কুষ্টিয়া-যশোরের সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার : মোহাম্মদ তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী

১৪-১০-১৯৭৩

<৯, ৭.৩, ২৫০-২৬০> 

২১/২২/২৩শে মার্চ আমরা নিম্নলিখিত কয়েকজন অফিসার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য তদানীন্তন এসডিপিও জনাব মাহবুবউদ্দিন আহমেদের বাসায় (ঝিনাইদহে) একত্র হই:

১। তৌফিক এলাহী, এসডিও, মেহেরপুর

২। কামালউদ্দিন সিদ্দীকী, এসডিও, নড়াইল

৩। ওয়ালিউল ইসলাম, এসডিও, মাগুরা

৪। শাহ মোহাম্মদ ফরিদ, এসডিও, গোয়ালন্দ।

আলোচনায় আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে একটা সামরিক সংঘর্ষ অবধারিত। এই বৈঠকে নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমি আমার এলাকায় সমস্ত থানার পুলিশদের প্রস্তুত রাখি।

২৫শে মার্চ রাতে নুরুল হক এমপি আমকে টেলিফোনে জানালেন যে, ঢাকায় পাক সেনাবাহিনী বের হয়ে পড়েছে এবং জনগণের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমি তাকে আমার বাসায় অবিলম্বে আসতে অনুরোধ করি। অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম যে, ঢাকা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কুষ্টিয়াকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর জানিয়েছেন এবং কুষ্টিয়া এক্সচেঞ্জ মেহেরপুরে এই খবর জানিয়েছে। প্রথমে কুষ্টিয়ার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। কিন্ত যোগাযোগ তার আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একজন অজ্ঞাতনামা অপারেটর রাজারবাগ থেকে উত্তর দেয়, ‘যা বলার বলেছি তো, আর বিরক্ত করবেন না’। আবার অনুরোধ করার পর আর কোন উত্তর পাওয়া গেল না।

২৫শে মার্চ রাত বারোটায় মাইকে কুষ্টিয়া শহরের জনগণকে ঢাকাতে পাক বাহিনীর নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা জানিয়ে দেয়া হল। সেই মুহুর্ত থেকে আমি আর পাকিস্থানী সরকারী কর্মচারী রইলাম না এবং জনগণের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলাম।

২৫শে মার্চ রাতে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা পাকাসড়কে গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরী করা হয় এবং মেহেরপুরকে চুয়াডাঙ্গার সাথে বিচ্ছিন্ন করা হয়। মেহেরপুর-কুষ্টিয়া রাস্তায় খলশাকুন্ডী কাঠের পুল ভেঙ্গেচুরে দেয়া হল। এক দল যুবক এই পুলটা ভেঙ্গে দিয়েছিল।

মেহেরপুরে আনসার কমান্ডারকে আমি আদেশ দিই ২৬শে মার্চের মধ্যে মেহেরপুর মহকুমার সমস্ত আনসার ও মুজাহিদকে একত্র করার জন্য।

২৬শে মার্চ ভোরবেলা। আমার ধারণা হয়েছিল মেহেরপুরকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমার মনে হল সমস্ত জনতার মধ্যে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে এবং প্রত্যেকে তার একক সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে এক সম্মিলিত সত্ত্বায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা এবং এর অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের শক্তি এই জনতার মধ্যে নবরূপান্তরিত সত্ত্বার মধ্যে নিহিত ছিল। প্রত্যেকটা লোক এবং প্রত্যেকটা ছেলে আমার কাছে নতুনভাবে ধরা দিয়েছিল। গায়ের বধুরা পর্যন্ত স্বতস্ফুর্ত গনজাগরণে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে একাত্মতা অনুভব করছিল। সেই মুহুর্তে আমি যেন দিব্যচক্ষে পৃথিবীর বড় বড় বিপ্লবকে চাক্ষুষ দেখতে গেলাম।

সমগ্র পরিস্থিতির আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়নে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হিই যে, আমাদের যে কোন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে এবং শুধুমাত্র ভারতই আমাদের এই সাহায্য করতে পারে। দ্বিতীয়ত: ভারত-পাকিস্থানের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় এটা সুস্পষ্ট ছিল যে, বাংলাদেশের যে কোন সামরিক বা গণঅভ্যুত্থান ভারতের সমর্থন পাবেই। তাই ২৬শে মার্চ সকালে আমি দুরকমের চিঠি ভারতে পাঠাই। একটা চিঠি পাঠানো হয়েছিল নদীয় জেলা প্রশাসকের কাছে, যার একটা অনুলিপি পাঠাই লেফটেন্যান্ট কর্ণেল চক্রবর্তী (সিও, ৭৬ বিএসএফ, বা মেহেরপুর সীমান্তের ভারতে মোতায়েন ছিল) এর কাছে। দ্বিতীয় চিঠি ভারতের জনগণকে উদ্দেশ্য করে পাঠাই। দুটো চিঠিতেই আমি আমার দস্তখত এবং সরকারী সীলমোহর ব্যবহার করি। দ্বিতীয় চিঠিটা ‘অমৃতবাজার’ এবং ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২৭/২৮/২৯/৩০ মার্চ-এর সংখ্যাগুলোতে। ‘ডেস্টিনেশন মুজিবনগর’ বইটিতে একটা চিঠির ফটোস্ট্যাট কপি মুদ্রিত রয়েছে।

প্রথম চিঠিটা নদীয়ার জেলা প্রশাসক মি: মুখার্জীর কাছে লেখা হয়েছিল। কর্ণেল চক্রবর্তী আমাকে বলেছিলেন যে এই চিঠিটা দিল্লীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনতিবিলম্বে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তারই ফলস্বরূপ ২৯শে মার্চ বেতাই (ভারতে) বিওপিতে আমাকে দেখা করার খবর পাঠানো হয়।

২৯শে মার্চ আমি বেতাই বিওপিতে যাই নদীয়া জেলা প্রশাসক এবং কর্ণেল চক্রবর্তী আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং স্থানীয় বিএসএফ-এর একটি ছোট দল গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে। আমি এবং কর্ণেল চক্রবর্তী গার্ড অব অনার পরিদর্শন করি। নদীয় জেলা প্রশাসক আমাকে আনঅফিসিয়াল দূত হিসেবে মর্যাদা দেন।

