(১) কুমিল্লার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ(২) ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সশস্ত্র প্রতিরোধ: সাক্ষাৎকার: মেজর আইনউদ্দিন

<৯, ৩.৪, ১৩৭-১৪১>

কুমিল্লার সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার: মেজর আইনউদ্দিন

(১৯৭১ সালের মার্চে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাষ্টার হিসাবে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

২৬১০১৯৭৩

একাত্তরের ২৫ শে মার্চ রাত ১২ টার দিকে কুমিল্লা পুলিশ ক্যাম্প পাঞ্জাবীরা আক্রমণ করে এবং গণহত্যা করে। ২৫ শে মার্চ রাতে তারা এসপি ও ডিসিকে গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে। সে সময় আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম। ২৬শে মার্চ সকালে যখন আমি আমার বাসার বারান্দায় বসে ছিলাম, তখন গাড়িতে করে সাদা পোশাক পরা কিছু লোককে ধরে আনতে দেখি। ঐ দিন আমাকে মেজর জামিল (অবাঙালি) নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমাকে রাতে অয়ারলেসে ডিউটি করতে হবে। আমি রাত ১১টার দিকে যখন ডিউটিতে ছিলাম ঐ সময় সিলেট থেকে পাঞ্জাবী বেলুচ রেজিমেন্ট-এর সি-ও অয়ারলেসে কথা বলেন। সে সময় আমি বুদ্ধি করে নিজের নাম ও পদ গোপন করে একজন পাঞ্জাবীর নাম করে অয়ারলেসে কথা বলি। বেলুচ রেজিমেন্টের সি-ও-র কথায় বুঝতে পারলাম যে শ্রীমঙ্গলে যে সমস্ত বাঙালি সৈন্য ছিল (খালেদ মোশাররফ সাহেব তখন শ্রীমঙ্গলে ছিলেন) তাদের আক্রমণ করবে, তার জন্য বেলুচরা রেকি করেছে। এ সংবাদ পেয়ে আমি কিভাবে এ সংবাদ শ্রীমঙ্গলে পাঠাবো তার চেষ্টা করি, কিন্তু ইতিপূর্বে বাঙালিরা টেলিফোন লাইন কেটে দেয়ায় ঐ জরুরি সংবাদটি শ্রীমঙ্গলে পৌঁছানো সম্ভব হয় নি। খালেদ মোশাররফ সাহেব খবর না পেলেও শ্রীমঙ্গল থেকে তার দলসহ সরে পড়েছিলেন।

 

২৭ তারিখে আমি সাধারণ পোশাক পরে আমার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে যাই যে, যদি আমি রাত ১২টার ভিতর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে না আসি তবে যেন তারা হাতিয়ার নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে একটি জায়গায় অপেক্ষা করে। নির্দিষ্ট জায়গাটা আমি ঠিক করে দিয়েছিলাম।

 

আমি সাধারণ পোশাক পরে একখানা সাইকেলে চড়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওনা হই। দুপুর একটার দিকে পথিমধ্যে পাঞ্জাবী সৈন্যরা ট্রেঞ্চ কাটছিল। কিন্তু তারা আমাকে চিনতে পারে নি। তবে পথিমধ্যে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তায় কংশনগর বাজারে কিছু বাঙালি আমাকে আটক করে। তারপর আমি আমার পরিচয়পত্র দেখিয়ে     তাদের বুঝাই যে, আমি বাঙালি একজন ক্যাপ্টেন, বিশেষ কাজে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাচ্ছি। অনেক তথ্য-প্রমাণ দেয়ার পর তারা আমাকে মোটরসাইকেলে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছিয়ে দেয়। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাত দেড়টার সময় পৌঁছাই। আমি গিয়ে দেখি সকল পাঞ্জাবী সৈন্যকে বাঙালীরা গ্রেফতার করে ফেলছে এবং ছোটখাটো সৈন্যদের বাঙালি সৈন্যরা মেরে ফেলছে।

