অভিজ্ঞতার আলোকে

অভিজ্ঞতার আলোকে

২৪ জুলাই, ১৯৭১

বাংলার মুক্তি আন্দোলনে যারা রক্ত দিয়েছেন, যারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে শত্রুসেনার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তাদের উদ্দ্যেশে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়ে শুরু করছি। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের রায়কে উপেক্ষা করে, গণতন্ত্রের সমস্ত নীতি পদদলিত করে এবং মানবতার সমস্ত শিক্ষাকে মথিত করে স্বৈরাচারী বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তানী বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরপরাধ নিরস্ত্র বাঙালী জনতার উপর ২৫শে মার্চের রাতে। বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে সূর্যরশ্মি পৃথিবীর আবহাওয়ায় প্রবেশ করার পূর্বেই প্রচারিত হয়ে গেল এ খবর, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নৃশংস কার্যকলাপের ঘটনা। কিন্তু বাংলার মানুষ এবার মরণজয়ী। সামরিক বাহিনীর কামান, ট্যাংক, মর্টার, বিমান ও আরও হাজার ধরনের উন্নত মরণাস্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হল তারা। বিপুল বিক্রমে বিশ্বাসঘাতক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ হল EPR, পুলিশ বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর। এ খবরও প্রচারিত হল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিশাবসানের পূর্বেই। সচেতন জনতা বুঝতে পারলো মুক্তি তাঁদের সোজা পথে আসবে না। স্বাধীনতা তো ভিক্ষে করে পাওয়া যায় না। স্বাধীনতা আদায় করে নিতে হয়। এবং তার জন্য প্রয়োজন হয় রক্তের। জনতার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো বঙ্গবন্ধুর বাণী “রক্ত যখন দিতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের ঠেঁকিয়ে রাখতে পারবে না।” বাংলার বীর জনগণ রুদ্ররোষে বেরিয়ে এল রাস্তায়। কৃষক, মজুর, শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী ও জনতা অস্ত্র হাতে তুলে নিল। কোটি কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হল রক্তের বিনিময়ে বাংলার মুক্তি আদায় করার দুর্জয় প্রতিজ্ঞা, পরাধীনতার গ্লানির অবসান করার দীপ্ত প্রতিজ্ঞা।