আমাদের বৈঠক এক ঘন্টাকাল স্থায়ী হয়। আপ্যায়নের মাধ্যমে মি: মুখার্জী আমাকে জানান যে, আমার চিঠির উত্তরে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া আমাকে শীঘ্রই জানানো হবে এবং তারা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশনার অপেক্ষা করছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাদের সংগ্রামে ভারতে জনগণের ও সরকারের সমর্থন জানান এবং চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে চেংখালী চেক পোষ্টের অদুরে ভারতীয় বিওপিতে কোন একজন সামরিক অফিসারকে সাথে নিয়ে দেখা করি আমাদের সামরিক প্রয়োজন সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করার জন্য। ইতিমধ্যে চুয়াডাঙ্গার তদানীন্তন ইপিআর-এর উইং কমান্ডার মেজর ওসমানের সাথে আমার যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

৩০শে মার্চ সকালে মেহেরপুর থেকে ১৮ মাইল দুরে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করতে যাই। চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান কুষ্টিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় তিনি পরামর্শ দেন যে আমি মাহবুব উদ্দিন আহম্মদ (তদানীন্তন ঝিনাইদহের এসডিপিও)-কে সাথে নিয়ে যাই। আমি মাহবুবকে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু অল্প সময় পরে হঠাৎ সে মেজর ওসমানের চুয়াডাঙ্গা অফিসে আবির্ভুত হয়। মাহবুবকে আমি ভারতীয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করি এবং তাকে বলি ঐদিন সন্ধ্যায় ভারতের চেংখালী চেকপোষ্ট বিওপিতে কিছু সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিতে আমার সাথে আসতে এবং এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সাথে বিশদ আলোচনা করতে। আমি তখন অত্যধিক উত্তেজিত ছিলাম। আমি লক্ষ্য করলাম মাহবুবও কম উত্তেজিত ছিল না। কারণ একটু পরে বুঝতে পারলাম মাহবুব আমাকে অদুরবর্তী একটি জীপের কাছে নিয়ে চলল এবং খুব গোপনে বলল (মেজর ওসমানও এ ঘটনা সম্বন্ধে তখন অবহিত ছিলেন না) যে, ঐ জীপের ভিতরে ২জন খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বসে আছেন এবং তারা হচ্ছেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) এবং ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলাম (বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী)। আমরা দু’জনে জীপের ভিতরে প্রবেশ করলাম। শার্ট এবং লুঙ্গি পরিহিত এবং পুটুলি হাতে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত এই দুই ব্যক্তিই অবশ্য পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

আলাপ-আলোচনার পর বুঝতে পারলাম তাঁরা বিভিন্ন জনপদ ঘুরে ঝিনাইদহে এসেছেন এবং সেখান থেকে মাহবুব তাদেরকে মেহেরপুরে নিয়ে আসে এই উদ্দেশ্যে যে, তাদেরকে যেন সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতে পৌঁছানো যায়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্থান সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা এবং সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং আক্রমণকে পরাভূত করে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য বন্ধু-প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে সাহায্য এবং সহযোগিতার ব্যবস্থা করা। সত্যি বলতে কি, তাঁদের এই বৃহত্তর প্রচেষ্টার তাৎপর্য আমি তখনো উপলদ্ধি করতে পারিনি। সিদ্ধান্ত হল যে, ভারত সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৈঠকে মিলিত হব। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলামের সীমান্তের অপর দিকে যাবার ব্যবস্থা করা হবে। শর্ত হল একটা, আমরা যাদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তাদের কাছে এই দুই জনের পরিচয় গোপন রাখব। তারা জানতে চাইলে আমরা বলব, এই দুই ব্যক্তি আমাদের পরিচিত।

বিকালে সীমান্তের উদ্দেশ্যে দুটো জীপ রওয়ানা দেয়। পথে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমরা ব্যারিকেডে সরিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম আমাদের গাড়ীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। রাস্তার দু’পাশে জনতা মুহুর্মুহু জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আমাদেরকে সম্বর্ধনা জানাচ্ছিল। এই দুটো জীপ গাড়ী যেন তাদের কাছে স্বাধীনতার শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। এরা অনেকেই আমাদেরকে চিনত। গ্রামবাসীরা বুঝতে পেরেছিল যে, আমরা কোন গোপন মহৎ সামরিক উদ্দেশ্যে সীমান্তে ঘোরাফেরা করছি। পথে পথে দেখতে পেলাম স্বত:স্ফুর্ত জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, অস্ত্র বলতে হয়তো একটা দুটো শর্টগান। তখনই এদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াস এবং আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে ভবিষ্যত প্রস্তুতি, সামরিক প্রতিরোধ এবং সংঘর্ষে জনশক্তি এবং এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অথচ দলবদ্ধ জনতাই জোগাবে।

সন্ধ্যার পরে পরে আমরা চেংখালী চেকপোষ্ট পৌঁছালাম। বড় বড় শিরিষ গাছের সারি দু’পাশ থেকে রাস্তার উপরে একটা ছাতার মত আবরণ সৃষ্টি করেছিল। কোন লোকালয় জনপদ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না, চারদিক পরিবেশ ধু-ধু খা-খা করছিল। শুক্লপক্ষের ম্লান চাঁদের আলো পরিবেশকে আারো গভীরতর করে তুলেছিল। পিছনে গাড়ী দুটো রেখে আমি এবং মাহবুব ধীরে এবং সতর্কতার সাথে অপরিচিত গন্তব্যস্থানের দিকে আন্দাজের উপর ভর করে এগুচ্ছিলাম। বারবার আমাদের গায়ের লোম শিউরে উঠছিল। প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর সামনে একটা পাকা ঘরের ধ্বংসস্তুপ দেখতে পেলাম, আমরা বুঝতে পারছিলাম না আমরা কোথায় যাচ্ছি। হঠাৎ সেই ভুতুড়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে যেন এক অশরীরী আত্মার আওয়াজ শুনতে পেলাম ‘হল্ট’। যদিও আমরা একটু ভড়কে গিয়েছিলাম তবুও অনতিবিলম্বে ঝোপের আড়াল থেকে একটা মানুষের ছায়া বের হয়ে আসল এবং সেটা ছিল ভারতীয় বিএসএফ-এর একজন সিপাহী, আমাদের পরিচয় দেবার পর সে আমাদেরকে তাদের বিওপিতে নিয়ে চলল। আরো আধা মাইল চলার পর আমরা বিওপিতে পৌঁছালাম এবং আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন বিএসএফ-এর উচ্চপদস্থ কর্মচারী জনাব গোলক মজুমদার এবং লেফটেন্যান্ট কর্ণেল চক্রবর্তী। আনুসঙ্গিক আলোচনার পর দুটো সিদ্ধান্ত নেয়া হলো-

