স্বাধীনতার আহ্বান সম্বলিত শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস

<2.70.382-384>

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
স্বাধীনতার আহ্বান সম্বলিত শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক আন্দোলনের পুস্তিকা ১০ ডিসেম্বর, ১৯৬৮

 

পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস

[পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী পরিষদ কর্তৃক ১৯৬৮ সালের ৮ই জানুয়ারীতে গৃহীত এবং ১৯৬৮ সালের ১লা ডিসেম্বরে পরিবর্ধিত ও পুনঃলিখিত এ দলিলটি সভাপতি সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও পরবর্তীতে পুর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি গড়ে ওঠার তাত্ত্বিক ভিত্তিপ্রস্তর। এ ঐতিহাসিক প্রতিভাদীপ্ত দলিল এমন এক সময় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলো যখন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন সংশোধনবাদ বা নয়া সংশোধনবাদের কানা গলিপথে পথ হাতড়াচ্ছে, আন্তরিকভাবে সর্বহারা বিপ্লবীরা প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। এ সময় আন্তরিক সর্বহারা বিপ্লবীদের জন্য অত্যন্ত জরুরী কর্তব্য হয়ে পড়েছিলো পূর্ব বাংলার সমাজ ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতার একটি ঐতিহাসিকভাবে আনা সঠিক বিশ্লেষণ ও সারসংকলন, একটি সঠিক কর্মনীতি এবং এগুলোর ভিত্তিতে একটি সঠিক পার্টি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করা। এ ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পাদনে তাত্ত্বিক প্রয়োজন মেটায় ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস’ যা পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির প্রতিটি সচেতন কর্মী, সহানুভুতিশিল ও সমর্থকের অবশ্য পাঠ্য। স. বি. প]

ভূমিকা

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা আমরা কিভাবে প্রয়োগ করবো, আমাদের দেশের বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা হবে ‘তীর’ যা আমাদের নিক্ষেপ করতে হবে পূর্ব বাংলার বিপ্লবকে লক্ষ্য করে। যারা আজ লক্ষ্যহীনভাবে তীর ছোঁড়েন, এলোপাথাড়ি তীর ছোঁড়েন, তারা সহজেই বিপ্লবের ক্ষতি করতে পারেন। মার্কসবাদী নামধারী বহু ব্যাক্তিই ‘এলোপাথারি তীর’ ছুড়ে সুবিধাবাদীরাও প্রতিবিপ্লবী ভূমিকা পালন করছেন।

সভাপতি মাওসেতুঙ বলেছেন, “অতীতের ভুলগুলো অবশ্যই প্রকাশ করে দিতে হবে। অতীতের খারাপ বস্তুকে বৈজ্ঞানিক মনোভাব দিয়ে বিশ্লেষন করা ও সমালোচনা করা প্রয়োজন যাতে ভবিষ্যতের ভবিষ্যতের কাজ আরো সতর্কভাবে সম্পন্ন করা যায়। এটাই হচ্ছে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহন করে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানোর অর্থ।”

‘পাক স্বাধীনতা’কালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কেন ব্যর্থ হলো উপনিবেশবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব গ্রহন করতে এবং ঔপনিবেশিক ও সামন্ততান্ত্রিক শোষনের অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে?

‘স্বাধীনতা’ উত্তরকালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কেন ব্যর্থ হলো উপনিবেশবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রাম পরিচালনা করে সমাজতন্ত্রের পথ তৈরী করতে? এ ব্যর্থতার কারণগুলো ক্ষমাহীনভাবে বৈজ্ঞানিকভাবে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উদঘাটন করতে হবে, যাতে একই ভুল ভবিষ্যতে না হয় এবং মার্কবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারীরা সক্ষম হন তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে!

সারা দুনিয়ার সর্বহারা – এক হও!

প্রাকস্বাধীনতাকাল

বৃটিশ শাসনকালে ভারতের সামাজিক বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত মূল দ্বন্দ্বগুলো দায়ী ছিলোঃ

১. ভারতীয় জনগনের সাথে বৃটিশ উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব।

২. ভারতের বিশাল কৃষক জনগনের সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব।

৩. ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেনীর সাথে শ্রমিক শ্রেনীর দ্বন্দ্ব।

৪. ভারতের মুসলিম বুর্জোয়া, সামন্তগোষ্ঠী ও শ্রমিক-কৃষকদের সাথে অমুসলিম বিশেষতঃ হিন্দু বুর্জোয়া, সামন্তগোষ্ঠী ও শ্রমিক-কৃষকদের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব।

ভারতের বুর্জোয়া শ্রেনী (মুসলিম ও অমুসলিম বুর্জোয়া) নিজস্ব শ্রেনীস্বার্থেই সর্বপ্রথম স্বাধীনতার দাবী করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থায় ভারতের বুর্জোয়া শ্রেনী ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম বিকশিত মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তগোষ্ঠী অখন্ড স্বাধীন ভারতে অপেক্ষাকৃত কম বিকশিত অমুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তগোষ্ঠী কর্তৃক বিলুপ্তির সম্ভাবনা দেখতে পায়। তারা নিজেদের বিকাশের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা দাবী করে। এভাবে শ্রেনীস্বার্থ তাদের আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করে তোলে। একটা পর্যায়ে এ দ্বন্দ্ব বৈরীরূপ নেয় এবং অবাধ বিকাশের জন্য পৃথক স্বাধীন ভূখন্ড পাকিস্তানের দাবী করে।

মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তগোষ্ঠী তাদের দাবীর পেছনে মুসলিম কৃষক-শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার জন্য অবৈরী সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের সুযোগ নেয় এবং তাদের মাঝে জঘন্য সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্র চালায়। অমুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তগোষ্ঠী অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার মানসে এবং ভারতের মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তগোষ্ঠীর পাকিস্তান আন্দোলন নস্যাত করার জন্য অমুসলিম শ্রমিক-কৃষকদের মাঝে জঘন্য সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্র চালায় যাতে তারা অমুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়।

বৃটিশ উপনিবেশবাদীরাও ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত করে নিজেদের শাসন ও শোষন অব্যাহত রাখার জন্য তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচারনা ও ষড়যন্ত্র চালায়।

এ সকল কারনে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয় এবং অবৈরী সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব বৈরী রুপ নেয়। শ্রমিক ও কৃষক শ্রেনী ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়। 

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বিধাবিভক্তিতে বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখার সুবিধা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রচন্ড ক্ষয়ক্ষতি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী দেশপ্রেমিকদের অংশগ্রহণ এবং শ্রমিক-কৃষকদের চেতনার বিকাশ উপনিবেশবাদীদের বাধ্য করে তাদের সমর্থক ও সহযোগী বুর্জোয়া শ্রেনীর (মুসলীম লীগ ও কংগ্রেস) নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে যাতে তারা এ নয়া শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমে এ মহাদেশকে আধা উপনিবেশ পরিণম করতে সক্ষম হয়। এভাবেই পাকিস্তান ও ভারতের সৃষ্টি।

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অবিভক্ত ভারতকে যুক্ত করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ

