আন্তঃ প্রাদেশিক বৈষম্যের উপর অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বক্তব্য

<2.130.567>

শিরোনামঃ আন্তঃ প্রাদেশিক বৈষম্যের উপর অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বক্তব্য

সূত্রঃ সাপ্তাহিক ‘ফোরাম’ 

তারিখঃ ১৪ নভেম্বর, ১৯৭০ 

SENSE AND NONSENSE ABOUT DISPARITY

THE BALANCE SHEET OF DISPARITY

Rehman Sobhan

বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজস্ব আদায় ক্ষমতার তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব আদায় ক্ষমতা নিয়ে নিরর্থক কিছু যুক্তি তর্ক আলোচিত হচ্ছে। এ আলোচনা মূলত কিছু অসমর্থনীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ড শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের আয় দ্বারা নির্বাহিত হচ্ছে। এসকল ব্যয়ের গুরুভার পূর্ব পাকিস্তানের আয়ে নির্বাহিত হয়না। দ্বিতীয়তঃ পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চ আয়ই উচ্চ উন্নয়নমুলক কর্মকান্ডের পূর্বশর্ত। একটি সুসঙ্গত সংলাপই এ ধরনের প্রতারণামুলক ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করতে পারে।

 

আর্থিক উন্নয়ন

টেবিল ১ এ দুই প্রদেশের আয়ের বর্ণনা প্রদান পূর্বক প্রেদেশ দুটির আয় ও ব্যয়ের মধ্যে তুলনা করা হল। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক অঞ্চলের আয় ভিন্ন কর্তৃপক্ষের দ্বারা সঙগৃহীত হয়। ১৯৬৫-৬৬ থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত তৃতীয় পরিকল্পনায় দেখা যায়, বহিঃশুল্ক, আবগারি শুল্ক, বিক্রয় কর ও আয়কর বাবদ কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে আদায় করে ৪৭০.৫ কোটি রুপি এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আদায় করে ১৩০৪.৪ কোটি রুপি- যা ছিল মোট আয়ের প্রায় ৭৩ শতাংশ।

আয় সংগ্রহের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকার ফলে প্রাদেশিক সরকারের আয় সীমিত ছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক আয় ছিল ২৫৮ কোটি রুপি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মোট প্রাদেশিক আয় ছিল ৪৭৭ কোটি রুপি। সুতরাং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মোট আয় ছিল ৭২৮.৫ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মোট আয় ছিল ১৭৮১.৭ কোটি। অপরপক্ষে পুর্ব পাকিস্তানের বার্ষিক ব্যয় ছিল ৪৮৪.৯ কোটি, যেখকানে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যয় করা হয় প্রায় ১৬৫৯.৯ কোটি রুপি। উক্ত রাজস্ব ব্যয় উভয় অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিসরে সংঘটিত হয়।

পুর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন ব্যয় ৮৫১.৩ কোটি রুপি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় হয় ১১০৭.৬ কোটি রুপি। রাজস্ব এবং উন্নয়ন ব্যয় বাবদ পূর্ব পাকিস্তানের মোট ব্যয় ছিল ১৩৩৬ কোটি রুপি ও পশ্চিম পাকিস্তানের মোট ব্যয় ছিল ২৭৬৭ কোটি রুপি।

 

 

<2.130.568>

সুতরাং দেখা যাচ্ছে উভয় প্রদেশের আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি। পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক ঘাটতি প্রায় ৬০৮ কোটি রুপি যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থিক ঘাটতি ৯৮৫ কোটি রুপি।

মূলত বৈদেশিক সহায়তা এবং জাতীয় মুদ্রাস্ফীতি নীতির সমন্বয়ে উক্ত অর্থনৈতিক মন্দা মেটানো হয়। বৈদেশিক সহায়তার পরিমান ছিল প্রায় ১২৯৫ কোটি রুপি। অবশিষ্ট অর্থের ঘাটতি মেটানো হয় মুদ্রাস্ফীতি ঘটিয়ে।