১। আমাদেরকে আগামীকাল থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে এবং

২। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হবে এবং যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালাতে হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে যোগাযোগ করার। তখনো তারা জানতেন না যে আমাদের সাথে জনাব তাজউদ্দিন এবং ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলাম রয়েছেন।

আমি এবং মাহবুব নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করলাম যে, আমাদের সাথে যে তাজউদ্দিন রয়েছেন তা গোলক মজুমদারকে জানাব এবং গোলক মজুমদারকে জানালাম। তিনি আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে তাড়াতাড়ি তাজউদ্দিন সাহেবকে তার কাছে নিয়ে আসতে বললেন। আমরা তাজউদ্দিনকে তার কাছে নিয়ে আসলাম। তারা একে অপরকে আন্তরিকভাবে করমর্দন এবং আলিঙ্গন করলেন। গোলক মজুমদার আমাদেরকে বলছিলেন যে, কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে একটি সামরিক জেট অপেক্ষা করছে। যদি কোন রাজনীতিবিদ আসে তাকে যেন তক্ষুনি দিল্লীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হয়ত ঐ প্লেনেই জনাব তাজউদ্দিন এবং ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলাম দিল্লীতে গিয়েছিলেন।

রাতে আমরা এক সাথে খাবার খাই। গোলক মজুমদার তাজউদ্দিন এবং ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলামকে নিয়ে যান এবং আমরা চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে যাত্রা করি।

এই রাতে সাক্ষাৎকারের পর থেকে ভারত থেকে কমবেশী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং জ্বালানী পেতে থাকি। আমি নিজে প্রায় এক পক্ষকাল ধরে এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ভারত থেকে নিযে আসতাম। এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র চেংখালী চেকপোষ্টের বিপরীত দিকে ভারতীয় বিওপি থেকে নিয়ে আসতম। আমি প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় ভারত সীমান্ত অভিমুখে চুয়াডাঙ্গা থেকে যাত্রা করতাম। সাথে থাকত ইপিআর-এর দুটো এসকর্ট পেট্রল, কয়েকটা ট্রাক এবং কোন কোন সময় দর্শনা চিনিকলের ট্রাক্টর এবং তার সাথে লাগানো ট্রলি। এই অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করার সময় আমি ভারতীয় কাগজপত্রে দস্তখত করে নিতাম এবং মেহেরপুর এসডিও’র সরকারী সীলমোহর ব্যবহার করতাম।

মধ্যরাত্রের দিকে আমরা ভারতীয় বিওপিতে পৌছাতাম এবং চুয়াডাঙ্গায় ফেরত আসতে আসতে অধিকাংশ সময়েই ভোর হয়ে যেত। এই সময় এক নাগাড়ে আমি দশ দিন বিছানায় গা লাগাতে পারিনি। অস্ত্রশস্ত্র দেবার সময় অনেক সময় কর্ণেল চক্রবর্তী থাকতেন এবং সবসময় ক্যাপ্টেন মহাপাত্র থাকতেন। এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্র বেতাই বিওপি (যা মেহেরপুর মহকুমার সংলগ্ন ছিল) থেকে সংগ্রহ করতাম।

২৫শে মার্চ রাতে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এবং কুষ্টিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। কুষ্টিয়া এবং চুয়াডাঙ্গার খবরাখবর আমরা নিতে থাকি। আমরা খবর পাই যে, চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমি জানতে পেরেছিলাম যে, চুয়াডাঙ্গার সাধারণ ইপিআর-এর জোয়ানরা সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে। চুয়াডাঙ্গার এই সিদ্ধান্তে ইপিআর-এর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে ভূমিকা এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের এই সাহসিকতা এবং দেশপ্রেম বাংলাদেশের এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর ভূমিকা এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মেজর ওসমান কুষ্টিয়া থেকে ২৭/২৮ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় আসেন এবং তিনিও এই সিদ্ধান্তের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানান। দুইজন সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে থাকি পোশাক পরিহিত এবং সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া জেলা, পাবনা জেলার বহুলাংশ, যশোহরের কিয়দংশ এমনকি ফরিদপুরের গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত বাংলার সাধারণ জনগণের চোখে স্বাধীনতার সুর্যসৈনিক হিসেবে প্রতীয়মান ছিল। আজো শহীদ হাবিলদার মেজর মুজিবর রহমান, সুবেদার মুজাফফর, সুবেদার মুকিত এবং আরো অনেক চেনা মুখের কথা বার বার মনে পড়ছে। সেই দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে এরা আমার জন্যও আশার প্রতীক হিসেবে প্রোজ্জ্বল ছিলেন।

দু’একদিনের মধ্যেই চুয়াডাঙ্গার সাথে মেহেরপুরের যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং আমি মেজর ওসমানের সাথে চুয়াডাঙ্গায় সাক্ষাৎ করি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তু তাকে অবহিত করি। মেজর ওসমান আমাকে প্রয়োজনীয় সামরিক অস্ত্রসম্ভার সম্বন্ধে ধারণা দেন।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, গোয়ালন্দের তৎকালীন এসডিও জনাব মোহাম্মদ ফরিদ সস্ত্রীক মেহেরপুরে বেড়াতে এসে আটকা পড়ে যান। তাকে মার্চের ২৭/২৮ তারিখে গোয়ালন্দে ফেরত যাবার বন্দোবস্ত করি। জনাব ফরিদ তার স্বীয় মহকুমায় এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য অত্যধিক উৎসাহ দেখান এবং এই দুর্যোগের সময় গোয়ালন্দে ফেরত যান। তিনি পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং অমানুষিকভাবে নির্যাতিত হন। তিনি ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে মুক্তি পান।