এ ধ্বনি আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে আঘাত করলো বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আর সে ঢেউ এসে সাড়া জাগালো হজরত শাহ মখদুম শাহদ্দৌলার পদস্পর্শে পবিত্র শাহজাদপুরসহ পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, উল্লাপাড়া, ফরিদপুরসহ আরও অসংখ্য গ্রামে। প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলো সবাই। মুক্তিবাহিনী গঠিত হল মহল্লায় মহল্লায়। মা-বোনেরা এবং অশীতিপর বৃদ্ধও এসে দাঁড়ালো মুক্তিবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সবার মুখেই একই মন্ত্র “জয় স্বাধীন বাংলা”। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলে শত্রু বাহিনীর আগমনের- মোকাবেলা করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে। কারও হাতে বর্শা, কারও হাতে দা এবং কারও হাতে মজবুত লাঠি। বাইরে থেকেও মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা এলো। বিভিন্ন জায়াগয় ছাউনি ফেলা হল। শেরপুর থেকে নগরবাড়িঘাট পর্যন্ত ঐ রকম ছাউনি পড়লো পাঁচ-ছয়টা। এ পর্যন্ত ছাউনিতে বাংলার মুক্তিসেনাদের হাতে সাধারণত বন্দুক, রাইফেল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে নেওয়া কিছু উন্নত ধরনের অস্ত্র থাকতো। সোনার বাংলার সোনা মুক্তিযোদ্ধাদের জনতা আপন করে নিল। নিষ্পেষিত, অধিকারবঞ্চিত জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দেখতে পেল স্বাধীন বাংলার প্রতিচ্ছবি। একটি ঘটনা বলি। একদিন দুপুরের দিকে খেয়া নৌকায় পার হচ্ছি। সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজন যুবক। নৌকারোহীরা মুক্তিসংগ্রামে মোমেনের ত্যাগের কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছে। একজন অশীতিপর বৃদ্ধ উঠে এলেন আমাদের কাছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার মাথায় হাত রেখে বললেন, “তোমরাই তো বাবা অবহেলিত, লাঞ্ছিত বাংলার চোখের মণি। তোমাদের রক্তের বিনিময়ে আমার মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হবে। আমি মুক্ত বাংলায় মরতে পারবো। আমাদের পরবর্তী পুরুষকে আর পরাধীনতার গ্লানি সহ্য করতে হবে না। কি গৌরব এ ত্যাগের! জয় তোমাদের হবেই বাবা, ইনশাআল্লাহ জয় আমাদের হবেই। এ যুদ্ধ তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ। দুর্ভাগ্য, অনেক বয়েস হয়েছে আমার। অস্ত্র ধরবার ক্ষমতা এখন আর নেই। কিন্তু তবুও যদি আমাদের মত নিরস্ত্র হয়ে সামনে আসতো শত্রু তবে এ বয়সেও একবার দেখিয়ে দিতাম বিশ্বাসঘাতকের কি শাস্তি।” ভাবছিলাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর এই আশীর্বাদের উপর শ্রদ্ধা রেখে, মাতৃভূমিকে মুক্ত করবার প্রতিজ্ঞা নিয়েই তো অসংখ্য রণাঙ্গনে বাংলার রত্নরা সদাসচেতন প্রহরী হয়ে রয়েছে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য। চিন্তা করার আর সময় হয়নি। বৃদ্ধকে মৌখিক শ্রদ্ধা নিবেদনও করা হয়নি। হঠাৎ শুনতে পেয়েছিলাম মারণাস্ত্রের বিকট আওয়াজ। খুব কাছে। কয়েক সেকেণ্ড পরে খেয়াল হল অদূরে পাইকারহাটির ডাববাগানে মুক্তিবাহিনীর ছাউনির কথা-আমাদের বাহিনীর ৬০ জন মুক্তিসেনার কথা। তখন বেলা প্রায় দুটো। পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্যরা ১৪ খানা ট্রাকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে কাশিনাথপুর থেকে আসছিল বাঘাবাড়িঘাট অভিমুখে। মাঝপথে ডাববাগানে। ট্রীগারে হাত রেখে মুক্তি বাহিনীর জোয়নরা প্রস্তুত। শত্রুসেনাদের ট্রাকগুলো ওদের আওতায় এসে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো মুক্তিসেনাদের রাইফেল আর ব্রেনগানগুলি। শত্রুবাহিনীর পাঁচখানা সৈন্যবাহী ট্রাক অকেজো হয়ে গেল গুলির আঘাতে। প্রাণ দিল ৫০/৬০ জন পাকিস্তানী সৈন্য। এ যুদ্ধে আমাদের বাহিনীর একজন গুরুতররূপে আহত হয়েছিল- EPR- এর লোক। অদ্ভূত শরীর। তার গায়ে বিদ্ধ হয়েছিল ৫/৬টা বুলেট অচেতন অবস্থায় তাকে নিয়ে আসা হল ফ্রন্ট থেকে। ডাক্তারগণ তাকে ঔষধ দিচ্ছেন অপারেশন করে তার শরীর থেকে শত্রুবাহিনীর বুলেট বের করছেন। বাঁচার আশা খুবই কম। আমরা সেবা করছি কায়মনোবাক্যে। ও চোখ মেলে চাইলো। জিজ্ঞেস করলো মুক্তিসেনাদের কুশল, অগ্রগামী অবস্থানের পরিস্থিতি। মুমূর্ষ অবস্থায়ও ওর চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার দুর্জয় প্রতিজ্ঞা। করুণাময় আল্লাহতায়ালার অসীম কৃপায় ও বেঁচে আছে। মনে হয় বাংলার কোন প্রান্তে আবার সে অস্ত্র তুলে নিয়েছে শত্রুসেনাকে সমুচিত শিক্ষা দিতে। খোদার অসীম রহমত আছে ওর উপর, কারণ ও তো সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। পরে পাকিস্তানী বাহিনীর কামান আর মটারের আঘাতে ডাববাগান নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ধ্বংস হয়েছিল পাশ্ববর্তী গ্রামগুলো। মুক্তিযোদ্ধারা তবুও নির্ভয়। তারা আবার ঘাঁটি গড়ালো ঘ্যাটনা ব্রীজের তলায়। পণ করলো, পাকস্তানী বাহিনীকে কিছুতেই সিরাজগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে দেওয়া হবে না। কয়েকদিন পর শত্রুসেনারা ট্রেনে সৈন্য বোঝাই করে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে সিরাজগঞ্জের দিকে। কিন্তু মুক্তিসেনারা ঘ্যাটনা ব্রীজের কাছে রেলের ফিস-প্লেট তুলে রেখেছে। ট্রেন থেমে গিয়েছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্রেন

