(১) ঘেরাও(২) চট্টগ্রামের সশস্ত্র প্রতিরোধ(৩) সরবরাহের অভাব(৪) চট্টগ্রাম শহরে চূড়ান্ত লড়াই(৫) ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ(৬) প্রথম বাংলাদেশ সরকার(৭) রামগড় ভস্মীভূত(৮) শুভপুর সেতুর যুদ্ধসাক্ষাতকারঃ মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম

<৯, ২.৭, ৫৯-৮৮>

চট্টগ্রামের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও প্রাসঙ্গিক কথা

সাক্ষাতকারঃ মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম

(মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম রচিত ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ গ্রন্থ, ১৯৮১ থেকে সংকলিত। ১৯৭১ সালের মার্চে উনি ক্যাপ্টেন পদে সাবেক ইপিআর সেক্টর হেড কোয়ার্টার চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন)

।।চরম আঘাতের সেই রাত।।

২৫শে মার্চ, ১৯৭১ সাল। বৃহস্পতিবার।

 

অন্যান্য দিনের মতো সকাল ৭টায় আমি অফিসে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি পশ্চিম পাকিস্তানী মেজর ইকবাল বসে আছেন। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, “মিঃ রফিক আপনাকে দারুন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অনেক খাটুনি গেছে আপনার ওপর দিয়ে, কক্সবাজার গিয়ে কয়েকদিন বিশ্রাম নিন না কেন? ইচ্ছা হলে আজই যেতে পারেন। আমি কমান্ডিং অফিসারকে বলে দেব।”

 

এটা ঠিক, গত কয়েক বছরের মধ্যে আমি কোন ছুটি নেই নি। বিশ্রামের আমার খুবই প্রয়োজন ছিলো। তবু মেজর ইকবালের সেদিনের অস্বাভাবিক পীড়াপিড়ি আমার ভালো লাগলো না, বরং আমার সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করলো। তাঁকে আমি শান্ত গলায় জবাব দিলাম, “ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু স্যার, আপনি তো জানেন গত জানুয়ারি থেকে সব ছুটি বাতিল করা হয়েছে।”

 

“ওকথা বাদ দিন। আমি কমান্ডিং অফিসারকে বুঝিয়ে বলতে পারবো। আমার বিশ্বাস, তিনি ছুটি মঞ্জুর করবেন।” মেজর ইকবাল তবুও বলে চললেন।

 

মেজর ইকবাল যে কমান্ডিং অফিসারের একজন প্রিয়পাত্র তা আমরা সবাই জানতাম। আমাকে চট্টগ্রাম শহরের বাইরে এবং আমার সৈন্যদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখার জন্যে মেজর ইকবালের এ প্রচেষ্টা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আমি তাঁর কথায় তাল না দিয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বললাম, “আপনি বোধকরি জানেন, গতকাল পোর্ট এলাকায় জনতার ওপর সৈন্যরা গুলি চালিয়েছে অনেক লোক মারা গেছে।”

 

‘অনেক নয়’- যেন তেমন কিছুই ঘটেনি এমন ভাব দেখিয়ে তিনি বললেন, “মাত্র একজন কিংবা দু’জন আহত হয়েছে।”

 

এরপর তিনি মুখে কৌতুহলোদ্দিপক হাসি ফুটিয়ে বললেন, “শুনলাম শেখ মুজিবর রহমান সামরিক পদক্ষেপের প্রতিবাদে আগামী ২৭শে মার্চ হরতাল ডেকেছেন।”

 

 

“আমি এখনো শুনিনি তবে পোর্ট এলাকায় যে সৈন্যরা এলোপাতারি গুলি চালিয়েছে তার শব্দ আমাদের অফিসে বসেও শোনা গেছে।”

 

সেদিন বেলা ২টায় আমি ই-পি আর সদর দফতর ত্যাগ না করা পর্যন্ত মেজর ইকবাল সারাক্ষণ আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করলেন।

 

ইয়াহিয়ার সাথে মীমাংসায় পৌঁছে গেছে বলে এ সময়ে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে নির্ভরযোগ্য কোন মহল থেকে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলো না। সরকারী বেতার একটা রাজনৈতিক ফয়সালার আভাস দেয়া হয়। কিন্তু এ খবরের ওপরও নির্ভর করা গেলো না। বাসা থেকে সেই মুহূর্তে আমি আমার সদর দফতরে টেলিফোন করে সকল সৈন্যকে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলাম। তারপরে বাড়ির লনে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলাম।

 

চট্টগ্রামের বেলা ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে ডাঃ জাফর আমার বাসায় এলেন। লনে বসে আমরা সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে আলোচনা করলাম। কিন্তু তখনো ঢাকার কোন নির্ভরযোগ্য খবর আমরা পাইনি। রাত ৮টার দিকে ডাঃ জাফর ঢাকার কোন সংবাদ এসেছে কিনা জানার জন্য আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে গেলেন। আমি আমার এক বন্ধু ক্যাপ্টেন মুসলিম উদ্দিনকে নিয়ে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আগেই রাতের খাবার খেয়ে নেয়ার জন্য বাসার ভিতরে গেলাম। খাওয়া কেবল শুরু করেছি, এমন সময় একজন আওয়ামী লীগ কর্মীসহ ডাঃ জাফর আবার ফিরে এলেন। রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিট।

 

“মনে হচ্ছে আলোচনা ব্যার্থ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার গোপনে করাচী চলে গেলেন বলে শোনা যাচ্ছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্যাংক নিয়ে শহরের দিকে বেরিয়ে পড়েছে বলে খবর এসেছে।“ তারা দুজনই উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় এতো উত্তেজিত ছিলো যে তাদের মুখ দিয়ে যেন কথা সরছিলো না।

 

“আপনি কি সত্যি সংবাদ বলছেন?” তবু আমি ডাঃ জাফরকে জিজ্ঞেস করলাম।

 

“হ্যাঁ। ঢাকা থেকেই আমরা এ খবর পেয়েছি। খবর পেয়েই আমাদের দল জনাব সিদ্দিকীর বাসায় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হই। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে জনাব সিদ্দিকী আমাদেরকে অবিলম্বে আপনাকে ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে বলেছেন এবং উপযুক্ত বেবস্থা গ্রহণ করার জন্য আপনাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এতগুলো কথা বলে উভয়ে একটু থামলেন এবং গভীর আশা নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তাদের দু’জনকেই বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। আমি শুনতে পেলাম, কে যেন খুব নিচু গলায় বলল, “এবার আপনার পালা।”

 

তখনও আমাদের হাত ভাতের থালায়। মুহূর্তের জন্য আমি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। ওদিকে আগ্রহী আগন্তকের স্থির দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ।

 

সেনাবাহিনী ট্যাংক নিয়ে শহরের দিকে বেরিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই তারা ভয়ানক কিছু ঘটাবে। সব চাইতে খারাপ কিছুর কথাই এখন আমাদের ভাবা উচিত। ৩রা মার্চ থেকেই ওরা নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করেছে শুধু ২৪ শে মার্চ চট্টগ্রাম পোর্টে ২০ জনেরও বেশী লোক নিহত হয়েছে। আরো খবর পেয়েছিলাম বাংলাদেশের সর্বত্রই ওদের হত্যাকাণ্ড চলছে – ঢাকা, খুলনা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহীসহ আরো অনেক জায়গায় গুলি চলেছে। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায়ও এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম ই-পি-আর- এর দুটি ওয়্যারলেস সেটই ঢাকার পিলখানার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিল না। এমন কোন দিন ঘটে নি। সন্দেহ আগে থেকেই গভীরতর হয়ে উঠেছিল।

 

এসব দ্রুত আমার মানসপটে ভেবে উঠলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থেকে জেনেছি, ওদেরকে কোন জায়গায় একবার লেলিয়ে দেয়া হলে হেন নৃশংসতা নেই যা ওরা করতে পারেনা। ইয়াহিয়ার আকস্মিক ঢাকা ত্যাগ, আলোচনা ব্যার্থ হওয়া এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনীর বের হওয়া – সবকিছু মিলিয়ে একটা বেপরোয়া হত্যালীলার সুস্পষ্ট আভাস পাচ্ছিলাম। আরো আশংকা করছিলাম, সামরিক বাহিনীর বাঙালি সৈন্যরাও ওদের হাত থেকে নিস্তার পাবে না।

 

এ সময় নিজের ভেতর থেকেই আমি যেন এক অলৌকিক সাহস অনুভব করলাম। মনে হলো আমার ভেতর থেকে কে যেন আমাকে বলছে আমার নিজের জীবন এবং আমাদের অন্যান্যর জীবন রক্ষার জন্য এ পশুশক্তির বিরুদ্ধে অবশ্যই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এরপর আমি ‘হয় স্বাধীনতা অর্জন, না হয় ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু’ এ ধরনের এক চরম সিদ্ধান্ত নিলাম। ডাঃ জাফরকে বললামঃ আমাদের ষোলশহর এবং ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে বাঙালি সৈন্যদেরকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে বলুন। তারপর রেলওয়ে হিলে আমার সদর দফতরে দেখা করবেন।

 

খাওয়া থেকে উঠেই আমি হালিশহর ই-পি-আর দফতরে ফোন করলাম। সেখানে বাঙালি জেসিও’রা আমার নির্দেশের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তাঁদেরকে বললাম, এক্ষুনি সব ফাঁড়িতে দ্বিতীয় সাংকেতিক বার্তাটি পাঠিয়ে দিন। অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের রুম থেকে বের হতে দেবেন না। নৌ- বাহিনী সদর দফতরের দিকে থেকে হামলা হতে পারে। সেদিকে প্রতিরক্ষামুলক কিছু সৈন্য মোতায়েনের ব্যবস্থা করুন। আমি আসছি।

 

রাত তখন ৮টা ৪৫ মিনিট। আমি শেষবারের মত আমার সারসন রোডস্থ বাসভবন ত্যাগ করলাম। আমাদের প্রথম লক্ষস্থল ওয়ারলেস কলোনীর দিকে আমাদের গাড়ী ছুটে চললো। আমার পাশে ড্রাইভার কালাম এবং পেছনের সিটে দুজন রক্ষী। তীব্র উত্তেজনায় সবাই ঠোঁট কামড়াচ্ছিলো। রাস্তা জনমানবশূন্য। আমাদের গাড়ী যতই আয়ারলেস কলোনির এগচ্ছিলো, উত্তেজনা ততই বাড়ছিলো। একটা সরু রেল ক্রেসিংয়ের ওপর আসতেই জীপ একটু লাফিয়ে উঠলে আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো। আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এখান থেকে আমি ওয়ারলেস স্টেশনের এনটিনা দেখতে পাচ্ছিলাম। নিরাপত্তামুলক ব্যবস্থা হিসাবে আয়ারলেস স্টেশনের চারদিকে ছিল কাটা তারে ঘেরা।যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে সেজন্য আমি ড্রাইভারকে গাড়ী আস্তে চালাতে বললাম। আমাদের এখানকার সাফল্য ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তামুলক ডিউটিতে নিযুক্ত ই-পি-আর-এর একটি প্লাটুনের মোকাবিলা করতে হবে আমাদের ৪ জনকে ওদেরকে নিরস্ত্র করতে হবে। আমার রেকর্ড অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন হায়াত এবং সুবেদার হাসমত এই প্লাটুনের কমান্ডে ছিলেন। বাকী সেনারা সবাই ছিলো বাঙালি। আমাদের জানামতে এখানে আরো তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো। অনুরুপভাবে নগরীর অন্যান্য এলাকাতেই ই-পি-আর প্লাটুন অবস্থান করছিলো। তবে আয়ারলেস কলোনীর এই প্লাটুনটিই শুধু পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারের কমান্ডে ডিউটিরত ছিলো।

 

গেটে পৌঁছতেই প্রহরারত শান্ত্রি জীপ থামিয়ে দিলো। বাঙালি শান্ত্রি প্রহরারত ছিলো। সে আমার জীপটি ভেতরে যাবার অনুমতি দিলো। আমরা ক্যাপ্টেন হায়াতের রুমের সামনে গিয়ে জীপ থামালাম। সেখানেও একজন শাস্ত্রী পাহারা দিচ্ছিলো।

 

সাবধানে আমি হায়াতের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মারাত্মক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, হয় সফল হবো, না হয় আমার মাথা ভেদ করে একটা বুলেট বেরিয়ে যাবে। শেষেরটি সত্যি হলে চট্টগ্রামের ই-পি- আর সেনা পরিচালনা করতে আর কোন বাঙালি অফিসার থাকবে না। এই চিন্তা আমাকে কিছুটা বিহবল করে তুললো ক্ষণিকের জন্য।

 

আমি খুব আস্তে দরজায় নক করলাম এবং বন্ধুসুলভ গলায় বললাম। “হ্যালো হায়াত ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?”

 

“এই কেবল শুয়েছি স্যার।“ আমার গলায় স্বর চিনতে পেরে সে আলো জ্বালালো। জানালার পর্দার ফাক দিয়ে আমি দেখলাম বালিশের তলা থেকে কি যেন একটা নিয়ে সে তার শোবার পোশাকের নিচে রাখছে। দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো।”

 

“সব ঠিকঠাক হ্যাঁয়” জবাব দিয়েই সে দরজা খুললো।

 

“প্লিজ ভেতরে আসুন স্যার, এবং-”

 

তার কথা শেষ না হতেই আমি স্টেনগান তার বুকের দিকে ধরে বললাম, “আমি দুঃখিত হায়াত, তোমাকে গ্রেফতার করতে হচ্ছে।“ হঠাৎ সে তার পিস্তল বের করার উদ্যোগ নিতেই ড্রাইভার কালাম দ্রুত এগিয়ে আসে এবং দুজনেই হায়াতের মাথায় আঘাত করি। সাথে সাথে আমরা তার হাত ও মুখ বেধে ফেললাম এবং টেলিফোনের তার কেটে দিলাম। তারপর পাশের ব্যারাকে ঘুমন্ত সুবেদার হাসমতকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠালাম। সুবেদার হাসমত চোখ মুছতে মুছতে উঠে এসে স্যালুট দিয়ে দাড়াতেই কালাম এবং অন্য প্রহরিরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হাসমতকে আটক করে তার হাত ও মুখ বেঁধে ফেলা হলো।

 

হায়াতের রুমের সামনে দাঁড়ানো শাস্ত্রীটি এতক্ষন হতভম্ব হয়ে এইসব অদ্ভুত ঘটনা দেখছিল। হঠাৎ কি মনে করে সে একটি টিলার দিকে দৌড় দিলো। কালাম ফিসফিস কণ্ঠে বললে, ও পশ্চিম পাকিস্তানী এবং পড় মুহূর্তেই একটি বুলেট সাঁ করে চলে গেলো। আমরা নিচু হয়ে বসে পড়লাম। ব্যারাকগুলো থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে পড়তে লাগলো। যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় আমি বললাম, শান্ত্রি ভুল করে গুলি ছুঁড়েছে। তারপর সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলাম। অন্য তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করলো। যে শান্ত্রি গুলি ফেলে পালিয়ে গেলো। এই প্লাটুন থেকে আমি ১০ জন সেনাকে রেলওয়ে হিলে আমার সম্ভাব্য সমর- দফতর রক্ষা করার জন্য পাঠালাম। অন্যদেরকে হালিশহরে আমার সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিলাম। বিচ্ছিন্ন প্লাটুনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিভিন্ন দিকে কয়েকজন বার্তাবাহককে পাঠালাম এবং চূড়ান্ত নির্দেশের জন্য সবাইকে অবিলম্বে হালিশহরে আমার সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দিলাম।

 

অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে একটি দুঃসাধ্য কাজ সমাধা হলো। ড্রাইভার কালাম এবং দুজন প্রহরীকে ধন্যবাদ, তারা জীবন বিপন্ন করে এ কাজে সহায়তা করেছে।

 

রাত সাড়ে নটায় আমরা হালিশহরে পৌঁছলাম। ড্রাইভার কালামকে সতর্ক করে আলো নিভিয়ে দিয়ে গাড়ী আস্তে চালাবার নির্দেশ দিলাম। হালিশহরে জেসিও এবং এনসিওরা আমরা জন্য অপেক্ষা করছিলো। তিনটি অস্ত্রাগাড়ের সবকটিই আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিলো। বাঙালি এনারা যার যার অস্ত্রাগারের সামনে অস্ত্র ও গুলির জন্য সমবেত হয়েছে। মাত্র একমাস আগে আমরা থ্রি-নট- থ্রি রাইফেলের পরিবর্তে বিপুল পরিমান চীনা হাতিয়ার ও গোলাগুলি পেয়েছিলাম। এগুলো মিলিয়ে আমাদের মজুত ছিলো উদ্বৃত্ত, যুগ পরে খুবই কাজে লেগেছিলো।

 

হালিশহরের কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ছিল ৩০০ পশ্চিম পাকিস্তানী-ই-পি-আর সৈন্য। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো সিনিয়র জেসিও এবং এনসিও। নিঃশব্দে এদের পরাভূত করতে হবে কেননা আমার সদর দফতরের চারপাশের এলাকায় ছিলো অবাঙালিদের ঘন বসতি। এছাড়া বেশ কিছুসংখ্যক কমান্ডে সেসব অবাঙালির সঙ্গে বসবাস করছে বলে আগেই খবর পেয়েছিলাম এবং কমান্ডে ও অবাঙালিরা সবাই ছিলো পুরোপুরি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। কাজেই এখানে কোন শব্দ হলে গোটা ব্যাপারটা পণ্ড হয়ে যাবে।

 

অস্ত্রাগার আমাদের কব্জায় থাকায় আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলাম। শুধু একটি মাত্র বিপদ ছিলো, কেউ যদি গোপনিয়তা ফাঁস করে দেয় তাহলে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে নৌবাহিনী সদর দফতর থেকে পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের প্রচেষ্টা বানচাল করতে ছুটে আসতে পারে।

 

আমরা প্রথমে সমগ্র এলাকা ঘেরাও করে ফেললাম যাতে কোন পশ্চিম পাকিস্তানী পালাতে না পারে। এরপর শুরু হলো শত্রু সৈন্যদের গ্রেফতারের পালা।

 

মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনেক বাঙালি জেসিও এবং এনসিওকে সীমান্ত এলাকায় পাঠিয়ে চট্টগ্রামের ই-পি-আর সদর দফতরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের মোতায়েন করা হয়েছিলো। চট্টগ্রামের ই-পি-আর কমান্ডার ছিলেন লেঃ কর্নেল আবদুল আজিজ শেখ। নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য ঢাকার নির্দেশে তিনি এই ব্যবস্থা করছিলেন।

 

এই সব বদলী ইত্যাদির ব্যাপারে প্রথমে আমি খুবই চিন্তিত হয়েছিলাম। পরে দেখলাম যে, এটা আমার পরোক্ষ উপকারেই লেগেছে। কারণ, এক জায়গায় এতগুলো শত্রু সৈন্য পাওয়া কম সৌভাগ্যের কথা নয়।

 

আমি কৌশলে অস্ত্রাগারে বাঙালিদের মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম। দিনের বেলা আমি শুধু বাঙালি সেনাদের চুলকাটা, পোশাক ও আচরণ পরীক্ষা করে দেখতাম। এদেরকে সংশোধনের অছিলায় শাস্তি হিসাবে অস্ত্রাগার প্রহরার অতিরিক্ত ডিউটি  দিতাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাতের এই ডিউটি পড়তো। ফলে অস্ত্রাগারের কাছে আর কোন পশ্চিম পাকিস্তানীর থাকার দরকার হতো না। আমার এই ব্যবস্থা খুবই কাজে লেগেছিলো।

 

তখন রাত ১০টা। আমি আমার অফিসের বারান্দায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছি। ভীষণ ক্ষুধা বোধ করছিলাম। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। পানি চেয়ে পর পর দুগ্লাস খেয়ে দেখলাম। সৈন্যদের ইতিমধ্যে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়ে গেলো। নৌ-বাহিনীর সদর দফতর থেকে কোন হামলা হলে তা প্রতিরোধ করার জন্য দুটি প্লাটুন এর মধ্যেই সেদিকে পাঠানো হয়েছিলো। আমি পশ্চিম পাকিস্তানীর সবচাইতে সিনিয়র জেসিও সুবেদার মেজর ইতবার এর অপেক্ষা করছিলাম।

 

কোনরুপ সন্দেহ না করেই সুবেদার মেজর আমার অফিস রুমে প্রবেশ করলেন। আমি তাকে বসতে বললাম। তারপর বললাম, “সুবেদার- মেজর সাহেব, আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন। শহরে কি ঘটেছে জানেন কিছু ?”