চুয়াডাঙ্গাতে ইতিমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত এবং কর্মসূচী নেয়া হিয়েছিল:

১। ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গা এবং তার অধীনস্ত সমস্ত বিওপিতে অবাঙালি ইপিআরকে নিরস্ত্র করা,

২। কুষ্টিয়া জেলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোতায়েন সম্বন্ধে বিশদ খবরাখবর সংগ্রহ করা,

৩। কুষ্টিয়ার উপর একটা আক্রমণ পরিকল্পনা প্রনয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা। এই মিশনে এর জনশক্তি যোগাবে একদিকে ইপিআর, অন্যদিকে আনসার মুজাহিদ এবং সাধারণ ছাত্রজনতা। আক্রমণ এবং অবরোধ মোটামুটি ত্রিমুখী হবে। একদিকে জনাব মাহবুবউদ্দিন আহম্মদ ঝিনাইদহ কুষ্টিয়া রাস্তা অবরোধ করবেন এবং ইপিআর আনসার মুজাহিদদের একটি দল অভিমুখে যাবে। অপরদিকে প্রাগপুর-ভেরামারা-কুষ্টিয়া থেকে ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া অভিমুখে অগ্রসর হবে। এই সম্মিলিত বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী।

প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে এই আক্রমণ ২৯শে মার্চ ভোর পাঁচটার সময় শুরু করা হবে। পরে এই সিদ্ধান্ত ২৪ ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অনধিক দুই কোম্পানী সৈন্য কুষ্টিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো পাহারা দিচ্ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেকি এবং সাপোর্ট ব্যাটালিয়ানের একটা অংশ ছিল। এদের ফায়ার, পাওয়ার, মোবিলিটি এবং কমিউনিকেশন পাকিস্তানের অন্যান্য সাধারণ পদাতিক ব্যাটালিনের চেয়ে অনেক বেশী। শহরের উপকন্ঠে, অনেকটা অপরাধের মত, প্রথমে মুক্তি বাহিনীকে যার মধ্যে ইপিআররা ছিলেন মুলশক্তি, মোতায়েন করা হয়। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল পুরানো ৩০৩ রাইফেল এবং কিছু পুরোনো এসএমজি। ইপিআর ছাড়া আনসার এবং মুজাহিদদের কাছে ১০ রাউণ্ড বা অনুর্ধ্ব ২০ রাউন্ডের মত গুলি ছিল।

৩০শে মার্চ সকালে অবরোধের স্থানগুলো থেকে যুগপৎভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানের উপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করা হয় এবং সাথে সাথে আমাদের প্রত্যেকটির অবস্থানের পিছনে সমবেত হাজার হাজার লোক গগনবিদারী আওয়াজে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি তোলে এবং শ্লোগান দিতে দিতে মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অতর্কিত আক্রমণে, জনতার এই আকাশফাটা চিৎকারে এবং রাইলে ছাড়াও কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আওয়াজে দিশেহারা এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়্ এটা তাদের কল্পনাতীত ছিল যে, বাঙালি ইপিআর-এর জোয়ানরা ঐ অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নিজেদেরকে সংগঠিত করে সুসজ্জিত বিক্ষিপ্ত দলগুলো এই আক্রমণের মুখে তাদের কুষ্টিয়া সেনাবাহিনী সদর দফতরের দিকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। তাদের এই পশ্চাদপরণে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এই আক্রমণ ছিল সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিজনক। কারণ, তারা বুঝতে পারেনি কারা কোথা থেকে তাদের উপর এই আক্রমণ চালাচ্ছে এবং কেন? এই পশ্চাদপরণই তাদের জন্য কাল হল। কারণ প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে সাথে তাদের মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং আমদের মনোবল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এভাবে যুদ্ধ সারাদিন চলতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তারা তাদের অবস্থান থেকে পুল আউট করে কুষ্টিয়া জেলা স্কুল এবং সার্কিট হাউসে একত্রিত হতে থাকে এবং এটাই তাদের জন্য কাল হয়। আমরাও তাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। আমাদের অবরোধের তিন দিক থেকে জেলা স্কুল এবং সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলে, যদিও তখন পর্যন্ত কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ রাস্তার কয়েক মাইল জনশক্তির অভাবে আমাদের আয়ত্তাধীন ছিল না। পরে অবশ্য আমরা এই দল থেকে বন্দী লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহর কাছে থেকে জানতে পারি যে, মেজর শোয়েব এবং অন্যান্য অফিসাররা রি-ইনফোর্সমেন্ট-এর জন্য বারবার অনুরোধ জানাচ্ছিলেন যশোহর সদর দফতরকে। কিন্তু যশোহর সদর দফতর তাদেরকে কোন সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছিল না্ এতে তথাকথিত দুর্ধর্ষ ২২ এফএফ একেবারে ইঁদুরের মত হয়ে যায়। তারা পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে। ৩১শে মার্চ থেকে তারা পলায়ন করতে শুরু করে।

মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আনুমানিক ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছিল। বাকী দুই কোম্পানির অনধিক সৈন্য সবাই জনতার সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়্ এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কুষ্টিয়া হতে ঝিনাইদহের পথে একটা পুলের উপর মুক্তিবাহিনী একটা বিরাট খাদ খনন করে ক্যামোফ্লেজ করে রেখেছিল। মেজর শোয়েব এবং ২২ এফএফ-এর কিছু অফিসার এবং সৈনিক গাড়ীতে করে যশোহরের দিকে পশ্চাদপরণ করার সময় এই খাদে পড়ে যায় এবং তারপর যারা বাঁচতে পেরেছিল তারা পাশ্ববর্তী গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার সাধারণ মানুষের এই সময়কার সাহসিকতা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। তাদের স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলার গ্রামের আবাল-বৃদ্ধবণিতা সমষ্টিগতভাবে রুখে দাঁড়ায়। এই সংঘর্ষে যদিও অনেক সাধারণ বাঙালি নিহত হয় তবুও ২২ এফএফ কেউ যশোহর ফিরে যেতে পারেনি। কুড়াল, কাস্তে বা কোন সময় একেবারে খালি হাতে কোন সময় গাছ থেকে অতর্কিতে সাধারণ জনগণ এদের মোকাবেলা করে। আমরা ১লা এপ্রিল থেকে অনবরত এই গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেতে থাকি যা তারা পাক সেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল।

