অপারেশন জ্যাকপট

অপারেশন জ্যাকপট

 

ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৬ই মে বিএসএফ এর নিকট থেকে বাংলাদেশে পূর্ণ সামরিক তৎপরতা  চালাবার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এক সপ্তাহ পরে ২৩শে মে ভাগীরথী নদীর তীরে একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়। এই ক্যাম্পের অবস্থান ছিল পলাশী স্মৃতিসৌধের পাশে। এর সাংকেতিক নাম দেওয়া হল ক্যাম্প ‘ সি২পি’।ক্যাম্পের জন্য লোক সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসাররা বিভিন্ন যুবশিবির সফরে বেরিয়ে পড়েন। আমার ক্যাম্পে আগত নৌবাহিনীর অফিসার বললেন,’’ আমি কয়েকজন নিপুণ সাঁতারু বাছাই করতে চাই, তাদেরকে তরুণ এবন ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। জুন মাসের মধ্যে ১৫০ জন স্বেচ্ছাসেবকের প্রথম দলটি বাছাই করে ‘ সি২পি’ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। আগস্টের মধ্যে এরা কঠোর এবং শ্রমসাধ্য ট্রেনিং সম্পন্ন করে। পুরো ব্যাপারটাই ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর দায়িত্বে।

 

বাংলাদেশে নৌপথে সৈন্য এবং অন্যান্য সমর সরঞ্জাম পরিবহনের ব্যবস্থা বানচাল করার উদ্দেশ্যে জাহাজ এবং নৌযান ধ্বংস করাই ছিল এই উদ্যোগের লক্ষ্য অল্প খরচে দ্রুত লক্ষ্য অর্জনে পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক দরকার ছিল যাদেরকে সাঁতারের এবং লিমপেট মাইনসহ বিভিন্ন প্রকার বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের  ট্রেনিং দেওয়া যেতে পারে।এ কাজের জন্য উচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকদের নিয়ে একটা বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় এ বিশয়ে বিস্তারিত কর্মসূচী প্রণীত হয় নৌবাহিনীর হেডকোয়াটারে। পরিকল্পনা অনুসারে চট্টগ্রামও মংলার সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর, দাউদকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ নগরবাড়ি, খুলনা, বরিশাল গোয়ালন্দ, ফুলছড়িঘাট এবং আরিচা ঘাটের নদীবন্দরগুলোর উপর সরাসরি আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।অভিযানের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়’ অপারেশন জ্যাকপট’। অপারেশন  কার্যকরী করার চূড়ান্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় সংশিষ্ট সেক্টর কমান্ডারদের উপর।

 

২৮শে জুলাই আমি ডেল্টা সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং এর সাথে বসে চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম। চার ঘণ্টারও বেশী সময় আমরা বিস্তারিত আলোচনা করি এবং চট্টগ্রাম নদীবন্দর ও কর্ণফুলী নদীর ম্যাপও চার্ট পর্যালোচনা করি।চন্দ্রতিথি আবহাওয়ার অবস্থা, জোয়ার ভাটার সময়, বাতাসের গতিপ্রকৃতি, স্রোতের গতি এবং আরও অসংখ্য তথ্য আমাদের আলোচনায় প্রাধান্য লাভ করে। মে মাস থেকেই বন্দরের তৎপরতা সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। আমরা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বন্দর এলাকা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার চিত্রও পেয়ে যাই। অপারেশনে আমাদের নৌ-মুক্তিযোদ্ধার কোথায় কি ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে তাও আমরা বিশদভাবে আলোচনা করি। বন্দরের জন্য পাকবাহিনী কি ধরণের রক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং সন্ত্রাসীরা কোথায় কিভাবে পাহারার ব্যাবস্থা করেছে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। সে সময়ে রাতের বেলায় নদীমুখে সকল প্রকার নৌ চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। প্রধান কয়েকটি গানবোট নিয়মিত টহলকার্যে নিযুক্ত ছিল। আমাদের পরিকল্পনা গোপন রাখতে পারলে এসব বাধা তেমন কোনই সমস্যা নয়। ঠিক হল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ১৪ই আগস্টে ৬০ জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত তরুণ চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হল। রাতে তারা সাঁতার কেটে কর্ণফুলী পাড়ি দিয়ে যতবেশী  সংখ্যক জাহাজে গিয়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দেবে।তারপর তারা ভাটার টানে দুরে সরে যাবে।

