিয়েছিল(গ্যানিজ ও ভোগ-এর অপারেশন) মায়া, মানু এবং গাজী দস্তগীর। এরা একটি ৯০ সিসি হোন্ডায় চেপে অপারেশনে যায়। সাথে ছিল একটি স্টেন, গোটা কয়েক গ্রেনেড-৩৬ ও ফসফরাস বোমা। কভারে ছিলাম টয়োটাতে চেপে আমি (সামাদ) উলতফ ও জুয়েল (পরবর্তীকালে শহীদ)। পি-এনও পেট্রোল পাম্প অভিযানটি হয়েছিল একটু ভিন্ন কায়দায়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা এখানে হানা দিয়েছিল কালো মুখোশ পরে, শুধু চোখ দুটো বের করে রেখে। মুখোশগুলো সেলাই করে দিয়েছিলেন আমার স্ত্রী শাহীন বানু। পাম্পের অবাঙালি কর্মচারীর ‘ফ্যান্টোমাস আগেয়া’ বলে আর্ত চিৎকার করে পালিয়ে যায়। গেরিলা দল ১০ পাউণ্ড পিকে চার্জ লাগিয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায় অপারেশনের স্টেন হাতে ছিল গাজী দস্তগীর ও টুলু। পাম্প অফিসের ঘরের পাহারায় ছিল নীলু। বিস্ফোরক চার্জ বসিয়েছিল মায়া। গাড়ির ড্রাইভিংয়ে ছিলাম আমি। এই ভক্স ও্যাগন গাড়িটি ছিল এয়ার ভাইস মার্শাল (তৎকালীন উইং কমান্ডাএ), কে,এম, আমিনুল ইসলামের। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সীমান্ত অতিক্রমের পূর্বে এই গাড়ি ও তার নিজের পিস্তলটি আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। এই গাড়িটি পাওয়ার স্টেশনশহ ঢাকার বিভিন্ন অপারেশনে আমাদের প্রভূত  কাজে এসেছিল।

 

কমলাপুর রেল স্টেশনের অপারেশনটি ছিল আমার, মায়া, দস্তগীর- সম্মিলিতভাবে এই তিনজনের একটি গ্রেনেড থ্রো-এর অপারেশন। গ্রেনেড দুটি ছিল আমার গাড়ির ডেস্ক বোর্ডে দুটি বৈদ্যুতিক তারের বাল্বের মোড়কে ঢাকা, যাতে চেকিংয়ে পড়লে খানসেনাদের দৃষ্টিকে তা সহজেই প্রতারিত করতে পারে। প্রয়োজনীয় কভার দেওয়ার জন্য আমার গাড়ির পেছনের বনেটে বানানো, ঠিক সীটের মতো দেখতে, একটি চোরা পকেটে রাখতাম সব সময় দুটো স্টেনগান।

 

আমদের এই অপারেশনগুলির উদ্দেশ্য ছিল হানাদার বাহিনী অধিকৃত খোদ ঢাকা নগরীতেই যে স্বাভাবিক অবস্থা আদৌ বিরাজ করছে না তা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া। আমার এই প্রাথমিক উদ্দেশ্যে সফল হয়েছিলাম এবং আমাদের এই দুর্ধর্ষ অভিযানসমূহের প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতিতে অপরাহ্নকাল অতিক্রান্ত হতে না হতেই ঢাকা শহর জনশূন্য হয়ে পড়া ছিল তখনকার দিনে প্রায় রোজকার অবস্থা। তবে আমাদের যা কিছু অপারেশন হয়েছিল, তা হয়েছিল নতুন ঢাকা এলাকাতেই। পুরনো ঢাকায় আমাদের কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করতে পারিনি।

 

অপারেশনের সমস্ত খবর আমি স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করে সেক্টরে পাঠিয়ে দিতাম। আমাদের এই প্রাথমিক গেরিলা মিশনগুলির সাফল্যের পরবর্তী পর্যায়ে মেজর অপারেশন চালানোর নির্দেশ পেতে থাকি। এই সময় আমরা জেনারেল ওসমানীর একখানি চিঠি পাই। তাঁর চিঠিতে ছিল অপারেশনের জন্য রেকি করা, অবজেকটিভ বা টার্গেট স্থির করা, এসকেপ রুট ঠিক রাখা এবং বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজে বের করা সংক্রান্ত মূল্যবান পরামর্শ।