আজো একটি কিশোরের কথা মনে পড়ে, যে একটা শর্টগান দিয়ে তিনজন পাকসেনাকে অনুসরণ করে, যাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল। সে নিজের বুদ্ধিবলে শর্টগান দিয়ে তিনজন পাকসেনাকে খতম করে এবং ওদের অস্ত্রশস্ত্র আমাদের কাছে জমা দেয়। পরে কুষ্টিয়া মুক্তিবাহিনীর দখলে আসার পর আমাদের দখলীকৃত অস্ত্রসম্ভারের হিসাব নিতে গিয়ে আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই। যে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ২২ এফএফ পশ্চাদপরণ করে মনোবল থাকলে ঐ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তারা এক পক্ষকাল যুদ্ধ করতে পারত। হয়ত আমাদেরকে পরাজিত করতে পারত। ২২ এফএফ-এর এই পরায়জয় এবং মুক্তিবাহিনীর জয়ে আমাদের মনোবল দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমরা বিশ্বাস করতে থাকি আমাদের বিজয়ের গতি অপ্রতিহত থাকবে এবং অচিরেই পদ্মার পশ্চিমাঞ্চলকে আমরা পুরোপুরি মুক্ত করতে পারব। কিন্তু সামরিক জ্ঞানের অভাবে আমরা বুঝতেই পারিনি যে এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী কিভাবে আবার মরণ কামড় হানতে পারে।

আমার যতদুর মনে পড়ে কুষ্টিয়াতে আমরা ৩৫টি গাড়ী, ৬টি আর-আর গানসহ শতাধিক রাইফেল, এলএমজি এবং ভারী মেশিনগান এবং গোলাবারুদ দখল করি, যা দিয়ে আমরা মুক্তিবাহিনীকে সুসজ্জিত করতে থাকি। এই দখলকৃত অস্ত্রসম্ভার এবং গাড়ী আমরা চুয়াডাঙ্গায় এনে জনগণকে প্রদর্শন করি, যা অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন সংস্থা পর্যবেক্ষণ করে।

এই সময় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কোন একদিন একটি ফরাসী-স্পেনিশ টেলিভিশন সংস্থার প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় ৩টি পাকিস্তানী স্যাবর জেট চুয়াডাঙ্গা আক্রমণ করে এবং আধঘন্টা পর্যন্ত বোমা বর্ষণ করে। এই টেলিভিশন সংস্থা অন্তত্য সাহসিকতার সাথে এই ঘটনার পুরোপুরি আলোকচিত্র গ্রহণ করে যা সারা বিশ্বে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এই ছবিগুলো নিশ্চই বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

এই সময় মুক্তিবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দলকে কুষ্টিয়ায় রেখে আমরা নতুন সমর পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমরা যশোহর থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তরে বিশাখালীতে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলি। মাহবুব এই এলাকার সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বিশাখালীতে আমাদের দুই কোম্পানিরও কম সৈন্য ছিল। উত্তর-পূর্বে আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উভয় পার্শ্বে ঢাকা হতে আক্রমণা প্রতিহত করার প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরী করি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজে আমাদের দুই প্লাটুনেরও কম ইপিআর জোয়ান ছিল। এই সময়কার টেলিফোন কর্মচারীদের সহায়তা এবং তাদের দেশপ্রেম আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

উপরোল্লিখিত কয়েকটি জায়গার সাথে আমরা সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করেছিলাম। রাজশাহী এবং পাবনায় পাক সেনাদের তৎপরতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম। গোয়ালন্দ মহকুমার প্রশাসক শাহ মোহাম্মদ ফরিদের অনুরোধে আমরা একটি ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীকে গোয়ালন্দে শত্রকে মোকাবেলা করার জন্য প্রেরণ করি। এমনকি আমরা পাবনা দখলের পর নগরবাড়ি ঘাটে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ক্ষুদ্র একটি বাহিনী প্রেরণের প্রস্তুতি নিই। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যশোহরে পাকসেনাকে কোণঠাসা করা এবং ঢাকা হতে কোনরকম রিইনফোর্সমেন্ট বা আক্রমণকে প্রতিরোধ করা।

সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে কোন ব্যক্তির কাছে এটা প্রতীয়মান যে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীর পক্ষে এই সামরিক ভূমিকা পালন করা অসম্ভব ছিল এবং কোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী এই প্রস্তুতি নিতে কোন দিনই সাহস পেতোনা তবুও দেশপ্রেমের উন্মাদনা আমাদেরকে পেয়েছিল, তাই যা করা সম্ভব নয় তা করার সাহস এবং প্রস্তুতি আমরা নিয়েছিলাম।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা কুষ্টিয়া, যশোর (শুধু সেনানিবাসকে বাদ দিয়ে), ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহীকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করি এবং আমাদের নিজস্ব সীলমোহরও বানাই। শুধু তাই নয়, গোয়ালন্দ থেকে কুষ্টিয়া এবং কুষ্টিয়া থেকে দর্শনা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু করতে শুরু করি। আমরা এই সময় ব্যাংকেও নির্দেশ দিই ৫০০ টাকার উপরে কাউকে কোন পেমেন্ট না করতে। এমনকি ভারতে সাথে আমাদের এই বোঝাপড়া হয় যে আমার সরকারী সীলমোহর এবং দস্তখত করা সার্টিফিকেট মোটামুটি পাসপোর্টের মর্যাদা পাবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটা বলবৎ ছিল- অর্থাৎ আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা চালাচ্ছিলাম। আমি এই সময় মেহেরপুরের প্রশাসনভার মেহেরপুরের সেকেণ্ড অফিসারকে দিই এবং নিজে সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সামরিক অফিসারের ভূমিকা পালন করি।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই সময় শত শত ভারতীয় এবং বিদেশী সাংবাদিক, টেলিভিশন সংস্থা আমাদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং এই মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করে। তাদের সবারই একই প্রশ্ন ছিল যে, তোমাদের সরকার কোথায়?