থেকে নেমেছে মেরামত করার জন্য। এ সময়ের জন্যই ওৎ পেতে বসে ছিল মুক্তিসেনারা-সংখ্যায় মাত্র ১০ জন। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো তাদের রাইফেল। ভূলুষ্ঠিত হল আক্রমণকারী পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর ১৫/১৬ জন সৈন্য। শত্রুসেনারা মেশিনগান, মর্টার আর রকেট ব্যবহার করেও মাত্র ১০ জন মুক্তিকামী বাঙালীর সামনে দিয়ে সেদিন ঘ্যাটনা ব্রীজ অতিক্রম করতে পারেনি। নরপিচাশ পাকিস্তানী সৈন্যরা তখন ফিরে উল্লাপাড়া  গ্রামে চলে যায়। নিরপরাধ জনগণের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, হত্যা করে নিরস্ত্র লোকজনকে। আশ্চর্য পৌরুষ পাকিস্তানী সৈন্যদের। মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খেয়ে নিরস্ত্র মানুষ মারার অদ্ভুত মনোবল! আরও আশ্চর্য ইসলামপ্রীতি এহিয়া খানের! ইসলাম কি কোথায়ও নিরস্ত্র, নিরপরাধ লোককে হত্যা করার অনুমতি দিয়েছে? অনুমতি দিয়েছে কি অসংখ্য নিরপরাধ লোকের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার, খাদ্যশস্য নষ্ট করার? মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করার?

        জানি, এহিয়া খান এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে-পারবে না। কিন্তু যত অত্যাচারই করুক না কেন বাংলার জনগণ এবার এদের উৎখাত করবেই। একজন বাঙালী জীবিত থাকলেও সে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করবে। বাংলাকে মুক্ত করবে। আমরা পশুর-মত বাঁচতে পারি না। আমাদের মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলেছে তাদের আমরা ক্ষমা করতে পারি না। তাইতো সেদিন বাংলার সোনা ফলানো মাঠের মধ্য দিয়ে আসবার সময় কয়েকজন কৃষক আমার কাছে এসেছিল। ওরা বলছিলো, “তিন গাঁয়ের লোক সভা করে ঠিক করেছে-যদি গায়ে মিলিটারী আসে তবে লাঠি, দা আর বর্শা নিয়েই তাদের খতম করব। গায়ের একটা পুরুষ লোক বেঁচে থাকতে একটা মিলিটারী ঢুকতে পারবে না। পুরুষ লোক বেঁচে থাকতে গাঁয়ের মেয়েদের উপর মিলিটারী এত অত্যাচার করবে তা হতে দেওয়া হবে না।” ওরা জানে ওদের লাঠি আর বর্শা মিলিটারীর মারণাস্ত্রের তুলনায় কত নগণ্য। কিন্তু কি অদ্ভুত প্রত্যয়! এহিয়া খান, তুমি এদের পরাভূত করতে পারবে কি?

(এই কথিকাটির লেখকের নাম জানা যায়নি)

২৭ জুলাই, ১৯৭১

অসম সাহসের অধিকারী মুক্তিবাহিনীর হাতে নরপশুরা মার খেয়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছে, আর অনেকে হাসপাতালে পা-হাত হারিয়ে কাতরাচ্ছে। তাদের বন্ধুরা সেসব দেখেশুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা হতে যেসব সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় ‘ছেড়ে দে মা পালিয়ে বাঁচি’ এই পুরাতন কথাটি ওরা জেনে ফেলেছে। কারণ, পশ্চিম পাঞ্জাবী কুকুরদের সঙ্গে বালুচ ও পাঠান সৈন্যদের তীব্র মতদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পশ্চিম পাঞ্জাবী অধিনায়ক অনেক জায়গায় বালুচ ও পাঠান সৈন্যাদের নিরীহ নিষ্পাপ গ্রামবাসীদের উপর গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিলে এই মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। যার ফলে সৈন্যদের মধ্য হতে একটা বিরাটসংখ্যক অংশ বাঙালীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজী নয়, এ দৃষ্টান্ত কয়েকটা ঘটনায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিছুসংখ্যক পাঠান সৈন্য মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে মুক্তিফৌজে যোগদানেরও ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অনেকে নিজের পায়ে নিজেরা গুলি করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তারা জানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে

লড়াই করে এ পৃথিবী হতে চিরবিদায় না নিয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে থাকা অনেক ভাল। তবুও আশা থাকবে ভাল হয়ে মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, পুত্র পরিজনের সঙ্গে দেখা করার।

