আটগ্রাম অপারেশন
(০৯ নভেম্বর, ১৯৭১)
আমাদের হাতে নিয়মিত বাহিনী এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত গণবাহিনী এর সদস্য সংখ্যা এক হাজার এর মত ছিল। আমাদের কাছে সেমি-অটোমেটিক রাইফেল, লাইট মেশিনগান, কিছু মিডিয়াম মেশিনগান, এবং আরও কিছু ভারী অস্ত্র ছিল। সারকথা, আমরা শত্রুর উপড়ে চূড়ান্ত আঘাত হানতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলাম।
আটগ্রাম অপারেশনে আমি ৪ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা মোতায়েন করি। লেঃ কর্নেল দত্ত এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমরা অপারেশনের প্ল্যান করি। ২ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ছিল ক্যপ্টেন আনাম এর তত্ত্বাবধানে, যাকে শেষ মুহূর্তে কমলপুর অপারেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে সেকেন্ড লেঃ জহিরকে এই ২ কোম্পানির দায়িত্ব দেবা হয়। তাদের উপর দায়িত্ব ছিল, শ্ত্রুকে পাশ কাটিয়ে সুরমা নদী পার হয়ে পিছন থেকে আক্রমণ করা। তাঁর কোম্পানিগুলোর রাস্তার ২ দিক থেকে চারগ্রাম-দর্পনগর এর কাছে অবস্থান নেবার কথা ছিল। এর লক্ষ ছিল, যাতে সিলেট থেকে পাকিস্তানিদের সাহায্য করতে কোন দল আসলে তাদের ঠেকানো, এবং আটগ্রাম থেকে পিছু হঠতে গেলে যেন তাদের আক্রমণ করা যায়। লেঃ গিয়াস এর অধীনে ১ কোম্পানি ছিল, যার উপর দায়িত্ব ছিল প্রথমে আটগ্রাম-জাকিগঞ্জ এর রাস্তা ক্লিয়ার করা এবং আস্তে আস্তে অপারেশনের অন্য সব রাস্তা ক্লিয়ার করা এবং সব শেষে ডিফেন্সিভ পজিশন নেবা।
চতুর্থ এবং সর্বশেষ কোম্পানির কাজ ছিল আরাআড়িভাবে গোটাগ্রাম গ্রাম থেকে প্রতরক্ষা ব্যুহ তৈরি করা এবং সেখানে অবস্থান নেবা। এখানে বলা দরকার, পাকবাহিনী এপ্রিল-মে মাসের দিকে আটগ্রাম থেকে জাকিগঞ্জে আসার একটা শর্টকাট রাস্তা বানায়। এই রাস্তা দিয়েই শত্রুর সবচেয়ে বেশী আনাগনা ছিল। এই রাস্তা অবরোধ করতে পারলে শত্রুবাহিনী জাকিগঞ্জে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরবে। কিন্তু এটা খুব কঠিন কাজ ছিল। তাই আমি এই কোম্পানি কে এই কাজের দায়িত্ব দেই।
সুরমা নদী পার হবাও বেশ কঠিন কাজ ছিল। সেসময় কোন দেশী নৌকা পাওয়া যাচ্ছিল না। কোন রকমে আমরা ২টা নৌকা জোগাড় করি, এবং সেগুলো দিয়ে ৪ ঘণ্টায় পুরো দলটিকে পার করি।
আমাদের এই অপারেশনের প্রধান লক্ষ ছিল আতগ্রাম এর পাকিস্থানী ঘাটি কে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলা। এটা খুব শক্ত ঘাটি ছিল। এই ঘাটি অপারেশনের জন্য উপর থেকে নির্দেশ ছিল। আমার মতে এটা একটা দুঃসাহসিক অভিযান ছিল। প্রথম থেকে এই অপারেশনের সাফল্যের ব্যপারে আমি খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলাম না। তাই আমি যারা প্ল্যান করেছে, তাদের সাথে বেশ ক’বার এটা নিয়ে কথা বলি। যাই হোক, আমাদের উপর নির্দেশ ছিল, তাই আমরা শেষ পর্যন্ত এই অপারেশনে যাই। আমাদের প্ল্যান ছিল শত্রুর উপরে আগে আক্রমণ না করা। বরং এমনভাবে আগানো, যাতে, তারা আমাদের উপরে আগে আক্রমণ করে, এবং আমরা ডিফেন্স পজিশন থেকে তাদের মোকাবেলা করি।
