সাক্ষাৎকারঃ মোঃ রহমতউল্লাহ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
নৌ বাহিনীর গঠন ও তার যুদ্ধ তৎপরতা সূত্রঃ বাংলা একাডেমির দলিলপত্র ১৯৭১

 

<১০, ২২.১, ৫১০-৫১৪>

অনুবাদ

সাক্ষাৎকারঃ মোঃ রহমত উল্লাহ

 

১০ শে জানুয়ারি ১৯৭১ আমরা বোম্বে এয়ারপোর্ট এ পৌঁছাই এবং সেখানে  মেজর ও কমিশনার সাহেব আমাদের উষ্ণভাবে স্বাগত জানান।  পরের দিন আমরা নয়াদিল্লী তে পৌঁছাই এবং সেখানে ভারতের সেভী স্টাফ ও গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শর্মা আমাদের গ্রহন করেন। নয়াদিল্লী অবস্থানের প্রথম ১০ দিন আমরা ভারতীয় নৌবাহিনীর সাববেরিন ও স্থল শাখার কর্মকর্তা, ভারতীর সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার প্রদান করি। এরপর  ক্যাপ্টেন রয় চৌধুরী ও ভারতীয় আন্ত বাহিনী গোয়েন্দা দপ্তরের এক কর্নেল আমাকে ভারতে পালিয়ে আসার  লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞসা করেন। আমি তাদের প্রস্তাব করি আমরা নৌ কমান্ডো হতে চাই এবং এজন্য আমরা কমান্ডো প্রশিক্ষণ চাই। আমাদের প্রশিক্ষন গ্রহন শেষে আমরা ভারতীয় কতৃপক্ষের সহযোগীতায়  আমাদের  তত্বাবধানে বাংলাদেশী প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে একটি কামান্ডো দল গঠন করবো। প্রস্তাবটি ভারতীয় কতৃপক্ষ মঞ্জুর করেন।

 

এডমিরাল নন্দা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন রয় চৌধুরী বাংলাদেশ নেভী কামান্ডোদের সব ধরনের সাহায্য করতে পেরে অনেক বেশি আনন্দিত ছিলেন। মুর্শিদাবাদের প্লেসি তে একটি ট্রেনিং সেন্টারও প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২২ শে এপ্রিল ১৯৭১ লেফটেন্যান্ট সমীর দাস ও পেটি অফিসার গুপ্তা যমুনা নদীতে (নয়া দিল্লী) আমাদের  নৌ কামান্ডো প্রশিক্ষন শুরুর  বিস্তারিত আলোচনা করেন।

 

নিম্নলিখিত প্রশিক্ষণ সমূহ আমাদের অনুশীলন করতে হতো। (ক) পানির নীচ দিয়ে শত্রুকে আক্রমন ও ক্ষতি সাধনের জন্য  ৬/৭ ঘন্টা সাঁতার, (খ) মাইন  (গ) ল্যান্ড মাইন (গ) ব্রীজ ধ্বংস (ঘ) নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধ। আমাদের প্রশিক্ষন গ্রহনের সময় আমরা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান  কর্নেল (বর্তমানে জেনারেল) এম এ জি   ওসমানীর সাথে নয়া দিল্লীতে সাক্ষাৎ করি।আমরা আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে তার সাথে আলোচনা করি। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেন যে আমাদের পরিকল্পনা  ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন   করার জন্য তিনি কলকাতা ফিরে যেয়ে নৌ কমান্ডো ট্রেনিং ও ছাত্রদের গ্রুপ থেকে নৌ কামান্ডতে নিয়োগের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করবেন।

 

 

