১০৫। ১৯ ডিসেম্বর সম্পাদকীয়ঃ মুক্তির শুভ দিনে

রাশেদুজ্জামান রণ

<৬,১০৫,১৭৪-১৭৫>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়ঃ মুক্তির শুভ দিনে

সংবাদপত্রঃ মুক্তিযুদ্ধ ১ম বর্ষঃ ২৪শ সংখ্যা

তারিখঃ ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১
.

সম্পাদকীয়

                                মুক্তির শুভ দিনে

বাঙালী জাতির জীবনে আজ মহা উৎসবের দিন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে গত ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে দখলদার বর্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করিয়াছে। ২৪ বৎসর জাতীয় নিপীড়ন ও সীমাহীন দুঃখভোগের পরে বাংলাদেশের জনগণ প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিগড়=(নিগূঢ় হবে।) হইতে মুক্ত হইয়া বহু আকাঙ্খিত স্বাধীনতা লাভ করিয়াছেন। বহু সংগ্রাম, বহু ত্যাগের পর বাঙালী জাতি আজ স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাস করার অধিকার লাভ করিয়াছেন। দুনিয়ার বুকে সগৌরবে উদয় হইয়াছে হাজার হাজার শহীদের রক্তোত স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
.

বাঙালী জাতীয় জীবনের এই শুভ দিনে আমরা অন্তরের শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করি সেই বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি যাঁরা গত ২৩ বৎসরে জাতীয় অধিকার ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। আমরা সালাম জানাই সেই অগণিত প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক কর্মীদের জাতীয় অধিকার, গণতন্ত্র এবং শ্রমিক কৃষক ও মেহনতি জনগণের মুক্তির জন্য যাঁরা দিনের পর দিন পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকবর্গের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছেন এবং সেজন্য বহু অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করিয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গে আজ এই শুভ দিনে আমরা বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি আবার ধ্বনিত করিতেছি।
.

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্যে বাংলাদেশের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতা যে অবদান রাখিয়াছেন, পাক সামরিক জান্তার বহু পাশবিক অত্যাচার সত্ত্বেও জনগণ যে ভাবে দৃঢ়তার সহিত স্বাধীনতা সংগ্রামকে অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়া গিয়াছেন, সেজন্য আমরা বাংলাদেশের জনগণকে আজ আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছি। আমরা অভিনন্দন জানাইতেছি আমাদের দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা যোদ্ধাদের যারা(যাঁরা হবে।) মুক্তিসংগ্রামে এক বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিয়াছেন এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগের এক গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন।
.

প্রতিবেশী ভারতের জনগণ, গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ, সরকার এবং সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তি সংগ্রামে যে অকুন্ঠ সমর্থন ও সাহায্য দিয়াছেন, তা বাঙালী জাতি কোনোদিন ভুলিবেনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সেই সাহায্য ও সমর্থনের জন্য আমরা তাদের নিকট জানাই আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন।
.

সর্বোপরি, আমরা অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের নিকট, যাঁদের সাহায্য ও সমর্থন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে অবিস্মরণীয় অবদান রাখিয়াছে।
.

বস্তুত, স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় সমর্থন, শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা যোদ্ধাদের অসম সাহসিক সংগ্রাম এবং ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সাহায্য এবং সমর্থন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের এই ঐতিহাসিক বিজয় সম্ভব করিয়াছে।
.

কিন্তু বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হইয়া স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী অধ্যায়ের দায়িত্বের কথা আমরা যেন বিস্মৃত না হই। পাক সেনাদল কর্তৃক ধ্বংস্কৃত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, প্রায় এক কোটি দেশত্যাগী নর-নারীকে দেশে ফিরাইয়া আনিয়া তাঁদের পুনর্বাসন, দেশের শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা এবং অত্যাচার ও শোষণহীন,(এখানে কমা ছিলনা!) সুখী ও শান্তিময় সমাজ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলার কঠিন কর্তব্য আজ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে। মুক্তিযুদ্ধে জয়ের চেয়ে এক(এখানে এ হবে।) কাজ কম কঠিন নহে। কোন একটি দল, সে দল যত বড়ই হোকনা কেন, তার একার পক্ষে এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই, আজ জরুরী প্রয়োজন হইল উচু হইতে নিচু পর্যন্ত সমস্ত স্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সমস্ত দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক শক্তির একতা। এই একতার আবেদন আমরা আজ আবার সকলের নিকট জানাইতেছি।

.

তাছাড়া, দেশীয় ও বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্ত সম্পর্কে সমস্ত জনগণ ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে আমরা হুঁশিয়ার করিয়া দিতেছি। মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দেশে তার নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ রক্ষা করার জন্য সব সময়ই আমাদের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরোধিতা করিয়াছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক সামরিক জান্তাকে অশেষ সাহায্য দিয়াছে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মুখে তারা জাতিসংঘের মারফত আমাদের দেশে হস্তক্ষেপ করিতে চেষ্টা করিয়াছে। পরিশেষে সপ্তম নৌবহর পাঠাইয়া ভীতিপ্রদর্শনপূর্বক মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে পর্যুদস্ত করিতে সচেষ্ট হইয়াছিল।
.

চীনের মাওবাদী নেতৃত্বও মার্কসবাদী লেলিনবাদী(এখানে হবে লেনিনবাদী।) নীতি বিসর্জন দিয়া আমাদের ন্যায়সঙ্গত মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল ইয়াহিয়া চক্রকে সমর্থন দিয়া চলিয়াছে।
.

যদিও আমাদের বিরুদ্ধবাদী ঐ সকল শক্তির চক্রান্ত এ পর্যন্ত ব্যর্থ হইয়াছে, কিন্তু তাদের সে চক্রান্ত থামে নাই। এখনও তারা আমাদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে নানাবিধ বিগ্ন(এখানে বিঘ্ন হবে) সৃষ্টি করিতে এবং বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে বিপর্যস্ত করিতে সচেষ্ট থাকিবে। তাই, জাতির মুক্তির এই শুভদিনে সকল গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক শক্তিকে আমরা আহবান করি যে, ঐক্যবদ্ধভাবে এই চক্রান্তের মোকাবিলা করিয়া উহাকে পরাস্ত করুন। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখুন।

Scroll to Top