নভেম্বর ৯, ১৯৭১। সূরযাস্তের পরে আমরা নতুন উদ্যমে আগানো শুরু করি। রাত ১১ টার দিকে প্রথম কোম্পানি যার কাজ ছিল, কমলপুর গ্রাম এর কাছে রাস্তা ক্লিয়ার করা শত্রুর মুখমুখি হয়। রাস্তা ক্লিয়ার করতে তাদের ৩০ মিনিট এর মত সময় লাগে। বাকি কোম্পানিগুলো শত্রুকে পাশ কাটিয়ে নিরাপদে নিজ নিজ অবস্থানে চলে যায়। রাস্তা ঘাট তখন খুব কর্দমাক্ত এবং খাল-বিলে ভরা ছিল। আমরা গোটাগ্রাম গ্রামে ভোর ৫ টার দিকে পৌছালাম। এই গ্রামে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। আমাদের একটা দল সেই ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। রাজাকাররা তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। তারা সব মিলিয়ে ১২ জন ছিল। ১জন বাদে সবাইকে আমরা ধরে ফেললাম। ১ জন কি করে যেন পালাতে সক্ষম হয়, এবং আটগ্রামে পাকিস্থানি ক্যাম্পে খবর দেয়। আটগ্রামে ১ কোম্পানি পাকি সেনা, ১ কমানির মত রাজাকার এবং খাইবার স্কাউট ছিল। ভোর সাড়ে ৬টার মত বাজে। আমরা তখনও আমদের ব্যাংকারগুল ঠিকমত রেডি করতে পারিনি। এমন সময় শত্রুরা প্রথম আমাদের উপড়ে হামলা করে। শত্রুর আমাদের শক্তি সম্পর্কে কোন ধারনা ছিল না। তারা ভেবেছিল, আমরা কোন ছোট দল নিয়ে এখানে আছি। তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি, আমরা এত বড় দল নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এখানে অবস্থান করছি। ওরা আমাদের দিকে ভাবলেশহীনভাবে এগিয়ে আসছিল আর চিৎকার করছিল “মুজিব কে বাচ্চে, হাতিয়ার ছোর দো, আগার নাতো, কয়ি জিন্দা বাপাস নেহি যাওগে”। ১ প্লাটুনের মত পাকি সেনা রাস্তার ২ দিক থেকেই এগিয়ে আসছিল। তারা ১০০ গজের মধ্যে আসার সাথে সাথে আমি রাস্তার ২ দিক থেকে আমাদের ৪টা লাইট মেশিনগান চার্জ করতে বললাম। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের মেশিন গান গর্জে উঠল। কিছু বুঝে উঠার আগেই ১৮ জন পাক সেনার লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বাকিরা পাশের নালায় আশ্রয় নেয় এবং পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ১টা পাক সেনা ভর্তি ৩-টন ট্রাক জাকিগঞ্জ থেকে আসার পথে আমাদের এণ্টি-ট্যাঙ্ক মাইন এর আঘাতে উড়ে যায়। অন্য দিক থেকেও কিছু হামলা হয়, যেগুল আমরা সফলতার সাথে প্রতিহত করি। সন্ধ্যা হবা পর্যন্ত শত্রুর দিক থেকে আর কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। এর ভিতরে তারা সিলেট থেকে আরও সেনা এবং ভারী অস্ত্র নিয়ে আসে।