 

“না স্যার”- সরলভাবেই তিনি জবাব দিলেন। আসলেও তিনি কিছু জানতেন না। তিনি শুধু দেখছেন যে, সৈন্যরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে এবং তিনি এটাকে আমার নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ডিউটির অঙ্গ বলে মনে করেছিলেন। পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ গণহত্যা পরিকল্পনার কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করায় ব্রিগেডিয়ারের নিচের পদের খুব কমই এ ব্যাপারে জানাতে পারে। মাত্র কয়েকজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ ব্যাপারে জানতে পেরেছিলেন। এ কড়াকড়ি গোপনীয়তা প্রকারান্তরে আমাদেরি কাজে লেগেছিলো।

 

সুবেদার- মেজর হঠাৎ চোখ কচলে দেখলেন পাশের বিশ্রাম কক্ষ থেকে চারজন সৈন্য বেড়িয়ে এসে রাইফেলের বেয়োনেট তাঁর বুকের ওপর ধরেছে। আমি তখন দৃড়কণ্ঠে বললাম’ “সুবেদার- মেজর সাহেব, আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। চিৎকার কিংবা পালাবার চেষ্টা করলেই প্রাণ হারাবেন।

 

তাঁর হাত বেঁধে বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। এভাবেই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সকল পশ্চিম পাকিস্তানী জেসিওকে গ্রেফতারের পালা শেষ হলো। এ গোপনীয়তা রক্ষা না করলে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যেতো। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় হবার আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিংবা নৌবাহিনীর লোকেরা আমাদের আক্রমন করে বসতো।

 

এর কিছু পরেই ই-পি-আর সিগন্যাল কোম্পানির দায়িত্বে নিয়োজিত আবাঙ্গালি জেসিও সুবেদার মোবিনকে আমার কক্ষে ডাকলাম। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী ই-পি-আর সেনারা কিছু একটা ঘটেছে বলে আঁচ করে ফেলে। কিন্তু নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের আর কিছু করার ছিলো না। কেননা, গোটা এলাকা আমাদের সৈন্যরা আগেই ঘেরাও করে ফেলেছিলো।

 

সুবেদার অফিসে ঢুকতেই দেখি সে খুব আতঙ্কিত। ঠিক এ সময়ে মেজর ইকবালের টেলিফোন এলো। আমি রিসিভার তুলে ধরতেই ওপাশ থেকে তিনি বললেন, হ্যালো রফিক এতো রাতে ওখানে কি করছেন ?

 

“এখানকার গার্ডরা সতর্ক আছে কিনা, দেখতে এসেছি।“

 

“আচ্ছা। মুহূর্তের জন্য তিনি থামেন, তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করেন, সুবেদার মোবিন কোথায় ?”

 

“তিনি হয়তো রুমে ঘুমাচ্ছেন। কথা বলবেন তাঁর সাথে?”

 

“হ্যাঁ, দয়া করে টেলিফোনটা তাকে দিন না।”

 

“আমি এক্ষুনি তার কাছে লোক পাঠাচ্ছি। তিনি এলেই আপনাকে ফোন করতে বলবো।“ সন্দেহ নিরসনের জন্য আমি আরো কিছুক্ষন তার সাথে আলাপ চালিয়ে যাই, “সৈন্যরা ডিউটি দিচ্ছে কিনা তা কয়েকটি জায়গায় দেখে এসেছি, সবকিছু ঠিক আছে।“

 

এরপর হঠাৎ তার প্রশ্ন শুনে ধাক্কা খেলাম। “কিন্তু ক্যাপ্টেন হায়াতের টেলিফোন কেউ ধরছে না কেন ?”

 

“ওহ! ওর টেলিফোনটা খারাপ। এইমাত্র ওর ওখান থেকে এলাম। সুন্দর এক কাপ চা খাওয়ালো।”

 

“ইয়ার! কভি হামকো ভি লে চলো চায়ে পিনে কে লিয়ে। মেজর ইকবাল বললেন।”

 

“কালকেই নিয়ে যাব।”

 

এরমধ্যে চারজন সিপাই সুবেদার মোবিনকে বেঁধে ফেললো। বাইরের কেউ জানতেও পারলো না আমার রুমে কি ঘটেছে। মেজর ইকবাল রেখে দিলেন। আমি বেয়োনেট চেয়ে নিয়ে সুবেদার মেজরের গলায় ধরে বললাম, “আমার অধীনে এতদিন কাজ করে নিশ্চয়ই বুঝেছেন আমি কেমন। এখনই মেজর ইকবালের সাথে আপনাকে কথা বলতে হবে- আমি যেভাবে বলবো ঠিক সেইভাবেই জবাব দিয়ে কথা না বললে মেরে ফেলবো। বুঝতে পারছেন ?”

 

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার কথায় তিনি সম্মতি জানালেন। আমি ইকবালের নম্বরে ডায়েল করে সুবেদার মোবিনের কানের কাছে রিসিভার ধরলাম।

 

“হ্যালো স্যার, আমি সুবেদার মোবিন বলছি।”

 

“মোবিন সাহেব, আপনার কাছে আর কেউ আছে কি?” মেজর ইকবাল প্রশ্ন করেন। আমি মাউথ পিসে হাত চারা দিয়ে মোবিনকে বলতে বললাম। বলুন এখানে কেউ নেই। সুবেদার আমার নির্দেশ মত তাই বললেন।

 

“কিন্তু ক্যাপ্টেন রফিক তো ওখানে ছিলেন, কোথায় গেলেন তিনি।“ এবারও আমি টেলিফোন চেপে ধরে তাকে যেভাবে বলতে বললাম তিনি সেভাবেই জবাব দিলেন, “ক্যাপ্টেন রফিক এই মাত্র সুবেদার মেজর ইতবারকে নিয়ে কোথায় যেন বেড়িয়ে গেলেন।“

 

“কোই গড়বড়?”

 

“না স্যার। সব কিছু ঠিকঠাক হ্যাঁয়।“ সুবেদার মোবিন অত্যন্ত অনুগত জবাব দিলেন।

 

“বহুত আচ্ছা। আজ রাতের জন্য আপনিই ডিউটি অফিসার। টেলিফোনের পাশেই অপেক্ষা করবেন। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।“

 

“ঠিক হ্যাঁয় স্যার-“

 

বিরাট একটা দুশ্চিন্তা কেটে গেলো। বন্দী সুবেদার মোবিনের প্রহরায় একজন বাঙালি জেসিওকে রাখা হলো যাতে সে আর টেলিফোনে কিছু উল্টাপাল্টা বলতে না পারে।

 

রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে সিনিয়র বাঙালি জেসিও সুবেদার জয়নাল খবর দিলেন যে, কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে আমরা চট্টগ্রাম শহরে ই-পি-আর এর সকল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য আটক করতে সক্ষম হলাম। সীমান্ত ফাঁড়িগুলোতেও আমার সাংকেতিক বার্তা দুটি পৌঁছে গেছে বলে খবর পেলাম। বার্তা দুটি পেয়েই রাত ৮টা ৪০মিনিট থেকে ৯টা ৩০মিনিটের মধ্যে তারা সব ফাঁড়ির পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের পরাভুত করা হয়। ২৪শে মার্চের রাতে যখন আমি দ্বিতীয় বার্তাটি স্থগিত রাখতে বলি, সে নির্দেশ পাওয়ার আগেই প্রথম নির্দেশ অনুযায়ী কয়েকটি ফাঁড়িতে বাঙালি সেনারা কাজ সমাধা করে ফেলে। পরে অবশ্য দ্বিতীয় বার্তাটি স্থগিত হয়ে গেল তারা আর চট্টগ্রামের দিকে রওনা হয় নি।

 

২৫শে মার্চ রাতে দ্বিতীয় বার্তায় চূড়ান্ত নির্দেশ লাভের পর অনেক সেনাদলই চট্টগ্রামের দিকে রওনা হয়ে পড়ে।

 

এদিকে চট্টগ্রাম শহরের বিচ্ছিন্ন প্লাটুনগুলো খবর পেয়ে লড়াই কেন্দ্রগুলোর দিকে এগোচ্ছিলো। শুধু বিমানবন্দরের প্লাটুনটির সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না। এটা আমার জন্য খুবই বিপদের কারণ ছিলো। কেননা, পরিকল্পনা মোতাবেক শত্রুরা যাতে বিমান বন্দর ব্যাবহার না করতে পারে তার দায়িত্ব ছিলো এই প্লাটুনের ওপর। এখান দিয়ে সৈন্য আনা-নেয়া বন্ধ করতে পারলে বিমান বন্দর, পোর্ট এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতরসহ সমগ্র এলাকায় আমাদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা সহজতর হতো। বিমানবন্দরের টেলিফোন এক্সচেঙ্গ অপারেটরকে গোপনে চব্বিশ ঘণ্টা লাইন চালু রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু ২৫শে মার্চ সন্ধার পরই নৌ-বাহিনীর সদর দফতরের সৈন্যরা গোপনে বিমানবন্দরে গিয়ে পুরো প্লাটুনের লোকদের গ্রেফতার করে ফেলে। ফলে এখানে আমাদের বড় একটা ক্ষতি হয়ে যায়।

 

উপকূলীয় বাধ বারবার শত্রু সৈন্যর চলাচল প্রতিরোধ করার জন্য দুটি প্লাটুনকে পাঠানো হলো। একটি কোম্পানি রেলওয়ে হিল প্রতিরক্ষা দায়িত্বে রইলো। প্রায় ১০০ সৈন্যকে দুই অথবা তিনজনের ছোট ছোট দলে ভাগ করে আগ্রাবাদ রোড এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকার মোড়ে মোড়ে লড়াইয়ের জন্য মোতায়েন করা হলো। বাকী সৈন্যদের হালিশহরেই সংরক্ষিত রাখ হলো- যাতে কোথাও বিপদ দেখা দিলে তারা সেদিকে যেতে পারে। রামগড়ের সৈন্যদের কাছে পাঠানো বার্তায় তাদেরকে ফেনী নদীর ওপর শুভপুর সেতু ধ্বংস করে সেখানে একটি কোম্পানিকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থায় অবস্থান গ্রহণ করতে এবং অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে প্রধান সড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসতে বলা হয়েছিল।

 

হালিশহর ত্যাগের আগে বন্দিদের একটি ভবন কঠোর প্রহরাধীনে রাখার এবং “শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ” করে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে রাত ১১ টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে আমি রেলওয়ে হিলের সদর দফতরে পৌঁছলাম। এখানে পৌঁছে নৌ- বাহিনীর সদর দফতর, পোর্ট এলাকা এবং বিমানবন্দরের ওপর আক্রমন চালানোর উদ্দেশ্যে সীমান্ত এলাকার সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি ভেবেছিলাম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এবং ষোলশহরে মোতায়েন ৮ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে সক্ষম হবে। রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ডে ছিলেন লেঃ কর্নেল চৌধুরী এবং ৮ইষ্ট বেঙ্গল ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। এ দু’জায়গায় বাঙালি সৈন্যদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ২০০০ এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো আনুমানিক ৪০০।

 

রাত তখন ১১টা ৩০মিনিট। হঠাৎ ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা বারাক থেকে বেড়িয়ে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের বাঙালি সৈন্যদের ওপর হামলা চালালো। অস্ত্রাগারের গার্ডদের হত্যা করে প্রথমে তারা সেগুলো দখল করে। অন্যান্য বাঙালি সৈন্য তখনও ঘুমিয়ে ছিলো। অস্ত্রাগার দখলের পরই পাকিস্তানী সৈন্যরা নির্বিচার হত্যালীলায় মেতে উঠে। সে রাতে তারা এক হাজারেরও বেশি বাঙালি সৈন্যকে হত্যা করে। এরপর তারা বাঙালি সৈন্যদের আবাসিক কোয়াটারগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং অস্ত্রের মুখে যাকে পায় তাকেই হত্যা করতে থাকে। নারী ও শিশুদের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়।

 

এই হত্যালীলা থেকে যেসব বাঙালি সৈন্য জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলো তারা চারদিকে দৌড়াতে শুরু করে। কেউ কেউ আমার দফতরে এসে সেই লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দেয়। অন্যরা ষোলশহরস্থ ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দিকে ছুটে যায়। এই রেজিমেন্টের অধিকাংশ অফিসার এবং সকল সৈন্য ছিল বাঙালি।

 

কিছুসংখ্যক সৈনিক ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে ষোলশহর ৮ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে রাত প্রায় একটার দিকে যোগাযোগ করে সেনানিবাসে আক্রান্ত বাঙালি সৈনিক এবং তাদের পরিবারবর্গ প্রাণ রক্ষায় এগিয়ে যাবার জন্য তাদেরকে অনুরোধ জানায়। সেই ভয়াবহ রাতে বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন এনাম সেনানিবাস থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

 

ইতিমধ্যে রেলওয়ে হিলে প্রতিরক্ষায় আমার ই-পি-আর প্লাটুনগুলোর সুসংগঠিত করে যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে এই পাহাড়েরই একটিন আবাসিক ভবনের নিচতলায় আমার সদর দফতর স্থাপণ করলাম।

 

এই ভবনের রেলওয়ে অফিসারদের কয়েকটি পরিবার বাস করতেন। রেলওয়ে হিলে অবস্থান নিতেই সেখানকার অফিসার এবং তাদের পরিবারবর্গ অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। তারা গাড়ি থেকে আমাদের জিনিসপত্র নামাতে পাহাড়ের উপর আত্মরক্ষামূলক ট্রেঞ্চ খুঁড়তে, নতুন টেলিফোন লাইন স্থাপণ করতে এবং আমাদের সৈনিকদের খাবার তৈরিতে প্রভূত সাহায্য করেন।

 

আগেই কোথায় কোথায় ট্রেঞ্চ খুঁড়তে হবে তা দেখে রেখেছিলাম এবং কয়েকজন জেসিওকে স্থানগুলো গোপনে দেখিয়েছিলাম। সৈনিকরা যথাস্থানে ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে কিনা তা দেখার জন্য রেলওয়ে হিলের চারদিক ঘুরলাম। পূর্বনির্ধারিত পাহাড়ের ঢালে ৩ ইঞ্চি মর্টার স্থাপণ করা হলো। রেলওয়ে হিলে আরও কয়েকটি ভবনে বহুসংখ্যক অফিসার তাদের পরিবারবর্গকে অন্য কোন নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানালাম। আমাদের কথামত অফিসারদের পরিবারবর্গকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হলেও অধিকাংশ রেলওয়ে অফিসার এবং তাদের বয়স্ক পুত্রসন্তান ও পুরুষ আত্মীয়রা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের সাহায্য করার জন্য পাহাড়েই থেকে গেলেন। ইতিপূর্বে খবর পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের সকল সীমান্তবর্তী ফাঁড়ির ই-পি-আর সৈনিকরা আবাঙ্গালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করে আমার সঙ্গে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে কেবলমাত্র নৌ-সদর দফতর এবং সেনানিবাস ছাড়া সমগ্র চট্টগ্রাম শহর এলাকা, হালিশহরস্থ ই-পি-আর লাইন এবং ই-পি-আর সদর দফতর তখন আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে। আমি ভেবেছিলাম ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সৈনিকদের নিয়ে মেজর জিয়া এবং লেঃ কর্নেল চৌধুরী সেনানিবাস আক্রমন করবেন এবং আক্রমণে নিশ্চয়ই তারা সফলতা অর্জন করবেন। পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কার্যক্রম গ্রহণের উদ্দেশো রাত ৮টা ৩০ মিনিটে যখন আমি সারসন রোডের বাসভবন ত্যাগ করি তখনই ডাঃ জাফর এবং জনাব কায়সারকে বলেছিলাম ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে তারা যেন খবরটি জানিয়ে দেন। তারা আমার যুদ্ধ শুরু করার কথা এই রেজিমেন্টকে জানিয়েছিলেন। বলা প্রয়োজন যে, ঐ রাতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে হালিশহর এবং চট্টগ্রাম নগরীর অন্যান্য এলাকায় ৫০০ অবাঙ্গালি সৈনিক, জেসিও এবং কয়েকজন ই-পি-আর অফিসারকে আমরা নিরস্ত্র করতে পেরেছিলাম। আমার অধীনস্থ ই-পি-আর সৈনিক ও জেসিওদের সাহসিকাপূর্ণ কার্যক্রমের পূর্ণ গোপনীয়তা সুস্ঠ পরিকল্পনা জন্যই অবাঙ্গালি সৈনিক ও অফিসারদের নিরস্ত্র করা সম্ভব হয়েছিলো।

 

প্রাথমিক সাফল্যের পর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমি ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সৈনিকদের সাফল্যের খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আর ভাবছিলাম নিশ্চয়ই তারাও ২০ বালুচ রেজিমেন্টাক ইতিমধ্যে নিরস্ত্র করতে পেরেছেন। প্রাথমিক সাফল্যের পর পরই সদর দফতর এবং বিমানবন্দর দখলের জন্যে আমি আমার সীমান্ত ফাঁড়ির ই-পি-আর সৈনিকদের আগমন অপেক্ষায় উন্মুখ ছিলাম।

 

ইত্যবসরে আমি বেতার কেন্দ্র, টেলিফোন একচেঞ্জ আক্রমন ও দখল করার উদ্দেশ্যে আমার সৈন্যদের পাঠালাম। আমার এই রেলওয়ে হিল দফতরের ঠিক উল্টোদিকেই ছিলো নৌ-বাহিনীর যোগাযোগ কেন্দ্র। এখান থেকে পরিস্কার দেখা গেলো কয়েকজন পাকিস্তানী নৌ-সেনা ওখানে ঘোরাফেরা করছে। ঠিক এই সময়ে নৌ- বাহিনীর একটি গাড়ি আগ্রাবাদের দিকে এগিয়ে গেলো। আমার মর্টার জেসিও সুবেদার আইজুদ্দিন গাড়ি দেখেই তাঁর অবস্থান থেকে দৌড়ে এসে বললো- “স্যার, গাড়ীতে কয়েকজন নৌ-সেনা রয়েছে। দেবো নাকি শেষ করে ?”

