অধ্যাপক আজিজুর রহমান মল্লিক
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ০১ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ০১ নং দলিল থেকে বলছি…
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সমগ্র দেশবাসীর মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কর্মচারীরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ হয়। ৭ ই মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ বেতার মারফত আমাদের শোনার সুযোগ হয় ৮ই মার্চ সকালে। ঐদিনই আমার পরামর্শ অনুসারে শিক্ষকেরা একটি সভায় মিলিত হয়ে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করবেন বলে অঙ্গীকার করেন। এই সভায় অন্যান্যদের মধ্যে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান,সৈয়দ আব্দুল করিম,অধ্যাপক মুহাম্মদ রশিদুল হক ডঃ আনিসুজ্জামান ও জনাব ফজলী হোসেন প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
তখন থেকে ২২শে মার্চ পর্যন্ত স্বাধীনতা -সংগ্রামের জন্য আমরা এক ধরনের প্রস্তুতি নিই। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সন্নিহিত স্থানে অবস্থিত কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ -এর ডক্টর আব্দুল হাইয়ের সংগে অধ্যাপক রশিদুল হক ও অধ্যাপক শামসুল হককে (তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) যোগাযোগ করতে নির্দেশ দেই। কারণ তিনিও আমাদের মতই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে আমার জানা ছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরিতে হাতবোমা,গ্রেনেড ইত্যাদি তৈরি করা যায় কিনা সে বিষয়ে পরীক্ষা করতে অধ্যাপক শামসুল হককে গোপনীয় মৌখিক নির্দেশ দেই। কিছু কিছু ছাত্রকে সামরিক ট্রেনিং দেবার চেষ্টা করা হয় ডঃ হাইয়ের উদ্যোগে। ইউ, ও, টি,সি-র ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক ডক্টর এস, এম, আতাহারকে আমি নির্দেশ দেই ইউওটিসি-র রাইফেলগুলো সক্রিয় করার চেষ্টা করতে। চট্টগ্রাম শহরে আয়োজিত সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতিবাদ-সভা ও বিক্ষোভ-মিছিলে অন্যান্য অনেকের মধ্যে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ও ডঃ আনিসুজ্জামান সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। আরও আগে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত বাঙালি-অবাঙালি সংঘর্ষে আহতদের জন্য আমার সঙ্গে শিক্ষক-ছাত্ররা রক্ত দান করেন।
২৩ শে মার্চ সকালে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ঐদিন বিকেলে চট্টগ্রাম শহরে সকল পর্যায়ের শিক্ষক ছাত্র ও জনসাধারণের প্রতিবাদ মিছিল বের হবে এবং তারপরে প্যারেড গ্রাউন্ডে আমার সভাপতিত্বে শিক্ষক-জনতার সভা হবে। যদিও এ সম্পর্কে আমি আগে কিছু জানতাম না, তবু এই মিছিল ও সভায় আমি শিক্ষক ছাত্রসহ যোগ দেই। মিছিল বেশ বড় হয়, সভায় জনসমাবেশও হয় প্রচুর। পলো গ্রাউন্ডের এই জনসভায় তিল ধারণের স্থান ছিল না তাছাড়া মাঠের চারিদিকে বাড়ীর ছাদেও অনেক নারী পুরুষ জড়ো হয়। এই সভায় আমি জনতার সংগ্রামের সঙ্গে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করি। বাঙালির ন্যায্য অধিকার অর্জন করা পর্যন্ত সংগ্রামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকবো সে অঙ্গীকার ও করি। এ সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুল করিম, অধ্যাপক আর আই চৌধুরী ও স্থানীয় নেতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী। উল্লেখ্য যে এই সভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন আমার প্রাক্তন ছাত্র এবং তৎকালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ। সভা চলাকালে সংবাদ আসে যে অস্ত্র বোঝাই ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে বাধা দেবার জন্য প্রায় ১০/১৫ হাজার মানুষ বন্দর এলাকায় বেষ্টনী সৃষ্টি করেছে এবং শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড স্থাপন করা হচ্ছে। সভায় উত্তেজনা বাড়ে। এমতাবস্থায় সভা মুলতবী করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করি কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের কাছে ব্যারিকেড দেখে আবার ফিরে আসি এবং রাঙ্গুনিয়া হয়ে গ্রাম্য পথ ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফিরি অনেক রাতে। অচিরেই যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিরস্ত্র জনসাধারণের মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে তখন আর আমার ও আমার সহকর্মীদের মনে কোন সংশয় থাকে না।
এই পরিস্থিতিতে প্রতিরোধের একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করা আশু প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। ২৪ শে মার্চ সকালে UBL (তদকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড-এর আঞ্চলিক ম্যানেজার জনাব কাদের এবং চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার জনাব শামসুল হকের (উভয়েই মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় শহীদ হন) সঙ্গে টেলিফোনে আমার কথাবার্তা হয়। সেই আলাপের ভিত্তিতে হাটহাজারী ও রাউজান থানার সঙ্গে আমি টেলিযোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করি এবং শত্রুসৈন্য পথে বেরিয়ে পড়লে স্থানীয় জনসাধারণের সাহায্যে যাতে তাদের প্রতিরোধ করতে পারি তার জন্যও পরিকল্পনা প্রস্তুত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করি।
২৫ শে মার্চ সারাদিন খুব উদ্বেগের মধ্যে কাটে। শহরের বিভিন্ন স্থানে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে,এসব খবর টেলিফোনে পাই। যেমন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ জনাব ইউ, এন, সিদ্দীকির বাড়ীতে এসে কিছু লোক তাঁর আগ্নেয়াস্ত্র চাইলে তিনি আমাকে ফোন করেন পরামর্শের জন্য। আমি তাকে অস্ত্র দিয়ে দিতে বলি। বিরাজমান অস্থিরতা ও উত্তেজনার ঢেউ বিশ্ববিদ্যালয়েও এসে লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার ও শিক্ষকদের নিয়ে আমার অফিসঘরে বসে আমরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করি।
২৫ শে মার্চ রাত ১০ টার পরে আমার বাসায় টেলিফোন করে ঢাকা থেকে খবর দেন যে,পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ট্যাংক ঢাকার পথে বেরিয়ে গেছে,সম্ভবত: সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে এবং শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই খবর পেয়েই আমি শিক্ষকদের কয়েকজনকে আমার অফিসে আসতে বলি। এদের মধ্যে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ডঃ আর, আই চৌধুরী, অধ্যাপক করিম, অধ্যাপক মুহম্মদ আলী, ডঃ আনিসুজ্জামান, জনাব মাহবুব তালুকদার, ওসমান জামাল ও রেজিস্টার খলিলুর রহমান ছিলেন। আমরা প্রথমে চট্টগ্রাম সাংবাদিকদের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নিই। তাঁরা কিছুই বলতে পারলেন না। এই সময় আমার আত্মীয় কুমিল্লার ডি, সি. শামসুল হক খান-এর সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিনি জানান, যে কোন মুহূর্তে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে ক্যান্টনমেন্টে গাড়ীর জ্বালানী সরবরাহ আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমি তাঁকে অবিলম্বে কুমিল্লা সার্কিট হাউস থেকে সরে গিয়ে গ্রামের দিকে আশ্রয় নিতে বলি। আর পর তাঁর সঙ্গে আমার আর কোন যোগাযোগ হয়নি। তাকে সামরিক বাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল সে খবর অনেক দিন পরে পাই।