১০ নভেম্বর, ১৯৭১। এই সন্ধ্যাটার কথা আমার এখনও পরিস্কার মনে আছে। তখন বিকাল ৫ টা হবে। আটগ্রাম থেকে সংখ্যায় বেশ ভারী একদল লোক দেশীয় অস্ত্র হাতে চিৎকার করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। তাদের কাভারিং নিয়ে পিছনে পাঞ্জাবি সেনারা ছিল। ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথে আমি গুলি করার নির্দেশ দেই। সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বলতে পারব না, কিন্তু তাদের আনুমানিক ৫০ জনের মত মাটিতে লুটিয়ে পড়ল গুলি খেয়ে। মুহূর্তের মধ্যে বাকি জনতা উধাও হয়ে গেল। এরপরে শুরু হল আসল যুদ্ধ।
শত্রুরা ৩ দিক থেকে আর্টিলারি গোলার কাভারিং নিয়ে আমাদের উপর হামলা করল। শত্রুরা ২ বার চেষ্টা করল, কিন্তু আমাদের ১ ইঞ্চিও সরাতে পারল না। রাত বাড়ার সাথে সাথে শত্রুর হামলার পরিমান ও চাপ বাড়তে লাগল। রাত ৮ টার দিকে আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে আসতে লাগল। সব গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে আমরা মহাবিপদে পরব।এসময় পিছন দিক থেকে গোলাবারুদ এর সরবরাহ পাবারও কোন আশা ছিল না। আমি সেক্ট্র কম্যান্ডার লেঃ কর্নেল দত্ত কে ওয়্যারলসে জিজ্ঞেস করলাম, কি করা উচিত বা কি করব তখন। তিনি আমাদের বললেন, গুলি শেষ হবার আগেই নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে।
২ দিনের যুদ্ধে আমরা ৩৯ জন পাকিস্তানি সেনা কে মারি, এবং তাদের অস্ত্র হস্তগত করি। এছাড়াও ১১ জন রাজাকারকে জ্যান্ত ধরে ফেলি। আমাদের পক্ষে ২জন শহীদ হয় এবং ৫ জন আহত হয়।
২০ নভেম্বর, ১৯৭১। এদিন ছিল ঈদের দিন। যেহেতু আমার স্ত্রী করিমগঞ্জে একা ছিল, আমি কিছুক্ষনের জন্য তাঁর সাথে দেখা করতে যাই। যৌথ কম্যান্ডের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০/২১ নভেম্বর “ডি ডে” হিসেবে নির্ধারণ করা হয় এবং এসময় শত্রুর উপড়ে চূড়ান্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। এই সময় থেকেই ভারতীয় মিত্র বাহিনী সরাসরি আমাদের হয়ে যুদ্ধের ময়দানে নামে। ঈদের দিন হবার কারনে সারা দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিছুটা হাল্কা মুডে ছিল। পরে একজন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, তারা এদিনে হামলার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।
সিলেটের ঐ অঞ্চলের “ডি ডে” প্ল্যান ছিল এরকম। ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারি সাপোর্টসহ এক ব্যটেলিয়ন যোদ্ধাকে দায়িত্ব দেবা হয় জাকিগঞ্জ শহরকে শত্রুমুক্ত করার। এক ব্যাটেলিয়ন গুর্খা রেজিমেন্ট এবং প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে দায়িত্ব দেবা হয় পাকিদের শক্তিশালী ঘাটি আটগ্রামকে মুক্ত করার। আটগ্রামের উলটা দিকে, সুরমা নদীর অপর পাড়ে সালামটিলা এবং রাজাটিলা নামে শত্রুর ২টা চেকপোস্ট ছিল। এই ২টি ঘাটি ক্লিয়ার করার দায়িত্ব দেবা হয় লেঃ কর্নেল জিয়ার (এখন কর্নেল) অধীনে থাকা “জেড ফোর্সকে”। তাঁর কাছে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল।
