৬৮। অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দেবদাস হয়ে বেঁচে আছেন (৪৬৭-৪৬৯)
সূত্র – দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ মে ১৯৭২।
হানাদারদের নির্যাতনের লক্ষ শিকারের অন্যতম মুজিবর রহমান আজ দেবদাস হয়ে বেঁচে আছেন
|| নজরুল ইসলাম বুলবুল ||
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অংক বিভাগের অধ্যাপক জনাব মুজিবুর রহমান পাক বাহিনীর অসহ্য নির্যাতনের স্বাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন। প্রতিদিনের মত ২৫-এর রাত্রিতেও বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বসে গল্প করছিলেন তিনি। রাত্রি গভীর হয়ে গেছে, কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য নেই কারো।
যাদের সঙ্গে গল্প করছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন হিন্দু অধ্যাপক। দেশে যে সামরিক নির্যাতন শুরু হয়ে গেছে তা কারো জানা ছিলো না। গভীর রাত। একদল লোকের বুটের শব্দ শুনে সবাই আৎকে উঠলেন। ইতিমধ্যে কয়েকজন পাক সৈন্য ঢুকে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। অধ্যাপকবৃন্দ তখনো বসে আছেন। সৈন্যরা কাছে এসে তাদের নাম জিজ্ঞেস করতে লাগলো। হিন্দু অধ্যাপকগণ নিজেদের মুসলমান নামে পরিচয় দিলেন। কিন্তু মুশকিলে পড়েছিলেন অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।
তিনি নিজেকে সে নামে পরিচয় দেবার সাথে সাথে সৈন্যরা তার উপর নির্যাতন চালায়। বেশ কিছুক্ষণ মারধর করে তারা চলে যায়। অধ্যাপক রহমানের একমাত্র দোষ, বঙ্গবন্ধুর নামের সাথে তার নামের মিল ছিলো। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। ৪ এপ্রিল মুক্তি মুক্তিবাহিনী রাজশাহী শহর ও বিশ্ববিদ্যায় এলাকা পাঞ্জাবীদের হাত থেকে মুক্ত করে।
১৩ এপ্রিল পাক বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের কর্তৃত্ব হারায়। এরপর শুরু হয় গণহত্যা ও নির্যাতন। ১৪ এপ্রিল ভাষা বিভাগের একমাত্র হিন্দু অধ্যাপক শ্রী সুখরঞ্জন সমদ্দারকে এবং ১৫ এপ্রিল অংক বিভাগের অধ্যাপক জনাব হাবিবুর রহমানকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
শহীদ সমদ্দার বাবুর মরদেহের অংশবিশেষ কাজলা গ্রাম থেকে উদ্ধার করা গেছে। কিন্তু শহীদ হাবিবুর রহমানের কোনো খবর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে থাকতেন। ২৫ মার্চের দুঃসহ বেদনা সহ্য করে তিনি নিজেকে অত্যন্ত অসহায় বোধ করছিলেন।
জনাব রহমানের বন্ধুবর্গ যারা হিন্দু ছিলেন তারা সবাই সীমান্ত অতিক্রম করেছেন। এসব কথা চিন্তা করে জনাব রহমান ক্রমেই মানসিক যন্ত্রণা করতে লাগলেন। ইসলাম রক্ষার জন্য পাক বাহিনী যে পন্থা অবলম্বন করেছিলো তা দেখে মুজিবুর রহমান সাহেব ধর্মের উপর আস্থা হারাতে বসেছিলেন। যদিও ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত তিনি একজন খাটি মুসলমান ছিলেন।
ইয়াহিয়া এবং তার লেলায়িত সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের উপর ইসলাম রক্ষার অজুহাতে যে অত্যাচার, গণহত্যা আর নির্যাতন চালিয়েছিলো তা দেখে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ধর্মের উপর আস্থা হারিয়ে ফেললেন। এই কারণে তিনি ১৯৭১ সালে ১০ মে তারিখে নিজেকে মুজিবুর রহমানের পরিবর্তে ‘দেবদাস’ নামে পরিচিত হন। তার এই নাম পরিবর্তনের কথা লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন এবং এরপর থেকে তার সাথে দেবদাস নামে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান। ১০ মে তারিখে অধ্যাপক রহমান নিজেকে ‘দেবদাস’ নামে পরিচিত করেন।