 

১০ আগস্ট ‘অপারেশন জ্যাকপট’ শুরু হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য  বাছাইকৃত ৬০ জন তরুণকে তিন ভাগে ভাগ করি। ১ এবং২ নম্বর গ্রুপ স্থলপথে মিরেশ্বরাই এবং চট্টগ্রাম শহর হয়ে কর্ণফুলী পূর্বপাড় চরলাক্ষার সর্বশেষ ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছাবে। ৩নম্বর গ্রুপ চারলাক্ষার উপনীত হবে নৌকাযোগে। তিনটি গ্রুপেরই সার্বিক কমান্ডে থাকবেন একজন  কমান্ডার। তাদের সকলের কাছে থাকবে লিমপেট মাইন, একজোড়া ফিন( সাঁতারের সময় পায়ে লাগানোর জন্য) এবং শুকনো খাবার। প্রতি তিনজনের কাছে একটি করে স্টেনগান থাকবে। সার্বিক দায়িত্বে নিযুক্ত গ্রুপ কমান্ডারকে দেওয়া হয় হালকা অথচ শক্তিশালী একটি ট্টানজিস্টর সেট। তার জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রের প্রতিটি সঙ্গীতানুষ্ঠান তাকে শুনতে হতো খুব মন দিয়ে। এতে ব্যর্থ হলে সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।

 

৯ আগস্টে হরিণা ক্যাম্পে তাদের চূড়ান্ত নির্দেশ দেই।পথপ্রদর্শক এবং কুলীসহ তাদের সকলকে বলে দেওয়া হয় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কিভাবে অগ্রসর হতে হয়, পথে কোথায় কোথায় থামবে ইত্যাদি। প্রতিটি এলাকায় আমাদের বিশ্বস্ত গেরিলা বেস কমান্ডারের ঠিকানা দিয়ে দেওয়া হয় এরা তরুণদের খাদ্যও  আশ্রয় দেবে এবং চরলাক্ষা যাওয়ার পথে ব্যবস্থা করবে। ১৩ই আগস্ট১নম্বরও২ নম্বর গ্রুপ চারলাক্ষার পূর্ববর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে যায়। জায়গাটি চট্টগ্রামের কাছেই। পথে অবশিষ্ট অংশটুকু এদের জন্য খুবই মারাত্মক কারণ তাদেরকে শহরের ভেতর দিয়ে নৌকা দিয়ে নদী  পার হতে হবে। তারপরই তাদের শেষঘাঁটি চরলাক্ষা।

 

এদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তান দখলদারবাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনী সাংঘাতিক আক্রমণ চালাবে। একারণে শত্রুরা ছিল পুরো সতর্ক অবস্থায়। সারারাত ধরে কারফিউ চলতো। লোকজনকে তল্লাশির জন্য পথে মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছিলো অসংখ্য চেকপোস্ট। মেশিনগান ফিট করা আর্মি জীপগুলো সারা শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। নতুন করে আবার বাড়ি বাড়ি তল্লাশি শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকা ঘেরাও দিয়েও অভিযান চালানো হয়।পথচারী সবাইকে কঠিন তল্লাশি শুরু হয়।এতসব তল্লাশি ফাঁকি দিয়ে শহরের মাঝখান দিয়ে পার হতে হবে ১নম্বরও ২নম্বর গ্রুপকে তারপর আছে নদী পার হওয়ার সময় তল্লাশির ঝামেলা। সেটি পার হলে আশা আছে সময়মত এই দুই গ্রুপ চরলাক্ষায় পৌঁছে যাবে। কিন্ত কনকারণে যদি দলের একজনও ধরা পড়ে তাহলে সমস্ত অভিযান বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা। তাই হামলাকারী দলের নেতাও আমাদের মত চিন্তিত ছিল।

 