রিক্রুট্মেন্টঃ ১০ই মে ১৯৭১ আমরা বিমানে কলকাতা পৌঁছাই। ২১ শে মে ১৯৭১, আমি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সেনানায়ক কর্নেল (বর্তমানে জেনারেল) এম এ জি ওসমানির সাথে তাকিপুর ও ভোমরা যুব ক্যাম্প পরিদর্শন করি এবং ন্যাভাল কমান্ডো ট্রেনিং এর জন্য ১২০ জনকে নিয়োগ দেই। এই ক্যাম্পগুলো ছিলো মেজর জলিল ও লেফটান্যান্ট কর্নেল আবু ওসমানের অধীনে। নতুন রিক্রুটদের পশ্চিমবংগের প্লেসি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহনের জন্য প্রেরন করা হয়। দ্বিতীয়  ব্যাচে প্রায় ২০০ ছাত্র কে আগরতলার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বিক্রুট করা হয়। আমি ইনচার্জ হিসেবে  সকল প্রশিক্ষণার্থীদের   প্রশিক্ষণ, খাদ্য, বাসস্থান এবং সকল  পরিকল্পনা ও অপারেশন  কর্মকাণ্ডের  ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিলাম।

 

ভারতীয় কতৃপক্ষের সম্মতিতে পুরোদমে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষনের মধ্যে ছিলো, ক) কমপক্ষে ৯/১০ ঘন্টা সাঁতার, পানির উপরে ও নীচে সাঁতার, উপকুলে সাঁতার, অতিরিক্ত ওজন ও মাইন সহ সাঁতার, ফিন সহ ও ফোন ছাড়া সাঁতার, রাতে শব্দহীনসাঁতার, অপারেশন, কৌশল, খ) বিস্ফোরণ প্রশিক্ষণ, গ) গ্রেনেড ছোড়ার প্রশিক্ষণ, ঘ) ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার প্রশিক্ষণ ও ঙ) নিরস্ত্রভাবে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ । চূড়ান্ত প্রশিক্ষণ ছিলো প্লেসীর নিকটবর্তী ভাগীরথী নদীতে ১৮ ঘন্টা সাঁতার যেটির নিকটেই আমরা ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম। এই ঐতিহাসিক স্থানটি ছেলদের কঠিন ও দীর্ঘ প্রশীক্ষন গ্রহন করে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো। ছেলেদের জন্য প্রশিক্ষনকালীন সময় ছিলো অনেক কষ্টের অনেক সময় লবন ছাড়াই তাদের খাবার গ্রহন করতে হতো। বাংলাদেশ সরকারও তাদের ব্যাপারে খুব বেশী উৎসাহী দেখায়নি। প্রথম ব্যাচের কমান্ডদের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয় ১০ ই জুলাই  ও দ্বিতীয় ব্যাচ ৩১ শে জুলাই ১৯৭১ সালে তাদের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে।

 

 

পরিকল্পনাঃ ভারতীয় কতৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে বাংলাদেশের  প্রধান প্রধান বন্দরে অবস্থানকারী পাকিস্তানি ও বিদেশী জাহাজসমূহ ধ্বংস ও নদীপথ সম্পূর্ণভাবে  অচল করার  পরিকপ্লনা করি । নিম্নোক্ত বন্দরসমুহ অচল  করার জন্য আমাদের সর্বাত্তক প্রচেষ্টা ছিলো। ১) চট্টগ্রাম বন্দর (২) মংলা বন্দর (৩) চাদপুর অভ্যন্তরীণ  নদীবন্দর (৪) নারায়ণগঞ্জ অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর (৫) দাউদকান্দি আভ্যন্তরিন নদীবন্দর ও অন্যান্য বন্দর। ১৭৮ জন প্রশিক্ষত কমান্ডো ৪ ভাগ করে নিম্নোক্তভাবে প্রেরিত হয়েছিলোঃ-(ক) ফ্রান্স থেকে পালিয়া আসা অন্যতম সদস্য এ ডব্লিও চৌধুরির নেতৃত্বে প্রথম গ্রুপকে  ১লা আগস্ট ৬১ জন কে চট্টগ্রামে (খ) ২য় গ্রুপে ফ্রান্স থেকে আরেক সদস্য এম বি আলমের নেতৃত্বে ২ আগস্ট ২৮ জন কামান্ডো চাদপুরে  (গ) ফ্রান্স থেকে আসা অপর সদস্য এম বি রহমানের নেতৃত্বে ২ আগস্ট  ২৮ জন সদস্যের ৩য় দল কে নারায়ণগঞ্জ এবং (ঘ) ৪ আগস্ট ১৯৭১ চতুর্থ দলকে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা আরেক সদস্য এম এ উল্লাহ এর নেতৃত্বে ৬১ জনের কমান্ডো দলকে মংলা বন্দরে প্রেরন করা হয়। প্রত্যেক দলকে  ১৬ই আগস্ট রাতে  ০০.০০ ঘন্টায়  তাদের জন্য নির্ধারিত বন্দরে আক্রমন করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়।