 

আমি বললাম, “না এখন নয়। এটা বোধ হয় পর্যবেক্ষণ গাড়ী। রাস্তা পরিস্কার আছে কিনা দেখার জন্য এসেছে। মনে হয় সৈন্যদের আরো বড় দল এই রাস্তায় আসবে। সেই লক্ষ্য বস্তই হবে আমাদের জন্য উত্তম। একসঙ্গে অনেক লোককে পেয়ে যাবো।“ একটু পরেই আরেকটি গাড়ী একই পথে চলে গেলো। কিন্তু সৈন্যদের বড় দলটি আর এলো না। মিনিট দশেক পর দুটি গাড়ীই ফিরে এলো এবং ক্যান্টনমেন্টের দিকে চলে গেলো।

 

পরবর্তীকালে জানতে পেরেছিলাম, প্রথম গাড়ীতে করে মেজর জিয়া পোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন। তার কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে এম, ভি, সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আনার জন্য তিনি রওনা হয়েছিলেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চট্টগ্রামস্থ নিউ মার্কেট শাখার ম্যানেজার জনাব কাদের যখন আমার বার্তা নিয়ে ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দফতরে যান তার আগেই মেজর জিয়া তার কমান্ডিং অফিসারের আদেশে ষোলশহর থেকে বেড়িয়ে পড়েন। রেজিমেন্টের ডিউটি অফিসার আমার বার্তাটি পান। খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে থামানোর জন্য পোর্টের দিকে রওনা হয়ে যান। ২৫শে মার্চ রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা এই মধ্যে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের ওপর হামলা চালায়। ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য ও অফিসারবৃন্দ তখনো এ খবর জানতে পারেন নি। পূর্বে উল্লেখিত দ্বিতীয় গাড়ীতে ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। আগ্রাবাদ পর্যন্ত গিয়ে মেজর জিয়াকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যারিকেড পরিস্কার করেছিলেন। খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে সর্বশেষ পরিস্থিতির কথা জানালে মেজর জিয়া ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট লাইনে ফিরে আসার এবং তার অফিসারদের সঙ্গে পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেন। মেজর জিয়াকে বহনকারী প্রথম গাড়িটি দেখেই নায়েব সুবেদার আইজুদ্দিন উত্তেজিত হয়ে আক্রমন করতে চেয়েছিল। রেলওয়ে হিলের পাশের এই সড়কের অনেকখানি আমাদের এল-এম-জি এবং রকেট লাঞ্চারের সুনির্দিষ্ট আওতার মধ্যে ছিল। আমরা ধৈর্য্য না ধরলে মেজর জিয়া এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে বহনকারী গাড়ী দুটি রকেট লাঞ্চারের গোলায় উড়ে যেতো। আরো বড় শিকারের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম বলেই অলৌকিকভাবে সেদিন তারা দুজন বেঁচে গিয়েছিলেন।

 

ইউনিট লাইনে ফিরে মেজর জিয়া এবং তার অফিসাররা কমান্ডিং অফিসার সহ অবাঙ্গালি অফিসারদের গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেন। অবাঙ্গালি অফিসারদের গ্রেফতার পর্ব শেষ হবার পরই তাদের কাছে ক্যান্টনমেন্টের হত্যাকাণ্ডের খবর পৌঁছে।

 

৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসার পরে স্বীকার করেছিলেন, ক্যান্টনমেন্টের ঘটনার ব্যাপারে মতদ্বৈততা দেখা দেয়। রেজিমেন্টের তরুন অফিসারদের কয়েকজন তখনই ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সৈনিকদের জীবন রক্ষায় ছুটে যেতে চান। অন্যরা ২১০ বালুচ রেজিমেন্টকে আক্রমন করাকে আত্মঘাতি হবে বলে মত প্রকাশ করেন। এই মত পার্থক্যের ফলেই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এই পর্যায়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাওয়া কিংবা ২০ বালুচ রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা বোকামি হবে। এরপর ঐ রাতেই আমরা ষোলশহর ত্যাগ করে পটিয়ার দিকে অগ্রসর হই।

 

এদের এই পদক্ষেপ সম্পকে আমি আগে কিছুই জানতাম না। ৮ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে যাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলাম সেই ডাঃ জাফর ফিরে এলে সব জানতে পারলাম। কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে ডাঃ জাফরকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি এদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন  নি?

 

“আপনার খবর তো ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পৌঁছে দিয়েছি। তবু তারা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রেজিমেন্টাল সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি”- ডাঃ জাফর জবাব দিলেন।

 

“দয়া করে এক্ষুনি যান, গিয়ে ওদেরকে থামান। এখন সবকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রনে। ওদের সাথে সম্মিলিতভাবে বাকী জায়গাগুলোও আমরা মুক্ত করতে পারবো। আজকের রাতই সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ।“

 

।।সশস্ত্র প্রতিরোধ।।

 

চট্টগ্রাম, ২৬শে মার্চ। আমার দফতরে টেলিফোনে খবর এলো যে পাকিস্তানী সেনারা নৌ-ঘাঁটি থেকে  অগ্রসর হয়ে হালিশহরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহের ওপর আক্রমন চালিয়েছে। ই-পি-আর ট্রুপস এই আক্রমণ প্রতিহত করে। শুত্রুদের প্রচুর হতাহত হয়। পাকিস্তানীরা হালিশহরে কোন বাধা আশা করেনি। সংগঠিত প্রতিরোধ মোকাবেলার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলো না। তাদের অগ্রবর্তী দলটি হালিশহরের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যূহের সম্মুখীন হতেই আমাদের সৈনিকরা পাকিস্তানীদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো। পাকিস্তানীরা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমুর হয়ে পড়ে। বহু সংখ্যক হতাহত হলো। অবশেষে তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। এ সময়ে অপর এক টেলিফোমে জানালাম, ৮০ থেকে ১০০টি যানের বিরাট একটি কনভয় কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছে। কুমিল্লা থেকে মেজর বাহার চট্টগ্রাম টেলিফোন অপারেটকে একথা জানালে সে তাৎক্ষনিক আমাকে তা অবহিত করে। সংবাদ পাওয়ার পরপরই আমি পাকিস্তানী কলামটিকে এম্বুশ করার জন্য একজন জেসিওর নেতৃত্ব হালিশহর থেকে এক কোম্পানি সৈন্য পাঠালাম। হালকা মেশিনগান এবং ভারী মেশিনগান ছাড়াও কোম্পানিটির সাথে ছিল ৩ মর্টার ও রকেট লাঞ্চার। অপারেশনাল কমান্ডার সুবেদার মুসা যাত্রার প্রাক্কালে আমাকে টেলিফোন করে বললেন, “আমাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করবেন স্যার।“

 

“সকল দেশবাসী আপনাদের জন্য দোয়া করছে। যুদ্ধ চালিয়ে যান, মাতৃভুমিকে মুক্ত করেন। আমার গলার স্বর ছিলো আবেগে উদ্বেল।“

 

কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামগামী শত্রুপক্ষে ছিলো ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোরস রেজিমেন্ট ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি অংশ এবং তাদের সঙ্গে ১২০ মিলিমিটার মর্টারবাহী একটি দল। ২৬শে মার্চ রাত ১টার দিকে তারা চট্টগ্রামের পথে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব একশ মাইলের কিছু বেশি। তাদের পথে বহুসংখ্যক কাল্ভারট এবং ছোট ছোট সেতু ছিল। সৈন্য চলাচল বাধাদানের জন্যে পূর্বেই জনসাধারণের এগুলোর অধিকাংশ ভেঙ্গে ফেলেছিলো। তাই পাকিস্তানী কলামটিকে অনেক ক্ষেত্রে মুল রাস্তা ছেড়ে ছেড়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। একই সাথে ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারের সৈনিকরা সেতুগুলো মেরামতও করে চলছিলো। যা হোক, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শুভপুরে সেতুর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে রাখা হয়েছিল। কুমিল্লাস্থ ৫৩ ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি নিজেই সমগ্র কলামের নেতৃত্বে ছিলেন। শুভপুর সেতু মেরামত করতে সময় লাগবে দেখে ব্রিগেড কমান্ডার পদাতিক সেনাদের নিয়ে নদী পার হয়ে চট্টগ্রামের পথে রওনা হলেন এবং পিছনে রেখে গেলেন মর্টার এবং ইঞ্জিনিয়ার ইউনিটকে। তাদের বলে গেলেন সেতু মেরামত করতে তারা যেন অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে যোগ দেয়। সূর্য তখন অস্তপ্রায়। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি এবং তার বাহিনী চট্টগ্রাম থেকে ১৪ মাইল দূরে কুমিরায় পৌঁছে গেলেন।

 

এদিকে ইপিআর সেনারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রাস্তার পূর্বে পাশের একটি উঁচু জায়গায় এম্বুশ করে বসেছিলো। রাস্তার পশ্চিমে কিছু দুরেই সাগর। উঁচু জায়গাটি থেকে রাস্তা এবং সাগর বেশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। বড় সেতুগুলোর কষ্টসাধ্য বাধা পেরিয়ে আসতে পেরে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি খুব খুশী ছিলেন কারণ সেতুগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হলে তাদের পক্ষে সেতু পার হওয়া সম্ভব হতো না। সমস্যার মুহূর্তে কুমিরায় পৌঁছে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে আর মাত্র মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই চট্টগ্রামের পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন এবং তারপরই নামতে পারবেন বাঙালিদের শায়েস্তা করতে। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি জীবনের সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জার মুখোমুখি হলেন। ইপিআর সেনাদের এমবুশে তিনি এবং তার প্রায় অর্ধেক সৈন্য দিশেহারা হয়ে পড়লো।

 

এই এমবুশে পাক সেনাদের হতাহতের খবর পরে পাওয়া গিয়েছিলো। লাইট মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলির শিকার হয়েছিলেন ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফরস রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল শাহপুর খানসহ প্রায় ৭০ জন পাকসেনা। ধ্বংস প্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যাও ছিলো প্রচুর। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি জীবন বাঁচানোর জন্যে তখন প্রাণপণে ছুটেছিলেন পাহাড়ের দিকে। কয়েকজন সঙ্গীও তাকে অনুসরণ করলো। ভীতসস্ত্রস্ত সৈনিকরা হাতিয়ার, যানবাহন এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ফেলেই প্রাণপণে ছুটেছিলো। শত্রুপক্ষের পিছনের অংশ যারা আমাদের অস্ত্রের আওতার বাইরে ছিল তারা সঙ্গে সঙ্গেই সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুর করলো। এক ঘণ্টারও বেশি সময় এই গুলি বিনিময় চললো। এই সময় আমাদের সেনারা প্রায় ৩মাইল সরে এসে পরবর্তী অবস্থানে প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে ইপিআর এর ৫জন গুরুত্বরভাবে আহত হয়।

 

কুমিল্লায় শত্রুর বিরুদ্ধে ইপিআর সেনাদের এই এমবুশ ছিলো আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এই প্রথম সরাসরি আক্রমন। কুমিরার ঘটনার গুরুত্ব এতই সুদুরপ্রসারী ছিলো যে, এই ঘটনা পাকিস্তানী সৈন্যদের চট্টগ্রামে অবাধে কিছু করার মুল পরিকল্পনা ব্যাহত করে দেয়। চট্টগ্রামে শত্রুদের লোকবল পর্যাপ্ত ছিলো না বলে কুমিল্লা থেকে লোকবল বৃদ্ধি ছিল একমাত্র ভরসা। এই এম্বুশের পরে আমরা একটি আয়ারলেস বার্তা শুনে ফেলি। চট্টগ্রামের জৈনক কমান্ডার ঢাকায় ৯৪ ডিভিশনের কর্নেল স্টাফ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, আমাদের অনেক লোক হতাহত হয়েছে। সীতাকুণ্ডের দক্ষিনে বাকী সৈন্যরা আটকা পড়ে আছে। বিমানে সৈন্য পাঠানোর অনুরোধ করছি। জরুরী ভিত্তিতে বিমানে করে হতাহতদের সরাবার বাবস্থা করা দরকার।

 

কুমিল্লায় আমারও কিছু লোক হতাহত হয়েছিল। আমারও প্রয়োজন ছিল নতুন সৈন্যের, অস্ত্র এবং গোলাবারুদের। সেই মুহূর্তে সীমান্ত এলাকা থেকে যে সব ইপি সৈন্য আসছিলো তারাই ছিলো আমার প্রধান ভরসা।

 

২৬শে মার্চ ভোর নাগাদ ক্যাপ্টেন হারুন শহরের পাঁচ মাইলের মধ্যে এসে পড়লেন। তাঁর সৈন্যরা উচ্চ কণ্ঠে “জয় বাংলা” শ্লোগান দিতে দিতে আসছিলো। কিন্তু শহরের উপকণ্ঠে এসেই থামতে হলো তাদেরকে। কয়েকজন সৈন্যকে শহর ছেড়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে যেতে দেখা গেলো। কিছুক্ষনের জন্য ক্যাপ্টেন হারুন বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন “শত্রুরা কি তাহলে পুরোপুরি শহর দখল করে ফেলেছে?” এই ভাবনা তাঁকে কিছুটা হতবুদ্ধি করে দেয়। পরে দেখা গেলো যে, এরা বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার এবং ৮ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক। তারা সবাই পটিয়ার দিকে যাচ্ছিলো। শহরে ঢোকার আগে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি কালুরঘাট ব্রিজ পেরিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁকে কালুরঘাট এলাকাতেই থাকতে বলা হলো। ফলে পূর্বে পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের যুদ্ধে আমার সঙ্গে যোগ দেয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হলো না।

 

কক্সবাজারে ইপিআর কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মফিজ। তিনি দুটি ইপিআর কোম্পানি নিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য কক্সবাজার ত্যাগ করেছিলেন। তাঁকেও কালুরঘাট এলাকায় থামিয়ে সেখানেই আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে বলা হয়। তিনি পরে আমাকে বললেন। আপনার সাথে যোগ দিতে পারিনি এটা আমার ত্রুটি ছিলো না। মেজর জিয়া আমাকে কালুরঘাট থামিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাকে আপনার নির্দেশের কথা জানালে তিনি আমাকে জানান শহরে কেউ নেই। অবশ্য পরে দেখা গেলো আপনি তখনো শহরে যুদ্ধ করে চলেছেন।“

 

আমরা তখনো শহর ছাড়ি নি। বিভিন্ন জায়গায় প্রচণ্ড লড়াই হচ্ছিল। কিন্তু ঘটনাবলী শহরের পরিস্থিতিকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছিলো তা মোটেই আমার জন্য অনুকুল ছিলো না।

 

কক্সসবাজার এবং কাপ্তাই থেকে যে সৈন্যরা আসছিলো কালুরঘাট ব্রিজের কাছে তাদের থামিয়ে দেয়া হচ্ছিল। কুমিরায় প্রধান সড়ক বরাবর প্রচণ্ড সংঘষের দরুন রামগড়ের সৈন্যরা আসতে পারছিলো না। শহরে যে ক’জন সৈন্য ছিলো শুধু তাদের সম্বল করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর গত্যন্তর ছিলো না। নৌ- বাহিনীর সদর দফতর এবং পোর্ট মুক্ত করার পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো।

 

বেলা ৯টা নাগাদ অনেক উঁচু দিয়ে শহরে হেলিকাপ্টার ঘোরাঘুরি শুরু করলো। কয়েক জায়গায় জনসাধারণ সেগুলোর দিকে বন্দুকের গুলি ছুঁড়লো। বিরাটকায় সি-১৩০ বিমানগুলো ঢাকা থেকে সৈন্য আনতে থাকলো। অসহায়ভাবে তবু আমরা সেই অবস্থান আঁকড়ে রইলাম। আমাদের প্রচেষ্টা ছিলো, ক্যান্টনমেন্ট এবং নৌ- বাহিনীর সদর দফতর থেকে শুত্রুদের বেরোতে না দেয়া। কিন্তু ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের অধিকাংশ সৈন্য নিহত হওয়ার এবং ৮ বেঙ্গল রেজিমেন্ট শহর ত্যাগ করায় ওদিকে দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের বেরোনো সহজতর হয়ে উঠেছিল। ঘটলোও তাই। ট্যাংকের ছত্রছায়ায় ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেড়িয়ে পড়লো।

 

নৌ-বাহিনী সদর দফতরের পাকিস্তানী সৈন্যরা অবশ্য তখনো আটক অবস্থায়। সমগ্র আগ্রাবাদ রোডের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ছিল ইপিআর সৈন্যদের দখলে। হালিশহরের কাছে সুদূঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম বলে শত্রুপক্ষের একটি লোকের পক্ষেও চলাচল করা সম্ভব ছিলো না। এমনিভাবে ওদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা আমরা অনেকখানি ব্যাহত করতে পেরেছিলাম।

 

চট্টগ্রামের পাকিস্তানীদের সাহায্যার্থে বেশ কিছু সংখ্যক সৈন্য ২৬শে এবং ২৭শে মার্চ ঢাকা থেকে বিমানযোগে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে এসে পৌছায়। বিমানবন্দর থেকে পাকসেনারা আগ্রাবাদ এলাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাক সেনাদের অপর একটি গ্রুপ হালিশহর ইপিআর সদর দফতরের দিকে অগ্রসর হয়। হালিশহরে আমরা ইপিআর বাহিনী আগে থেকেই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলেছিলো।

 

কুমিরার সংঘর্ষ মারাত্মক হয়ে পড়ে। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির সৈন্যদের মনোবল এতই ভেঙ্গে পড়েছিলো। যে, তাদের পক্ষে আর সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিলো না। এই সময় হেলিকপ্টার যোগে জেনারেল মিঠঠা খান কুমিল্লায় উপস্থিত হন এবং সৈন্যদের প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে এক জঘন্য মিথ্যা ভাষণে বলেনঃ “হিন্দুদের প্ররোচনায় বাঙ্গালিরা তোমাদের অফিসার, সৈন্য এবং তাদের পরিবার পরিজনকে হত্যা করে চলছে। তোমরা তাদের রক্ষা না করলে তারা সকলেই প্রাণ হারাবে। প্রতিশোধ গ্রহনের জন্য তোমরা সামনে এগিয়ে যাও। খুনের বদলে খুন। ইসলাম এবং পাকিস্তানকে তোমরা রক্ষা কর।“ প্রতিশোধ গ্রহনের এই তীব্র হলাহল পাকিস্তানী সৈনিকদের মনে ব্যাপক জিঘাংসা সৃষ্টি করে।

 

মূল সড়ক পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব না হওয়ার ব্রিগেডিয়ার শফি পাহাড়ের ভিতর দিয়ে একটি কলামকে সেনানিবাসে ২০বালুচ রেজিমেন্টের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। অপর কলামকে উপকুল রেখা বরাবর অগ্রসর হয়ে বাধের উপর তরিত অবস্থান গ্রহণকারী আমাদের সৈন্যদের ঘিরে ফেলার নির্দেশ দেন।

 

সন্ধ্যা হয়ে আসে। মাঝে মাঝেই উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় চলছিলো। সংঘর্ষ এলাকা থেকে জনসাধারণ ক্রমশঃ দূরে সরে যেতে থাকলেও এলাকার তরুনরা আমাদের সৈনিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে খাবার এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি সরবারহ করতে থাকে। এমনকি তারা হতাহতদের নিরাপদ স্থানে সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে থাকে। সৌভাগ্যরে বিষয় ছিল তাদের অনেকেই শত্রু সৈন্যদের কাছাকাছি থেকে তাদের প্রতিটি অবস্থানের খবরাখবর আমাদের সরবরাহ করে চলছিল।