আরও একটি কারণে এই দলের নেতা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নৌকায় করে ৩নম্বর গ্রুপটি ১৩নপম্বর ঘাঁটিতে পৌঁছার কথা ছিল, তারা সে ঘাঁটিতে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। এদিকে১৩ আগস্ট কলকাতা রেডিওর সঙ্গীতানুষ্ঠান শোনার ট্টানজিস্টর খুলতেই তার কানে ভেসে এলো পুরনো দিনের বাংলা গান’’ আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ী’’। এগানের ভেতর দিয়ে সে এবং তার দল প্রথম সংকেত লাভ করে। কমান্ডার জানে,আগামী২৪ ঘণ্টার আরেকটি গান সে শুনতে পাবে। ওটি শোনার পর সে ট্টানজিস্টর ফেলে দিতে পারবে। ‘ অপারেশন জ্যাকপট সফল না হওয়া পর্যন্ত তাদের আর কোন গান শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রেডিও শুনতে হবেনা।

 

নগরীতে মোতায়েন আমদের লোকেরা চমৎকারভাবে দায়িত্ব পালন করছিলো। তারা মিশনের নৌ-মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে একেবারে চরলাক্ষায় পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করে দেয় । রাস্তায় একটি এ্যাম্বুলেন্স এবং বিদ্যুৎ বিভাগের একটি পিকআপ দেখতে পেলেও পাকিস্তানী সৈন্যদের মনে তেমন প্রশ্ন জাগেনি। শুধু তাই নয়, পাকবাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে গেঁয়ো পোশাকপরা একদল লোক ফলমূল, মাছ, চাউল এবং লবণের ঝুড়ি নিয়ে ফেরী নৌকায় উঠলো এবং চালক যখন নিশ্চিত মনে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে কর্ণফুলীতে পাড়ি জমালো তখনও পাকিস্তানীরা কিছুই বুঝতে পারেনি। সবাই ভেবেছিলো বাজার সেরে বাড়ি ফিরছে। এইসব হাঁটুরে সওদার জন্যই আগেই তাদেরকে টাকাপয়সা দেওয়া হয়েছিলো । প্রতিটি ঝুড়ির একেবারে তলায় চটের থলেতে ছিল লিমপেট মাইন, ফিনা ইত্যাদি। আবার কোনটায় ছিল স্টেনগান।

 

১৪ই আগস্ট রেডিওতে দ্বিতীয় বাংলা গানটি শোনা গেলোঃ’’ আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম তার বদলে চাইনি কোন দান।‘’ আসলে এটা ছিল সাংকেতিক সংকেত। যার ফলে সেই রাতেই নৌ-মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানী জাহাজসমূহে আঘাত করার কথা।

 

কিন্ত দুর্ভাগ্য এই দলের অভিযান একদিন পিছিয়ে গেলো।৩ নম্বর গ্রুপ ছাড়া সকলেই রাতের মধ্যে চরলাক্ষায় পৌঁছে গিয়েছিলো। ৩ নম্বর গ্রুপের যোদ্ধারা প্রায় ৮০ মাইল হেঁটে আসার পর ১৪ই আগস্ট একদিন তাদের বিশ্রাম দরকার।দিনের আলোতে কিছুটা রেকিও করা দরকার। লক্ষ্যবস্তগুলো প্রতিটি সদস্যের দেখা উচিত। যেখান দিয়ে তারা পানিতে নামবে এবং কাজ শেষ করে যেখানে তাদের উঠতে হবে সেসব জায়গাও আগে থেকে তাদের দেখে রাখতে হবে। তাই একেবারে তাড়াতাড়ি করলেও পরবর্তী রাতের আগে আর কিছু হচ্ছেনা।

 

১৪ই আগস্ট এখানে কিছু না ঘটলেও শত্রপক্ষের জন্য সময়টি খুব স্বস্তির ছিলোনা। সারারাত্রি সমগ্র সীমান্ত এলাকা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে আমাদের যোদ্ধারা অসংখ্য আক্রমণ চালায়। আমাদের হতাশাগ্রস্তও জনগণও চাইছিলেন ১৪ই আগস্ট তাদের ছেলেরা কিছু একটা করুক। এমন কিছু করুক যাতে পাকিস্তানীদের উচিত শিক্ষা হতে পারে।

 

১৫ই আগস্ট চরলাক্ষায় আমাদের৪০ জন তরুণ যাদের অধিকাংশেরই বয়স বিশের কোটা পার হয়নি- তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে স্বল্পক্ষণের একটি ঘুম দেয়।

 

