অর্থনৈতিক দুর্যোগ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৫। অর্থণৈতিক দুর্যোগ নিউইয়র্ক টাইমস ১৫ এপ্রিল ১৯৭১

 

Razibul Bari Palash

<১৪, ২৫, ৫৮৫৯>

                       

নিউইয়র্ক টাইমস, ১৫ এপ্রিল ১৯৭১

অর্থণৈতিক দুর্যোগ

 

পূর্ব পাকিস্তানের অনেক অঞ্চলে কৃষকরা তাদের ধানের  বীজ বপন করছে না কারণ পাকিস্তানি আর্মি এবং বাংলার স্বাধীনতা বাহিনীর কারণে তারা সামনে আসতে ভয় পায়।

 

ভারতবর্ষের ১০০০ কিলোমিটার জুড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ‘টেক্সটাইল মিলস’ সস্তা তুলো পণ্য চালু করছে যার একমাত্র বাজার হল পূর্ব পাকিস্তান।  তবে সেগুলো সেখানে বিক্রি করা যাচ্ছে না যতক্ষণ পাকিস্তানি বাহিনী স্বাধীনতা আন্দোলনকে নির্মূল করে এবং যুদ্ধ শেষ না করে।

 

গত তিন সপ্তাহের যুদ্ধ প্রচুর জীবন নষ্ট হবার পাশাপাশি দেশের উভয় অঞ্চলের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

 

যদিও এই সংবাদদাতা পূর্ব পাকিস্তানে প্রকার ক্ষুধা দেখেন না, তবে গ্রামাঞ্চলে খাদ্য শস্য কম এবং কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়।

 

এমনকি স্বাভাবিক সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি ক্ষুধার্ত এলাকা বলা হতে পারে, কারণ এখানে বার্ষিক খাদ্যশস্যের ঘাটতি ২৫ মিলিয়ন টন।

 

পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশী সাংবাদিকদের প্রবেশের উপর পাকিস্তানি সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পূর্ব বঙ্গের বঙ্গোপসাগরের বন্যাকবলিত ঘনবসতিপূর্ন কিছু বদ্বীপের কোন খবরই পাওয়া যায় না। গত বছরের নভেম্বরে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানায় কয়েক লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। এতে সেখানকার সকল ফসল ধ্বংস হয়। 

 

ত্রাণ সরবরাহের সময় থেকে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ বেঁচে আছে। মার্চ মাসের প্রথম দিকে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয় এবং সেনা বাহিনী সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ চালায় যার ফলে ঘূর্ণিঝড় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ হ্রাস পায়।

 

বিদেশী কূটনীতিক এবং অন্যেরা চিন্তিত আছেন যে সেখানে খাদ্য সমস্যা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মারাত্মক আকার ধারণ করবে – বর্ষা আসার সাথে সাথে- কারণ এই সময়ে দক্ষিণের কিছু এলাকায় প্রায় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রায় পাঁচ মাসের জন্য এই অবস্থা বলবত থাকে। 

 

এ ছাড়াও এটি অনুমান করা হয় যে প্রায় ১০০০০০ ঘূর্ণিঝড় বেঁচে থাকা মানুষ এখনো ঘর বা আশ্রয়হীন। বর্ষাকালে তারা নিকৃষ্ট অবস্থার মুখোমুখি হবে।

 

যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকট বাড়বে। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী – যা সম্পূর্ণরূপে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা গঠিত- তারা খাদ্য, , চা বাগান এবং পাটকলগুলি ধ্বংস করছে। যারা প্রতিরোধ করছে আতার গেরিলা কৌশল অবলম্বন করছে। তারা রেল লাইনগুলি উধাও করে দিচ্ছে, সেতু উড়িয়ে দিচ্ছে এবং সেনাবাহিনীর আক্রমণকে সীমাবদ্ধ করার জন্য তাদের রসদ আসার পথগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে।

 

চা আবাসন ও পাটকলের ম্যানেজার, বেশিরভাগই বিদেশী – তারা তাদের চাষ ছেড়ে দিচ্ছে , দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছে বাঙ্গালী সহকর্মীদের হাতে।