‘প্রাক-স্বাধীনতা’র কালে ভারতের সামাজিক অবস্থা ছিল উপনিবেশিক, সামন্তবাদী ও আধা সামন্তবাদী। উপনিবেশিক শক্তি সামন্তবাদকে জীবিত রেখে সামন্ত শ্রেনীর মাধ্যমে বিশাল কৃষক শ্রেনীকে শোষণ ও নিপীড়ন করতো। কাজেই উপনিবেশবাদী জাতীয় বিপ্লব এবং সামন্তবাদবিরোধী গনতান্ত্রিক বিপ্লব অর্থাৎ জাতীয় গনতান্ত্রিক বিপ্লব হওয়া উচিত ছিল এদেশের বিপ্লবের চরিত্র। এ জাতীয় গনতান্ত্রিক বিপ্লব বুর্জোয়া শ্রেনী সম্পন্ন করতে অক্ষম। কাজেই ঐতিহাসিকভাবে সর্বহারা শ্রেনী ও তার পার্টির দায়িত্ব এ বিপ্লব সম্পন্ন করা। কাজেই এ বিপ্লব হওয়া উচিত ছিলো জাতীয় গনতান্ত্রিক অথবা নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব যার লক্ষ্য সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম। বিশ্ব বিপ্লবের ইহা একটি অংশ।

এ নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করার জন্য সর্বহারা শ্রেনীর পার্টির নিম্নলিখিত শর্ত পালনের প্রয়োজন ছিলঃ

(ক) “সুশৃংখলিত, মার্কসবাদ লেনিনের তত্ত্বে সুসজ্জিত, আত্মসমালোচনার পদ্ধতি প্রয়োগকারী ও জনগনের সাথে সংযুক্ত এমন একটি পার্টি;

(খ) এমন একটি পার্টির নেতৃত্বাধীন একটি সৈন্যবাহিনী;

(গ) এমন একটি পার্টির নেতৃত্বে সমস্ত বিপ্লবী শ্রেনী ও বিপ্লবী দলের একটি যুক্তফ্রন্ট।’’

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি উপরোক্ত শর্ত পালনে ব্যর্থ হয়; ফলে বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্ব গ্রহন করে, নিজেদের শ্রেনীস্বার্থে অবৈরী সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে শ্রমিক কৃষক শ্রেনীকে নিজেদের পেছনে ঐক্যবদ্ধ করে এবং ভারতকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়!

[সভাপতি মাওসেতুঙ বলেছেন বিপ্লবী পার্টি হচ্ছে জনসাধারণের পথ প্রদর্শক; বিপ্লবী পার্টি যখন তাদেরকে ভ্রান্তপথে চালিত করে তখন কোন বিপ্লবই স্বার্থক হতে পারে না।]

স্বাধীনতাউত্তরকাল

পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত মূল দ্বন্দ্বগুলো বিদ্যমানঃ

(১) পূর্ববাংলার জনগনের সাথে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব।

(২) পূর্ববাংলার বিশাল কৃষক জনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব।

(৩) পূর্ববাংলার জনগনের সাথে –

(ক) সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের,

(খ) সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের ও

(গ) ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব।

(৪) পূর্ববাংলার বুর্জোয়া শ্রেনীর সাথে শ্রমিক শ্রেনীর দ্বন্দ্ব।

দ্বন্দ্বসমূহের বিশ্লেষণ

প্রথমঃ পূর্ব বাংলার জনগনের সাথে পাকিস্তানী ঔপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বঃ

মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তবাদের পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, দিল্লী, লক্ষ্ণৌ, বোম্বাই প্রভৃতি স্থানে বৃটিশ সমর্থক বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা বাঙালী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের (যারা খুবই অল্পসংখ্যক) চেয়ে বহুগুন বিকশিত থাকায় স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব কুক্ষিগত করা হয়।

 
<2.70.385-389>

পূর্ববাংলার হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী ও সামন্তবাদীরা মুসলিম বুর্জোয়া, কৃষক শ্রমিকের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও ধর্মীও নিপীড়ন চালাতো। বঙ্গভঙ্গ আইনের মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলা একটি আলাদা প্রদেশ হলে অর্থনৈতিক শোষণ ও ধর্মীয় নিপীড়ন এর কিছুটা লাঘব হবে জেনে বাঙালী মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা তা সমর্থন করে। কিন্তু নিজ বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হবে বলে হিন্দু বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা এ বিভাগের বিরোধীতা করে; ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। কাজেই মুসলিম বুর্জোয়া ও সামন্তশ্রেণীর বিকাশে দুটি বাধা ছিল, একটি হল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ আর একটি হিন্দু বুর্জোয়া ও সামন্তবাদিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ধর্মীয় নিপীড়ন। কাজেই স্বাধীনতা আন্দোলন কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত না হওয়ায়, পূর্ববাংলার সৃষ্টি ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজন ছিল।

পূর্ববাংলার বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা পাকিস্তানের মাধ্যমে নিজেদের শ্রেণী বিকাশ ঘটাতে সক্ষম মনে করে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করে এবং মুসলিম শ্রমিক-কৃষকদের পাকিস্তান দাবীর পিছনে ঐক্যবদ্ধ করে। তারা পাকিস্তানে যোগ দেয় এবং এভাবে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের প্রদেশে পরিণত হয়।

স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব অবাঙালী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের হাতে থাকায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের নিকট হস্তান্তর করে। কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচিতে স্থাপন, বৃটিশ উপনিবেশবাদের সামরিক আমলা দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনী গঠন এবং বেসামরিক আমলা দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য অংশ চালু করা (এই সকল সামরিক আমলাদের অধিকাংশই বৃটিশ উপনিবেশবাদের সমর্থক অবাঙালী ছিল) প্রভৃতির মাধ্যমে এই অবাঙলী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের একচ্ছত্র মালিকানা লাভ করে এবং নিজেদের শ্রেণী বিকাশের অবাধ সুযোগ পায়।

এ শাসক শ্রেণী পূর্বিবাংলার স্বতন্ত্র জাতিয় ও অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য স্বায়ত্তশাসন কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রদানের পরিবর্তে একে অবাধ শোষণের জন্য প্রথম থেকেই প্রচেষ্টা চালিতে আসে। এ শাসকশ্রেণী রাষ্টক্ষমতার মাধ্যমে পূর্ববাংলার পাট, চা, চামড়া প্রভৃতির অর্থ দ্বারা বিকাশ লাভ করে এবং এ বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে সিয়াটো, সেন্টো প্রভৃতির সামরিক চুক্তি সম্পাদন করে। এভাবে পাকিস্তান আধা-উপনিবেশে পরিণত হয়। সম্প্রতি এ শাসকশ্রেণী সংশোধনবাদ  বিশেষতঃ সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে নানা প্রকার অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করেছে।

পূর্ববাংলায় পাট, চা, চামড়া, কাগজ প্রভৃতির অর্থ দ্বারা, সস্তা শ্রমশক্তি দ্বারা, প্রায় সাতকোটি মানুষের বাজার এবং সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যে পাকিস্তানী বুর্জোয়া শ্রেণী একচেটিয়া পুজিপতিতে পরিণত হয়। তারা পূর্ববাংলাকে শাসন ও শোষণের একটি স্থায়ী ক্ষেত্রে পরিণত করে।

পূর্ববাংলাকে শাসন ও শোষণের একটি বিরাট বাধা হলো একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা এবং ভাষা ও স্বতন্ত্রের প্রধান উপাদান। জাতি হিসেবে পূর্ববাংলার স্বাতন্ত্র মুছে দেয়ার জন্য এ পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা প্রচলনের হীন প্রচেষ্টা চালায়। এ হীন প্রচেষ্টাকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নস্যাৎ করে দেয়। বর্তমানেও এ শাসক শ্রেণী বাংলাভাষা পরিবর্তনের হীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