 

প্রাথমিক অভিযানগুলির সাফল্য আমাদের আরবান গেরিলা কার্যক্রমকে আরও বিকশিত করে তুলতে থাকে এবং উন্নত ফায়ার পাওয়ারসজ্জিত একটি আধুনিক সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থায় এনে দাঁড় করায়। আমাদের গেরিলা দলে ক্রমেই আরো নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেরা আসতে শুরু করে। এদের মধ্যে বদি(বদিউল আলম), আলম, স্বপনের কথা মনে পড়ছে। জন সমর্থনের ক্ষেত্রেও ক্রমশঃ প্রসারিত হতে শুরু করে। উলতফের চাচা সাংবাদিক আতাউস সামাদ ফ্লাইট লেঃ হামিদুল্লাহকে সীমান্ত অতিক্রমে সাহায্যকারী পরিবারের টিকাটুলী হাটখোলার শাহাদাত চৌধুরী (বর্তমানে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রার’ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) তাঁর ছোট ভাই ফতে আলী, এবং তাদের কনিষ্ঠ আরেক ডাক্তার ভ্রাতা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। হাফিজ ভাইয়ের বাসায় আলতাফ মাহমুদের যাতায়াত ছিল, গেরিলা তৎপরতায় তাঁর সমর্থন ছিল। সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র এক জায়গায় থাকলে তা জানাজানির পর যদি পুরো সম্ভারই শত্রুদের হাতে ধরা পড়ে যায় এই আশংকায় আলতাফ মাহমুদ সেগুলি বিভিন্ন স্থানে রাখার পরামর্শ দেন এবং তাঁর নিজের বাসায়ও তার কিছু নিয়ে রাখেন। গেরিলাদের সাথে তাঁর এই সংযোগ ও তাঁর বাসায় এই অস্ত্র পাওয়ার জন্য পাকবাহিনী তাকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায় এবং অকথ্য নির্যাতন করে বাংলাদেশের এই প্রখ্যাত সুরকারকে হত্যা করে।

 

গেরিলা কর্মকান্ডের ক্রম বিস্তৃতিতের পরবর্তী ধাপে মায়া ক্র্যাক প্লাটুন যে অপারেশনগুলি পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিশেষভাবে সেগুলি ছিল

 

(১) ফার্মগেট অপারেশন

(২) দুঃসাহসিক উলান পাওয়ার স্টেশন অপারেশন

(৩) গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন

(৪) ওয়াপদা পাওয়ার হাউস রেইড

(৫) কাটাবন মসজিদের উত্তর পার্শ্বস্থ বৈদ্যুতিক স্টেশনে হামলা

(৬) হোটেল ইন্টারকনের বিস্ফোরণ ইত্যাদি।

 

এ ছাড়া, এগারনা রকটে যোগে এমপি হোস্টেল আক্রমণও ছিল এই পর্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যাতে ব্রিগেডিয়ার বশরি, লেঃ জেনারেল কর্নেল হেফাজীর মতো পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররাও ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিল। এম-কে ১৬ মাইন সংস্থাপন করে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াসও এই সময়ের ব্যাপার। এগুলি সবই ছিল জুলাই-আগস্ট মাসের ঘটনা।

 