২১ নভেম্বর ১৯৭১, সকাল ১০টা। জাকিগঞ্জ শহর শত্রু মুক্ত হয়। ২২ নভেম্বর ৭১ পর্যন্ত আটগ্রাম ক্লিয়ার করা যায়নি। আমি আমার এক ব্যটেলিয়ন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ২০/২১ নভেম্বর শেষ রাতের দিকে যোগ দেই। যেহেতু এই এলাকাটা আমাদের রেকি করা হয়নি, সিদ্ধান্ত নেই, ভোরবেলায় আক্রমণ করা যাবে না। আমাদের ২টা লক্ষ্য ছিল। তাই আমরা ২টা দলে ভাগ হয়ে যাই। আমি ২ কোম্পানি কে লেঃ জহির এর অধীনে দেই রাজা টিলা আক্রমণ করতে, আর আমার অধীনের দলের কাজ ছিল সালাম টিলা আক্রমণ করা। ২১ নভেম্বর সকালের আলো ফুটার আগেই আমরা শত্রু অবস্থান ঘিরে ফেললাম।
জায়গাটা কিছুটা রেকি করে সিদ্ধান্ত নেই, বিকাল ৩টায় একসাথে উভয় ঘাটিতে হামলা করা হবে। প্ল্যান মত বিকাল ৩টায় শত্রুকে হতভম্ব করে দিয়ে আমরা সামনা সামনি দুঃসাহসিক ভাবে শত্রুর উপরে হামলা চালাই। পাকিস্থানিরা পুরো জায়গাটা মাইন পেতে রেখেছিল। ফলে, যুদ্ধে আমাদের ৪ জন সহযোদ্ধা এর পা উড়ে যায়। ২ ঘণ্টার তুমুল লড়াই এর পরে শত্রুরা পিছু হটা শুরু করে। পাশে ঘন জঙ্গল থাকায় পাকিদের বেশীরভাগ পালাতে সক্ষম হয়। তারা বিপুল পরিমানে গোলাবারুদ ফেলে যায়। সালাম টিলা এবং রাজা টিলা আমাদের দখলে আসে, এবং ২ জন পাকি সেনা কে আমরা ধরে ফেলি।
২৩ নভেম্বর, ১৯৭১। আমি হেড কোয়ার্টার থেকে মেসেজ পাই, আটগ্রামে কর্নেল জিয়ার কাছে রিপোর্ট করতে। আমি ১২টার দিকে যখন পৌছালাম, তাকে বেশ হাসিখুশি দেখলাম। তিনি মিত্র বাহিনী এর এক ব্রিগেডিয়ার এর সাথে ব্যাঙ্কারে বসে ছিলেন। তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং একটা সিগারেট অফার করলেন। আমাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পরে তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন, সুরমা নদীর অন্য পাশ দিয়ে কানাইঘাট এর দিকে অগ্রসর হতে এবং যে কোন মুল্যে কানাইঘাট-দূর্বাস্ত রাস্তা ব্লক করতে। নির্দেশ পেয়ে আমি আমার ক্যাম্পে ফেরত আসি এবং আমার দল কে আমাদের ক্যাম্প থেকে ১০ মাইল দূরে লুবা চেরা চা বাগানের দিকে অগ্রসর হতে বললাম। ২৫/২৬ নভেম্বর, ১৯৭১। আমরা লুবা চেরা চা বাগানে ডিফেন্সিভ পজিশন নেই।
এই ৪-৫ দিনে মুক্তি বাহিনী ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সরাসরি সহায়তায় পুরো জাকিগঞ্জ থানা এবং কানাইঘাট থানার অর্ধেকের বেশী মুক্ত করে ফেলি। ঐসব এলাকায় মানুসের মুক্তির আনন্দ, উচ্ছাস ছিল চোখে পরার মত। হানাদারদের হাতে ৯ মাস এর অত্যাচার, অনিশ্চিত জীবন যাপনের পরে মুক্তির বাধ ভাঙ্গা আনন্দ বলে বুঝানর মত না। ঐ এলাকাতে পাকিস্থানিদের অত্যাচার এর কোন সীমা ছিল না। শত শত মেয়ে কে ওরা ওদের ক্যাম্পে নিয়ে অত্যাচার, ধর্ষণ করে। জাকিগঞ্জ মুক্ত করার পর একটা ব্যাঙ্কার থেকে ১জন মেয়ে সহ পাকিস্থানি সেনার লাশ পাওয়া যায়। ঐ ব্যাঙ্কার থেকে ১টা মেয়ের লাশ এবং প্রচুর শাড়ি, মেয়েদের পোশাক পাওয়া যায়।