কুমিল্লার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর অনেক চেষ্টায় ঢাকার ‘পূর্বদেশ ‘ও ‘ইত্তেফাক’ অফিসে এবং আমার আত্মীয় ঢাকাস্থ নরউইচ ইউনিয়ন ইনসিওরেন্স – এর তৎকালীন প্রধান কর্মকর্তা জনাব আব্দুল মান্নান খানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। কেউ কেউ সেখান থেকে বললেন যে, একটা কিছু ঘটেছে, কেউ কেউ বলেন কোন মারাত্মক ঘটনার খবর তাঁদের জানা নেই। তবে শহরে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে এবং ট্যাঙ্ক ও সিপাহীরা রাস্তায় টহল দিচ্ছে। এ সময় চট্টগ্রামের একজন সাংবাদিক জানান যে, শেখ মুজিব আত্মগোপন করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। আমরা যখন ঢাকায় কথা বলছি,তখন ঢাকার সঙ্গে টেলিফোন সংযোগ হঠাৎ ছিন্ন হয়ে যায় অনুমান রাত ১১ টার দিকে। আমরা আরো দু-তিন ঘণ্টা বসে থেকে আলাপ-আলোচনা করি এবং সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। ঢাকাতে সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারে এই যুক্তির ওপর আমি বার বার জোর দিই। এর প্রেক্ষিতে আমাদের প্রস্তুতি জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেই এবং সেই রাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর এর অফিস আমাদের স্থানীয় সংগ্রাম প্রচেষ্টার সদর দপ্তরে পরিণত হয়। নেতৃত্বের দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবেই আমার ওপরে বর্তায়। সারা রাত অফিসে কাটিয়ে ভোর সাড়ে চারটায় বাসায় ফিরে এসে সবেমাত্র গোসল করতে বাথরুমে গিয়েছি তখন চট্টগ্রাম শহর থেকে কোষাধ্যক্ষ সিদ্দিকী সাহেবের ফোন পাই। তিনি জানেন যে তাঁর বাড়ীতে কয়েকজন তদানীন্তন ই বি আর-এর যুবক অস্ত্রসহ উপস্থিত হয়েছে। তারা এই বাড়ীতে ঘাঁটি স্থাপন করবে শত্রু পক্ষের মোকাবেলার জন্য। আমি ফোনে সেই উত্তেজিত যুবকদের সাথে কথা বলে জানতে পারি যে তারা জীবন নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে অস্ত্রসহ বেরিয়ে এসেছে এবং আরও দল বের হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে অস্ত্র ও গুলিগোলা আছে। তারা সিদ্দিকী সাহেবের বাড়ী থেকে ক্যান্টনমেন্ট -এর সঙ্গে যুক্ত শহরের রাস্তার ওপর নজর রাখবে এবং পাকিস্তানী সৈন্য রাস্তায় বের হলেই তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। এ বাড়ী তাই তাদের দরকার। আমি সিদ্দিকী সাহেবকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়ী ছেড়ে কাছাকাছি অন্য বাড়ীতে যেতে বলি এবং এদের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতে বলি। তখন শহরে স্থানে স্থানে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। টেলিফোনে গোলাগুলির আওয়াজ পাচ্ছিলাম এবং ছেলেরাও জানাল তাদের দক্ষিণ দিকের একটা বাড়ী থেকে এ বাড়ী লক্ষ্য করে গোলা ছোড়া হচ্ছে এবং বিদ্যুতের তারের খুঁটিতে আঘাত লেগে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। পরে আমরা জানতে পারি দক্ষিণের ঐ অবাঙালি বাড়িতে আগেই প্রস্তুতি হিসেবে শত্রু সৈন্য মোতায়েন ছিল।
২৬ শে মার্চ সকালে এ খবর আসার পর আওয়ামী লীগের জনাব এম, আর, সিদ্দিকী ও জনাব এম, এ, হান্নানের সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম এর পরিস্থিতি সম্বন্ধে আরও খবর জানতে পারি। কিছুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন রফিক সি, আর, বির টিলায় অবস্থান নিয়েছিলেন। আনিসুজ্জামান এর সঙ্গে তাঁর টেলিফোনে কথা হয় এবং পারস্পরিক এলাকার সংবাদ বিনিময় হয়। চট্টগ্রাম ডাকবাংলোতে অথবা রেলওয়ে রেস্ট হাউসে সংগ্রাম পরিষদের একটি অফিস কাজ করছিল। সেখান থেকে একজন টেলিফোন করে আনিসুজ্জামানকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে শোনান এবং তা লিখে নিয়ে সবাইকে জানাতে বলেন। এরপর চট্টগ্রামের বেতার তরঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা শুনতে পাই। জনাব এম, এ, হান্নান বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করেন এবং পরে সকলকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লালদীঘি ময়দানে জমায়েত হতে নির্দেশ দেন। আমি টেলিফোন করে কালুরঘাটে এবং ডাকবাংলোতে বলি যে,এই ঘোষণা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা দরকার, কেননা, ওরকম জমায়েতের ওপর বিমান থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা আছে। পরে তাঁরা এই সমাবেশ বাতিল করার ঘোষণা দেন। এ ব্যাপারে আমার যে আশঙ্কা ছিল পরবর্তী সময়ে তা সত্যে পরিণত হয়। পাকিস্তানের কয়েকটি জঙ্গি বিমান চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করার পর কালুরঘাটে বোমা বর্ষণ করে।
২৬ শে মার্চ সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটি থেকে জিলা প্রশাসক জনাব হাসান তৌফিক ইমাম টেলিফোনে আমাকে জানান যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং উত্তর চট্টগ্রাম থেকে ইপিআর -এর জওয়ানদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে জমায়েত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমি যেন তাদের দায়িত্ব নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি। রাতে প্রায় আড়াইশ জওয়ান ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছান। আমরা তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আলাওল হল ও এ, এফ, রহমান হলে থাকবার ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তখন থেকে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব আমরা শিক্ষক ও অফিসারদের মধ্যে ভাগ করে দেই। যেমন কেউ খাবারের তত্ত্বাবধান করেন, যানবাহনের দায়িত্ব নেন কেউ, পেট্রোলের জন্য পাম্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে স্লিপ দেবার দায়িত্ব দেয়া হয় কাউকে, ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবার নেতৃত্ব নেন কেউ। আমি অফিসে থাকি এবং আমাকে সর্বক্ষণ সহায়তার ভার দেয়া হয় আনিসুজ্জামানকে।
ই, পি, আর- এর জওয়ানদের প্রতিরোধ কার্যক্রমে তাৎক্ষনিকভাবে নেতৃত্ব দেবার জন্য পেয়েছিলাম সুবেদার আব্দুল গণিকে। সেই রাতেই আমার অফিস থেকে সি, এস, আই,আর-এ ড: হাইকে ফোন করে ক্যান্টনমেন্টের যতটুকু খবর আঁচ করা সম্ভব, তা জেনে নিই এবং ই, পি, আর -এর জওয়ানদের দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের উত্তর দিক (হাটহাজারী রাস্তার পূর্বদিকের এলাকা) ঘিরে রাখার কৌশল স্থির করা হয়। ক্যান্টনমেন্টের উত্তরাঞ্চলে ছিল পাহাড় ও জংগল এবং সামান্য জনগোষ্ঠীর বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যাপগ্রাফিক ম্যাপ ছিল। আমার অফিসে বসে ম্যাপ দেখে ট্রেঞ্চ কাটার জায়গা নির্দিষ্ট হয় এবং ক্যাম্পাসে কনট্রাকটরদের শ্রমিক দিয়ে রাত্রেই পরিখা খনন করা হয়। পরদিন জওয়ানদের নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং তাদের প্রত্যেককে প্যাকেট লাঞ্চ দেয়া হয়। এ ব্যাপারে গ্রাম্য জনসাধারণ আমাদের আবেদনে সাড়া দেন এবং যথেষ্ট সাহায্য করেন। তাঁরা সাধ্যমত চাল-ডাল-তরকারী, আটা, ময়দা, গরু, ছাগল, মুরগী আমাদের কাছে পৌঁছে দেন দান হিসেবে। তবে তাঁদের কাছ থেকে কোন অর্থ আমরা গ্রহণ করিনি। সৈন্যদের পথ দেখানোর কাজেও তাঁরা যথেষ্ট সাহায্য করেন। উল্লেখ্য যে, ই, পি, আর-দের সাহায্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এক মাইল দূরে রেল লাইনের পূর্ব দিকে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের জন্য ওয়ারলেস সেট স্থাপন করা হয়েছিল।
২৭ শে মার্চ বেতারে মেজর জিয়ার প্রথম ঘোষণা প্রচারিত হয়। তা শুনেই আমি হান্নান সাহেবকে টেলিফোনে বলি যে, ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর নাম যোগ করা আবশ্যক। নইলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয় বিবেচিত হবে না। মেজর জিয়া পরবর্তী ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধুর নাম করে, তাঁর পক্ষ থেকে।