পূর্ব পাকিস্তানের ঘাটতির ৩৮৮.৫ কোটি অর্থাৎ ৬৪% আসে বৈদশিক সহায়তার মাধ্যমে যা ছিল মোট বৈদেশিক সাহায্যের ৩০%। বাকি ঘাটতি অর্থাৎ ৩৬% পূরণ হয় মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে। অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ৯২% ঘাটতি মেটানো হয় বৈদেশিক সহায়তা দিয়ে এবং মাত্র ৮% আসে মুদ্রাস্ফীতি নীতি সমন্বয়ের মাধ্যমে।

ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দুটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে- বৈদেশিক লোনের হিস্যা এবং অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি। ফলে ১৯৬৪-৬৫ থেকে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানের মুল্য তালিকায় সূচক বেড়েছিল প্রায় ৩০ পয়েন্ট যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সুচক বৃদ্ধি ছিল ১৬ পয়েন্ট।

সুতরাং দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে প্রদেশটির সম্পদের উপর খুব নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানকে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব থেকে রক্ষা করার নিমিত্তে পূর্ব পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়ানো হয়েছিল।

রাজস্ব অসমতার যৌক্তিকতা

কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দ্ধমুখী উন্নয়নের কারণ হিসাবে তুলনামূলক অধিক আয়কে চিহ্নিত করা হয় যা বাস্তব ঘটনার বিপরীত। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাত দুষ্ট নীতিমালা পূর্ব পাকিস্তানের স্বল্প আয়ের মূল কারণ যা নিম্নোক্ত টেবিলের মাধ্যমে সুষ্পষ্ট করা হলঃ

টেবিল ১

উন্নয়নের স্থিতিপত্র (১৯৬৫-৬৬ থেকে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত)    (কোটিতে)

ক। আয়ঃপূর্ব পাকিস্তানপশ্চিম পাকিস্তানঅংশ(%)
১. কেন্দ্রীয় সংগ্রহঃ   
বহিঃ শুল্ক                                    ১৮৭.৮৩৪৪.৫৩৫.৩
কেন্দ্রীয় শুল্ক১৪১.৪৪৮১.১২৬.৮
কর৫৮.৯২৫২.৫১৫.৭
বিক্রয় কর৮২.৪২১৯.৩২৭.২
মোট৪০৭.৫১৩০৪.৪২৬.৫
২। প্রাদেশিক সংগ্রহ২৫৮৪৭৭.৩
৩। মোট আয়৭২৮.৫১৭৮১.৭২৯
খ। ব্যয়ঃ   
১। রাজস্ব ব্যয়৪৮৪.৯১৬৫৯.৫
২। উন্নয়ন ব্যয়৮৫১.৩১১০৭.০৬
৩। মোট ব্যয়১৩৩৬.২২৭৬৭.১৩২.৬
গ। মোট ঘাটতিঃ৬০৭.৭৯৮৫.৪
ঘ। ঘাটতি পুরণঃ   
১। বৈদেশিক সহায়তা৩৮৮.৫৯০৬.৫ 
২। আর্থিক মুদ্রাস্ফীতি২১৮.২৭৮.৯ 

 

 

শুল্ক আয়

১৯৬৫-৬৬ থেকে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত সময়কালে মোট শুল্ক আয়ের মাত্র ৩৫.৫% আসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। আবার মোট আমদানীর কেবল ৩২% আসে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। দুই দেশের জন্য আমদানি ও শুল্ক নীতিতে ছিল ব্যাপক তারতম্য। সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে তার রপ্তানি আয় ও শতকরা ৫৫ ভাগ বৈদেশিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা হয়। অন্যথায় পূর্ব পাকিস্তানের শুল্ক আয় প্রায় ৫০% এর বেশি হত।

কেন্দ্রীয় আবগারি শুল্ক

এ আয় মূলত উৎপাদনের উপর আয় যার মাত্র ২৬.৮% পূর্ব পাকিস্তান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এ আয় কারখানা থেকে পণ্য বিপণনের সময় সংগৃহীত হত।

 

<2.130.570>

 

