১১৭। ২৬ নভেম্বর সম্পাদকীয়ঃ এবারের ঈদ

তাসমিয়া তাসিন

<৬,১১৭,১৯৩-১৯৪>

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ষষ্ঠ খন্ড

 

শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
সম্পাদকীয়

এবারের ঈদ

বাংলার মুখ

১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা

২৬ নভেম্বর, ১৯৭১

 

 

এবারের ঈদ

বাংলার আকাশে এবারেও শাওয়ালের চাঁদ দেখা দিয়েছে । আত্মবিশ্বাসের বলিষ্ঠতা, সংগ্রামের দৃঢ়তায় সাড়ে সাত কোটি নাগরিক অধ্যুষিত বাঙ্গালী জাতি তাদের ভাগ্যের ইতিহাসের এক করুণ ও সঙ্কটময় মূহুর্তে সেই শাওয়ালের চাঁদকে স্বাগতম জানিয়েছেন।রমজানেরপূর্ণ কৃচ্ছ সাধনার পর গত শনিবার বাংলাদেশে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করলেন। বাংলার ঘরে ঘরে এবারের শারদোৎসব যেভাবে পালিত হয়েছে, ঈদ-উল-ফিতরও সেইভাবেই পালিত হয়েছে।ঈদ আনন্দের হলেও, বছরের একটি পুন্যোৎসব হলেও, এবার হয়েছে ত্যাগের, উৎসবের নয়। শারদোৎসবে যেমন এবার বুড়িগঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বুকে বাজনা বাজেনি, বিচিত্র বেশে নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নামেনি মিছিল করে তেমনি এই ঈদে ঘরে ঘরে আনন্দের ঢেউ খেলেনি, নতুন পোশাকে নামেনি রাস্তায়, আত্মীয়-স্বাজনের বাড়ীতে যায়নি উন্মুক্ত খুশির মন নিয়ে।বাংলার বুকে বর্বর ইয়াহিয়ার ফ্যাসিবাদী চক্র যে অত্যাচার, যে নির্যাতন, যে করুণ মর্মবিদারক পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে তা সব আনন্দকে সব আশা আকাঙ্খাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। বাংলার বুকে আজ এমন কোন ঘর নাই যার স্বজন হারানোর শোক নাই। কি পরোক্ষ, কি প্রত্যক্ষ শোকে শোকে আজ তারা এমন হয়েছেন যে, অত্যাচার, নির্মম নগ্ন পাশবিকতার শিকার পরিণত হয়ে বাংলার প্রতিটি নারী-পুরুষ দুর্জয় শপথে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত। প্রতিটি মুহুর্ত, প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি রক্তের ফোঁটা, মাতৃভূমির মান রক্ষায়, সার্বিক অস্তিত্ব রক্ষায় উৎসর্গীকৃত। অতএব ঈদের উৎসবের জন্যে তাদের স্বাভাবিক অনুভুতিও এর সাথে বিলীন। তারা ইতিহাসের এমন চরম মূহুর্তে বিশ্বের বুকে নিজেদের প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে আত্মবলিদানরত।

.

শুধু এবারের ঈদ নয়। বিগত সালের ১২ ই নভেম্বর বাংলার বুকে যে ভয়ঙ্করী দুর্যোগ নেমে এসেছিল যার ফলে ২০ লাখেরও বেশী নর-নারী বাংলার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছেন, এক বিস্তীর্ণ জনপদ ধূলিসাৎ হয়েছে তার ফলে সেবারও বাংলার মানুষ রমজানের ঈদের পবিত্র সুখ আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি। স্বজন হারানোর শোকে তখনো তারা ছিলেন মুহ্যমান। 

.

বাংলার মানুষ আজ যে ত্যাগ ব্রতে উদ্ধুদ্ধ, দেশকে হানাদার জল্লাদ বাহিনীর কবলমুক্ত করার কাজে হাসিমুখে কোরবান দিচ্ছেন তারই মধ্যে তারা এবারের ঈদের স্বরূপ খোঁজার চেষ্টা করেছেন।

.

আকাশে অশ্রুর কুয়াশামুক্ত খুশীর রোশনাই ছড়িয়ে শাওয়ালের চাঁদের অপেক্ষায় বাংলার বীর সিংহ শাবকরা কাজ করছেন, দেশকে মুক্ত করে সে চাঁদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন আর এক আনন্দ পুলকে দোলায়িত হচ্ছেন এই ভেবে যে, লৌহ শপথ বাস্তবায়িত হলেই তাঁরা ঈদ করবেন। নিজেদের মধ্যে নয়, দুনিয়ার স্বাধীনতাপ্রিয় সংগ্রামী প্রতিটি মানুষের সাথেই তারা ঈদের সত্যিকার আনন্দ আর শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন।নিঃস্বার্থভাবে সেই কাজে নিজেদের নিয়োগ করার শক্তি দেয়ার জন্যে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ পরম করুনাময়ের কাছে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে হাত উঠিয়ে প্রার্থনা জানিয়েছেন। এই প্রার্থনা, এই মোনাজাত হয়েছে ভাঙ্গা মসজিদে, উন্মুক্ত ময়দানে, শরণার্থী ক্যাম্পে, হাসপাতালে, গীর্জায়, মন্দিরে সর্বত্র। ছিন্ন বস্ত্রে, কঙ্কালসার দেহে উন্মুক্ত হৃদয়ের এই মোনাজাত বিশ্ববিধাতার কাছে, মানবতার কাছে, স্বাধীনতাপ্রিয় প্রতিটি বিশ্ববাসীর কাছে।

.

তাই ঈদের সাথে সাথে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত বঙ্গশার্দুলরা হানাদার পাকদস্যুদের অধ্যুষিত এলাকায় দ্রুতগতিতে নিধন করে চলেছেন একের পর এক।

.

বিভিন্ন রণাঙ্গন হানাদার বাহিনী মুক্ত হচ্ছে। বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা খুব শীঘ্রই জলে, স্থলে , আকাশে হানাদার দস্যুদের নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। এই হলো বাংলাদেশ সরকারের দুর্জয় বলিষ্ঠ শপথ। ঢাকার পতন আসন্ন। চূড়ান্ত বিজয় একান্ত নিকটতর । বাংলার প্রতিটি নারী-পুরুষ জল্লাদমুক্ত, অবাঞ্ছিত অবস্থা থেকে মুক্ত এক স্বাধীন, সার্বভৌম দেশে সুখে শান্তিতে বসবাস করবেন এই হোক তাদের চরমতম ও দুর্জয় বলিষ্ঠ শপথ।

Scroll to Top