স্থানীয়দের থেকে আমরা জানতে পারি, পাকিরা মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে আসত এসব ক্যাম্পে এবং নির্মম অত্যাচার করত তাদের উপড়ে। বিশেষ করে তাদের মিলিশিয়া বাহিনী এজন্য কুখ্যাত ছিল।
অন্য সব ফ্রন্টেও যুদ্ধ তখন জমে উঠেছে। সব জায়গায় পাকিদের লেজেগোবরে অবস্থা। যুদ্ধ করার সাহস, মনোবল তারা হারিয়ে ফেলেছিল। মক্তিবাহিনী এবং জনরোষের ভয়ে তারা ভীত হয়ে পড়েছিল।
২৬ নভেম্বর, ১৯৭১। আমরা আমাদের পরের লক্ষ্যে আগানো শুরু করলাম। আমার লক্ষ্য ছিল, কানাইঘাট-দূর্বাস্ত রাস্তা কেটে দেবা। কানাইঘাত শত্রুর শক্তিশালী ঘাটি ছিল। প্রথমে এটা দখল করা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লক্ষ্য ছিল। ২৬/২৭ নভেম্বর রাতে আমি বড়চাতাল গ্রামে পৌছালাম, যার ২দিক দিয়ে পুকা রোড চলে গেছে। আমরা এই গ্রামে পজিশন নেই, যাতে পাকিরা কানাইঘাত থেকে পালাতে বা বাইরে থেকে কানাইঘাটে কোন সাহায্য না আসতে পারে। এটা খুব কঠিন কাজ ছিল, কারন পাকিরা এটা কোনভাবেই হতে দিবে না। পাকিরা ২ দিক থেকে আমাদের উপরে বৃষ্টির মত ১০৫ মিমি. আর্টিলারির শেলিং করা শুরু করল।
আমি জানতাম, এখানে পাকিদের বড় ধরনের হামলার মুখে পড়ব। সেকারনেই এটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। যাই হোক, আমি ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই পথ দিয়ে পাকিদের আনাগনা বন্ধ করে রাখলাম।
এই অপারেশন সিলেটে আমাদের মিত্র বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী এর একটা বড় সাফল্য ছিল। কানাইঘাটের পতন হবা পাকিদের জন্য একটা বড় ধরনের ধাক্কা ছিল। এখানে হেরে যাবার পরে তাদের বামদিকে চরকাই, আর ডানদিকে হরিপুরে পিছু হটা ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। আমাদের এই বিজয় দ্রুত সিলেট এর পতন কে ত্বরান্বিত করে।
১ ডিসেম্বর, ১৯৭১, বিকাল ৫টা। আমরা তখনও রাস্তা ব্লক করে বসে আছি। সেক্টর কম্যান্ডার লেঃ কর্নেল চিত্ত রঞ্জন দত্ত আমার কাছে এলেন। অল্প কিছু কথা হবার পরে তিনি বললেন, পরদিন ভোর হবার আগেই কানাইঘাট আক্রমণ করতে হবে। আমি তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, এটা অসম্ভব কারন প্রথমত, আমরা খুব ক্লান্ত। দ্বিতীয়ত গত ৩ দিন যাবত আমাদের ঘুম হয়নি। তৃতীয়ত আমাদের গোলাবারুদ এর প্রয়জন। তিনি আমার সাথে একমত হলেন না। তিনি জানালেন, এটা হাই কম্যান্ডের নির্দেশ। তিনি আরও জানালেন, আরও বড় বড় অপারেশন আটকে আছে শুধুমাত্র কানাইঘাট এর জন্য।