পূর্ব পাকিস্তান সাধারণত পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী ব্যবহার করে।পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আবগারি শুল্ক প্রদান করলেও তা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক আয় হিসেবে নথিভুক্ত করা হত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯৬৮-৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের আবগারি শুল্কের এক পঞ্চমাংশ আসে বস্ত্র ও সুতা শিল্প থেকে।উক্ত আয়ের নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করা উচিত যাহা অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

মোট আয়ের দুই তৃতীয়াংশ আসে পশ্চিম প্রদেশ থেকে। কিন্তু তা একমাত্র সম্ভব হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পায়নের ফলে। মূলত সকল আবাগারি শুল্ক অর্জিত হয় শিল্পায়নের ফলে। মোট আয়ের ৭৩.২% পশ্চিম পাকিস্তানের আবগারি শুল্ক থেকে অর্জিত হওয়াটা কোন বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। যদি পুর্ব পাকিস্তান তার শিল্পায়ন উন্নয়নের সুষ্ঠু সুযোগ পেত, তবে পূর্ব পাকিস্তানের আয় তুলনামুলক ভাবে আরও বেশি হত।

প্রত্যক্ষ কর

সরাসরি কর বলতে ব্যক্তি ও কোম্পানির আয় ও সম্পদের উপর করকে বোঝায়।কর বাবদ পূর্ব পাকিস্তানের আয় মোট আয়ের ১৫.৭% মাত্র যা অন্যান্য সকল খাত অপেক্ষা কম। কর মূলত ধনবান জনগোষ্ঠী এবং কোম্পানি থেকে আর্জিত হয়, যা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১%। এ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসরত। বেশিরভাগ কোম্পানি পূর্ব পাকিস্তানে তার কর্মকান্ড পরিচালনা করলেও প্রধান কার্যালয় পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ার ফলে সেখানেই কর পরিশোধ করে থাকে। ১৯৬৮-৬৯ সালে সমগ্র পাকিস্তানের কোম্পানি কর বাবদ ২৩.২ কোটি রুপি সংগৃহীত হয়, যার মধ্যে কেবল মাত্র ২.৯৮ কোটি রুপি পূর্ব পাকিস্তান সংগ্রহ করে।

মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের ধন সম্পদের এ আধিক্যই তাঁদের অধিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের প্রধান কারণ।

 

বিক্রয় কর

বিক্রয় করের ২৭% আসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে- যার মধ্যে ৫৪% ই আমদানি সংক্রান্ত। অবশিষ্ট ৪৬% আঞ্চলিক উৎপাদন সংক্রান্ত।পশ্চিম পাকিস্তানের বিক্রয় কর্মকাণ্ড অধিক হবার কারণে বিক্রয় কর এবং আবগারি শুল্ক বাবদ সেখানকার মোট আয় বেশি। পশ্চিম পাকিস্তানের মোট আয়ের সিংহ ভাগই আসে পূর্ব পাকিস্তানের দৈনন্দিন পণ্য সামগ্রীতে ব্যয়ের মাধ্যমে।

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে উভয় প্রদেশের আয়ের ব্যপ্তি তাঁদের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। আবার উভয় প্রদেশের উন্নয়নে অসমতা প্রদেশ দুটির আয়েও অসমতা আনয়ন করে। পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত উন্নতি এবং বর্ধিত আমদানি ও উৎপাদন প্রদেশটির আয় ও স্বচ্ছলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 

<2.130.571>

 

আশা করা যায় যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ তাদের তথাকথিত মুখপাত্র ভুল ও উদ্দেশ্যমূলক মন্তব্য দ্বারা বিভ্রান্ত হবেন না। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অতীত অবিচারগুলোর সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা উভয় প্রদেশের মধ্যকার সৌহার্দ্য বৃদ্ধি করবে এবং অমিমাংসীত সমস্যাবলি সমাধানে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখবে। প্রমাণ বিকৃত করে মানুষ বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা জনগনের মধ্যে মিথ্যা ধারণা সৃষ্টি করবে যার ফলে আজ জাতির উপর এই অবিচার সংঘটিত হচ্ছে এবং এর কুফল হবে চিরস্থায়ী।

Scroll to Top