 

হাজার হাজার চা শ্রমিককে দেবার মত টাকা নেই। উত্তরপূর্বের সিলেট জেলার প্রায় সব কাজই বন্ধ করে দিয়েছে। চা শ্রমিকরা সব হিন্দু এবং ম্যানেজারদের মতে যারা ইতোমধ্যে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে যেটি একটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা।

 

 

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাংক ও দোকানগুলি লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

তাদের মূল লক্ষ্য সাধারণ মানুষ – বললেন পূর্ব অঞ্চলের বেইজে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার কর্নেল এম এ জি ওসমানি। তিনি বলেন,”তারা জনগণকে সন্ত্রাসের ভয় দেখাচ্ছেন  ও খুধার্ত রাখার চেষ্টা করছে।”

 

এখানে লবণ, দারুচিনি, রান্নার জন্য সরিষা তেল, ল্যাম্পের জন্য কেরোসিন এবং মেশিনগুলির জন্য জ্বালানি যেমন- গ্রামের ময়দা মিল চালানোর জন্য –  ইত্যাদির সংকট রয়েছে।

 

চাল এবং মাছ বাঙালিদের প্রধানতম খাবার। পুর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন মানুষ। কিন্তু চালের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তারা কাঁঠালের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কাঁঠাল, যা একটি সবজি হিসাবে রান্না করা যায় পেকে যাবার আগে এবং পেকে গেলে ফল হিসেবে খাওয়া যায়। পূর্ব পাকিস্তানে সর্বত্র এটি প্রচুর পরিমাণে ফলে। কিন্তু এটি সবসময় বাঙালির খাদ্য তালিকায় সামান্য অংশ জুড়ে ছিল।

 

সেনাবাহিনীর সামরিক সরবরাহ ব্যতীত পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে কিছু আসছে না।বাঙালিদের এখন তাদের নিজেদের এলাকায় যা পাওয়া যাবে তাই দিয়ে চলতে হবে। শত শত বছর, বন্যা, ঝড় ও গভীরতম দারিদ্রতার পর থেকে তাদের বেঁচে থাকার লড়াই চলছে।

 

যদিও যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানকে শারীরিকভাবে স্পর্শ করেনি তবে পূর্বের কারণে এর অর্থনৈতিক মন্দার হতে পারে।

 

পূর্ব থেকে উৎপন্ন হওয়া পাট দেশের বৃহত্তম একক রপ্তানি পণ্য এবং বিদেশী মুদ্রা উপার্জনকারী পণ্য। বেশিরভাগ বৈদেশিক আয়ের টাকা  পশ্চিমবঙ্গে সেনাবাহিনীর জন্য এবং বড় শিল্প ও জনসাধারণের কাজের জন্য ব্যয় করা হয়।

 

পূর্ব পাকিস্তানে এই ধরনের শোষণ, যা ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে দেশটির দুই অংশের আলাদা হবার সময় থেকেই চলছিল। এর ফলেই এখন পূর্ব অঞ্চল তাদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য দাবি করেছে এবং অবশেষে যা স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।

পূর্বের পাট কল বন্ধ হয়ে গেলে, পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে।

 

পূর্ব পাকিস্তান সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসেবে ব্যাবহ্রিত হয়েছে। বিশেষ করে পোশাকের জন্য তুলার উপকরণ। এবং এই বাণিজ্য এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

 

তুলা হল এমন সস্তা মানের বিশ্বের কোন স্থানে যার আর  কোনও বাজার নেই; এটা পূর্ব পাকিস্তানে একটি সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি হত। এটা করা হত পশ্চিমের টেক্সটাইল শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য।

 

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমস্ত সংবাদ প্রতিবেদনগুলির উপর সেন্সরশিপ প্রয়োগের কারণে সেখানে অর্থনীতিতে কি কি সমস্যা হচ্ছে তা তুলে ধরা মুশকিল হচ্ছে।

 

পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা বাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সরকার কতদিন যুদ্ধ করে টিকে থাকবে তা অনিশ্চিত।

 

-সিডনী এইচ শ্যানবার্গ 

Scroll to Top