আমরা উত্তরে জানাই যে, অতি শীঘ্রই আমাদের বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হবে। এই সময় আমরা ভারতে টুংগী বিওপি’তে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎও করি এবং সমগ্র পরিস্থিতির পর্যালোচনা করি। তাঁরা আশ্বাস দেন যে অতি শীঘ্রই সরকার ঘোষণা করা হবে।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ও শেষদিক থেকে যুদ্ধ একটি নতুন মোড় নেয়। এই সময় শত্রুসৈন্য যশোর সেনানিবাসে নতুনভাবে সমর প্রস্তুতি নিতে শুরু কর্ আমার অভিমত যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি যে, বাঙালিরা তাদের সুশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিতে পারে। কুষ্টিয়ার গ্লানি নিশ্চয়ই তাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল। তাই প্রচুর রিইনফোর্সমেন্ট ঢাকা থেকে যশোহর আনা শুরু হয়। আমরাও উর্ধ্বশ্বাসে তাদের নতুন তৎপরতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা একসময় ভাবছিলাম যে জনতার সমুদ্র নিয়ে যশোহর সেনানিবাসে ঝাঁপিয়ে পড়ব। যশোহর সেনানিবাস তখন আমাদের কাছে বাস্তিলের কারাগারের মত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটির প্রতীক মনে হচ্ছিল। কিন্তু লক্ষ লক্ষ জনতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার একটা ঝুঁকি ছিল যে হয়ত যশোহর আমরা দখল করতে পারব কিন্তু তা হবে হাজার হাজার লোকের প্রাণের বিনিময়ে। এতবড় একটা ঝুঁকি নিতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।

এই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের প্রথম সংঘর্ষ হয় বিশাখালীতে। এইখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্যের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এটা ছিল এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে। আমাদের ইপিআর বাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই আক্রমণ মোকাবিলা করে। হানাদার বাহিনীর শতাধিক সৈন্য হতাহত হয়। প্রায় ২৪ ঘন্টার এই আক্রমণ প্রতিহত করার পর আমরা বিশাখালী থেকে প্রতিরক্ষাবুহ্য পিছিয়ে আনতে বাধ্য হই। এই প্রথম ট্যাকটিক্যাল রিট্রিট আমাদের মনোবলের উপর মারাত্ম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই প্রথম আমরা উপলদ্ধি করি যে শত্রুর দুরপাল্লার ভারী কামানের জবাব দেবার মত অস্ত্র আমাদের ছিলনা। অন্যদিকে শত্রু এই কামানের আক্রমণ দ্বারা আমাদেরকে পিনডাউন করে রেখে সেই আর্টিলারী কভারের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর তাদের সুবিধা অনুযায়ী আক্রমণ চালাতে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক আক্রমণে তারা প্রচুর সৈন্য ব্যবহার করছিল। প্রত্যেক আক্রমণের সাথে আমাদের মনোবলও ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং আমরা ভবিষ্যত বিজয়ের কোন সামরিক সমাধান খোঁজে পাচ্ছিলাম না। তদুপরি আমদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাও সম্ভব হচ্ছিল না এবং কোন রণাঙ্গণে অগ্রবর্তী অথবা পশ্চাদবর্তী অবস্থানগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে তাতে যুদ্ধ দক্ষতা এবং মনোবলের উপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তা যারা যুদ্ধে অভিজ্ঞ তারাই বলতে পারবে। এই রকম একটি অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে আমি নিজেও অসহায় অবস্থায় পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হই। তদুপরি এই সময় বর্ষার অশুভ আগমন শুরু হয়। আমাদের অবস্থানগুলোতে খাদ্যদ্রব্য এবং গোলাবারুদের অভাব দেখা দেয়। বিচ্ছিন্ন অবস্থানগুলোতে এই বিরূপ পরিস্থিতিতে সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যেতে শুরু করে। আমাদের পশ্চাদপসরণ অব্যহত থাকে। এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসারও কোন সুব্যবস্থা ছিলনা। ঔষধের অভাবে অনেকেই মারা যায়। এটা সহজেই অনুধাবনযোগ্য যে গোয়ালন্দের মত জায়গায় ক্ষুদ্র একটি প্রতিরক্ষাবুহ্য কি রকম আত্মঘাতী ছিল। এদের পেছনে পাক ছত্রীসৈন্য অবতরণ করে অনায়াসে ঐ ঘাঁটিকে উড়িয়ে দেয়। একইভাবে নগরবাড়ি ঘাট এবং অবশেষে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ শত্রুর আয়ত্তে চলে যায়। আমাদের খবর অনুযায়ী জেনারেল মিঠা খান পাবনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এ্যাসিক্স-এর অপারেশন চালান।

চতুর্দিকে শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমাদের সংঘটনও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। প্রত্যেকটি ঘাঁটি থেকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়ে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। আস্তে আস্তে ঝিনাইদহ আমাদের আয়েত্তর বাইরে চলে যায়। শত্রুসৈন্য কুষ্টিয়াও দখল করে ফেলে এবং চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। আমরা এই শত্রুর আক্রমণের মুখে পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাসের সময় এবং সুযোগ পাচ্ছিলাম না। চতুর্দিকে প্রচুর বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সাধারণ জনগণের মনোবলও ভেঙ্গে পড়তে থাকে। চুয়াডাঙ্গা যখন শত্রুর আক্রমণের আওতায় চলে আসে তখন আমরা সদর দফতর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে পেছনে মেহেরপুরে নিই।