পাক সামরিক বাহিনী ঘটনাটি জানতে পায়। ১২ মে সামরিক কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক দেবদাসকে গ্রেফতার করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনের দোতলায় একটি ছোট্ট রুমে তাকে রাখা হয়। এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক দেবদাস আমাকে জানালেন যে, এখানে থাকা অবস্থায় সাধারণ সৈন্যরা তাকে অকথ্য নির্যাতন করেছে।
তার শরীরে, মাথায় বুটের লাথি মারা হতো। ১১ দিন ধরে অতিথি ভবনে তাকে নির্যাতন চালানো হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সহকর্মী বন্ধুই তার সাহায্যে এগিয়ে যাননি বলে তিনি আমাকে জানালেন।
ঐ সময় অতিথি ভবনে সামরিক অফিসারদের অফিস ছিলো। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাক বাহিনীর সহযোগী অধ্যাপক ডঃ বারী, ডঃ মকবুল হোসেন ডঃ মতিউর রহমানকে তিনি সামরিক অফিসারদের কাছে যাতায়াত করতে দেখতে পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্দী থাকাকালীন সামরিক অফিসাররা মোটামুটি ভাল ব্যবহারই দেখাতো। কিন্তু সাধারণ সৈন্যরা অকথ্য অত্যাচার চালাতো বলে অধ্যাপক দেবদাস জানালেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ দিন বন্দী রাখার পর একটি গাড়ীতে করে সামরিক কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক দেবদাসকে পাবনা নিয়ে যায়। পাবনায় তাকে ৩/৪ দিন রাখা হয়। এই সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ কাজী সালেহ আহমেদকেও তার সাথে নিয়ে যাওয়া হয়।
পাবনায় সামরিক অফিসাররা অধ্যাপক দেবদাসকে নানা রকম প্রশ্ন করেন। কিন্তু তিনি তাদের অন্যায় অত্যাচারকে মাথা পেতে নিতে অসম্মতি জানায়। যার ফলে তাকে সামরিক প্রহরায় নাটোরে পাঠানো হয়। নাটোরে তাকে পুলিশ লাইনে রাখা হয়। এখানে তাকে দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার চালানো হয়।
কিন্তু নিজের অত্যাচারের কথা অধ্যাপক দেবদাস কিছুতেই বলতে রাজী নন। শেষে কিছুটা মৃদু হেসে তিনি বললেন, ওরা আমার উপরে যে অত্যাচার করেছে তা বলে আর কি লাভ হবে। ওরা আমার সাথে বেশ ভালো ব্যবহার দেখিয়েছে, এই বলে তিনি চুপ করে রইলেন। বুঝতে পারলাম, অত্যধিক নির্যাতনের ফলে তিনি কথার খেই মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলেন। ঠিকমত খেয়াল করতে পারছেন না পূর্বের সব ঘটনা।
নাটোরে অধ্যাপক দেবদাসকে তিন মাস একটি ছোট্ট কামরায় বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার অপরাধের শাস্তিস্বরূপ নাটোর জেলখানায় তাকে আটক রাখা হচ্ছে। নাটোরে বন্দী থাকাকালীন সময়ে পাক সামরিক অফিসাররা অধ্যাপক দেবদাসকে কয়েকটি প্রশ্ন করে। সবগুলো প্রশ্নের কথা তিনি বর্তমানে মনে করতে পারছেন না। কিন্তু কয়েকটি প্রশ্নের কথা তার মনে আছে আজো।
তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “আপনাকে ছেড়ে দিলে আপনি কাজে যোগদান করবেন কি না”
