১২। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো নরপশুরা (৩৭৪-৩৭৫)
সূত্র – দৈনিক বাংলা, ২০ জানুয়ারি ১৯৭২
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো নরপশুরা
ওরা যখন ওদের ফুপার রক্তাক্ত লাশ জড়িয়ে কাঁদছিল তখন পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনটি নরপিশাচ অট্টহাসি দিয়ে ওদের বিদ্রূপ করছিল।
২৭ শে মার্চ শনিবার। হানাদার বাহিনীর ৬টি জীপ ঢাকা থেকে নদী বন্দর নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে দীর্ঘ ১০ মাইল পথের দু’পাশেই চালিয়েছিল হত্যাযজ্ঞ। কামানের গোলা আর মর্টারের শেল দিয়ে জ্বালিয়ে একাকার করিয়ে দিয়েছিল অসংখ্য ঘর বাড়ী। অবশেষে নারায়ণগঞ্জ শহর উপকন্ঠে এসে জেটি মাসদাইরে প্রচন্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
পরে হানাদার দস্যুরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল নিরস্ত্র নিরীহ নারী-পুরুষের উপর।এতে অনেক জীবন অকালে ঝরে পড়ে পৃথিবীর বুক থেকে।মাসদাইরে ই ছিল জনাব জসিমুল হকের বাড়ি। তিনি ছিলেন জামিল ডকইয়ার্ড এর মালিক। নারায়নগঞ্জ শহরে সকলের পরিচিত।
জনাব জসিমুল হক ও তার স্ত্রী হত্যা সম্পর্কে কিছু জানার জন্য আমি তাদের মাসদাইর গ্রামের বাড়িতে যাই। বাড়িতে কেউ ছিল না। ছেলে মেয়েরা সবাই অন্যত্র আত্মীয়স্বজনের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। ঘটনাটি আমাকে জানিয়েছিল হীরা নামে একটি কিশোরী।
মিসেস হক তার ফুফু।হীরাও সেদিন জনাব হক এবং ফুফুর সাথে মৃত্যুর সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে আজও সেদিনকার ভয়ংকর দৃশ্য ছবি হয়ে আছে।কেমন করে হীরা বেচে গিয়েছিল এখন তা সে ভাল করে বলতে পারবে না।কিন্ত সেদিনকার ভয়ংকর দৃশ্য সে ভুলতে পারেনি মোটেই। হীরা বলেছিল ২৭শে মার্চ এর দুটোয় সাত আট- জন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িতে হানা দিয়ে চারিদিকে গুলি করতে থাকে।তখন ঘরের মেঝেতে আমরা সবাই শুয়ে পড়ি।
কিন্ত কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার সামনে রাইফেল ও এল,এমজি নিয়ে এসে হানাদারেরা গালাগালি দিতে দিতে আমাদেরকে ঘরের বাইরে আসতে বলে। আমরা একে একে বাইরে আসি।হানাদারেরা আমাদেরকে বাইরে এনে আংগিনায় দু’সারিতে দাঁড় করায়। পাশের বাড়ির লোকজনও ওদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। ওদের সবাইকে ওরা হত্যা করে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে। অবশ্য তার আগে টাকা পয়সা লুট করতে ওরা ভুলেনি। হীরার ফুফু আসমাও রেহাই পাননি। তার বুকে বেয়নেট চারজ করে পরে গুলী করে তাকে হত্যা করে।
আমি আর শেলী (ফুফাত বোন) তখন ফুফার লাশের কাছ থেকে বাড়ির ভিতরে ফুফুর খোজে এসে এই ঘটনার সম্মুখীন হই। আমাদের দেখে ফুফু আম্মা ডাক্তার ডাকতে বলে আলমারি থেকে “নভালজীন” ট্যাবলেট দিতে বলেছিলেন। তখন ফুফু আম্মার শরীর থেকে রক্তের স্রোত বইছিল। শেলী কাপড় চাপা দিয়ে ক্ষতস্থানের রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিল।আমি টেলিফোনে ডাক্তার ডাকছিলাম। ডাক্তার পেয়েছিলাম, কিন্ত এলাকাটার নিরাপত্তার কথা ভেবে ডাক্তার আসেননি। তখন চারিদিকে গোলাগুলির প্রচন্ড শব্দ আর মৃত্যুপথযাত্রীদের যন্ত্রণা ও চিৎকার যেন এক প্রলয় বইছিল বাইরে।
ইতিমধ্যে আমাদের অপর একটি ঘরে হানাদারেরা আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ফুফু আম্মা তখন বেদনায় গোংগাচ্ছিলেন। বাঁচার চেষ্টায় তিনি অস্থির। আমাকে তিনি পাক ঘর থেকে দুধ এনে দিতে বললেন। আমি দুধ এনে ফুফু আম্মার মুখের কাছে ধরলে অতি কষ্টে দুধ পান করে ফুফা কোথায় আছেন জিজ্ঞাসা করলেন।প্রথমে শেলী ফুফার মৃত্যু সংবাদ গোপন রাখতে চেয়েছিল। কিন্ত আমি ফুফু আম্মার অন্তিমকাল বুঝতে পেরে বলেছিলাম ফুফাকে ওরা মেরে ফেলেছে।
এ কথা শুনে ফুফু আম্মা একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আমাদেরকে শুধু বললেন, তোর ফুফার কবরের পাশে বাড়ির তেতুল গাছের তলায় আমাকে কবর দিস। সন্ধ্যার দিকে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।