 

আমি যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌঁছাই তখন করোলা ব্রীজের কাছে দিয়ে জীপ যেতে দেখি। ঐ জীপটিকে আমি থামালাম। ঐ জীপে কয়েকজন বাঙালী সৈন্য এবং একজন ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসান (পাঞ্জাবী) ছিল। আমি সূর থেকে বাঙালী সৈন্যদের ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতার করতে বলি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙালী সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ক্যাপ্টেন কৌশলে গাড়ি ব্যাক করে পালিয়ে যায়। কিন্তু ২৮ তারিখে ঐ ক্যাপ্টেন যখন বিকালে পুনরায় কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছিল তখন করোলা ব্রীজের নিকট ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। ঐ গাড়িতে তিনজন বাঙালী সৈন্য মারা যায় ও দুজন আহত হয়। ঐ ক্যাপ্টেন মুসলমান ছিল, তাই বাঙালীরা দায়পরবশ হয়ে তার মৃতদেহ মুসলমান কায়দায় রাত আড়াইটায় কবর দেয়। এ ধরণের কবর দেয়া প্রথম ও শেষ। তারপরে আর কোথাও মৃতদেহকে মুসলিম কায়দায় কবর দেয়া হয় নি। (শত্রুদের আনুষ্ঠানিকভাবে কবর দেয়া নাকি জেনেভা কনভেনশনে আছে)

 

২৮ তারিখে আমি ৪ জন অফিসারসহ অন্যান্য সৈন্য নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ডিফেন্স নিই। ২৭ তারিখে রওনা হয়ে খালেদ মোশাররফ সাহেব শ্রীমঙ্গল থেকে পুরা কোম্পানী নিয়ে ২৮ তারিখ সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছান এবং আমাকে বলে যান, যদি কোন এম-এন-এ বা কোন বুদ্ধিজীবী আসেন তাহলে তাদের আমার (খালেদ মোশাররফ) সাথে যোগাযোগ করার জন্য যেন সিলেট তেলিয়াপাড়া টি-এস্টেটে পাঠিয়ে চলে যান। তেলিয়াপাড়ায় খালেদ মোশাররফ সাহেব ক্যাম্প খোলেন।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে এবং স্থানীয় প্রশাসন ঠিকভাবে চলে। ঐ সময় এস-ডি-ও ছিলেন রকিবুদ্দিন আহমেদ। তিনি তখন স্থানীয় প্রশাসক হন।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে রক্ষা করার জন্য গোকনঘাটে ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার, ক্যাপ্টেন শহীদ ও মাহবুবুর রহমানকে ঐ ঘাট দেখাশোনার জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল; কারণ ঐ নদীপথে পাক সৈন্যরা জাহাজে করে সৈন্য আনতে পারত। গোকনঘাট চিল একটি লঞ্চঘাট। সৈন্যরা করোলা নদীর আশেপাশে ডিফেন্স নিয়ে ছিল। তাদের তত্ত্বাবধান করেন সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট হারুনর রশীদ।

 

২৯ তারিখে বিকাল ৪টার দিকে পাকবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিমান থেকে দেড়-দুঘন্টা ধরে বোমাবর্ষণ করে। এর ফলে একজন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য শহীদ হয়। কিন্তু বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে তেমন কোন অস্ত্র না থাকায় শুধু ট্রেঞ্চের ভিতর বসে থাকতে হয়।

 

