আমরা তাদের ভাতে মরবো
১অক্টোবর, ১৯৭১
রেলওয়ে হাসপাতালের সামনে দিয়ে জিন্না এভিনু হয়ে ফকিরাপুল আমার গন্তব্যস্থল। রেলওয়ে হাসপাতাল পেরিয়ে শ’দুয়েক ফুট যাওয়ার পরই রাস্তার ডান দিকের টেলিফোন ভবনের স্থানে মেশিনগানের ট্রিগারে হাত দিয়ে শুয়ে থাকা কয়েকজন সৈনিক দৃষ্টিগোচর হবে। জানোয়ারের রুক্ষ হিংস্রতা নিয়ে তারা অদৃশ্য শত্রুর দিকে নিশানা করে রয়েছে। এ ছাড়াও টেলিফোন ভবনের চারদিকে প্রকাশ্য ও গোপন জায়গা থেকে প্রহরারত রয়েছে আরও শ’খানেক সৈনিক। দেহের পা থেকে মাথা পর্যন্ত তারা সশস্ত্র। কিন্তু টেলিফোন ভবনের মূল ফটকে অস্ত্রের সমাবেশ বেশী চোখে পড়বে না। সেখানে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল হাতে কয়েকজন অবাঙালী মোহাজের
রাজাকারকে দেখা যাবে। তাদের চোটপাট দেখার মতো। টেলিফোন ভবনে ঢুকতে প্রত্যেককেই তল্লাশী করা হয়। শার্টের কলার থেকে শুরু করে দেহের বিভিন্ন অংশে নিষ্ঠার সাথে বোমা, অটোমেটিক সমরাস্ত্র, এসিডের বোতল রয়েছে কিনা পরখ করে দেখা হয়। এ টেলিফোন হাউজ তাদের রক্ষা করতেই হবে। কারণ এ ভবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি বিকল হলে পশ্চিমের সাথে পূর্বের তার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। অবশ্য এ ব্যবস্থা বিকল হলে একমাত্র ভরসা থাকবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ওয়্যারলেস সিস্টেম। আমি বাসা থেকে যে রিকশায় উঠেছিলাম তার চালকের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ দাড়ির অর্ধেকেরও বেশীতে সাদা ছাপ লেগেছে। রিকশায় উঠে বসার পরেই হঠাৎ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস কজরলেন, “বলতে পারেন সাহেব, এটা কার দেশ?” আমি তার দিকে চেয়ে রইলাম। রিকশাওয়ালার বললেন, “এটা হারামজাদা বদমাশ পাঞ্জাবীদের দেশ, না মানুষের দেশ?” আমি চারদিকে তাকিয়ে আস্তে কথা বলতে অনুরোধ জানালাম। বুড়োর দু’চোখে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে। বুড়োর কাহিনী হলোঃ পাঁচদিন রিকশা চালিয়ে সঞ্চয় করেছিলেন তের টাকা। একটি ছোট্ট কাপড়ের থলেতে তার জীবনের নিঃশ্বাসের মতো মূল্যবান সঞ্চয়গুলো গোপন করে রেখেছিলেন। মালীবাগের কাছে মোড়ে এক পাঞ্জাবী বর্বর সৈন্যের লোভের লুটেরা হাত তার সে সঞ্চয় কেড়ে নিয়ে গেছে। মনেও দয়া হতো। কিন্তু তার মনে দয়া নেই। আবার রাইফেল উঠানোর পর থলে থেকে আমার সঞ্চয় তাকে দিয়ে দেই। বলতে পারেন সাহেব, আর কতদিন এ ভাবে চলবে? আল্লার গজব পড়বে না। তাদের ওপর! আল্লা আর কত সহ্য করবে? হে খোদা, তাদের ওপর তোমার গজব নাজেল করো।” বুড়ো এরপর থেমে গিয়ে একমনে রিকশা চালাতে শুরু করলেন। এ তো শুধু বুড়োর অভিযোগ নয়। রাস্তা থেকে পথচারীদের হাতের ঘড়ি খুলে নেওয়া, পকেট হাতড়িয়ে টাকা-সিগারেট বের করে নেয়া তো সাধারণ ব্যাপার। একটি দেশের আসতে দেখলেই হাতের ঘড়ি, চোখের গগলস খুলে পকেটে লুকিয়ে রাখা তো সাধারণ ঘটনা। দু-এক টাকার বেশী পকেটে নিয়ে কেউ রাস্তায় বেরোয় না।