রাত ১টা। বন্দরনগরী পুরো নিদ্রামগ্ন। শান্ত নদীতে স্রোতের কুলুকুলু ধ্বনি। নিঃশব্দে ওরা নদীরপাড়ের দিকে দ্রুত  এগিয়ে যায়।অপর পাড়ের জেটিগুলো তখন বিদ্যুৎ আলোয় ঝলমল করছিল। সার্চলাইট ফেলে নদীর ওপর লক্ষ্য রাখছিল   সান্ত্রীরা। ওরা ক্লান্ত। হয়ত ঘুমেঘুমে ঢুলুঢুলু।

 

১৪ই আগস্ট এবং তার পূর্ববর্তী কয়েকদিন পাকিস্তানীদের উপর বেশ বড়রকমের ধকল গেছে। এরাতে তাদের সকলেই যেন একটু নিশ্চিন্ত। পাকা প্লাটফরমের উপর লম্বা ক্রেনের ছায়াগুলো যেন ভৌতিক মনে হয়। তবে সান্ত্রীরা এই ছায়া চেনে। নদীর দিক থেকে তাদের ভয়ের কোন আশংকা নেই।কোন নৌকা কিংবা সাম্পান জাহাজের দিকে অগ্রসর করতে চাইলেই দেখা যাবে। সেক্ষেত্রে দূরপাল্লার কয়েকটি অস্ত্রের রাউন্ডই যথেষ্ট। কিন্ত তেমন কখনই ঘটেনি।

 

এমভি আল- আববাস এসেছে৯ই আগস্ট।১২নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা এই জাহাজ ১০,৪১০ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে।

 

একখানি বার্জে (ওরিয়েন্ট বার্জ নম্বর৬) ২৭৬ টন অস্ত্রশস্ত্রও গোলাবারুদ বোঝাই করে করে মৎস্য বন্দরের জেটির সামনে রাখা আছে। এটাকে ট্রেনে ঢাকা নিয়ে যাওয়া  হবে। 

 

এমভি হরমুজ ১৪ই আগস্ট চট্টগ্রাম পৌঁছেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে৯,৯১০ টন সমরসম্ভার।১৩ নম্বর জেটিতে জাহাজটি ভেড়ানো।

 

আরও কয়েকখানি জাহাজও বার্জ এদিকওদিক রয়েছে। নেভাল জেটিতে ছিল দুটি  গানবোট এবং একখানি বার্জ। সন্ধার পরি গানবোট দুটি অজ্ঞাতস্থানের উদ্দেশ্য রওনা হয়ে যায়। আমাদের ছেলেদের কপাল খারাপ। এমন সুন্দর দুটি শিকার হাতছাড়া হল। রাত সোয়া আটটা। আল-আববাসও হরমুজের মাস্টার এবং ক্রুরা গভীর নিদ্রায় অচেতন। মিলিটারি এবং সান্ত্রীরা আধো ঘুম আধো জাগরণে ঢুলছে। রাত দুইটা বাজলে তাদের ডিউটি শেষ। আর মাত্র ৪৫ মিনিট বাকী। তারপর অন্যরা আসবে।

 

মাথাটা পানির উপর রেখে আমাদের ছেলেরা যার যার লক্ষ্যবস্তর কাছে পৌঁছে গেছে। কালবিলম্ব না করে তারা জাহাজগুলোর গায়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দিয়ে আবার তেমনি নিঃশব্দে নদীর ভাটিতে ভেসে যায়। আর দক্ষিণে সরে গিয়ে তারা পূর্বতীরে উঠে পড়ে। রাত পোহাতে তখনওঅনেক বাকি।নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার পর্যাপ্ত সময় তারা পেয়ে যায়।সকাল নাগাদ তারা পটিয়া এবং  সেখানে সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে১নম্বর সেক্টর হেডকোয়াটার হরিণার  উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে।

 

রাত১টা ৪০মিনিট। হঠাৎ কান ফাটানো আওয়াজে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কেঁপে উঠে। লোকজন শয্যা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে। শিশুরা ভয়ে কান্না করছে। কিন্ত কি ঘটছে তা কেউ বলতে পারেনা।

 