৩১ তারিখে আখাউড়া থেকে তৎকালীন ইপি-আর (বর্তমানে বিডিআর ) নায়েক সুবেদার গোলাম আম্বিয়া আমার সাথে যোগাযোগ করে। তিনি আখাউড়াতে ডিফেন্স নিয়েছিলেন। আখাউড়াতে ইপি-আর এর সৈন্যরা পাঞ্জাবীদের ঘেরাও করে রাখে। তারপর ৩১ তারিখে সারাদিন গোলাগুলী হওয়ার পর কিছু পাঞ্জাবী সৈন্য মারা যায় ও কিছু ধরা পড়ে। কিন্তু ৭ জন পাঞ্জাবী পালিয়ে যায়। তারপর ঐ ৭ জন পাঞ্জাবী সৈন্যকে গ্রামের ভিতর বাঙালীরা ধরে মেরে ফেলে।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যে সমস্ত পাঞ্জাবী অফিসার ধরা পড়ে তারা হলোঃ

১) লেঃ কর্নেল খিজির হায়াৎ খান,

২) মেজর সাদেক নেওয়াজ,

৩) লেফটেন্যান্ট আমজাদ সাইদ।

তাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নবীনগর, শাহবাজপুর, সরাইল হয়ে তেলিয়াপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাদেরকে ভারতীয় সৈন্যদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। তাদেরকে বাঙালীরা হত্যা করতে পারতো কিন্তু ঐ পাঞ্জাবী অফিসাররা কোনদিন বাঙালীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি বা বেঈমানি করে নি।

 

১লা এপ্রিল ৭১ আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউড়া যাই। ইপি-আর সৈন্যদের সাথে যোগাযোগ করলাম। তারা বলে যে তারা আমার সাথে (মানে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে) একত্র হয়ে যুদ্ধ করবে। তারা আমার কাছে কিছু অস্ত্র চাইলে আমি অস্ত্র সরবরাহ করতে রাজী হই। তারপর ইপি-আর-এর সৈন্যরা আখাউড়া, গঙ্গাসাগর ও উজানীসাহা ব্রীজের আশেপাশে ডিফেন্স নেয়। আমি আগরতলায় বিএসএফ-এর সাথে ফোনে যোগাযোগ করি এবং তাদের কাছে কিছু অস্ত্র চাই। এবং তারা তা দিতে চান। লেঃ কর্নেল দাসের সাথে রাতে ফোনে যোগাযোগ করি।

 

১/২ তারিখে আমি আখাউড়া আওয়ামী লীগের সহসভাপতিকে সংগে করে আগরতলায় যাই। সেখানে বিএসএফ-এর লেঃ কর্নেল দাসের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। মিঃ দাস ১০ হাজার গুলি ও একশন ৩০৩ রাইফেল ও কিছু এক্সপ্লেসিভ দিতে অঙ্গীকার করেন এবং পরে তিনি তা দেন। এ অস্ত্র দেয়ার ব্যাপারে যে কন্ট্রাক্ট হয় সে কন্ট্রাক্ট করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম-এন-এ আলী আজম সাহেব। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম-এন-এ আলী আজম ও লুৎফুল হাই সাচ্চু সাহেব বেঙ্গল রেজিমেন্টের খাওয়া-দাওয়া, গাড়ি ইত্যাদি দিয়ে প্রচুর সাহায্য করেছেন যুদ্ধ চলা অবস্থায়। সৈন্য জনাব আলী আজম ৩০ তারিখের পূর্বেই আগরতলা গিয়ে অস্ত্রের ব্যাপারে যোগাযোগ করেছিলেন।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মেজর হাবিবুল্লাহ বাহার (যিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে এসেছিলেন-ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার-কমান্ডিং অফিসার (তিনি কুমিল্লা থেকে পালিয়ে আসেন) এবং ক্যাপ্টেন সায়গলকে (যে পাকিস্তানে পালিয়ে গেছে) তেলিয়াপাড়া ক্যাম্পে অন্য কাজে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

 