 

উপকূল বরাবর শত্রু সৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়েই আমরা আরেকটি এমবুশের আয়োজন করি। পাকিস্তানীরা আমাদের এম্বুশে পড়ে যায়। এই দ্বিতীয় এমবুশেও শত্রুসেনাদের অনেকে হতাহত হয়। ভীতু পাকিস্তানীরা তাদের মৃত সঙ্গীদের ফেলেই নানা দিকে দৌড়াতে থাকে। অনেকেই পথ ভুলে গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়লে নিরস্ত্র বিক্ষুব্ধ জনতার হাতেই প্রাণ হারায়। 

 

ইতিমধ্যে ইপিআর কোম্পানীর গোলাবারুদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসে। অপরদিকে হালিশহর সদর দফতরেও বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করার মতো গোলাগুলি আর তেমন ছিল না। এই পরিস্থিতিতে আমি কুমিরার কোম্পানিকেও পেছনে সরে শহরের উপকন্ঠে নতুন প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বললাম। স্থানটি হালিশহরে আমাদের অবস্থানের নিকটেই ছিল। আমরা তীব্রভাবে গোলাগুলি এবং নতুন সৈন্যের প্রয়োজনীয়তার অভাব অনুভব করি। অথচ সেই মুহূর্তে এগূলো সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য ছিল। এদিকে রাঙামাটি থেকে আগত ইপিআর সেনারা ক্যান্টনমেন্টের অদুরে বাধাগ্রস্থ হয় এবং রামগড় এলাকার অপর দুটি ইপিআর কোম্পানিও মূল সড়ক পথ ধরে অগ্রসর হতে পারছিল না। এ সময় আমার হাতে দুটি বিকল্প পথই খোলা ছিল। হয়, ক্যান্টনমেন্টের অস্ত্রাগার দখল করা অথবা সরবরাহের জন্য ভারতের সাথে যোগাযোগ করা অন্যসব সম্ভাবনা ব্যর্থ হলে চূড়ান্ত পন্থা হিসেবে শেষেরটিই বিবেচনা করা যায় বলে মনে করলাম। আমি প্রথম পন্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেই এবং তখনই রামগড়ের একটি কোম্পানীকে মাঠের পথ ধরে অগ্রসর হয়ে ক্যান্টনমেন্টের পেছনে অবস্থানকারী আমাদের সেনাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিলাম। অপর কোম্পানীটিকে শুভপুর সেতু এলাকায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তুলতে বললাম যাতে সড়ক পথে কুমিল্লা থেকে নতুন কোন পাক সৈন্য চট্টগ্রাম আসতে না পারে।

 

২৬শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৮টার দিকে নৌবাহিনীর যোগাযোগা ঘাঁটিতে পাক সৈন্যদের আনাগোনা লক্ষ করা গেল। রেলওয়ে পাহাড়ে আমার ট্যাকটিকাল হেড কোয়ার্টার থেকে পাশের একটি মসজিদে তাদের আনাগোনা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তিও তাদের সঙ্গে মসজিদে যোগ দেয়। এসময়ই হালকা মেশিনগান নিয়ে অবস্থানকারী আমার একজন সিপাই ট্রেঞ্চ থেকে যে মুহূর্তে মাথা তুললো অমনি একটি বুলেট তাকে আঘাত করলো। গুলিটি আসে মসজিদের দিক থেকে। সাথে সাথে শত্রুরা আমাদের অবস্থানের উপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে বিপুলভাবে গুলি চালাতে শুরু করলো। কামানের গোলা আমাদের চতুর্দিকে পড়তে থাকে। বিস্ফোরিত গোলার মারাত্মক টুকরোগুলো ভয়াবহরূপে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শত্রুদের একটি দল টাইগার পাস ঘাঁটি থেকে আক্রমণ চালায়। অবশ্য এই আক্রমণ সাথে সাথেই প্রতিহত করা হল। কিছুক্ষন পর অপরদিক থেকেও হামলা হতে থাকে। তবে দুটি হামলাই সামনের দিক থেকে আসছিল বলে তারা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। বরং পাকিস্তানিরা  প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। সামনে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়ে তারা পিছু হটে গিয়ে তাদের সুদৃঢ় ঘাঁটি থেকে আমাদের অবস্থানের উপর অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকল।

 

অনুরূপভাবে আমাদের হালিশহর অবস্থানের উপর কয়েক দফা হামলা হলো। কিন্তু প্রতিবারই শত্রু সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। ২৬শে এবং ২৭শে মার্চের মধ্যবর্তী রাতকে মনে হচ্ছিল এ রাত যেন আর পোহাবে না। গুলির শব্দে গোলার বিস্ফোরনে সমস্ত শহর কেপে কেপে উঠছিল বারংবার।

 

এ সময় আমাদের অবস্থানের পেছনেই গোলার আওয়াজ পেলাম। অন্য কোন ভাবে আমাদের অবস্থান দখল করতে না পেরে শত্রুরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। রেলওয়ে হিলে আমাদের অবস্থান শত্রুদ্বারা ঘেরাও আসন্ন হয়ে উঠলো। অথচ কোন ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র আমাদের ছিল না।

 

প্রায় দু’ঘন্টা পর কামানের গোলা বর্ষণ একটু কমে এলো। এ সময় আহত সৈনিককে আমার কমাণ্ড পোস্টে নিয়ে আসা হলো। সে ছিল বয়সে তরুন। কাদামাটি লাগা কাপড়চোপড় রক্তে ভেজা। বুলেট তার বুকে বিদ্ধ হয়েছিলো। দারুন কষ্টে নিঃশ্বাস টানতে গিয়ে আস্ফুট কন্ঠে সে জিজ্ঞাসা করলো, “কখন আমার মৃত্যু হবে?” তার দৃষ্টিতে ছিল সারা বিশ্বের আকুল জিজ্ঞাসা। এরপর সে আর কিছু বলতে পারেনি। আরও অনেকের মতোই নিভৃত যন্ত্রণায় সেও আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেল।

 

।। ঘেরাও ।।

 

ঢাকা এবং অন্যান্য স্থানে নৃশংস অভিযানের প্রাথমিক সাফল্যে উৎফুল্ল ইয়াহিয়া তার বাহিনীকে ব্যপক গণহত্যার ছাড়পত্র প্রদান করে। পাকসেনারা তাদের অভিযান এলাকাগুলোতে প্রানী বলতে যা পেয়েছে তাই নিধন করেছেএবং এসব স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে অবলীলাক্রমে। কিন্তু তবুও লোক এবং অস্ত্রবলে বলীয়ান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ প্রতিরোধ চালিয়ে গড়ে তোলে। কিন্তু এই প্রতিরোধ অব্যাহত রাখা ছিল দুঃসাধ্য, কারণ অস্ত্র চালনায় জনসাধারনের একদিকে যেমন কোন ট্রেনিং ছিল না। তেমনি তাদের অস্ত্রগুলোও ছিল পুরনো আমলের। এদিকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত আমাদের সৈনিকেরা যেখানেই সংগঠিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছেন সেখানেই শুরু হয়েছে কামান,ট্যাঙ্ক আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা শত্রুপক্ষের সম্মিলিত আক্রমণ। এই ধরনের বারংবার হামলার মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের গোলাবারুদের মজুতে টান পড়ে।

 

এই অবস্থায় রেলওয়ে হিলের অবস্থান ত্যাগ করার জরুরী প্রয়োজন দেখা দিল। তখন চারদিকেই শত্রুসেনা। ক্রমাগতএক ঘন্টার বেশি সময় ধরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর কামানগুলো আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে আমাদেরকে ব্যস্ত রাখে। এই সংকটময় অবস্থায় আমি আমার সৈন্যদের কোতোয়ালী থানা এলাকার দিকে স্বরে যেতে নির্দেশ দেই এবং সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের পেছনে সকলকে একত্র হতে বলি। গুলি বর্ষণের ছত্রছায়ায় যখন সকলেই স্থান ত্যাগ করে চলে যায় তারপরই আমি ঘাঁটি ত্যাগ করার জন্য পা বাড়াই। একজন তরুন কলেজ ছাত্রও আমার সাথে ছিল। আমরা চলছিলাম কিন্তু মুখে কোন কথা ছল না। সমস্ত সকালটি ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। বিমুড় বিষণ্ণতায় সমস্ত শহর যেন আচ্ছন্ন। রাস্তাঘাট ছিল জনমানবশুন্য, মনে হচ্ছিল মৃতের নগরী। শত শত বছর পড়ে মাটির তলা থেকে খুঁড়ে যেন নগরটিকে আবিষ্কার করা হয়েছে। দূরে বন্দরে জাহাজের মাস্তুল,ক্রেন,ওধারে অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম সবকিছুই একটির পর একটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। ভরাক্রান্ত হৃদয়ে পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই সা করে একটি বুলেট আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে আমরা নিচু হয়ে চলার গতি বাড়িয়ে দেই।

 

কদমতলী রেলক্রসিং এর কাছে নৌ-সেনাদের দুটি ট্রাক এ সময় অন্ধকারের মধ্যে অপেক্ষা করছিল। আমি নিঃশঙ্কচিত্তে সামনে এগোচ্ছিলাম। কোন দেশ কি আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না ? বহির্জগতের কোন দেশ কি জানে না বাংলাদেশে এখন কী ঘটছে ? আমাদের বেতার ঘোষণা কী তারা শুনেছে ? এমনি নানা কথার ভীড় আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কদমতলীর কাছাকাছি এসে আমরা এসব কথা ভাবতে ভাবতে যখনই রাস্তা পেরুতে গেছি তখনই দুটি গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলোয় আমার চোখ ঝলসে যায়। দুটি গাড়ি থেকেই সৈন্যরা লাফিয়ে নামতে থাকে। আমি সামনে একটি প্রাচীর দেখে সেটি পার হওয়ার জন্য দৌড় দিই শত্রু সৈন্যরাও গুলি বর্ষণ শুরু করে। একটি গুলি এসে আমার ডান হাতে থাকা এস্টেনগানে এসে লাগলে প্রচণ্ড ধাক্কায় সেটি ছিটকে পড়ে। আমি মুহূর্তে দেয়ালের উপর লাফিয়ে উঠে প্রচণ্ড বেগে ওপাশে গিয়ে পড়ি। তারপর লাফিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আবার কখনো দৌড়ে চলতে থাকি। পেছনে শুনতে থাকি নৌ-সেনাদের এলোপাথারি গুলি বর্ষণের শব্দ। তাদের দুঃখ, শিকার তাদের হাতছাড়া হয়ে গেলো।

 

 আমার বাম উরুতে তখন ভয়ানক যন্ত্রনা হচ্ছিল, ভীষণ রক্ত ঝরছিল এবং ট্রাইজারের একটি অংশ হাটু পর্যন্ত ছিলে ঝুলে ছিল। দেয়াল থেকে লাফিয়ে পড়ার সময়ই বোধহয় কিছুতে লেগে এই জখম হয়েছে। কোতোয়ালী থানায় পৌছে দেখি আমার লোকেরা সবাই সেখানে জড়ো হয়েছে। ৩’’ মর্টারগুলো তখন আমাদের জন্য বোঝা হয়ে পড়েছিল। কারণ ওগুলোর কোন শেল অবশিষ্ট ছিল না। পেট্রোলের অভাবে কয়েকটি গাড়িও আমাদের ফেলে আসতে হলো। আমি টেলিফোনে জনাব সিদ্দিকীকে মর্টারগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য কাউকে গাড়িসহ পাঠাতে বললাম এবং সৈন্যদের পূর্বপরিকল্পিত যায়গায় গিয়ে প্রস্তুত হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলাম। আমাদের আশা ছিল সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের উপর আক্রমণ চালিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রচুর গোলাগুলি উদ্ধার করতে পারবো।

 

আমাদের ভিন্ন রাস্তায় অগ্রসর হতে হলো। ক্যান্টনমেন্ট ও শহরের মধ্যবর্তী প্রধান শহরটি তখন শত্রুকবলিত। আমরা কিছু লোক গাড়িতে এবং কিছু লোক পায়ে হেটে গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হলাম। চকবাজারের কিছু সামনে শহরের উপকণ্ঠে পৌছতেই আমার একজন ইপিআর সিপাই পায়ে হেটে শহরের দিকে ফিরছে। “ওদিকে কোথায় যাচ্ছো ?” আমি চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম। বিষণ্ণ কণ্ঠে সে জবাব দিল, আপনার কাছেই স্যার। সে আরও বলল, “আপনি ক্যান্টনমেন্টের পেছনের এলাকায় গিয়ে আমাদের একত্র হতে বলেছিলেন। কিন্তু একজন অফিসার অন্যপথ দিয়ে সৈন্যদেরকে নিয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে চলে গেছে।“ আমি আবার চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন অফিসার ?”

 

“আমি তার নাম জানি না, স্যার”

 

 জনাব হান্নান এবং ডাঃ জাফরকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম মেজর জিয়াউর রাহমান আমাদের সেনাদের কালুরঘাট সেতুর দিকে নিয়ে গেছেন। আমি আওয়ামীলীগ নেতাদের অনুরোধ করলাম তারা যেন জিয়াকে বলেন আমার সৈন্যদের ছেড়ে দিতে যাতে তারা শহরে আমার সাথে যোগ দিতে পারে। তদনুসারে ডাঃ জাফর, জনাব হান্নান, নগর আওয়ামীলীগের সেক্রেটারি জনাব মান্নান,জনাব কায়সার, আরও কয়েকজন কালুরঘাটের দিকে রওনা হয়ে যান। গোমদন্ডী ষ্টেশনের কাছে তারা মেজর জিয়া, মেজর শওকত ও আরো কয়েকজন নেতার সাক্ষাত পান। আমার সাথে শহরের লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্য তারা জিয়াকে আমার সৈন্যদের ছেড়ে দিতে বলেন। মেজর জিয়া জবাব দেন যে, তার বাহিনী পুনর্গঠনের পরই তিনি আমার সংগে যোগ দেবেন। আওয়ামীলীগ নেতারা ফিরে এসে আমাকে সব কথা জানালেন। অবশ্য মেজর জিয়া এবং তার অফিসাররা শহরের লড়াইয়ে আর আসতে পারেন নি।

 

ঢাকা থেকে তখনও বিমান বোঝাই করে সৈন্য আনা হচ্ছিল। প্রধানতঃ কুমিল্লার ৫৩ ব্রিগেড থেকে এবং অন্যান্য স্থান থেকেও পাক সৈন্যরা চট্টগ্রামের পথে এগিয়ে আসছিল। শহরের উপর দিয়ে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিল। এদিকে বাংলাদেশের পতাকা বিক্রি বেড়ে গেলো বহুগুণ। সর্বত্র নীল আকাশের নিচে নতুন পতাকা উড়তে দেখা গেল। কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট থেকে শত্রুসৈন্যরা বের হয়ে সবাইকে সেগুলো নামিয়ে ফেলতে বাধ্য করতে লাগলো। যদিও প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি বাঙ্গালির হৃদয়ে গ্রথিত বাংলাদেশের পতাকার ছাপ তারা কোনদিনই মুছে ফেলতে পারে নি।

 

 ক্যান্টনমেন্টের অদূরে ইপিআর সৈন্যরা আমার কথা অনুযায়ী নতুন সৈন্যদের অপেক্ষা করছিল। আমার সৈন্যদের কালুরঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একথা তারা তখনও জানতে পারেনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে ক্যান্টনমেন্টের উপর যে হামলা পরিচালনার পরিকল্পনা আমি ইতিপূর্বে করছিলাম তা ভেস্তে গেলো।

 

এমতাবস্থায় আমি অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাব্লাম, ৬০ মাইল পথ অতক্রম করে ভারতে একবার যেতে পারলে সেখান থেকে নিশ্চয়ই অস্ত্র, গোলাগুলি এবং জরুরী জিনিসপত্র সংগ্রহ করা যাবেএবং এরপর রামগড় থেকে কিছু সৈন্য নিয়ে এসে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে পারবো। অস্ত্রের জন্য ভারতে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে আমি সীমান্ত রক্ষীদের সাথে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করে রাখার জন্য অয়্যারলেসে রামগড়ে একটি বার্তা পাঠালাম। আমার ভারত পৌঁছানোর পর আলোচনা শুরু করতে যাতে দেরী না হয় সেজন্যই আগে থেকে এ ব্যবস্থা করলাম। 

 

 

।। সরবরাহের অভাব ।।

 

       ২৮শে মার্চ ভোর নাগাদ শত্রুপক্ষ ক্যান্টনমেন্ট এবং নৌবাহিনীর ঘাটির মধ্যবর্তী প্রধান সড়কের টাইগার পাস এলাকা দখল করে নেয় এবং নগরীর কেন্দ্রস্থলে সার্কিট হাউসে তাদের সদর দফতর স্থাপন করে। কুমিরায় যে শত্রুদলটিকে আমরা প্রতিহত করেছিলাম তারাও এসে ক্যান্টনমেন্টের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। আমাদের সেখানকার সৈন্যরা সরে এসে হালিশহর প্রধান প্রতিরক্ষা ব্যূহ অবস্থান নেয়। হালিশহরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ দু’ভাবে কাজে লাগছিলো। প্রথমত, এ প্রতিরক্ষা ছিল বিমানবন্দর, নৌবাহিনীর সদর দফতর এবং পোর্ট এলাকায় শত্রুদের আসার পথে হুমকিস্বরূপ। দ্বিতীয়ত, শত্রুদের প্রধান অংশে আঘাত হানার জন্যও দৃঢ় ঘাঁটি হিসেবে এটা কাজে লাগছিলো। ইতিমধ্যে ইপিআর সৈন্যদের কালুরঘাটে আটকানো না হলে পোর্ট, বিমানবন্দর এবং নৌবাহিনীর সদর দফতর আক্রমণ এবং দখল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো এবং তাহলেই যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যেত। পোর্ট এলাকা থেকে শত্রুসৈন্যরা দিনের বেলা কয়েকবারই আগ্রাবাদ রোড পরিষ্কার করে টাইগার পাস দিয়ে নৌঘাঁটির সংগে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। কিন্তু তীব্র প্রতিরোধের মুখে প্রত্যেকবারই তাদের পিছু হটতে হয়। শত্রুরা হয়তো মরিয়া হয়ে অগ্রসর হলে সরকটি দখল করতে পারতো। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় এ ধরনের সংঘর্ষে লোকক্ষয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। লোকক্ষয় এড়ানোর জন্যই তারা সাময়িকভাবে এ প্রচেষ্টা স্থগিত রেখে কুমিল্লা থেকে অগ্রসরমান সৈন্যদের দেওয়ান হাট উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

 

দামপাড়া পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশরাও অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রু সেনাদের প্রতিরোধ করছিল। কিন্তু যুদ্ধের পুরো ট্রেনিং এবং অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা বেশিক্ষন টিকতে পারেনি। সংঘর্ষে বহু বাঙালি পুলিশ হতাহত হয়। শত্রুদের ক্রমাগত চাপের মুখে বাঙালি পুলিশদের স্থানটি পরিত্যাগ করতে হয়।

 

