২৩। ৩০ জুলাই ঐতিহাসিক গণপ্রতিনিধি সমাবেশ

কম্পাইলারঃ হিমু নিয়েল

<৬,২৩, ৪৫-৪৭>

শিরোনামঃ ঐতিহাসিক গণপ্রতিনিধি সমাবেশ

সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা (১ম বর্ষঃ ১২শ সংখ্যা)

তারিখঃ ৩০ জুলাই, ১৯৭১

 

ঐতিহাসিক গণপ্রতিনিধি সমাবেশ

আহমেদ রফিক

.

অসহযোগ আন্দোলন থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণ করে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করার পর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রথম বৈঠক এ মাসেই ৫ই ও ৬ই তারিখে মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

.

দেশমাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে যখন সাড়ে সাত কোটি মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে বুকের তাজা রক্ত বইয়ে দিয়েছে বাংলার শ্যামল প্রান্তরে, জাতীয়তাবাদের নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত সংগ্রামী বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারারুদ্ধ, বিশ্বমানবতা যখন বিবেকের দংশনে কিংকর্তব্য বিমূঢ়, সারা বিশ্ব যখন বাংলার নেতৃত্ব বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দিকে এক বিরাট উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে, তেমনি এক মুহুর্তে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। কার্যকরী সংসদের ৩৯ জন সদস্য এবং উভয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যুক্ত বৈঠকে মোট ৩৭৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ১৩৫ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ২৩৯ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে যাঁরা সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত অথবা গ্রেফতার হয়েছেন এবং কয়েকজন আত্মসমর্পণও করেছেন। আর কেউ কেউ নিজ নিজ এলাকায় থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কাজে ব্যস্ত থাকায় সম্মেলনে হাজির হতে পারেননি। অবশ্য আরও বেশ কয়েকজন সদস্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমুহে আশ্রয় নিয়েছেন।

.

এই বৈঠক কয়েকটি দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে নস্যাত্‍ করার উদ্দেশ্যে ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়েছিল। ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করে, আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের উপর সকল রকম অত্যাচার চালিয়ে তাদেরকে সর্বস্বান্ত করেছে। আর সর্বশেষে আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করা হলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাচন বাতিল হবে না বলে একটি মস্ত বড় প্রলোভনের টোপ ছেড়েছিল। কিন্তু এই বৈঠক প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ইয়াহিয়ার প্রলোভনের টোপ ব্যর্থ হয়েছে।

.

সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিটি মানুষই যে সংগ্রামী বাংলাদেশের প্রতিনিধি তার চিহ্ন আঁকা রয়েছে তাদের চোখে মুখে। তাঁরা এসেছেন রণক্ষেত্রের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সারা বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের দুর্জয় সংকল্পের প্রতিনিধি হিসেবে। তাদের চোখ মুখে চূড়ান্ত বিজয়ের অলোয় উদ্ভাসিত।

.

এই বৈঠকের রাজনৈতিক তাৎপর্য, ঐতিহাসিক গুরুত্বও অনেক। ভাবী কালের ঐতিহাসিকেরা যেদিন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস লিখবেন, সেদিন এই মুজিবনগর বৈঠকের গুরুত্ব তার যথার্থ প্রেক্ষিত নিয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা একটি যুক্ত বৈঠক করেছেন এবং দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকতে পারে, ঐতিহাসিক তাৎপর্য কি?

.

এই তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে, আজ থেকে দু’মাস আগে জানুয়ারীর এক শীত বিকেলে রমনার সবুজ ঘাসে ঢাকা রেসকোর্সের ময়দানে। তখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সদ্য নির্বাচন বিজয়ের মহা উল্লাস। গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়ার আকুল প্রত্যাশায় বাংলার আবাল বৃদ্ধা বনিতা প্রতীক্ষারত। সেই মহা বিজয়ের মহা উল্লাসের দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রস্তাব দিলেন রমনার মাঠের প্রায় বিশ লাখ মানুষের সামনে দাড়িয়ে অর্থাৎ গণ-আদালতে দাড়িয়ে আওয়ামী লীগের সকল সংসদ সদস্যকে শপথ গ্রহণ করতে হবে, জনগণের রায় বানচাল হতে পারে, জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে পারে এমন কাজ কেউ করবেন না। জনগণের সঙ্গে গণস্বার্থের সঙ্গে কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে জনগণের অধিকার রইল তাকে চরম শাস্তি দেয়ার। সেদিনও বাইরের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা প্রশ্ন তোলেননি তা নয়, নতুন করে আবার শপথ গ্রহণের দরকার কি ? বাংলাদেশের জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু তার ময়দানের ভাষণে এর জবাব দিয়েছেন অল্প কয়েকটি কথায়, “এই নির্বাচনী বিজয়ই চূড়ান্ত বিজয় নয়। আমাদের আবার সংগ্রামে নামতে হতে পারে।”

.