রাত১টা৪৫ মিনিট। আরেকটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তারপর তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম । একটির পর একটি বিস্ফোরণে চট্টগ্রাম তখন থরথর করে কাঁপছে। আতংক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।সান্ত্রীরা দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুলি ছুঁড়তে শুরু করে।৬ নম্বর ওরিয়েন্ট বার্জ দেখতে না দেখতে তলিয়ে গেলো।আল-আববাস এবং হরমুজও দ্রুত ডুবতে থাকে। জাহাজের খোলে প্রচণ্ড বেগে তখন পানি ঢুকছে। আশেপাশের বার্জগুলোও তখন ক্ষতিগ্রস্ত। বিস্ফোরণে জাহাজের ক্রুদেরও  অনেকে হতাহত হয় কিন্ত ভয়ে কেউ সাহায্যের জন্য ওদিকে অগ্রসর হচ্ছেনা, পাছে আবার বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায়।

 

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সিনিয়র অফিসাররা বন্দরে গিয়ে উপস্থিত হন। সমগ্র এলাকায় সান্ধ্য আইন জারি করা হল। মুক্তিবাহিনীর খোঁজে হেলিকপ্টারগুলো আকাশে উড়ে গেছে। পাকিস্তানীরা তাদের জিঘাংসা মেটাতে নদীর পূর্বপাড়ের জনপদগুলোর উপর নির্বিচারে কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। নদীর পাড়ের গ্রামগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সন্দেহের বশবর্তী নিরাপদ গ্রামবাসী এবং জেলেদের ধরে এনে মুক্তিবাহিনীর খবর বের করার চেষ্টা করা হয়। শেষে কিছু না পেয়ে তাদের নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিরস্ত্র গ্রামবাসী আর জেলেদের লাশগুলো স্রোতের টানে ভেসে চলে সমদ্রের দিকে।

 

পটিয়াতে আমাদের যোদ্ধারা তখন বিশ্রাম নিচ্ছিল। তারা একটি অতিবিপদজনকও জটিল মিশন সফল করেছে। তাদের এই সফল অভিযান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

 

ভোর তখন পাঁচটা। ঢাকাস্থ ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়াটারের অপারেশন রুমের কর্তব্যরত স্টাফ অফিসার  ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ না করেই সত্ত্বর ঘটনা সম্পর্কে কোর কমান্ডারকে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেন। গেরিলাদের চাঁদপুর এবং মংলা বন্দরের হামলার খবরও কুমিল্লাও যশোর সেনানিবাস থেকে তড়িৎ  গতিতে হেড কোয়াটারে পাঠানো হয়। এই সকল আক্রমণে একদিকে শত্রুর যেমন বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়, অপরদিকে পাকিস্তানীদের মিথ্যা দম্ভ আর অহমিক হয় ধূলিসাৎ। অপারেশন জ্যাকপট সফল হয় পুরোপুরিভাবে।

 

এই দিনের ঘটনা সম্পর্কে ১৬ই আগস্ট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তদন্ত রিপোর্টে লেখা হয়েছিলোঃ

 

‘’পরিস্থিতি পর্যালোচনার প্রেক্ষাপটে জাহাজের কোন ব্যক্তিকেই দায়ী করা চলেনা। কারণ পূর্ব থেকে কিছুই টের পাওয়া যায়নি এবং গেরিলারা যে এমন ধরণের অভিযান চালাতে পারে তা আগে থেকে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। অবশ্য নদীর দিকটা ভাল করে দেখাশোনা করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দিন রাত্রির কোন সময়েই নৌকা ইত্যাদি আর জাহাজগুলোকে  ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছেনা।‘’(পাক সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত)

 

সামুদ্রিকও নদীবন্দরগুলোর উপর এই চমকপ্রদ হামলা পাকিস্তানীদের হতচকিত করে দিয়েছিলো। এমন দুঃসাহসিক অভিযান চালাতে পারে এটা ছিল পাকিস্তানীদের চিন্তারও বাইরে। এই হামলার আগ পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ –পদ্ধতি সম্পর্কে পাকিস্তানীরা মোটামুটি পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। সারা দেশজুড়ে এ  সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা ছোট ছোট হামলা চালায়। কিন্ত জুন-জুলাই মাসের এই ছোট ছোট হামলাগুলি ছিল কম তাৎপর্যপূর্ণ।হ্যান্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ , শত্রুর গাড়ি ধ্বংস , রাজাকার, দালাল,শান্তিবাহিনী বা আলবদর, আলশামস এর লোকজন হত্যার মধ্যে এসময়ের ঘটনাবলী সীমাবদ্ধ ছিল। কোন গুরুত্বপূর্ণ লক্ষবস্তর উপর তখনও হামলা চালানো হয়নি শত্রপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিল তখন পর্যন্ত অক্ষত। এমনকি নেতৃস্থানীয় বাঙ্গালী দালালরা পর্যন্ত বেশ আয়েশের সাথে তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলো। মাঝে-মধ্যে এদের মধ্যে কয়েকটি পরিকল্পনাহীন হামলা হলেও তা ব্যর্থ হয়ে গেছে।মাঝখান থেকে গেরিলারা ধরা পড়ে পাকিস্তানীদের হাতে প্রাণ দিয়েছে।