পরদিন ২৯শে মার্চ। সকালে শত্রুসেনারা আগ্রাবাদ রোড অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং একটি দল্কে তারা মাদারবাড়ি ও আইস ফ্যাক্টরি সড়ক হয়ে নিউ মার্কেটের দিকে পাঠিয়ে দেয়। নিউমার্কেটে অবশ্য আমাদের লোক ছিল না তবে আমি এক প্লাটুন শক্তিসম্পন্ন একটি দল্কে (প্রায় ৩০ জন) ঐ এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান কোর্ট ভবন দখলে রাখার জন্য পাঠিয়েছিলাম।

 

 শত্রুদের আরেকটি দল স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকের নৌ-ভবন থেকে বেড়িয়ে পি-আই-এ অফিসের নিকটবর্তী একটি লেনের মধ্যে দিয়ে ডিসি হিলের দিকে এগুতে থাকে। কয়েকজন পথচারী তাদের পথের মধ্যে পড়লে পাকিস্তানীরা তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর একস্থানে থেমে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় এবং দ্রুতগতিতে পাহাড়ের উপর উঠে সমস্ত এলাকাটি বিনা বাধায় দখল করে নেয়। কোর্ট বিল্ডিঙে তখন আমাদের সৈন্যরা পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য অপেক্ষমান। তারা গভীরভাবে সাহায্যের প্রত্যাশা করছিল। এবং সাহায্য করলেই যে কোন মুল্যে তারা শত্রুদের প্রতিরোধ করতে পারতো।

 

 ওইদিন বিকালে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি জাকির হোসেন রোডে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানর জন্য মেডিকেল কলেজে ফোন করে। এ পর্যন্ত মেডিকেল কলেজ আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। কলেজের নিকটেই গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রবর্তক হিলে আমাদের কিছু সৈনিক মোতায়েন ছিল। আমাদের আহত সৈনিকদের নিয়ে মেডিকেল কলেজের ডাক্তার, নার্স, ছাত্রছাত্রীরা সকলেই দিনরাত ব্যস্ত ছিল।

 

 পূর্ব কথিত এ্যাম্বুলেন্সটি ফিরে আসতেই ডাক্তার এবং নার্সরা দ্রুত বেড়িয়ে আসেন। কিন্তু এ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলতেই বেড়িয়ে আসে একদল শত্রু সৈন্য, হাতে তাদে উদ্যত হাতিয়ার। ক্ষিপ্ততার সাথে তারা হাসপাতাল ভবনের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহন করে। সন্ধ্যা নাগাদ আরও একদল সৈন্য এসে অবস্থানরত সৈন্যদের সাথে যোগ দেয়। কর্মচঞ্চল হাসপাতাল ভবন এবং তার পার্শ্ববর্তী আবাসিক এলাকায় নেমে আসে এক বিষণ্ণ নীরবতা।

 

হালিশহর এবং কোর্ট ভবন এ দুটি স্থানে তখনও আমাদের সুদৃঢ় ঘাটি ছিল। তাছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে আমাদের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন দলগুলো তখনও শত্রুসেনাদের মোকাবিলা করছিল। কিন্তু শেষে কুমিল্লা থেকে নতুন শত্রুদল দেওয়ানহাট ক্রসিঙের কাছে পৌছে গেলে আগ্রাবাদ এলাকা থীকে আমাদের সৈন্যদের হালিশহর ঘাঁটিতে সরে আসা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। শহরের অর্ধেক জনসংখ্যা ততক্ষনে গ্রামের দিকে চলে গেছে। অনেকে সরাসরি সীমান্তের দিকেও চলে যায়। সকলেই কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়ে। জনসাধারণ ঠিকই ভেবেছিল যে, কোনরূপ সাহায্য ছাড়া যুদ্ধে জয়লাভ করা আমাদের পক্ষে দেরী হবে। কারণ ইতিমধ্যেই তারা দেখছে আমাদের সৈন্যরা ভীষণ অসহায় অবস্থার মধ্যে যুদ্ধ করছিল। আমাদের গোলাগুলির সরবরাহ ছিল খুবই কম। একজন সৈনিকের হাতের অস্ত্র অকেজো হয়ে গেলে তাকে নতুন অস্ত্র না দেয়া পর্যন্ত সেই সৈনিকটিই অকেজো হয়ে পড়ে। কেউ আহত হলেও তার প্রাথমিক চিকিৎসা কিংবা তাকে অন্যত্র স্থানান্তরের কোন ব্যবস্থা আমাদের ছিল না। এমনকি একপর্যায়ে প্রয়োজনীয় পানি ও খাদ্য সরবরাহেরও কেউ ছিল না। আমার ট্যাক্টিকাল হেডকোয়ার্টারে ওয়্যারলেস কিংবা আধুনিক কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা পরযাপ্ত না থাকায় বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধরত সৈনিকদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে পারিনি। ফলে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত হওয়া এবং সে অনুসারে নতুন নির্দেশ দেওয়াও সম্ভব হয়নি। এছাড়া যাতায়াতের জন্য যানবাহনের সমসসাও ছিল প্রকট। আমরা যোগাযোগ এবং পরিবহনের অভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি বেশি। কুমিরায় আমাদের অবস্থান বিপন্ন হওয়ার সংবাদ একজন সংবাদ বাহকের মারফত তিন ঘন্টা পর পাই। সংবাদ পাওয়ার আধ ঘন্টার মধ্যেই আমি নতুন কিছু সৈন্য কুমিরার উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কুমিরার দুই মাইল দূরে পৌছানোর পূর্বেই কুমিরার পতন ঘটে। আমাদের সৈন্যরা ততক্ষনে হালিশহরের দিকে ফিরে আসতে থাকে। আরেকটি সংকট ছিল ট্রেনিংপ্রাপ্ত শত্রুসৈন্যদের সাথে যখন অব্যাহতভাবে নতুন নতুন সৈন্য এবং অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ যোগ হচ্ছিলো, আমি তখন অসহায়ভাবে তা দেখছিলাম। একইভাবে দল বেধে আমাদের সামরিক লোকজনও শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো।

 

আমি যে কয়জন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করছিলাম তার সঙ্গে একজনও নতুন সৈনিক কিংবা একটিমাত্র বুলেটও যোগ করতে পারিনি। ক্রমাগত শত্রুসৈন্যরা মোকাবিলা করে আমাদের ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। অনেকেই ২৫ তারিখের রাত থেকে এখন পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও চোখ বন্ধ করতে পারেনি। আমার রেলওয়ে ঘাঁটি  সার্কিট হাউস এলাকা, মেডিকেল কলেজ, ডিসি হিল এবং হালিশহর কোট বিল্ডিঙ্গের যুদ্ধে আমি নতুন সৈন্য ও অস্ত্র সরবারহ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় হতাশ হয়েছি বারবার। আর এই প্রত্যাশা যুদ্ধের সেই পর্যায়ে আমার সৈন্যদের অবসাদগ্রস্ত করে তোলে সাময়িকভাবে।

 

।। চট্টগ্রাম শহরে চূড়ান্ত লড়াই ।।

 

       ৩০শে মার্চ। শহরে তখন কারফিউ চলছে। খুব ভোরে একজন ভদ্রলোক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে অস্থিরভাবে অনবরত টেলিফোন করছিলেন। একটু আগে জানালা দিয়ে তিনি নারকীয় দৃশ্য দেখেছেন। একটি গাক্সহের উপর বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। কয়েকজন পাকসেনা কিশোর বয়সের একটি ছেলেকে সেই পতাকা নামিয়ে ফেলতে বলে। ছেলেটি অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাছ বেয়ে উপরে উঠে এবং পতাকাটি আস্তে আস্তে ভাজ করতে থাকে। ঠিক এ সময়ে নিচ থেকে সৈন্যরা সুস্থ মস্তিষ্কে তার দিকে রাইফেল তাক করে গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ ছেলেটি বৃন্তচ্যুত ফুলের মতো নিচে পড়ে যায়। সৈন্যরা হো হো করে হেসে ওঠে এবং সে স্থান ত্যাগ করে।

 

কোন এ্যাম্বুলেন্স কিংবা অন্য কেউ কিশোরটির সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। হাসপাতালের সবকটি গাড়িই পাকিস্তানী সৈন্যদের বহন করছিল। বস্তুত পুরো হাসপাতালটিই মিলিটারি ক্যাম্পে পরিনত হয়েছে। বাঙালি ডাক্তার, নার্স এবং অধিকাংশ রোগীই ইতিমধ্যে হাপাতাল ত্যাগ করেছে। আর রক্তপিপাসু দানব্দের হাত থেকে বাচতে যারা একেবারেই অসমর্থ তারা অসহায়ভাবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

 

প্রতিদিনের ব্যস্ত বিপণী কেন্দ্র নিউমার্কেট সেকিন একেবারে চুপচাপ। দুপুরের মধ্যে পাকসেনারা পোর্টের দিক থেকে বরফকল সড়ক হয়ে এখানে পৌছে যায় এবং সদরঘাট, রেলওয়ে ষ্টেশন এবং স্টেডিয়ামের দিকে তারা অগ্রসর হতে থাকে। ছোট একটি দল কোর্ট হিলের দিকেও পা বাড়ায়। কিন্তু হিলে অবস্থানরত আমাদের সৈনিকদের বুলেট বৃষ্টিতে পাকিস্তানীদের পিছু হটে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয়।

 

একই দিনে হালিশহরেও সকাল ৮টা থেকে সংঘর্ষ চলতে থাকে। পাকিস্তানীরা মরিয়া হয়ে কামান দেগে চলছিল। নৌবাহিনীর সবগুলি কামানই তখন সক্রিয় ছিল। ক্রমাগত ৬ ঘন্টা যাবত তারা হালিশহরের উপর গোলাবর্ষণ করে। কামানের ছত্রছায়ায় শত্রুরা হালিশহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইপিআর সেনাদের পাল্টা আক্রমণের মুখে অগ্রগতি লাভে ব্যর্থ হয়ে শত্রুরা বিমান বাহিনীর সাহায্য প্রার্থনা করে। আধ ঘন্টার মধ্যে দুটি বিমান চলে আসে। এবং বেলা সাড়ে বারোটা থেকে আমাদের অবস্থানের উপর ক্রমাগত বিমান হামলা চলতে থাকে। আমাদের কোন বিমান বিধ্বংসী হাতিয়ার ছিল না। সেই সময় নিজেদেররও কোন বিমান থাকার কথা নয়। তাই শত্রু বিমানগুলো আকাশে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে নির্ভিগ্নে আমাদের উপর বোমাবর্ষণ করতে থাকে। তারা তাদের ইচ্ছা মতো রনাঙ্গনের উপর আঘাত হানতে থাকলো। পরিস্কার রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে তারা একটার পর একটা ট্রেঞ্চ দেখে দেখে স্ট্যাম্পিং করে চলছিল। আমাদের বীর সেনানিরাও প্রাণপণে ঘাটি আঁকড়ে লড়াই করতে থাকল। লড়াই করতে করতে অনেকেই ট্রেঞ্চের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করল। আহতও হল অনেক। কিন্তু অবিরাম বোমা বর্ষণের ফলে তাদের অপসারণ করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। যুদ্ধরত বাকী সৈন্যরাও বুঝতে পারল তাদের আর বেশিক্ষন হালিশহর রক্ষা করা সম্ভব হবে না। গোলাগুলির মজুতও নিঃশেষ প্রায়। তারা রাইফেলের উপরে বেয়নেট লাগিয়ে নিচের শত্রুদের সাথে হাতাহাতি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হল।

 

বিকালের মধ্যে শত্রুরা হালিশহর দখল করে নিল। হাতাহাতি যুদ্ধ চলল আধঘন্টার মতো। শত্রুসৈন্য সংখ্যাধিক্যের ফলে চূড়ান্ত ফলাফল কি হয়েছিল তা বোঝা গিয়েছিল। আমাদের সৈন্যরা পেছনে এসে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের এক স্থানে অবস্থান গ্রহন করলো সহযোগীদের লাশও ফেলে আসতে হলো।

 

হালিশহর পতনের পর শত্রুদের পুরো দৃষ্টি পড়লো কোর্ট হিলের উপর। এটাই ছিল শহরে আমাদের সর্বশেষ ঘাটি, সর্বশেষ আশা। বিভিন্ন দিক থেকে অবস্থানটির উপর কয়েকবারই হামলা হল। কিন্তু প্রতিবারই আমাদের সৈন্যরা তা প্রতিহত করে! এরপর এল ট্যাংক বহর। অগ্রবর্তী ট্যাংকটি পাকা রাস্তা বেয়ে উপরের দিকে উঠতেই আমাদের সৈন্যদের ট্যাংক বিধ্বংসী শেলের আঘাতে তা অকেজো হয়ে পড়লো। ট্যাংকটি অকেজো হয়ে থেমে পড়লে পেছনে অন্যান্য ট্যাংক এবং পদাতিক সৈন্যরা কিছুটা থমকে দাঁড়ালো। এ সময় সম্ভবত আমাদের শক্তির পরিমাপ করছিল। ইতিমধ্যে অবশ্য শত্রুপক্ষ আমাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছিল। আমাদের সৈনিকদের তখন গোলাবারুদ নিঃশেষ প্রায়। এবং বাইরের সাথে সকল সংযোগও প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। অদূর ভবিষ্যতে নতুন করে কোন সাহায্য লাভের সম্ভাবনা ছিল না।

 

২রা এপ্রিল ভোরে শত্রুরা আবার হামলা শুরু করলো। হামলা ছিল সুপরিকল্পিত। মাত্র ৩০জন সৈনিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল পাকিস্তানিদের পুরো একটি ব্যাটেলিয়ন। দুটি কোম্পানি মিলে প্রথম আঘাত হানলে তা সাফল্যের সাথে প্রতিহত করা হয়। এরপর আরও জোরদার হামলা চলতে থাকে। দুটি সংরক্ষিত কোম্পানি এবার অন্য দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। মারাত্মক গুলিবর্ষণের ছত্রছায়ায় এরা একটু একটু করে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকে। এদিকে আমাদের প্রতিরোধকারী সৈন্যদের গোলাগুলি নিঃশেষ হয়ে যায়। একমাত্র ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রটিও অকেজো হয়ে পড়ে। পদাতিক বাহিনীর আগে আগে এ সময় দিটি ট্যাংক উপএ উঠে আসে। বলতে গেলে অলৌকিকভাবে সেদিন আমাদের সৈনিকদের প্রায় সবাই সে স্থান ত্যাগ করে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবেই কোর্টহিলের পতন ঘটল এবং সাথে সাথে অনির্দিষ্ট কালের জন্য চট্টগ্রাম নগরীও আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। তখন সময় ছিল বেলা সাড়ে ১২টা। মাত্র ৩০জন ইপিআর এর দুর্জয় সৈনিক শত্রুপক্ষের এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য শক্তির অব্যাহত শেলিং এবং উপর্যুপরি আক্রমণের মুখে ৩ দিনেরও বেশি তাদের অবস্থান আগলে রেখেছিল। কাজেই এই পরাজয় তাদের অদম্য সাহস ও বিক্রমের মহিমাকে ম্লান করে দিতে পারে না।

 

।। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ।।

 

       এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই আমি অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের উদ্দেস্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য রামগড় যাই। সেখান থেকে সাবরুম গেলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) অফিসাররা আমার সাথে কথা বলেন এবং অবিলম্বে আগরতলা নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। প্রয়োজনবোধে ভারতীয় রাজধানীতে যাওয়ার ব্যবস্থাও তারা করে রাখেন।

 

২রা এপ্রিল আমি আগরতলা পৌছালে সরাসরি আমাকে সরাসরি বিএসএফ এর সিনিয়র অফিসার মিঃ কালিয়ার অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। আমি তার কাছে আমাদের লড়াইয়ের অবস্থা বর্ণনা করে সামরিক সাহায্যের অনুরোধ জানালাম। মিঃ কালিয়া অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে কেন্দ্রীও সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন বিধায় আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কোন গত্যন্তর ছিল না। আমাকে আগরতলার এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হল এবং সেখানেই এক কক্ষে আমি সারাদিন রইলাম। সেখানে সাদা পোশাক পরিহিত কয়েকজন ভারতীয় অফিসার পর্যায়ক্রমে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তারা আমার কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান,তাদের শক্তি, কোন ধরনের অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করলেন। তারা আমার অতীত জীবন এবং কী কারনে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলাম সে বিষয়েও প্রশ্ন করলেন, ঘটনাবলী সম্পর্কে আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, পাকবাহিনীর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং স্বাধীনতা অর্জনে আমরা কি কি উদ্যোগ নিয়েছি তাও জানতে চাইলেন।

 

এদের সঙ্গে আমার আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আন্তরিকতার সাথে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারা খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। তবে এদের আলোচনার ধারা থেকে আমরা বুঝতে পারি, এরা সকলেই ভারতীয় সমরিক বাহিনী ও বিএসএফ-এর গোয়েন্দা বিভাগের লোক। পরেরদিন নেতৃস্থানীয় ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হল। বিকআলের দিকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচিন সিং এর সাথে আমি বৈঠকে মিলিত হলাম। তার আচরণও ছিল বন্ধুসুলভ। তার কাছেও আমি অস্ত্রশস্ত্র এবং কিছু জরুরী জিনিসপত্রের জন্য অনুরোধ জানাই।

 

মুখ্যমন্ত্রী আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, দিল্লী থেকে জবাব এলেই তিনি আমার জন্য কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এ সময় দরকার হলে আমাকে দিল্লী যাবার জন্যও প্রস্তুত থাকতে বলা হলো।

 

পরদিন চট্টগ্রাম জেলার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা আগরতলা পৌছলেন। তাদের নিয়ে পুনরায় আমি শ্রী শচিন সিং এর সাথে দেখা করলাম। তিনি আমাকে জানালেন যে, ৯২তম বিএসএফ ব্যাটেলিয়ন থেকে জরুরী ভিত্তিতে আমি কিছু অস্ত্রশস্ত্র পেতে পারি। আমার অন্যান্য জিনিসপত্রের চাহিদা সম্পর্কেও তাকে অবহিত করতে বললেন। আমি তার কামরার এক কোনায় বসে প্রায় ১০ মিনিটের মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের একটি তালিকা প্রস্তুত করে ফেলি। আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে সেটি তুলে দিয়ে আমি তখনই চট্টোগ্রামের পথে আগরতলা ত্যাগ করলাম। পথে ৯২তম বিএসএফ এর কমান্ডীং অফিসার কর্নেল ঘোষের সাথে আলোচনা করলাম। তিনি ততক্ষনে আমাকে কয়েকটী লাইন মেশিনগান, রাইফেল, হ্যাণ্ডগ্রেনেড ও কিছু গোলাবারুদ সরবরাহ করার জন্য তার ব্যাটেলিয়ন কে নির্দেশ দিয়ে ফেলেছেন এবং সেগুলো ইতোমধ্যেই সাবরুম থানায় পৌঁছে গিয়েছিল। জিনিসগুলো আমাকে দেয়ার জন্য ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে বিএসএফ এর ক্যাপ্টেন মেহেক সিং কে আমার সঙ্গেই পাঠানো হয়।

 

