শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২। অবস্থা সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে | বাল্টিমোর সান | ২৮ মার্চ, ১৯৭১ |
<১৪, ২, ৪–৭>
দি বাল্টিমোর সান-মার্চ ২৮, ১৯৭১
অবস্থা সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে
-জন ই. উড্রাফ
দুইদিনের গোলাগুলি ও জ্বালাও পোড়ানোর পরে, ঢাকাকে একটি বারুদ আর অগ্নিশিখার শহরে পরিনত করে পূর্ব পাকিস্তানি সেনারা সহসাই পশ্চিম পাকিস্তানিদের গ্রেফতার করে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায় ।
এর মধ্যে রাষ্ট্রপতি এ ম ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দেন গত রাতে তার সতর্কতা শেষ হয়েছে, দুই বছর ব্যাপী গণতন্ত্রের উপর চালানো পরীক্ষা, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীর দখল নিতে সেনাবাহিনীর এরই মধ্যে গোলাগুলি, সকল অভিমুখে আগুন ছড়ান, এবং শেখ মুজিবর রহমানের জন্য জনগনের সমর্থন, পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি জনতার নির্বাচিত নেতা এখন জেলে।
স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সব হামলার মধ্যে খুব কমই শোনা যেত যা পরিষ্কারভাবে জানান দিত যে কেউ একজন সেনাবাহিনীর গুলি থেকে বেঁচে ফিরছে।
অল্প কিছু ঘটনার সাক্ষী সাংবাদিকদের মতে, সৈনিকরা কোন পূর্ব সতর্কতা না জানিয়ে শুন্য হাতের নাগরিকদের উপর ভারী অস্ত্র নিয়ে হামলা চালাত। মৃত্যু বা কি ঘটল তা নিশ্চিত হওয়া যেত না।
কথাবার্তার ভাঙ্গনের চেয়েও জরুরী প্রথম যে চিহ্নটি পাওয়া গেল তা আসলো একটি রিপোর্টের মাধ্যমে যা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় ভারী পাঁচিলে ঘেরা রাষ্ট্রপতি ভবনে বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে রেখে যায়। গেটে দুই ঘণ্টা ব্যাপী অনুসন্ধানের পরে জানা গেল, সেনা বিচ্যুতির দায়িত্বে সেখানে থাকা বেসামরিক রক্ষীর জবাবে, “ এই প্রশ্ন করার জন্য এটা খুব খারাপ সময় ( রাষ্ট্রপতির খোঁজ জানা)”
রাত ১১ টার দিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সৈন্যরা সাংবাদিকদের ধরতে লাগল এবং তাদের গুলির ভয় দেখিয়ে ভিতরে যাবার আদেশ দিল। শহরের বিভিন্ন জায়গায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে আবার গোলাগুলি শুরু হল। কাল রাত ১২ টা ২০ মিনিটে শেখ মুজিবের ঘরে করা টেলিফোনের উত্তরে একটি শান্ত কণ্ঠ বলল শেখ বিছানায়।
আজ সকালে করাচি রেডিও শেখ মুজিবরের খোঁজ সম্পর্কে প্রথম নির্দিষ্ট করে বলল, দাবি করা হচ্ছে প্রায় এক ঘণ্টা আগে শেখ মুজিব ও তার পাঁচ জন লেফটেন্যান্ট সহ গ্রেফতার হয়েছে সেই ফোন কলের ১০ মিনিট পরে। কল করার দশ মিনিট পরে হোটেলের সেই টেলিফোন ডেড হয়।
এদিকে হোটেলে সৈন্যরা আসে পাশে ওড়া বাংলাদেশের সবুজ, লাল ও সোনালি পতাকা ছিড়ে ফেলে এবং তা পুড়িয়ে দেয়।
শুক্রবার রাত ১ টার দিকে প্রথম কামানের শব্দ শোনা যায় যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পের দিকে এগোচ্ছিল যেখানে বাঙ্গালী ছাত্র নেতারা দীর্ঘ সময় ধরে সক্রিয় ছিল।
প্রায় ২৫ থেকে ৩০ সৈন্য বোঝাই ট্রাক হোটেলের পাশ দিয়ে দেড় মাইল দূরে ক্যাম্পাসের দিকে এগোচ্ছিল। কিছুক্ষন পরেই ক্যাম্পাসের দিক থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ শোনা গেল।
রাত ২ টা থেকে ২.৩০ এর দিকে আরো কয়েকটা কামান বসানো হল, দুটি বড় দালান জ্বালিয়ে দেয়া হল, রাত বিপুল আলোকছটায় ছেয়ে গেল। বাঙ্গালী সাংবাদিকরা হোটেলের ১০ম তলার জানালা দিয়ে দেখে সেটাকে ইকবাল ও মহসিন হল চিহ্নিত করল যা ছিল আওয়ামী লীগ ছাত্রদের কর্ম ঘাঁটি।
রাত প্রায় ২ টা ১৫ তে সেনারা হোটেল ছেড়ে রাস্তার ওধারে একটি সরু গলিতে নিঃস্ব প্রায় কিন্তু জনপ্রিয় একটি ইংরেজি সংবাদপত্রের অফিসের দিকে এগোচ্ছিল। লোকজন স্পষ্টভাষায় এবং প্রায় দায়িত্বহীন ভাবে সরকারকে গালাগাল শুরু করে।
গলির মধ্যে একটি ধ্বংস হওয়া গ্যারেজ থেকে দুটি ধ্বংসপ্রাপ্ত গাড়ি উদ্ধার করা হয় যা আগে থেকেই উপস্থিতমতো একটি ব্যারিকেডের মধ্যে টেনে নেয়া হয়েছিল, এবং সৈন্যরা চলে যাওয়ার আগে তা বিনাশ করার জন্য শত গুলি চালায়। এক পর্যায়ে গ্যারাজের দ্বিতীয় তলা থেকে চিৎকার শোনা যায় “বাঙ্গালী এক হও’”, জবাবে সৈন্যরা রাইফেল ও মেশিনগানের শত শত গুলি ছোড়ে।
এই পর্যায়ে প্রায় ১৫ জন ছাত্র খালি হাতে হোটেলের পাশে বীথিকায় নেমে আসে এবং ক্ষোভের সাথে চিৎকার করতে থাকে।
সৈন্যরা জীপ ঘোরায় এবং যুবকদের দিকে মেশিনগান তাক করে গুলি শুরু করে, সৈন্য ভর্তি জীপ পিছে রেখে ছাত্ররা ভয়ে পালিয়ে যায়।
এরপর সেনারা যেখান থেকে একতার শ্লোগান আসছিলো সেই গ্যারাজে ফিরে যায়। তারা দরজা ভেঙ্গে কয়েকজনকে ভিতরে ঢোকায়। এর কিছুক্ষনের মধ্যেই দরজার কাছে অল্প আগুন জ্বলতে দেখা যায়। সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং গ্যারাজের সর্বত্র ছড়িয়ে যায়।
সেনারা গুলি করতে করতে গলি দিয়ে পালিয়ে সংবাদপত্রের অফিসের দিকে যায়।
যখন তারা ভিতরে পৌঁছায়, তারা চিৎকার করে সাবধান করে কিন্তু তারা পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দুতে বলছিল, যা পূর্ব পাকিস্তানে খুব বেশি বোধগম্য ছিলনা। কেউ গেলনা, সেনারা ভবনের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করল এবং এর মধ্যে শত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও মেশিনগান ছেড়ে দিল।
দরজা ভেঙ্গে তারা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পাশের রুমে প্রবেশ করলো। হোটেলে ফেরার সময় সেনারা চিৎকার করে বলছিল “নারায়ে তাকবির” একটি মুসলিম শ্লোগান যার অর্থ “সৃষ্টিকর্তার জয়” যা পাকিস্তানি আচরণের সাথে সম্পৃক্ত।
তারা আরো চিৎকার করে উর্দুতে বলল “আমরা যুদ্ধ জয় করেছি”। রাত প্রায় চারটার দিকে তাদের দুইজন ভিতরে আসলো এক জগ চা নিতে।
এর মধ্যে সব দিক দিয়ে প্রায় হাফ ডজন আগুন ঝলসে উঠলো, এবং প্রায় ৪.১৫ এর দিকে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ক্যান্টনমেন্ট থেকে সবচেয়ে বড় আগুন জ্বলে উঠলো। ঘণ্টা ব্যাপি এই আগুন জ্বলে আর প্রথম আধা ঘণ্টা ধরে গোলাবারুদের ফুলকি উড়তে দেখা যায়। দুই একরেরও বেশি জায়গা জুড়ে এর আলো ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের শিখা ও ধোঁয়ায় আকাশ বাতাস ছেয়ে যায়।
রাত প্রায় ৫.২০ মিনিটে ছয়টি চাইনিজ টি-৫৪ ট্যাঙ্ক গর্জন করে হোটেলে আসে এবং প্রায় ২০ মিনিট সেখানে অবস্থান করে। এগুলোর মধ্যে একটার কামান সরাসরি হোটেলের কর্নার বরাবর সর্বক্ষণ তাক করানো ছিল। এরপর শীঘ্রই একটি বড় ট্রাক আসে যেটার বডিতে কয়েক ফুট গভীর আমেরিকার তৈরি কারবাইন্স ও কম্যুনিস্ট- ব্লক একে- মডেলের স্বয়ংক্রিয় রাইফেলস বসানো ছিল।