এ পাকিস্তানী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদী শ্রেণীর বিকাশের জন্য ক্রমশ পূর্ববাংলার সম্পদ, সস্তা সংশক্তি ও প্রায় সাত কোটি মানুষের বাজার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এভাবে বৃটিশ উপনিবেশবাদের প্রত্যক্ষ উপনিবেশ থেকে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশ হিসাবে কিছু কালের জন্য আধা-উপনিবেশ পরিণত হলেও এখানে প্রথম থেকেই পাকিস্তানী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদী শাসকগোষ্ঠীর জাতীয় নিপীড়ন ও শোষণ বিদ্যমান ছিল। এ শাসকশ্রেণী নিজেদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববাংলার উপর জাতীয় নিপীড়ন বৃদ্ধি করে এবং তাদের বিকাশ একচেটিয়া রূপ
গ্রহণের পর্যায় এলে তারা শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য শাসন ব্যবস্থাকে ক্রমেই অধিক সময়বাদি করে এবং এভাবে পূরববাংলার ওপর জাতীয় নিপীড়ন উপনিবেশ শোষণের রূপ নেয় এবং পূর্ববাংলা পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর উপনিবেশে পরিণত হয়। এ উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী নিজেরাই সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তবাদেও স্বার্থ রক্ষা করেছে। এ কারণে পাকিস্তান নিজেই একটি আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী দেশ।

এই পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী পূর্ববাংলার পাকিস্তানবাদী দালাল বুর্জোয়াদের মাধ্যমে এবং গ্রামে সামন্তবাদকে জীবিত রেখে এদেশে শাসন ও শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এ উপনিবেশিই শোষণের ফলে পূর্ববাংলার মাঝারি ও ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ ব্যাহত হয়েছে এবং গ্রামে শামোণ্টোবাডী শোষণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষতঃ বর্তমানে বিদেশী ঋণ পরিশোধের জন্য, বিদেশে ঋণ হ্রাসের ফলে কলকারখানার পুঁজি সংগ্রহের জন্য গ্রাম্য শোষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। কাজেই পূর্ববাংলার শ্রমিকঃ কৃষক, ক্ষুদে বুর্জোয়া ও মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণীর এক অংশ তথা সমগ্র পূর্ববাংলার জাতি এ শোষণে শোষিত। এ উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী অখন্ড পাকিস্তান, ধর্মের ভিত্তিতে এক জাতি, তথাকথিত ইসলামী সংস্কৃতি, পূর্ববাংলা একটি প্রদেশ প্রভৃতি প্রচারের মাধ্যমে শোষণের উপনিবেশিক চরিত্র গোপন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন উপনিবেশিক চরিত্র গোপন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন উপনিবেশিক শক্তি শোষণের উপনিবেশিক চরিত্র গোপন করার জন্য এক দেশ, এক জাতি প্রভৃতি প্রচারের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ইতিহাস তার ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে। পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হতে বাধ্য।

দ্বিতীয়ঃ পূর্ববাংলার বিশাল কৃষক জনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্বঃ

গ্রামে সরকারি কর্মচারি (পুলিশ, সার্কেল অফিসার), মৌলিক গণতন্ত্রী (বি, ডি), জমিদার, ধনীচাষী, অসৎ ভদ্রলোক (টাউট) ও মাঝারি চাষীর উপরের স্তর, গ্রামের ক্ষেতমজুর, গরীব চাষী ও মাঝারি চাষির ব্যাপক অংশের ওপর সামন্তবাদী শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানী উপনিবেশিক শ্রেণী গ্রামের সামন্তবাদীদের জিইয়ে রেখেছে এবং তাদের বিকাশের সর্বময় প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ শাসক শ্রেণী তাদের বিকাশের নিমিত্ত পুঁজি ও সস্তা শ্রমশক্তি সংগ্রহের সামন্তবাদী শোষণ তীব্রতর করছে।

গ্রামে সামন্তবাদী শোষণের প্রকাশ হলো ভূমিকর ও অন্যান্য খাজনা বৃদ্ধি, গ্রামে রেশন চালু না করা, বুনিয়াদী গণতন্ত্র সৃষ্টি করা, ঋণ প্রভৃতির মাধ্যমে চাষীদের শৃংখলে আবদ্ধ করা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ না করা, সেচ প্রকল্প কার্যকরি না করা, বিভিন্ন ধরণের ইজারাদারী প্রথা, পোকা ধ্বংশের ব্যবস্থা না করা, অবৈতনিক সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু না করা, বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা না করা প্রভৃতি।

তৃতীয়ঃ (ক) পূর্ববাংলার জনগণের সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বঃ

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একদিকে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রাখছে, অন্যদিকে পূর্ববাংলার বুর্জোয়াদের এক অংশের সাথে আঁতাত রাখছে এবং তাদের মাধ্যমে পাকিস্তানী শাসকশ্রেণীর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তারা ঋণ, প্রত্যক্ষ ব্যবসায় প্রভৃতির মাধ্যমে পূর্ববাংলার জনগণকে শোষণ করছে। তারা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিয়ে চীন বিরোধী কমিউনিস্ট বিরোধী ঐক্যজোট গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীরা নিজেদের স্বার্থেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে বর্তমানে আঁতাত করতে পারছে না এবং নিজেদের শ্রেণী বিকাশের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে সমাজতান্ত্রিক দেশ বিশেষতঃ চীনের সাথে বন্ধুত্ব করতে বাধ্য হচ্ছে।

অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পূর্ববাংলার উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের সুযোগ নিয়ে তাদের সমর্থক পূর্ববাংলার বুর্জোয়াদের সাহায্য ও সমর্থন করছে। সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক এই দালাল বুর্জোয়ারা এই উপনিবেশিক শাসন বিরোধী আন্দোলন করছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এ আন্দোলনকে মূলধন ধরে দুইভাবে ব্যবহার করছে- একদিকে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে চীন বিরোধী পাক-ভারত যৌথ চুক্তি সম্পাদন করার জন্য; অন্যদিকে এই দালাল বুর্জোয়াদের দ্বারা পূর্ববাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে চীন বিরোধী পূর্ববাংলা-ভারত চুক্তি সম্পাদন ও পূর্ববাংলাকে প্রত্যক্ষ মার্কিন উপনিবেশে পরিণত করার যখন ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। বর্তমান মার্কিন সমর্থক পূর্ববাংলার দালাল বুর্জোয়ারা ছয় দফা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে করছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এদেশের সামন্তবাদীদের স্বার্থ রক্ষাকারী ধর্মীয় পার্টিগুলোকে সাহায্য ও সমর্থন করছে। এরা সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র।

(খ) পূর্ববাংলার জনগণের সাথে সংশোধনবাদ, বিশেষতঃ সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বঃ

পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের নিয়ে চীন বিরোধী,  কমিউনিস্ট বিরোধী ঐক্যজোট প্রতিষ্টার জন্য তারা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম তারা সমর্থন করে না। কারণ পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের সাথে আঁতাত রেখে পাকিস্তানসহ তার উপনিবেশকে শোষণ করাই তাদের লক্ষ্য। এই জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম নস্যাৎ করার জন্য তারা পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের সাহায্য করবে যাতে পূর্ববাংলাকে শোষণের একটা ভাগ তারা পায়।

প্রসঙ্গক্রমে বায়াফ্রা, বার্মা, ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশের কথা উল্লেখযোগ্য। বায়াফ্রার জনগণ সংগ্রাম করছে জাতীয় অত্যাচার, নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির জন্য। সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা নাইজেরীয় সামরিক সরকারকে অস্ত্র, অর্থ ও লোক সরবরাহ করে বায়াফ্রার জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যাতে তারা সমগ্র নাইজেরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ চালাতে পারে। তারা বার্মার মুক্তি সংগ্রামকে দাবিয়ে রাখার, ভিয়েতনাম মহান সংগ্রামকে মুছে দেয়ার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।

(গ) পূর্ববাংলার জনগণের সাথে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের জাতীয় দ্বন্দ্বঃ