 

 

 

অপারেশনের জন্য পুরো যাত্রাপথ হেটে কমান্ডো দলগুলোর চাদপুর চট্টগ্রাম নারায়ণগঞ্জ ও মংলায় পৌঁছানো কে বাংলাদেশের সবাধীনতাপ্রিয় স্বাধীন মানুষেরা অনেক উৎসাহ প্রদান করে। চার দিন ব্যাপি এই যাত্রায় তারা একটি ভাতও  খেয়ে পারে নি । তাদের এমন সব পথ অতিক্রম করতে হয়েছে যেই পথে পাঞ্জাবী সেনা, রাজাকার ও তাদের স্থানীয় সাহায্যকারীরা মুক্তিফৌজ ধরার জন্য সর্বদা সজাগ ছিলো।

 

মংলা গ্রুপ ভারত থেকে স্থানীয় নৌকা চালিয়ে  মংলায় প্রবেশ করে।পুরো যাত্রায় বিশুদ্ধ পানির কোন ব্যবস্থা ছিলো না। আসার পথে তারা সুন্দরবনের গহীন জঙ্গল অতিক্রম করে। ৬ই আগস্ট, ১৯৭১  তারা একযোগে আক্রমন পরিচালনা করে এবং বাংলাদেশের মানুষ রেডিও-বাংলাদেশ, বিবিসি, লন্ডনের মাধ্যমে এই  সাফল্যের  খবরটি জানতে পারে। বাংলাদেশের নৌ কমান্ডোরা চট্টগ্রামে ৬ টি জাহাজ ও বার্য, মংলায় ৫ টি জাহাজ ও বার্য, নারায়ণগঞ্জে  তিনিটি কোস্টার ও বার্য ও চাদপুরে একটি জাহাজ ও প্নটুন ধ্বংস করে। দাউদকান্দি সেতুও সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করা হয়। এর ফলে পাকিস্তানি গানবোটগুলোর চলাচলের পথ ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার একমাত্র নৌ পথটিও বাংলাদেশের নৌ কামান্ডোদের আক্রমনে  বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের মুক্তিবাহীনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এরকম অভিযান এর আগে হয়নি। এই খবর অংশগ্রহণকারী কামান্ডোদের অত্মায় শান্তি এনে দেয়।  অপারেশন সাফল্যের সাথে শেষ করে তারা প্লেসি ক্যাম্পে ফেরত আসে। বাংলার সাহসী বীরএর একজন  জনাব আফতাবুদিন ( নংঃ ০০৫৬) খুলনার ভুদহাটায় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ার ঘটনা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। রাজাকাররা পরে থাকে নির্মমভাবে হত্যা করে ।

 

 

আগরতলা যুব ক্যাম্প থেকে ৬০ জন তরুন আমাদের ক্যাম্পে কমান্ডো ট্রেনিং এ  যোগদান করেছিলো। আবার পশ্চিমবঙ্গের ১২০ জন তরুন যুব ক্যাম্প থেকে আমাদের ক্যাম্পে যোগদান করে। ২৬ শে আগস্ট ১৯৭১ চার থেকে বিশ জনের ছোট ছোট গ্রুপ করে নিম্নোক্ত স্থানসমূহে আমরা নাশকতা ও ধংসাত্বক অপারেশন  পরিচালনার জন্য প্রেরন করি। স্থানগুলো হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর, বরিশাল, মংলা,আরিচা, সিলেট,নগরবাড়ি, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, মাগুরা, দাউদকান্দি, ফুলছরিঘাট, খুলনা,রাজশাহী,ভোলা ,নরসিংদী,নবীনগর, রাজবাড়ী, অস্টগ্রাম ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর।  তারা তাদের নির্ধারিত স্থানে অপারেশন পরিচালনা করে সময়মত প্লেসি ক্যাম্পে ফেরত আসে ।পাকশির হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংসের পদক্ষেপ ও নেয়া হয়। একটি অপারেশনে ৪ জনের একটি কমান্ডো গ্রুপ রাজাকারদের হাতে  ধরা পরে এবং তাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। অমানুষিক অত্যাচারেও আমাদের নতুন ট্রেনিং প্রাপ্ত কমান্ডোরা তাদের পরিচয় প্রকাশ করে নি। পরে তারা মুক্তি পায়। ফরিদপুর অপারেশনে শহীদ কবিররুজামান ( নংঃ ০০৬৭) পাঞ্জাবীদের হাতে নিহত হন। চট্টগ্রাম বন্দরে আমাদের একজন সদস্য নিখোজ হন তখন তিনি বহিঃনোঙ্গর এলাকায় অপারেশনে নিয়োজিত ছিলেন। ফুলছরিঘাট অপারেশনে একটী চলন্ত গানবোটে মাইন স্থাপন করতে গিয়ে এ আর মিয়ান সহ ৩ জন নিহত হন।

 

 

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কামান্ডার ইন চিফ ব্রিগেডিয়ার সালেক কে  খুলনাতে আমাকে সহ ১১ জন কে একটি অপারেশনে পাঠানোর পরামর্শ দেন।  আমি ২৬ শে সেপ্টেমবর ১৯৭১ তাকিতে অবস্থিত নয় নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে  প্লেসি ক্যাম্প ত্যাগ করি। আমাকে নিম্নোক্ত অস্ত্র সমূহ প্রদান করা হয়। ২৬ টি মাইন, ২০ পাউন্ড বিস্ফোরক, ২টি এস এল আর, ৪ টি এস এমজি ও ৬০০ টাকা। ৪০ জন মুক্তিফৌজ সহ লেফটেন্যান্ট আরেফিন, ২০ জন নৌ কমান্ডো সহ এম বি আলম  ও গ্রুপ ইনচারজ খিজির আলী ৪০ জন মুক্তিফৌজ সহ আমার সাথে ৩০ সেপ্টেমবর তাকি ক্যাম্পে যোগদান করেন। খুলনা ও সুন্দরবন এলাকায় তিনটি ট্রেইনিং ক্যাম্প সহ আমি ১৯ টি ক্যাম্প স্থাপন করি ও নিম্নোক্ত অপারেশন সমূহ পরিচালনা করি। ৮ হাজার মুক্তিসেনা এইসব ক্যাম্পে প্রশিক্ষন দেয়া হয় এবং তারা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে। অক্টোবর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার নেতৃত্বে নিম্নোক্ত অপারেশনসমুহ পরিচালনা করি, (১) ৬ অক্টোবর আশাসুনি অপারেশন, এখানে ২৫ জন রাজাকার নিহত ও আহত হয়। (২) ৯ অক্টোবর চাপড়া অপারেশন, এখয়ানে ৬ জন রাজাকার নিহত ও আহত হয়। (৩) ১৫ ও ২৮ অক্টোবর সুন্দরবন অপারেশন, এখানে ৬ জন ডাকাত আটক করা হয়। (৪) ২৬ শে অক্টোবর কয়রা অপারেশন এখানে একটি জাহাজ একটি বার্য ও একটী ফ্লাট ধ্বংস ডুবিয়ে দেয়া হয়। (৫) ২ নভেম্বর মংলা বন্দরে ২টি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়। (৬) ৮ নভেম্বর লক্ষিখোলা অপারেশনে ৬ জন রাজাকার আহত ও নিহত হয়। (৭) ১২ই নভেম্বর মংলা বন্দরে একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়। (৮) ২৫শে নভেম্বর চালনা অপারেশনে ১০ জন রাজাকার নিহত ও আহত হয়। (৯) ৫ ডিসেম্বর কাপিলমুনি অপারেশনে ১০০ রাজাকার নিহত হয়। (১০) ৬ নভেম্বর আশাসুনি অপারেশনে ২ জন রাজাকার নিহত হয় ও একজন আত্মসমর্পণ করে। (১১) ৭ ডিসেম্বর দেবহাটা অপারেশনে একজন রাজাকার নিহত ও একজন আত্মসমর্পণ করে। (১২) ৮ ডিসেম্বর মাংলা বন্দরে সকল রাজাকার আত্মসমর্পণ করে ও সকল অস্ত্র দখল করা হয়। (১৩) ১০ ডিসেম্বর বাইটাঘাটা অপারেশনে ২ জন রাজাকার নিহত ও একজন আত্মসমর্পণ করে। (১৪) ১৪ই ডিসেম্বর গোল্লামারি অপারেশন পাক বাহিনীর তীব্র গোলাবর্ষণ এর কারনে পরিত্যাগ করা হয়  এবং (১৫)  ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর আমার অধীনে খুলনা জেলার  ৮০০০ মুক্তি বাহিনী ও মুজিব বাহিনী ছিলো  এবং সম্মিলিতভাবে আমরা খুলনা আক্রমন করি। শত্রুদের কাছ থেকে দখল করা ২ টি বার্জ,  ৪ টি ৪০/৬০ মিমিঃ কামান দিয়ে সজ্জিত দুটি বার্য থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থাসমূহের উপর গোলাবর্ষণ করা হয় এবং পাক বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষের পর আমি ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৬.৩০ ঘন্টায় খুলনা শহরে প্রবেশ করি। এখানে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।