চট্টগ্রাম শহরের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানীরা গ্রামাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানিদের একটি কলাম হাঠাজারি, ফটিকছড়ি, নারায়নহাট এবং হিয়াকু হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হয়। অপরদিকে রাঙ্গামাটি,কাপ্তাই এবং কক্সবাজারের দিকেও একটি করে কলাম অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় আমরা গ্রামাঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রন বলবত রাখার সিদ্ধান্ত নেই। এ উদ্দেশ্য সাধন কেবল শত্রুসৈন্যদের শহরাঞ্চলে কোণঠাসা করে রাখার মাধ্যমেই সম্ভব ছিল। এভাবে সুসংগঠিত গোরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে শত্রুর শক্তিক্ষয় করে তাদের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানাই হবে সঠিক পদক্ষেপ। এটা আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিল যে, এই সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আমাদের হারাতে হবে অসংখ্য জীবন। আমাদের সামনে যুদ্ধের প্রস্তুতি ব্যতিত অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থাছিল না। এ জন্য অবশ্য জনসাধারণকেও সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

 

রামগড় থেকে দুটি ইপিআর প্লাটুনকে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৬ মাইল দূরে ভাটিয়ারি এবং ফৌজদারহাটের মধ্যে প্রতিরক্ষা মুলক অবস্থান গ্রহনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। অন্য দুটি ইপিআর প্লাটুনকে ফটিকছড়ি হাঠাজারি হয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে সহযোদ্ধাদের সাহায্যে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন হারুন এবং আরও কয়েকজন অফিসার ৬টি কোম্পানি নিয়ে কালুরঘাট সেতুর নিকটেই প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছিল। ঠিক এ পর্যায়ে চৌঠা এপ্রিল আমরা ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রথম সংগ্রহ পাই। যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্ন এ সময় আমার পুরো বাহিনীকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। সসস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের গুরুত্তহিন স্থান থেকে সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ফ্রন্টগুলোতে পাঠানো হল। ক্যাপ্টেন মতিন এবং লেফটেন্যান্ট এজাজের নেতৃত্বে এরুপ দুটি কোম্পানি ভারতীয় এলাকা দিয়ে শতাধিক মাইল দূরে চট্টগ্রাম সেক্টরকে শক্তিশালী করার জন্য সেখানে পৌছে। আমার দলের শক্তি ববৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ এদের একটি কোম্পানি ভাটিয়ারি অভিমুখে রওনা হয়। এবং অন্য একটি কোম্পানিকে নিয়ে আমি হিয়াকু,ফটিকছড়ি হয়ে পুনরায় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হই। এটা ছিল এক কষ্টসাধ্য অভিযাত্রা। রাস্তা ছিল অত্যন্ত খারাপ। যান্ত্রিক কনভয় বলতে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের কয়েকখানি জিপ, আর এই জিপ গুলোকে প্রায় অর্ধেক পথই আমাদের ঠেলে নিয়ে যেতে হচ্ছিল। আমাদের এ চলাচলের গোপন খবর রাখার উপায় ছিল না। কারণ, যেমনি দিনের বেলায় আমাদের চলতে হচ্ছিলো। তেমনি আবার ভারতের পথে পলায়নপর ভিতসন্ত্রস্ত অসংখ্য জনসাধারণ একই পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল। যদিও আমরা সবাই বেসামরিক পোশাকে ছিলাম। এবং অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলাম। তথাপি শত্রুকবলিত একটি শহরের দিকে কিছুসংখ্যক লোকের সুসংগঠিত হয়ে চলার ভাব দেখে আশংকা ও হতাশায় নিমজ্জিত লোকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়। আত্মতুষ্টি লাভের জন্য তারা মুক্তিযোদ্ধার সঠিক  সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুন বাড়িয়ে শহরের দিকে তাদের যাত্রার কথা যেভাবে বলাবলি করছিল সে খবর দ্রুত শত্রু ঘাঁটিতে পৌছে যায়।

 

নারায়ণহাটে পৌছে আমরা সন্ধ্যার পরবর্তী যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। রাতের সামান্য আহার গ্রহন করি। নারায়নহাট থেকে আমাদের মুক্তিসেনাদের নাজিরহাট পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য কয়েকটি নৌকার বেবস্থা করা হয়। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল অন্যদিকে নৌকাগুলোরও কোন ছৈ ছিল না। ক্লান্তিতে অবসাদে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিছুক্ষন পর মুষল ধারায় বৃষ্টি নেমে আসে। আমরা বৃষ্টিতে ভিজে উন্মুক্ত আকাশের নিচে শীতে কাপতে থাকি। নাজিরহাট পৌছাতে ভোর হয়ে গেল। এখানেই খবর পেলাম ক্যান্টনমেন্টের নিকট আমাদের যে সানাদল ছিল শত্রুর আক্রমনে তা পিছু হটে হাটহাজারীর দিকে চলে গেছে। নাজিরহাট পৌছেই আমাদের জন্য একটি সম্ভাব্য ঘাটি খুজে বের করার উদ্দেশ্যে দ্রুত পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করি। খোজাখুজির পর কয়েক মাইল দূরে উদালিয়া চা বাগানই উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে দিকে রওয়ানা দিলাম। বাগানের ম্যানেজার আন্তরিকতার সাথে আমাদের স্বাগত জানালেন। সকল প্রকার সাহায্যের তিনি ব্যবস্থা করেছিলেন।

 

সীতাকুণ্ড পাহাড় শ্রেণীর একটি বিচ্ছিন্ন ছোট পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে উদালিয়া চা বাগান। সৈন্যদের এখানে ছোট ছোট দলে ভাগ করে। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, খাবারের ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কাজের ভার দেয়া হল। একশন গ্রুপকেও সদা প্রস্তুত রাখা হলো, যাতে তারা স্বল্পকালীন সময়ে শত্রুর মোকাবিলায় দ্রুত রওয়ানা হতে পারে। প্রয়োজনবোধে বিকল্প ঘাঁটি স্থাপনের স্থানটিও দেখে রাখা হল। রক্ষাবুহ্য নির্মাণের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হলে এ স্থানের দায়িত্ব লেফটেন্যান্ট এজাজের উপর ন্যাস্ত করে আমি কালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হই।

 

কালুরঘাটের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে অধিকাংশই ইপিআর সৈনিক। প্রাথমিক পর্যায়েই আমি যখন চট্টগ্রাম শহরে পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম। তখনই আমার সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য চট্টগ্রামের সীমান্ত ফাঁড়িগুলো থেকে ইপিআর সৈনিকদের অগ্রযাত্রা মেজর জিয়া থামিয়ে দেন। ইপিআর সৈনিকদের তিনি কালুরঘাটে রেখে দিয়েছিলেন। ৮ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইস্ত বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কিছু সৈন্যকেও এখানে রেখে দেয়া হয়। সব মিলিয়ে কালুরঘাটে তখন ৬টি কোম্পানি ছিল যার সৈন্য শক্তি ছিল প্রায় এক হাজার।

 

  আমি যখন চট্টগ্রাম শহর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নতুন লোকবল ও অস্ত্রবলের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছিলাম তখন আমারই নির্দেশে আগত ইপিআর সেনাদের কালুরঘাটে আটকে রাখা হয়। আমাদের সৈন্যদের কালুরঘাটে না থামিয়ে আমার সঙ্গে শহরের যুদ্ধে যোগ দিতে দেয়া হলে আমরা সাফল্যের সাথে নৌবাহিনীর সদর দফতর, বিমান বন্দর এবং ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারতাম। এর ফলে পাকিস্তানীরা আর নতুন সৈন্য আনতে পারতো না এবং আমরাও সেখানে তাদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে পারতাম। সে ক্ষেত্রে আমাদের যুদ্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্নতর।

 

কী কারনে জানি না, কালুরঘাট যুদ্ধ হয়েছিল দু সপ্তাহ পরে এবং এই দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আমাদের এখানকার সৈন্যরা কোন কাজেই লাগে নি। আমাদের তরুণ অফিসাররা দুর্জয় মনোবল এবং অদম্য সাহসে সঙ্গে এখানে লড়াই করলেও সৈন্যরা কিন্তু যোগ্য সিনিয়র অফিসারের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছিল। অবশ্য আমাদের সিনিয়র অফিসারদের সংখ্যাও তখন খুব বেশি ছিল না। এদের মধ্যে আবার মেজর শওকত কক্সবাজার চলে গিয়েছিলেন। ভূল খবরের ভিত্তিতেই এটা হয়েছিল। তারপর তিনি নিজেই কক্সবাজার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে কালুরঘাটে আমাদের সৈন্যদের সাথে যোগ দেন।

 

এখানে আমাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র তেমন ছিল না। ৩০৩ রাইফেল ছাড়া আর ছিল কয়েকটি হালকা মেশিনগান এবং দুটি ৩’’ মর্টার। ইপিআর মর্টার জেসিও ৩’’ মর্টার দিয়েই অবিশ্বাস্য কাজ করেছিলেন। মাত্র কয়েক রাউণ্ড মর্টার শেল দিয়েই তিনি শত্রুসৈন্যদের একাধিক যায়গায় ব্যস্ত রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি একাই দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন জায়গা থেকে মর্টার দাগতে থাকলে আমাদের মর্টারের সংখ্যা ঠিক কতো পাকিস্তানীরা তা অনুমান করতে ব্যর্থ হয়। আমাদের প্রতিরোধের দুর্জয়তায় শত্রুরা বরাবরই পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং পরিশেষে প্রায় দু  সপ্তাহ পর ১১ই এপ্রিল কালুরঘাটের যুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ নেয়। কালুরঘাট সংঘর্ষে আমরা কেবল সইনিকই হারাই নাই, দু জন অফিসারও সেই সংকটকালে আহত হয়েছিল। ক্যাপ্টেন হারুন গুরতর অবস্থায় বার্মায় আশ্রয় নিলেন, আর লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন গুরতর আহত অবস্থায় পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হলেন।

 

কালুরঘাট অবস্থান পরিদর্শনের পর আমি আবার রামগড় হয়ে কুমিরার দিকে অগ্রসর হই। কুমিরার সৈন্যদের জন্য আরো কিছু অস্ত্রশস্ত্র লাভের উদ্দেশ্যে রামগড়ে আমাকে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। রামগড়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে আবার দেখা হলে তাকে আমি কালুরঘাট অবস্থানের অসারতার কথা বলি। তারপর কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সোজা কুমিরার পথে রওনা হই। কুমিরায় তখনও আমাদের সৈন্যরা শত্রুর সাথে মরণপণ লড়ে যাচ্ছিলো।

 

।। প্রথম বাংলাদেশ সরকার ।।

 

৪ঠা এপ্রিল চট্রগ্রাম শহরের পতন ঘটলে পাকিস্তানীরা ক্রমান্বয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১০ই এপ্রিলের মধ্যে সেতুর নিকট তারা তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তোলে। এই সময় শত্রুরা ছিলো আক্রমণমুখী এবং আমাদের ভুমিকা ছিলো আত্মরক্ষামূলক। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকতে থাকতে আমাদের সৈন্যরা উদ্যম হারিয়ে ফেলেছিল।

 

১১ই এপ্রিল সকাল আটটায় শত্রুপক্ষের গোলন্দাজ বাহিনী কালুরঘাট অবস্থানের উপর আক্রমণ শুরু করে। নৌবাহিনীর কামানগুলো থেকেও গোলাবর্ষণ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন হারুন ও লেফটেন্যান্ট শমসের সেতুর পশ্চিম পার্শ্বে (শহরের দিকে) অগ্রবর্তী দলের নেতৃত্বে ছিলেন। আমাদের প্রধান অবস্থান ছিলো সেতুর পূর্ব পার্শ্বে।

 

কিছুক্ষণের মধ্যে শত্রুদের গোলাবর্ষণ তীব্রতর হয়ে ওঠে। এই গোলাবর্ষণের ছত্রছায়ায় পাকিস্তানীরা সম্মূখযুদ্ধেও প্রস্তুতি নিয়ে সেতুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ট্রেঞ্চ থেকে হারুন শত্রুপক্ষের অস্বাভাবিক তৎপরতা লক্ষ্য করে শমসেরকে বললো তোমার বাইনোকুলারটা দাও তো, ওদের অবস্থানটা দেখি। কথা শেষ না হতেই হারুন তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলো। তীব্র যন্ত্রণায় হারুন কুকড়ে যাচ্ছিলো। লাইট মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি তাকে বিদ্ধ করেছে। দুজন ছাত্র তাড়াতাড়ি হারুনকে ধরে সেতুর গোড়ায় নিয়ে এলে সে নিজেই প্রায় দৌড়ে সেতু পার হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে যায়। তাকে একটি মাইক্রোবাসে পটয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর অল্পক্ষণ পরেই শমসেরের হাটুতে গুলি লাগলে সেও অচল হয়ে পড়ে। তখন তার প্রায় চারপাশে লড়াই চলছিলো। শমসের শত্রুদের হাতে বন্দী হয়। দুজন অফিসারকে হারিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। তারা ঘাঁটি ত্যাগ করে পিছনে হাটতে শুরু করে। সেদিন বিকাল নাগাদ কালুরঘাটে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং আমাদের সৈন্যরা পার্বত্য চট্রগ্রামের পথ ধরে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

 

পথে মহালছড়িতে হঠাৎ পাক বাহিনীর কমান্ডো কোম্পানীর সাথে তাদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পাক বাহিনীর সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী মিজোরাও ছিলো। পাকিস্তান সরকার এইসব মিজোদের আশ্রয় এবং ট্রেনিং দিয়ে ভারতের বিরূদ্ধে বিদ্রোহাত্মক তৎপরতায় সহায়তা করতো।

 

উদালিয়া চা বাগানে আমাদের যে কোম্পানী ঘাঁটি স্থাপন করেছিলো পাকিস্তানীদের তীব্র আক্রমণে তাদের সে এলাকা পরিত্যাগ করতে হয়। ওদিকে চট্রগ্রাম ঢাকা মহাসড়কের কুমিরায় তখন প্রচণ্ড লড়াই চলছিলো। চট্টগ্রামের দিকে শত্রুদের অগ্রাভিযান প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের যে সৈন্যরা সেখানে অবস্থান গ্রহণ করেছিলো, শত্রুবাহিনী পর্যবেক্ষণ বিমানের সহায়তায় তাদের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। গোলাবর্ষণে আমাদের পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আরো রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য আমাদের সৈন্যরা সীতাকুণ্ডতে সরে আসে। শত্র সৈন্যর আগমন বিলম্বিত করার উদ্দেশ্যেই সেখানে আমাদের অল্প কয়েকজন সৈন্য থেকে যায় এবং এই অবসরে বাঙালি সৈন্যরা তাদের সীতাকুণ্ড ঘাঁটি সুদৃঢ় করে গড়ে তোলে। কিন্তু ১৬ই এপ্রিলের মধ্যে শত্রুরা আমাদের সীতাকুণ্ড অবস্থানের উপর আঘাত হানে। তারা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় কয়েক দফা হামলা চালায়। নৌবাহিনীর কামানগুলো তখন ব্যাপকভাবে গোলাবর্ষণ করছিলো। তবুও আমাদের সেনারা পাল্টা আঘাত হেনে শত্রুপক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে।

 

বাংলাদেশের প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখন লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময়ে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় আমবাগানে বাঙালির জীবনে এক অনন্য সাধারণ ঘটনা ঘটে যায়। দিনটি ছিলো এপ্রিলের ১৭ তারিখ। ঐদিন সকাল আনুমানিক ৮টায় জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্ণেল এমএজি ওসমানী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা বৈদ্যনাথ তলায় এসে পৌঁছান। নেতৃবর্গের বসার জন্য পাশের গ্রামগুলো থেকে কিছুসংখ্যক চেয়ার জোগাড় করা হলো। সেসব চেয়ারের অধিকাংশের হাতল ছিলো না। বেলা এগারোটার মধ্যে অন্যান্য নেতারা পৌঁছে গেলেন। পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন এবং জনা পঞ্চাশেক বিদেশী সাংবাদিকও সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা আম্রকাননে উপস্থিত হলেন। এদের সামনেই সেদিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। শেখ মুজিবের নামানুসারে এ জায়গার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম হন উপ-রাষ্ট্রপতি এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাক সামরিক জান্তার কারাগারে বন্দী। ইপিআরের একটি প্লাটুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।

 

এদিকে ১৮ই শত্রু বাহিনী আমাদের সীতাকুণ্ড অবস্থান ছত্রভঙ্গ করে দিলে এখান থেকে আমাদের সৈন্যদের মীরেশ্বরাইতে পশ্চাদপসরণ করতে হলো। আমরা জানতাম মীরেশ্বরাইতেও আমরা অল্প কিছুদিনের জন্য থাকতে পারবো, তারপর আবার সরে যেতে হবে। এই দুঃখজনক অবস্থা কতদিন চলবে তা কারো জানা ছিলো না। সৈন্যরাও ক্রমে আস্থা হারিয়ে ফেলছিলো। কোনো রকম অবস্থান প্রতিরক্ষায় নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে নিজেরাই সন্দিহান হয়ে উঠছিলো। লোকবল ও বিপুল অস্ত্রবলের সাহায্যে শত্রুপক্ষ প্রতিটি যুদ্ধেই ইচ্ছামতো ফলাফল নির্ধারণ করে চলছিলো। এই সংকটময় দিনগুলোতে আমাদের সবচাইতে বেশী দরকার ছিলো কিছু ভালো অস্ত্রের। চিরাচরিত পন্থায় যুদ্ধ হচ্ছিলো। অস্ত্রবল বৃদ্ধি করতে না পারলে আমাদের জয়ের কোনো আশাই ছিলো না। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের বাংলাদেশ বাহিনীর কলকাতাস্থ সদর দফতরটি ছিলো রণাঙ্গণ থেকে বহুদূরে। সম্ভবতঃ এই দূরত্বের কারণেই যুদ্ধের পরিস্থিতি ও আমাদের চাহিদা সম্পর্কে সদর দফতর কিছুটা উদাসীন ছিলেন। একদিকে আমাদের সামরিক দফতর থেকে বলা হতো, “যেভাবেই হোক ঘাঁটি দখলে রাখার জন্য দৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করো।” আবার উন্নত ধরণের অস্ত্রশস্ত্র চাইলে জবাব পেতাম, ‘এটা তো গেরিলা যুদ্ধ, ভারী অস্ত্রের তেমন প্রয়োজন নেই।’ ওই জবাব গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কিত বই পড়া জবাব না ভারতের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহে সরকারের অক্ষমতা তা আমরা জানতাম না। গেরিলা যুদ্ধে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন নেই, এই উক্তিটি যে কত অসার তা সে সময়ে পৃথিবীর অন্যান্য যেসব দেশে গেরিলা যুদ্ধ চলছিলো সেসব যুদ্ধ পর্যালোচনা করলেই বুঝা যায়। তাছাড়া আমরা শুধু গেরিলা যুদ্ধ করছিলাম না। সাথে সাথে প্রচলিত ধারার লড়াইও আমাদের করতে হচ্ছিলো। দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে আমাদের সৈন্যরা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে শত্রুপক্ষের অগ্রাভিযান প্রতিরোধেরও চেষ্টা করছিলো। প্রচলিত প্রথার এই যুদ্ধের পাশাপাশি ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছোট ছোট গেরিলা দলকেও বাংলাদেশের ভিতরে পাঠানো হচ্ছিলো।

 