প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও আমরা রাত ৮টার দিকে কানাইঘাট এর দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের ভিতর এর রাস্তা দিয়ে ১২ মাইল পার হতে হয়েছে। যাই হোক, ২রা ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে আমরা আমাদের নির্ধারিত জায়গায় মিলিত হলাম।
কানাইঘাট একটা থানা হেড কোয়ার্টার। সুরমা নদীর তীরে চমতকার একটা শহর। এখানে এক কোম্পানি পাকি সেনা এবং প্রচুর সশস্ত্র রাজাকার ছিল। শত্রুরা শহরের চার দিকে তাদের দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা তৈরি করে ছিল। তাদের কিছু ব্যাঙ্কার সিমেন্টের বানান ছিল। চারদিকে প্রচুর মাইন পাতা ছিল। ব্যাঙ্কার এর কাছে ধারে যাবা চিন্তার বাইরে ছিল। তাদের মুখমুখি আক্রমন করা ছাড়া আমাদের আর কোন পথ খোলা ছিল না। এক ব্যাটারি ১২০ মিমি আর্টিলারি মর্টার ছিল তাদের সাথে। অন্য দিকে, আমাদের কাছে শুধু ২টা ৩ ইঞ্চি মর্টার ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ছিল ক্লান্ত। সব মিলিয়ে এটা খুব কঠিন ছিল আমাদের জন্য।
যেখানে আমরা মিলিত হইয়েছিলাম, সেখান থেকে রাত ৩ টার দিকে বের হয়ে পড়লাম। পথে শত্রুর কিছু বাধা হটিয়ে লক্ষ্যের ৫০০ গজের মধ্যে আসতে আমাদের পাক্কা দেড় ঘন্টা সময় লেগে যায়। প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। আমাদের সব সহযোদ্ধা চলে এসেছে। আমরা বুঝতে পারলাম, দিনে দুপুরে এরকম শক্ত অবস্থানে হামলা করলে আমাদের বড় ধরনের মুল্য দিতে হবে। আমি খুব কাছ থেকে শত্রুর অবস্থান দেখে নিলাম এবং নিশ্চিত হলাম, এই অবস্থায় শত্রুকে হটানো প্রায় অসম্ভব। আমি পিছনে গিয়ে লেঃ কর্নেল দত্ত কে পুরো ব্যপারটা ওয়্যারলেসে বুঝালাম। তিনি প্রথমে আমাকে যেভাবে হোক, আক্রমণ করতে উতসাহিত করলেন, কিন্তু পরে বুঝলেন, সেটা থিক হবে না। তিনি আমাকে পিছু হঠতে বললেন। আমি সর্বশক্তিমান এর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম, কেননা এই অবস্থায় হামলা করলে আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রানহানি হত সেদিন।
আমরা সেদিন কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম। বিরামহীন পরিশ্রমের ফলে আমাদের ১৫০ জন যোদ্ধা ২রা ডিসেম্বর সন্ধ্যার মধ্যে অপারেশন করার জন্য আনফিট হয়ে পরল। আমার সাথে শুধু ৩ কোম্পানি যোদ্ধা থাকল কানাইঘাট অপারেশনের জন্য। আমাদের সেক্টরের মিত্রবাহিনীর ও মুক্তিবাহিনী এর কম্যান্ডার ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকি সেদিন সন্ধায় আমাদের এলাকায় এলেন। আমরা তাঁর কাছ থেকে অন্য সব ফ্রন্ট এর সর্বশেষ আপডেট পেলাম। চারদিকে মুক্তিবাহিনী এর সাফল্যের সংবাদে আমরা পুনর্জীবিত হলাম। গত ১০-১৫ দিন আমরা রেডিও শুনারও সময় পাইনি।
এই অপারেশনে আমাদের কোম্পানি কম্যান্ডার ছিল এ মতিন চৌধুরী, লেঃ জহির, লেঃ গিয়াস। এদের সবাই খুব সাহসী যোদ্ধা এবং অধিনায়ক ছিলেন।