উত্তরে অধ্যাপক দেবদাস বলিষ্ঠ কণ্ঠে জানান, “তোমাদের স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে আমি কাজে যোগ দিতে রাজী নই।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, ” আওয়ামী লীগকে বাতিল করা সম্পর্কে তোমার মতামত কি”।
উত্তরে তিনি জানান, “আওয়ামী লীগ ৬দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলো। সুতরাং আওয়ামী লীগকে বাতিল ঘোষণা করতে হলে নির্বাচনের পূর্বেই তা করা উচিৎ ছিলো। নির্বাচনের পরে তা বাতিল ঘোষণা করার অধিকার জনতা তোমাদের দেয়নি। তাই এটা করার মোটেই যুক্তিসঙ্গত হয়নি।
তৃতীয় প্রশ্ন ছিলো, “পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলে ভারত একে দখল করে নিবে কিনা”। উত্তরে জনাব দেবদাস জানান, “ভারতের পাশে আফগানিস্তান, কাশমীর ও বার্মার মতো ছোট ছোট রাষ্ট্র রয়েছে স্বাধীনভাবে। সুতরাং ভারত তাদের যদি দখল না করে থাকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তাকে দখল করবে না।”
নাটোরে বন্দী থাকার সময় যে বাবুর্চি তাকে খাবার দিয়ে যেতো সে ছিলো বাঙ্গালী। ঐ বাঙ্গালী মাঝে মাঝে বাইরের জগতের খোঁজখবর ও সিগারেট এনে দিত বলে অধ্যাপক দেবদাস আমাকে জানালেন। এছাড়া নাটোরের ছোট দারোগা ছিলো বাঙালি। সেও মাঝে মাঝে গোপনে দেখা করতো।
নাটোর জেলে বন্দী থাকাকালে অধ্যাপক দেবদাস মিলিটারীর সরাসরি হাত থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছিলেন। জেলখানার পাশের একটি বাসার আনোয়ার নামে একজন ছাত্র তার পরিচিত ছিলো। আনোয়ার তার পরিচিত অধ্যাপককে বন্দী দেখতে পেয়ে গোপনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং তার বন্দী থাকার সংবাদটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্রামের বাড়ীতে পৌঁছে দেয়।
নাটোরে দীর্ঘ তিন মাস বন্দী থাকার পর ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। অধ্যাপক দেবদাস মুক্তি পেয়ে জয়পুরহাটে চলে যান এবং দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত জয়পুরহাটে বোনের কাছে থাকেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ফিরে এসেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি কাজে যোগ দেননি। কাজে যোগদানের ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি হেসে উত্তর দেন, “কি হবে কাজে যোগ দিয়ে।” বিগত নয় মাসের বেতনও তিনি এ পর্যন্ত নেননি।
অত্যধিক নির্যাতনের ফলে অধ্যাপক দেবদাস বর্তমানে গুরুতররূপে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মাঝে মাঝে তিনি জ্বরে ভুগছেন। মাথায় মিলিটারীর বুটের আঘাতের ফলে তার মস্তিস্কের গোলযোগ দেখা দিয়েছে। পূর্বের কোনো স্মৃতিকে তিনি ভালভাবে স্মরণ করতে পারছেন না। এছাড়া বেশিক্ষণ কথা বলতেও তার পক্ষে কষ্ট হয়। এ অবস্থায় তিনি পুনরায় অধ্যাপনার কাজে অংশ নিতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। অধ্যাপক মুজিবুর রহমান দেবদাস নামে এখনো নিজের পরিচয় দিচ্ছেন।
জনাব মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংক শাস্ত্রে এম এ পাশ করেন। ১৯৬৪ সনে তিনি মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংক শাস্ত্রে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। করাচী ও সিলেট সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৭ সনে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।