সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার আলী মোহাম্মদ মকিবর রহমান সরকার

<, ১১.২, ৩২৯৩৩০>

সারদা ও অন্যান্য স্থানের সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার- সুবেদার আলী মোহাম্মদ মকিবর রহমান সরকার
০৬-০৬-১৯৭৩

২৫ মার্চের ঘটনায় আমরা বিস্মিত হয়ে পড়ি এবং পশ্চিমা শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য অস্ত্র দিয়ে অস্ত্রের জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হই।

 

সারদায় অস্ত্র সংগ্রহঃ সারদা পুলিশ একাডেমির ভাইস প্রিন্সিপাল মিঃ বড়ুয়াকে সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের আজিজুর রহমানকে সম্পাদক করে এবং আমি স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে একটি মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি। সেই মুহুর্তে আমাদের সঙ্গে পুলিশের কিছু অংশ ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র, অধ্যাপক মিলে বিরাট এক মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। সারদা ক্যাডেট কলেজ থেকে ৩০৩ মার্কা রাইফেল এবং পুলিশ একাডেমি থেকে ৬০০/৭০০ রাইফেল ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করি। এবং সারদা ও রাজশাহী রোডে বাংকার করে পজিশন নিয়ে থাকি।

 

রাজশাহীতে ইতিমধ্যে পাক সেনারা অবস্থান করছিলো। আমরা একটি কোম্পানী নিয়ে রাজশাহী অভিমুখে যাত্রা করি। কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা শুনতে পাই যে, নাটোর হয়ে আরেকটি ব্যাটালিয়ান ঢাকা-পাবনা-নগরবাড়ীর পথে রাজশাহীর দিকে আসছে। ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বে ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতিরোধের জন্য পাঠানো হয়।

 

আমরা প্রথমে পাবনার মুলাডুলিতে পাকসেনাদের সম্মুখীন হই। সংঘর্ষে পাকসেনাদের বিপুল ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটি। রাজশাহীতে অপর যে দলটি ছিলো তাদের সঙ্গে পাক সেনাদের নিয়মিত যুদ্ধ হচ্ছিল। সংঘর্ষে সমস্ত পাকসেনা খতম হয়।

 

১২ এপ্রিল রাজশাহী সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। অপর দল যেটা মুলাডুলিতে পিছু হটেছিলোসেই দলটি নাটোরে গিয়ে পুনরায় পজিশন নেয়। সেখানেও ব্যাপক শেলিং-এর সামনে টিকতে না পেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে আমরা পিছু হটি। সেখান থেকে আমরা বানেশ্বরে(রাজশাহী) ডিফেন্স নেই। পাক আর্মীর একটি ব্যাটালিয়ান ৭৫ মিলিমিটার কামান এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করে।

 

ইতিমধ্যে আমরা খবর পেলাম আড়ানীতে ২০/২৫ জন পাক সেনা গ্রামে ঢুকে নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করছে এবং ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিচ্ছে। খবর পেয়ে আমি একটা ছোট সেকশন নিয়ে গ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হই। গ্রামে গিয়ে শোনলাম নদীর অপর পাড়ে পাক সেনারা পজিশন নিয়ে আছে। আমরা ফায়ারিং শুরু করি। বহুক্ষণ ফায়ারিংয়ের পর অপর পক্ষ থেকে কোনো জবাব না আসায় বিস্মিত হই। পরে সেখানে গিয়ে দেখলাম তারা ‘ক্যামোফ্লেজ’ করে পালিয়েছে। পাক সেনারা কলাগাছ কেটে তাতে খাকী কাপড় পড়িয়ে এবং কাঠের তৈরী রাইফেল হাতে দিয়ে নদীর পাড়ে আমাদের দিকে মুখ করে রেখে দিয়েছে। আমরা ভাবছিলাম পাক সেনারাই অস্ত্র নিয়ে পজিশনে আছে।

 

আড়ানী ব্রিজে প্রতিরোধঃ আমরা হতাশ হয়ে নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করে আড়ানী ব্রিজের নিচে এ্যামবুশ করতে থাকি। রাত্রি ৪টার দিকে বুঝতে পারলাম ব্রিজের উপর দিয়ে কিছু লোক যাচ্ছে। হল্ট বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা ফায়ারিং শুরু করে। আমরা পাল্টা জবাব দেই। কিছুক্ষণ উভয় পক্ষে সংঘর্ষ হয়। ৫/৭ মিনিট পর ব্রিজের উপরে পাক সেনারা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। আমরা সেখানে ৪টি পাক সেনার লাশ উদ্ধার করি। বাক দুই চারজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

 

বানেশ্বরেরযুদ্ধ ও সারদায় গণহত্যাঃ আমরা সবাই রওয়ানা হয়ে ১৩ই এপ্রিল তারিখে বানেশ্বরের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেই। বানেশ্বরে পাক সেনাদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আমাদের মুক্তি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অনেক মুক্তিসেনা শাহাদাত বরণ করে। বানেশ্বর এবং সেই সাথে সারদার পতন হয়। সারদায় পাক আর্মী চলে আসায় বেসামরিক লোক ও সামরিক বাহিনীর প্রায় ১৫০০/২০০০ লোক নদীর ধারে আশ্রয় নিয়েছিলো। পাক সেনারা তাদের ঘিরে ফেলে এবং ৭০০/৮০০ লোককে নৃশংসভাবে গুলি করে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। ওই দলের মধ্যে আমরা মাত্র তিন চারজন বেঁচে ছিলাম। পাক সেনাবাহিনী সন্ধ্যার দিকে রওয়ানা হয় এবং রাজশাহী দখল করে নেয়।

Scroll to Top