সেদিন সন্ধার দিকে আমরা বেশ ভাল বোধ করছিলাম এবং কানাইঘাটের শত্রুর ঘাটি গুড়িয়ে দেবার ব্যপারে বদ্ধপরিকর হলাম। আমরা শত্রুর ব্যাপারে আরও কিছু খোজ খবর করলাম। খোজ খবর থেকে মনে হল, তারাও ৩রা ডিসেম্বর ভোর এর আগেই আমাদের কে আশা করছে।
৩ ডিসেম্বর ভোর ৪টা। আমরা কানাইঘাটের শত্রু ঘাটি এর ৩০০ গজের মধ্যে চলে আসলাম এবং পজিশন নিলাম।আমরা ভোর সাড়ে পাচটায় শত্রুর দিকে ফায়ার ওপেন করলাম। তারাও পাল্টা গুলি ছুড়ল। তারা আরটিলারি গোলা ছুড়তে লাগল আমাদের দিকে। আমরা শত্রুর উপড়ে চাপ বাড়াতে লাগলাম ৩ দিক থেকে আক্রমণ করে। ১ ঘণ্টা এর মধ্যে আমাদের ১৫ জন হতাহত হল। ভোর ৭ টার দিকে শত্রু পিছু হটা শুরু করল। ভোর সোয়া সাতটার দিকে আমরা শত্রুর ব্যাঙ্কারে চার্জ করলাম। আমরা বর্বর পাঞ্জাবি সেনাদের কে বেয়নেট চার্জ এবং গ্রেনেড দিয়ে মারা শুরু করলাম। তাদের বেশীরভাগ অস্ত্র ফেলে সুরমা নদীতে ঝাপ দিল এবং মারা পড়ল। সর্বশক্তিমানের অসীম কৃপায় আমরা সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে কানাইঘাটকে সম্পূর্ণ মুক্ত করলাম এবং হেড কোয়ার্টার এ মেসেজ পাঠালাম।
কানাইঘাটে শত্রুরা ব্যাপক ক্ষ্যক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারা ১২ জন লাশ ফেলে যায়। পরদিন লোকাল লোকজনের থেকে পরে জানতে পারি, তারা আরও অনেক লাশ ভাসতে দেখে সুরমা নদীতে। তাদের ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমান গোলাবারুদ ও আমাদের হস্তগত হয়।
নয় মাস পরে হানাদারমুক্ত হয়ে লোকজনের খুশির কোন সীমা ছিল না। তারা আমাদের কাছে আসত এবং এই নয় মাসে পাকিস্থানিদের নির্মম অত্যাচার এর বর্ণনা দিত।
কানাইঘাট এর যুদ্ধে আমাদেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, কিন্তু আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে বীরত্ব দেখায় এই যুদ্ধে, তা ছিল কিংবদন্তী এর মত। এটা মিত্র বাহিনী এর সাহায্য ছাড়া আমাদের একক বড় বিজয় ছিল। আমাদের ৬জন শহীদ হয় এবং ২০ জন আহত হয় এই যুদ্ধে। কানাইঘাটের পতন হবার ফলে শত্রুর পায়ের তলার মাটি একেবারে সরে যায়।
৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১। হাজার হাজার উতফূল্ল জনতার সামনে আমরা কানাইঘাট ডাকবাংলো তে বাংলাদেশের পতাকা উত্তলন করি।
৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমরা সিলেটের দিকে আগানোর নির্দেশ পাই। জেড ফোর্স এর কম্যান্ডার কর্নেল জিয়া প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে কানাইঘাট হয়ে সিলেটের দিকে যাচ্ছিলেন। আমি ও লেঃ জহির এর সাথে এক কোম্পানি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাঠালাম। জওয়ানরা তখন সিলেট শহর এর পথে আগুয়ান। ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। সিলেট-শিলং রোডে পাকিদের আর এক শক্তিশালী ঘাটি দারবস্ত এর পতন হয় আমাদের এবং মিত্র বাহিনীর হাতে। পাকিরা হরিপুরে পিপিএল (পাক পেট লিমিটেড) এর আশেপাশে ঘাটি করে ছিল। এক গুর্খা ব্যাটেলিয়ন এখানে কয়েকবার আক্রমণ করে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাচ্ছিল না।