১৯৫৫ সাল থেকে শুরু হওয়া আমেরিকার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পাকিস্তানিদের সমর্থনের নজির ছিল এইসব পুরনো ধরণের ভারী অস্ত্র, যার জোরাল পরামর্শ ছিল কিছু অল্পসংখ্যক ইউনিট যাতে বাঙ্গালি নিয়োগ ছিল তা থেকে তাদের নিরস্ত্র বা অব্যহতি দেয়া।
সারাদিন ব্যাপি বিক্ষিপ্ত হামলা চলে এবং সকাল বেলা পাড়া প্রতিবেশী সব দিক দিয়ে লাউডস্পীকার সহ ট্রাক চলে। দখলদারিরা ছাদে চড়ে বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে সংঘর্ষে মৃতদের উদ্দেশ্যে কালো পতাকা উত্তোলিত করে।
ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ঢাকা রেডিও তে প্রথম সম্প্রচার হয় গতকাল সকালের মধ্যভাগে, বাহুল্য বর্জিত ঘোষণায় বলা হয় পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ চলবে। পরে একজন কর্মকর্তা বলল শহরে লাউডস্পীকার ব্যবহার করা হয়েছে লোকজনকে ঘরে থাকতে সতর্ক করার জন্য। আগের রাতে হোটেলের কাছে হামলার ব্যাপারে কোন সতর্কতা জারি করা হয়নি।
সকাল ৮.৩০ দিকে জনাব ভুট্টো তার দলবল সহ ভারি সেনা পাহারায় হোটেল ত্যাগ করে আর পাঞ্জাবি বেসমরিকরা কম্যুনিস্ট-ব্লক রাইফেলস বহন করে নিয়ে যায়। জনাব ভুট্টো ধূসর রঙের স্যুট পরা ছিল এবং কঠিন মুখভঙ্গি করে দুইবার বলল, “আমার কিছু বলার নেই”।
সকালে একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হোটেলে এসেছিল, বিকেল ও সন্ধ্যার মধ্যে সে নিজেকে হোটেল এলাকা সহ প্রায় দুই স্কয়ার মাইল এলাকার কমান্ডার হিসেবে শনাক্ত করল। দুপুরের পরে পুলে সাঁতার কাটার সময় সে হোটেল ব্যবস্থাপনাকে বলল বিদেশিদের থাকার অনুমতি দেয়া হল।
৬ টার দিকে হোটেলে সাংবাদিকদের ফোন আসতে লাগলো যে মার্শাল ল প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তাদের চলে যাবার পরামর্শ দিচ্ছে। সেনাবাহিনী সরকারি জনসংযোগ বিভাগের মেজর সিদ্দিক সালিক, ফোন কলের ধরনের নির্দেশনার ব্যাপারে অনুসন্ধানকারী এক সাংবাদিককে বলে, “কিছু উপদেশ বাধ্যতামূলক।”
কেন তাদের হোটেল ছাড়তে হবে এই প্রশ্ন বারবার করা হলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল বলে, “আমরা চাই আপনারা ছেড়ে যান কারন এটা আপনাদের জন্য অনেক বিপদজনক হবে। এখানে অনেক রক্তপাত হবে”।
রাত ৮ টার মধ্যে হোটেলে অবস্থানকারী ত্রিশের অধিক সাংবাদিকদের চারটি সেনা ট্রাকে ওঠানো হয় কিন্তু তাদের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বক্তব্য শোনানোর জন্য অপেক্ষা করানো হয় যেখানে সে ঘোষণা করেছিল, আওয়ামী লীগের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের প্রশংসা করল এবং বলল, “আমি তাদের নিয়ে গর্বিত”।
এরপর ট্রাক গুলো রাইফেল বহনকারী সৈন্য ভর্তি ট্রাকের পিছে এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে চলল, পিছনে সব গাছ কাদামাটির নল, আবর্জনার স্তুপ, জ্বালিয়ে দেয়া বিভিন্ন সরু গলি যেখানে প্রায় সব দেয়ালে দেয়ালে শেখ মুজিবের ছবি ছিল, সব গুঁড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে চলল আর পিছে তিনটি ট্রাক ভর্তি সশস্ত্র সেনারা জ্বলতে থাকা একটি গ্রাম বসে দেখছিল।