প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট: প্রথম বেঙ্গল রিজেমেন্ট যশোর সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জলিল প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ২৫শে মার্চের আগেই প্রথম বেঙ্গলকে এক্সারসাইজের জন্য ঝিকরগাছার দিকে পাঠানো হয়। আমরা প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। আমি, মাহাবুব এবং মেজর ওসমান চিঠির মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যত কর্মসূচী সম্বন্ধে তাকে অবহিত করি স্বতন্ত্রভাবে চিঠির মাধ্যমে। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার আহ্বান জানাই। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কোন চিঠিরই জবাব পাইনি। এর পরপরই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশোর সেনানিবাসে ফিরে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে একজন তরুণ বাঙালি লেফটেন্যান্ট আনোয়ার শাহাদাত বরণ করেন। প্রচুর বাঙালি সৈন্য হতাহত হয়। এই সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ প্রায় ৩০০ বাঙালি সৈন্যকে নিয়ে চৌগাছার দিকে অগ্রসর হয়। প্রত্যেক অস্ত্র হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় চুয়াডাঙ্গায়। সে তখন প্রথম বেঙ্গলের বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন লোকদের নিয়ে চৌগাছায় একত্রিত করছিল। আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধের কিছু খবর পেয়ে সে আমাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চুয়াডাঙ্গায় আসে। তার কাছে আমি জানতে পারি যে তারা তখন ভারত সরকারের কাছে অস্ত্রশস্ত্রের জন্য চেষ্টা করছিল। আমরা তখন যৌথভাবে সামরিক পরিকল্পনার প্রস্তুতি নিতে থাকি।

প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন: এই সময় আমরা জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখি। আমরা আশা করছিলাম যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং ঘোষণা করা হবে। এই সময় আমাদের মুক্তাঞ্চলে প্রতিদিন অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন দল আমদের মুক্তাঞ্চল ঘুরেফিরে দেখছিলেন এবং এত প্রতিকুল অবস্থার ভেতরেও আমরা যে শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে প্রতিরক্ষা করছিলাম তা নয়, আমরা এরকম একটা সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান চালিয়ে জয়ী হয়েছিলাম। এই সামরিক বিজয় জনগণের উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা ও দৃঢ় সংকল্প তাদের সবাইকে বিমোহিত করেছিল।

মেহেরপুরের কোন এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের প্রস্তাবের কথা আমরা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে জানতে পারি। আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য গভীর আগ্রহে প্রতিক্ষা করতে লাগলাম। এই সময় যশোরের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্য ভেদ করে এগিয়ে আসছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে আমরা পশ্চাদপসরণ শুরু করি। ওদের সৈন্যসংখ্যা আমাদের তুলনায় বেশী। আমাদের রণকৌশলগত পশ্চাদপসরণ ছিল প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধে অনিবার্য পরাজয়ের সূচনা মাত্র।

১২ই এপ্রিল- দিনের পর দিন মরণপণ যুদ্ধের পরও আমরা যখন কোন স্বীকৃতি পাচ্ছিনা তখন আমাদের মনোবল ভাঙ্গতে শুরু করে। একটা পর্যায় পর্যন্ত মানুষের মনোবল অক্ষুণ্ণ থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকগুলি ব্যর্থতা আমাদের যোদ্ধাদের মনেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিল। এমন এক সংকটজনক দিনে আমরা খবর পেলাম, বাংলাদেশ সরকার ১৬ই কিংবা ১৭ই এপ্রিল শপথ গ্রহণ করবেন। তার আগেই আমি প্রাথমিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম। তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে আমাদের স্থান নির্ধারণের কাজ শুরু হয়েছে- শহর থেকে দুরত্ব বজায় রাখা এবং ভারতীয় এলাকা থেকে বিদেশী সাংবাদিকরা যাতে সহজে আসতে পারেন এবং শত্রুর সম্ভাব্য বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ছদ্মাবরণের ব্যবস্থা করা।

১৬ই এপ্রিল মাহাবুব (ঝিনাইদহ মহকুমা পুলিশ অফিসার ছিলেন, পরে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একজন অফিসার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন) ও আমি চুড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানের দিকে যাত্রা করি। তখন ছিল অত্যন্ত সংকটময় সময়। তখন আমরা আমাদের বাহিনীর পশ্চাদপসরণের খবর পাচ্ছি। অগ্রবর্তী এলাকার সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আমাদের সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর ওসমান তখন আমাদের বাহিনীর প্রধান। তিনি তাঁর সদর ঘাঁটি মেহেরপুরে সরিয়ে এনেছেন। মেজর ওসমান ভীষণ ব্যস্ত এবং চিন্তান্বিত। পাকিস্তান বাহিনী একের পর এক আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করে এগিয়ে আসছে। আমরা তখনো জানতামনা আর কতদিন মাতৃভূমির বুকে আমাদের শেষ ঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে পারবো। আমরা দুপুর নাগাদ আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম। একটা সাধারণ মঞ্চ তৈরী হচ্ছে, বাঁশ দিয়ে ঘেরা। এলাকাটি সীমান্ত ঘেঁষা বলে আমরা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ৭৬তম ব্যাটালিয়নের লে: কর্ণেল চক্রবর্তীর সাথে এই উপলক্ষ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করছিলাম।

১৭ই এপ্রিল আমি আর মাহবুব সেই ঐতিহাসিক স্থানে ছুটলাম। অনাড়ম্বর আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যদের সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। আমি তাঁদের নিয়ে এলাম বদ্যনাথতলার মণ্ডপে। ওখানে আশেপাশের গ্রাম থেকে কিছু চেয়ার সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারের মধ্যে সবগুলো পূর্ণাঙ্গ নয়। কোনটার একটা হাতল নেই, কোনটার একটা পায়া খোয়া গিয়েছে। মণ্ডপ পাহাড়া দেবার জন্য নিয়োজিত আনসারদের জন্য কিছু রান্না হয়েছিল। মাহাবুব আর আমি দ্রুত একটা অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়ন করে ফেললাম। অন্যদেরও তা দেখালাম। আমরা নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার দেবার মত কয়েক প্লাটুন ইপিআর ও মুজাহিদ মোতায়েন করি। মাহাবুব তাদের নিয়ে গার্ড অব অনার দেবার মহড়া শুরু করলো্ আমি তখন কর্ণেল ওসমানী ও অন্যদের সাথে ককেটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। হাজার দুয়েক লোক জমায়েত হয়েছে অনুষ্ঠানে। তাদের মধ্যে অন্তত: শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান।