টেলিফোন ভবনের সামনে আসার পর দেখলাম একটি কিশোরের দেহ জনৈক রাজকার তল্লাশী করছে। কিছু না পেয়ে পকেট থেকে কলম নিয়ে ক্যাপ খুলে নাকের সামনে তুলে তা পরীক্ষা করে দেখলো। উর্দুভাষী লোকজন এ অপমানজনক তল্লাশী ব্যবস্থা থেকে নেহাই পাচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তো তারাই। তারাই মালিক-মোখতার।
এ টেলিফোন ভবনের অভ্যন্তরে ২৫শে মার্চ রাত বারটায় এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। রাত বারটা বাজার কয়েক মিনিট আগে হিংস্র হায়েনার ক্ষিপ্রতা নিয়ে একদল রক্তলোলুপ এ্যালসেসিয়ান টেলিফোন ভবনের কন্ট্রোল রুমে ঢুকে পড়ে। কন্টোল রুমে কয়েকজন বাঙালীর ডিউটি ছিল। বাইরের হত্যাকাণ্ডের খবর সম্পর্কে তারা কিছুই জানতো না। অন্যান্য দিনের মতোই সেদিন রাতেও তারা ডিউটি করছিলো। আওয়ামী লীগের নির্দেশ মোতাবেক যা করার সে কাজই করছিলো। হাতে সমরাস্ত্র নিয়ে রক্তখেকো কুকুরগুলো সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে তাদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই মনে করে কয়েকজন কর্মী কন্ট্রোল রুমের যন্ত্রপাতি চোখের পলকে যতদুর সম্ভব বিনষ্ট করে দেয়।
এর ফলেই ঢাকা শহরের সব বেসামরিক টেলিফোন ২২ দিনের মতো অকেজো ছিল।
হঠাৎ কি মনে করে গুলিস্তান এলাকায় রিকশা ছেড়ে দেই। দিনের বেলাও চারদিকে থমথমে ভাব। এখানে কয়েকটি পশ্চিম পাকিস্তানী রেডিমেড শার্ট বিক্রির দোকান রয়েছে। দু-একটা দোকান ঘুরে দেখলাম। মালিক মুখে হাত দিয়ে বসে রয়েছে। বিক্রি নেই। একজন দোকানদারের সাথে পরিচয় ছিল। তাই কণ্ঠে সহানুভূতির
রেশ নিয়ে বেচাকেনার খবর জিজ্ঞেস করলাম। উর্দু ভাষা ব্যবহার করলাম। কারন উর্দুভাষী দোকানদারদের সাথে বাঙালীর বাংলা ভাষায় কথা বলাও প্রায় দেশদ্রোহিতার শামিল। কোন অবস্থাতেই অধিকৃত এলাকায় বাঙালীতু প্রকাশ পায় এমন কিছু করা হারাম। প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারে।
‘বেচাকেনা কেমন চলছে’ প্রশ্নের উত্তরে দোকানদার যা বললো তার সারমর্ম হচ্ছে-কোন বাঙালী পাকিস্তানী কাপড় কেনে না, আর অবাঙালীরাও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অর্থ ব্যয় করতে চাচ্ছে না।
এরপর গেলাম বায়তুল মোকাররম ও ষ্টেডিয়ামের একটি শাড়ির দোকানে। দোকানদার বললো, তাঁতের শাড়ি কিছু বিক্রি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী শাড়ি সারা দিনে একটিও বিক্রি হয় কিনা সন্দেহ।
দখলীকৃত এলাকার আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত কোটি কোটি বাঙালী ইয়াহিয়াশাহীর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের এমনি প্রাচীর সৃষ্টি করে চলেছেন। এমনিভাবে কোটি বাঙালী জনতা বাঙালী জাতীয়তাবাদের উদগাতা শেখ মুজিবের সেই ঐতিহাসিক আহবান ‘আমরা তাদের ভাতে মারবো’ বাণীকে বাস্তবায়িত করছেন।
(ইলিয়াস আহমদ ছদ্মনামে সলিমুল্লাহ রচিত)