২৭শে ও ২৮শে মার্চ ই, পি, আর-এর আরও কিছু জওয়ান এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে আত্মরক্ষা করে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত এদের সংখ্যা দাঁড়ায় চারশো’র বেশী। কিন্তু ই, পি, আর ও ই, বি, আর-এর জওয়ানদের একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয়। এস, পি শামসুল হক, মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার সঙ্গে আমার টেলিফোনে যোগাযোগ ছিলো। পরস্পরের কাছে পরিচিত হবার জন্য আমরা ভিন্ন কিন্তু নির্দিষ্ট নাম ব্যবহার করতাম। আমাকে দেয়া নাম ছিল ‘ডানিয়েল’। যোগাযোগ করা ক্রমশ: কঠিন হয়ে উঠছিলো, কেননা ক্রমেই তাঁদের অবস্থান এমন জায়গায় হচ্ছিল যেখানে টেলিফোনে কথা বলা যাচ্ছিল না। যাহোক,বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থানরত জওয়ানদের যুদ্ধ ব্যাপারে নেতৃত্ব দেবার জন্য আমি সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ক্যাপ্টেন রফিক-এর মারফত চেয়ে পাঠাই। তাঁরা পাঠান একজনকে। (পরে দেখি তিনি আমার পূর্ব পরিচিত ও আমার বড় ছেলের বন্ধু)। তাকে নিয়ে একটা ভুল বুঝা-বুঝি হয়। তিনি সরাসরি আমার অফিসে এসে জওয়ানদের দায়িত্ব গ্রহণ না করে, ক্যাম্পাসে আমার সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র দেখে আরও অস্ত্র সংগ্রহের জন্য বর্ডারে যাবার কথা বলেন এবং এ ব্যাপারে কর্তব্যরত অধ্যাপকের কাছে একটি গাড়ী চান। অধ্যাপক একথা আমাকে ফোনে জানান। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া কিংবা মেজর জিয়া যে তাকে পাঠিয়েছেন তা তিনি জানালেও আমরা সরাসরি কোন খবর কালুরঘাট থেকে পাইনি বলে উক্ত অফিসার সম্বন্ধে আমাদের সন্দেহের উদ্রেক হয়। তখন তাকে আমি আমার অফিসে ডেকে পাঠাই এবং জিজ্ঞাসাবাদ করি। তাতেও সন্দেহ নিরসন না হওয়াতে ই, পি, আর-এর এক নায়েক এবং দুই সিপাহীর সাহায্যে তাকে এবং তার দু’জন সহচর ছাত্রকে নিরস্ত্র করি এবং ভাইস চ্যান্সেলরের ভিজিটরস রুমে পাহারাধীন রাখি। তাঁদের উদ্দেশ্যে আমি বলি যে দেশ এক সংকটময় পরিস্থিতিতে জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত। এ অবস্থায় কারও চালচলনে সন্দেহের উদ্রেক হলে তাকে নজরবন্দী রাখতে হয়। মেজর জিয়ার ক্যাম্প থেকে তাঁদের সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করে তারপর সিদ্ধান্ত নেব। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়াকে ফোনে যোগাযোগ করি। তিনি বলেন যে, উক্ত অফিসারকে দু’জন ছাত্রসহ পাঠিয়েছি। আমার বক্তব্য, তাই যদি হয়, তবে আমার সঙ্গে দেখা না করে এখানকার দায়িত্ব না নিয়ে চলে যাচ্ছিল কেন। যাহোক,তখন ওই অফিসারকে মুক্ত করে আমি জিয়ার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিই এবং অন্য কোন সিনিয়র অফিসার পাঠাতে অনুরোধ করি। সঙ্গের দুজন ছাত্রকেও তার সঙ্গে পাঠাই কারণ এটা প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা প্রতিরোধ সংগ্রামে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিতে মেজর জিয়ার ক্যাম্পে গিয়েছিলো। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার নির্দেশে অফিসারকে নিয়ে আমাদের এখানে আসে। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত নয়। ছাত্রদের পরিচিতি সম্বন্ধে স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে (জনাব আখতারুজ্জামান তাঁদের মধ্যে একজন) খবর নিয়ে জানতে পারি যে, তাঁদের বক্তব্য সত্য। তখন ওই দুটি ছাত্রকে দিয়ে উক্ত অফিসারকে কালুরঘাট পাঠানো হয় ক্যাপ্টেন রফিকের নিকট। ছাত্র দুটি যখন ফিরে আসছিলো তখন তাঁরা পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ক্যাম্পাস থেকে সংগ্রাম পরিচালনার সময় আমাদের ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দুইজন সদস্য আব্দুর রব (তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক) এবং ফরহাদ কাপ্তাই রোডের ওপর এক গেরিলা অপারেশনে মৃত্যুবরণ করে।
২৯শে মার্চ সেনাবাহিনী ও পুলিশের অফিসারদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। মনে হয় তাঁরা অবস্থান পাল্টেছেন, কিন্তু আমাদের খবর দেবার সময় পাননি।
পক্ষান্তরে আমরা চট্টগ্রাম শহরের পতনের সংবাদ পাই। ইতিমধ্যে শত্রুর গুলিতে পরিখায় অবস্থানরত আমাদের কয়েকজন জওয়ান আহত হয়। এমতাবস্থায় প্রতিরোধ এখান থেকে জোরদার করা সম্ভব নয় বলে জওয়ানদের পক্ষ থেকে আরও উত্তরে চলে যাবার প্রস্তাব আসে। আমরা একমত হই। তাঁরা নাজিরহাটে যাবে সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের সঙ্গে অবস্থানকারী জওয়ানরা গন্তব্যস্থলের দিকে রওয়ানা হয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে ডাক্তার আবুল বশর ও ডাক্তার আখতারুজ্জামানের চিকিৎসাধীন কয়েকজন আহত যোদ্ধা ছাড়া তখন আর প্রায় কোন যোদ্ধাই আমাদের হাতে রইলো না। এরপরে শহর থেকে গ্রাম্য পথ ঘুরে যোদ্ধৃবেশে কিছু আওয়ামী লীগ ও নেতা এবং ইউ, ও, টি, সির কিছু প্রশিক্ষণরত ছাত্র ও অফিসার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছান,কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ করে রাখা অসম্ভব দেখে তারাও অন্যত্র চলে যান। এদিকে ক্যাম্পাস থেকে উত্তর চট্টগ্রাম বা রাঙ্গামাটির রাস্তায়ও স্থানীয় জনসাধারণ ব্যারিকেড স্থাপন করতে শুরু করে। এই অবস্থায় আমরা স্থির করি যে ৩০ শে মার্চ ক্যাম্পাস থেকে সকল শিশু, বৃদ্ধ ও নারীকে স্থানান্তরিত করা হবে। কয়েকটি বাসে করে কিছু পরিবার নাজিরহাটে পাঠিয়ে দেয়া হয়, অন্যেরা গিয়ে আশ্রয় নেন কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের হস্টেলে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের বেতন বন্ধ ছিল কারণ হাতে টাকা ছিল না এবং ব্যাংক বন্ধ ছিল। কিছু কর্মচারী ব্যাংকের দরজা ভেঙ্গে টাকা নেয়ার প্রস্তাব করে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিই এবং ব্যাংক লুট করা চলবে না বলে দিই। আমার বাসায় যে ব্যক্তিগত টাকা ছিল (উল্লেখ্য, আ,আর ব্যক্তিগত গাড়ী বিক্রয়ের দশ হাজার টাকা ব্যাংক বন্ধ থাকায় বাসায় ছিল) সেখান থেকে চার হাজার টাকা নিয়ে এবং অধ্যাপক আর, আই, চৌধুরীর কাছে যে ২/৩ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসের টাকা ছিল তা নিয়ে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের বাড়ী যাবার ভাড়া তাৎক্ষণিকভাবে দিয়ে দিই এবং তাদের যার যার বাড়ীতে চলে যেতে বলে তাদের কাছ থেকে আমি বিদায় নিই। ৩১ শে মার্চ রাতে ক্যাম্পাস প্রায় খালি হয়ে যায়। ডাক্তার দু’জনের হাতে চিকিৎসাধীন চার পাঁচজন যোদ্ধাকে রেখে ১লা এপ্রিল সন্ধ্যায় আমার পরিবার, রেজিস্টারের পরিবার এবং আনিসুজ্জামানকে (তাঁর পরিবার আগেই কুণ্ডেশ্বরীতে স্থানান্তরিত হয়েছিল) নিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করলাম। আমি সপরিবারে রাউজানে আশ্রয় নিলাম। ক্যাম্পাসে ভি, সির বাসগৃহ ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় আমার সেক্রেটারি ইনস্যুরেন্স পলিসি, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদির কিছু কাগজপত্রের ব্যক্তিগত ফাইল আমার পাসপোর্টসহ আমার সামনে এনে হাজির করে সঙ্গে নেবার জন্য। আমি ওই পাসপোর্ট সবার সামনে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম কারণ, তখন আমি আর পাকিস্তানী নই, তাই পাকিস্তানী পরিচয়ে কোন পাসপোর্ট সঙ্গে রাখতে চাইনি। অন্যান্য কাগজপত্রের ফাইলটিও ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, যতক্ষণ না দেশ স্বাধীন হচ্ছে ততক্ষণ কোন বীমা, কোন শেয়ার সার্টিফিকেটের দরকার নেই। পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীন হবার পর আমার সেক্রেটারি ঐ ছুড়ে ফেলে দেয়া ফাইলটি আমার ড্রাইভারকে দিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
রাউজানে আমি সপ্তাহখানেক ছিলাম। ইতিমধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের প্রতিকূলে চলে যায়। সকলেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করতে থাকে। কুণ্ডেশ্বরীতে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা ছড়িয়ে- ছিটিয়ে পড়েন। সেখানে আশ্রয় দাতা নূতনচন্দ্র সিংহের পরিবার ও স্থান ত্যাগ করেন। নূতন বাবু শূন্য গৃহে রয়ে যাবার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পরে ১৩ ই এপ্রিল হানাদার বাহিনী তাকে হত্যা করে।
সম্ভবত: ৮ই এপ্রিল আমি রাউজান থেকে নাজিরহাটে চলে যাই। ওখানে তখন আমাদের সহযোগী জওয়ানরা ছিলেন। সেখানে এক রাত তাদের সঙ্গে থেকে রামগড়ের পথে রওয়ানা হই। সপরিবারে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক রশিদুল হক ও ড: মাহমুদ শাহ কোরেশী আমার সঙ্গে আসেন। উল্লেখ্য নাজিরহাট থেকে আমার সঙ্গে যায় মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজন, তাদের সঙ্গে কালুরঘাট থেকে সরিয়ে আনা ট্রান্সমিটার সেট ছিল। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধাও ছিল।