স্পষ্টতই পাক বাহিনী ভীষণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এমনকি সেদিন পাক পশুদের একটা চলন্ত গাড়ীর সামনে একটি বোমা ফুটলে গাড়ী থামিয়ে ড্রাইভার সমেত অস্ত্র শস্ত্র ছেড়ে সকলেই নেমে পালাতে আরম্ভ করে। তখনই মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন ও জনগণ গিয়ে গুলি না করে ছুরি দিয়ে পাক পশুদের কতল করে ফেলে। এই চার মাসের যুদ্ধে পাক পশুরা সেখানে যেভাবে নতুন নতুন কলাকৌশল করে প্রস্তুতি নিয়েছে, পরক্ষণেই মুক্তিবাহিনী চারদিকে থেকে আক্রমণ করলে আস্তানাতেই চিরতরে মৃত্যুর কালো অন্ধকারে লুটিয়ে পড়েছে। এসব দেখেশুনে পাক পশুরা বাঙালীদের সঙ্গে আর যুদ্ধ করতে রাজী নয়। তাছাড়া বেশ কিছুদিন হতে পশ্চিম পাকিস্তানের যে সমস্ত লোক বাংলাদেশে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য ও এক নম্বর লাইসেন্স নিয়ে কন্ট্রাকটরি করত এবং বড় বড় চাকরিজীবী হয়ে বাংলার মাটিতে আধিপত্য বিস্তার লাভ করে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র তৈরি করে ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করত, তাদের অনেকেই এদেশ থেকে চলে গেছে। খুলনা পোর্ট হতে জাহাজ ভর্তি হয়েছে তাদের মালপত্র-জীপ, ট্যাক্সি, খাট, আলমিরা, আসবাবপত্র ও এমন কি যাত্রীবাহী বড় বড় বাস পর্যন্ত। এইসব মালপত্র নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে। বাংলাদেশে কার্যরত সব লোকই খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে এদেশে তাদের থাকা চলবে না। একটা ঘটনার উল্লেখ করি। বেশ কিছুদিন আগে পশ্চিম পাকিস্তানী পশুদের মেজর খান আলতাফ হোসেনের ভাই, যিনি একজন সি এ্যাণ্ড বি’র প্রথম শ্রেণীর কন্ট্রাকটর, তিনি বক্তব্যগুলি তার আর এক বাঙালী প্রথম শ্রেণীর কন্ট্রাকটর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে পেশ করে বলেন, “রহমান সাহেব, এদেশে আমরা থাকতে পারব না। ভাইয়ের কাছে অনেক কিছু শুনলাম। যে কটা টাকা-পয়সা আছে তা নিয়ে আমি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছি। আর আমার যে সমস্ত জিনিসপত্র রয়েছে, তা আপনাকে দিয়ে চলে যাব। আপনাদের দেশ মুক্ত হবার পর বেঁচে থাকলে পরে দেখা হবে।” এমন কি খুব গোপনভাবে তিনি বলে গেলেন, তার ভাই যশোর ক্যান্টনমেন্টে রয়েছেন কিন্তু খুলনায় থাকা বেশী নিরাপদ নয় মনে করে চলে আসতে চান- কখন কোন সময় কি হয় তার ভয়ে।’ এখন বুঝতেই পারা যাচ্ছে তাদের মনোবলের মিটার কত নীচুতে নেমে গেছে। অথচ টিক্কা এত ধাক্কা খাওয়ার পরও চিন্তা করতে পারে না কি গতি হবে তার। আর জঙ্গী এহিয়া ইসলাবাদের স্বপ্নপুরীতে থেকে মুক্তিবাহিনীর মার কি রকম কি করে বুঝিতে পারবে? যে স্বপ্নপুরী একদিন ওর বাপ বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের রক্ত চুষে অর্থ নিয়ে গড়ে তুলেছিল, সেখানে শুধু লালপানির শ্রাদ্ধ করা হয়। আর এদিকে তার দালাল ভাইস অ্যাডমিরাল মোজাফফর হাসান ঐ বর্বর কুকুরদের আস্তানায় আস্তনায় সাহস যোগাতে বেরিয়ে পড়েছে। হলে কি হবে, ফল যে হচ্ছে তার উল্টো। মুক্তিবাহিনীর হাতে ওরা দিনের পর দিন মার খেয়ে হয়েছে দিশেহারা।

         ছিঃ ছিঃ লজ্জা করে একটা কথা বলতে; মুক্তিবাহিনীর হাতে এত মার খাওয়ার পরেও ইয়াহিয়া আজও ভারতকে দোষারোপ করছে। লজ্জাহীনকে শিক্ষা দিতে হলে কিছুটা নির্লজ্জ না হয়ে পারা যায় না। এখন পর্যন্ত তো বাংলার মুক্তিবাহিনীকে স্বীকার করা হল না, অথচ মুক্তিবাহিনী বাংলার মাটিতে থেকে আজ হতে প্রায় চার মাস ধরে অবিরাম লড়াই করে যাচ্ছে, তবুও তারা ভারতের দুষ্কৃতকারী। যদি তাই-ই হয় তাহলে ইয়াহিয়ার প্রিয় দালাল ও পাক সেনাদের জিজ্ঞাসা করলেই তো সঠিক খবরটা পাওয়া যাবে। কারা তারা, যাদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পিছনে সরে যাচ্ছে? দালালেরা কিছুদিনের জন্য পরিত্রাণ পাবার আশায় তো রাজাকার বাহিনী করেছে। আর এই রাজকার বাহিনীতে যতসব চোর, বাটপার, বদমাইশ ও ডাকাতদের নেয়া হয়েছে- যারা সমাজের কাছে ঘৃণার পাত্র এবং যাদের সমাজে কোন ঠাঁই নেই। এদের মধ্যে অবশ্য অনেকে জেল-হাজতে ছিল। এই সমস্ত লোকেরাই পাক পশুদের লুটতরাজ ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। তাদের নাম ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনীর কাছে ধরা পড়েছে। আসলে মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে জীবন রক্ষার্থে রাজকারের খাতায় নাম লিখেছে। অথচ দেখা গেছে, পাক বাহিনী এদেরকে ভালোভাবে বিশ্বাসও করে না। ঐ রাজাকারেরা

এখন শুধুমাত্র মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামের কতগুলি দালালের দেহরক্ষী হিসাবে রাইফেল ঘাড়ে করে চলে, কোন সময় মুক্তিবাহিনীর সম্মুখীন হলেই অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে পালিয়ে যায়।

        এদিকে আবার ইয়াহিয়া ডিফেন্স সার্টিফিকেট, সেভিংস সার্টিফিকেট ও প্রাইজবণ্ড কেনার কতই না আহবান জানাচ্ছে; কিন্তু বিশ্বাসঘাতক এহিয়া জানে যে অন্ধ তার লাঠি একবারই হারায়। যে ভুল বাঙালী একবার করেছে, তার পুনরাবৃত্তি আর করতে পায় না। কারণ তারা জানে এসব টাকা-পয়সা কোন দিনই আর ফিরে পাওয়া যাবে না। বাঙালীদের জানতে বাকি নাই যে, এগুলোর হেড অফিস ঐ দালালদের দেশে। সে জন্যই ব্যাঙ্ক-বীমার টাকা জমা দেয়া ও প্রিমিয়াম বন্ধ হয়ে গেছে। আজকে ইন্সুরেন্সের প্রিমিয়ার দিতে গেলে কোন দিনও আর সে টাকা ফিরে পাওয়া যাবে না। বরং ওদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা হবে। অবশ্য বাংলাদেশ মুক্ত হবার পর বাংলাদেশ সরকার এর একটা ব্যবস্থা করবে। আমরা পশ্চিম পকিস্তানী দালালদের কোন মালপত্র খরিদ করবো না। কোন কাপড়-চোপড় আমরা না কিনলে ওদের গুদামে সব জমা হয়ে হয়ে পচবে। এ জন্যই ওদের কল-কারখানা বন্ধ হতে বাধ্য। ইতিমধ্যে অনেক মিল ও কারখানা হতে শ্রমিক ছাঁটাই আরম্ভ হয়েছে। আমরা ওদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে চিরতরে ভেঙ্গে চুরমার করে দেবো। বাংলার মানুষকে ফাঁকি দিয়ে অর্থ সঞ্চয় করবার দিন ঐ ২৫শে মার্চের রাত ১০টায় ফুরিয়ে গেছে। যারা আজ পশ্চিম পাকিস্তানী দ্রব্য দেখেশুনে খরিদ করছে, তারা নরঘাতক এহিয়ার হাতকে শক্তিশালী করতে সহায়তা ছাড়াও বাংলার সম্পদ ভোগ করে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়ে, বাংলার সম্পদ ভোগ করে বাংলার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা যে কত বড় অপরাধ তার কৈফিয়ৎ ওদের দিতে হবে জীবন দিয়ে। বাঙালীরা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করবেই করবে- যার জন্য দিনের পর দিন গ্রাম বাংলার প্রতিটি ছাত্র, শ্রমিক ও যুবকেরা এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করছে। এরা সকলেই স্বাধীনতা রক্ষার বজ্রকঠিন শপথ নিয়ে বাংলার পথে-প্রান্তরে ঐ কুকুরদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্যই বেরিয়ে পড়েছে। তারা জানে, অমাবস্যার কালো অন্ধকার ভেদ করে অচিরেই লাল সূর্য  আলোয় ভরা আভা নিয়ে পূর্বদিগন্তে উদিত হবে।

(অধ্যাপক এম, এ, সুফিয়ান রচিত)

Scroll to Top