ভারতীয় বৃহৎ পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী সরকার সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমর্থন করবে না। কারণ তার উদ্দেশ্য হলো বুর্জোয়ার নেতৃত্বে স্বাধীন পূর্ববাংলাকে শোষণ করা এবং চীনবিরোধী, কমিউনিস্ট বিরোধী একটি মিত্র পাওয়া। কিন্তু সর্বহারার নেতৃত্বে যুক্ত পূর্ববাংলা সহায়ক হবে আসাম, পশ্চিমবাংলা, বিহার, ত্রিপুরা তথা সমগ্র ভারতের শ্রমিক-কৃষকদের মুক্তির। এ কারণে ভারতের সম্প্রসারণবাদ শ্রমিক-কৃষকের পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বানচাল করার চেষ্টা করবে।

চতুর্থঃ পূর্ববাংলার বুর্জোয়াদের সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্বঃ

পূর্ববাংলার বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিকদের শোষণ করে এবং এদের মাঝে একটি অংশ পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের দালাল হয়ে পূর্ববাংলাকে শোষণ করছে। অপর অংশ সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল। একটি অংশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ উভয়েরই বিরোধী সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা, যারা সত্যিকার জাতীয় বুর্জোয়া। পূর্ববাংলার বুর্জোয়াদের প্রথম অংশ দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক। দ্বিতীয় অংশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল যারা ভারতের সাথে আঁতাত রেখে নিজস্ব শ্রেণী বিকাশের জন্য যতটুকু অধিকার প্রয়োজন তার জন্য সংগ্রাম করতে ইচ্ছুক। পূর্ববাংলার বুর্জোয়াদের ব্যাপক অংশ বর্তমানে এদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ। এদের নেতৃত্বে জাতীয় সংগ্রাম কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না। এদের সাথে জনগণের শত্রুতার সম্পর্ক ছাড়াও তারা যতক্ষণ পাকিস্তানী

উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করে ততক্ষণ জনগণের সাথে একটা মিত্রতা সম্পর্কও রয়েছে। বুর্জোয়া শ্রেণীর তৃতীয় অংশ জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে জনগণের শত্রুতার সম্পর্ক ছাড়াও তারা যতক্ষণ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম করে ততক্ষণ একটা মিত্রতার সম্পর্কও রয়েছে।

বর্তমানে জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমর্থক দালাল বুর্জোয়াদের হাতে। এ নেতৃত্বেও অবসান তিন প্রকার হওয়া সম্ভবঃ (ক) সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি দৃঢ়ভাবে জাতীয় পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে কৃষক জনতাকে উপনিবেশবাদ সামন্তবাদ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করলে; (খ) উবনিবেশিক শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নিকট আত্মসমর্পন করে চীন বিরোধী কমিউনিস্ট বিরোধী জোট কমিউনিস্ট স্থাপন করলে মার্কিম সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাহায্য ও সমর্থনে দালাল বুর্জোয়াদের জাতীয় সংগ্রাম ধ্বংস করতে সক্ষম হবে; (গ) ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের দালাল বুর্জোয়াদের সাথে আপোষে আসলে এই দালাল বুর্জোয়াদের আসল বিশ্বাসঘাতকতা ও গণবিরোধী চরিত্র প্রকাশ পাবে।

 

 

প্রধান দ্বন্দ্ব

উপরোক্ত দ্বন্দ্বগুলো ছাড়াও পূর্ববাংলার সমাজে আরো দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু এই চারটি মূল দ্বন্দ্ব। সভাপতি মাও বলেছেন, “কোনো প্রক্রিয়াতে যদি কতগুলো দ্বন্দ্ব থাকে তবে তাদের মধ্যে অবশ্যই একটি প্রধান দ্বন্দ্ব থাকবে যা নেতৃস্থানীয় ও নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। অন্যগুলো গৌণ ও অধীনস্থ স্থান নিবে। তাই দুই বা দুয়ের অধিক দ্বন্দ্ববিশিষ্ট কোন জটিল প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদের অবশ্যই তার প্রধান দ্বন্দ্বকে খুঁজে পাবার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই প্রধান দ্বন্দ্বকে আকড়ে ধরলে সমস্যাকেই সহজে মীমাংসা করা যায়।” পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ বিরোধী কৃষক-শ্রমিক, ক্ষুদে বুর্জোয়া মাঝারি বুর্জোয়ার এক অংশ এবং দেশপ্রেমিক ধনী চাষী ও জমিদারদের অর্থাৎ সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। কাজেই বর্তমান সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় পূর্ববাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদীদের জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব।

কিন্তু উপনিবেশবাদ বিরোধী জাতীয় সংগ্রাম একটা নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছালে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শ্রেণীকে রক্ষার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ একযোগে অথবা আলাদাভাবে নিজেদের সৈন্য দ্বারা পূর্ববাংলার জনগণের সংগ্রামকে নস্যাৎ করার চেষ্টা চালাবে। এ অবস্থায় পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ গণসংগ্রাম বিরোধীর প্রধান ভূমিকা থেকে গৌণ ভূমিকা গ্রহণ করবে। পক্ষান্তরে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ পূর্ববাংলার গণবিরোধী সংগ্রামের গৌণ পূর্ববাংলা বিরোধী ভূমিকা থেকে ক্রমশঃ মূখ্য ভূমিকা গ্রহণ করবে। পক্ষান্তরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত হবে। এই প্রধান দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে নতুন করে ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে সঠিক মুক্তিসংগ্রামের পথে পরচালিত করতে হবে।

পূর্ববাংলার বিপ্লব ও তার চরিত্র

পূর্ববাংলার বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা নিজেদের বিকাশের জন্য পাকিস্তানে যোগ দেয়।কিন্তু পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শ্রেণী পূর্ববাংলার বুর্জোয়া বিকাশের জন্য যে সুবিধা প্রয়োজন তা নিজেদের বিকাশে ব্যবহার করে। ফলে এদেশের বুর্জোয়া বিকাশ ব্যাহত হয়। তাই বুর্জোয়া বিকাশের প্রয়োজনীয় অবস্থার সৃষ্টি অর্থাৎ সামন্তবাদ ও উপনিবেশবাদের অবসান প্রয়োজন।

সামন্তবাদের অবসান সম্ভব গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে এবং ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান সম্ভব জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে। কাজেই, পূর্ববাংলার বিপ্লব হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব।

বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের যুগে বুর্জোয়ারা এ বিপ্লব স্মপূর্ণ করতে পারে না। নিজেরাই কিছুদিন পরে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দালাল হয়ে যায়। এ বিপ্লব সম্পূর্ণ করার মত একটি শক্তিই রয়েছে, তা সর্বহারা শ্রেণী ও তার পার্টি। সর্বহারার নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবের লক্ষ্য ধনতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্র। বিপ্লব সর্বহারার নেতৃত্বে পরিচালিত বলে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে পরিচিত হবে, যা বিশ্ববিপ্লবের একটি অংশ।

এ বিপ্লবের একটি চরিত্র হলো সশস্ত্র বিপ্লব। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল উপাদান সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও আইন এবং এদের সাহায্যে ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণী পূর্ববাংলাকে শাসন ও শোষণ করছে। এ নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হলে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণী ও স্তরকে ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষক-শ্রমিক মৈত্রির ভিত্তিতে এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণী ও স্তরের সমন্বয়ে নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। সভাপতি মাও-এর ভাষায় বন্ধুকের নলের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে হবে।