মাত্র তিন মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। ইয়াহিয়া চক্র বিশ্বাসঘাতকতা করলো । নিরস্ত্র এবং অহিংস গণ অসহযোগ আন্দোলনের মোকাবিলায় আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কয়েক ডিভিশন সৈন্য তারা লেলিয়ে দিল বাঙ্গালী নিধনে। মার্চ মাসের সাত তারিখে আবার লাখো লাখো মানুষ জমায়েত হল রমনার মাঠে তাদের মুক্তি সংগ্রামে নেতার নির্দেশ লাভের জন্য। তাদের সকলের মনেই সেদিন একটি নীরব প্রশ্ন এর পর কি হবে ? বঙ্গবন্ধু যদি তাদের মধ্যে না থাকেন, তাকে যদি গ্রেফতার হতে হয় বর্বর জঙ্গীচক্রের হাতে তাহলে কি হবে ? কে নির্দেশ দেবে সংগ্রামী জাতিকে ? এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। আবেগমণ্ডিত বজ্রকন্ঠে বললেন, “আমি যদি নির্দেশ দেয়ার জন্য না থাকি তাহলে আমার এই নির্দেশ রইল, এই সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এই সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”

.

বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে হাজির নেই। হানাদার বর্বর ইয়াহিয়া চক্রের হাতে আজ তিনি বন্দী কিন্তু বাংলাদের মুক্তির সংগ্রাম থামে নি, স্বাধীনতার সংগ্রাম পথভ্রষ্ট হয়নি, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী অথবা নেতা নীতি ভ্রষ্ট হয়নি, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বরং তারা আরো ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। মুক্তি সংগ্রাম আরও জোরদার ও সংগঠিত হয়েছে। সংগ্রামে চূড়ান্ত জয়লাভের দিনও ক্রমশঃ আমাদের নিকটবর্তী হচ্ছে। আর এই সংগ্রাম ও সাফল্যের নিরিখেই এ মাসে অনুষ্ঠিত মুজিবনগর বৈঠকের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিচার করতে হবে।

.

ইয়াহিয়া ভুট্টো টিক্কা চক্র আশা করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে আটক করা হলে নেতাহীন মুক্তি আন্দোলন বানচাল হবে, চরম অত্যাচারের মুখে আওয়ামী লীগ দল ভেঙ্গে যাবে, আওয়ামী লীগের পরিষদ সদস্যেরা ইয়াহিয়ার নির্দেশ মেনে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচনী রায়কে ব্যর্থ করে দেবে। এই দুরাশায় ইয়াহিয়া তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ভাবী ভোলানি। আওয়ামী লীগ দলীয় কয়েকজন পরিষদ সদস্যকে বন্দীকরা ছাড়া আর দু একজনের বেশী ইয়াহিয়া খান দলে ভেড়াতে পারেননি। আওয়ামী লীগ গোটা জাতির সমর্থন পেয়ে মুক্ত অঞ্চলে বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গড়ে তুলেছেন, মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়েছেন। নগরে এই মাসের গোঁড়ার দিকে তারা সকলে একত্র হয়ে ইয়াহিয়ার মিথ্যা প্রচারণা ফাঁস করে দিয়েছেন এবং বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন, শেখ মুজিব বন্দী হলেও আদর্শ রয়ে গেছে পিছনে, আর রয়ে গেছে তার সুযোগ্য সহকর্মীরা যাদের নেতৃত্বের প্রভাবেই ইয়াহিয়ার তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের ফাঁদে তাদের কেউ ধরা দেননি। তারা সকলেই মক্তাঞ্চলে রয়েছেন এবং মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়ে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন রত। বিশ্বের কোন কোন প্রখ্যাত রাজনৈতিক ভাষ্যকার তাই বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব ইতিহাসে এমনটি আর কখনো ঘটেনি। আওয়ামী লীগের মত একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল রাতারাতি বিপ্লবী চরিত্র গ্রহণ করবে, এটা বিস্ময়কর বিশ্বের ইতিহাসে এটা তুলনাহীন, উপমাহীন ঘটনা।

.

এই বৈঠক প্রমাণ করেছে, ইয়াহিয়া-চক্রের চরম বর্বরতার মুখেও বাংলাদেশের গণঐক্য অটুট গণপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ অর্জনে দৃঢ়-সংকল্প। এই বৈঠক আমাদের মুক্তিবাহিনীর মনে নতুন প্রেরণা এনেছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে এনেছে নতুন প্রত্যয়, দৃপ্ত সাহস। বহির্বিশ্বের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও উপলব্ধি করেছেন, বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ ও প্রতিনিধিত্ত্বশীল সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

.

বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলি, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবং সংগ্রামে জয়লাভ অবশ্যম্ভাবী । উদয়াচলে মুক্তি সূর্যের আলোর রেখা উদ্ভাসিত। রক্ত পিছল সূর্যতোরণে আজ প্রতীক্ষারত বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর হাহাকার ব্যর্থ হবে না। বীরের রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা বিফলে যাবে না। জয় আমাদের সন্নিকট এবং সুনিশ্চিত। জয় বাংলা ।

 

(স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত)

Scroll to Top