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমরা আবার উলটা পথে এসে পিছন দিক থেকে হরিপুরে আক্রমণ করতে গেলাম। বেশ বড় পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ২টা বড় দেশী নৌকায় করে আমরা ১৫ মাইল এর মত পথ পাড়ি দেই। ভোর ৫টার দিকে আমরা নদী পার হই, কিন্তু হঠাত শত্রু বাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলে। সেদিন আমাদের অনেকে হতাহত হয়। আমার ৫ জন সহযোদ্ধা শত্রুর আর্টিলারি গোলার আঘাতে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। সেদিন আমরা কিছুই করতে পারলাম না। ১২ ডিসেম্বর রাতে আমরা আবার সুরমা নদী পাড়ি দিলাম এবং পিছন থেকে হরিপুরে তাদের উপড়ে হামলা করলাম। ১৩ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হরিপুর আমাদের দখলে আসে। ঐ রাস্তায় চিকনাগুল নামক জায়গায় শত্রুরা আমাদের প্রতিরোধ করে। ১৪ই ডিসেম্বর এর ঐ যুদ্ধে আমরা আমাদের ৩জন বীর যোদ্ধাকে হারাই। আরো ৪ জন গুরুতর আহত হয় সেদিন। অবশেষে পাকবাহিনী খাদেমনগর এর দিকে পালিয়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমরা এবং মিত্রবাহিনী খাদেম নগর ঘিরে ফেলি। এটা ছিল, সিলেট শহরের বাইরে তাদের সর্বশেষ ঘাটি।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমাদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় এর সূচনা হয়। যৌথবাহিনী এর কাছে পাকিস্থানি বাহিনী এর শোচনীয় পরাজয় আমার কাছে কোন বিস্ময় ছিল না। আমরা জানতাম,এটা ছিল অবধারিত। আজ হোক, আর কাল হোক, এটা হতেই হত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। জনতা উল্লাস করছিল, চিৎকার করছিল। আমি সাব কিছুর সাথে সামিল হতে পারিনি। আমি গত ৯ মাসের প্রতিটা মুহূর্ত সেদিন মনে করছিলাম। যেসব সহযোদ্ধা কে হারিয়েছি, যাদের বাচাতে পারিনি, তাদের কথা খুব বেশি মনে পরছিল। আমি কাদছিলাম। মনে হচ্ছিল, তাদের আত্মা অমর হয়ে আমার চারপাশেই ঘুরছে। আমরা একসাথে যাত্রা শুরু করেছিলাম, কিন্তু আজ যখন আমরা লক্ষ্যে পৌছালাম, তখন আমি যেন অনেকটাই একা। সেদিন আমরা যারা একসাথে যাত্রা শুরু করেছিলাম, দেশের জন্য, তাদের বেশিরভাগকেই হারিয়ে ফেলেছি। আমি কিভাবে জানি বেচে আছি এখনও। কিন্তু আমি কি করতে পারি? এটা বিস্ময়কর যে আমি এখনও বেচে আছি। মৃত্যু আমার কানের পাশ দিয়ে বেশ কবার হ্যালো বলে চলে গেছে। আমরা এখন মুক্ত, স্বাধীন। আসুন, আমরা অন্তত কোনদিন তাদের কথা না ভুলি এবং তাদের অমর আত্মার শান্তি কামনা করি।
** ১৯৭১-এর মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন।