অগ্রগামী মুক্তিবাহিনী
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
পাকিস্তানী বর্বর সেনারা মুখের উপর এক বিরাশী-সিক্কার চড় খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ার উপক্রম। গত মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত সমানে জ্বালাতন করে, বাংলার বুকে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে, সমৃদ্ধ জনপদ শশানে পরিণত করে, বাংলার শক্তিকে নিঃশেষ করেছে ভেবে, বাংলার পথে পথে শকুনী-গৃধিনী এবং শিবাদলের অট্টহাসিতে ভরে তুলেছিল বাংলার আকাশ। কিন্তু ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি তাদের বোধের অন্তরালে কখন যে জেগে উঠেছে, অনুধাবন করতে পারেনি অদূরদশী বর্বর হয়েনার দল। আচমকা কোন দিক থেকে গালের উপর পড়ল বিরাশী সিক্কার চড়।
আর অমনি বন্ধুর দল হায় হায় করে উঠলো। নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বিতাড়িত হয়ে সাধারণ পরিষদে হাজির গণতন্ত্রের জিগির তুলে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলে, পাকিস্তানের নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে পাকিস্তানী বন্ধুরা আরামকে হারাম করে বিশ্বের দরবারে হাজির হলো। বন্ধ কর, যুদ্ধ বন্ধ কর।
কারণ কী? কারণ আছে তো বটেই। মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনী দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে পরিণতির দিকে। একের পর এক পতন হচ্ছে নিরাপদ দুর্গগুলোর সাহায্যদ্রব্য আনয়নের এবং পাঠানোর পথগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। দুটি প্রধান বন্দর চট্টগ্রাম এবং চালনা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। বিমান বাহিনী যে সাহায্য করবে সে উপায়ও নেই। কুল্লে দু’খানা বিমান এখন পাকিস্তানের বেঁচেবর্তে আছে, তাও আবার লুকানোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। কেননা সারা বাংলাদেশে জানোয়ারগুলোর আর লুকানোর কোন ঠাই নেই। মুক্তিবাহিনী খুঁজে খুঁজে ওদের আঘাত করছে, শেষ করছে। সারাবাংলা এখন হয়ে উঠেছে শয়তানের মৃত্যুফাঁদ।
বাংলাদেশের অর্থে কেনা সমরসম্ভার নিঃশেষিত প্রায়। এতদিন যে ধর্মের আফিমের নেশায় বুদ হয়েছিল সারা পাকিস্তানের সুবিধাবাদী জল্লাদ আর দালালের দল, আজ তাদেরও নেশা ভাঙতে শুরু করেছে। জাতীয় সংগ্রামের আগুনের আচে আফিমের নেশাও চড়াৎ করে ভেঙে যাচ্ছে। পাঞ্জাবী মহাপ্রভূদের মনোরঞ্জনার্থে আর অস্ত্র ধরতে রাজী নয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অনেকেই। আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জবানবন্দীতে একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে।
এবার দিন গুণবার পালা সামরিক জান্তার এবং তাদের চেলাচামুণ্ডা মওদুদী, ভুট্টো, কাইয়ুম খান, নুরুল আমিন, মাহমুদ আলী প্রমুখের। নিয়াজী বাংলার মাটিতে বসে ইয়ানফসী, ইয়ানফসী শুরু করেছে। ঢাকা বেতার তবু আজো প্ৰলাপ বকছে। ওদেরই কথার প্রতিধ্বনি তুলে নিজেদের বোঝাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু অনুভব ভুলের বোঝায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে।
মুক্তিবাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে এবং মেশিনগানের গুলিতে সচকিত দালালের দল কোন বিবর খুঁজছে? বোমার আঘাতে প্রকম্পিত ঢাকা নগরীতে আজ কি আর বর্বরদের জীবনের উচ্ছলতার কোন অবশিষ্ট আছে? না,
নেই। যশোর দুর্গ পতনের পর, ময়নামতি দুর্গ অবরুদ্ধ হওয়ার পর, সিলেট জেলা, রংপুর এবং যশোর খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত হওয়ার পর আর কি ভাবছে বাংলার স্বার্থবিরোধী, বাঙলার চরম শত্রু পাকবাহিনী এবং তার অনুচরেরা?
আজ মুক্তিবাহিনীর পথ রোধ করবে কে? কোথায় সে শক্তি? নিঃশেষিত শক্তি পাকিস্তানের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে । যারা নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ছে তাদের নিজেদের স্থান করে নিতে হবে সেই কবরে।
দুঃসাহসী মুক্তিবাহিনীর দৃঢ়পণ, বজ্ৰমুঠিতে ধরে রাখা হাতিয়ার আজ বদ্ধপরিকর সব অনাচারী, অত্যাচারী, জুলুমবাজদের মূলোচ্ছেদ করার জন্য। লাখো শহীদের রক্তলাল-বাঙলায় উদিত আজ স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। উত্তাল বিজয়-উল্লাসে মুখরিত বাংলা আকাশ-বাতাস।
আজ শোন বর্বরের দল, হয় মৃত্যুবরণ করো নয় পরাজয়ের কালি ললাটে লেপন করে আত্মসমর্পণ করো। বাংলার মাটিতে ঠাই নেই তোমাদের।
দুর্জয়, দুর্বার বাঙলার মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলো। সংহার করো, নিঃশেষ করো অনাচারী বর্বরদের। বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তোমাদের বিজয়-আহবান জানাতে প্রস্তুত।
সুদূর দিনাজপুরের বাংলাবান্ধা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দৃঢ় দুর্দমনীয় হোক তোমাদের পদক্ষেপ। মনোবলহীন, ক্লাব, কুৎসিৎ হানাদার আজ মৃত্যুর দিন খুঁজছে বন্দীপ্রায় বিবরে।
তোমাদের জয়যাত্রায় শরীক সাতে সাত কোটি বাংলার মানুষ। গণহত্যাকারীদের নিঃশেষ করো বাংলার মাটি থেকে
(মুস্তাফিজুর রহমান রচিত)