আমি যখন কুমিল্লা থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রওনা দিই তখন যে প্রায় একশত সৈন্য রেখে আসি তারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বেপরোয়া হয়ে পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এর ফলে প্রায় ৩-৪ শত পাঞ্জাবী সৈন্য মারা যায়। কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য শহীদ হন।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমি ১৫/২০ জন এম-পি-এ কে ভারতে পাঠিয়ে দিই। এপ্রিল মাসে আমি জানতে পারি যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ভৈরব এসেছেন। সৈয়দ সাহেবকে অবহিত করাই যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে আছে। আমি সৈয়দ সাহেবকে আনার জন্য স্পিডবোট পাঠাতে চাইলে তিনি আসতে রাজী হন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আসেন নি। এ সময়ের মধ্যে আমি বিভিন্ন জেলায় অয়ারলেসের মাধ্যমে খবর নিতে লাগলাম যে কোথায় বাঙালীরা রিভোল্ট করল। আমি জানতে পারলাম ময়মনসিংহে মেজর সফিউল্লাহ আছেন ও নরসিংদীতে একটি কোম্পানী আছে মেজর মতিউর রহমানের নেতৃত্বে। মেজর সফিউল্লাহ একটি পরিকল্পনা করেন যে, মেজর মতিউর রহমানের বাহিনী ও তাঁর কোম্পানী মিলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবে ও দখল করবে। এ সংবাদ আমি মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেবকে জানাই। তিনি এ খবর পেয়ে তেলিয়াপাড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসেন। এখানে একত্র হয়ে তারা সবাই মিলে যুক্তি করে ভালভাবে কাজ করতে পারবে। পরে সফিউল্লাহ সাহেব পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে চলে আসেন এবং মেজর মতিউর রহমান সাহেব ভৈরব ব্রীজের কাছে ডিফেন্স নিয়ে থাকেন।

 

এদিকে মেজর নাসিম এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে আশুগঞ্জ ডিফেন্স দিয়ে থাকেন ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ছিলাম আমি, ভৈরবে ছিলেন মেজর মতিউর রহমান এবং আশুগঞ্জে ছিলেন মেজর নাসিম। বাকি সবাই তেলিয়াপাড়া চলে যান।

 

মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে একত্রিত হলেন তখন তারা সিদ্ধান্তে আসতে চাইলেন যে, তারা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করবেন কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বিপুলসংখ্যক পাকসৈন্য রয়ে গেছে। ঐ পাকসৈন্যের সাথে যুদ্ধ করে পারা যাবে না, এর ফলে অনেক সৈন্য মারা যাবে। শেষ পর্যন্ত মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন পালসেনাদের গেরিলা পদ্ধতিতে ঘায়েল করতে হবে।

 

১৪ তারিখে পাকসেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিমান থেকে গুলি করে; ফলে কিছু পাবলিকসহ কিছু বাঙালী সৈন্য মারা যায়। এ সংবাদ খালেদ মোশাররফ সাহেব পেয়ে জানালেন যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট আখাউড়া চলে আসে। ঐ তারিখে পাকসৈন্য প্যারাট্রুপার ফেলে আশুগঞ্জের পিছনের দিক থেকে আক্রমণ করে। এর ফলে মেজর নাসিম সাহেবের কিছু সৈন্য শহীদ হয়। ১৪ তারিখ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিমান আক্রমণ চলে। এর পরে আশুগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে কোন রকম টেলি-যোগাযোগ বা কোনরকম যোগাযোগ সম্ভব হয় নি।

 

১৪ই এপ্রিল আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংক থেকে (ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক) ম্যানেজারকে বাড়ি থেকে ডাকিয়ে ব্যাংক খুলে ২ কোটি টাকা নিয়ে যাই। ঐ টাকা ঐদিন তেলিয়াপাড়া মেজর সফিউল্লাহ সাহেবের কাছে জমা দিই। ১৪ তারিখে সারাদিন বিমান আক্রমণ হচ্ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। এ সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার ভিতরে আমি বীরত্বের সাথে এ কাজ সমাধান করি। আমি বিকালেই তেলিয়াপাড়া থেকে ফিরে এসে দেখি আমার বাহিনী কিছু কিছু আখাউড়া চলে এসেছে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে দু’খানা মূল্যবান অয়ারলেস সেট নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সড়ক পথে তেলিয়াপাড়া হয়ে আখাউড়া চলে আসি।