ফার্মগেট অপারেশন চালিয়েছিল মোট ৬ জন গেরিলা- আমি (ড্রাইভিংয়ে) জুয়েল, বদিউজ্জামান আলম, পুলু ও স্বপন। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল আলমের হাতে একটি চাইনীজ এস, এম জি, বাকী সবাইয়ের হাতে স্টেনগান। একটি ফসফরাস গ্রেনেড ও একটি গ্রেনেড-৩৬ জুয়েল ও পুলুর হাতে। অপারেশনটি মাত্র তিন মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়। অবশ্য তাঁর পূর্বে কয়েক দফা রেকি করে অভিযানের পরিকল্পনা স্থির করা হয়। এ অপারেশনে মারা গিয়েছিল হানাদার বাহিনীর ৫ জন মিলিটারী পুলিশ ও তাদের সহযোগী ৬ জন রাজাকার। ঢাক সেনানিবাস, অপারশন হেড কোয়ার্টার, এম পি এ হোস্টেল এবং তৎকালীন দ্বিতীয় রাজধানী (বর্তমানে শেরে-বাংলা নগর) এলাকার কাছাকাছি ফার্মগেটে খান সেনাদের একটি বড় ধরনের কড়া চেকপোস্টের উপর গেরিলাদের এই দুঃসাহসিক হামলা বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। উলান অপারেশনেও এমনি ইমপ্যাক্ট সৃষ্টি হয়েছিল। এটি ছিল জুলাইয়ের শেষ পক্ষের ঘটনা। অপারেশনটি সংঘটিত হয় গাজী দস্তগীরের নেতৃত্বে। দলে ছিল জিয়া, নীলু, হাফিজ এবং অন্যান্য আরো কয়েকজন। এরা ক্ষিপ্রতার সাথে পাওয়ার স্টেশনে পাহারারত পুলিশদের অতি সহজেই পরাভূত করে ট্রান্সফর্মারটিকে মারাত্মক ক্ষতি সাধনে সমর্থ হয়েছিল। একই সময় রাত্রি নয়টার দিকে গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনটিও উড়িয়ে দেওয়া হয়। ক্র্যাক প্লাটুনের পুলু, সাইদ, জুয়েল হানিফ ও বাশার আরেকটি দলে বিভক্ত হয়ে এই অপারেশন চালায়, নেতৃত্বে ছিল জুয়েল। গাড়ির ড্রাইভিংয়ে ছিলাম আমি। ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ অপারেশন করি মায়া, আমি,উলফত এই কয়জনে মিলে। কাঁটাবনের উত্তর পার্শ্বস্থ কেন্দ্রের উপর হামলাটি চাইয়েছিল আলম, জিয়া, বদি চুল্লুর গাড়িতে করে।

 

বিশেষভাবে ঢাকার পাওয়ার স্টেশনগুলি মায়া ক্র্যাক প্লাটুনের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল এই উদ্দেশ্যে যে, এগুলিকে অকেজো করে দিতে পারলে শুধু ঢাকা নগরীই অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে না, বন্ধ হয়ে যাবে দখলদার বাহিনীর রেডিও, টিভির সমস্ত প্রচার ও তাদের কর্মপ্রবাহ। এসব বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার সম্পর্কিত খুঁটিনাটি তথ্য জুগিয়েছিলেন দু’জন প্রকৌশলী। এদের একজন ছিলেন ওয়াপদার বিদ্যুৎ সরবরাহ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী।

 

জনাব নজরুল ইসলাম (পরবর্তীতে শহীদ)। তারা ট্রান্সফর্মারগুলি কিভাবে ধ্বংস করতে হবে তার জন্য প্রয়োজনীয় ডায়াগ্রাম ইত্যাদি সরবরাহ করেছিলেন। একই সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সেকশন অফিসার জনাব ডাবলু আহমদের কথা। তিনি বাংলাদেশের সকল ব্রিজে আর কালভার্ট এর ব্লুপ্রিন্ট তাঁর অফিস থেকে গোপনে মুজিবনগর সরকারের কাছে আমার মাধ্যমে সরবরাহ করেছিলেন, পরে তিনি পাকবাহিনী কর্তৃক ধৃত হয়ে ক্যান্টনমেন্টে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন। সেলিম নামের এক বোম্বাইয়া যুবকের কথাও প্রসঙ্গগতঃ উল্লেখের দাবী রাখে। সে বার্মা থেকে এসে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল। পাঞ্জাবীদের সাথে তার যোগাযোগ থাকায় তার মারফত অনেক গুরুত্বপুর্ণ তথ্য পেতাম। সেগুলি আমাদের অপারেশনের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল।