১০ ই এপ্রিলে হানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করে। ১১ই থেকে ১৪ ই এপ্রিলের মধ্যে রামগড়ে সপরিবারে এসে পৌঁছান অধ্যাপক শামসুল হক, ডঃ আনিসুজ্জামান, ওসমান জামাল; অন্য শিক্ষকদের মধ্যে ষরিৎকুমার সাহা, নূরুল ইসলাম খোন্দকার প্রভৃতি এবং বেশ কিছু ছাত্র। ছাত্রেরা অনেকেই সাবরুম হয়ে ভারতে প্রবেশ করে এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ দু’চার দিনের সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এসে শত্রুর মোকাবিলা করে। আমাদের ছাত্র শহীদ ইফতিখার ছিল তেমন একজন।
রামগড়ে এসে মেজর জিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হয়। সেখান থেকেই তিনি তখন যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেজর শামসুদ্দীন (ই পি আর), ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন আফতাব (গোলন্দাজ বাহিনী), ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া প্রমুখ। রাঙ্গামাটি থেকে হাসান তৌফিক ইমাম ও এস, পি বজলুর রহমান আমাদের আগেই এখানে এসে যোগ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতৃস্থানীয় কর্মী তাদের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকা থেকে সাদেক খানও সেখানে এসে পৌঁছান। রামগড়ে মুক্তিযুদ্ধের কাজে এবং আমাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সর্বাত্মক সাহায্য করেন সেখানকার চা বাগানের ম্যানেজার জনাব আব্দুল আউয়াল। রামগড় অবস্থানের শেষ দিন ভোরে ক্যাপ্টেন কাদের আমার সঙ্গে দেখা করে তাঁর উপর জিয়া কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে যান পার্বত্য চট্টগ্রামে। তিনি এই অপারেশন নিহত হন।
এপ্রিলের মাঝামাঝি রামগড় থেকে আগরতলায় গিয়ে পৌছাই। দেশের মাটি ছাড়ার সময় আমরা যারা চলে যাচ্ছিলাম এবং আমাদের যেসব বন্ধু তখনও দেশে রয়ে গেলেন, সকলেরই চোখ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। আমি আনিসুজ্জামানকে তখন বলেছিলাম, মন খারাপ করো না, এই বছর শেষ হবার আগেই আমরা স্বদেশে ফিরে আসব। আমি জানিনা সেই দুরবস্থার সময়ে এ প্রত্যয় কি করে আমার মনে জন্মেছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতে একথা আমি বহুজনকে বহুবার বলেছিলাম। এমনকি জুন মাসেই সিদ্ধার্থ সঙ্কর রায়কে বড়দিন উপলক্ষে চট্টগ্রামে আসার পর অগ্রিম নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।
আগরতলায় একটি পরিত্যক্ত বাসগৃহে আমার ও পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। অদূরে শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কলেজের একটি পরিত্যক্ত হোস্টেলে সৈয়দ আলী আহসান, রশিদুল হক ও কোরেশীর স্থান হয়। পরে এই হোষ্টেলেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুল হক, আনিসুজ্জামান, ওসমান জামাল, চা বাগানের আব্দুল আউয়াল এবং মেজর শামসুদ্দিন, মেজর শওকত ও মেজর শফিউল্লার পরিবার আশ্রয় লাভ করেন। এক-একটি কক্ষে এক-একটি পরিবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
আগরতলায় আমার অনেক আগেই এসে পৌঁছেছিলেন জনাব এম, আর, সিদ্দীকি ও জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী। তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে কর্মপন্থা স্থির করার চেষ্টা করি। কিন্তু তাৎক্ষণিক কিছু করার ছিল না। তখন আমরা সকলেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার অপেক্ষা করছি। স্রোতের মতো শরণার্থী আসছে। ঢাকা থেকে ও অনেক বন্ধু, পরিচিত, স্বজন সেখানে এসে পৌঁছচ্ছেন। এখানে একদিনের দুপুরের খাবার এর কথা আমার মনে পড়ে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খাবারের আয়োজন ছিল বেশ উন্নতমানের। আমরা খেতে বসেছিলাম। এই কদিন আমাদের সঙ্গে যেসব ছেলে কাজ করছিল তাদের যে দুরবস্থা আমি দেখেছি তা ভেবে আমার বিবেক নাড়া দিল, আমি খেতে পারলাম না। সৈয়দ আলী আহসান ও অন্যান্য সহযোগীদের বলে আমি এলাম এবং একটি সস্তা হোটেলে গিয়ে রুটি ও নিরামিষ খেলাম। প্রতিরোধ যুদ্ধে পিছু হটলেও সীমান্তের কাছাকাছি তখনও যুদ্ধ চলছে। মেজর খালেদ মোশাররফ এসে ২/৩ রাত আমাকে যুদ্ধ ক্ষেত্রের কাছে নিয়ে যান। অচিরেই তাঁকে সদলে পিছু হটতে হয়। সঙ্গী অফিসারদের নিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর জিয়া আগরতলায় চলে আসেন। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে আমার আগরতলায় পরিচয় হয়। ট্রান্সমিটার সমেত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রও উঠে আসে আগরতলায়। কিন্তু এর প্রচার শক্তি এত সীমাবদ্ধ ছিল যে, কর্মীদের আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফল ঘরে ঘরে পৌঁছতে পারেনি। পরে ড: ত্রিগুনা সেন যখন আগরতলা সফরে আসেন, তখন তাঁকে আমরা অনুরোধ জানিয়েছিলাম আমাদের বেতারের জন্য শক্তিশালী ট্রান্সমিটার সরবরাহ করতে।
আগরতলায় থাকতে একদিন দৈনিক ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় খবর দেখলাম যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপারটা ছিল এই যে, এপ্রিল মে মাসে কাঠমুন্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তন উৎসবে আমার প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেবার কথা ছিল। নেপালি কর্তৃপক্ষ তাই পাকিস্তান সরকারকে আমার বিষয়ে লিখেন। পাকিস্তান সরকার জানান যে,আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাঠমুন্ডুর কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে খবরটা ঐভাবে প্রকাশ পায়। পরে পাকিস্তান সরকার অনেক শরণার্থী সম্পর্কে ভারত সরকারকে লিখেছিলেন যে, দুষ্কৃতকারীরা তাদের ধরে ভারতে নিয়ে গেছে, এসব ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে পাকিস্তান সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক। এই তালিকায় অবশ্য আমার নাম ছিল না।
মে মাসের প্রথম দিকে জনাব আব্দুল মালেক উকিল কলকাতা থেকে এক সন্ধ্যায় আগরতলায় আমার বাসায় আসেন। তিনি বললেন,প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন,তাঁর সঙ্গে দিল্লী যাবার জন্য। উকিল সাহেব আমার কলকাতা যাবার বিমানের টিকিটও নিয়ে এসেছিলেন। পারিবারিক ব্যবস্থা সাঙ্গ করে কলকাতায় পৌছতে আমার দুই দিন বিলম্ব হয়। তাজউদ্দিন সাহেব দিল্লী চলে গিয়েছিলেন,আমার আর তখন যাওয়া হল না। এখানে উল্লেখ করতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকালে সপরিবারে আমার ব্যয় নির্বাহের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আমাকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু তা আমি গ্রহণ করিনি। দেশের বাইরে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজন,ছাত্র-ছাত্রী ও বন্ধুবান্ধবের নিকট হতে প্রাপ্ত সাহায্যসামগ্রী দিয়েই আমি সংগ্রামের দিনগুলি কাটিয়েছি।
কলকাতা পৌঁছে বাংলাদেশ মিশন অফিসে আমাকে নেয়া হয়। হোসেন আলী তখন বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করে এই মিশনের অস্থায়ী প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন,বিদেশে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীকে টেলিফোনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজে যোগদানের অনুরোধ জানাতে। কলকাতায় তাঁদের ধারনা ছিল, বিচারপতি চৌধুরী এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছেন। টেলিফোন বুক করা হল। কিন্তু লাইন পাওয়া গেল না। শেষে তাঁর কাছে পাঠানোর জন্য আমি ম্যাসেজ রেখে গেলাম যে, আমি এসে গেছি উনি যেন বাংলাদেশের সমর্থনে কাজ করতে নেমে যান।
কলকাতায় এসে আমার প্রথম কাজ হয় বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া গঠন করা। দেশের যেসব বুদ্ধিজীবী,শিল্পী ও অন্যান্য সংস্কৃতিকর্মী ততদিনে কলকাতায় শরণার্থী হয়েছেন, তাঁদের সংগঠিত করে মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে কাজ করা ছিল এর উদ্দেশ্য। আমি সভাপতি নির্বাচিত হই, জহির রায়হান নির্বাচিত হন সাধারণ সম্পাদক। সৈয়দ আলী আহসান, সারওয়ার মুর্শিদ, ব্রজেন দাশ, ফয়েজ আহমদ, কামরুল হাসান প্রমুখ এই কমিটি তে ছিলেন। প্রথম দিকে এই কমিটির কর্মকর্তাদের কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয় আমার প্রাক্তন ছাত্রী, সেসময়ে লরেটো কলেজের অধ্যাপিকা ডঃ পি সি ঘোষ এর বাসভবনে। তিনি এবং তাঁর স্বামী কমল ঘোষ ব্যক্তিগতভাবেই কমিটির কর্মকর্তাদের আপ্যায়ন এবং সভার অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচাদির ব্যয়ভার বহন করতেন। এই বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে নেতাজী রিসার্চ ইন্সটিটিউটে বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। এখানে আমার দুই মেয়ে এমি ও রানা তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি, মুক্তিযুদ্ধের গতি, শরণার্থীদের অবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সংগৃহীত হয়। অরুপ চৌধুরীর অফিসও এই পরিষদের কাজে এবং পরবর্তীতে স্থাপিত শিক্ষক সমিতির কাজে ব্যবহার করা হয়। পরে বাংলাদেশের শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন স্থানে সঙ্গীতানুষ্ঠান ও প্রচারমূলক বক্তৃতাদানের ব্যবস্থাও হয় পরিষদের উদ্যোগে। এর কাজে কলকাতার মৈত্রেয়ী দেবী, গৌরী আইয়ুব, বিচারপতি মাসুদ এবং অধ্যাপক আব্দুল ওয়াহেদ মাহমুদ খুব সাহায্য করেছিলেন।
ইতিমধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ সেনকে সভাপতি করে ও দিলীপ চক্রবর্তীকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি। এঁদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করা এবং বাংলাদেশের শরণার্থী শিক্ষকদের নানাভাবে সাহায্য করা। আমি কলকাতা এলে এঁদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। আলাপক্রমে স্থির হয় যে বাংলাদেশের শিক্ষকদের একটা সংগঠন থাকলে উভয় পক্ষেই কাজের সুবিধা হবে। আমি তখন এই কাজের উদ্যোগ নেই নিই। আনিসুজ্জামানকে আগরতলা থেকে ডেকে পাঠাই এবং কয়েক দিনের প্রস্তুতির পর দ্বারভাঙ্গা হলে বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের এক সভা আহবান করি। কয়েক হাজার শিক্ষক এই এই সভায় যোগদান করেন। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে জনাব কামরুজ্জামানও বক্তৃতা দেন। সভার সভাপতিরুপে আমি যে ভাষণ দিয়েছিলাম তা পরে কলকাতা বেতার থেকে প্রচারিত হয়। এই সভায় আমাকে সভাপতি ও আনিসুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গঠিত হয়। সহ-সভাপতিদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান, সারওয়ার মুর্শিদ ও জনাব কামরুজ্জামান (এমপি)।
‘লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া’ গঠন করা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। কেউ কেউ সরকারকে এমন ধারণা দিয়েছিলেন যে সরকারী যে উদ্যোগের বাইরে যেভাবে আমরা এই পরিষদ গঠন করেছি তাতে সরকারের সঙ্গে অসহযোগের সম্ভাবনাই বেশী থাকবে। আমাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ এমন ধারনা করেছিলেন যে সরকার এক ধরনের দলীয় নিয়ন্ত্রণ আমাদের ওপরে আরোপ করতে যাচ্ছেন। শিক্ষক সমিতি গঠনের পূর্বমুহূর্তেও আবার এ ধরনের একটা ভাবের সৃষ্টি হয়। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এমপি ও জনাব কামরুজ্জামান এমপি’র মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এক সন্ধ্যায় আমাকে ও আনিসুজ্জামানকে ডেকে পাঠান। তিনি বলেন যে, আনিসুজ্জামান প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে যুক্ত থাকলে তাঁর কাজে সুবিধা হবে অতএব তাঁকে যেন শিক্ষক সমিতিতে বড় দায়িত্ব না দেয়া হয়। আমিরুল ইসলাম ও একই বক্তব্য সমর্থন করেন। কিন্তু আমরা আগে থেকে যেভাবে ভেবে এসেছিলাম তার ফলে এই প্রস্তাবে সম্মত হইনি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পনা সেল গঠন করলে ডঃ মুজাফফর আহমদ, ডঃ সারোয়ার মুর্শিদ, ডঃ মোশাররফ হোসেন ও ডঃ স্বদেশ বসুর সঙ্গে ডঃ আনিসুজ্জামানকে তার সদস্য করা হয় তখন আনিসুজ্জামান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ত্যাগ করেন এবং সেই ভার অর্পিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ অজয় রায়ের ওপরে।
শিক্ষক সমিতির কাজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের শরণার্থী শিক্ষকদের সাহায্য করা, শরণার্থী শিবিরে প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয় চালানো, প্রচার পুস্তিকা প্রণয়ন করা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন চেয়ে পত্র লেখা ও পুস্তিকা প্রেরণ করা এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রচারাভিযান চালানো। বহু শিক্ষককে আমরা সহায়ক সমিতির তহবিল থেকে সাহায্য করতে পেরেছিলাম, শরণার্থী শিবিরে কিছু কিছু বিদ্যালয় খুলে বালক-বালিকাদের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা রাখার ও শিক্ষকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। কয়েকটি পুস্তিকা আমরা প্রকাশ করেছিলাম ইংরেজিতে তার মধ্যে ‘পাকিস্তানবাদ ও বাংলাদেশ’ সম্পর্কে ওসমান জামালের লেখা একটি পুস্তিকা এবং বাংলাদেশ গণহত্যা সম্পর্কে একটি সচিত্র পুস্তিকা উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমরা চিঠি লিখি এবং আশাব্যঞ্জক ও সমর্থনসূচক উত্তর পাই। অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এল বাসামকে লেখা আমার চিঠি, তিনি আমার অনুমতি নিয়ে সাইক্লোষ্টাইল করে সে দেশের প্রধান মন্ত্রী ম্যাকলম ফ্রেজারসহ অনেক নেতাকে পাঠান এবং আমাদের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ করেন। আমেরিকা ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পরিচিত অধ্যাপকের কাছে লিখা আমার চিঠি মোটামুটি একই ভাবে ব্যবহার করা হয়।
ভারতে আমরা যে প্রচারাভিযান চালাই, তার প্রথম পর্বের সম্পূর্ণ উদ্যোগ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির। এই সমিতির দিলীপ চক্রবর্তী, সৌরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, অনিল সরকার (বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাহায্য-সহায়তায় অনিলের গভীর আবেগ নিয়ে জড়িয়ে পড়ার একটি উদাহরণ আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই। এক পর্যায়ে শরণার্থী শিক্ষকরা যখন আর কোথাও আশ্রয়ের স্থান পাচ্ছেন না, তখন তিনি নিজ বাসগৃহ তাঁদের থাকার জন্য ছেড়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ওঠেন এবং তাঁর স্ত্রী প্রতিদিন ভোরে ঐ বাড়িতে এসে রান্নাবান্না ও তাঁদের খাওয়ানোর কাজ সেরে রাত ন’টার পর তাঁর পিতার বাসায় ফিরতেন), ডঃ অনিরুদ্ধ রায় ও বিষ্ণুকান্ত* শাস্ত্রীকে নিয়ে আমি ও আনিসুজ্জামান এলাহাবাদ, আলীগড়, লক্ষ্ণৌ, আগ্রা ও দিল্লী সফর করি। এসব শহরের বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন ছাড়াও আমরা বিভিন্ন জনসভায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ওপর বক্তৃতা দেই। আমাদের সংগে সুবেদ আলী (এম,পি,এ) যোগ দেন। তিনি প্রয়োজনমত উর্দুতে আমার ইংরেজি বক্তৃতার অনুবাদ জনসমাবেশে পেশ করতেন। বিষ্ণুকান্ত বলতেন হিন্দিতে। আনিসও আমার মতো ইংরেজিতেই বলতেন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু আমাকে বক্তৃতা করতে দেয়া হয়। সেখানকার পরিবেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূল ছিল না। বক্তৃতা করতে ওঠার আগে সে সম্পর্কে আমি সচেতন ছিলাম। আমার বক্তৃতার পরে শ্রোতাদের অনেকেই কেঁদে ফেলেছিলেন। বক্তৃতা নাকি মর্মস্পর্শী হয়েছিল, একথা অনেকে বলেছেন।
দিল্লীতে সাহিত্য একাডেমীর প্রাঙ্গণে অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভায় ভাষণ দিই এবং বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে আনিসুজ্জামান বক্তৃতা দেন।
বক্তৃতা দেওয়া ছাড়াও দিল্লীতে আমরা বেশ কয়েকটি ঘরোয়া আলোচনায় যোগ দেই। কলকাতায় আসার পরে ডক্টর বরুণ দের মাধ্যমে সিদ্ধার্থ রায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে আলোচনা হয়। আমার মনে হয়েছিল, তিনি তখনও আমাদের সংগ্রামের তীব্রতা অনুভব করতে পারেননি। দিল্লীতে আবার তাঁর সঙ্গে এবং শিক্ষামন্ত্রী ডঃ নূরুল হাসানের সঙ্গে শুধু আমার সাক্ষাৎ হয়। তাছাড়া আমরা অশোক মিত্র ( আই,সি,এস) ,ডঃ আশোক মিত্র পি, এন, ধর ও পি, এন হাকসারের সঙ্গে আলাপ করি। বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে একটি কমিটি গঠন করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের বিবেচনা করা উচিত, একথা হাকসার বেশ জোর দিয়ে বলেছিলেন। তাঁর কথা পরে আমরা আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম।।
