শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৫৩। অস্ত্র যখন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা | নিউইয়র্ক টাইমস | ২৭শে জুন, ১৯৭১ |
<১৪, ৫৩, ১১৫-১১৬>
দি নিউইয়র্ক টাইমস, রবিবার, ২৭শে জুন, ১৯৭১
যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান
অস্ত্র যখন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা
ওয়াশিংটন – নিক্সন প্রশাসন গতসপ্তাহের পত্রিকা পড়ে জানতে পেরেছে যে তারা মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে পাঠানোর উপর নিজেরাই যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তা উপেক্ষা করছে দেশটির পূর্ব অংশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই।
দেরিতে জানতে পারা যে ২৫শে মার্চে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবার পরেও সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই অন্তত তিনটি মালবাহী জাহাজ নিউইয়র্ক বন্দর থেকে করাচীর পথে ছেড়ে গেছে, এবং ঐ দিনের পর আরো নতুন রপ্তানি আদেশ যে বেআইনি ভাবে দেয়া হচ্ছে, এতে প্রশাসন প্রকাশ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর সাথে আছে সংসদীয় অসন্তোষ এবং ভারতের সাথে রাজনৈতিক টানাপোড়েন।
এই ঘটনাটি পূর্ব পাকিস্তানের কার্যত বিস্ফোরক পরিস্থিতির প্রতি ওয়াশিংটনের দ্যর্থক মনোভাবকে আরো স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিতে কাজ করেছে, যেখানে বাঙালী স্বাধীনতা আন্দোলনের উপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর চালানো দমন-পীড়নে এখন পর্যন্ত প্রায় ২,০০,০০০ বাঙালী নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে এবং ষাট লক্ষ শরণার্থীকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যেতে বাধ্য করেছে।
কয়েকজন পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন যে প্রশাসনের তরফ থেকে ইচ্ছাকৃত ছলচাতুরী ছিল। মোটামুটি সবাই এটা মেনে নিয়েছিল যে যারা প্রশাসনের উপরের দিকে নীতিনির্ধারণ করেন এবং যারা কার্যত সেই নীতির প্রতিফলন ঘটান তাদের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় অস্ত্রের এই চালানগুলো সঙ্ঘটিত হয়েছে, যেটাকে একজন উদ্বেজিত আমলা গত সপ্তাহে বর্ণনা করেন, “হস্তীসম বৃহৎ প্রশাসনের মূল্য” হিসেবে।
অস্ত্রের এই চালানগুলোকে ঘিরে এই আমলাতান্ত্রিক বিভ্রান্তি সবদিক থেকেই পর্বতপ্রমাণ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই বেশ কয়েকজন সিনেটরকে আশ্বস্ত করেছিল (লিখিতভাবে) যে পাকিস্তানের জন্য কোনো অস্ত্রের চালান পাঠানোর কথা নেই, হতবাক হয়ে যায় যখন তারা দুটো (আরো পরে তৃতীয়) মালবাহী জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার কথা জানতে পারে এবং ছুটে যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের কাছে এর ব্যাখ্যা চাইতে।
পেন্টাগন তাদের কম্পিউটার ঘাঁটে এবং তথ্য পরিবেশন করে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চমকে দিয়ে, যে ২৫শে মার্চে অস্ত্রের চালানের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মাত্র ৬ই এপ্রিলে এসে কার্যকর হয়েছে। এরপর, প্রশাসন থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয় যে ২৫শে মার্চের আগে পাকিস্তানী সরকারী কর্মকর্তাদের হাতে যেসব সামরিক সরঞ্জাম হস্তান্তর করা হয়েছে সেগুলো পাঠিয়ে দেয়া যেতেই পারে। কেন পাঠিয়ে দেয়া যায় সেটা আর বলা হয়নি।
প্রকৃত সত্য নিরূপণ করতে দ্রুত একটি উচ্চ-পদস্থ বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়, কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানার আগেই চার দিন অতিবাহিত হয়ে যায় যে পাড়িল্লা, পাকিস্তানের মালবাহী জাহাজ যেটি গত সপ্তাহান্তে নিউইয়র্ক বন্দরে মালামাল তুলছিলো, সেটি বন্দর ছেড়ে গেছে (১) ১ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার সমমূল্যের গোলাবারুদ, (২) সামরিক বিমান, সাঁজোয়া যান এবং জীপগাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ এবং (৩) বিমানবিধ্বংসী গোলন্দাজদের প্রশিক্ষণের জন্য বেতার-নিয়ন্ত্রিত চালক বিহীন ছোট বিমান নিয়ে।