 

 

যেদিন থেকে আমি অপারেশন ও তরুনদের ক্যাম্পে প্রশিক্ষন দেয়া শুরু করি সেদিন থেকে স্বাধীনতার দিনটি পর্যন্ত নিম্নোক্ত কমান্ডারগন আমার অধীনে ছিলেন। এরা হলেন, ১) ক্যাপ্টেন শফিকুল্লাহ,২) লেফটেন্যান্ট আ স ম আরেফিন, ৩) মুজিব বাহিনীর খুলনা জেলার চীফ জনাব কামরুজ্জামান (টূকু), ৪) জনাব তৌফিক (মুজিব বাহিনী),৫)জনাব বাহার আলী (মুজিব বাহিনী),৬) জনাব কাইযুম(মুজিব বাহিনী),৭) জনাব এম এ সালাম (মুজিব বাহিনী), ৮) জনাব ইউনুস (মুজিব বাহিনী) ও ৯) জনাব খিজির আলি।

 

এখানে উল্লেখ্য ব্যাপার এই যে খুলনা ও মংলায় নদীতে অনেক কুমির ছিলো এবং আমাদের কমান্ডোরা পায়ে শুধুমাত্র ফিন পরে ও লিমপেট মাইন নিয়ে অপারেশনে যেতো এবং কুমিরের জন্য কোন অপারেশনেই কোন দুর্ঘটনা ঘটে নি। যদিও শীতে পানি ছিলো বরফশীতল তারপরেও আমাদের কমান্ডোদের দিনের পর দিন পানিতে থাকতে হতো। তীব্র বর্ষণ, তীব্র শীত, রেশনহীন, আশ্রয়হীন ভাবে তাদের থাকতে হতো এমনকি সুন্দরবনেও থাকতে হতো যেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। এই কমান্ডোরা অনেক অনেক অপারেশন করেছে যেগুলো বর্ণনা করা সম্ভব নয়। জহুরুল হক,আব্দুল খালেক, শমশের আলী মংলা অপারেশনে গুরুতরভাবে আহত হন। কমান্ডো অপারেশনে ছোট বড় ৭৬ টি সমুদ্রগামী জাহাজ, বার্য,কোস্টার, গানবোট, কনভারটেড গানবোট,ফ্লাট ,ডুবিয়ে দেয়া হয় ও কিছু জেটি ও ব্রিজ ধ্বংস করা হয়।

 