নীরব আম্রকুঞ্জ। সমবেত গ্রামের মানুষের নিকট অতীতেও এমন কোন অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়নি। আমরাও অনুষ্ঠানের কথা গোপন করে রেখেছিলাম। গ্রামের মানুষের শূন্যদৃষ্টির ভাষা আমরা বুঝতে পেরেছি। তারা যেন এক অঘটন ঘটতে দেখেছে- বিস্ময়াবিষ্ট, নিষ্পলক।

বেলা ১১ টা নাগাদ বহুপ্রতীক্ষিত অনুষ্ঠানের সূচনা হল। আমি জীপে করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এমএজি ওসমানী ও অন্যান্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তোরণের কাছে নিয়ে এলাম। মাহাবুব গার্ড অব অনারের নেতৃত্ব দিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করলেন। পিছনে দাঁড়িয়ে জেনারেল ওসমানী। সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন পতাকা উত্তোলন করছিলেন তখন সাংবাদিকরা তাদের চতুর্দিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। একটা ছোট দল জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইলো। একটা জাতির জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করলাম। এমন জন্মের কাহিনী ইতিহাসে বহুবার পড়েছি। কিন্তু বিশ্বাস হয়না চোখের সম্মুখে একটি জাতি জীবনের স্পন্দনে স্পন্দিত হচ্ছে। গার্ড অব অনারের পর ভাবী মন্ত্রিসভার সদস্যরা মঞ্চে উপবেশন করলেন। সৈয়দ নজরুল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলেন। তারপর এক এক করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণ দান করলেন। রাষ্ট্রপতির পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। ঘোষণা করা হলো, লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের নীচে পাকিস্তান সমাধিস্থ হয়েছে। আর এই সমাধির উপরে একটি জাতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেই জাতি হলো বাংলাদেশ। মানুষ এই ঘোষণাকে অভিনন্দিত করলো।

আমাদের মধ্যে কয়েকজন সম্মেলন কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ তার সহযোদ্ধারা প্রতিরক্ষাবুহ্য রচনা করে বসে রয়েছেন। মাহাবুব আর আমি চললাম আমাদের কর্মক্ষেত্রে। পথে আমরা উপলদ্ধি করলাম, একটি জাতি আজ জন্ম নিল বটে কিন্তু আজ যে শিশু জন্ম নিল সেই শিশুকে বিশ্বসভায় আসন গ্রহণের জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমরা জানি এই পথ পাড়ি দেবার জন্য আরও রক্তমূল্য দিতে হবে। আমাদের কাহিনী রক্তাক্ষরে লিখতে হবে। এই মুহুর্তে আমাদের চিন্তা হলো, সদ্যজাত জাতি বড় হবে যেদিন, যেদিন বিশ্বসভায় মর্যাদার আসন পাবে, সেদিন কি আমরা তা আজকের মত দেখার জন্য বেঁচে থাকবো?

সরকার গঠনের পর আমাদের সাথে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একত্রীকরণ হয়। মেজর ওসমানের নেতৃত্বাধীনে আমাদের সৈন্য শার্শা-নাবারণ এলাকায় মোতায়েন করা হয়। এই সময় উল্লেখযোগ্য যে, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন এবং ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজ ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে মেহেরপুরে এসেছিলেন তারাও এপ্রিলের আনুমানিক দশ তারিখে চুয়াডাঙ্গায় আমাদের সাথে যুদ্ধে যোগ দেন। এই সময় আরো দুজন সামরিক অফিসার আমাদের সাথে যোগ দেন। তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন হুদা, যিনি পাবনা থেকে পিছু হটে আমাদের সাথে যোগ দেন। আর অন্যজন ছিলেন ক্যাপ্টেন ওহাব। যিনি যশোহর সেনানিবাস থেকে পালিয়ে আসেন। শার্শা নাভারনের নতুন প্রতিরক্ষাবুহ্যকে আমরা শক্তিশালী করতে থাকি। এই সময় আমরা আর একজন নতুন মুক্তিযোদ্ধাকে পাই, যাকে পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনীতে নেয়া হয়। তার সাথে পরিচয় হয়। তিনি সরাসরিভাবে প্রতিরক্ষাবুহ্যতে মোতায়েন ছিলেন। তিনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ। তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ছিলেন।

এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে এই সময়েই ক্যাপ্টেন হাফিজ নাভারনে শত্রুবাহিনীর ঘাঁটির উপর একটা সাফল্যজনক দু:সাহসিক রেইড চালান। এই রেইডে প্রথম বেঙ্গলের লোকজন ছিল। এতে করে যদিও শত্রুর কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয় তবুও তারা আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে এবং তারপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরাট আকারে আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে শত্রুবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিয়েছিল, যার প্রত্যুত্তরে আমাদের কিছুই ছিলনা। তাই আক্রমণকারী বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করে আমরা পিছু হটতে থাকি। এই সময় হাবিলদার মেজর মুজিবুর রহমান সহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে শহীদ হন। অনেকেই হতাহত হন। আমরা পরে জেনেছিলাম শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি হতাহত মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক ছিল। সেই এলাকায় এক মৃত মেজরের নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক ছোট মেমোরিয়াল তৈরী করেছিল।

আমাদের পশ্চাদপসরণ বিশৃঙ্খলভাবে হয়েছিল। পশ্চাদপসরণের সময় কিছু মূল্যবান হাতিয়ার খোয়া যায়। বেনাপোল চেকপোষ্টে আমাদের দফতর স্থানান্তরিত করা হয়। ঐদিন জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বৃটিশ এমপি টমাসম্যানসহ চেকপোষ্টে আসেন এবং ঐখানে তার বিবৃতি দনে। ঐদিন পরে শত্রুবাহিনী আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপর গুলিবর্ষণ করে। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য আমরা মোটেও তৈরী ছিলাম না। শত্রুর আক্রমণে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং বাংলাদেশের মাটিতে শেষ ঘাঁটিটুকু ছেড়ে দিয়ে ভারতে পশ্চাদপসরণ করি।

Scroll to Top