দিল্লীতে আমরা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সংগে সাক্ষাৎ করি। তিনি ধৈর্য সহকারে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার বক্তব্য শোনেন এবং ভারতীয় সরকার ও জনগণের সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে আমরা মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিতে পারি সে সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত মত বিনিময় করেন। পরে মিসেস গান্ধী ও শিক্ষামন্ত্রী ডঃ নূরুল হাসানের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হয়। এরপরে প্রতিমন্ত্রী কে, আর গণেশ আমাদের এক নৈশভোজে আপ্যায়িত করেন। সেখানে ব্রক্ষানন্দ*রেড্ডী ও নন্দিনী শতপথীর মতো রাজনীতিবিদরা ছিলেন, অনেক সাংবাদিকও ছিলেন। প্রধানত: সাংবাদিকরাই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বহুবিধ প্রশ্ন করেন, রাজনীতিবিদেরাও কিছু কিছু প্রশ্ন করেছিলেন।আমার উত্তর দেয়া শেষ হলে আমি কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ পাই। আমার প্রশ্ন ছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্যে, তবে আমি তা সাধারণভাবে উত্থাপন করেছিলাম। ঐ আলোচনা থেকে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য ছাড়া শরণার্থী সমস্যার সমাধানের যে কোন সম্ভাবনা নেই একথা ভারতীয় নেতারা বোঝেন। তবে তাঁরা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাবছেন। চীন যে পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করবেনা, এ ধারণাও তাঁদের হয়েছে। মনে হল তবুও তারা ঐ মুহূর্তে ঝুঁকি নিতে চান না এ বিষয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি হবে, এ সম্পর্কে তাঁরা খুবই সন্দিহান। সুতরাং ভালো করে আটঘাট না বেঁধে তাঁরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কিংবা বাংলাদেশের পক্ষে বড় রকম সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চান না।
সমস্ত পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমার এবং আমাদের এসব সাক্ষাৎকারের ফলাফল ও আমার নিজের ধারণা আমি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন কে কলকাতায় এসে জানাই। এরপর আমি পাটনা, বোম্বাই, নাসিক, পুনা, কেরালা, জয়পুর, আজমীর ও হায়দারাবাদে জনসভায় বক্তৃতা দিতে যাই। পাটনায় যে বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দিতে যাই সে সভায় সভাপতিত্ব করেন জয় প্রকাশ নারায়ণ এবং অন্যান্যর মধ্যে বক্তৃতা দেন বিহার প্রদেশের গভর্নর ডঃ বড়ুয়া।
বোম্বের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও আমি ছাত্র শিক্ষকদের সমাবেশে বক্তৃতা দিই। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। এখানে বাংলাদেশের দুর্গত শরণার্থীদের সাহায্যে আনুমানিক ষাট/সত্তর হাজার টাকার চেক প্রদান করা হয়। এই সাহায্য এবং একইভাবে ভারতের বিভিন্ন জনসভায় সংগৃহীত অর্থ আমরা দাতাদের পক্ষ থেকে সরাসরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির তহবিলে জমা দেবার ব্যবস্থা করি। কোন অর্থ আমরা নিজ হাতে গ্রহণ করিনি। বিহারে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে জনসমর্থন যোগানোর ব্যাপারে তৎকালীন বিহার সরকারের বিরোধীদলের নেতা কর্পোরী ঠাকুর (পরবর্তীকালে ইনি মূখ্যমন্ত্রী হন) আমাদের সংগে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের সকল রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে ও তাদের সরকারের সংগে সহযোগিতা করেছে। প্রধানমন্ত্রী সবচে’ কট্টর বিরোধী নেতা রাজ নারায়ণও আমাদের সমর্থনে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আমার এলাহাবাদ সফরকালে তিনি তার রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এক বিরাট জনসমাবেশের আয়োজন করেন এবং সমাবেশের তোরণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিরাট এক প্রতিকৃতি স্থাপন করেন। দলের কর্মকর্তা আর কর্মীদের আগ্রহে আমি ঐ সমাবেশে তাদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেই। সে সময় ভারতে বাংলাদেশের সমর্থনে এমন একটি জোয়ার এসেছিল যাতে করে সব জায়গায়, এমনকি দুর্গাপূজা মণ্ডপের প্রবেশদ্বারেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানানো দেখেছি।
বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই)অবস্থান কালে মহারাষ্ট্রের গভর্নর নবাব ইয়ার আলী জংগ এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। বাংলাদেশের সমর্থনে আয়োজিত সমাবেশে তিনি উপস্থিত হন এবং আমার বক্তৃতা শোনেন। বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রচুর অর্থ, গেরিলাদের জন্য পোশাক পরিচ্ছদ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ মুক্ত হবার পর আমি যখন দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলাম তখন প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যে একদিন হঠাৎ নবাব ইয়ার আলী জংগ আমার বাসায় এসে উপস্থিত হন এবং বলেন যে,“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যের জন্য আমি যে তহবিল খুলেছিলাম তাতে প্রচুর টাকা জমা হয়েছে। যেহেতু এই টাকা আমাদের জনসাধারণ কর্তৃত্ব বাংলাদেশকে দেয়া তাই এটি আপনাকে নিতে হবে”। মহারাষ্ট্রে তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল। সুতরাং এই বিষয়ে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলি। মহারাষ্ট্রের গভর্নর আমাকে তহবিলের যে চেক প্রদান করেন তা আমি বঙ্গবন্ধুকে পাঠিয়ে দিয়ে সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতীকী সাহায্য হিসেবে মহারাষ্ট্রের জনগণকে দেবার জন্য পরামর্শ দেই। অতঃপর তাই করা হয়।
শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে সৈয়দ আলী আহসান কে একবার বাঙ্গালোরে এবং মাজহারুল ইসলাম কে কেরালাতে বক্তৃতা দিতে পাঠানো হয়। সৈয়দ আলী আহসান, মাজহারুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান মাঝে মাঝে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। আমিও দুবার অংশ নিয়েছিলাম।
সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে (১৮ থেকে ২০ তারিখ) দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। “ওয়ার্ল্ড মিট অন বাংলাদেশ” নামে এটি পরিচিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জয়প্রকাশ নারয়ণ। সেখানে ২৪ টি দেশের ১৫০ জন প্রতিনিধি সমবেত হন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতারূপে আমি এই সম্মেলনে যোগ দেই। অন্যান্যদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান, মওদুদ আহমদ ও আজিজুর রহমান প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীও এই উপলক্ষে আয়োজিত হয়। আমি তা উদ্বোধন করি। এই সম্মেলন খুব সফল হয় এবং বিশ্ব জনমত গঠনে আনুকূল্যও সৃষ্টি হয়। এই সম্মেলনের সাফল্যের পিছনে গান্ধী ফাউন্ডেশনের বেশ অবদান আছে। এখানে অমরেশ সেন এর ভূমিকা ও তৎপরতা উল্লেখযোগ্য। এখানে একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বি পি কৈরালা, অমরেশ সেন এর বাসায় গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রামে গুর্খাদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেন। সেসময় তিনি ভারতে আশ্রিত ছিলেন বলে তার এই প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয়, একথা তাকে জানাই। তবে তার এই আগ্রহের কথা আমি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ কে জানানোর আশ্বাস দেই। পরবর্তীকালে এই কথা তাজউদ্দীন আহমেদকে জানালে তিনি এই ব্যাপারে আমার সঙ্গে ঐক্যমত প্রকাশ করেন যে, ভারতে আশ্রিত কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সহায়তা নেয়া আমাদের উচিত হবে না।
দিল্লীর আন্তর্জাতিক সম্মেলন শেষ করেই আমি নিউ ইয়র্ক এর পথে রওনা হয়ে যাই। বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রচারকার্য চালানো ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার তখন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। আমি এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। শিক্ষকদের মধ্যে রেহমান সোবহানও ছিলেন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে আবদুস সামাদ আজাদ, এ আর সিদ্দিকী, ফণি মজুমদার, সিরাজুল হক আর ছিলেন সৈয়দ আবদুস সুলতান, ডাঃ আসহাবুল হক এবং ফকির সাহবুদ্দীনের মত সংসদ সদস্য। এস এ করিম, আবুল ফাতাহ ও এ, এম, এ মুহিতের মতো বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী প্রাক্তন পাকিস্তানী কূটনীতিবিদ। আমাদের এই প্রচেষ্টার সাফল্য সম্পর্কে অনেকেই অবহিত আছেন।