এ বিপ্লবের আর একটা চরিত্র হলো দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম। এ বিপ্লবে দ্রুত বিজয়ের সম্ভাবনা খুব কম। কারণগুলো হচ্ছে পূর্ববাংলার শ্রমিক-কৃষক জনগণের অনৈক্য অবস্থা, সঠিক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ও মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী পার্টির অভাব, সংশোধনবাদী ও নয়া সংশোধবাদী পার্টি কর্তৃক জনগণকে বিপথে পরিচালনা, জনগণের মাঝে প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শের অভাব।

পক্ষান্তরে, ঔপনিবেশিক শক্তি একত্রিত, শাসনক্ষমতা সুদৃঢ়, বিডি প্রথার মাধ্যমে গ্রাম পর্যন্ত তাদের শাসন ব্যবস্থা বিস্তৃত এবং সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং সম্প্রসারণবাদ তাদের সাহায্য করবে। তাই বর্তমানে শক্তির ভারসাম্য পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের পক্ষে। এ অবস্থা পরিবর্তন করতে সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কাজেই পূর্ববাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী দুরুহ যুদ্ধের মাধ্যমেও সম্পন্ন হবে।

এ বিপ্লবের আর একটি চরিত্র হলো গ্রাম্য এলাকা দ্বারা শহর ঘেরাও এবং পরে শহর দখল। সভাপতি মাওসেতুং বলেন, “নিয়ম অনুসারে বিপ্লব আরম্ভ হয়, গড়ে ওঠে এবং জয়ী হয় ঐ সকল স্থানে, যেখানে প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল।” কাজেই, গ্রাম্য এলাকায় গিয়ে কৃষকদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য জাগ্রত করে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে গ্রাম্য এলাকা দখল করতে এবং ঘাটি স্থাপন করতে হবে। শহরগুলো দখলকৃত গ্রাম্য এলাকা দ্বারা ঘেরাও করতে হবে এবং পরে শহর দখল করতে হবে।

এ বিপ্লবের আর একটি চরিত্র হলো ঐক্যফ্রন্ট গঠন।

জাতীয় পতাকা উর্ধ্বে তিলে ধরে, জাতীয় সংগ্রামের ভিত্তিতে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা অপরিহার্য।[১]

শ্রমিক-কৃষক মৈত্রির ভিত্তিতে, সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ বিরোধী সকল দেশপ্রেমিক শ্রেণী ও স্তরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ঐক্যফ্রন্টের মাঝে সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি অবশ্যই আদর্শগত, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক স্বাধীনতা রক্ষা করবে এবং ‘স্বাধীনতা’ ও উদ্যোগ গ্রহণের নীতিতে অটল থাকবে এবং নিজের নেতৃত্বের ভূমিকার জন্য জিদ ধরবে।

কাজেই ঐক্যফ্রন্টে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব, স্বাধীনতা ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে আর তা থাকার একটি মাত্র গ্যারান্টি হচ্ছে সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে একটি গণফৌজ। সভাপতি মাও বলেছেন, “গণফৌজ না থাকলে জনগণের কিছুই থাকবে না।” কাজেই ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে গণফৌজ।

 

 

<02.70.390-393>

 

জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাধারণ কর্মনীতি

 

          ১। সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও গেরিলা যুদ্ধের জন্য সর্বাপেক্ষা সুবিধাজনক এমন স্থানে অর্থাৎ জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্য গ্রাম্নচলে যেতে হবে [২]

          ২। গ্রাম্য মজুর, গরীব চাষী ও মাঝারি চাষীকে উজ্জীবিত করতে হবে সামন্তবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী গেরিলা যুদ্ধে।

          ৩। কৃষি বিপ্লবঃ উপনিবেশবাদ সমর্থক জমিদার, ধনী চাষীদের জমি দখল করে তা ক্ষেতমজুর ও গরীব চাষীদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। সরকারী কর্মচারী (পুলিশ্, সার্কেল অফিসার) এবং বি.ডি-দের মাঝে উপনিবেশবাদ সমর্থকদের ধ্বংস করতে হবে।

          ৪। গেরিলা বাহিনী থেকে নিয়মিত বাহিনী সৃষ্টি ও ঘাঁটি এলাকা তৈরী করতে হবে।

          ৫। ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

          ৬। গ্রাম্য এলাকা দখল করে তা দিয়ে শহর ঘেরাও করে শেষ পর্যন্ত শহর দখল করতে হবে।

          ৭। পাকিস্থানী উপনিবেশবাদ ও তার দালাল পূর্ববাংলার বুর্জোয়া, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, অন্য যে সকল বৈদেশিক শক্তি ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেনীকে সমর্থন করে (যদি তাঁদের সম্পত্তি  এ দেশে থাকে) এবং বৈদেশিক শক্তিসমূহের দালালদের (যখন তারা জাতীয় বিপ্লবের বিরোধিতা করে) সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।

          ৮। দখলকৃত এলাকায় জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে হবে। এ সরকার গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে, শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণী ও স্তরের সহযোগীতার উপর একনায়কত্ব ও জনগণের মাঝে গণতন্ত্র কায়েম করবে।

          ৯। বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিকে স্বায়ত্তশাসন ও বিভিন্ন উপজাতিকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে।

          ১০। সকল বাঙালী দেশপ্রেমিক জনগণের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিকাশের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হবে।

          ১১। জনগণের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করা হবে।

 

বিপ্লবী যুদ্ধের সাধারণ কর্মনীতি

 

          ১। নিয়মিত বাহিনী গড়ে না ওঠা পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ বিপ্লবী যুদ্ধের প্রধান রূপ;

          ২। প্রধানতঃ চাষীদের নিয়ে গঠিত লালফৌজ প্রধান সংগঠন;

          ৩। গেরিলা যুদ্ধের গতিপথে নিয়মিত বাহিনী কড়ে উঠবে;

          ৪। দীর্ঘস্থায়ী দুরুহ যুদ্ধ চলবে।

 

          প্রধান কাজঃ মার্কসবাদী লেনিনবাদী ও মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী সর্বহারা রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠা।

 

 

 

          অনুপূরক কাজঃ (১) সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামে কৃষকদের গেরিলা উজ্জীবিত করা; (২) প্রধানতঃ চাষীদের নিয়ে গেরিলা বাহিনী করে গেরিলা যুদ্ধ করা; (৩) কৃষি বিপ্লব করা; (৪) নিয়মিত বাহিনী ও ঘাঁটি এলাকা তৈরী করা।

 

আন্তর্জাতিক বক্তব্য

 

          বর্তমান বিশ্বের মূল দ্বন্দ্বগুলো নিম্নরূপঃ

          (১) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের     দ্বন্দ্ব;

          (২) একদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব, সংশোধনবাদীদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব; অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী         ও সংশোধনবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব।

          (৩) সাম্রাজ্যবাদী ও সংশোধনবাদী দেশসমূহের শাসকশ্রেণীর সাথে নিজেদের দেশের জনগণের দ্বন্দ্ব।

          (৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন           আমেরিকার নিপীড়িত জনগণের দ্বন্দ্ব।

 

দ্বন্দ্ব বিশ্লেষণ

 

          (১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশোধনবাদের সাথে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের দ্বন্দ্বঃ

 

          মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী তাঁদের শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখার পথে এবং বিশ্বকে নিজেদের শোষণের ক্ষেত্র হিসাবে পুনর্বন্টনের পথে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহকে বিশেষতঃ সমাজতান্ত্রিক চীনকে প্রধান বাঁধা বলে মনে করা হয়। কারণ, চীন সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের ভিত্তিতে সর্বদা সাম্রাজ্যবাদী ও সংশোধনবাদী শোষণের স্বরূপ তুলে ধরেছে। এ শাসন ও শোষণের হাত থেকে মুক্তির একমাত্র পথ বিপ্লবের পতাকাকে চীন উর্ধ্বে তুলে ধরছে। চীনের বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেণী বিপ্লবের দেশ ও জাতিসমূহের শাসন ও শোষণ বিরোধী সংগ্রামকে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে ও বাস্তব সাহায্য করছে। চীন বিশ্বে শাশন ও শোষণ বিরোধী সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