 

১৫ই এপ্রিলে মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকেল বলেন, আমাকে আখাউড়ায় সৈন্যদের দেখাশোনা করতে হবে। আখাউড়াতে ৩০/৪০ জন সৈন্য ছিল। আমি ১৫ তারিখে আমার বাহিনীকে বিকালে গঙ্গাসাগরের দিকে মুখ করে ডিফেন্স নেবার কলাকৌশল দেখিয়ে দিই। ১৫ তারিখ রাতে কুমিল্লা থেকে রেলে করে পাকসৈন্য গঙ্গাসাগরে আসে এবং গঙ্গাসাগরের ব্রীজের দক্ষিণ পারে বাজারের দিকে তারা ডিফেন্স নেয় এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট উত্তর দিকে অর্থ্যাৎ আখাউড়ার দিকে ডিফেন্স নেয়। ১৬ই এপ্রিল সকালে যেখানে ব্রীজের নিকট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ডিফেন্স নিয়েছিল, সেখানে ঐ সৈন্যদের সাথে দেখা করার জন্য আমি ক্রলিং করে যাচ্ছিলাম। পাকসৈন্যরা আমাকে দেখে আমার দিকে অবিরাম গুলীবর্ষণ করতে থাকে, কিন্তু আমি ঐ ঝুঁকি নিয়ে ট্রেঞ্চে গিয়ে সৈন্যদের বলে আসি পাকবাহিনীকে হত্যা করে যখন তাদের সংখ্যা কমে আসবে এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট ট্রেঞ্চের কাছে চলে আসবে ঠিক তার অল্প কিছুক্ষণ আগে যেন তারা বিওপিতে চলে আসে।

 

১৬ এপ্রিল গঙ্গাসাগরের এক পাড়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং অপর পাড়ে পাকবাহিনী অবস্থান করছিল। ঐ দিন বিকালে ৪টা থেকে পাকবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনী আধ ঘন্টা বোমাবর্ষণ করে থেমে যায়।

 

বিকাল ৬টা থেকে পাকবাহিনী আবার গোলা ছুড়তে থাকে এবং আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে থাকে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে এবং বহু পাকসেনাকে খতম করে শেষে পাকসেনাদের সামনে টিকতে না পেরে সব বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈন্য পিছনের দিকে চলে আসে। বাকি ছিল মাত্র সিপাই মোস্তফা কামাল; সে আর ফিরে আসে নাই। তার হাতে ছিল একখানা এল-এম-জি ও ৮ হাজার গুলী। তার সাথে যে ২ জন সেনা ছিল তারাও চলে গেল। কামাল ট্রেঞ্চের ভিতর থেকে যুদ্ধ করতে থাকে। তার গোলায় পাকবাহিনীর তিনজন অফিসার মরে ও ২ জন আহত হয়। সবসুদ্ধ প্রায় সাড়ে তিনশ’ সৈন্য খতম হয়। কামালের গুলি যখন ফুরিয়ে যায় তখন শত্রুসেনারা মাত্র ৫০ গজ দূরে ছিল, তবু সে পিছনে ফিরে আসে না। দূর থেকে পাকসেনা চিৎকার করে কামালকে আত্মসমর্পণ করতে বলে, কিন্তু কামাল তা করে নাই। পরে যখন পাকসেনারা ক্রলিং করে কামালের ট্রেঞ্চের কাছে আসে, কামাল তার শেষ সম্বল দু’খানা গ্রেনেড দিয়ে কিছু পাকসেনাকে আহত করে। শেষ পর্যন্ত কামাল পাকসেনাদের কাছে ধরা পড়ে। পাকসেনারা তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। প্রায় সাড়ে তিনশ’ পাকসেনা মারা যায়। এ সংবাদ যখন পাকসেনারা অয়ারলেসে তাদের এড অফিসে প্রেরণ করছিল তখন বেঙল রেজিমেন্ট তাদের অয়ারলেসের মাধ্যমে সঠিকভাবে জানতে পারল যে, বেঙ্গল পাকবাহিনীর সাড়ে তিনশ’ সৈন্যকে হত্যা করেছে। এত সৈন্য মরার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায় যার কারণে পরবর্তী ২/৩ মাস তারা আর আক্রমণ করে নাই।