জাতিসংঘের অন্যান্য কয়েকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি পর্তুগালের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় ও আমার কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। একদিন আমি জাতিসংঘ ভবনে পর্তুগীজ দূতের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলাপ করছি, তাঁকে আমাদের সংগ্রামের পটভূমি বিশদভাবে বুঝাচ্ছি ঠিক সে সময় আমাদের সামনে দিয়ে হলের ভিতরে যাচ্ছেন পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের সদস্য শাহ আজিজুর রহমান, মাহমুদ আলী, রাজিয়া ফয়েজ প্রমুখ। এঁরা যাবার সময় পর্তুগীজ দূত আমাকে আঙ্গুলের ইশারায় বললেন, ঐ দেখুন, আপনাদের প্রতিপক্ষরাও যাচ্ছেন। রাজিয়া ফয়েজ আমার পূর্বপরিচিতা ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে আমার কাছে এসে হোটেলে আমার ঠিকানা জানতে চাইলেন এবং রাত দশটার পর আমার সঙ্গে দেখা করবেন, বললেন। নির্ধারিত সময়ে তিনি জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আমাকে এই বলে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, আপনার মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ যাঁদের সঙ্গে কাজ করছেন তাঁদের নেতা হলেন তাজউদ্দিন প্রমুখ ব্যক্তি। আমি বললাম তাঁরা জনগণের প্রতিনিধি। গণপ্রতিনিধিরা আমার চাইতে বেশী সম্মানের দাবিদার। সব দেশে তাঁরাই সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের বেলায়ও তাই হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা লিপ্ত আছি। কে বেশী সম্মানিত কে কম সম্মানিত এ প্রশ্ন এখানে ওঠে না। তাঁকে আমি বলি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দেশ স্বাধীন হবে এবং তা আর বেশীদিন বাকী নেই। বাংলাদেশের গেরিলাদের হাতে প্রতিদিন যত পাক সৈন্য মারা যাচ্ছে তাদের সংখ্যা পাকিস্তান সরকার গোপন করতে চাইলেও বিদেশী সাংবাদিকরা তাদের হতাহতের যে সংবাদ দিচ্ছেন তাতে বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। তখন তিনি ও অধিক হারে পাক সৈন্য ক্ষয়ের কথা স্বীকার করলেন। আমি তাঁকে আবার প্রশ্ন করি, আপনার এই শারীরিক অবস্থায় আপনি কিভাবে এসেছেন ? উল্লেখ্য যে তিনি সন্তানসম্ভবা ছিলেন। তিনি জানান, ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের চাপে আমাকে অনিচ্ছা ও অসুবিধা সত্ত্বেও আসতে হয়েছে। সন্তান ধারণের ৭ মাস অতিবাহনের মেডিক্যাল সার্টিফিকেট প্রদান করা সত্ত্বেও আমাকে অব্যাহতি দেয়া হয়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর অন্যান্যদের সঙ্গে যখন তাঁকেও বাংলাদেশের বিরোধিতা করার কারণে জেলে পাঠানো হয়েছিল তখন তাঁর স্বামী ও তাঁর বোন আমার কাছে আসেন তাঁর মুক্তির ব্যাপারে বলার জন্য। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর সম্পর্কে একথার ওপর জোর দিয়ে বলি যে, তিনি ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন, অতঃপর অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও জেল থেকে মুক্তি পান।
জাতিসংঘে দায়িত্বপালনের সঙ্গে সঙ্গে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সম্পর্কে শিক্ষক, ছাত্রদের সমাবেশ ও জনসভায় বক্তৃতা করি। প্রসংগতঃ উল্লেখ যে,এ সময়ের ১০ বৎসর পূর্বে আমেরিকার এক বিখ্যাত ও প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলাম (পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষীণ এশীয় ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর) এবং তার আগে ও পরে আমেরিকাতে বিভিন্ন সেমিনার ও কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। এর ফলে ঐ দেশের বহু শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ আমার পরিচিত ছিলেন। অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন উদ্যোগী হয়ে আমার জন্য এ রকম বিশেষ প্রোগ্রাম এর ব্যবস্থা করেন। এতে বাংলাদেশ সরকারের কোন অর্থ ব্যয় হয়নি। তবে আই, আর, সি নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাও এখানে কিছুটা সহায়কের ভূমিকা পালন করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত আমার প্রাক্তন ছাত্র জে, আর খান এ- সময়ে আমার সচিবের কাজ করেন। আমি বক্তৃতা দিই নিউইয়র্ক, কলাম্বিয়া, পেনসিলভানিয়া, স্ট্যানফোর্ড, বার্কলে লংবীচ, শিকাগো, বাফেলা, প্রিন্সটন, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলাইন, হার্ভার্ড, বষ্টন, ইয়েল প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটামুটিভাবে আমার কর্মসূচি হতো স্থানীয় রেডিও টিভি সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার প্রদান, মধ্যাহ্নের ফ্যাকাল্টি সদস্যদের সমাবেশে বক্তৃতা দেয়া এবং অপরাহ্নে উন্মুক্ত স্থানে ছাত্র সমাবেশে বাংলাদেশের ওপর বক্তৃতা দিয়ে সমর্থনের আহবান জানানো। উল্লেখ্য যে, এরূপ অনেক ক্ষেত্রে আমার বক্তৃতার পর শ্রোতারা মার্কিন সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতেন। সেটি আমাদের জন্য একটা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক পরিস্থিতি বলে বিবেচিত হতো। আমার সঙ্গে প্রায়ই থাকতেন ডাঃ আসহাবুল হক। তাছাড়া আমার অনুরোধে ও প্রয়োজনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, সৈয়দ আবদুস সুলতান, ডাঃ আসহাবুল হক, সিরাজুল হক প্রত্যেকে এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন। সংসদ সদস্য সিরাজুল হককে আমি পাঠিয়েছিলাম টেক্সাসে। তিনি বক্তৃতা দিয়ে আসার পরপরই সেখানে পাকিস্তানের পক্ষে বক্তৃতা দিতে যান ডক্টর ফাতেমা সাদেক। তারপর সেখানকার বাঙালিরা আমাকে সত্বর টেক্সাসে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তৃতা করার জন্য তাগাদা দেন। আমি ছোট্ট একটি প্রাইভেট বিমানে টেক্সাসে যাই এবং এক ছাত্র শিক্ষক সমাবেশে বক্তৃতা দেই। এখানে অনেক পাকিস্তানী ছিলেন যাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে দিতে হয়েছে। আমি যখন বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বর্বরতার নজীরগুলি একের পর এক উল্লেখ করতে থাকি তখনই প্রশ্ন করা বন্ধ হয়ে যায়। এই সভায় ২/৩ জন আমেরিকানও আমাদের সপক্ষে বক্তৃতা দিয়েছিলেন বলে আমার মনে পড়েছে।
ফিলাডেফিয়াতে গভীর ঔৎসুক্য ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে। তার প্রধান কারণ পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক থাকাকালীন আমার যারা ছাত্র বা গুণগ্রাহী ছিলেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় বা ঐ এলাকার বিভিন্ন কলেজ শিক্ষক ছিলেন। আমার সময়কার অনেক অধ্যাপকও সেখানে তখন কর্মরত ছিলেন। এসব কারনে বাংলাদেশ লবি ওখানে খুবই শক্তিশালী ছিল। ফলে পাকিস্তানের জন্য মার্কিন সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ সেখানে প্রতিবাদকারীরা ঘেরাও করেছিলেন ছোট ছোট স্পীড বোট নিয়ে। এখানে আমার অনেক প্রাক্তন সহকর্মী অধ্যাপকদের সংগে দেখা হয় এবং যোগাযোগ স্থাপিত হয়। যেমন অধ্যাপক নর্মান ব্রাউন, অধ্যাপক হোলডেন ফারভার, রিচার্ড ল্যামবার্ট প্রমুখ। হার্ভার্ড ডক্টর কিসিঞ্জারের এক সহকারী আমার বক্তৃতার পর পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে খুব তর্ক করেছিলেন, কিন্তু শ্রোতাদের ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। মার্কিন জনমত তখন বাংলাদেশের অনুকূলেই ছিল, যদিও মার্কিন সরকারের মনোভাব ছিল এর উল্টো। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বক্তৃতায় ছাত্র, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের লোক উপস্থিত থাকতেন এবং বেতার-টেলিভিশনে তা প্রচারিত হত। তাছাড়া বিভিন্ন শহরে স্থানীয় রেডিও-টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের লোকজন আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কয়েকটি কলেজেও আমি বাংলাদেশ ওপর বক্তৃতা দেই।