এটি উল্লেখ্য যে হাসনাবাদ ও হালদিয়া ক্যাম্প দুটি পক্ষত্যাগ করা পাকিস্তানি নেভি সদস্যদের সংগঠিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো। নয় নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিলের সহযোগিতায় নেভির জন্য বঙ্গবন্ধু ফ্লিট নামের একটি ফ্লিট তৈরি করা হয়েছিলো। এই ফ্লিটটি ছোট অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত ছোট ছোট বোট  দিয়ে গঠিত হয়েছিলো। তারা সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ে ছোট ছোট অপারেশন চালাতে আসতো। তারা বাংলাদেশে সম্পূর্ণভাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে।

 

পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করা সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত  দুটি গানবোট পদ্মা ও পলাশ অপারেশনের জন্য খুলনা এলাকায় আসে। দুটি গানবোটই ধ্বংস হয়। ডুবে যাওয়া দুটি গানবোটে সেইলর ও সৈন্যদের পজিশন ও তাদের পরিনতি নিম্নে দেয়া হলো। শহীদঃ  রুহুল আমিন C. ERA,মোহাম্মদ মমতাজউদ্দিন  Me-1, মহিউদ্দিন  A. B. M. D. H,, মোল্লাহ  A.B., এম এম রহমান A.B, এম হক A.B, রফিকুল ইসলাম নেভাল কমান্ডো এবং ফরিদউদ্দিন আহমেদ  REN-1, আহতঃ এম এ তাহের  ME-1, এ আর ভুঁইয়া -EN-1, এম ফজল এল এম ই, আব্দুল হোক এ বি এম এ মুতালিব এ বি এম এ মজুমদার এম ই-১, নেভি কমান্ডো বশির আহমেদ ও মোঃ জালালউদ্দিন  L/S। রাজাকারদের কাছে ধরা পরেন ও নির্মম অত্যাচারের জন্য খুলনা জেলে নেয়া হয়, এম এ রউফ L/S, এম এস হক L/wrt, এম এ সরকার PO/RS, এম এ হুসেন S/td, এ আর খান To-2, রফিকুল্লাহ A. B, জাকের জাকের L/S, তাহের ME/I.।

 

এছাড়া নৌসেনাদের ৮ জনের একটি দল হাজামারায়  ৩ নম্বর সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। তারা হলেন, জনাব ইসলাম ইআর, এম এম উদ্দিন L/wrt, জেড ইউ আহমেদ – CK-I, কে এন ইসলাম PM-1, সালেহ মোহাম্মদ ADD, আমিন- REN-I, ও সিরাজউদ্দিন AB।  কর্নেল শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বি কম্পানির অধীনে  এই ৮ জন নৌসেনা  ধর্ম নগর (সিলেট) এলাকায় পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে  যুদ্ধ করে। তিনটি আক্রমনেই তারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন, এছাড়া তারা প্রতিদিনই শহীদ লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামানের নেতৃত্বে সিলেটের অভ্যন্তরে যুদ্ধে যেতেন। তারা বর্ডার এলাকা ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। এছাড়া আরো নৌসেনা যারা বিদ্রোহ করেছিলো তারা বিভিন্ন সেক্টরের অধীনে সাহসের সাথে মাতৃভূমির জন্য  যুদ্ধে অংশ নেন।

 

 

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশীদের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। এদিনে ৬-৪৫ ঘন্টায় আমি খুলনা সার্কিট হাউজে বাংলাদেশের পতাকা উড়াই। শহরের জনতা সেদিন জয় বাংলা শ্লোগান তুলে উল্লাস করছিলো। তারা মুজিব বাহিনীকে শহরে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছিলো। ১১-০০ ঘটিকায় মেজর জলিল ভারতীয় সৈন্যদের সাথে নিয়ে খুলনা শহরে প্রবেশ করেন এবং খুলনা শহরে আমাকে ও আমার গ্রুপকে দেখে আশ্চর্য হয়ে যান।

 

                            ___ জয় বাংলা ____

(মোহাম্মাদ রহমতুল্লাহ)

সাব লেফটেন্যান্ট, পাকিস্তান নৌ বাহিনী

১৯-১১-১৯৭৪

Scroll to Top