একাত্তরের যুদ্ধের এই বৈশিষ্ট অনেকেই পরিস্কারভাবে বুঝতে পারেনি। তাই আমাদের সরকার এবং সামরিক হেডকোয়ার্টারের কাছে আমাদের সুবিধা অসুবিধা বোধগম্য হয়নি। সবচাইতে নাজুক অবস্থা ছিলো আমাদের অর্থাৎ সমরক্ষেত্রের কমান্ডারদের যারা সৈন্য ও অফিসারদেরকেও যুদ্ধের ব্যাপারটা বুঝাতে হতো। সে সময়ের একটি ঘটনার কথা বলছি। তখন আমি সৈন্য নিয়ে মীরেশ্বরাই এলাকায় শত্রুর সাথে যুদ্ধ করছিলাম। ৩ইঞ্চি মর্টার গোলার ঘাটতি ছিলো আমাদের এবং শত্রুরা তখন আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের উপর কামান দেগে চলছিলো। শত্রুদের গোলায় আহত একজন সৈনিক আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমাদেরকে কামানের আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের কামান ব্যবহার করছেন না কেনো?” এ প্রশ্নের কোন জবাব আমি দিতে পারি নি। তবুও আমার আশা ছিলো, শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সাহায্য আমি পাবোই। এটা আমার দুরাশা ছিলো কিনা বলতে পারি না। পর্যাপ্ত অস্ত্র শস্ত্র পাবার ইঙ্গিতের উপর ভিত্তি করেই আমি যোদ্ধাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।

 

শেষ পর্যন্ত যখন অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছিলো না এবং যোদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র দেয়া যাচ্ছিলো না সে অবস্থায় সৈন্যদের ঘাঁটি আগলে থাকার নির্দেশ দেয়া আমাদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর হয়ে উঠে। এতদস্বত্বেও আমি আমার বাহিনীকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে তাদের অবস্থান রক্ষা করতে বাধ্য করছিলাম। এছাড়া আর বিকল্প পথ ছিলো না। কোনো কোনো সময় মনে হয়েছে সৈন্যদের আমরা গিনিপিগের মতো ব্যবহার করছি। ট্রেঞ্চে বসে থেকে কেউই প্রাণ হারাতে চায় না। তারা যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধই করতে চেয়েছিলো, কিন্তু প্রচলিত যুদ্ধের সুযোগ ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছিল।

 

২০শে এপ্রিল পাক সেনাদের দুটি ব্যাটালিয়ন সর্বশক্তি দিয়ে মীরেশ্বরাইয়ের উপর হামলা চালায়। চুড়ান্ত আঘাত হানার পূর্বে প্রায় ২৪ ঘন্টাই পাক কামানগুলো আমাদের উপর আঘাত হেনে চলছিলো। মাটি খোড়ার সরঞ্জামাদি এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক জিনিসপত্র না থাকায় তেমন শক্তিশালী বাংকারও আমরা তৈরি করতে পারিনি। অনেক সময়েই সৈন্যদের বেয়নেট দিয়ে মাটি খুড়তে দেখেছি। উপরের আচ্ছাদন তৈরীর জিনিসপত্রও ছিলো না। তাই আমাদের বাংকার ও ট্রেঞ্চগুলো কামানের গোলায় ভেঙ্গে পরছিলো। খোলা জায়গায় আমাদের আমাদের সৈন্যরা শত্রুর সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছিলো। যা আশংকা করেছিলাম, শত্রুরা এই সময়ে এয়ার বার্ষ্ট শেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। আমাদের সৈন্যরা এই ধরনের হামলার সাথে পরিচিত ছিলো না। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় অবস্থান থেকে তারা হটতে শুরু করে। শত্রু পক্ষেও হতাহত কম হচ্ছিলো না। পরপর তিনদফা আক্রমণে ওদের শতাধিক সৈন্য হারাতে হয়। আমাদের ট্যাংক বিধ্বংসী গোলায় পাকিস্তানী সৈন্যবাহী আটটি যান প্রায় তিন ঘন্টা যাবৎ জ্বলতে থাকে। মটরযানে অবস্থানরত বেশকিছুসংখ্যক সৈন্যও জ্বলন্ত দগ্ধ হয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে আমাদের সৈন্যরা পরবর্তী অবস্থান মস্তাননগরে প্রতিটি রক্ষাব্যুহ গড়ে তোলে। এই সময় শত্রুপক্ষের সাথে কয়েকটি ট্যাংক এসে যোগ দিলে সংঘর্ষ তীব্রতর হয়।

 

আমাদের সৈন্যরা মস্তাননগরে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার পূর্বেই সেখানে শত্রুর কামানের গোলা এসে পড়তে থাকে। বাঙালি সেনাদের তখন খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা যাচ্ছিলো না। এমনকি গোলাগুলির যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে উঠছিলো। তবু তারা শেষ গুলিটি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘাঁটি আগলে রাখে। শত্রুরা তখন ট্যাংক সামনে নিয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। মস্তাননগরে অবস্থান টিকিয়ে রাখা দুস্কর হয়ে উঠলে আমি করের হাটের কয়েক মাইল দক্ষিনে হিংগুলী এলাকায় সৈন্যদের নিয়ে যেতে মনস্থ করি। এখানে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর একটি খাল থাকায় শত্রুদের দ্রুত অগ্রগমন সম্ভব ছিলো না। অগ্রসরমান শত্রুর ট্যাংকের অগ্রযাত্রা থামাতে হলে খালের উপর প্রধান সেতুটি ধ্বংস করা দরকার।

 

তখন প্রায় মধ্যরাত। আমাদের সৈন্যরা সবাই ক্লান্ত, অবসন্ন। তবুও তারা হিংগুলীতে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গড়ে তোলে এবং পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাতে কারো চোখে ঘুম ছিলো না। পাকিস্তানীরা সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিলো। হিংগুলীর অদুরেই আমরা তাদের যানবাহন এবং ট্যাংকের আওয়াজ পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিলাম। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমি সেতুটি ধ্বংসের কাজে হাত দিলাম। আমাকে সহায়তা করছিলো বিএসএফের মেজর প্রধান।

 

রাত ৭টা নাগাদ সেতুটি ধ্বংস করার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো এবং মেজর প্রধান সেই রাতেই সাব রুমের পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আমি ত্রিশ সেকেন্ডের একটি ফিউজে আগুন ধরিয়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেই। এক এক করে সেকেণ্ড অতিবাহিত হয়, তারপর মিনিট, কিন্তু বিস্ফোরণ আর ঘটলো না। আসোলে ফিউজটি খারাপ ছিলো। আমার সঙ্গে অতিরিক্ত যে ফিউজ ছিলো তাও দেখা দেখা যয় অকেজো। ভোর হতে মাত্র দুঘন্টা বাকী। এরই মধ্যে সেতু আমাদের ধ্বংস করতেই হবে। তখন আমার সামনে হিংগুলী থেকে পঁচিশ মাইল দুরের রামগড় থেকে ফিউজ নিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিলো না। ট্যাংক এবং অন্যান্য গাড়ী ক্রমশ নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছিলো। রাত তিনটা। আমি তখন মরিয়া হয়ে ফিউজের জন্য খবর পাঠালাম। আমাদের নিজস্ব কোনো বিস্ফোরণের মজুত ছিলো না। ফলে সম্পূর্ণভাবে বিএসএফের উপর নির্ভর করতে হতো।

 

রাতে আমরা দ্রুত হিংগুলী ঘাঁটিতে অবস্থান করছিলাম। ভোরে আবার তার পুনর্বিন্যাস করা দরকার হবে। ভয় ছিলো এই পুনর্বিন্যাসের আগেই না শত্রুরা এসে পড়ে। সেতু ধ্বংস করা যায়নি। ট্যাংক এসে পড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। ইতিমধ্যে রামগড় ফেরার পথে মেজর প্রধান খবর পান যে, সেতুটি ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। এই সংবাদ পেয়ে তিনি দ্রুত কয়েকটি ফিউজ নিয়ে পুনরায় হিংগুলী অবস্থানে আসেন। রাত তখন পৌনে চারটা। এসময় রামগড়ের দিক থেকে আমার দিকে অগ্রসরমান একটি জীপের আলো আমার নজরে পড়ে। মেজর প্রধান জীপ থেকে দৌড়ে এসে আমাকে একটি ফিউজ দিয়ে বলেন, এটা আশা করি কাজ করবে। না সেটাতেও কোনো কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ ফিউজ কাজ হলো। কর্ণবিদারী বিস্ফোরণের আওয়াজ কয়েক মাইল দূর থেকেও শোনা গেলো। সেতুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়াতে আমাদের দুশ্চিন্তার অবসান হলো। আমরা দুজনে আনন্দে বলে উঠলাম ‘চমৎকার।‘

 

শত্রুসৈন্যদের মূল দল তখন মাইল খানেক দূরে। এদের পিছনেই ছিলো আর্টিলারী। দিনের প্রথম আলোয় আমরা তাড়াতাড়ি ঘাঁটি পুনর্বিন্যাসের কাজে হাত দেই।

 

এই সংকটময় মুহুর্তে কুমিল্লা সেক্টর থেকে পাওয়া আমাদের নিয়মিত কোম্পানীকে অন্য এক যুদ্ধ ফ্রন্টে চলে যেতে হয়। আমার কাছে হিংগুলীতে তখন একশ’র বেশী লোক ছিলো না, যাদের অধিকাংশ ইপিআর পুলিশ ও মুজাহিদ। আমাদের সৈন্যদের বেশীরভাগই মহালছড়ি এবং নারায়ণহাট এলাকার সংঘর্ষে ব্যাপৃত ছিলো। আমাদের হিংগুলীর অগ্রবর্তী অঞ্চল ছিলো প্রায় তিন মাইল বিস্তৃত। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল রক্ষা করা অপরিহার্য। কুমিল্লা সেক্টর কোম্পানীর কাছে কিছু ভালো অস্ত্র ছিলো তা তারা নিয়ে গেছে। আমাদের ছিলো মাত্র দুটি লাইট মেশিনগান। বাকীগুলো সবই ছিলো সেকেলে ৩০৩ রাইফেল। একটি ৩” মর্টার পাওয়া গেলেও সেটি আপন খেয়ালে চলতো। আমি বুঝতে পারছিলাম, মাত্র একশ সৈন্য নিয়ে দুই ব্যাটালিয়ন শত্রুসৈন্যকে নিশ্চই বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। নারায়ণহাটে সৈন্য চেয়ে আমি যে খবর পাঠিয়েছিলাম তাদের আসতে অন্তত দুদিন লাগবে। এখানে আমাকে এই দুইদিন শত্রুদের ঠেকাতে হবে। শত্রুরা আমার আসোল শক্তি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আভাস পেলেও তৎক্ষনাৎ আক্রমণ করে বসতো। সেতুর পূর্বদিকে পাহাড়ী এলাকা পর্যন্ত প্রায় সমতল। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট ঢিবি, টিলা। সৈন্য চলাচলে এগুলো আড়াল হিসেবে কাজে লাগছিলো। এই সমতল এলাকাটির দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় দুই মাইল। সেতুর পশ্চিম দিকের এলাকা একেবারে সমুদ্র উপকুল পর্যন্ত আমাদের অরক্ষিত রাখতে হচ্ছিলো। সৈন্যসংখ্যা বেশী না থাকায় আমি জনা ত্রিশের মতো লোক নিয়ে তাদের দু’ভাগে ভাগ করি। এরপর দুদলকে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাঠাই। উদ্দেশ্য ছিলো তারা এমনভাবে চলাচল করবে যাতে দুর থেকে শত্রুরা বুঝতে পারে যে, দুটি অঞ্চল জুড়েই আমরা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করেছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী সামনে এগিয়ে গিয়ে এক জায়গায় শুয়ে পড়ে এবং এমনভাবে হামাগুড়ি দিয়ে কোনো মাঠ বা ঝোপের পিছনে চলে আসতো যাতে শত্রুরা যাতে শত্রুরা তাদের পিছনে হটে যাওয়া দেখতে না পায়। এখান থেকে উঠে আবার একটু প্রকাশ্যভাবেই আরেক যায়গায় যেতে থাকে। গোপনে পিছন দিকে এবং প্রকাশ্যে সামনের দিকে যাওয়ার এই প্রক্রিয়া বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকবার করে চলে। এতে শত্রুদের ধারণা জন্মায় যে এক একটি স্থানেই পঞ্চাশ ষাটজন করে বাঙালি সেনা রয়েছে। অথচ আমাদের ছিলো মাত্র পনের জনের মতো সৈন্য। বিকাল পর্যন্ত আমরা কাজটি চালিয়ে যেতে থাকি। দূর থেকে কেউ এ দৃশ্য দেখলে নির্ঘাত মনে করবে সেতুর উভয় পার্শ্বে আমাদের পনের থেকে দুই হাজার সৈন্য প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করেছে।

 

এই অবস্থায় আমাদের বাদবাকী সৈন্যরা সেতুর নিকট রাস্তা কভার করে সুবিধাজনক স্থানগুলোতে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলতে থাকে। সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। পদ্ধতিটি কিছু সময়ের জন্য অবশ্যই কাজে লেগেছিলো। রাতে আমাদের সাড়া সম্মুখভাগ জুড়ে শত্রুর কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হয়। দুই দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, তবুও তারা এগিয়ে এসে আক্রমণ করলো না। এদিকে আমাদের দলেও নতুন সৈন্য এসে পৌঁছায়নি। এ সময় এক নতুন বিপদ দেখা দিলো। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য এসে পড়ায় শত্রুরা রণাঙ্গণে আরো বেশী করে সৈন্য পাঠাতে লাগলো। ১২০ এম এম মর্টারসহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি পুরো ব্যাটালিয়ন ফটিকছড়ি, নারায়ণ হাট দিয়ে হিয়াকুর দিকে এগোয়। এদের অগ্রাভিযানের ফলে হিয়াকু এবং করেরহাট হিংগুলী এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে আমাদের সকল সৈন্য আটকা পড়ার আশংকা দেখা দেয়। এই অবস্থায় আমি নারায়ণ হাট থেকে সৈন্য পাওয়ার আশা পরিত্যাগ করি।

 

।। রামগড় ভস্মীভূত ।।

 

২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানীদের হাতে করের হাটের পতন ঘটে। তারপর তিনদিক থেকে রামগড় অভিমুখে অগ্রসর হয়। করেরহাট রামগড় সড়কে একদল, নারায়ণহাট হিয়াকু রামগড় পথে দ্বিতীয় দল এবং মহালছড়ি রামগড় সড়ক ধরে তৃতীয় দল অগ্রসর হতে থাকে। করেরহাট থেকে রামগড় যাওয়ার পথে পাহাড়গুলো দখল করার জন্য পাকিস্তানীরা পূর্বদিকে এগুচ্ছিলো। ফেনী নদীর শুভপুর সেতুর দিকেও কিছুসংখ্যক শত্রুসেনা অগ্রসর হচ্ছিলো। পক্ষকাল পরে এই সেতুর কাছেই এক রক্তক্ষয়ী লড়াই সংঘটিত হয়।

 

করেরহাট এবং রামগড়ের মাঝামাঝি স্থানে ছোট বাজার হিয়াকু। শত্রুরা কিভাবে যেনো জেনেছিলো আমরা রামগড়েই চট্টগ্রাম সেক্টরের সদর দফতর স্থাপন করেছি। কথাটি আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ নয়। এখানে আমাদের কিছু জালানী এবং খাদ্য মজুত ছিলো। আরো ছিলো আমাদের আহতদের চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী একটি হাসপাতাল। এছাড়া ছিলো ছোট্ট একটি ট্রেনিং ক্যাম্প। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে আমরা অস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহারের ট্রেনিং দিচ্ছিলাম। তবে প্রয়োজনে এখান থেকেও সবকিছু সরানোর প্রস্তুতি আমাদের ছিলো। রামগড় অবশ্য আমাদের মান সম্মানেরও প্রতীক হয়ে উঠছিলো। কারণ এটাই ছিলো আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সর্বশেষ মহকুমা সদর দফতর। তাই আমরা স্থানটি প্রতিরক্ষার জন্য সম্ভাব্য সবরকম প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এজন্য আমরা কয়েকটি সেতু ধ্বংস করে ফেলি। সীমিত সম্পদ ও শক্তির দিকে লক্ষ্য রেখে যতদূর সম্ভব ব্যাপক এলাকা জুড়ে সম্ভাব্য শত্রু হামলার স্থানগুলোতে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তুলি।

 

রণকৌশলের দিক থেকে তখন হিয়াকু এবং করেরহাটের মধ্যে আমাদের কোনো সৈন্য রাখার উপযোগিতা ছিলো না। সৈন্যদের এখানে শত্রুবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিলো। তাই সকল দিকের সব সৈন্য প্রত্যাহার করে হিয়াকু এলাকায় সমাবেশ করেছিলাম।

 

অন্য পথে আরো পূর্বে মহালছড়িতে আমাদের সৈন্যদের উপর ইতিমধ্যে শত্রুরা হামলা চালিয়েছিলো। আমাদের বাহিনী তখন আরো সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র চেয়ে খবর পাঠাচ্ছিল। কিন্তু আমরা তাদের কিছুই দিতে পারি নি।

 

এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ সামরিক কমান্ডের মতো কিছু একটা গঠন করেন। রণাঙ্গণের কমান্ডাররা কিন্তু সর্বোচ্চ সামরিক কমাণ্ড থেকে কোনো আদেশ পান নি। বস্তুতঃ অভিযান সংক্রান্ত কোনো আদেশই তাদের ছিলো না। যে কোনো মূল্যে শত্রু আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে। আমাদের প্রতি এটাই ছিলো সেই বিমূর্ত হাই কমান্ডের একমাত্র নির্দেশ। যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব চিত্রের সাথে এই আদেশের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। শত্রুর অগ্রাভিযান কিছু সময়ের জন্য হয়তো বিলম্বিত করা যায় কিন্তু প্রাণঘাতী লড়াইয়ের ময়দানে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ ছাড়া শত্রুকে দমন করার চিন্তা আকাশ কুসুম স্বপ্নমাত্র। কেউ কেউ এই যুক্তি অনুধাবন না করেই খামখেয়ালী এবং অসঙ্গত আদেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। অচিরেই আমাদের সৈন্যরা এই অদৃশ্য কমান্ডের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং এর আসোল অস্তিত্ব সম্পর্কেই সকলের মধ্যে সন্দেহ সন্দেহ দেখা দেয়।

 

পাকিস্তানীরা মহালছড়ি আক্রমণ করেছিলো ২৭শে এপ্রিল। এখানে ছিলো প্রায় তিন হাজার সৈন্যের দুটি মিজো ব্রিগেড এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি নিয়মিত কমান্ডো কোম্পানী। আমাদের সৈন্যদের পাহাড়ী এলাকায় যুদ্ধের ট্রেনিং ছিল না। অস্ত্র ও রসদপত্রের অভাব ছিলো। তাই মহালছড়িতেও আমাদের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়। পাকিস্তানীরা মিজোদের সামনের সারিতে পাঠিয়ে দিয়ে একটির পর একটি হামলা চালাতে থাকে। প্রতিবার প্রথমেই তাদের সে হামলা ব্যর্থ হয়ে যায়। হামলায় মিজোরা দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পিছনে থাকা কমাণ্ডদের চাপের ফলে মিজোরা পিছনেও সরতে সরতে পারছিল না। এমনকি কমান্ডোরা অস্ত্র দিয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছিলো যে কোনো মিজো পালাতে চেষ্টা করলেই তাকে গুলি করা হবে। যুদ্ধ গড়িয়ে চলে।

 