সময়সংক্ষেপ করার জন্য আমার যাতায়াত ব্যবস্থা হয় প্রধানত: উড়োজাহাজে। প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়েই আমি প্রথমে ফ্যাকাল্টি ক্লাব এবং পরে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশে ভাষণ দিই। উড়োজাহাজে ভ্রমণ সূচী এমনভাবে প্রণীত হয় যে,আমি প্রায় প্রত্যেক দিনই একটা না একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হাজির হতে পেরেছি। এ কর্মসূচী প্রণয়নে জে, আর, খান অত্যন্ত পারদর্শিতার প্রমাণ রেখেছেন। এসব অনেক প্রোগ্রামে কুষ্টিয়া প্রতিরোধ সংগ্রামের নেতৃত্ব দানকারী ডা: আসহাবুল হক আমার সঙ্গে ছিলেন।
নিউইয়র্কে অবস্থানকালে কয়েকজন আইনজ্ঞ ও অস্ত্র ব্যবসায়ী গোপনে আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবিত অস্ত্রশস্ত্রের মূল্য পরে পরিশোধ করলেও চলবে বলে তাঁরা আমাকে জানান। তাঁরা আরো প্রস্তাব দেন যে, অনুমতি দেয়া হলে, তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী কারাগার হতে কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে মুক্ত করার চেষ্টা করবেন। আমার সংশয় ছিল এটি পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের কোন অংশ হতে পারে। যদি তারা তাদের কথায় খাঁটি হয় তাহলেও গোপনভাবে অস্ত্র সরবরাহের সময় অস্ত্র শত্রুর হাতে পড়তে পারে। আর কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে গেলে তাঁর জীবনের ওপরে ঝুঁকি আসার আশংকা অধিক। এসব ভেবে আমি তাদের জানালাম এটি আমার এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়। আমি তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম দরকার হলে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার আপনাদের কাছ থেকে অস্ত্র নেবে। এরপর অল্পকালের মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় এ ব্যাপারে আর অনুসন্ধান করার প্রয়োজন হয়নি।
যেসব মার্কিন সিনেটর বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলতেন, আমি তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করি। সিনেটর কেনেডির সঙ্গে আমার কলকাতায় সাক্ষাৎ হয়েছিল, তবু আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানাই। সিনেটর স্যক্সবী ও সিনেটর চার্চের সঙ্গেও বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি। স্যাক্সবীর এক ছেলে (স্যাক্সবী জুনিয়র) আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনের ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সফররত অবস্থায় আমার সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি ড: ফজলুর রহমান খানেরও শিকাগোতে সাক্ষাৎ হয়। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে সেখানে এক বলিষ্ঠ লবির সৃষ্টি করেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রচার কার্যে তার আর্থিক অবদান ও ছিল বিরাট। আমি এক রাতের জন্য তাঁর অতিথি ছিলাম। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক বন্ধু অধ্যাপক ডিমকও বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে সহায়ক শক্তি হিসেবে প্রচুর কাজ করেছিলেন।
লংবীচে আমার মনে পরে, একটি সমাবেশে ভাষণ দেবার পর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেতার বাদক রবি শঙ্কর-এর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান এবং যে যন্ত্র সংগীতের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছিলেন তার একটি রেকর্ড আমাকে উপহার দেন।
বস্টন ও হার্ভার্ডে বিমানবন্দরে আমাকে রিসীভ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন আমাদের কয়েকজন সিভিল সার্ভিসের সদস্য। তাঁরা আমার সঙ্গে বিভিন্ন জনসভায় উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত জনাব খুরশিদ আলম একটি সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। ডঃ মহিউদ্দীন আলমগীরও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পক্ষে জনসমর্থনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানের একজন বিশেষ উদ্যোক্তা ছিলেন। আমার জন্য তার সযত্ন আতিথ্যের কথাও আমার মনে আছে।
নভেম্বরের শেষের দিকে নিউইয়র্ক থেকে কলকাতায় ফেরার পথে লন্ডনে বাংলাদেশীদের সমাবেশেও আমি বক্তৃতা দেই। সেখানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্রবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সেখানে বাঙালিরা যথেষ্ট মনোবল নিয়ে কাজ করছিলেন। বস্তুত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র এবং লন্ডনে বাঙালি সমাজের মধ্যে ঐক্যের যে বোধ, সংগ্রামের যে সংকল্প এবং ত্যাগ স্বীকারের যে মনোভাব আমি লক্ষ্য করি, তাতে মুক্তিযুদ্ধের পরিণাম ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলিষ্ঠ আশার সঞ্চার হয়। লন্ডন ছাড়া ব্রিটেনের লিভারপুল, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ ইত্যাদি স্থানে এবং ইউরোপের বিভিন্ন শহরে গিয়ে আমার বক্তৃতা দেবার কথা ছিল। কিন্তু এটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, আমরা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি এবং বাংলাদেশ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে পাকিস্তান শীঘ্রই ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে। পাকিস্তানের পক্ষে এর একটি কৌশলগত ধারণা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিপন্ন করতে পারলে বাংলাদেশ প্রশ্ন চাপা পড়ে যাবে। পরবর্তীকালে নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টোর বক্তৃতা (হাজার বছর ধরে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের অঙ্গীকার) আমার এই ধারনা যে ঠিক ছিল তার প্রমাণ বহন করে। যাহোক, উপমহাদেশে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার আসন্ন অবস্থার দরুন আমার উক্ত সফরসূচী বাতিল করে দিল্লী হয়ে আমি কলকাতা ফিরে আসি।
কলকাতায় ফেরার অল্পকাল মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায় শুরু হয়ে যায়। ঐ সংকট মুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার জনসভায় যে বক্তৃতা করেন,তা আমি বেতারে শুনি ঘরে বসে। সত্যি বলতে কি, সে বক্তৃতা শুনে আমি আশাহত হয়েছিলাম। কেননা আমার আশা হয়েছিল যে, ঐ সময় হয়তো বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়ে তিনি কিছু বলবেন। তারপর সেই রাতেই আকস্মিকভাবে ভারতের ওপর পাকিস্তানী হামলার সংবাদ শোনা গেল। এর পরপরই ভারতীয় সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত বাহিনীর দ্রুত অগ্রগতি সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল আরো তাড়াতাড়ি এরা ঢাকায় এসে পৌঁছাতে পারছে না কেন। তারপর যেদিন পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের সংবাদ হলো সেদিন দেখলাম বড়দিনের আরো কিছু দেরী আছে। উল্লেখ্য, সিদ্ধার্থ সংকর রায়কে আমি খ্রীষ্টমাসে স্বাধীন বাংলাদেশে আসার অগ্রিম আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম গত জুন মাসে।
মুক্তিলাভের এই আনন্দ দ্রুত ম্লান হয়ে গেল ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যার সংবাদে। আমার কত আপনজনই না দেশদ্রোহীদের ষড়যন্ত্রে অকালে শহীদ হয়েছেন। তবু বারবার নিজেকে বলেছি, এত শহীদ, এত আত্মত্যাগীর মর্যাদা যেন আমরা রক্ষা করতে শিখি স্বাধীন বাংলাদেশে।
দখলদার বাহিনীর আত্নসমর্পনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ আমাকে বলেন যে, আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিদ, ছাত্র-যুবক, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই আপনার প্রত্যক্ষ ছাত্র। তারা আপনার কথা শুনবে। বিজয়ের পর প্রত্যেকে যাতে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয় এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা না ঘটে সেজন্য স্বাধীন বাংলা বেতারে আপনি একটা বক্তৃতা দিন। দালাল, রাজাকার এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণ যারা করেছে বাংলাদেশ সরকার তাদের শাস্তি প্রদান করবে বিশেষ আদালতে। তাজউদ্দিন সাহেবের এই পরামর্শে উপরোক্ত আহবান জানিয়ে আমি স্বাধীন বাংলা বেতারে বক্তৃতা দেই। এরপর আমি যশোরে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন ভূখণ্ড পরিদর্শন করি। অবশেষে ‘৭২- এর ৪ ঠা জানুয়ারি আমি সপরিবারে দেশে ফিরে আসি।
– আজিজুর রহমান মল্লিক
এপ্রিল, ১৯৮৪