তিন দিন ধরে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এবং সাংবাদিকরা গোলাবারুদগুলো “প্রাণঘাতী” নয় সরকারের এরূপ দাবির বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন। এর সুত্রপাত হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ববর্তী এক স্বীকারোক্তি থেকে যে পাকিস্তানের কাছে যে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয় করা হয়, যা কিনা “অ-প্রাণঘাতী” দ্রব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তার মধ্যে গোলাবারুদও আছে।
তৃতীয় দিনের মাথায়, এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেনঃ “কখন গোলাবারুদ প্রাণঘাতী হয়?”। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র উত্তর দেনঃ “এটি একটি ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্ন”।
অস্পষ্ট থেকে যায় পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির মূলকথা এই স্বীকৃত পটভূমির বিপরীতে যে এখানে অত্যন্ত বাস্তব আশঙ্কা রয়েছে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার যদি না পূর্ববাসীদের স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষার জন্য দ্রুত একটি রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া যায়।
এই আশঙ্কা উদ্ভূত হচ্ছে ভারতের সম্পদের উপর শরণার্থীদের সংখ্যা যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে, ভারতের স্থানীয় অধিবাসী এবং শরণার্থীদের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান বিরোধ এবং পূর্ব পাকিস্তানের “মুক্তিযোদ্ধা”-দের রাজনৈতিক মৌলিকিকরণ বিষয়ক ভারতের ভয় থেকে। এই সবগুলো উপাদানকেই নয়াদিল্লী দেখছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনৈতিক স্থিরতা এবং এই উপমহাদেশের শান্তির প্রতি সরাসরি হুমকি স্বরূপ।
ভারতীয় নীতি, যুক্তরাজ্য এবং কানাডার শক্ত সমর্থনসহ, হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপর যথেষ্ট পরিমানে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের ব্যবস্থা করা যাতে সে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। ভারতের যুক্তি হচ্ছে শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এটা করা জরুরী। চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে পাকিস্তানকে সব ধরণের বৈদেশিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত করার দাবী তাদের।
এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব অস্পষ্ট। প্রশাসনের সহজাত প্রবৃত্তি, বিশেষ করে পেন্টাগনের, হচ্ছে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার সুসম্পর্কের ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে কোন মূল্যে পাকিস্তানের সাথে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এই মনোভাব এখনো বজায় আছে যদিও গত কয়েক বছরে পাকিস্তান আরো কাছ ঘেঁষা হয়েছে সমাজতন্ত্রী চীনের।
যদিও এই মাসের শুরুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে পূর্ববাসীদের সাথে “রাজনৈতিক আপোসরফা” করার উপায় খুঁজতে বলেছে – দুই মাস ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলার পর এই প্রথমবার এটা করলেও – তারা অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে।
তবে, গত সপ্তাহে বিশ্ব ব্যাংকের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল পরামর্শ দেয়, পাকিস্তানের পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর, যে ১১০টি নতুন তহবিল পাকিস্তানের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সঙ্ঘের মাধ্যমে দেয়া হবে যতক্ষণ না ইসলামাবাদ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সাথে “রাজনৈতিক আপোসরফা” করে।
– ট্যাড সুলচ