মিজোদের কয়েকটি ছোট ছোট দল কোনোক্রমে কয়েকটি টিলা পেরিয়ে পাহাড়ের উপর সুবিধাজনক স্থান দখল করে নেয়। এদের এই জায়গা থেকে আমাদের অবস্থান এবং রামগড় অভিমুখী সড়ক পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো।

 

যুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমেই সঙ্গীন হয়ে ওঠে। আমাদের সৈন্য সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুন বেশি শত্রুসৈন্য বাঙালি সৈন্যদের প্রায় ঘিরে ফেলে। তরুন অফিসার ক্যাপ্টেন কাদেরকে আমরা এখানেই হারাই। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে একটা সুবিধাজনক স্থান দখল করার জন্য সে গিয়েছিলো যাতে বাঙালি সৈন্যদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণে সে সাহায্য করতে পারে। কাদের সফল হয়েছিলো, কিন্তু তারপরই লাইট মেশিনগানের এক ঝাক গুলিতে তার দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছিলো ক্যাপ্টেন কাদের। এই যুদ্ধে প্রথম একজন অফিসার হারিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিলো। দু’জন মাত্র শওকত ও ফারুক (পরে দুজই সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হয়েছিলেন) এবং সিপাই ড্রাইভার আব্বাস শত্রুদের বৃষ্টির মতো গুলির মধ্য দিয়েই ক্যাপ্টেন কাদেরের দেহ উদ্ধার করে আনে। রামগড়ে আমরা যথাযোগ্য ধর্মীয় ও সামরিক মর্যাদায় কাদেরের মৃতদেহ দাফন করি।

 

এপ্রিলের ২৯ তারিখে হিয়াকুর কাছে যুদ্ধ শুরু হয়। আমাদের অবস্থান স্থলের সামনের জায়গাটি ছিলো খোলা কিন্তু দু’পাশে ছোট ছোট টিলার উপর ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গলের আড়াল দিয়ে শত্রুরা আমাদের পিছনে চলে আসতে পারতো। সে পরিস্থিতিতে সরবরাহ ঘাঁটি রামগড় থেকে আমাদেরকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হতো। আমাদের কাছে তখন রান্না করার মতো কিছু ছিলো না। অধিকাংশ খাবারই আসতো রামগড় থেকে। দিনটি ছিলো পরিস্কার। ভোর থেকেই আমাদের অবস্থানের উপর মর্টার শেলিংয়ের মাধ্যমে কয়েক দফা হামলা হয়। বোমাবর্ষণের ছত্রছায়ায় আমাদের দিকে অগ্রসরমান শত্রুর অগ্রভাগে ছিলো প্রায় দুইশত স্থানীয় দালাল। খোলা মাঠ দিয়ে দুই কোম্পানী পাকসেনা এগিয়ে আসছিলো। ওরা একশ গজের মধ্যে আসতেই আমাদের অস্ত্রগুলো গর্জে উঠলো। এই আকস্মিক হামলায় মুহুর্তের মধ্যে ওরা ভয় ও আতংকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। দীর্ঘ দুই ঘন্টা অবিরাম লড়াইয়ে আমাদের কয়েকজন হতাহত হবার পর অবশেষে আমাদের সৈন্যদেরকে চিকনছড়ার দিকে পশ্চাদপসরণ করার নির্দেশ দেয়া হলো।

 

হিয়াকুর পতনের পর রামগড়ের পতন অবসম্ভাবী হয়ে উঠলো। সবচাইতে বিপজ্জনক ব্যাপার ছিলো শত্রুরা আমাদের অসামরিক ব্যাক্তিদের বিশেষ করে বড় বড় শরণার্থী দলের ভারত গমনের পথ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলো। সে সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক ধূলিময় রাস্তা ধরে নারায়ণহাট থেকে হিয়াকুর এবং তারপর রামগড় হয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাবরুমে আশ্রয় নিচ্ছিলো। কিন্তু হিয়াকুর পতনের পর সে পথ বন্ধ হয়ে গেলো।

 

করেরহাটের পতনের পর বুঝতে পারি বর্তমান ধারায় যুদ্ধ করে আমরা কিছুই করতে পারবো না। আমরা আমাদের বাহিনীকে সুসংগঠিত করে তুলতে পারছিলাম না। এই বাহিনীতে ছিলো বিভিন্ন ধরণের লোক। ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, সামরিক বাহিনীর লোক এবং মাত্র সপ্তাহ খানেক ট্রেনিং দেওয়ার পর রণাঙ্গণে নামিয়ে দেয়া নতুন মুক্তিযোদ্ধা। এইসব দলের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলার অভাব ছিলো আমাদের বিপর্যয়ের একটি কারণ। আমাদের সকল সৈন্যদের একটা নিরাপদ শিবিরে নিয়ে তাদের জন্য বিশ্রাম ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। তাহলে তাদেরকে নিয়েই আবার একটা সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিত বাহিনী গড়ে তোলা যেতো। আমাদের অধিকাংশ সৈন্যকেই ইতিমধ্য অপুষ্টিরও শিকার হয়ে পড়তে হয়েছিলো।

 

সেই উদ্দেশ্যে ভারতীয় সীমানায় ছয় মাইল ভিতরে হরিনায় একটা গোপন শিবির স্থাপন করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে কয়েকটি তাবু পেয়েছিলাম। রামগড় থেকে কিছু কিছু জিনিস এখানে নিয়ে আসা হলো। শিবিরের জন্য যে হাসপাতালের ব্যবস্থা করেছিলাম, যুদ্ধে আহতদের সেখানে আনা হয়। এরপর যুদ্ধ থেকে একটু অবকাশ পেয়েই নতুনভাবে আমাদের বাহিনী সংগঠনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়।

 

মুজিবনগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তখন অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছিলেন। কাজটি ছিলো খুবই দুঃসাধ্য। বাংলাদেশ বাহিনী একটা উল্লেখযোগ্য পরিমান এলাকায় তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে কেউ আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি দিবে না। যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় বাংলাদেশের যে কোনো একটি অঞ্চলে যতদূর সম্ভব সৈন্যদের জড়ো করে সেই এলাকা প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা যেতো। সময় নষ্ট না করে সেই সময়ই এই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু দেখা গেছে কর্তৃপক্ষ সকল ফ্রন্টেই যুদ্ধ করতে আগ্রহী এবং যুদ্ধ করে জয়ী হতেও চাইছিলেন। আমাদের সৈন্যসংখ্যা এবং তাদের পরিমানের প্রেক্ষিতে রণকৌশলগত দিক থেকে এ ব্যবস্থা ছিলো অবাস্তব। সব জায়গায় যুদ্ধ করার দরুন সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে আমাদের সেনাদের বিচ্ছিন্ন এবং স্থানীয়ভাবে লড়ে যেতে হয় এবং এই লড়ে যাওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলো লক্ষ্যহীন। তাই একটির পর একটি এলাকা এলাকা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে।

 

৩০শে এপ্রিল মহালছড়ির সৈন্যরা রামগড় এসে পৌঁছে। এখান থেকে সকালে ছোট ছোট দলে হরিনা শিবিরের দিকে অগ্রসর হয়। ওদের আসার আগে কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে রামগড় ছেড়ে যেতে প্রস্তুত থাকার আদেশ দিয়েছিলেন। এই আদেশে বোঝা গিয়েছিলো, হাই কমাণ্ড আমাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটাতে অসমর্থ। তখন সাহায্য ব্যতিরেকে মাত্র তিনদিনের বেশী যুদ্ধ করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। কিন্তু অবাক কাণ্ড, ৩০শে এপ্রিল রাতেই আরেকটি নতুন আদেশ পেলাম। বাংলাদেশ সরকারের জন্য রামগড় রক্ষা কর। ইতিমধ্যে চিকনছড়া থেকে আমরা সৈন্য সরিয়ে এনেছি। হরিণায় আমাদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণের জন্য রামগড়ের বাইরে কিছু সৈন্য রেখেছি। যাতে শত্রুর অগ্রাভিযান কিছু সময়ের জন্য তারা বিলম্বিত করতে পারে। আমাদের সৈন্যদের অর্ধেক তখন হরিণার রাস্তায়।

 

অবশ্য সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর রামগড় প্রতিরক্ষার জন্য উপস্থিত যাদেরকে পেলাম সবাইকে জড়ো করা হলো। পাকিস্তানী সৈন্য যাতে ভারতীয় ভূখন্ডে ঢুকে না পড়ে তা প্রতিহত করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দলও সাবরুমে চলে আসে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই পদক্ষেপে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিলো। গুজব রটেছিলো যে, রামগড় প্রতিরক্ষায় ভারতীয় সৈন্যরাও অংশ নিতে পারে। কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটে নি।

 

১লা মে থেকে শত্রুরা রামগড়ের আশেপাশের এলাকার উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। একটি দল মূল সড়ক ধরে অগ্রসর হচ্ছিলো। অন্য একটি দল রামগড়ের পূর্ব-দক্ষিণে পাহাড়ের দিকে এগোতে থাকে। এই পাহাড় এবং রামগড়ের মধ্যে কিছুটা জায়গা একেবারে খোলা এবং সমতল। পহেলা মে দিবাগত রাতে এই পাহাড়ে গোপনে শত্রু সমাবেশ ঘটেছিলো।

 

২রা মে সকালে পাকিস্তানীরা মরিয়া হয়ে রামগড়ের উপর আক্রমণ শুরু করে। কামানের প্রচণ্ড গোলার ছত্রছায়ায় তারা সড়কপথে আমাদের প্রথম প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙ্গে দেয়। শেলের আঘাতে আমাদের বাংকারগুলো ভেঙ্গে পড়তে থাকে। এদিকে সেই পাহাড় এবং রামগড়ের মধ্যবর্তী স্থানটিতে ধোঁয়ার জাল সৃষ্টি করা হয়। এই ধোঁয়ার আড়ালে শত্রুদের দ্বিতীয় দলটি রামগড়ের মধ্যভাগের দিকে অগ্রসর হয়। সন্ধ্যার ঘন্টাখানেক আগে শত্রুরা শহরটির মধ্যাঞ্চলের উপর চুড়ান্ত আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। এরপর এক ঘন্টারও বেশী সময় আমাদের সৈন্যরা শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে এবং পরিশেষে গুলি ফুরিয়ে গেলে তারা অন্ধকারের আড়ালে পশ্চাদপসরণ করে।

 

ওদিকে সাবরুমের সকল বেসামরিক বাসিন্দাকে ইতিপূর্বে আরো অভ্যন্তরে নিরাপদ স্থানে অপসারণ করা হয়েছিলো। সারা তল্লাট জুড়ে বুলেট ছুটছিলো। ভারতীয় এলাকার বাড়িঘর এবং গাছপালায় গিয়ে গুলি লাগছিলো। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিনীও (বিএসএফ) ইতিমধ্যে যার যার ট্রেঞ্চের ভিতরে অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। তবে তারা সবকিছু অবলোকন করছিলো মাত্র।

 

এ সময় শত্রুর একটি অয়্যারলেস বার্তা আমরা শুনতে পাই। ওতে বলছিলো, “রামগড়ের বিদ্রোহী হেডকোয়ার্টার দখল করেছি।”

 

২রা মে রাতে শত্রুরা রামগড়ের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সমগ্র বাজার এলাকা জ্বলে উঠে। ঊর্ধ্বমূখী ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর অগ্নিবলয়ের ভিতর দিয়ে দুরে তখন পাহাড় শ্রেণীর অস্পষ্ট রেখা চোখে পড়ছিলো সেখানেই আমাদের স্বপ্নের সেই দেশ যার জন্য আমরা যুদ্ধ করে চলেছি, অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। কিন্তু কতদিন এ যুদ্ধ চলবে তা আমরা কেউ জানতাম না।

 

।। শুভপুর সেতুর যুদ্ধ ।।

 

রামগড় হারানোর বিপর্যয়ে আমাদের তখন মনমরা অবস্থা। হরিণায় বিকল্প সদর দফতর স্থাপন করতে পারলেও ভারতের আশ্রয়ে থেকে শত্রুর বিরূদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। রামগড়ে আমাদের একটা সান্তনা ছিলো যে, সেটা আমাদের নিজের দেশ। সেখানকার সব কিছুই আমাদের। কিন্তু হরিণা ভারতীয় এলাকা। দুইয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য। আমাদের সব স্বপ্ন বুঝি ভেঙ্গে গেলো। আমাদের কেউ কেউ শিশুর মতো কেঁদেছিলো। মানসিক আঘাতে পাথর হয়ে যাওয়া অনেককে দেখছিলাম একটা ঘোরের মধ্যে পা দুটি যেনো টেনে নিয়ে হরিণার দিকে চলছে। কাঁধে ঝুলছে পুরোনো দিনের হাতিয়ার এবং গুলিশূণ্য থলে।

 

এরপর প্রধান সড়কে শুভপুর সেতুর কাছে মারাত্মক লড়াই আসন্ন হয়ে উঠে। ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর সহযোগীতায় সেতুর একটি অংশ আমরা এর আগে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। এখানে আমাদের দলে লোকসংখ্যা ছিলো মাত্র একশ’র মতো। এদের অধিকাংশই ছিলো আবার সাত দিনের ট্রেনিং প্রাপ্ত বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। সেতু প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পড়েছিলো ইপিআর সুবেদার ফখরুদ্দিনের উপর। আমাদের লক্ষ্য ছিলো শত্রুরা যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ সেতু ব্যবহারের সুযোগ না পায় এবং ঢাকা ও কুমিল্লার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে না পারে।

 

করেরহাটের পতনের পর সেতুর উত্তরদিক থেকে আমরা সৈন্য প্রত্যাহার করে সেতুর দক্ষিণ দিকে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করি। আমরা জানতাম সেতুটি দখল করার জন্য শত্রুরা মরিয়া হয়ে উঠবে। করেরহাটে তারা কামান মোতায়েন করেছিলো। কয়েকটি ট্যাংকও নদীর পার পর্যন্ত চলে এসেছিলো। দূর থেকে শত্রুপক্ষের কামানের গোলা এসে আমাদের উপর পড়ছিলো। ট্যাংকগুলো অগ্রসর হয়ে আমাদের একটির পর একটি বাংকার ধ্বংস করে চলছিলো। আমাদের ট্যাংক বিধ্বংসী কয়েকটি ছোট হাতিয়ার থাকলেও তখন কোনো শেল আমাদের কাছে ছিল না।

 

ট্যাংক ও কামানের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের ছত্রছায়ায় পাকিস্তানীরা কয়েকবারই নদী পার হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। দুবার তাদের সৈন্যরা নদীপথে মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে দু’দিকের গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে যায়। পরিস্কার দিনের আলোয় তাদেরকে দেখে দেখে আমরা গুলিবিদ্ধ করতে থাকি। অনেকটা যেনো বেশ আরামের সাথে টার্গেট প্র্যাকটিস করার মতো। এভাবে দুই কোম্পানীরও বেশী সৈন্য আমরা নির্মূল করি। তাদের লাশগুলো নদী দিয়ে ভাসতে ভাসতে সাগরের দিকে চলে যায়। এভাবে সৈন্যক্ষয়ের পর শত্রুরা নদী পার হয়ে সেতু দখলের চেষ্টা ত্যাগ করে।

 

ওদিকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত পাকসেনাদের নিকট ফেনী শহরের পতন ঘটে। ১১ই মে’র মধ্যেই তারা শুভপুর সেতুর কাছে এসে পড়ে।

 

পাকিস্তানীদের এই কলামে শত্রুদের আনুমানিক দুটি ব্যাটালিয়ন ছিলো। পক্ষান্তরে সেতুর কাছে একশ’রও কমসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা তখন চুড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। পরের দিন শুরু হয় যুদ্ধ।

 

১২ই মে সকাল থেকে করেরহাটের কমাণ্ডগুলো আমাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। অপরদিকে নদীর পাড়ে শত্রু ট্যাংকগুলোকেও দেখা যায়। পাকিস্তানীরা আমাদের অবস্থানের উত্তর ও পশ্চিম দিকে ধূম্রজালের সৃষ্টি করে। সকাল ১১ টায় পশ্চিম দিকের সেই ধোঁয়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে দুটি কোম্পানী প্রথম হামলা শুরু করে। কিন্তু বেশ ক্ষতি স্বীকার করে তাদেরকে পিছু হটতে হয়। তারপর কিছু সময় সব চুপচাপ। বেলা তিনটার দিকে প্রচণ্ড গোলা বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার হামলা শুরু করে। দুটি শত্রু ব্যাটালিয়নকে হামলায় অংশ নিতে দেখা যায়। দিনের বাকী সময়টুকু আমাদের সেনাদেরকেও প্রচণ্ডতম গোলাবর্ষণের মোকাবিলা করতে হয়। প্রায় অর্ধেক মুক্তিযোদ্ধাই তখন শেলের আঘাতে আহত। সরাসরি আঘাতে বাংকারগুলো ধসে পড়লে অনেকেরই জীবন্ত সমাধি ঘটে। আমরা হতাহতদের সরাতে পর্যন্ত পারছিলাম না। নতুন সৈন্যও যোগ হচ্ছিলো না। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা খাদ্য কিংবা পানির মুখ দেখেনি। বেলা পাঁচটার দিকে কামানের গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়। শত্রুরা তখন আমাদের অবস্থান থেকে আনুমানিক ৩০০ গজ দূরে। শুধু একটি মেশিনগান এবং দুটি লাইট মেশিনগান দিয়ে আমরা এদের মোকাবিলা করছিলাম। ট্যাংকের আঘাতে অস্ত্রগুলো ধ্বংস হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত সেগুলো সেগুলো সমানে শত্রু নিধন করে চলে। এরপর আমাদের সৈন্যরা শুধু ৩০৩ রাইফেল দিয়ে গুলি চালাতে থাকে। অচিরেই হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানীদের তুলনায় আমরা সংখ্যায় ছিলাম খুবই কম। আমাদের যেসব সেনা ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থানে ছিলো তারা শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করতে পেরেছিলো। এদের অধিকাংশই ছিলো গুরুতর আহত। তারপরেও মনোবল ভেঙ্গে পড়ে নি।

 

তখন সন্ধ্যা হয় হয়। শুভপুর সেতুর অদুরে ভারতের শ্রীনগর সীমান্ত ফাড়ি। এখান থেকে একটি কাঁচা রাস্তা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে আগরতলা অভিমুখী প্রধান সড়কে গিয়ে মিশেছে। এই সন্ধ্যায় রাস্তাটিতে অন্য কোনো লোক ছিল না। শুধু রণাঙ্গণ ফেরত কিছু লোক নিঃশব্দে হেটে চলছিলো। এদের মধ্যে কেউ কেউ হাটছিলো লাঠিতে ভর দিয়ে। কয়েকজনকে আবার সহযোদ্ধারা ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো। পথে আমাদের একজন অফিসারের সাথে তাদের দেখা হলে জনৈক মুক্তিযোদ্ধা তার বাম হাত তুলে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানায়। তার ঝুলন্ত ডান হাত থেকে রক্ত ঝরছিলো। শেলের বিচ্ছুরিত টুকরায় হাত প্রায় দুভাগ হয়ে গিয়েছিলো। শুধু কুঁকড়ে যাচ্ছিলো। তবু সে মুখে একটু হাসির ভাব ফুটিয়ে অফিসারকে “জয় বাংলা” বলে শুভেচ্ছা জানায়। তারপর সে অন্যদের সাথে সামনে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়।

Scroll to Top