          কাজেই সাম্রাজ্যবাদ ও সংশোধনবাদ এ প্রতিবন্ধককে ধ্বংস করতে সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে অবস্থা বিপ্লবের পক্ষে, জনগণের পক্ষে, সমাজতন্ত্রের পক্ষে এবং সাম্রাজ্যবাদ, সংশোধনবাদ ও সকল প্রতিক্রিয়ার বিপক্ষে। বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য সমাজতন্ত্রের পক্ষে। কাজেই সাম্রাজ্যবাদীরা ও  সংশোধনবাদীরা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দ্বন্দ্বের অবসান করাতে অক্ষম। সভাপতি মাও বলেছেন, “আজকের দিনে দু’ধরনের বাতাস প্রবাহিত- পূবালী বাতাস ও পশ্চিমী বাদাস। চীনে একটি প্রবাদ আছে, ‘হয় পূবালী বাতাস পশ্চিমী বাতাসকে দাবিয়ে রাখে, না হয় পশ্চিমী বাতাস পূবালী বাতাসকে দাবিয়ে রাখে।“ আমাদের মতে বর্তমান পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পূবালী বাতাস পশ্চিমী বাতাসকে দাবিয়ে রাখছে। এর অর্থ এই যে, সমাজতান্ত্রিক শক্তি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপ অত্যধিক প্রাধান্য লাভ করছে। একারণে সাম্রাজ্যবাদীরা ও সংশোধনবাদীরা বাইরে থেকে চাপ প্রয়োগ, ব্ল্যাকমেইল এবং আভ্যন্ত্ররীণ দালাল প্রভৃতির মাধ্যমে

 

 

 

          সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রমপরিবর্তন ঘটিয়ে ধনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে এবং সে অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

          সভাপতি মাওসেতুঙ কর্তৃক সূচিত ও পরিচালিত মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদী, সংশোধনবাদী ও আভ্যন্তরীণ পুঁজিবাদী দালালদের চীনে ধনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার রঙীন স্বপ্নকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়েছে। এ সাংস্কৃতিক বিপ্লব পথ দেখিয়েছে কিভাবে বিপ্লবীরা সংশোধনবাদী দেশসমূহে পুঁজিবাদী  শাসকশ্রেণীকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে। কাজেই সমাজতন্ত্রী দেশসমূহের সাথে সাম্রাজ্যবাদী ও সংশোধনবাদী দেশসমূহের দ্বন্দ্ব বর্তমান। কিন্তু এ দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব নয়।

 

          (২) একদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব, সংশোধনবাদীদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ; অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী ও সংশোধনবাদী দেশগুলোর মাঝে দ্বন্দ্বঃ

          মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহকে কমিউনিজমের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সাম্রিক জোটে আবদ্ধ করছে এবং এভাবে তাঁদেরকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শোষণ করছে। এ কারণে মার্কিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের দ্বন্দ্ব রয়েছে। অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের শাসক শ্রেণীগুলোর মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে।

          সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ অন্যান্য সংশোধনবাদী দেশগুলোকে শাসন ও শোষণ করছে এবং যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন জোটে আবদ্দ রেখেছে যাতে তার খপ্পর থেকে কেউ বেরুতে না পারে।

          মার্কিং সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের স্বার্থে সংগ্রাম ও সহযোগীতা করে। তারা নয়া ঔপনিবেশিক ও ঔপিনিবেশিক শাসন ও শোষণের জন্য ক্রমশঃ পৃথিবীকে নিজেদের প্রভাবের এলাকা হিসেবে ভাগ করে নিচ্ছে। এ এলাকা বন্টনের বিষয় নিয়ে তাঁদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় আবার নিজেদের সাধারণ স্বার্থরক্ষার জন্য তারা সহযোগীতা করে।

কাজেই এ দ্বন্দ্ব বর্তমান। কিন্তু এটা প্রধান দ্বন্দ্ব নয়।

 

          (৩) সাম্রাজ্যবাদী ও সংশোধনবাদী দেশসমূহের শাসকশ্রেণীর সাথে নিজেদের দেশের জনগণের দ্বন্দ্বঃ

          সাম্রাজ্যবাদী সংশোধনবাদী দেশসমূহের শাসকশ্রেণী নিজেদের দেশের আপামর জনসাধারণকে শোষণ করছে। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে শাসন ও শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এবং এ কারণে তাঁদেরকে বিশাল সামরিক বাহিনী গঠন করতে হয়েছে। এ সামরিক ব্যয়ভার আসে দেশের জনগণের কাছ থেকে ফলে জনগণের ওপর শাসন ও শোষণ তীব্রতর হচ্ছে। কোন কোন সাম্রাজ্যবাদী ও সংশোধনবাদী দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু জাতির ওপর শাসন ও শোষণ অধিকভাবে চালানো হয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আফ্রো-আমেরিকানদের (নিগ্রো) ওপর জাতিগত শোষণ করছে। সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ গুটিকয় বিশ্বাসঘাতক দালালদের সহায়তায় সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে শোষণ করছে।

কাজেই এ দ্বন্দ্ব বর্তমান; কিন্তু এটা প্রধান দ্বন্দ্ব নয়।

 

          (৪) মার্কিং সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত জাতিসমূহের দ্বন্দ্বঃ

          মার্কিন সাম্রজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্র্যজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ শাসন ও শোষণ করছে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার  দেশসমূহকে ঔপনিবেশ ও আধা ঔপনিবেশ পরিণত করে। এ শোষণের ওপর নির্ভর করছে তাঁদের বিকাশ। এ কারণে আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো হচ্ছে পৃথিবীর

 

 

          গ্রামাঞ্চল। তাঁদের লুন্ঠন করে বেঁচে আছে পৃথিবীর শহরাঞ্চল ইউরোপ ও আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো। এই গ্রামাঞ্চলে যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সুদৃঢ় নয় এবং অপেক্ষাকৃত অনেক দুর্বল, সেখানেই বিপ্লবের সুচনা করতে হবে এবং কালক্রমে সমগ্র গ্রামাঞ্চল দখল করে শহর অবরোধ করা এবং শেষ শহর দখল করা মাওসেতুঙের চিন্তানুসারী নীতি।

          এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশের বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশবাদের প্রত্যক্ষ শাসন ও শোষণ থেকে নিজেদের দেশ ও জাতিগুলোকে মুক্ত করেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের এটা একতা বড় বিজয়। কিন্তু এই বুর্জোয়া শ্রেণী ও শ্রেণী বিকাশের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে সহযোগীতার সম্পর্ক স্থাপন করে নিজ দেশকে নয়া-ঔপনিবেশে পরিণত করছে। এ অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শর্ত তইরি করা সর্বহারা শ্রেণীর ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

          ভিয়েতনামের বীর জনগণের মহান মুক্তিযুদ্ধ যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সম্পূর্ণ পরাজিত করার পর্যায়ে পৌঁছেছে তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধঃপতিত দোসর সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ শান্তি আলোচনার প্রহসনের ভেতর দিয়ে এ মহান মুক্তি সংগ্রামকে মুছে দেওয়ার জঘন্য ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।

          তবু ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়, বার্মা, নক্সালবাড়ী, বিহার, কঙ্গো, মোজাম্বিক, এঙ্গোলা, আজানিয়া, প্যালেস্টাইন, বায়াফ্রা, রোডেশিয়া, নিউজিল্যান্ড, বলিভিয়া প্রভৃতি স্থানে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে।

          মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বর্তমান বিশ্বপ্রতিক্রিয়ার কেন্দ্র। ঘটনাবলী প্রমাণ করছে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়ার জনগণের প্রধান শত্রু।

          এ দ্বন্দ্ব বর্তমান এবং ইহাই প্রধান দ্বন্দ্ব।

 

আন্তর্জাতিক ও দেশী কমিউনিস্ট আন্দোলন

 

          আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রধান বিপদ হলো সংশোধনবাদ ও নয়া সংশোধনবাদ। সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের  নেতৃত্বে সংশোধনবাদ বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি দ্বারা ক্যু-দেতা ঘটিয়ে ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে কয়েকটি সমাজতন্ত্রী দেশে। যে সকল কমিউনিষ্ট পার্টি এখনো ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়নি সেগুলোর মাঝে বুর্জোয়া দালালদের সহায়তায় প্রতিবিপ্লবী কাজ পরিচালনা করছে এবং কোন কোন পার্টির ক্ষমতা এই দালালরা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে ধনতন্ত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তারা সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যে আভ্যন্তরীণ বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের দ্বারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জঘন্য চক্রান্ত করছে।

          কোন কোন পার্টি সংশোধনবাদীদের চক্রান্তের খপ্পরে পড়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে স্বাধীন পথ অনুসরণ কুরছে, ঘোষণা করে প্রকৃত পক্ষে সুবিধাবাদী পথ অনুসরণ করছে, সংশোধনবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ মার্কস-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা আর সংশোধনবাদের মাঝে কোন মাঝারি পথ নেই।

          বর্তমান দুনিয়ায় চীনা কমিনিষ্ট পার্টি ও আলবেনিয়ার শ্রমিক সঠিক মার্কশ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী হয়ে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলছে। সভাপত মাওসেতুঙ দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী লেনিনবাদী, বর্তমান দুনিয়ার সর্বহারা শ্রেণীর মহান নেতা ও পরিচালক। (৩)

          “সভাপতি মাওসেতুঙ প্রতিভার সঙ্গে সৃজনশীলভাবে ও সামগ্রিকভাবে মার্কসবাদ লেনিনবাদকে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন, রক্ষা করেছে এবং বিকাশ করেছেম, মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত

 

 

 

<02.70.394-396>

 

          করেছেন।“ মার্কস ও এঙ্গেলস মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতা। লেনিন মার্কসবাদকে সাম্রাজ্যবাদী যুগে সর্বহারা বিপ্লবে পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান করেন, সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রতিষ্ঠা করেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। স্তালিন লেনিনবাদকে রক্ষা করেন ও সর্বহারা বিপ্লবের কতগুলো গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্নের সমাধান করেন। সভাপতি মাও সেতুঙ সাম্রাজ্যবাদকে সামগ্রিক ধ্বংসের যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে বিকাশ করেছেন। তিনি সমাধান করেছেন কিভাবে সমাজতান্ত্রিক দেশে ধনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রতিরোধ করা যায় এবং যে সকল দেশে ধনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানকার সর্বহারা বিপ্লবীরা কিভাবে পুনরায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে, তিনি প্রতিভার সঙ্গে দুনিয়ার প্রথম মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা ও পরিচালনা করেন। এভাবে তিনি মার্কসবাদকে এই সম্পূর্ণ নতুন স্তরে উন্নীত করে, যে স্তর হলো মাও সেতুঙ চিন্তাধারার স্তর।

 

          ‘বিশাল সাগর পার হবার জন্য নির্ভর করি কর্ণধারের ওপর, বিপ্লব করার জন্য নির্ভর করি মাও সেতুঙ চিন্তাধারার ওপর। কাজেই বর্তমান যুগের বিপ্লবীদের চেনার উপায়- মাও সেতুঙ চিন্তাধারা অধ্যন, অনুশীলন ও তার ভাল সৈনিক হওয়ার ওপর। বর্তমান আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট আন্দোলনে এক নতুন ধরনের সংশোধনবাদ দেখা দিয়েছে। এরা মাও সেতুঙ-এর বুলি ঝাড়ে এবং কাজে তার বিরোধীতা করে; কথায় ও কাগজে মাওসেতুঙ চিন্তানুসারী ও অনুশীলনে সংশোধনবাদী পথ অনুসারী। মাও সেতুঙ চিন্তাধারার মুখোশ এঁটে জনগণকে ও বিপ্লবীদের ধোঁকা দেওয়ার বুর্জোয়া দালালদের এ এক অভিনব কারসাজি ও এটাই নয়া সংশোধনবাদ।

 

          বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের বিরাট পুনর্গঠন পুনর্বিন্যাসের সময়। বিভিন্ন দেশে যেখানে সংশোধনবাদী ও নয়া সংশোধনবাদীরা নেতৃত্ব কুক্ষিগত করছে, সেখানে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মাও সেতুঙ চিন্তানুসারীরা নতুন পার্টি সৃষ্টি করে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে জনগণকে বিপ্লবের পথে পরিচালিত করছে।

 

নয়া মার্কসবাদীলেনিনবাদীমাও সেতুঙ চিন্তানুবাদী সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি গঠনের প্রয়োজনীয়তা

 

          সভাপতি মাও বলেছেন, “যদি বিপ্লব করতে হয় তাহলে অবশ্যই একটি বিপ্লবী পার্টি থাকতে হবে। বিপ্লবী পার্টি ছাড়া, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী তত্ত্বে ও বিপ্লবী রীতিতে গড়ে ওঠা, একটি বিপ্লবী পার্টি ছাড়া শ্রমিক শ্রেণী ও ব্যাপক জনসাধারণকে সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের পরাজিত করতে নেতৃত্ব দান করা অসম্ভব।“ আমাদের দেশে গতানুগতিক যে মার্কসবাদী নামধারী পার্টি ছিল তা ‘মস্কোপন্থী’ ও ‘পিকিংপন্থী’ নামধারী দুই ইপদলে বিভক্ত হয়, তাঁদেরকে, তাদের থেকে বেরিয়ে আসা অথবা বিতাড়িত এবং অন্যান্য বিচ্ছিন্ন দল ও উপদলগুলোকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা প্রয়োজন।

 

পূর্ব পাকিস্থান কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী সংশোধনী পার্টি

 

          এই পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদের সকল মূল তত্ত্বকে সংশোধন করে প্রকৃতপক্ষে শোষকশ্রেণী অর্থাৎ উপনিবেশবাদী, সামন্তবাদী পুঁজিবাদী, স্ম্রাজ্যবাদী ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল হয়ে পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষকদের বিপথে পরিচালিত করছে। এই অধঃপতিত দলদ্রোহী গোষ্ঠী অরথনিতিবিদ বার্ণাষ্টাইনবাদের অনুসারী। শ্রমিক-কৃষক জনগণকে বিভ্রান্ত করে শোষকশ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধি এদের লক্ষ্য। এরা ‘মস্কোপন্থী’ নামে পরিচিত। এরা পূর্ববাংলার শ্রমিক-কৃষক জনগণের জাতীয় শত্রু।

 

পূর্ব পাকিস্থান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) নামধারী নয়া সংশোধনবাদী পার্টি

 

          এরা কথা ও কাগজে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাও সেতুঙ চিন্তানুসারী ও অনুশীলনে সংশোধনবাদী। অর্থাৎ এরা লাল পতাকা ওড়ায় লাল পতাকার বিরোধিতা করার জন্য। এরা পূর্ববাংলার ওপর পাকিস্থানী ঔপনিবেশিক শোষণ স্বীকার করে না এবং জাতীয় সংগ্রাম না করায় এরা পূর্ববাংলার জনগণের নিকট ঔপনিবেশিক সরকারের দালাল হিসেবে পরিচিত। জাতী গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি না নিয়ে তারা একটি ঔপনিবেশিক