রণকৌশলের দিক থেকে শত্রপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রসমূহ বিভিন্ন হেডকোয়াটার,অফিসার মেস, অস্ত্রও রসদ গুদাম, বিদ্যুৎ ও জালানি কেন্দ্র, বন্দর, রেলওয়ে এসবের উপর আগস্ট পর্যন্ত কোন সুপরিকল্পিত হামলা হয়নি। ফলে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে বাংলাদেশ প্রশ্ন প্রায় মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের এবং দেশের মানুষের মনোবল কিছুটা যেন  ভেঙ্গে পড়ে।

 

অন্যদিকে পাকবাহিনীর অবস্থা তখন বেশ সুবিধাজনক। যুদ্ধের প্রথমদিকে আমাদের নিয়মিতবাহিনী তাদের বেশকিছু ক্ষতি করেছিলো। শত্রুপক্ষের হতাহতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে মোটামুটি জানা যায় যে, পাঁচ থেকে ছয় হাজার শত্রুসৈন্য নিহত এবং তখন আট থেকে দশ হাজার আহত হয়েছিলো। আহতদের মধ্যে এক- তৃতীয়াংশ পুনরায় যুদ্ধ করার অনুপযুক্ত হয়েছিলো।

 

সামরিকভাবে গেরিলা তৎপরতা সন্তোষজনক না হলেও আমরা ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই আশাবাদী ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ প্রচলিত পদ্ধতিতে ট্রেনিং পেতো এবং ট্রেনিং শেষ করেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদেরকে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতে হতো।তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবারই বয়স কম, আবেগ বেশী। কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী। এরা প্রত্যেকেই গ্রুপলিডার কিংবা ঐ ধরণের কিছু একটা হতে চাইতো। এটা বুঝতে চাইত না সবাই লিডার হলে অনুসারী কোথা থেকে আসবে। অবশ্য যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এর চাইতে বেশি কিছু আমাদের আশা করার ছিল না।

 

এমনি যখন আমাদের অবস্থা যে সময়ে অপারেশন জ্যাকপট এর সাফল্য প্রমাণ করেছিলো যে, যথাযথ শিক্ষা এবং নেতৃত্ব দিতে পারলে আমাদের ছেলেরাও অবিশ্বাস্য কাজ করতে পারে। তাদের মধ্যে আন্তরিকতার কোন অভাব ছিলোনা।তারা বুদ্ধিমান, কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে দ্রুত তা বুঝে নিতেও সক্ষম। তাদের মানসিক উৎকর্ষ ছিল নিঃসন্দেহে নিরক্ষর পাকিস্তানী সৈন্যদের চাইতে উত্তম। শিক্ষিত এক বিরাট গেরিলাবাহিনী আমরা পেয়ে ছিলাম, এটা আমাদের সৌভাগ্য।

 

সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিমাসে ২০ হাজার গেরিলাকে ট্রেনিং প্রদান করে তাদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই হিসেবে ৭১ এর ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে গেরিলার সংখ্যা আনুমান করা হয় এক  লাখের উপরে। এদের মধ্যে শতকরা৩০ ভাগ যথাযথভাবে কাজ করলেওপাকবাহিনীর পরিকল্পনায় একটা ভাঙ্গন ধরানো সম্ভব। এই পরিস্থিতিতে গেরিলাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে। আর চূড়ান্ত আঘাত আনার সেটাই সুবর্ণ সুযোগ। একদিকে যেমন চলছিল এসব পরিকল্পনা, অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে ভারতও পাকিস্তান ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছিল  একটা অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের দিকে।

Scroll to Top