 

হোটেল ইন্টারকনের ওপর ১১ ই আগস্টের ২য় দফায় হামলা ছিল ক্র্যাক প্লাটুনের একটি মাষ্টার পিস বিশেষ। এ অপারেশনের মূল নায়ক ছিলাম আমি এবং বাকের (পরে শহীদ)। উলফত, মায়া ও গাজী ছিল সাথে। হোটেল ইন্টারকনের ওপর জুন মাসের হামলার পর খানসেনারা কড়া পাহারা বসিয়েছিল। সেখানে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। মিঃ জামান ও ওয়ারিস নামে জৈনিক বিহারীর বদৌলতে হোটেলের প্রেমিসে অবস্থিত থাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের নতুন অফিস কক্ষের জন্য গ্লো-সাইন তৈরির অর্ডার সংগ্রহ করে সেই সুবাদে হোটেলে প্রবেশের সুযোগ করে নিই এবং কিভাবে অপারেশন করা যায় সে সম্বন্ধে রেকি করি। ব্যবসার নাম করে আমি সব সময় একটি ব্রীফকেস বহন করে নিয়ে যেতাম। গ্লো-সাইন তৈরীর কাজ শেষ হওয়ার পর দিনই ব্রীফকেসে ২৮ পাউণ্ড পি-কে এবং ৫৫ মিনিট মেয়াদী ‘টাইম পেন্সিল’ ভরে বিকেলে গাড়িতে চেপে রওয়ানা হলাম আমি, বাকের, মায়া ও গাজী। এদের মধ্যে শেষের দু’জন গাড়ীতে স্টেনগান নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। এরপর হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ রচিত ‘বিচ্ছুদের নেপথ্য কাহিনী’ শিরোনামে দৈনিক বাংলা, ১০ জানুয়ারী, ১৯৭২-এ প্রকাশিত সিরিজে* অপারেশনের অবশিষ্ট বর্ণনা হচ্ছেঃ হোটেলের লাউঞ্জে প্রবেশের জন্যে মূল দরজা দিয়ে না ঢুকে ‘সুইস এয়ার’-এর অফিসকক্ষের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সামাদ ও বাকের। এ ব্যাপারে সহায়তা করলো ঐ অফিসেরই এক বন্ধু মোঃ শফি। প্রথমে সামাদ টয়লেট রুমে ঢুকলেন। খানিক পরে বাকের। ব্রীফকেস নিয়ে একেবারে কোনার ল্যাট্রিনে ঢুকলো বাকের। বাক্স খুলে ‘টাইম পেন্সিল’ প্রেস করলো। এর আগেই ল্যাট্রিনের দরজার ‘লক’ করা হয়েছে, সামাদ সাহেব রয়েছেন টয়লেটের মূল দরজার দাঁড়িয়ে ‘কভার’ হিসেবে। বাকের ব্রীফকেসটি রাখলো কমোডের পেছনে। তারপর দরজা তেমনি বন্ধ রেখে ল্যাট্রিনের উপর দিক দিয়ে দেয়াল টপকে বেরিয়ে এলো বাকের। তারপর প্রথমে সামাদ ও পরে বাকের হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ৫-৫৬ মিনিটে ঘটলো প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। হোটেল লাউঞ্জ শপিং আর্কেড এবং আশেপাশের কক্ষের কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেল, ছিটকে গেল কক্ষের দরজা, ভেঙ্গে পড়লো কক্ষের ভেতরকার এবং লাউঞ্জের লাগোয়া দেয়াল। আহত হলো বেশ কয়েকজন। বিশ্ব সংবাদপত্রসমূহে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার রোমাঞ্চকর সচিত্র সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হলো। প্রকাশিত এরূপ একটি সংবাদের অংশবিশেষ এখনো আমার মনে আছে। এটা ছিল, “It shows that the guerillas can move at Dacca city at their will.” (অনুবাদঃ এটা নির্দেশ করে যে গেরিলারা ঢাকায় মন মতো চলাফেরা করতে পারছে)

Scroll to Top