 

এরপর আমার বাহিনী আখাউড়া বি-ও-পিতে ডিফেন্স নেয়। পরে আমার অধীনে দ’জন লেফটেন্যান্ট নিয়োগ করা হয়। একজন ক্যাডেট অফিসার হুমায়ুন কবীর। তার এলাকা ছিল কসবা। তিনি কসবাতে সাবসেক্টর কমান্ডাড় ছিলেন। অপরজন হলেন লেফটেন্যান্ট হারুনার রশীদ। তিনি নসিঙ্গরে সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন। হারুন ও কবীরের কাছে এক কোম্পানী ও আমার কাছে দুই কোম্পানী সৈন্য ছিল। কোন সময় কসবা রেলস্টেশন ও কসবা নতুন বাজার পাকবাহিনী দখল করতে পারেনি। এবং নসিঙ্গরের কালাছড়া টি এসেস্ট প্রায় সব সময় মুক্তিবাহিনীর অধীনে ছিল। আমি প্রত্যেক দিন একবার করে তিনটি ক্যাম্প পরিদর্শন করতাম।

 

১৭ই এপ্রিল রাত ১১টা ৩০ মিনিটে মেজর শাফায়াত পামিল ও আমিসহ পাঁচজন অফিসার ও ৬০ জন সৈন্য নিয়ে আখাউড়া পাকবাহিনীর সেনাদের দখলে ছিল। ব্রীজ উড়িয়েছিল ৬৫ জন বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈন্য। তারা অক্ষত অবস্থায় আখাউড়া বি-ও-পি তে ফিরে আসে।

 

কর্নেল বাজার অপারেশন জুন১৯৭১:

 

আখাউড়া পতন হওয়ার পর বাংলাদেশ বাহিনী কর্নেল বাজারে জড়ো হয়। বাংলাদেশ বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পাক সৈন্যদের হত্যা করে সংখ্যা কমানো। তাই তারা ওখানে রয়ে গেল। পাকবাহিনীর সৈন্য ছিল এক কোম্পানী আর বাংলাদেশ বাহিনীর ৩টি কোম্পানী ছিল। তার ভিতর একটি ছিল অনিয়মিত বাহিনী।

 

আগরতলা থেকে যে রাস্তা গঙ্গাসাগরের দিকে গিয়েছে ঐ রাস্তার উত্তর মুখ হয়ে বাংলাদেশ বাহিনীর সেনারা ডিফেন্স নেয়। ঐ রাস্তার উত্তর দিকে একটি খাল ছিল। পাকবাহিনী আখাউড়া থেকে কর্নেল বাজারের দিকে অগ্রসর হয় উত্তর দিক থেকে। তারা খাল পার হয়। রাতের বেলায় এসে পূর্বদিকে অর্থ্যাৎ বাংলাদেশ বাহিনীর পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে। এর ফলে বাংলাদেশ বাহিনীর সেনারা ছত্র ভঙ্গ হয়ে পড়ে তারা ছিল অনিয়মিত বাহিনী। যা কিছু সৈন্য ছিল তাদের মধ্যে হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। ফলে বেয়নটের আঘাতে বাংলাদেশ বাহিনীর ৭ জন সৈন্য শহীদ হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বাহিনীর অনিয়মিত সৈন্যদের আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। তারা যার যার মত নানা দিকে চলে যায়।

Scroll to Top