 

শাসকশ্রেণীর হাত শক্ত করছে এবং অন্যদিকে ব্যাপক জনগণকে ঔপনিবেশিক শোষণ বিরোধী সংগ্রামে লিপ্ত মার্কিনের দালাল বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে ঠেলে দিচ্ছি। ‘পিকিংপন্থী’ নাম ধরে তারা বিপ্লবের কেন্দ্রকে অবমাননা করছে। এরা নয়া সংশোধনবাদী।

 

নতুন দল, উপদল ও বিচ্ছিন্ন বিপ্লবী

 

          পূর্ববাংলার বিপ্লবের ফুটন্ত অবস্থা হওয়ায় বর্তমানে দেশীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। মার্কসবাদী নামধারী পূর্ব পাকিস্থান কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লবী চরিত্র, দালালী ক্রমশঃ পার্টি কর্মী ও বিপ্লবীদের সামনে প্রকাশ হোয়ায় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাও সেতুঙ চিন্তানুসারীরা দৃঢ়ভাবে বিদ্রোহ করছে। এ অবস্থায় কিছু সুযোগ সন্ধানী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ঘোলা পানিতে মাছ ধরে নেমেছে।

 

          মোটামুটি অনুসন্ধানের ফলে তাদের নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়ঃ

 

          নয়া সংশোধনবাদী পার্টির আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে বিতাড়িত একটি চক্র নিজেদেরকে সঠিক মার্ক্সবাদী, নকশালবাদী অনুসারী বলে জাহির করে। তবে এ গ্রুপটি সকল কর্মী ও জনসাধারনের নিকট ঔপনিবেশিক শক্তির দালাল বলে প্রকাশ্যভাবে পরিচিত।

 

          অপর একটি দল বর্তমানে নয়া সংশোধনবাদীদের সাথে আতাঁত করছে। অধঃপতিত ভাগ্যন্বেষী বুর্জোয়া গোষ্ঠীর একটি ভগ্নাংশ। সচেতন কর্মীদের দলটি একট জোট বা সুবিধাবাদী, নেতৃত্বলোভী ও হীনমনা দলটি সুযোগসন্ধানী ও পদলোভী মেরুদন্ডহীনদের একটি প্রতিক্রিয়াশীল আতাঁত।

 

          অন্য একটি উল্লেখযোগ্য দল মার্কসবাদী নামধারী পার্টির অভ্যন্তরে ভ্রুণ-পার্টি সৃষ্টির দায়ে বিতাড়িত, বক্তব্যের দিক দিয়ে তারা নয়া সংশোধনবাদী পার্টি থেকে অভিন্ন। জাতীয় বক্তব্যে এরা অস্পষ্ট, তত্ত্বগতভাবে দুর্বল।

 

          আরেকটি বিপ্লবী দল কমিউনিস্ট আন্দোলনের নামে প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদে বুর্জোয়াদের একটি আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করছিল। এরা ধার করা বক্তব্য এলোপাতাড়ি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সেতুঙ চিন্তাধারার কথা বলে তাদের সত্যিকার ক্ষুদে বুর্জোয়া চরিত্র গোপন করার প্রয়াস পায়। এরা শিশু অবস্থায় পার্টির মাঝে কোন দ্বন্দ্ব থাকবে না স্টালিন ও মাও সেতুঙ কর্তৃক বহুপূর্বে ধিকৃত ভাববাদী ডেবরিন তত্ত্বের আশ্রয় নিয়েছিল যাতে আন্দোলন কয়েকজন ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীর পকেটস্থ হয়। এ ছাড়া রুদ্ধদ্বা নীতি, মনগড়া মনোলিথিজম, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সেতুঙ চিন্তাধারার দালালদের ঐক্যে আতংকবোধ কিন্তু সংশোধনবাদী, নয়া সংশোধনবাদী ও প্রমাণিত দালালদের সাথে নীতিহীন সুবিধাবাদী পবিত্র আতাঁর রাখতে উৎসাহী, বহুকেন্দ্রের তত্ত্বে বিশ্বাস, বিপ্লবী যুবকদের হাতে পার্টির নেতৃত্ব থাকবে এই তত্ত্ব, সভাপতি মাও সেতুঙ’এর গেরিলা যুদ্ধের নীতির পাশে ঢের মার্কসবাদ বিরোধী গেরিলা যুদ্ধের তত্ত্বে স্থান প্রদান প্রভৃতি জঘন্য মার্কসবাদবিরোধী ক্ষুদে বুর্জোয়া তত্ত্বে বিশ্বাসী। কিছু কিছু বিপ্লবী এদের খপ্পরে পড়লেও অচিরেই তারা এদের সঠিক রূপ আবিষ্কার করে বেরিয়ে আসবে। সম্প্রতি তারা মার্কসবাদী নয়া সংশোধনবাদী পার্টির অভ্যন্তরে ভ্রুণ-পার্টি সৃষতির দায়ে বিতাড়িত যে পার্টির কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, সে পার্টিতে যোগ দিয়েছে।

 

          এ ছাড়া জ্ঞাত অজ্ঞাতভাবে বহু বিপ্লবী বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেন। তাদের কেউ সমঝোতা রেখে, কেউ সমঝোতাহীনভাবে কাজ করছেন, আবার কেউ এলোপাতাড়ি তীর ছুড়ছেন।

 

কাজেই প্রতিটি বিপ্লবী যারা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাও সেতুঙ চিন্তানুসারী ও সে অনুযায়ী অনুশীলনকারী তাঁদেরকে অবশ্যই সংশোধনবাদ, নয়া সংশোধনবাদ ও অন্যান্য মার্কসবাদ বিরোধী আদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং “প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সংগত”- পতাকা ঊর্ধ্বে তুললে ধরে   এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে। সভাপতি মাও বলেছেন, “ ধ্বংস ব্যতীত কোন প্রকার গঠনকার্য সম্ভব নয়। ধ্বংস বলতে সমালোচনা বর্জন বুঝায় এবং ইহাই বিপ্লব। যুক্তি সহকারে সত্য বের করা তার সাথে জড়িত, যা হলো গথনমূলক কাজ।”

 

          কাজেই প্রতিটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাও সেতুঙ চিন্তানুসারীদের উচিত নিজেদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং দেশব্যাপী সর্বহার শ্রেণীর একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করা। সভাপতি মাও বলেছেন, “সুশৃঙ্খলিত, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের তত্ত্বে সুসজ্জিত, আত্মসমালোচনা পদ্ধতি প্রয়োগকারী ও জনগণের সাথে যুক্ত এমন একটি পার্টি, এমন একটির পার্টির নেতৃত্বাধীন একটি সৈন্য বাহিনী, এমন একটি পার্টির নেতৃত্বে সকল বিপ্লবী শ্রেণী ও বিপ্লবী দলের একটি যুক্তফ্রন্ট-এ তিনটি হচ্ছে আমাদের শত্রুকে পরাজিত করার প্রধান অস্ত্র।”

 

          এই বিপ্লবী তত্ত্বে ও বিপ্লবী রীতিতে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য, উপরের কর্মসূচী ও বক্তব্য বাস্তবায়ন করার জন্য একটি সক্রিয় সংগঠন পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন।

 

                                চেয়ারম্যান মাওদীর্ঘজীবী হও

                                মার্কসবাদলেনিনবাদমাও সেতুঙ চিন্তাধারা জিন্দাবাদ।

Scroll to Top